টোপ

টোপ

তক্তপোশে বসে ক্যাশবাক্সের ওপরে রাখা খেরোর খাতাটায় একমনে হিসেব কষছিলেন নরহরি সামন্ত।

দুপুর প্রায় দেড়টা বাজে। চৈত্র মাস। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি, তাই ভীষণ গরম পড়েছে। নরহরির পরনে হাতাওলা গেঞ্জি ও ধুতি। তার জামাটা টাঙানো রয়েছে দেওয়ালের হুকে।

পাশের ঘরে কল চলার একঘেয়ে ঘটঘট মাথা ভোঁ ভোঁ করানো শব্দটা এখন স্তব্ধ। সামন্ত মিলের সরষে ও গম ভাঙার মেশিন দুটির ছুটি থাকে দুপুর একটা থেকে সাড়ে তিনটে অবধি। ফের চলে রাত সাতটা পর্যন্ত। মিলের কর্মচারীরা প্রায় সবাই গেছে খেতে। খদ্দেরও নেই কেউ। নরহরিও উঠবেন এখন। মেশিনঘর এবং অফিসঘর ভালো করে বন্ধ করে, তালা মেরে

নরহরি সামন্তর বয়স ষাট ছুঁয়েছে। স্থূলকায় কৃষ্ণবর্ণ। মাথায় ছোটো করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল। গলায় হরিনামের মালা। সামন্ত মিলের মালিক তিনি। এ ছাড়া মহাজনী কারবারও করেন। রীতিমতো ধনী লোক। বাইরে অতি ভদ্র বিনয়ের অবতার। তবে হাড়কিপ্টে। সারাক্ষণ চিন্তা কীভাবে দুটো বাড়তি পয়সা করা যায়, ছলে বলে কৌশলে।

দরজার কাছে পায়ের শব্দ।

চশমার ওপর দিয়ে একবার টেরিয়ে দেখে নিয়ে নরহরির চোখ ফের খাতা নামে।

আগন্তুক নেহাতই নগণ্য ব্যক্তি। শ্রীপতি দাস। খুব গরিব। পড়াশুনা শেখেনি বেশি। সামান্য চাষের জমি আছে। বাঁশ ও তালপাতা দিয়ে চাটাই মোড়া ঝুড়ি টোপ ইত্যাদি বানিয়েও কিছু রোজগার করে। ছোটোখাটো রোগা চেহারা। বয়স বছর পঞ্চাশ। অতি নিরীহ ভালোমানুষ। শ্রীপতির গায়ে ময়লা পুরনো শার্ট ও খাটো ধুতি। পা খালি।

মিলের কর্মচারী রঘু বসেছিল টুলে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলল শ্রীপতি, ‘এক কেজি আটা দাও তো।’

—‘ধারে হবে না।’ মুখ না তুলেই গম্ভীর গলায় জানালেন নরহরি।

—‘আজ্ঞে নগদই দেব।’ পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে, যেন অতি অনিচ্ছায় শ্রীপতি সেটি এগিয়ে দেয় সামন্তকে। বুঝি-বা এই তার

আপাতত শেষ সম্বল।

টাকা বেরুতে দেখে রঘু টুল থেকে ওঠে ব্যাজার মুখে। এমন ফালতু খদ্দেরের জন্যে বসে বসে ঝিমুনির সুখটা মাটি হল। সে আটা ওজন করতে যায়।

শ্রীপতি সামন্তমশায়ের সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করতে করতে বলে, ‘উঃ কী রোদ! জল হচ্ছে না মোটে। কী যে হবে?’

—‘হুম।’ মাথা না তুলেই দায়সারা সায় দিলেন সামন্ত।

রঘু এক ঠোঙা আটা এনে দিল শ্রীপতির হাতে।

নরহরি আটার দাম কেটে রেখে বাকি পয়সা ফেরত দেন শ্রীপতিকে। শ্রীপতি কিন্তু গেল না। সে ইতস্তত করে। তারপর বলে ওঠে, ‘আমার কুয়োটা একবার সংস্কার করা দরকার। জল একদম নেমে গেছে। চৈত্রেই এই অবস্থা। বোশেখ-জষ্ঠিতে যে কী হবে? বিশেষ করে খাবার জলটা পাই কোথা?’

নরহরির চোখ খাতার ওপর। তিনি কোনো জবাব দেন না।

শ্রীপতি আপন মনেই বিড়বিড় করে : ‘কুয়োটা মজে গেছে একবারে, সংস্কার হয়নি বহুকাল। বাবা এখানে ঘর করেছেন চল্লিশ বছর। এর মধ্যে হয়নি। তার আগে কবে যে হয়েছে কে জানে?’

নরহরি ভ্রূক্ষেপ করেন না শ্রীপতির কথায়।

শ্রীপতি ব’লে চলে, ‘রায়বাবুরা কুয়োসুদ্ধই জমিটা দান করেছিলেন বাবাকে। বিরাট ইঁদারা। ওর মাটি তোলা কি সোজা কাজ! আমাদের সাধ্যে কুলোয়নি। অ্যাদ্দিন দরকারও হয়নি। ননীদের কুয়ো থেকে পানীয় জলটা আনতাম গরমকালে। তা ননীর ছেলের এখন আপত্তি। ওর বউ আমার বউমা আর নাতিকে দিয়ে হরদম বেগার খাটায়। নাতিটা ইদানীং করতে চায় না। তাই চটেছে। আগে আমাদের কুয়োয় জল থাকত সারা বছর। পাড়া প্রতিবেশীরাও নিত। কিন্তু বছর পাঁচেক হল গ্রীষ্মে জল থাকছে না মোটে। বাসন মাজা, কাপড় কাচা চললেও, ঘোলা জল খাওয়া যায় না। এবার যে কী হবে? পুকুরে না হয় অন্য কাজগুলো সারা যাবে। কিন্তু খাবার জল? ননীর ছেলে বলেছে, নিজেদেরটা ঝালিয়ে নাও। কিন্তু করি কেমনে? খরচ কম?’

নরহরি সশব্দে খাতা বন্ধ করলেন। ভুরু কুঁচকে তাকালেন শ্রীপতির দিকে। ভাবে বোঝালেন যে এবারে তিনি বাড়ি যাবেন। এখন আপদটা বিদেয় হলে বাঁচি।

শ্রীপতি তবু নড়ে না। অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে তড়বড় করে বলে ওঠে, ‘কিছু টাকা ধার দেবেন সামন্তমশাই। কুয়োটা তাহলে ঝালাই।’

—‘ধার!’ নরহরির ভুরু কপালে ওঠে।

—‘আজ্ঞে বেশি নয়। এই শতখানেক টাকা। তাহলে দুটো মজুর লাগাই ইঁদারার মাটি তুলতে। নইলে গ্রীষ্মে তৃষ্ণার জল না পেয়ে ছাতি ফাটবে যে। আমার বাড়ির কাছাকাছি আর যে কুয়ো নেই, ননীরটা ছাড়া। অনেকদূর থেকে আনতে হবে পানীয় জল। বড়ো কষ্ট হবে।’

—‘কেন, নিজে পার না?’ নরহরি স্থির চোখে চেয়ে প্রশ্ন করেন, কৌশলটা মন্দ করেনি। জলের নামে ধার চাওয়া। তারপর যে সেটা কোথায় হবে ঈশ্বর জানেন।

শ্রীপতি বলল, ‘আজ্ঞে চেষ্টা করেছিলুম। জ্বরে ভুগে আমার শরীরটা কাহিল। নাতি ইস্কুলে পড়ে, জোয়ান হয়নি। মাত্র চোদ্দ বছর বয়স। বাড়িতে এই দুজনই মাত্র পুরুষ। কাল ঘণ্টাখানেক মাটি তুলে একেবারে হাঁপ ধরে গেল। আজ সারা গা ব্যথা। নাতিটারও হাত কেটেছে। অনেক কালের পাঁক। এ কাজ আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। দুজন মজুর লাগাই যদি, সঙ্গে আমি আর নাতিটা খাটব, তাহলে খানিকটা পাঁক তোলা যাবে। তাই দয়া করুন।

বাঁকা হাসেন সামন্ত, ‘আগের বার ধার দিয়ে এক বছরের জায়গায় দেড় বছর লাগিয়েছিলি শোধ করতে। মনে আছে?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বড্ড অসুবিধায় পড়েছিলুম। এবার আর হবে না।’ মনে মনে ভাবে শ্রীপতি, বাড়তি সুদ যে গুনতে হয়েছিল তাকে সে কথাটি বেমালুম ভুলে গেলেন সামন্তমশাই।

—‘বন্ধকি কী রাখবে?’-সোজা কাজের কথা পাড়েন সামন্ত।

—‘আজ্ঞে তেমন কিছুই নেই। এক কণাও সোনা নেই বাড়িতে। আমার অসুখ, বউয়ের অসুখে সব গেছে। শুধু কটা থালা বাটি সম্বল। সেগুলি বাঁধা দিলে খাব কিসে? কুমড়ো লাগিয়েছি। জালি এসেছে খুব। ফসল উঠলেই তাই থেকে শোধ করে দেব ধার।’ শ্রীপতি হাত কচলায়।

নরহরি ভাবেন, না বাবা, এত সহজে কথায় ভিজলে হরি সামন্তর ব্যাবসা কবে লাটে উঠত। তিনি নীরবে মাথা নেড়ে হাঁক দিলেন, ‘ওরে রঘু দরজা লাগা।’

বিমর্ষ মুখে ফিরে যায় শ্রীপতি। দরজার কাছে গিয়ে সে থমকে দাঁড়ায়। আবার ফিরে আসে নরহরির সামনে।

আচ্ছা জ্বালালে। নরহরি শ্রীপতির দিকে দৃপাত না করে গায়ে শার্ট গলান। –’আজ্ঞে এই পেতলের চাকতিটায় কী সব নকশা কাটা রয়েছে। কিছু বুঝতে পারেন এটা কী বস্তু?’ শ্রীপতি পকেট থেকে একটা ম্যাড়ম্যাড়ে হলুদ রঙা টাকার সাইজের চাকতি বের করে সামন্তের সামনে ধরে।

একটু অবাক হয়ে নরহরি শ্রীপতির হাতের খোলা তালু থেকে তুলে নেন চাকতিটা। চোখের কাছে পরীক্ষা করতে করতে চমকে ওঠেন। উল্টেপাল্টে দেখেন চাকতিখানা। বুকের ভিতর তার হৃৎপিণ্ডটা তখন লাফাতে শুরু করেছে। আরে এটা যে মনে হচ্ছে মোহর! সোনার মোহর। দু পিঠের লেখাগুলো আরবি কিংবা ফার্সি ভাষায় অনেকদিন আগে একজনের বাড়িতে তিনি নবাবি আমলের মোহর দেখেছিলেন, অবিকল যেন সেই জিনিস। তবে রংটা জেল্লা হারিয়েছে। পেতলই মনে হয় দেখে।

নরহরি ক্যাশবাক্স খুললেন। একটা আতশকাচ বের করে চাকতির গায়ে আঁকিবুকি বা লেখাগুলি পড়তে চেষ্টা করেন। এটা স্রেফ ভান। কারণ তিনি আরবি বা ফার্সি জানেন না মোটেই। যা করলেন, তা হল, ওইরকম দেখার ফাঁকে বাক্সে রাখা একখণ্ড কষ্টিপাথরে লুকিয়ে ঘসে নিলেন চাকতিখানা। সরু সোনালি রেখা পড়ে পাথরের গায়ে।

সোনা! নির্ঘাত সোনার মোহর। নরহরির কলজের ধকধকানিটা আরও প্রবল হয়। বাইরে কিন্তু তিনি নির্বিকার। দীর্ঘ সাধনায় এই কায়দা রপ্ত। ওজনের মারপ্যাচে খদ্দের ঠকাবার সময় অথবা সুদের অঙ্ক বাড়িয়ে অজ্ঞ ঘাতককে ফাঁকি দেবার কালে তিনি এমনি ভাবলেশহীন থাকেন বাইরে। উচ্ছ্বাসহীন মৃদু ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় পেলে এটা?’

—‘আজ্ঞে কাদার মধ্যে। কুয়ো থেকে কাল যে কাদা তুলেছিলাম তার মধ্যে পেয়েছি। কী জিনিস বটে?’

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নরহরি জানালেন, ‘পেতলের চাকতি নকশা কাটা। দেখতে মন্দ নয়। যাত্রার পোশাকে লাগানো ছিল কিংবা কোনো শৌখিন পেতলের জিনিসে।’

তখন নরহরির মগজে খেলছে চিন্তার ঢেউ।

শ্রীপতির বাড়ি যেখানে ঠিক ওর পিছনেই ছিল রায়দের একটা কাছারি বাড়ি। মাটির বাড়ি, তবে শান বাঁধানো মেঝে। রায়বাবুরা ছিল এই অঞ্চলের জমিদার মস্ত ধনী। চারপাশে গোটা এলাকা ছিল রায়দের সম্পত্তি। সেকালের বর্ধিষ্ণু গ্রাম এখন দিনে দিনে শহরের রূপ নিচ্ছে। রায় বংশের অবস্থা কিন্তু পড়ে গেছে। বসতবাড়ি জরাজীর্ণ অট্টালিকাটি এবং কিছু দেবোত্তর জমি ছাড়া জমিদারির কিছুই প্রায় আজ অবশিষ্ট নেই। জমিজমা পুকুর বাগান সব গেছে। খানিক গেছে বিক্রি হয়ে অভাবের তাড়নায়। বাকিটা হাতছাড়া হয়েছে সরকারের জমিদারি বিলোপ আইনের কবলে পড়ে। রায়বাবুরা অনেক জমি দিয়েছেন তাঁদের পুরনো কর্মচারীদের নামমাত্র মূল্যে বা বিনি পয়সায়। শ্রীপতির বাবা এইভাবেই পায় ওই জমি, প্রাচীন কুয়োটি সমেত। রায়বাড়ির নহবতখানায় সানাই বাজাত শ্রীপতির বাপ-ঠাকুর্দা। রায়দের সেই কাছারি বাড়ি আজ ধূলিসাৎ। শুধু বড়ো বড়ো কয়েকখানা ঘরের ভিতের চিহ্নটুকু এখনও দেখা যায়। ওই ইঁদারা লাগত কাছারি বাড়ির ব্যবহারে। এখন শ্রীপতির আশেপাশ আরও কয়েকজন ঘর তুলেছে। সবই কাঁচা বাড়ি। তাদের কেউ কেউ কুয়ো খুঁড়ে নিয়েছে। যারা পারেনি তারা অন্যদের কুয়ো থেকে জল নেয়। অন্তত খাবার জলটা।

বর্ধমান জেলার এই অঞ্চলে বর্গী আক্রমণ হয়েছিল। তাছাড়া ডাকাতের উপদ্রব ছিল ভীষণ। সিপাই বিদ্রোহের সময় একদল সিপাই এসে লুটপাটও চালিয়েছিল রায়দের জমিদারিতে। এমনি কোনো দুর্যোগের সময় নিশ্চয় কেউ আততায়ীর হাত থেকে বাঁচাতে ওই ইঁদারায় ফেলে দেয় সঞ্চিত সোনাদানা। তারপর আর উদ্ধার করতে পারেনি। মারা পড়েছে যে ফেলেছিল। অন্যরা জানত না এ খবর। অথবা যা ফেলেছিল সবটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি পরে। এখনও কিছু রয়ে গেছে কুয়োর কাদায়। ঠিক কী থাকতে পারে? প্রাচীন আমলের সোনার মোহর। রুপোর টাকা। সোনার গিনি। সোনা-রুপোর বাট। সেকালের সব খাঁটি সোনা-রুপোয় তৈরি। ওঃ!!

চাকতিটা দেখতে দেখতে নিরাসক্ত ভাবে নরহরি বললেন, ‘এটা দাও আমাকে। খাসা দেখতে। এতে একটা ফুটো করে আমার ছোটো নাতনিকে পুঁতির হারে লকেট বানিয়ে দেব। খুব খুশি হবে। শ্রীপতি হাতজোড় করে, ‘মাপ করবেন সামন্তমশাই। আমার নাতনিটা ওটা দখল করে বসেছে। পুতুল খেলার টাকা বানিয়েছে। অনেক কষ্টে চেয়ে এনেছি আপনাকে দেখাব বলে। ফিরে না পেলে কেঁদেকেটে একশা করবে।’

—‘বেশ বেশ, পয়সা দিচ্ছি, তোমার নাতনিকে অন্য কোনো খেলনা কিনে দাও।’

‘আজ্ঞে না’ শ্রীপতি অনুনয় করে। ‘বাপ মরা মেয়ে, বড্ড জেদি। যেটার ওপর ঝোঁক ওঠে ছাড়বে না কিছুতেই। ওকে না বলে দিতে পারব না। দেখি বুঝিয়েসুঝিয়ে অন্য খেলনার লোভটোভ দেখিয়ে যদি পাই। নইলে এই সামান্য জিনিসটা দিতে আমার বাধা কী? এটা কী কাজে লাগবে? তবে কিনা নাতনিকে আগে দিই ফেরত। তারপর বলে কয়ে ঠিক আদায় করব। আপনি চাইছেন। আপনার কথা কি ফেলতে পারি? তবে বুঝছেনই আমার অবস্থা?’

—‘এরকম চাকতি আর পাওনি কাদায়?’

—‘আজ্ঞে না। তবে খোঁজাও হয়নি তেমন। হঠাৎ এটা দেখে ফেললাম। ঠেকল হাতে। ওই নোংরা পাঁক ঘাঁটতে ভালো লাগে?’

এ বিষয়ে আর কৌতূহল দেখাতে সাহস হয় না নরহরির। যদি সন্দেহ করে? এত আগ্রহ কেন? অন্যের কাছে নিয়ে যাবে দেখাতে। আরও কিছু প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরছিল। কুয়োর কাদায় ঘটি বা ঘড়া-জাতীয় কিছু মিলেছে কি? কারণ এমনি গিনি সোনার মোহর রত্নপাথর কুয়োতে পুকুরে বা মাটির নীচে লুকিয়ে রাখার রেওয়াজ মুখ-বন্ধ ধাতু পাত্রে। খবরটা জানালে আরও নিশ্চিত হতেন গুপ্তধন সম্পর্কে। কিন্তু পাছে শ্রীপতির সন্দেহ জাগে সেই ভয়ে আর কথা বাড়ালেন না। উদার হাসি ফুটিয়ে বললেন নরহরি, ‘বেশ বেশ চেষ্টা করো, যদি পাও। নাতনিকে বোলো ওকে একটা ভালো খেলনা দেব বদলে। এই না চাকতি।’

—‘নিশ্চয় নিশ্চয়,’ চাকতিটা পকেটে রেখে শ্রীপতি নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেয় একটু অপ্রতিভ ভাবে।

শ্রীপতি চলে যেতে খানিক গুম হয়ে বসে থাকেন সামন্ত। ইস এমন দাঁওটা কি হাতছাড়া হবে? তাঁর উর্বর মস্তিষ্কে চকিতে উদয় হয় একটা মতলব। নাঃ, দেরি করলে ঠকবেন। আজই করা চাই।

পড়ন্ত বিকেল।

নিজের বাড়ির সামনে উঠোনে খাটিয়া পেতে বসে ছিল শ্রীপতি। ছোটো মাটির বাড়ি তাদের। বাড়ির চারপাশে কাঠা পাঁচেক জায়গা। বাড়ির হাল ভালো নয়। চালে খড় চাপানো দরকার। দেয়ালে ফাটল ধরেছে। এককোণে গোয়াল ঘর। একটি দুগ্ধবতী গাভী রয়েছে বটে তবে সে শ্রীপতির মতনই অনাহারে শীর্ণ।

লেপা উঠোন তকতক করছে। বাড়িটির জৌলুস নেই, তবে শ্রীহীন নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অতি প্রাচীন এক তেঁতুল গাছ বাড়ির গায়ে ছাতার মতো হয়ে দাঁড়িয়ে। ইঁদারাটা উঠোনের মাঝে। বাঁধানো উঁচু পাড়ের আস্তরণ খসে পড়েছে। বিরাট গোল মুখ। গভীরও খুব। দেখে বোঝা যায় এ কুয়ো বহুকালের। উঠোনের একধারে ঢিপি করে রাখা অনেকদিন পাঁক মাটি।

শ্রীপতির সংসারে পাঁচটি প্রাণী। শ্রীপতি, শ্রীপতির স্ত্রী, বিধবা পুত্রবধূ ও দুটি নাতি নাতনি। বছর চারেক আগে একমাত্র সন্তান জোয়ান ছেলেটা হঠাৎ মারা যাবার পর শ্রীপতির শরীর মন ভেঙেছে। অভাবে জড়িয়ে পড়ছে। কী করে যে সামলাই? উদাস মনে এইসব ভাবতে ভাবতে সহসা শ্রীপতি দেখে সামন্তমশাই তার উঠোনে ঢুকছেন। সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আজ্ঞে আসুন। বসুন।’ সে খাটিয়াটা দেখিয়ে দেয়।

সামন্ত বসেন না। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বুঝলে শ্রীপতি, পরে ভেবে দেখলেম তোমার সমস্যাটা। হাজার হোক তৃষ্ণার জল। এ বিপদ উদ্ধার করা মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য। দেখি ইঁদারার কী অবস্থা?’

কুয়োর মুখে গিয়ে তিনি উঁকি মারলেন ভিতরে। তারপর পাঁকের ঢিবি দেখিয়ে বললেন, ‘এই কাদা তুলেছ কাল?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

নরহরি কুয়োর কাদা এক খাবলা তুলে ভালো করে দেখেন। তারপর মাটিটুকু ফেলে দিয়ে এসে বসলেন খাটিয়ায়। গভীর ভাবে চিন্তা করছেন কিছু

ভ্যাবাচাকা শ্রীপতি সামনে খাড়া। আশায় নিরাশায় দুলছে তার মন। তার সমস্যা মেটাতে কী উপায় ভাবছেন সামন্ত?

—‘দেখো শ্ৰীপতি,’ গম্ভীর গলায় বললেন নরহরি, ‘তোমায় নগদ ধার আমি দেব না। জানি তোমার অভাবের সংসার। সুদ সমেত ধার শোধ করতে পারবে না হয়তো। বন্ধকি রাখতেও পারছ না। টাকাটা জলে যাবে আমার। আমি ব্যাবসাদার মানুষ। এমন ধারে কারবার করি না।’

—‘আজ্ঞে ঠিক ধার শোধ করে দেব, কথা দিচ্চি’, কাতর আবেদন জানায় শ্ৰীপতি।

—‘বেশ, ধার শোধ না হয় করবে, বিশ্বাস করছি। তখন তৃষ্ণার জল মিললেও দুবেলা আহারের যে টান পড়বে তোমাদের। সেটাও কাজের কথা নয়। আমি অন্য উপায় একটা ভেবেছি।’

—‘আজ্ঞে?’

নরহরি রহস্যময় হেসে বললেন, ‘নগদ ধার তোমায় দেব না বটে, তবে তোমার কুয়োর পাঁক আমি তুলিয়ে দেব নিজের লোক দিয়ে। আর সেই পাঁক আমি নিয়ে যাব সমস্তটা। ধরে নাও ওই পাঁকের বদলে তোমার কুয়ো ঝালাই হয়ে যাবে নিখরচায়, বিনা ধারে।’

শ্রীপতি থ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

আরও বুঝিয়ে বলেন নরহরি, ‘এসব পুরনো ইঁদারা বা পুকুরের পাঁক বড়ো সারবান। জান তো আমার বাগানের শখ। ওই পাঁক মাটি শুকিয়ে নিলে চমৎকার সার হবে। ফল ফুল দু-রকম গাছেরই। হয়তো যা মাটি পাব তার তুলনায় আমার মজুর খরচা একটু বেশিই পড়বে। তা হোক, ব্যাবসায় লাভ লোকসান দুই-ই আছে। তবে বিনা বন্ধকে ধার দিলে আমার ব্যাবসায় নীতি লঙ্ঘন হয়। তার চেয়ে এই ভালো। কী, রাজি আছ আমার প্রস্তাবে? পাঁক কিন্তু যা ওঠাবে পুরোটা চাই। অবশ্য যত বেশি মাটি উঠবে ততই ভালো সাফ হবে কুয়োটা। নয় কি?’ উত্তরের আশায় তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকেন নরহরি।

—‘আজ্ঞে এ তো উত্তম প্রস্তাব,’ শ্রীপতি কৃতার্থ হয়ে বলল, ‘ও কাদা নিয়ে আমি করবটা কী? ওর বদলে যদি কুয়োটা সাফ করে দেন, বড়ো উপকার হয়। যা পাঁক মাটি উঠবে সব আপনি নিয়ে নেবেন।’

টোপ গিলেছে। উল্লাসে নেচে ওঠে নরহরির বুক। তবে বাইরে ভড়ংটা বজায় রেখে আধবোজা চোখে মুখে একটু হাসি টেনে বললেন, ‘আহা, উপকারের কথা তুলছ কেন? এ হচ্ছে ব্যাবসার লেনদেন। তোমার পাঁক আমি কিনব। তবে পয়সার বদলে দেব মজুর খরচা।’

—‘আজ্ঞে একটু চা খাবেন?’ খুশি হয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতে চায় শ্ৰীপতি।

—‘চা? না থাক অসময়ে। হ্যাঁ, সেই চাকতিটা বাগাতে পারলে নাতনির থেকে?

শ্রীপতি খানিক সরে এসে খুব চাপা গলায় বলল, ‘সে এক কাণ্ড করেছি। হারিয়ে ফেলেছি ওটা।’

—‘অ্যা সে কী।’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার ওখান থেকে ফিরে আটটা নাগাদ পুকুরে গেলুম নাইতে। ভাবলেম জামাটা খুব ময়লা হয়েছে, একটু সাবান বুলিয়ে কেচে দিই মনটা খারাপ ছিল। খাবার জলের সমস্যা। ননীর ছেলের কথায় ব্যথা পেয়েছি। সেইসব ভাবতে ভাবতে আনমনে জলে জামা ধুয়েছি। চান করেছি। মনেই নাই যে পকেটে চাকতিটা রেখেছিলাম। বাড়ি ফিরে যখন খেয়াল হল দেখি চাকতি নেই। কত খুঁজলাম পুকুরে ঘাটে রাস্তায়। পেলুম না। কোথায় যে পড়ল? এখনো বলিনি নাতনিকে। জানলে যে কী অনর্থ করবে, দুশ্চিন্তায় আছি। দুপুরে বার দুই চেয়েছে। কোনোরকমে এড়িয়ে গেছি।’

হতভাগা! মনে মনে গর্জে ওঠেন নরহরি। আমাকেও দিল না। নিজের ভোগেও লাগল না। মূর্খটা জানলই না কী সম্পদ ফস্কে গেল। এসব অভাগাদের কপাল ফেরাবে কে?

—‘তোমার নাতনি কই?’ জিজ্ঞেস করেন নরহরি।

—‘ঘরেই আছে। বলেন তো ডাকি। তবে দোহাই, আজ ওই চাকতির কথা তুলবেন না। এখুনি বায়না জুড়ে দেবে। কাল পরশু, রয়ে সয়ে বলব। পছন্দসই কিছু দিয়ে ভোলাতে হবে।’

—‘থাক। ডাকতে হবে না।’ জানালেন নরহরি। মনে ভাবলেন এ ভালোই হল। মোহরটা ঘরে থাকলে ফের কাউকে গিয়ে দেখাত। শ্রীপতি না হয় বোকাসোকা লোক। মোহর কেমন দেখতে ধারণা নেই। ওই বস্তুটি যে আসলে কী কল্পনাও করেনি। আর কেউ দেখলে ঠিক সন্দেহ করবে। যাচাই করবে। তখন কি আর শ্রীপতি তাকে এই কাদা ছুঁতে দিত? নিজেরাই তুলত মোহরের লোভে।

মোহরটা শ্রীপতির ঘরে থাকলে পরে হয়তো কোনোদিন ও টের পেত নরহরির প্যাঁচ। এই নিয়ে হাঙ্গামা হুজ্জত করত। বখরা চাইত। অন্য লোকে ওকে মদত দিত। নরহরির শত্রুর অভাব নেই। দিনে দিনে তার যে ধনসম্পদ বাড়ছে, এ নিয়ে বদলোকের কম হিংসে? তবে অবশ্য ওই কুয়োর গুপ্তধন একবার নরহরির খপ্পরে গেলে কারও সাধ্যি নেই তা ফেরত নেয়। তবু খানিকটা ঝামেলা হত বৈকি। এখন আর কেউ টের পাবে না। নরহরির একান্ত বিশ্বস্ত কয়েকজন ছাড়া। লুকনো সোনাদানার লোভেই যে নরহরি কাদা কিনেছে এ প্রমাণও মিলবে না। নরহরি সামন্ত হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘তবে কালই আমার লোক পাঠিয়ে দেব। উঠি এখন।’

পরদিন সন্ধ্যাবেলা নরহরির পাঠানো চারজন মজুর হাজির হল শ্রীপতির কুয়োর মাটি তুলতে। তারপর শুরু হয়ে গেল দক্ষযজ্ঞ।

কপিকলে ঝোলানো মোটা দড়ি বেয়ে কুয়োর তলায় নেমে গেল দুজন লোক। সঙ্গে নিল কোদাল। দড়ি বেঁধে মস্ত একটা বালতি নামানো হল কুয়োয়। বালতি বালতি ভর্তি করা হচ্ছে কুয়োর পাঁক মাটিতে। অমনি ওপরের লোকেরা হড়হড় করে তা টেনে তুলছে। ঢেলে দিচ্ছে কুয়োর পাশে ভ্যান রিকশায় বসানো পিচের ড্রামে। দুটো ভ্যানে দুটো ড্রাম মজুত। একটা ড্রাম ভর্তি হলেই রিকশাচালক নরহরির বাড়িতে। ফিরে আসছে খালি ড্রাম নিয়ে। ততক্ষণে অন্য ড্রাম ভর্তি হচ্ছে কাদায়। ঘণ্টাখানেক টানা কাজের পর বিশ্রাম নিচ্ছে শ্রমিকরা।

এইভাবে গোটা দিন চলল কাজ। কখনো নরহরি, কখনো বা তাঁর বড়ো ছেলে বলহরি (যাকে লোকে ডাকে হরিবোল। বাপের চেয়েও নাকি সে বেশি পয়সা চেনে) নিজে দাঁড়িয়ে তদারকি করতে থাকে পাঁক তোলা।

কত বিচিত্র জিনিস উঠল কাদার সঙ্গে।

দুটো লোহার কপিকল। অনেক ছোটো বড়ো পিতল কাঁসার থালা বাটি। পাঁচটা নানান সাইজের টিনের বালতি। তিনটে তলোয়ার। বর্শার ফলক দুটো। একটা বন্দুকের নল। নানা সাইজের ছুরি অন্তত ডজন খানেক। ধাতুর জিনিস সবই জংধরা ক্ষয়ে যাওয়া, রং চটা— বহুকাল জলকাদায় থাকার ফলে। মাটি তোলার সময় যা হাতে লেগেছে তাই এসব। এছাড়াও আরও কত কী যে লুকিয়ে আছে ওই বিপুল পরিমাণ পাঁক-মাটির ভিতরে।

একটা মাঝারি আকারের পেতলের ঘড়াও উঠল। তাই দেখেই নেচে ওঠে নরহরির মন। বোধহয় ওই ঘড়াটায় পুরোই মোহর। মুখ খুলে যেতে মোহরগুলি ছড়িয়ে গেছে পাঁকে। ঘড়া পেয়ে গুপ্তধন প্রাপ্তির ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত হলেন নরহরি।

পাড়ার লোক ভিড় করে দেখে এই আদ্যিকালের ইঁদারা সাফাই। দুষ্টু ছেলেরা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দেখতে চায় ওই কাদায়। কী কী আশ্চর্য জিনিস বেরোয়? বকাঝকা করে তাদের তাড়ায় নরহরি ও বলহরি।

শেষ বিকেলে কাজে ক্ষান্তি দিল মজুররা। তখন ইঁদারার পাঁক-মাটি সাফ। তলায় চাপা ঝরনার মুখগুলো খুলে যেতে কলকল করে জল বেরুতে শুরু করেছে। কুয়োর মধ্যে যারা কাজ করছিল শশব্যস্ত হয়ে উঠে এল।

সন্ধ্যার সময় নরহরি যখন দলবলসহ বিদায় নিলেন, তখন শ্রীপতির উঠোনে এক মুঠোও কুয়োর কাদা নেই। শুধু বাতাসে ভাসছে পচা পাঁকের বোঁটকা গন্ধ

শ্রীপতির কুয়োর সমস্ত কাদা রাখা হয়েছিল সামন্ত বাড়ির বাগানের এক কোণে বাঁধানো চাতালে, ঢিবির পর ঢিবি করে।

নরহরি ভাবলেন, দুদিন এখানে শুকোক কাদা, দুর্গন্ধ কমুক, তারপর নিজে এবং দুই ছেলে মিলে খোঁজ করবেন কাদার স্তূপগুলি।

পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ। বাড়ির দাওয়ায় বসে ছিল শ্রীপতি। এমন সময় বছর ত্রিশ বয়সি এক যুবক এল।

যুবকটি লম্বা ছিপছিপে সুশ্রী। গৌরবর্ণ। পরনে পাঞ্জাবি পাজামা, পায়ে চটি। ধারালো চোখে বুদ্ধির ছাপ। মুখে চাপা কৌতুক।

শ্রীপতি উঠে সাগ্রহে আহ্বান জানাল, ‘আরে আনোয়ার ভাই, এসো এসো। তোমার কথাই ভাবছিলেম।’

আনোয়ার হোসেন স্থানীয় স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। শ্রীপতির হাতের কাজ সানাই বাদনের সে ভক্ত। তার নিজের গানবাজনার শখ আছে। ভালো অভিনয়ও করে।

—‘কী কুয়ো সাফাই হল?’ বলতে বলতে আনোয়ার কুয়োর ভিতর ঝুঁকে দেখে।

—‘হয়েছে ভাই। চার-পাঁচ হাত জল উঠেছে। সকালে চুন ফেলেছি। আশা করছি কাল ঘোলা জলটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এবার গ্রীষ্মে আর জলের ভাবনা থাকবে না। ওঃ, আমি এক্কেবারে অবাক হয়ে গেছি। ভাবতেই পারিনি যে সত্যি সত্যি তুমি যা বলেছিলে —

আনোয়ার হেসে বলল, ‘শ্রীপতিদা তুমি বড়ো সরল মানুষ। ওই সমস্ত টাইপের লোকেদের চরিত্র বোঝ না। আন্দাজ করেছিলাম যে টোপটা গাঁথবে। যাক আমার মোহরটি এবার ফেরত দাও। না, হারিয়ে ফেলেছ?’

‘না না, হারাবে কেন? দিচ্ছি।’ শ্রীপতি ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢোকে। একটু বাদেই বেরিয়ে এসে হলুদরঙা সেই চাকতিটা দেয় আনোয়ারের হাতে।

মোহরটা নিয়ে দেখতে দেখতে আনোয়ার বলল, ‘সাধে কি ঠকেছে নরহরি? কাদার ভেতর কদিন রেখে মোহরটার কেমন চেহারা দিয়েছি। এবার সামন্তগুষ্টি পাঁক ঘেঁটে মরুক গুপ্তধনের খোঁজে।’ মোহরটা সে প্যান্টের পকেটে রাখে।

—‘ওই মোহর তুমি পেলে কোথায়?’ শ্রীপতি কৌতূহল চাপতে পারে না। আনোয়ার বলল, ‘এটি আমার বাড়ির জিনিস। পারিবারিক সম্পত্তি নানির থেকে চেয়ে নিয়েছি লুকিয়ে, একজনকে দেখাব বলে। আমার এক পূর্বপুরুষ নবাব দরবারে চাকরি করতেন মুর্শিদাবাদে। তাঁরই অর্জিত ধন। এমনি মোহর আরও কটা আছে। সিন্দুকে। এবার এটা ঘষেমেজে চকচকে করে ফেরত দিতে হবে নানিকে।’

—‘আচ্ছা বুদ্ধি তোমার!’ শ্রীপতি উচ্ছ্বসিত।

–‘তা ওই ঠকবাজ সামন্তকে ধোঁকা দিতে কিঞ্চিৎ বুদ্ধি খরচা করতে হয় বৈকি। আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছিলুম শ্রীপতিদা তোমাকে। তুমি না কেসটা কেঁচিয়ে দাও। অ্যাকটিংটুকু ঠিকমতো পারবে কিনা! তুমি যা ভালো মানুষ।’

—‘হেঁ হেঁ’, সলাজ হাসে শ্রীপতি। ‘এককালে যাত্রায় অ্যাক্টো করেছি যে। সব কি ভুলে গেছি? শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে এখনও পারি। তবে ভাই সামন্তমশায়ের বাজের মতন চাউনির সামনে আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। কেবলই ভয় হচ্ছিল এই বুঝি ধরা পড়ে গেলুম। আর বেশি জেরা করলে হয়তো শেষ রক্ষে হত না।’

—‘আনোয়ার চাচা!’ ছয়-সাত বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে বাড়ি ঢুকেই ডাক দিল। তারপর ছুটে এসে আনোয়ারের হাত ধরে মিষ্টি রিনরিনে গলায় নালিশ জানাল, ‘জান চাচা, দাদু আমায় একটা হলুদ টাকা দিয়েছিল খেলতে। কুয়োর কাদায় পেয়েছিল। তারপর আবার চেয়ে নিয়ে গিয়ে হারিয়ে দিয়েছে।’

‘অ্যা! সত্যি! খুব অন্যায়। দাদুর সঙ্গে তুমি আড়ি করে দাও। আর আমি কাল তোমায় অনেকগুলো টফি এনে দেব। একটাও দিয়ো না দাদুকে।’ মেয়েটির একমাথা রুক্ষ চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে আনোয়ার হেসে বলল, ‘চলি।’

যেতে যেতে সে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘শ্রীপতিদা আমার শর্তটা মনে রেখো। একটা চমৎকার ডিজাইনের পাটি বুনে দিতে হবে। আর সামনের পূর্ণিমায় সানাই শোনাতে হবে আমাদের ছাতে বসে।’

শারদীয় ১৩৯৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *