যেমন ইচ্ছা সাজো

যেমন ইচ্ছা সাজো

এগারো ক্লাসের পানু আর তার ক্লাসের বন্ধুরা সবাই বেজায় ভাবিত। কারণ- ‘ভারতমাতা বিদ্যামন্দির’-এর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উৎসব সমাগত পানু অবশ্য দৌড়ঝাঁপ মোটেই করে না। তবুও এই উৎসবে একটি পুরস্কার তার প্রায় বাঁধা। এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ উপলক্ষে যে ‘Go as you like it’ বা ‘যেমন ইচ্ছা সাজো’ প্রতিযোগিতা হয় তাতে পানু গত দুবছরের চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু এবার তাকে এক বিষম বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর সেই নিয়েই তার আর তার সঙ্গীদের এত ভাবনা।

ব্যাপারটা হল দশ ক্লাসের দীপঙ্কর হঠাৎ কোথা থেকে এক থিয়েটারি মামার আমদানি করেছে। এই মামা নাকি তাকে এমন মেক-আপ দেবে, আর চলন-বলনে এইসা এলেমদার করে দেবে যে পানুকে এবার আর পাত্তা করতে হচ্ছে না। মাতুল-নির্ণীত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায় দীপঙ্কর যত ফুলছে, মাতুলহীন অসহায় পানু আর তার দলবল ততই দমে যাচ্ছে। অনেক ভেবেও পানু একটা উপায় খুঁজে পাচ্ছে না— একটা চমকপ্রদ সাজ, যার সাফল্য নিশ্চিত।

যাকগে, কালের গতি তো আর রোধ করা যায় না। পানুদের দুশ্চিন্তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে নির্ধারিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনও এসে পড়ল। এই অনুষ্ঠানে বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রীহরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে সভাপতিত্ব করতে রাজী করানো হয়েছে।

হেডমাস্টার মশাই-এর বিশেষ অনুরোধে রাজী হয়ে তিনি বললেন— ‘ওইদিন আমায় আর একটা জায়গায় যেতে হবে। তা ওখান থেকে ফিরে এসেই আমি যাব। না না, কারোর নিতে আসার দরকার নেই। হয়তো অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। আমি নিজেই খুব যেতে পারব। ‘ভারতমাতা বিদ্যামন্দির’ তো— খুব চিনি।

হেডমাস্টার মশাই বলে এসেছেন, এই সন্ধ্যা ছটা নাগাদ গেলেই চলবে।

.

প্রতিযোগিতার দিন। সারাদিন ধরে স্কুলের সামনের মাঠে মহোৎসাহে দৌড়ঝাঁপের প্রতিযোগিতা চলছে। ক্রমশ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। প্রতিযোগিতার পাটও শেষ হয়েছে। এবার পুরস্কারের পালা। ইতিমধ্যে সভাপতি মহাশয়ও এসে গেছেন। আবালবৃদ্ধ জনসাধারণ অবাক বিস্ময়ে এই প্রথিতযশা সাহিত্যিককে লক্ষ্য করেছে। শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রু-কেশ, চোখে প্যাসনে আর গলায় এক পাক দিয়ে জড়ানো একটা মটকার চাদর, খবরের কাগজের ছবির কৃপায় এই মূর্তি তাদের বিশেষ পরিচিত। স্বল্পবাক কিন্তু বয়সের তুলনায় সতেজ চলাফেরা। অবশ্য চলাফেরা তিনি করেছেন না, মঞ্চের উপর চেয়ারে বসে মৃদু মৃদু হাসি মুখে সমস্ত কিছু লক্ষ্য করছেন।

মাইকে ঘোষণা করা হল— এবার ‘Go as you like it’ আরম্ভ হবে। দর্শকদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। ভিড়ের মধ্যে এতক্ষণ অনেকগুলি চানাচুরওলা, আইসক্রিমগুলা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ দেখা গেল এদের মধ্যে অনেকেই নকল। মঞ্চের সামনে চানাচুরওয়ালাদের ভিড় জমে গেল

—‘চাই চানাদুর, সল্টেড বাদাম, এক আনা দুআনা। নে—বেন?

—‘চাই আইস… ক্রি…ম, কুলপি-মালাই—

কেউ কেউ আবার সভাপতিকে চানাচুর বেচার চেষ্টা করতে লাগল। সভাপতি এক আনার চীনাবাদাম কিনে ফেললেন, তারপর স্থানীয় জমিদার প্রধান বক্তার বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে দিলেন।

ক্লাস নাইনের তারাপদ পাগল বেশে বেজায় হুল্লোড় লাগিয়ে দিল। অবশ্য ছোটো ছোটো ছেলেগুলো ঢিলটিল ছুড়ে তারাপদকে সত্যি সত্যি ক্ষেপিয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে কসুর করছিল না।

এমন সময়ে বিহারী দারোয়ানবেশী দীপঙ্কর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল। লম্বা-চওড়া দীপঙ্করকে মানিয়েছে খাসা। মাথায় পাগড়ি, গায়ে লাল ফতুয়া, মালকোঁচামারা ধুতি, পায়ে শুঁড়তোলা নাগরা। আর সবচেয়ে দর্শনীয় তার গোঁফ আর গালপাট্টা। ইয়া মোটা আর কালো একজোড়া পাকানো গোঁফ ইঞ্চিখানেক চওড়া গালপাট্টার সঙ্গে কোলাকুলি করছে। কপালে সযত্নে অঙ্কিত এক তিলক, হাতে এক পাঁচহাত তেল-চকচকে বাঁশের লাঠি। সদ্য মুলুক থেকে আসা এক সাক্ষাৎ ভোজপুরী।

সার্থক তার থিয়েটারি মামার তালিম। ইস্কুলের আসল দারোয়ানদের নিষ্প্রভ করে দিয়ে দারোয়ান দীপঙ্কর মসমস করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো। তারপর লাঠি ঠুকে চোস্ত হিন্দিতে কুচোকাচাদের ধমকাতে আরম্ভ করল :

—‘এও বালবাচ্ছালোক, ভিড় মৎ করো! একদম বাহার যাও!’ বলেই, ‘খবরদার’ বলে এমন এক হাঁক পাড়ল যে দুই তিন ক্লাসের ছেলেগুলো তো ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। প্রধান বক্তার ছোটো ছেলেটা বাদাম ফেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।

সবাই দীপঙ্করকে দেখে চমৎকৃত। হেডমাস্টার মশাই খুব খুশি খুশি ভাব করে সভাপতির কাছে বলতে লাগলেন— ‘হোঁ হোঁ কেমন লাগছে? মানে ছেলেপুলেদের ব্যাপার। তা সেজেছে বেশ। কী বলেন?’

সভাপতি মশাই বিষয়টা খুব উপভোগ করছেন বলে মনে হল। এরপর ভোজপুরী যখন তাঁর সামনে এসে ‘রাম রাম বাবুজী’ বলে মস্ত এক সেলাম ঠুকল তখন তার দাড়ি গোঁফের ফাঁকে ফুটে ওঠা হাসি কারুরই চোখ এড়াল না।

দীপঙ্কর এরপর চরম দারোয়ানি দেখাতে আরম্ভ করল। লাাঠি ঠুকে, হিন্দি বাংলা বকুনি ঝেড়ে সে চানাচুরওয়ালাদের ভিড় একদম সাফ করে ফেলল। কেবল পাগল তারাপদর কাছে একটু বেকায়দায় পড়েছিল। তারাপদ থুতুটুতু ছিটিয়ে, চেঁচিয়েমেচিয়ে এমন কাণ্ড করল যে ভোজপুরি ‘আরে শিয়ারাম শিয়ারাম, একদম সত্যনাশ কর দিয়া’ বলে সঙ্গে সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করল। মোট কথা দীপঙ্করের সাফল্যে মাস্টার ছাত্র সবাই মুখরিত হয়ে উঠল।

কিন্তু একাদশ ক্লাসের ছেলেদের মনে সুখ নেই। ছি ছি, পানুটা এমনভাবে ডোবাল! মাঠে এল না পর্যন্ত! বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল, সে দুপুর থেকে বেরিয়ে গেছে। ঘরে তার ছোটোকাকা রেগে আগুন হয়ে বসে আছে। পানু নাকি চটি আর চাদর নিয়ে পালিয়েছে। বাবুর নবাবি করা হচ্ছে, ফিরে এলে এর ফল ছোটোকাকা হাতেনাতে বোঝাবে।

প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এমন সময় মঞ্চের কাছেই একটা গাড়ি এসে থামল। যিনি গাড়ি থেকে নামলেন তাঁকে দেখে তো পুরো জনতা স্তম্ভিত। সভাপতির মূর্তিমান যমজ ভাই! সেই দাড়ি, সেই চুল, সেই চাদর— বুঝিবা ইনি একটু বয়স্ক। মাঠসুদ্ধ লোকের চোখ ছানাবড়া। পাগল তারাপদও তার পাগলামি স্রেফ ভুলে গেল।

যাঁকে নিয়ে এই ব্যাপার তিনি কিন্তু অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে মঞ্চের দিকে এগিয়ে এসে হেডমাস্টার মশাইকে বললেন— ‘দেখুন ঠিক সময়ে এসে পড়েছি। তা আপনাদের প্রতিযোগিতা সব শেষ তো? বেশ বেশ।’

হেডমাস্টার মশাই খানিকক্ষণ হাঁ করে দ্বিতীয় সভাপতির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপরেই চমকে মঞ্চাসীন প্রথম সভাপতির দিকে তাকালেন।

ততক্ষণে প্রথম জন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন। ক্রমাগত হাত কচলাতে কচলাতে বলতে লাগলেন— ‘স্যার স্যার আমি পানু। সভাপতি সেজেছিলাম। মানে Go as you like it-এর জন্যে…

ব্যাপারটা অনুধাবন করেই ভয়ানক চটে গিয়ে হেডমাস্টার মশাই ঘটনাস্থলেই পানুকে উত্তমমধ্যম দেবেন কি না স্থির করছেন, এমন সময় আসল সভাপতি সাহিত্যিক মশাইয়ের চোখ পানুর ওপর পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ তিনি স্রেফ ভ্যাবাচাকা মেরে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাঁর জীবন্ত প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপরেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন।

ক্রমশ হেডমাস্টার মশাই, হেডপণ্ডিত মশাই, প্রধান বক্তা, ছাত্ররা, চানাচুরওলারা, পাগল সবাই হি হি হো হো করে অট্টহাসি জুড়ে দিল। কেবল ভোজপুরি দীপঙ্কর এই রসিকতায় যোগদান করল না।

খানিক পরে হাসির বেগে পানুর বিপদের মুখ কেটে যাওয়ার পর হেডমাস্টার মশাই হুকুম করলেন— ‘ওহে, মঞ্চের নীচে আমাদের পুরোনো সভাপতিকে একখানা চেয়ার দেওয়া হোক!’

সভার কাজ আরম্ভ হয়েছে এমন সময় হেডমাস্টার মশাই হঠাৎ সভাপতি সাহিত্যিককে জিজ্ঞেস করলেন— ‘আচ্ছা, আপনি সাতটার সময় এসে ঠিক সময়ে এসেছি বললেন কেন? আমার মনে হচ্ছে আপনি যেন ছটায় আসবেন বলেছিলেন।’

পানুই তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়ে উঠল— ‘স্যার, অপরাধ নেবেন না। আমিই ওনাকে পরে গিয়ে বলেছিলাম যে আপনি সাতটায় আসতে বলেছেন। ভেবেছিলাম ওই সময়টুকু আমিই সভাপতির হয়ে কাজ চালিয়ে দেব।’

হেডস্যার আর একবার পানুকে উত্তমমধ্যম দেবার কথা চিন্তা করতে গিয়ে তার দাড়ির দিকে চেয়েই হেসে ফেললেন আর আড়চোখে আসল জনের দাড়ির সঙ্গে একবার মিলিয়ে নিলেন।

সে বছরও যে পানুই ‘যেমন ইচ্ছা সাজো’র প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল তা আর বলাই বাহুল্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *