কার অধিকারে?
বাস চলছিল গড়িয়ে গড়িয়ে, থেমে থেমে। চৌমাথা থেকে বাজার অবধি পথে বেজায় ভিড়। তাছাড়া প্যাসেঞ্জারও ওঠেনি তেমন; অনেক সিট খালি। হয়তো আরও লোক তোলার আশায় বাস আস্তে আস্তে ধরছিল। কন্ডাক্টার ক্রমাগত চিৎকার করছে— ‘দুর্গাপুর, ইলেমবাজার, পানাগড়, দুর্গাপুর— চলে আসুন।’
আমি বসেছিলাম ড্রাইভারের ঠিক পিছনে, চকচকে পিতলের রডগুলোর গায়ে কোণের সিটটায়। ওখান থেকে ড্রাইভারের হাবভাব বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। ড্রাইভারের বাঁপাশের সিটে একজন মাত্র যাত্রী। তার পায়ের কাছে মস্ত উঁচু এক লুঙ্গির গাঁটরি। লোকটি বৃদ্ধ। পরনে ধুতি ও শার্ট, নাকের ডগায় গোল ফ্রেম চশমা, রোগা চেহারা, মাথায় কদমছাঁট পাকা চুল। সে বাসের ঝাঁকুনির তালে তালে টলটলায়মান লুঙ্গির মনুমেন্টটিকে কোনোরকমে আঁকড়ে ধরে সামলাচ্ছিল।
ঘন ঘন থামছে গাড়ি, আবার বিনা নোটিশে গোঁত্তা মেরে এগোচ্ছে। ফলে লোকটি গাঁটরি সামলাতে কিঞ্চিৎ বেগ পাচ্ছিল বোধহয়। হঠাৎ সে বলল— ‘বাজারের পথটা পেরোতে আর কতক্ষণ লাগবে হে?’
সঙ্গে সঙ্গে— ঘ্যাঁচ! ব্রেক কষল বাস। যুবক ড্রাইভার আধখাওয়া বিড়িটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গাঁটরির মালিকের মুখোমুখি ঘুরে বসে কড়া গলায় বলল— ‘কী মশাই, ভদ্রতা জানেন না? আমায় ‘হে’ বললেন যে, অ্যাঁ! কোন অধিকারে? কী রাইট আপনার?’
আচমকা ড্রাইভারের এই রুদ্রমূর্তি দেখে লোকটি থতমত হয়ে গেল। কাঁচুমাচুভাবে ক্ষীণ হেসে বলল, ‘এঁহে, তা অধিকার একটু আছে তো—’
ড্রাইভারের তর্জনে বৃদ্ধের বাকি কথা আর শেষই হল না।
—‘বটে? আবার অধিকার ফলানো হচ্ছে? বলতে চান বয়সে বড়ো? তবে আর কি, এক্কেবারে মাথা কিনে নিয়েছেন। যা খুশি তাই বলা যাবে।’
—‘না, মানে আমি—’ বৃদ্ধ মিনমিন করে কী বলতে যেতেই এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিল ড্রাইভার।
—‘থাক থাক আর ন্যাকা সাজবেন না। হে-টে আবার কোনদিশি ডাক? যত্তসব অভদ্র। আমাদের বুঝি প্রেস্টিজ-টেস্টিজ নেই? বলি, কোট-প্যান্ট পরা বাবু হলে এমন হে-টে বেরুত মুখ দিয়ে?’ তার গজর গজর আর থামে না। বেচারা বৃদ্ধ ঘাবড়ে গিয়ে চুপ। সে বিমর্যভাবে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম, ড্রাইভারটির আত্মসম্মান খুব প্রখর এবং হে সম্বোধনে বিশেষ আপত্তি আছে।
ড্রাইভারের বকুনি অবশ্য বেশিক্ষণ চলার সুযোগ হল না। অন্য যাত্ৰী হৈ হৈ করে উঠল— ‘ও দাদা, এবার স্টার্ট দিন, লেট হয়ে যাচ্ছে। চলতে চলতে লেকচার হোক’… ইত্যাদি।
তাড়া খেয়ে বাস ছাড়ল। বার কয়েক নিজের মনে বকবক করে ড্রাইভার অ্যাকসিডেন্ট বাঁচাতে মন দিল।
জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছি। দুপাশে উদার মাঠ, দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত। গোছা গোছা হলুদ শীষভরা ধানগাছের ডগাগুলো হাওয়ায় ঢেউ খেলছে। মাঝে মাঝে আলের পথ বেয়ে হন হন করে চলেছে কর্তা, তার ঘাড়ে রংচঙে টিনের বাক্স। চার-পাঁচ হাত পিছনে চলেছে ঘোমটা ঢাকা স্ত্রী; কাঁখে ছেলে। অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে, আবার দৌড়ে গিয়ে ধরছে স্বামীকে। মাথায় তরিতরকারি নিয়ে যাচ্ছে হাটুরে। রাখাল ছেলেরা দূর থেকে মুখ ভেঙাচ্ছে বাসের প্যাসেঞ্জারদের। রাস্তার ধারে বড়ো ছোটো পুকুর। ঘাটে কাপড় কাচছে বউ-ঝিরা। ছোটো ছেলেরা সাঁতার কাটছে আর তোলপাড় করছে জল। কোথাও জলের ধারে ছিপ হাতে ধ্যানমগ্ন একটি লোক, অন্য পারে একই ভঙ্গিতে এক বক। কখনো সাঁ করে উড়ে যাচ্ছে লম্বা লেজওলা ফিঙে। দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ড্রাইভার ও গাঁটরির মালিক সেই বৃদ্ধের মধ্যে নীচুস্বরে কী জানি কথাবার্তা হচ্ছে।
অবাক হয়ে দেখি, প্রায়ই বাস থামলে ড্রাইভার নিজে থেকেই ঘাড় বাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধের দিকে। চাপা স্বরে কথা হয়। বৃদ্ধের কথায় ড্রাইভার ঘনঘন মাথা দোলায়, হাসে। বাঃ, ড্রাইভারের রাগ দেখছি পড়ে গেছে। বোধহয় বৃদ্ধের ওপর একটু বেশি মেজাজ দেখানো হয়ে গেছে ভেবে সে এখন লজ্জিত। তাই আলাপ-টালাপ করে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়।
এক স্টপেজে ড্রাইভারের কোনো চেনা লোক তাকে একটি সিগারেট অফার করল। দেখলাম, ড্রাইভার একটু বিব্রতভাবে চোখ টিপে তাকে ইশারা করল— না। ফের সে বৃদ্ধের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল।
এমনি চলল পানাগড় অবধি।
পানাগড়ে বাস থামতে বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াল, নামবে বলে। পাশের দরজা খুলে তড়াক করে লাফিয়ে নামল ড্রাইভার। ছুটে গিয়ে হাজির হল বাসের সিঁড়ির মুখে। নিজেই টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনল লুঙ্গির গাঁটরি।— ‘রিকশা, অ্যাই রিকশা!’ হাঁক পাড়ল সজোরে। বাসের ছোকরা হেলপারকে ডাক দিল— ‘ওরে কেষ্টা, রিকশায় তুলে দে মালটা।’ তারপর সে একছুটে ঢুকল সামনের মিষ্টির দোকানে।
বৃদ্ধ ও মাল সাইকেল-রিকশায় উঠল। হন্তদন্ত হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল ড্রাইভার। হাতে একটা হাঁড়ি, খুব সম্ভব মিষ্টি আছে তাতে। বৃদ্ধের কোলে গুঁজে দিল হাঁড়িটা। টুকরো টুকরো কথা এল কানে— ‘বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্যে। না না, তাতে কী, এই সামান্য’– হাত কচলাতে কচলাতে সে টুক করে একটা পেন্নামও ঠুকে দিল বৃদ্ধকে।
রীতিমতো আশ্চর্য হলাম। ড্রাইভারটির রাগ ও প্রায়শ্চিত্ত দুই-ই দেখছি বাড়াবাড়ি ধরনের। রিকশা ছেড়ে দিতে ও ফিরে এল। মাথা নেড়ে সমানে বিড়বিড় করছে : ‘আরে ছি ছি। আরে ছি ছি— কী কাণ্ড!’
বেজায় কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম— ‘কী ব্যাপার মশাই?’
সে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর বলবেন না স্যার, কেলেঙ্কারি!!’
—‘কেন? কে উনি?’
ড্রাইভার চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘মামাশ্বশুর!’
বললাম, ‘সে কী, মামাশ্বশুরকে চিনতে পারেন নি।’
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘কী করে চিনব বলুন, একটিবার মাত্র দেখেছি। সেই বিয়ের সময়। বছর খানেক আগে ওই হট্টগোলের মাঝে কত রকমের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, সবাইকে কি মনে আছে ছাই। হঠাৎ সন্দেহ হল কেমন চেনা-চেনা ঠেকছে। আর কী সব বলছিল, অধিকার টধিকার আছে, ভাবলাম একটু খোঁজ নিই তো। ব্যাস, বেরিয়ে গেল— কুটুম্ব। একেবারে সাক্ষাৎ গুরুজন। পানাগড়ে কাপড়ের দোকান আছে! বউ ছেলেবেলায় কয়েকবার এসেছে এনাদের বাড়ি। ইস, বউয়ের কানে যদি ঘটনাটা যায়?’
ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ড্রাইভার বলল- ‘ওনার ব্যাভারটাও কিন্তু উচিত হয়নি, যাই বলুন। উঠেই পরিচয় দে, না ঘাপটি মেরে মজা দেখছেন। বললেন, বাবাজী আমায় চিনতে পার কিনা পরখ করছিলুম।’
আমার দিকে কাতর চোখে চেয়ে সে বলল— ‘এক কেজি স্পেশাল রাজভোগ দিলাম। পড়বে না রাগটা? বউয়ের কাছে আর বোধহয় কথাটা তুলবেন না। কী বলেন দাদা?’
আমি ভরসা দিলাম, ‘কিছু ঘাবড়াবেন না। আমার তো মনে হল উনি মোটেই চটেননি। বেশ হেসে কথা-টথা বলছিলেন দেখলাম।’
—‘ও ড্রাইভার দাদা। ছাড়ুন ছাড়ুন। লেট হয়ে যাচ্ছে—’ বাসের যাত্রীরা চিৎকার শুরু করল। কন্ডাক্টারও ঘন্টি মারছে ঘনঘন। ড্রাইভার আমার কাছে আরও একটু সান্ত্বনা পাবার আশায় ছিল। তাড়া খেয়ে মহা বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে ঘ্যাঁচ করে একসেলারেটার চাপল। ঝাঁকুনি খেয়ে এগোল বাস।
১৩৮৭