মিত্র হোটেল
কাটোয়া স্টেশনের খুব কাছে মিত্র হোটেল। চাকুরি সূত্রে আমার কাটোয়া
গমন। কাটোয়া থেকে এদিক-সেদিক ট্রেনে গিয়ে কিছু কাজ করতে হবে আট-দশ দিন। তাই সাইকেল রিকশাওলাকে বলেছিলুম যে হোটেলটা স্টেশনের যত কাছে হয় ততই ভালো। যাতে দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরতে পারি, আর চলনসই গোছের হলেই চলবে। রিকশাওয়ালা মিত্র হোটেলে হাজির করে।
দোতলা বাড়ি। দোতলায় মস্ত সাইনবোর্ড টাঙানো— মিত্র হোটেল। গোটা দোতলা জুড়ে হোটেল। সারি সারি ঘর সাত-আটখানা, সামনে রেলিং দেওয়া টানা বারান্দা। নীচের তলায় চা মিষ্টি তেলেভাজা ও লটকনের দোকান।
মিত্রমশাই ছোটোখাটো রোগা মানুষ। গায়ের রং তামাটে। ঝুনো নারকেলের মতন মুখখানি। মাথায় পাতলা চুল। কপাল ঘেঁষে টাক শুরু হয়েছে। পরনে হাতাওলা গেঞ্জি, খাটো ধুতি, রবারের চপ্পল। পরে অবিশ্যি বুঝেছিলাম যে এটা মিত্তিরবাবুর সর্বক্ষণের ড্রেস। কথায় কথায় তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমার মশাই সম্বল চারখানা হাতাওলা গেঞ্জি আর দুজোড়া ধুতি। এতেই চলে যায় হোটেল বাজার। আর একখানা শার্ট আছে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যেতে, দূরে কোথাও ভদ্রতা রক্ষা করতে যেতে ওটা চাপাই।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে হোটেলের অফিস ঘর। মিত্রমশাই নেড়া তক্তাপোশে বসে, পাশে ক্যাশবাক্স, সামনে একটা টেবিল ঘিরে তিনটে চেয়ার। বসলাম চেয়ারে এবং হোটেলে থাকার ইচ্ছেটা জানালাম। শান্তিনিকেতন থেকে আসছি শুনে মিত্রমশাই চোখ পিটপিট করে খুশি খুশি ভাবে ঘাড় দুলিয়ে বললেন, ‘বেশ। সিট আছে, পাবেন।’
—‘বড্ড গরম। ফ্যান আছে ঘরে?’ জিজ্ঞেস করি।
—‘আছে ফ্যানওলা ঘর,’ জানালেন মিত্রমশাই, ‘ডেইলি আট আনা একস্ট্রা ভাড়া লাগবে কিন্তু।’
—‘দেব।’ আমি রাজি।
রেট ঠিক হল, সিটের ভাড়া প্রতিদিন দু টাকা আর ফ্যানের জন্য বাড়তি আট আনা। মোট আড়াই। খাবার চার্জ আলাদা। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, মিত্র হোটেলে একটি মাত্র ঘরে ফ্যানের হাওয়া খাওয়ার বিলাসিতার বন্দোবস্ত রয়েছে।
ঘর পছন্দ হল। দিব্যি খোলামেলা, উত্তর-দক্ষিণে জানালা। ঘরের চারকোণে চারটে সিট অর্থাৎ তক্তপোশ পাতা। একটার ওপর গোটানো বিছানা, অন্য তিনটি খালি। বিছানাওলা তক্তাপোশটি দেখিয়ে মিত্র বললেন, ‘ওটা এক ট্যাক্স অফিসারের সিট। এখন ট্যুরে গেছেন। চমৎকার মানুষ।’
এক নজরে দেখে নিলাম, হুঁ, মাথার ওপর একটা সিলিং ফ্যান ঝুলছে বটে। সুইচ টিপে ফ্যানটাকে এবার ঘোরালাম। মৃদু ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুললেও সে খুব-একটা কাতরাল না।
ইনকাম ট্যাক্স অফিসার সামন্ত মশায়ের দেখা পেয়েছিলাম পরদিন। বয়স বছর পঞ্চাশেক। শ্যামবর্ণ দশাসই গম্ভীর দর্শন। ওই শুষ্ক কঠোর আবরণের তলায় একটি রসিক চিত্তের নাগাল সহজে মেলে না। আমায় দুদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে, খবরাখবর নিয়ে তারপর সামন্তদা খোলস ছেড়েছিলেন। মিত্রমশাই সামন্তদাকে যমের মতো ভয় করতেন। প্রধান কারণ ট্যাক্স আতঙ্ক। চটে গেলে যদি বিরাট ট্যাক্স চাপিয়ে দেয়, ব্যাবসা লাটে উঠবে। তাই সামন্তদার জন্য বরাদ্দ ছিল স্পেশাল মিল, অন্য বোর্ডারদের একই চার্জে। যদিও মিত্রমশাই বাইরে বলতেন যে মি. সামন্ত নাকি স্পেশাল চার্জ দেন, তাই। সামন্তদা শুনে মুচকি হাসতেন। আমার ওপর সামন্তদার নেকনজর পড়েছে জেনে আমার ভাগ্যেও কখনো কখনো জুটত আধা স্পেশাল মেনু। যেমন, ডাল তরকারির সঙ্গে একটা একস্ট্রা এক পিস বেগুনভাজা বা মাছের মুড়োর অংশ, বিশেষত যেদিন সামন্তদা সঙ্গে খেতে বসতেন।
সামন্তদার জ্বর হল। মিত্রমশাই শশব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডাকতে গেলেন। অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার। সামন্তদা আমায় ডাক্তারটির নাম শুনিয়ে রাখলেন- ‘ডক্টর বুচার।’ অর্থাৎ জল্লাদ ডাক্তার। বলাবাহুল্য নামটি তাঁর নিজের দেওয়া। ডাক্তারটি মিত্রমশায়ের ফেভারিট কারণ নাকি মিত্রমশায়ের শ্বশুর অক্কা পেয়েছে— এই ডাক্তারের হাতে এবং এর ফলে মিত্রর স্ত্রী দু বিঘে ধানজমি পায় বাপের সম্পত্তির ভাগ হিসেবে। সেই জমি বেচা টাকাতেই এই হোটেলের পত্তন।
—‘এর চাইতে ভালো কোনো ডাক্তার ডাকতে বলুন,’ আমি সন্ত্রস্ত হয়ে জানাই।
‘দরকার নেই। ডিগ্রি আছে। ওতেই হবে।’ সামন্ত নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকেন। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো, হাতে ব্যাগ, ঝলঝলে প্যান্টশার্ট পরা ভীষণ গম্ভীর মুখে ঢেঙা কালো প্রৌঢ় ডাক্তারবাবুটি এলেন মিত্রমশায়ের পিছু পিছু। তিনি সামন্তদার বুকে পিঠে স্টেথো লাগিয়ে অনেকক্ষণ পরীক্ষা করলেন। থার্মোমিটার লাগিয়ে টেম্পারেচার নিলেন এবং ১০০ ডিগ্রি জ্বরেই খুব চিন্তিত ভাবে মাথা ঝাঁকালেন।
সামন্তদা অতি সুবোধের মতন শুয়েছিলেন। একফাঁকে আমায় তেরচা চোখে দৃষ্টি হেনে মিনমিনে কণ্ঠে বললেন, ‘ডক্টর বু, ইয়ে মানে ডাক্তারবাবু, কেমন বুঝছেন, সিরিয়াস কিছু?
—‘নাঃ নার্ভাস হবার কিছু নেই,’ ডাক্তার আশ্বাস দেন, ‘প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছি, মিত্রমশাই আমায় রেগুলার খবর দেবেন কন্ডিশন জানিয়ে, প্রয়োজন হলেই আসব।’
—‘বেশ। আপনার প্যাড আছে?’ সামন্তদা বললেন।
—‘আছে।’ জানাল ডাক্তার।
—‘অসুখের নামটা লিখে দেবেন প্রেসক্রিপশনে,’ অনুরোধ করেন। ডাক্তারবাবু ভেবেচিন্তে প্রেসক্রিপশন লিখে পাঁচটি টাকা ভিজিট পকেটে পুরে বিদায় নিলেন। মিত্রমশাই তাঁর সঙ্গে গেলেন।
ডাক্তার চলে যাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে সামন্তদা উঠে বাক্স বিছানা গুছোতে শুরু করলেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘একী!’
সামন্তদা মুচকি হেসে বললেন, ‘বাড়ি যাচ্ছি গ্রামে। খেপেছ? এই ডাক্তারের ওষুধ খাব? প্রেসক্রিপশন কাটালাম আপিসে ছুটির জন্যে দরকার হবে বলে। গাঁয়ে কবরেজমশায়ের দু পুরিয়া ওষুধ খেলেই চাঙা হয়ে উঠব।’
‘দিন স্যার প্রেসক্রিপশানটা, ওষুধ নিয়ে আসি,’ বলে ঘরে ঢুকে ব্যাপার দেখে মিত্রমশাই থ। সামন্তদা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘একটা রিকশা ডাকুন। দেশে গিয়ে ওষুধ কিনব। ওষুধে কী হবে? এখানে আমার সেবা করবে কে?’
‘গুডবাই’ করে সামন্তদা চলে গেলেন। আমি থাকতে থাকতে তিনি ফিরে আসেননি। তবে তাঁর সিট রাখা ছিল যথারীতি। ও-খাটে আর কাউকে জায়গা দিতে সাহস হয়নি মিত্রমশায়ের। যদি হঠাৎ এসে পড়েন ট্যাক্স অফিসার।
এক সন্ধ্যায় কাজ সেরে ফিরে দেখি আমার ঘরে দুই খালি তক্তাপোশের একটিতে বিছানা পেতে বসে আছেন গোলগাল ফর্সা চেহারা, লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরা বছর চল্লিশের এক ভদ্রলোক। তাঁর খাটের পাশে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা বড়ো পিচবোর্ডের বাক্স। আমি হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় আধশোয়া হতেই নতুন আগন্তুক যেচে আলাপ করলেন। নাম তাঁর বারিদবরণ বারিক। এক গ্লাস কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। অর্থাৎ ঘুরে ঘুরে আয়না বিক্রি করেন। ঠিক নিজে হাতে বিক্রি নয়, দোকানে দোকানে গিয়ে বিভিন্ন আয়নার স্যাম্পল দেখান, অর্ডার নেন। পরে কোম্পানি মাল পাঠায় অন্য লোক মারফত, গাড়িতে। কোম্পানির পাওনা টাকা আদায়ও করেন বারিদবাবু।
বারিদবাবু গোপ্পে লোক। গল্প জুড়লেন, নানান দেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা। আমায় চা খাওয়ালেন। এখানে এলে তিনি নাকি মিত্র হোটেলেই ওঠেন এবং এই ঘরটিতে সিট চাই গরমকালে। আজ সারাদিন কাটোয়া শহরে চক্কর দিয়েছেন। পরদিন ভোরে বারিদবাবু মালপত্র সমেত বিদায় নিলেন। যাবেন কালনায়। পরশু হয়তো ফিরবেন এইপথে।
সেদিন আমার বেরুবার প্রোগ্রাম ছিল না। ঘরে বসেই কিছু কাজ করব। বেলা এগারোটা নাগাদ হোটেলের বেয়ারা জগুর সঙ্গে এক ভদ্রলোকের প্রবেশ ঘটল রুমে। ভদ্রলোক দৈর্ঘ্যে প্রস্থে মাঝারি, ময়লা রং, টিয়াপাখির মতন লম্বা নাক। নাকের নীচে এক চিলতে বাটারফ্লাই গোঁফ। পরনে ফুলপ্যান্ট, ফুলহাতা শার্ট, বুটজুতো। মাঝবয়সি। আমায় এক নজর দেখে তিনি হাতের পেটমোটা চামড়ার ব্যাগটা রাখলেন একটা শূন্য তক্তাপোশে। জগুর মাথায় একটা হোল্ডল এবং হাতে একটা বড়ো চটের থলে। হোল্ডল ও থলে সেই খাটে রেখে চলে গেল।
আগন্তুক ঝটপট বিছানা পেতে ফেললেন। তক্তাপোশে তারপর একটু খুটখাট করে বেরিয়ে গেলেন। আধঘণ্টাটাক বাদে ফিরে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আমায় খানিক নিরীক্ষণ করে কিঞ্চিৎ ভাঙা গলায় হাসি হাসি মুখে হাতজোড় করে বললেন— ‘নমস্কার।’ অর্থাৎ আলাপ করতে চাই।
অগত্যা আমিও প্রতিনমস্কার করলাম। কাজের খাতাপত্র গুছিয়ে সরিয়ে রাখলাম। ভদ্রলোক প্রথমে আমার পরিচয় নিয়েই নিজের পরিচয় জানালেন। ইনিও একজন সেলসম্যান। কোনো এক কোম্পানির লজেন্স টফি ইত্যাদির গুণাগুণ প্রচার করেন, দোকানে দোকানে স্যাম্পল দেন, অর্ডার নেন এবং কোম্পানির হয়ে টাকাকড়ি আদায় করেন। ভদ্রলোক হুড়হুড় করে কথা বলেন এবং একটি মুদ্রাদোষ— খানিকবাদে বাদেই বললেন, ‘বুঝলেন কিনা।’ নাম- সত্যচরণ কুণ্ডু। নিবাস— বহরমপুর।
যা হোক লোকটি বেশ আমুদে। কথায় কথায় আমি বলে ফেললাম, ‘গতকাল মি. বারিক এসেছিলেন। মানে বারিদবরণ বারিক। উনিও আপনার লাইনে। গ্লাস কোম্পানিতে আছেন।’
—‘বুঝেছি, আরশি বারিক।’ সত্যচরণের ভুরু কুঁচকোয়, ‘তা ও কী বলল?’
-–‘না না কিছু বলেননি,’ আমি জানাই, ‘বেশ লোক। অনেক গল্পগুজব হল। কুড়িটা টাকা ভাঙিয়ে নিলাম ওঁর থেকে।’
—‘আপনার ভাঙানি লাগবে? কত?’ বলতে বলতে সত্য কুণ্ডু জামা তুলে কোমরে গিঁট দিয়ে জড়ানো লম্বা গেঁজে টাইপের একটা থলি বের করে বার দুই ঝাঁকুনি দিতেই বিছানার ওপর খুচরো পয়সা ও নোটের একটি ছোটো ঢিবি হয়ে গেল।
—‘বলুন বিশ পঞ্চাশ কত টাকার ভাঙানি চাই? খুচরো পয়সা, নোট যা খুশি,’ সত্য কুণ্ডুর ঘোষণা
আমি ব্যস্ত হয়ে বলি, ‘না না অত লাগবে না, এই গোটা পাঁচেক টাকার পঁচিশ আর পঞ্চাশ পয়সা পেলেই খুব উপকার হয়। যা খুচরোর আকাল। আর পাঁচ টাকার এক টাকার নোট।’
কুণ্ডু মশাই ভাঙানি দিলেন। অতঃপর তাঁর চামড়ার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো টফি বের করে আমার কোলে ফেলে দিয়ে বললেন— ‘খান।’
—‘আরে আরে এতগুলো কেন?’ আমি সন্ত্ৰস্ত।
—‘খান খান,’ কুণ্ডু উদার, ‘আমাদের কোম্পানির প্রোডাক্ট। টেস্ট করুন। ফ্রি স্যাম্পল।’
একটি টফি মোড়ক ছাড়িয়ে মুখে দিয়ে বাকিগুলি ফেরত দিলাম। কুণ্ডু নিতে চান না। বললেন, ‘বাড়ির জন্যে নিয়ে যান।’
—‘আজ্ঞে বাড়ি ফিরতে আমার এখনও দেরি আছে’, আমি আপত্তি জানাই। পরদিন সকালে নীচের তলায় দোকানে গিয়ে টিফিন খেয়ে এসে দেখি কুণ্ডুমশায় উধাও হয়েছেন। সেইদিন সন্ধ্যায় ফের বারিদবরণ বারিকের আবির্ভাব হল মিত্র হোটেলে।
কথায় কথায় বারিদবরণকে জানালাম যে সত্যচরণ কুণ্ডু এসেছিলেন।
—‘ও লবেঞ্চুস কুণ্ডু।’ বারিকের কণ্ঠে তাচ্ছিল্য।
—‘হ্যাঁ বেশ চালাক। আমায় কিছু খুচরো করে দিলেন পঁচিশ আর পঞ্চাশ পয়সায়। এক টাকার নোটও দিলেন কিছু। আবার স্যাম্পল টফি খাওয়ালেন ফ্রিতে।’
বারিদবাবুর মুখখানা পাকা বেলের মতন টকটকে হয়ে উঠল। নিতান্ত অবজ্ঞাভরে তিনি জানালেন, ‘ও পঁচিশ পঞ্চাশ। হুঁ, ওর কাছে ওইসব কারবারই বেশি। ছোটো দোকান থেকে আদায় কিনা। তা আপনার ভাঙানি দরকার? দু- একশো যা চাই বলুন। পাঁচ দশের নোটে নিতে পারেন। দুইও কিছু দিতে পারি।’
আমি কৃতার্থ হয়ে জানালাম, ‘আজ্ঞে আর আমার ভাঙানি দরকার নেই। বারিকমশাই চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘একখানা লুকিং গ্লাস নেবেন? টোয়েন্টি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দেব। মানে কস্ট প্রাইস। ফাসক্লাস জিনিস। অর্থাৎ টফির মতন আয়না স্রেফ ফ্রিতে দেওয়া সম্ভব নয় তাই যতটা সুবিধে করে দেওয়া যায়। আমি সবিনয়ে তাঁর অনুগ্রহ প্রত্যাখ্যান করলাম, ‘নাঃ বাড়ি নিয়ে যেতে ভেঙেটেঙে যাবে।’
কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ বারিক জানালেন, ‘ঠিক আছে বোলপুর লাইনে গেলে আপনার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসব। বাড়ির মেয়েরা দেখবেন লুফে নেবে।
বারিদবরণ পরদিন বিদায় নিলেন।
হোটেলের একখানা ঘরে চারজন ছাত্র থাকত। চারজনই কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কলেজ হস্টেলের সিট পায়নি তাই আপাতত হোটেলে রয়েছে। চারটি ছেলেই যণ্ডামার্কা। কলেজে যায়। বিকেলে খেলতে যায়। সকাল সন্ধে পড়াশুনো করে। নিজেদের মধ্যে হুল্লোড় করে। মিত্রমশাই তাদের রীতিমতো সমীহ করে চলতেন। ছেলেগুলি প্রায় খেতে হাঙ্গামা লাগাত। চিৎকার করত
—‘ঠাকুর, মাছের মুড়োটা কোথায়?’
—‘ঠাকুর, মাছের পিস এত ছোটো কেন? ঝোলে ঝাল কেন এত?’ ইত্যাদি। পাছে অন্য খদ্দের তাদের দেখে বিগড়ে যায়, তাই বাইরের খদ্দের থাকলে ওদেরকে অফিস ঘরে একটা বেঞ্চে আলাদা খেতে দেওয়া হত।
ছেলে চারটির সঙ্গে আমার কিন্তু দিব্যি ভাব হয়ে গিছল। আমি আগে ফুটবল ক্রিকেট খেলতাম এবং খেলার জগতের খবরাখবর রাখি জেনে ওরা কখনো কখনো আমাকে ওদের ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে গল্প জুড়ত। মাঝে মাঝেই হাড়কিপ্টে মিত্ৰমশায়ের শ্রাদ্ধ করত সরবে। মিত্রমশাই শুনেও শুনতেন না। যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন চার দস্যিকে। আমায় বলতেন, ‘খুরে খুরে দণ্ডবৎ মশাই, আর কক্ষনো স্টুডেন্ট ঢোকাচ্ছি না। জ্বালিয়ে দিলে—’
এক রাতে ওই চার স্টুডেন্টের সাথে আমি ভাত খাচ্ছি। চারমূর্তির একজন হাঁক পাড়ল, ‘ঠাকুর ফ্যান দাও।’
—‘ফ্যান!’ আমি অবাক। ‘ভাতের সঙ্গে ফ্যান খাও নাকি?’
স্টুডেন্টটি হেসে বলল, ‘আজ্ঞে না, ফ্যান নয়, ডাল।’
—‘মানে!’ আমি হতভম্ব, ‘তাহলে ফ্যান বলছ কেন?’
—‘দাদা, ওটাই এখানে ডালের মেন ইনগ্রেডিয়েন্ট।’ বোঝায় আর একজন, ‘ডালে কতটা ফ্যান মেশায় জানেন? ডাল কম ফ্যানই বেশি। আমরা তাই ফ্যানই বলি। বড়োজোর বলা যায় ডাল মেশানো ফ্যান।’
বেগতিক দেখে মিত্রমশাই সুড়সুড় করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি কোনোরকমে হাসি চাপলাম।
একদিন রাত দশটা নাগাদ ঘুমবার জন্য সবে চোখ বুজেছি। খাবার ঘর থেকে ভেসে এল বহু কণ্ঠের কলরব। বুঝলাম অনেক খদ্দেরের আগমন ঘটেছে। নির্ঘাত জগুর কীর্তি। হোটেলের ছোকরা চাকর জগুর প্রধান ডিউটি হচ্ছে, দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের পাকড়ানো। সে সমানে চেঁচিয়ে আহ্বান জানায়— ‘চলে আসুন, ভাতের হোটেল। সস্তা রেট। টাটকা রান্না। সব গরম পাবেন। আমিষ নিরামিষ যা চান। সিট আছে—’
বেশি খদ্দের জোটাতে পারলে জগু মালিকের থেকে বকশিশও পায়। খাবার ঘরে তুমুল হাঁকডাক হৈ চৈ চলল ঘণ্টা দেড়েক। ততক্ষণ আমার ঘুমের দফা গয়া।
পরদিন সকালে মিত্ৰমশাই বিগলিত বদনে আমার ঘরে দর্শন দিতে এলে, বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলাম। মিত্রমশাই কাঁচুমাচু ভাবে বললেন, ‘কাল রাতে একটু ডিসটার্ব হয়েছে নাকি স্যার?’
গম্ভীরভাবে বলি, ‘তা একটু হয়েছে বৈকি। অত রাতে হৈ চৈ হলে কি আর ঘুম আসে?’
মিত্ৰমশাই অপ্রস্তুত হেসে বললেন, ‘কী করব স্যার, এসে পড়ল। খদ্দের লক্ষ্মী। তার ওপর মড়া পোড়ানো পার্টি। ওদের পেলে কি কোনো হোটেল ছাড়ে?’
—‘কেন?’
—‘মানে দুদিনের যত বাসি খাবার ছিল সব পার করে দিলাম। সাধে কি আর ওদের এত খাতির।’
—‘সে কী অসুখ করে যদি?’ আমি চিন্তিত, ‘যদি ধরা পড়ে যেতেন?
—‘নো রিস্ক স্যার,’ মিত্র নির্ভাবনা, ‘পাঁচ মাইল দূর থেকে হেঁটে এসে গঙ্গার তীরে মড়া পুড়িয়েছে। পেট জ্বলছে খিদেয়। তার ওপর নেশা করেছে। ওই হুতাসনে যা ঢালবেন স্রেফ দগ্ধ হয়ে যাবে। ভালো-মন্দর বিচার আছে নাকি? শুধু গরম গরম চাই। আর হ্যাঁ ভাতটা গরম টাটকা চাই। এক-একজনা যা টানল দেখলে ভির্মি খেতেন। ওদের জন্যে তাই পাইস সিস্টেম। মানে হাতা পিছু চার্জ।’
চার স্টুডেন্ট সেদিন কলেজ যাবার আগে খেতে বসে চিৎকার করে ঘোষণা করল, ‘যাক বাবা কদিন আর বাসি খেতে হবে না, গুদোম সাফ।’ তারপরই চারজন পিলে চমকানো হুংকার ছাড়ল— ‘মড়া পার্টি যুগ যুগ জীও।’
—‘দাদা। ও দাদা।’
এক রাতে কানের কাছে ফিসফিসানি ডাক শুনে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মিত্রমশাই। তিনি হাত জোড় করে কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘দাদা ঘুম ভাঙালাম অপরাধ নেবেন না। বড়ো বিপদে পড়েছি, একটু সাহায্য করবেন যদি?’
—‘কী ব্যাপার?’ আমি উদ্বিগ্ন হয়ে মশারির বাইরে আসি। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা।
মিত্ৰমশাই হাত কচলাতে কচলাতে ভারি বিব্রতভাবে বললেন, ‘হঠাৎ এক সাহেব এসেছে। কী যে চায় ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি যদি ওর সঙ্গে কথা বলেন।’
—‘সাহেব ইংরিজি বলছে, না অন্য কোনো ভাষা?’ আমি নার্ভাস।
—‘ইংরিজিই তো মনে হচ্ছে, তবে ধরতে পারছি না কিচ্ছু।’
বারান্দায় গিয়ে দেখি এক লম্বা জোয়ান শ্বেতাঙ্গ যুবক চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে
আছে। তার পায়ের কাছে মস্ত এক ক্যাম্বিসের ব্যাগ। আমি তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী চাই আপনার?’
সাহেব তড়বড় করে কথা বলে গেল। ইংরিজিই বটে তবে কিঞ্চিৎ নাকি সুরে জড়ানো উচ্চারণ। বুঝতে আমারও কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিল, যাহোক তার বক্তব্য মোটামুটি উদ্ধার করলাম।
সাহেবের নাম মার্টিন। অ্যামেরিকান। কাটোয়া শহরের কাছে একটা এগ্রিকালচারাল ফার্ম দেখতে এসেছিল। ভেবেছিল সন্ধের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাবে। কাটোয়া স্টেশনে এসে শোনে, ট্রেন লেট। বহুক্ষণ অপেক্ষা করে স্টেশনে। ট্রেন কখন আসবে ঠিক নেই। হয়তো গভীর রাত হয়ে যাবে। তাই সাহেব স্থির করেছে, রাতটা কোনো হোটেলে বিশ্রাম করে ভোরে কলকাতা রওনা দেবে। নোংরা স্টেশনে আর কাঁহাতক বসে থাকা যায়। সাইকেল রিকশাওয়ালাকে খুব কাছে কোনো হোটেলে নিয়ে যেতে বলতে এই মিত্র হোটেলে হাজির করেছে। সাহেবের চাই শুধু একটি সিংগল রুম ও একটি খাট। বিছানা তার সঙ্গে আছে।
ঘরে ফ্যান থাকলে ভালো হয়, বড্ড গরম।
—‘ঘর খালি আছে’, জানালেন মিত্রমশায়, ‘ফ্যান? তা টেবিল ফ্যান একটা ম্যানেজ হয়ে যাবে, আমারটাই না হয় দেব। জিজ্ঞেস করুন কিছু খাবে কিনা? টোস্ট ওমলেট টি কফি বিস্কুট?’
দোভাষীর ভূমিকা আমার।
মার্টিন মাথা নেড়ে জানাল, ‘খাবারটাবার দরকার নেই। আমার ওয়াটার বটল-এ খাবার জল আছে। লজিং পেলেই যথেষ্ট।’
মিত্রমশাই সাহেবকে ঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন। আমি শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে মিত্রমশাই হাসি হাসি মুখে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলাম— ‘সাহেব চলে গেছে?’
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
—‘কেমন ঘুমিয়েছিল?’
—‘বলল তো গ্র্যান্ড।’
মানে একটা কৌতূহল আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘চার্জ কী নিলেন?
মিত্রমশাই মাথা চুলকে একগাল হেসে বললেন, ‘কুড়ি।’
‘অ্যাঁ, বলেন কী!’ আমি থ, ‘সিট রেন্ট আর একরাতের ফ্যান ভাড়া, সব মিলিয়ে বড়োজোর তো তিন-চার টাকা।’
—‘আজ্ঞে দিলাম বুক ঠুকে বলে,’ খুশিতে উজ্জ্বল মিত্র জানালেন, ‘তা মশাহ একবারও দরদস্তুর করল না! এক কথায় বের করে দিল। ইস পঁচিশ বললেও বোধহয় আটকাত না।’
ঠাট্টা করলাম, ‘আপনার হোটেল তো জাতে উঠে গেল। সাহেবসুবোরা পা দিচ্ছেন। আর কি আমাদের পুছবেন?’
—‘হেঁ হেঁ, কী বলেন’, মিত্রমশাই লাজুক হাসেন, ‘তবে হ্যাঁ মডার্ন হোটেলকে খবরটা পৌঁছে দিতে হবে। বেটাদের রংঢং একটু বেশি কিনা, আমাদের তাই খাটো চোখে দেখে। এবার জানুক’-
আমার কাজ শেষ। এবার কাটোয়া এবং মিত্র হোটেল থেকে বিদায়ের পালা। পাওনাগণ্ডা মেটাবার সময় একটাকা ছাড় দিয়ে স্পেশাল ফেভার দেখালেন মিত্রমশাই। বললেন, ‘কার্তিক পুজোর সময় এখানে আসবেন একবার। খুব ধুমধাম হয় শহরে। বাইরে থেকে কত লোক আসে দেখতে। আগে চিঠি দিলে আপনার সিট রিজার্ভ রাখব ওই ঘরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঠাকুর বিসর্জন দেখতে পাবেন।’
হোটেলের সেই চার স্টুডেন্ট আমায় তুলে দিয়ে এল হৈ হৈ করে। দুঃখের বিষয় আর আমার কাটোয়া যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
বৈশাখ ১৩৯৪