বাসে বুড়ি

বাসে বুড়ি

মফস্‌সল লাইনের বাস। ঘড়ঘড়, ঝরঝর ভোকভোক করে চলেছে। কাছে কোথাও হাট বসেছে, বাসে বেশ ভিড়। ভিড়টা ছাদেই বেশি। অনেকেই দেখলাম বাসের ভিতর ঢোকার চেয়ে ছাদে চড়াই বেশি পছন্দ করে। কন্ডাক্টার গোঁত্তা মেরে এদিক ওদিক করছে। কারো বগলের নীচ দিয়ে, কারো ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে টিকিট কাটছে। আমি মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।

এক বুড়ি উঠল। তার কোলে একটা ছাগলছানা। বাসের মেঝেয় লোকের পায়ের ফাঁকে বুড়ি থেবড়ে বসে পড়ল। পাশে বসল তার ছাগল।

খানিকবাদে কন্ডাক্টার এসে বলল, ‘একী তলায় কেন? ওইতো একটা লেডিস সিট খালি, উঠে বস।’ বুড়ি কাতরকণ্ঠে বলল, ‘না বাবা পড়ে যাব। যা ঝাঁকুনি।’ হঠাৎ বুড়ির সঙ্গীর ওপর কন্ডাক্টারের নজর পড়ল। অমনি এক ধমক- ‘অ্যাই ছাগল তুলেছ যে? জান না বাসে গোরু ছাগল তোলা নিয়ম নেই।’

বুড়ি বলল, ‘কেনে খেতিটা কী হয়েছে বাবা?’

—‘প্যাসেঞ্জারের অসুবিধে হয়।’

‘বটে! কী অসুবিধে হচ্চে শুনি? ওই যে বউটার কোলে কচি মেয়েটা একনাগাড়ে চেল্লাচে, কানে তালা ধরিয়ে দিল গো, তার বেলায় কিছু নয়। ইদিকে আমার পুঁটি উঠে অবধি একটা রা কাড়েনি সে করল অসুবিধে?’

আর কথা না বাড়িয়ে কন্ডাক্টার বুড়ির কাছে টিকিট চাইল।

আঁচলের গিট খুলে দুটো পাঁচ পয়সা চোখের সামনে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে দেখে বুড়ি ভাড়া দিল। পয়সা পেয়ে গুণে কন্ডাক্টার বললে, ‘ছাগলের ভাড়া লাগবে।’

বুড়ি তেড়ে উঠল, ‘হেই বাবা, উর আবার ভাড়া কী? এটুকুন প্রাণী!’

বুড়ির ওপর কন্ডাক্টার চটেছিল। গলা একটু চড়িয়ে বলল, ‘মালের ভাড়া লাগে। পয়সা দাও!’ বুড়িও গলা চড়াল— ‘ইঃ, বলি ওই যে লোকটা তিনটে নাউ নিয়ে চলেছে তা নাউয়ের ভাড়া লেগেছে নাকি? নাউগুলোর চেয়ে আমার পুঁটির ওজন কম। মেপে দেখো কেনে?’

বইখাতা হাতে কয়েকজন স্কুলের ছেলে মজা দেখছিল। তারা সরবে সাপোর্ট করল, ‘ঠিক বলেছ বুড়িমা। ওজন হোক, লাউ ভারী না পুঁটি ভারী, তবে টিকিট।’

কন্ডাক্টার বলল, ‘কিন্তু এ হল জ্যান্ত প্রাণী। জ্যান্ত জীবের ভাড়া লাগবে।’

ভাবলাম এবার বুড়ির উপায় নেই। কঠিন যুক্তি। কিন্তু বুড়ি তৎক্ষণাৎ হাত মুখ নেড়ে বলে উঠল— ‘বলে কী গো। দুমাসের ছানার আবার টিকিট। এই যে কচি মেয়েটা, ওর ভাড়া লেগেছে নাকি? অবলা মুখ্যু মেয়েমানুষ পেয়ে যাতা বোঝাচ্ছ কেন বাছা?’

ছাত্ররা হৈ হৈ করে উঠল। ‘সাবাস বুড়িমা, আচ্ছা দিয়েছ! পুঁটি মাইনর। ওর আবার টিকিট কী?

—‘এই মেয়েটা মানুষের বাচ্চা!’ কন্ডাক্টার গম্ভীরভাবে জানাল।

—‘মানুষ নয় বলে পুঁটিকে অবহেলা কোরো না। ওর ভারী বুদ্ধি। এক্কেবারে মানবের মতো।’ বুড়িও ছাড়বার পাত্রী নয়।

কন্ডাক্টার এবার হাল ছেড়ে দিল। তর্ক করে সময় নষ্ট হচ্ছে। অন্য যাত্রীদের টিকিট কাটা দরকার। দু-একজন ইতিমধ্যে তাক বুঝে বিনা টিকিটে সটকে পড়েছে। এদিকে পুঁটির ভাড়া পাওয়ার আশা কম। সে বেজার মুখে একখানা টিকিট বুড়ির হাতে গুঁজে দিয়ে অন্যদিকে ফিরতে ফিরতে বলল— ‘বাচ্চা কোলে নাও। মেঝেয় রেখেছ কেন?’

বুড়ি নির্বিকারভাবে পুঁটিকে আঁকড়ে গ্যাঁট হয়ে বসে রইল।

একটু পরে। হঠাৎ শুনলাম তুমুল তর্জন গর্জন। একজন লোক চেঁচাচ্ছে।— ‘এই বুড়ি তোর ছাগলের কাণ্ডটা দেখ। ইস! কতগুলো কচি ডাঁটা মুড়িয়ে দিয়েছে। কী লোকসান! আর এই বাসও হয়েছে যাচ্ছেতাই। ছাগল ভেড়া যা ইচ্ছে তুলবে। ওহে কন্ডাক্টার দেখো ইদিকে।

উঁকি মেরে ঘটনাটা বুঝে দেখি সর্বনাশ্। লোকটি ছোটো এক ধামা পালং শাক রেখেছিল পুঁটির সামনে। বোধহয় বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছিল হাটে। মুখের কাছে রসাল খাদ্য পেয়ে পুঁটি আর লোভ সামলাতে পারেনি। কখন চিবোতে শুরু করে দিয়েছে।

কন্ডাক্টার হাজির। যো পেয়ে গেছে। চোখ পাকিয়ে বলল— ‘কী রে বুড়ি, তোর ছাগলের নাকি বড়ো বুদ্ধি। বড়ো লক্ষ্মী। খুব যে বড়ো বড়ো কথা হচ্ছিল। এবার?’

একটা ছাত্র ফুট কাটল— ‘আহা, বাচ্চা ছেলে খিদে পেয়েছিল। সকালে বেরিয়েছে, টিফিন হয়নি।’

পুঁটির ব্যবহারে বুড়ির বেজায় অপমান লেগেছে। সে পুঁটিকে দুই থাপ্পড় কষিয়ে দিল।— ‘হতভাগা কেবল খাই খাই। আসার আগে অতগুলো পাতা খাওয়ানু না? বাসে উঠেছিস, বসতে পেয়েছিস, তা নয়। যত বিটকেলে বুদ্ধি। ছাগলার স্বভাব যাবে কোথা?’

চাঁটি খেয়ে পুঁটি ভ্যা ভ্যা করে কান্না জুড়ে দিল। ছেলেগুলো হট্টগোল করতে লাগল। কন্ডাক্টার বুড়িকে জোর করে নামিয়ে দেবে কিনা ভাবছে এমন সময় বুড়ি নিজেই ছাগল বগলে উঠে দাঁড়াল। বোধহয় তার যাবার জায়গা এসে পড়েছে কিংবা বেগতিক দেখে আগেই কেটে পড়ছে। ‘চ বাড়িতে দেখাচ্ছি মজা। আচ্ছা গেরো হয়েছে বাবা ছাগল পুষে। ঝাড়া হাত পা কুটুম বাড়ি বেড়াতে যাব, উপায় নেই। দুদণ্ড না দেখলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। ফেলে আসব এবার, যত পারে চেল্লাক।’ গজ গজ করতে করতে বুড়ি পুঁটিকে নিয়ে এগোল।

ঠিক নামার মুখে বুড়ি ঘাড় ঘোরাল। পালং শাকের মালিককে উদ্দেশ্য করে ঝাঁপিয়ে উঠল— ‘তোমারও বাপু আক্কেল বলিহারি। ছাগলের জিবের ডগায় কচি শাক রেখেছ! বলি লোভ দেখালে মুনিরও মতিভ্রম হয়, এ তো অবোধ পশু! হবেই লোকসান।’

আচমকা ধমক খেয়ে শাকের মালিক ভ্যাবাচ্যাকা। ‘ঠিক ঠিক’― ছেলেরা সায় দিল। বেশ খুশি খুশি হয়ে বুড়ি তখন বাস থেকে নামল।

(সত্য ঘটনা)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *