নাড়ুবাবুর পেন উদ্ধার
নাডুবাবু যখন সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেন তখন তাঁর ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলছে— রাগে, দুঃখে, হতাশায়! ওঃ, এক সপ্তাহের মধ্যে দু-দুটো পেন পকেটমার হয়ে গেল! প্রথমটা না হয় বাজে ছিল কিন্তু এবারেরটা একটা দামি সেফার্স। আর শুধু কি তাই? ওই সবুজ সেফার্সটা তিনি তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখার জন্য প্রাপ্ত মূল্যের টাকায় কিনেছিলেন। বড্ড পয়া পেন ছিল।
নাডুবাবু একজন উঠতি লেখক। ওই সেফার্সটা না পেলে তাঁর লেখার হাতই আসতে চায় না। এ তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন। পেনটা খুললেই, প্লট চরিত্র ভাষা সব হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসতে থাকে। অন্য পেন নিয়ে চেষ্টা করে দেখেছেন— স্রেফ সময় নষ্ট। এক কলম লেখা এগোয়নি।
আর আজ কি না সেই পেনটা গেল! নাড়ুবাবু আর ভাবতে পারেন না।
অফিস টাইমে বাসে উঠে পেন সামলাই বা কী করে? এদিকে আবার পেন নিয়ে না গেলেও চলে না। ওঃ, যা ভিড়! বিশেষত যাবার সময়। আসার সময় না হয় কিছুক্ষণ এদিকে ওদিকে ঘুরে ভিড়টা কমে গেলে বাসে চাপেন। কিন্তু যাবার সময় তো আর এক ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বেরোনো যায় না। তা হলে যে খাওয়াই হবে না।
আর বাসে উঠে কোনোরকমে রড আঁকড়ে ঝুলে থাকাই দায়। তার মধ্যে কি আর কে তার পকেটের ভার দয়া করে লাঘব করছেন, তার খেয়াল রাখা যায়? তিনিই তো কত সময় পয়সা বার করতে গিয়ে ভুল করে নিজের ভেবে অন্যের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফেলেছেন। অসম্ভব ব্যাপার।
তা পেন না হয় আবার হবে কিন্তু ওইটি না ফিরে পেলে যে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের ইতি।
রাত্রে খাবার পর ছাদে উঠে ক্রমাগত পায়চারি করছেন। মাথাটা ঠান্ডা না হয়ে উত্তরোত্তর গরমই হয়ে উঠছে। প্রায় স্ফুটনাঙ্কে যখন পৌঁছেছে হঠাৎ সেই সময় বুদ্ধিটা বিদ্যুতের মতো খেলে গেল। দেখা যাক কী হয়। মরিয়া হয়ে উঠেছেন নাড়ুবাবু। হ্যাঁ, ওই ভাবেই চেষ্টা চালাবেন। যাক কিছু পয়সা আর পরিশ্রম।
পরদিন নাড়ুবাবু সময়মতোই অফিসে হাজির হলেন। আর গিয়েই সাতদিনের ছুটির দরখাস্ত দিলেন ঝেড়ে— ‘আঙ্কেল সিরিয়াস।’ অফিসের লোকদের বলে এলেন, কাকা এই আছেন কি নেই। ডাক্তার বদ্যি তাঁকে একাই সব সামলাতে হচ্ছে। কবে আবার জয়েন করতে পারবেন, ঠিক কিছুই বলতে পারছেন না।
পরদিন থেকে নাড়ুবাবু তাঁর অভূতপূর্ব অভিযান আরম্ভ করলেন।
অফিসের সময়মতো খেলেন। তারপর পান চিবোতে চিবোতে বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়ালেন। হুড়মুড় করে বাস এসে পড়ল। বাসের গায়ে লোক বাদুড়-ঝোলা ঝুলছে। সঙ্গে সঙ্গে বাসের মধ্যকার এবং উঠতি যাত্রীদের মধ্যে প্রচণ্ড গোলমাল লেগে গেল। একপক্ষ উঠতে দেবেন না, অন্যপক্ষও অপ্রতিরোধ্য। নাড়ুবাবু বহুদিনের অর্জিত দক্ষতার গুণে ওরই মধ্যে টুক করে সেঁদিয়ে পড়েছেন। কেউ উঠলেন, কেউ পারলেন না। কেউ-বা নেমেছেন, কিন্তু ধুতির কোঁচাকে বাস ছেড়ে নামানো যাচ্ছে না। হৈ-হৈ রৈ-রৈ কাণ্ড। তালেগোলে বাস দিল ছেড়ে।
এ লাইনে একমাত্র… নং হল অফিস পাড়ায় যাবার বাস। আর এ সময় তাই সবকটাতেই থাকে ভয়ানক ভিড়। এর মধ্যে কি নিজেকে বাদে অন্যকিছু সামলানো চলে।
নাড়ুবাবু উঠে জুৎ করে দাঁড়ালেন— রডটা দুহাতে আঁকড়ে ধরলেন। তারপর সজোরে গলা চড়ালেন— ‘দেখবেন মশাইরা, পকেট সামলান। অসাবধান হয়েছেন কি পকেট থেকে পেন হাওয়া হয়ে যাবে। আমার মশাই, গতকালই একটা নতুন পেন চলে গেল।’
দু-একটা সহানুভূতিসূচক গলা পাওয়া গেল।
—‘যা বলেছেন। আমারও একটা গেছে আগের মাসে।’
—‘আরে এ লাইনটা পেন চুরির জন্য বিখ্যাত।’
একটি দাদু গোছের বৃদ্ধের চাঁচাছোলা গলা শোনা গেল— ‘একখানা মোটে বাস। আর বাসও বাড়ায় না। আমাদের গর্ভমেন্ট যা হয়েছে। বেশ, তবে পকেট মারা গেলে গর্ভমেন্ট আমাদের ক্ষতিপূরণ দিক। কেন দেওয়া হবে না বলুন?’
নাড়ুবাবুকে আর বেশি কিছু বলতে হল না। বাসসুদ্ধ সবাই তাদের স্বচক্ষে দেখা বা বিশ্বস্তসূত্রে শোনা নানারকম চমকপ্রদ পকেটমারার কাহিনি পরস্পরকে শোনাতে আরম্ভ করে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে পেনটেনগুলোর প্রতি সাবধান হয়ে উঠল।
নাড়ুবাবুর অফিস অনেকটা পথ। কিন্তু তিনি মাঝামাঝি গিয়েই নেমে পড়লেন। গড়ের মাঠে এক চক্কর ঘুরে নিয়ে আবার একটা ফিরতি বাসে উঠলেন এবং উঠেই হাঁক ছাড়লেন— ‘মশাইরা, পেন সামলে, আমার কালই একটা গিয়েছে। শুনলাম এ লাইনে পেন হাতাবার কয়েকজন নামকরা ওস্তাদ যাতায়াত করছে।’
ব্যস, আগেকার মতোই সারা বাস পকেটমারার আলোচনায় গরম হয়ে ওঠে। যে যার পকেটে হাত দিয়ে জিনিস-টিনিস সব আছে কিনা দেখে নেয়। নাড়ুবাবু বাড়ির কাছে এসে নেমে পড়লেন।
এইরকম বার কয়েক যাতায়াত করে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লেন। তা মেহনত তো কম হয়নি। মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে নাড়ু, এখনই ফিরলি?’
—‘হ্যাঁ মা, তাড়াতাড়ি ছুটি পেয়ে গেলাম। এরকম এখন কয়েকদিন পাব।’
—‘তা বেশ।’ বলে মা চলে গেলেন, আর নাড়ুবাবুও পাশ ফিরে এক লম্বা ঘুম মারলেন।
এটাই আপাতত নাড়ুবাবুর দৈনন্দিন কর্মধারা হয়ে দাঁড়াল। চারদিন ধরে তাঁর ওই রুটিন চলছে। সকালে অফিস টাইমে বাসে ঘোরা আর উঠেই সকলকে পকেটমার সম্বন্ধে সাবধান করে দেওয়া।
নাড়ুবাবুকে এখন বাসের লোক বেশ চিনে গেছে।
—‘এই যে দাদা, এসে গেছেন?’
—‘আরে দাদাকে দেখেই পকেটের কথা মনে পড়ে গেল। দেখি আবার সব ঠিকঠাক আছে কি না।’
নাড়ুবাবুও সাবধান করেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, পকেটের জিনিসপত্তর সব সামলে। খুব খারাপ রাস্তা মশাই।’
ছেলেছোকরা টিপ্পনি কাটে, ‘কী দাদা, কাজের ফাঁকে পরোপকার করে একটু পুণ্য সঞ্চয় করছেন নাকি?’
—‘আরে জানিস না, দাদা হলেন পকেটমার নিবারণী সংঘের একজন জাঁদরেল মেম্বার।’
নাড়ুবাবু রাগেন না, হাসেন।
কোনো নতুন যাত্রী জানতে চায়, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? পকেটমার হয়েছে নাকি?’
নাড়ুবাবু তৎক্ষণাৎ বিস্তারিত করে বোঝান— ‘খুব সামলে চলবেন। এই সময় এই রুটের বাসে পকেটের জিনিসপত্তর একেবারে অস্থাবর। বিশেষ করে পেন। এই দেখলেন আছে, পাঁচ মিনিট পরেই দেখবেন হাওয়া।
আর তিনি বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাসসুদ্ধ লোকের নানান পকেটমারের গল্প মনে পড়ে যায়। কারো কারো পকেটমারার গল্পের স্টক ফুরিয়ে যাওয়ায় চুরি ডাকাতি রাহাজানির গল্পে বাস মুখর হয়ে ওঠে।
নাড়ুবাবু হৃষ্টচিত্তে সব লক্ষ করেন।
এইরকম কয়েকবার যাতায়াত করে বাড়ি ফিরে আসেন। আর এসেই টেনে ঘুম।
সেদিন পঞ্চম দিন। নাড়ুবাবু অফিসের দিকে থেকে যাত্রী বাসটা থেকে গড়ের মাঠের কাছে প্রথম ট্রিপটা দিয়ে নামলেন। একটু হাওয়া খেয়ে আবার একটা উল্টোদিকের বাস ধরবেন। তারপর আবার অফিসের দিকে।… এইরকম চলবে, বেশ কিছু পয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে। তা যাক, তিনি ছাড়ছেন না।
গড়ের মাঠে গাছের ছায়ায় ঘুরছেন। একজন পেন্টালুন আর হাওয়াই শার্ট পরা মাঝবয়সি লোক একই সঙ্গে বাস থেকে নেমে গুটি গুটি তাঁর পিছনে পিছনে আসছিল। হঠাৎ কাছে এসে ডাকল, ‘ও, মশাই, ইদিকে একবার আসবেন— একটা কথা ছিল।’
নাড়ুবাবু আড়চোখে চেয়ে বললেন, ‘বলুন।’
—‘চলুন-না ওই ফাঁকা গাছটার নীচে। তাড়া আছে?’
—‘নাঃ, তাড়া তেমন নেই, চলুন।’
গাছতলায় এসেই লোকটি তেড়িয়া হয়ে উঠল : — আচ্ছা মশাই, কদিন ধরে দেখছি আপনি ওই সময়টাতে বাসে চড়ে কেবল ইদিক-উদিক করেন। উঠেহ কেবল পকেটমারের গল্প ফাঁদেন। বলি, ব্যাপারখানা কী? আপনার আর কিছু কাজকর্ম নেই নাকি?
নাড়ুবাবু বললেন, ‘মানে, আমার পেনটা সেদিন গেল কি না। তাই অন্যদের একটু সাবধান করে দিচ্ছি। আর কিছু নয়।’
—‘ওঃ, খুব যে দেখছি অন্যের ভালোমন্দের চিন্তা। তা পেনটা ফিরে পেলে কী করবেন?’
—‘আজ্ঞে, কাল থেকেই আবার অফিস যাব। তবে না পাওয়া পর্যন্ত অফিসমুখো হচ্ছি না। আমার পয়া পেন মশাই।’
—‘বটে।’ লোকটি গম্ভীর হয়ে যায়। ‘কবে হারিয়েছিল?’
সোমবার সকাল দশটা নাগাদ।’
—‘অ’, ইতিমধ্যে লোকটি তার দুহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এই দুহাতই বার করে এনে নাড়ুবাবুর সামনে দুই মুঠো খুলল। দু মুঠোয় নানান
রঙের হরেক রকমের এক গাদা পেন।
—‘দেখুন কোনটা আপনার। সব কটাই নিয়ে এসেছি।
নাড়ুবাবু তৎক্ষণাৎ তাঁর সবুজ সেফার্সটিকে চিনে ফেলেছেন, আর টপ করে তুলে নিয়েছেন লোকটির প্রসারিত মুঠো থেকে। পরম আদরে হাত বোলাতে থাকেন তাঁর হারানিধির গায়ে।
‘ব্যস, মিলেছে তো? তাহলে আর কাল থেকে ঝুট ঝামেলা করবেন না। ওঃ ভারি তো একটা পেন গিয়েছিল! আজ পাঁচদিন ধরে কী কাণ্ডটাই-না আরম্ভ করেছেন।
নাড়ুবাবু বোঝাতে চেষ্টা করেন, ‘ভারি পয়া পেন মশাই। এটা ছাড়া আমার লেখাই বেরোয় না।’
—‘আর আমার হালটা কী হয়েছে ভাবুন তো?’ লোকটি ক্ষুব্ধস্বরে বলে ওঠে, ‘আজ পাঁচদিন ধরে স্রেফ হাত গুটিয়ে বসে আছি। আপনার জ্বালায় সব কাজকর্ম প্রায় বন্ধ। আমার আবার এই বাস রুটে সকালের অফিস টাইমে মাত্র এক ঘণ্টা ডিউটি। ব্যস, তারপরেই অন্য লোকের পালা। আর আমি বাকি সকালটা বিলকুল বেকার। তা রোজগারপাতি না থাকলে সংসারটা চালাই কী করে বলতে পারেন?’
নাড়ুবাবু অপ্রস্তুতের মতো মাথা চুলকান ‘আজ্ঞে তা ঠিক চিন্তা করিনি। মানে…’
—‘ঠিক আছে। পেন তো পেয়ে গেছেন। কাল থেকে বাসে উঠে ওইসব বাজে বকবেন না তো?’
—‘মোটেই না। কী দরকার আমার মুখব্যথা করে। স্রেফ অফিস যাব আর আসব।’ নাড়ুবাবু অম্লানবদনে উত্তর দেন।
—‘হ্যাঁ, মানে, ওই পুলিশ-টুলিশে দেবার মতলব নেই তো?’
—‘আরে না না।’ নাড়ুবাবু শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন— ‘আবার পেনটা খোয়াই! আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
—‘তাহলে কথা দিচ্ছেন। মনে রাখবেন কিন্তু। প্রমিস।’
—‘বিলক্ষণ বিলক্ষণ, চলুন-না একটা পান খাওয়া যাক।’ পেন ফিরে পাওয়ার আনন্দে নাড়ুবাবু গদগদ।
—‘সরি, আজ একদম সময় নেই। একটু কাজ আছে। নমস্কার।’ লোকটি ততক্ষণে হন হন করে বাসস্টপের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।
পরদিন থেকে নাড়ুবাবু অফিস যেতে আরম্ভ করলেন, এবং সবুজ সেফার্সটি বুক পকেটে নিয়েই।
প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে। নাড়ুবাবু লেখায় বেশ নাম করে ফেলেছেন। আর এখনও সেই সবুজ সেফার্সটিতেই তিনি লিখে থাকেন।
বাসে সেই লোকটির সঙ্গে তাঁর বারকয়েক দেখা হয়েছে। চোখাচোখি হতেই তিনি পরিচিতের মতন তার মুখের দিকে চেয়ে দাঁত বার করেছেন। লোকটি কিন্তু তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
১৩৭১