চিকন
‘উরি ব্বাস।’
ঘ্যাঁচ। চাপা আর্তনাদটা গলা ঠেলে বেরুতে-না-বেরুতেই দু হাতে ব্রেক চাপল মুকুন্দ। প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেয়ে সাইকেলের গতি মুহূর্তে রুদ্ধ হল। টলে গিয়ে মুকুন্দ নেমে পড়ল এবং পরক্ষণেই তড়িৎবেগে দ্বিচক্রযানটির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে লাফ দিয়ে চেপে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্যাডেল মেরে সে উধাও হল।
বাগানের বাইরে গিয়ে মুকুন্দ হাঁপ ছাড়ে। ভুল হয়েছে বইকী। সন্ধের ঝোঁকে হালদার বাড়ির বাগানের ভিতর দিয়ে যাওয়া। বাগান বলা উচিত নয়। জঙ্গল। বিরাট বিরাট গাছের তলায় ঝোপঝাড় আগাছায় ভরা। তারই ভিতর দিয়ে গেছে কটা সুঁড়ি পথ। আগে নাকি হালদার বাগান সত্যি দেখার মতন ছিল। সুরম্য অট্টালিকা ঘিরে বিশাল সাজানো বাগান। আম জাম কাঁঠাল নারকেল ইত্যাদি ফলের গাছের সঙ্গে নানান বাহারি ফুল পাতার সৌখিন গাছ। অবাঞ্ছিত আগাছাহীন তকতকে। বাগানে বাঁধানো ঘাটওলা মস্ত পুকুর।
হালদারকুঠি বা তার বাগানের গৌরবের দিনগুলি স্বচক্ষে দেখেনি মুকুন্দ এসব শোনা কথা, বাপ-পিতামহের মুখে। তার পঁচিশ বছরের জীবনের শুরু থেকেই দেখছে হালদারদের হতশ্রী অবস্থা। দিন দিন ওই বাড়ি বাগান আরও দীনহীন হয়ে পড়ছে। পুকুর মজে গেছে প্রায়
এই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এখানকার গাঁয়ের লোক দিনের বেলাতেই পথ চলে না বিশেষ। গেলেও সতর্ক হয়ে চলে। মুকুন্দ আনমনা ছিল। হালদারবাড়ির পিছন দিকে খানিক দূরে মাঠে একটা ইটভাটা হয়েছে সম্প্রতি। যাচ্ছিল সেখানে। বেশ জোরেই চালাচ্ছিল সাইকেল। হঠাৎ তার চোখে পড়ে আট-দশ হাত তফাতে সরু পথটা পেরোচ্ছে প্রকাণ্ড একটা সাপ। মালুম হল খরিস গোখরো। খাঁটি জাত-সাপ।
নেহাতই বরাত জোর তাই খুব সময়ে ব্রেক কষতে পেরেছে। নইলে সোজা গিয়ে পড়ত ওর ওপর। এবং তাহলে? ভেবে সে শিউরে ওঠে। এই জঙ্গুলে বাগান যে বিষাক্ত সাপখোপের আড্ডা কে না জানে। বুকের ধড়ফড়ানি কমতে তার সময় লাগে।
সাপটাও কম চমকায়নি।
বাঁক খেয়ে ফিরে ঝোপের আড়ালে আড়ালে সরসর করে অনেকখানি ছুটে গিয়ে তারপর ফিরে তাকিয়ে সাপটা নিশ্চিন্ত হল। মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না। যদি ও সত্যি ঘাড়ে পড়ত? আঘাত পেলে অবশ্যই রুখে দাঁড়াত সে। লোকটা ইচ্ছে করে বা অনিচ্ছাবশে অসাবধানে তার ঘাড়ে পড়েছে এত বিচার করার ধৈর্য থাকত না। ফলে দুজনের মধ্যে কেউ একজন প্রাণ হারাত। কিন্তু তা তো চায় না সাপটা। অবশ্য যদি সেই লোকটা হত ছেড়ে দিত না সে। পথ থেকে সরে গিয়েই সে এক ঝলকে দেখে নিয়েছিল মানুষটাকে।
বুড়ো ঠাকুর্দা বলত যে অকারণে হিংসা করবি না। শুধু খাদ্য আর আত্মরক্ষার প্রয়োজনে জীবকে আক্রমণ। আমাদের হাতিয়ার আছে। অতি মারাত্মক অস্ত্র। ভয়ানক বিষ। সে অস্ত্র অকাজে লাগাবি না। তবে হ্যাঁ, মনে রাখিস, মানুষ বড়ো ফিচেল জাত। তাদের ন্যায় অন্যায় বোধ কম। অকারণে অন্যের ক্ষতি করে। উত্ত্যক্ত করে। ওদের এড়িয়ে চলবি। নয়তো ভয় দেখিয়ে তাড়াবি দরকারে। হালদারবাড়ির মানুষরা ভালো। আমাদের আত্মীয়ের মতন। বহু পুরুষ ধরে এই ভিটেতে এক সাথে বাস। তবে অন্য মানুষদের থেকে সাবধান।
হালদার বাড়ির এক তলায় একটি অন্ধকার কুঠুরির মেঝের নীচে গর্তে থাকে সাপটা। বহুকাল ধরে তাদের বংশের কেউ-না-কেউ, কখনো একা, কখনো-বা জোড়ায় এই বাড়িতে বাসা বেঁধেছে। হালদাররা তাদের বলে বাস্তু সাপ। জাতে খরিস গোখরো হলেও হালদাররা নাম দিয়েছিল গোলাপনাগ। ফণা মেললে চ্যাটালো ফণায় ঘট চিহ্নের মাঝে থাকে একটুখানি গোলাপি ছোপ। এটাই হালদার ভিটের বাস্তু সাপদের বৈশিষ্ট্য।
যে সাপটা সাইকেল চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল তার একটা নাম আছে। চিকন। তার বুড়ো ঠাকুর্দার দেওয়া নাম। যখন সে প্রথম এই বাড়িতে পাকাপাকি বাস করতে আসে বুড়ো ঠাকুর্দা আদর করে ওই নামে ডাকত তাকে। এখন অবিশ্যি তার শরীর আর তেমন সরু চিকন নেই। ভরা যৌবনে তিন হাত লম্বা সুপুষ্ট তরতাজা গতিময় দেহ। শীতলপাটির মতন চকচকে গা ধূসর রঙা। তার আগে হালদারভিটেতে গোলাপনাগ বংশের একজনই বাস করত— বুড়ো ঠাকুর্দা। অতবড়ো গোখরো সাপ সচরাচর দেখা যায় না। অমন ভয় জাগানো চেহারা হলে হবে কি, ঠাকুর্দার মেজাজটি ছিল ভারি ঠান্ডা। সাত্ত্বিক প্রকৃতির।
বুড়ো ঠাকুর্দাই চিকনকে পরামর্শ দিয়েছিল, এই বাড়িতে আস্তানা গাড়তে। ঠাকুর্দার পর চিকনই হল হালদারভিটের বাস্তু সাপ। ঠাকুর্দার বয়স হয়েছে। ঠাকুর্দা গত হলে গোলাপনাগ বংশের কেউ বাস করবে না হালদারদের ভিটেতে, তা কি হয়?
বুড়ো ঠাকুর্দার মুখে চিকন শুনেছিল হালদারবাড়ির অনেক গল্প। এক সময় গমগম করত এই বাড়ি। এ বাড়ির বাসিন্দারা আর বাস্তু সাপরা মানিয়ে চলত পরস্পরকে। কেউ কারোকে বিরক্ত করত না, আঘাত করত না। এই ধারাই চলেছে বংশানুক্রমে। হালদার বাড়ির পুরোনো দিনের কথাও এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে জেনেছে মানুষে এবং সাপে, যারা এই ভিটেতে বাস করে আসছে। যেমন বুড়ো ঠাকুর্দা জেনেছিল তার আগের পুরুষের কাছে। আর চিকন শুনেছে বুড়ো ঠাকুর্দার মুখে।
বুড়ো ঠাকুর্দা বুদ্ধি দিতেন চিকনকে, ‘বুঝলি, হালদার বাড়িতে আমরা নিশ্চিন্ত। তবে বাইরের মানুষরা সবাই ভালো নয়। তাই বাস্তু সাপরা বাগানের চৌহদ্দির বাইরে যায় না পারতপক্ষে। আমিও যাই না। তুইও যাসনে।’
বিধিটি যথাসম্ভব মেনে চলে চিকন।
হালদার বংশের সঙ্গে গোলাপনাগ বংশের সম্পর্কটা আজও অটুট। এ যে দুই বংশেরই ভিটে। বিশাল হালদারকুঠির প্রায় গোটা অংশই আজ নিঝুম পুরী। জরাজীর্ণ। পরিত্যক্ত। শুধু একধারে কয়েকখানা মাত্র ঘর নিয়ে বাস করেন হালদার বংশের কয়েকটি প্রাণী। মাঝবয়সি কর্তা গিন্নি। তাদের বিধবা পুত্রবধূ এবং আট-দশ বছরের দুটি নাতি নাতনি।
ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে দুটি ঝোপঝাড় ভরা বাগানে ঘোরে। খেলে বেড়ায়। আতা কুল পেয়ারা খোঁজে। ফুল তোলে। ওরা কাছে এলে চিকন সন্তর্পণে সরে যায়। পাছে ভয় পায় ওকে দেখে। অবশ্য ভয় ওরা পাবে না। চিকনকে চেনে। দাদু চিনিয়ে দিয়েছে ‘ও হল বাস্তু সাপ। আমাদেরই মতন এই বাড়িতে বহুকাল আছে। ওকে ঢিলটিল মেরো না। তা হলে কিচ্ছুটি বলবে না।’
ওদের ছোড়া ঢিল অবশ্য মাঝে মাঝে চিকনের গায়ের কাছে পড়েছে। একটু চমকে উঠে চিকন স্থির চোখে তাকিয়ে দেখে বুঝেছে যে লক্ষ্যটা সে নয়। ফলটল পাড়তে গিয়ে ছোটো ছোটো হাতের ঢিল ওদের অজান্তে এসে পড়েছে তার কাছে। দিনের বেলা চিকন বাইরে বেরয় খুব কম। তাই হালদার বাড়ির মানুষগুলির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ।
একবার চিকন বেশ রেগে গিয়েছিল হালদার মশায়ের বাগাল ছেলেটার ওপর। বিকেলে নির্জন পুকুর পাড়ে খাবারের খোঁজে ঘুরছিল চিকন। বছর পনেরোর দুষ্টু ছেলেটা তাকে দেখে তাক করে ছুড়ছিল বড়ো একটা ঢিল। ভাগ্যিস লাগেনি গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে চিকন খাড়া হয়ে ফোঁস করে গর্জে উঠতেই ‘বাবাগো’ বলে বাগালটা মেরেছিল ছুট। ওকে আর তাড়া করেনি চিকন। ভয় দেখিয়ে কিঞ্চিৎ শিক্ষা দিতে চেয়েছিল মাত্ৰ।
হালদারকর্তা ব্যাপার শুনে বকেছিলেন ছেলেটাকে ‘নিশ্চয় তুই ঢিলটিল মেরেছিলি সাপটাকে। গোলাপনাগ গোখরো। ও তো কাউকে নিজে থেকে কামড়াতে যায় না। খবরদার ওকে ঘাঁটাবিনে। ও আমাদের বাস্তু সাপ। ভিটের লক্ষ্মী।’
কাউকে নিজে থেকে কামড়ায় না বটে চিকন। সেই শিক্ষাই দিয়েছে তাকে বুড়ো ঠাকুর্দা কিন্তু একটা মানুষকে বাগে পেলে সে ছাড়বে কক্ষনো? চরম শাস্তি পাওনা আছে মানুষটার। যে লোকটা ধরে নিয়ে গিয়েছিল বুড়ো ঠাকুর্দাকে।
হালদারবাড়ির গৌরবের দিন গত। দিনে দিনে জীর্ণ হচ্ছে অট্টালিকা। বাগান ঘেরা পাঁচিল ধসে পড়েছে অনেক জায়গায়। পাল্লাহীন ফটক সর্বদাই হাট করে খোলা। যে-সে লোক যাতায়াত করে বাগানের ভিতর দিয়ে। ফলপাকুড়, শুকনো কাঠকুটোর লোভে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘোরে বাইরের লোক। হালদারকর্তার সাধ্য কী সবাইকে ঠেকান। কত আর নজর রাখবেন বাড়ি ও বাগানের সীমানার ভেতর বাইরের লোকের প্রবেশ আটকাতে। নেহাতই ভালো মানুষ তিনি। কায়ক্লেশে সংসার চালান। এসব নিয়ে নিত্য ঝগড়া বিবাদ মন চায় না।
এমনি এক উটকো লোক এক আশ্বিনের বিকেলে হালদার বাগানে কীসের সন্ধানে তীক্ষ্ণ চোখে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখে ফেলে বুড়ো ঠাকুর্দাকে। তৎক্ষণাৎ লোকটা তেড়ে যায় সাপটাকে।
গোলাপনাগ বংশীয় মহাসর্প সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠেছিল বিশাল ফণা তুলে। কিন্তু লোকটা আশ্চর্য কায়দায় শক্ত মুঠিতে ধরে ফেলেছিল বুড়ো ঠাকুর্দার ঘাড়টা। ঝাঁকুনি মেরে অবশ করে ফেলেছিল সাপটাকে। তারপর ওর বিষ-দাঁত ভেঙে একটা ঝাঁপিতে পুরে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
চিকন দূর থেকে দেখেছিল ঘটনাটা। বেজায় ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাই তেড়ে গিয়ে ঠাকুর্দাকে রক্ষা করতে ভরসা পায়নি। তখন সে বয়সে নেহাতই কাঁচা। হালদারবাড়িতে বাসা বাঁধার কয়েক মাসের মধ্যেই এই ঘটনা। লোকটাকে মনে আছে চিকনের। রুক্ষ ঝাঁকড়া চুল মাথায়। রং কালো। পাকানো হিংস্র চেহারা।
মাস ছয়েক বাদে ওই বাগানেই ফের বুড়ো ঠাকুর্দার দেখা পায় চিকন। অতি রুণ অবস্থায়। ঠাকুর্দার কাছে শোনে যে ওই মানুষটা নাকি সাপুড়ে। সাপ ধরে খেলা দেখায়। খেতে দিত বটে নিয়মিত কিন্তু সর্বক্ষণ বন্দী করে রাখত ঝাঁপিতে। নড়াচড়া করা যেত না মোটে। শুধু মাঝে মাঝে দর্শকদের সামনে ঝাঁপি খুলে খোঁচা মেরে তাকে ফণা তুলতে বাধ্য করত একটুক্ষণের জন্য। এইভাবে থাকতে থাকতে একেবারে ভগ্ন স্বাস্থ্য অথর্ব হয়ে পড়ায় সাপুড়েটা ঠাকুর্দাকে ছেড়ে দিয়ে গেছে। বুড়ো ঠাকুর্দা সখেদে বলত, ‘কেন মানুষগুলো এত নিষ্ঠুর হয়? উঃ এ যে মৃত্যুর চেয়েও বেশি যন্ত্রণা। মানুষকে যদি, এমনি বন্দী করে রাখা হয় ছোট্ট খাঁচায়, কেমন লাগবে?’
বুড়ো ঠাকুর্দা আর বাঁচেনি বেশিদিন। সেই থেকে সাপুড়েদের সম্বন্ধে চিকনের দারুণ রাগ ও ভয়। তবে কে সাপুড়ে আর সাপুড়ে নয় তা সে বুঝতে পারে না। অবিশ্যি সেই লোকটাকে চিকন চিনে রেখেছে। মনে পুষে রেখেছে প্রতিহিংসার আগুন।
হালদার বাগানে অচেনা মানুষের উৎপাত বড্ড বেড়ে গেছে ইদানীং। কাছ দিয়ে একটা পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে বছর দুই। সে পথ দিয়ে গাড়ি চলে, বাস চলে হরদম। বাস স্টপেজ হয়েছে কাছেই। ফলে ওই রাস্তার কাছাকাছি গজিয়ে উঠছে দোকানপাট। ছোটোখাটো কারখানা। তৈরি হচ্ছে পাকা বাড়ি। পাড়া গাঁ মফস্সল শহরের রূপ নিচ্ছে। মানুষের বসতি বাড়ছে হালদার বাড়ির চারপাশে। বুনো জীবজন্তুরা এখন আর নিশ্চিন্তে হালদার বাগানে বিচরণ করতে পারে না। সদা সতর্ক শঙ্কিত থাকে মানুষের চোখ এড়াতে। চিকন এখন অন্ধকার না নামলে বেরয় না বাইরে পারতপক্ষে।
চিকনের উপদেশ না মেনে বেশি দুঃসাহসী হতে গিয়ে বেঘোরে মারা পড়েছে জোয়ান কেলেটা। মস্ত এক কালি গোখরো। যখন-তখন দিনের বেলাতেও বেরুত সে। এমনকী বাগানের সীমানা পেরিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়াল ছেড়ে সে ঘোরাঘুরি করত। ইটভাটার কাছে দিনের বেলায় খাবার খুঁজতে গিয়ে কেলে নজরে পড়ে যায় কয়েকজন মানুষের। রে রে করে লাঠি হাতে তেড়ে আসে লোকগুলো। ফলে কেলের প্রাণটা যায়।
কয়েক বছর যাবৎ হালদার বাড়িতে এক নিভৃত গর্তে বাসা বেঁধেছিল একজোড়া কালো গোখরো। যখন মানুষজনে ভরা ছিল এই বাড়ি তখন এমনটি হবার উপায় ছিল না। গোলাপনাগ গোখরো ছাড়া অন্য সাপের অধিকার ছিল না হালদার বাড়িতে বাস করার। তাহলে তাদের প্রাণের আশঙ্কা। কিন্তু এখন এই বিশাল পোড়ো বাড়ির নানা অংশে অনেক সাপখোপেরই আস্তানা। মেনে নিতে হয়েছে চিকনকে, উপায় কী?
কেলেরা বাস্তু সাপ নয় কোনোকালে। মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলার অভ্যাস নেই ওদের। বোঝে না মানুষের হালচাল। চিকনের ভয় ছিল নিরীহ হালদার বংশের কাউকে না ছোবল মেরে বসে বদমেজাজি দুর্দান্ত স্বভাব কেলেরা। সাবধান করে দিয়েছিল ওদের ‘খবরদার এমন কম্ম কদাপি নয়। তাহলে কিন্তু তোমাদের ভাগ্যে বিপদ আছে আমার হাতে।’
চিকনকে ডরাত কেলেরা। সমঝে চলত ওর হুকুম।
কেলে প্রাণ হারাবার পর কেলের বউ ভয় পেয়ে পালিয়েছিল এই বাড়ি ছেড়ে। অনেক দূরে ফাঁকা মাঠের মাঝে বটগাছের শিকড়ের নীচে গর্তে গিয়ে বাসা করেছিল। যাবার সময় চিকনকে সে বারবার বলেছিল— ‘তুমিও পালাও এ ভিটে ছেড়ে। নইলে মারা পড়বে ঠিক।’
চিকন কান দেয়নি তার কথায়।
এই অট্টালিকার আনাচ-কানাচ, চারপাশের ঝোপঝাড়, সুপ্রাচীন তরু-সকল, এখানকার দৃশ্য, এখানকার মাটি জল-বায়ুর স্পর্শ গন্ধ স্মৃতির মায়া ছিন্ন করে অন্য কোথাও যাবার চিন্তা চিকন সইতে পারে না। হ্যাঁ, যদি কোনোদিন হালদার মশাইও এখান থেকে চলে যান সপরিবারে তখন না হয় সে বিষয়ে ভাবা যাবে। তাই-বা কেন? চিকন ভাবে। এ যে তারও পূর্বপুরুষের বাস্তু। ভিটের মানুষরা চলে গেলেও সে কেন যাবে? এইখানেই কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন।
তবে কেলের মৃত্যুর পর চিকন আরও সাবধানে ঘোরাফেরা করে।
টানা দুটো দিন দুটো রাত চিকন তার গর্ত থেকে বেরুতে সাহস পেল না। মাটির কাঁপনে বোঝে যে কিছু একটা ভয়ানক তাণ্ডব চলছে বাইরে মাথার ওপরে। বিকেলের পরে হুল্লোড় কিছুটা কমে। তবু টের পায় অনেক লোকের চলাফেরা গভীর রাত অবধি। কখনো কখনো বাতাসে ভেসে আসে আগুনের আঁচ। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় চিকন গর্ভের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বেরতে বাধ্য হল খিদের জ্বালায়। বাড়ির ভিতরে কোনো খাবার জোগাড় করতে না পেরে সে বাইরের দিকে গেল সন্তর্পণে। ব্যাপারটা কী ঘটছে জানতে তার কৌতূহলও হচ্ছিল।
চিকন উঁকি মেরে দেখল যে বৈঠকখানা ঘরটা সাফসুফ করা হয়েছে। মেঝেতে পাতা রয়েছে কয়েকটা চাটাই। রাতে বোধহয় কারা শোয় এখানে।
বাড়ির লাগোয়া চাতালে কয়েকজন লোক বসে গল্পগুজব করছে। তাদের সামনে উনুনের আগুনে রান্না চড়েছে। এই পোড়ো বাড়িতে কারা থাকতে এল? ওই বিদঘুটে আওয়াজগুলোই বা কীসের?
ধীরে ধীরে বাগানে হাজির হয়ে চিকন হতভম্ব। যেন একটা প্রলয় ঘটে গেছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছ সটান মাটিতে শুয়ে। প্রবল ঝড় হয়ে গেছে নাকি? কিন্তু ঝড়জলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সে তো টের পায় গর্তে থেকেই তেমন তো কই অনুভব করেনি!
খানিক নজর করে চিকন বোঝে যে এ কীর্তি মানুষের। গাছগুলো গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। মাটিতে শোওয়া অনেক গাছের ডাল ও গুঁড়ি খণ্ড খণ্ড করে কাটা। প্রাচীন মহাবৃক্ষগুলির এই দুর্দশা দেখে বড়ো কষ্ট হল চিকনের। ডালপালা পাতায় ঢাকা এতকালের আড়াল আবডাল আচ্ছাদন নির্মম হাতে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে যেন। বাগানের অনেকখানি অংশ বেআব্রু নেড়া। কী ব্যাপার?
জানে না চিকন কারণটা। হালদাররা অভাবের দায়ে বাগানের অনেক গাছ বেচে দিয়েছেন শহরের এক কাঠ গুদামের মালিককে। ব্যাপারির লোকজন গাছ কাটছে। এরপর লরি বোঝাই হয়ে চালান যাবে কাঠ। হালদার বাড়িও হয়তো বিক্রি হয়ে যাবে শিগগিরি। জমি সমেত বাড়ি। কিনতে চেয়েছে একজন। সে পুরোনো অট্টালিকাখানা ভেঙে ফেলে এখানে কারখানা বানাবে। হালদার বংশের শরিকদের মধ্যে এই নিয়ে কথাবার্তা চলছে। এই পোড়ো বাড়ি আর জংলা বাগান রেখে লাভ কী? এই বাড়ির বাসিন্দা হালদারমশাই তাঁর ভাগের টাকা নিয়ে চলে যাবেন অন্য কোথাও।
একটা ব্যাঙের গন্ধ অনুসরণ করে চিকন। হঠাৎ দেখে পুকুরের দিক থেকে এগিয়ে আসছে একটা উজ্জ্বল আলো এবং মানুষের পায়ের শব্দ টের পায়। আড়ালে আত্মগোপন করার সুযোগ মেলে না। তার আগেই টর্চের জোরালো আলো এসে পড়ে চিকনের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভীত কণ্ঠে চিৎকার শোনা যায় ‘সাপ সাপ!’
অমনি হালদার বাড়ির দিক থেকে দৌড়ে আসে আলো এবং লাঠি সোটা হাতে কয়েকজন লোক। লোকগুলো ঘিরে ফেলতে থাকে সাপটাকে।
চিকন নজর করল, বাঁ পাশে একটা ঝোপ। ওই ঝোপের তলা দিয়ে পালানো যায়। কিন্তু তার আঁতে ঘা লাগল এভাবে পালাতে। এ যে কাপুরুষের কাজ।
হালদার বাড়ির বাস্তু সাপ সে। অকারণে হিংসা করা তার বারণ। তবে সে গোলাপনাগ গোখরো। দুনিয়ায় ভয় করে না কাউকে। কেউ সাধ করে তেড়ে মারতে এলে পিছু হটে লুকিয়ে পালায় না। রুখে দাঁড়ায়।
পলকে হাত দেড়েক খাড়া হয়ে ফণা মেলে দুলতে দুলতে তীব্র রাগ ও ক্ষোভে হিসহিসিয়ে গর্জে ওঠে চিকন। বলতে থাকে তার ভাষায় ‘আমায় যেতে দাও। পথ ছাড়ো। আমি তো মানুষের কিছু ক্ষতি করি না। তোমরা অযথা আমার পেছনে লেগেছ কেন?’
কিন্তু ঝগড়াটে নিষ্ঠুর মানুষগুলো চিকনের অনুরোধে কান দিল কই? সহসা এক টুকরো বড়ো ইট উড়ে এসে সাপটার গা ঘেঁষে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল সজোরে। লোকগুলোর কেউ ছুড়েছে ইটটা। অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।
চিকন বুঝল যে বৃথা চেষ্টা। এরা ভালো কথার লোক নয়। সে এবার ভয়ংকর ফুঁসে উঠে ধেয়ে গেল সামনে পথ আগলে থাকা মানুষটার দিকে। যে তাকে প্রথম দেখেছিল।
সাপের ওই রুদ্র মূর্তি দেখে লোকটা ‘বাপরে’ বলে এক লাফে ছিটকে পড়ল সাত হাত দূরে। পথ খোলা পেয়ে মুহূর্তে চিকন মাথা নামিয়ে এঁকেবেঁকে তীর বেগে ছুটে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
হালদার বাড়িতে চিকন আর ফিরল না। চিরকালের মতো বিদায় নিল।