সাঁকো ভূত রহস্য

সাঁকো ভূত রহস্য

ভবানী প্রেসের লাগোয়া ছোট্ট অফিসঘরে বসে এক সকালে কুঞ্জবিহারী সামনের টেবিলে দুম করে এক কিল বসিয়ে বলে উঠলেন, বুঝলে দীপক, স্পেশাল টাইপ নিউজ চাই। এসব একঘেয়ে খবরে আর পোষাচ্ছে না। সেই বাজার দর, ট্রেন লেট, লোডশেডিং, রাজনৈতিক লড়াই— সব কাগজেই তো প্রায় একই জিনিস। লোকে আমার কাগজ বিশেষ করে পড়বে কেন? নতুন ধরনের খবর চাই। তবে তো পাঠক টানবে—

বোলপুর শহরে ভবানী প্রেসের মালিক কুঞ্জবিহারী মাইতি ‘বঙ্গবার্তা’ নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এটা তাঁর শখ। কারণ কাগজ চালিয়ে লাভের বদলে বরং লোকসানই হয়। তবে কুঞ্জবাবু দমেন না। ভবানী প্রেস থেকেই ছাপা হয় বঙ্গবার্তা। কুঞ্জবাবুই তার সম্পাদক। কুঞ্জবাবু নিজে যথাসম্ভব ঘুরে ঘুরে খবর জোগাড় করেন। এছাড়া তাঁর দু-তিনটি রিপোর্টার আছে। রিপোর্টাররাও শখের। এই কাজের জন্য বেতন মেলে না। বঙ্গবার্তা দেবেই বা কোত্থেকে? রিপোর্টাররা গ্যাটের পয়সা খরচ করেই সাংবাদিকতা করে। বড়োজোর মাঝে মাঝে বাস ভাড়া জাতীয় কিছু খরচ পায় কাগজের রোজগার বুঝে। দীপক রায় বঙ্গবার্তার এমনি এক রিপোর্টার।

কুঞ্জবাবুর বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোট্টা, শ্যামবর্ণ। একটু ছটফটে মানুষ। দীপকের বয়স বছর পঁচিশ। রং ফর্সা। সুশ্রী লম্বা দোহারা গড়ন। চালাক চতুর এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়।

দীপক গ্র্যাজুয়েট। লোহা-লক্কড়ের কারবার আছে তার বাবার। বাবা এবং দাদাই যা ব্যাবসাপত্তর দেখে। দীপক বড়ো একটা ওদিকে ঘেঁষে না। নিজের নানান শখ নিয়ে থাকে। বঙ্গবার্তার পিছনে অনেকখানি সময় দেয়। তার মনে একটা গোপন আশা, ভবিষ্যতে নামকরা রিপোর্টার হবে। সে পকেটে পরিচয়পত্র রাখে। সেই কার্ডে ছাপা— দীপক রায়। সাংবাদিক।

—‘কী, ভাবলে কিছু?’ কুঞ্জবিহারী সামনে বসা দীপককে প্রশ্ন করলেন।

—আজ্ঞে।’ দীপক মাথা চুলকোয়, ‘কই তেমন কিছু—’

—‘যাও-না একবার নসিপুরে’, বললেন কুঞ্জবিহারী, ‘খোঁজ করে এসো ভব সরকারের জামাই-এর গল্পটা সত্যি কি না?’

—‘কী গল্প?’

—‘সাঁকো ভূতের।’

—‘অ্যাঁ, ভূত!’

—‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ভূত। ভূত কি কিছু খারাপ সাবজেক্ট? হতে পারে এটা বিজ্ঞানের যুগ। কিন্তু ভূতের দর কি কিছু কমেছে? মনে তো হয় না। তা নইলে ভূত বা অলৌকিক বিষয় নিয়ে আজও এত লেখালেখি হয় কেন?’ কুঞ্জবাবু তেতে উঠলেন।

—‘আজ্ঞে ব্যাপারটা কী?’ জানতে চাইল দীপক।

ব্যাপারটা হল, নসিপুর গ্রামের একদিকের সীমানায় একটা খাল আছে। খালের ওপরে আছে একটা সাঁকো। কিছুদিন যাবৎ কোনো লোক রাতে ওই সাঁকো পেরোতে গেলেই ভূত-টুত জাতীয় কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে সাঁকো থেকে। যে ধাক্কা মারছে কেউ তাকে দেখতে পায়নি। ভব সরকারের জামাই-এর মাসির বাড়ি ওই গাঁয়ে। সে বেচারা জানত না ব্যাপার। মাসির কাছে গিছল একটা কাজে। গাঁয়ে পৌঁছতে রাত হয়ে গিছল। ওই সাঁকো পেরিয়ে ঢুকছিল গাঁয়ে। হঠাৎ এক ধাক্কা খেয়ে পড়ে নীচে। ভাগ্যিস অল্প জল আর কাদা ছিল খালে। তাই লাগে-টাগেনি। তবে মেন্টাল শকটা খুব লেগেছিল। ভয়ে নসিপুরের লোক রাতে আর ওই সাঁকো পেরোচ্ছে না। ব্যস, এর বেশি আমি আর জানি না কিছু। ভবর জামাই গতকাল এসেছিল ভবর বাড়িতে। সাঁকো ভূতের গল্প করে গেছে। আমার গিন্নি শুনেছে নিজের কানে। তুমি চলে যাও নসিপুর। ব্যাপারটা যাচাই করে এসে রিপোর্ট দাও। জব্বর স্টোরি হবে।’

কাগজের লোকেরা খবরকে যে কেন স্টোরি বলে? ভাবল দীপক। সে জিজ্ঞেস করল, ‘নসিপুর কোথায়?’

—‘নানুরের একটু আগে। বাস রাস্তা থেকে মাইল দুই যেতে হয় ভিতরে মেঠো পথে। ওই গ্রামে আমার একজন চেনা আছে। দরকার হলে রাত কাটাতে পারবে তার বাড়িতে।’

—‘কিন্তু ভূত-প্রেতের ব্যাপারে নাক গলানো কি উচিত হবে?’ মাথা নেড়ে বললেন, বৃদ্ধ কম্পোজিটর দুলালবাবু। এতক্ষণ তিনি কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন সব কথাবার্তা।

—‘আপনি থামুন তো, ধমকে দিলেন কুঞ্জবিহারী, রিপোর্টারের কাজ অত সোজা নয়। কত রিস্ক নিতে হয় জানেন? দরকার হলে জঙ্গলে ঢুকতে হয়, পাহাড়ে চড়তে হয়, সমুদ্রে নামতে হয়, গোলাগুলির মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হয়।’

—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি কাল যাব নসিপুর।’ কুঞ্জবাবুর বক্তৃতায় উৎসাহিত দীপক সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়ল।

—‘আমি তাহলে এ হপ্তায় দু-লাইন ছেপে দিচ্ছি বার্তায়’, চেঁচিয়ে বললেন কুঞ্জবাবু, ‘নসিপুরের ভূতুড়ে সাঁকো— মানে যেটুকু শোনা গেছে। ফিল্ড তৈরি করে রাখি। পরে বেরুবে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতার বিবরণ। একটা বিশেষ সংখ্যায়।’

ভূত আছে কি নেই? তাই নিয়ে দীপক এ যাবৎ তেমন মাথা ঘামায়নি। ভূতের ভয়ে সে কাবু হয়নি কখনো। আবার ভূত নেই প্রমাণ করতে শ্মশানে মশানে যাবার দুঃসাহসও দেখায়নি।

বাড়িতে দীপকের দু-টি ভক্ত আছে। একটি ভাইপো এবং একটি ভাইঝি— বড়দার ছেলে-মেয়ে। পনেরো বছরের ছোটন এবং বারো বছরের ঝুমা। দীপক তাদের কাছে একবার সমস্যাটা তুলল– ‘কীরে ভূত আছে, না নেই?

—‘ফুঃ!’ উড়িয়ে দিল ছোটন।

ঝুমা বলল, ‘ভূত আছে বৈকি কাকু। কত লোক বলেছে। বেশি চালাকি করলে দাদাটা বুঝবে একদিন ঠেলা।’

দীপক কোনো মন্তব্য করল না।

সকাল দশটা নাগাদ নসিপুরে পৌঁছল দীপক। কুঞ্জবাবুর পরিচিত কেষ্ট ঘোষের সঙ্গে দেখা করে দিল কুঞ্জবাবুর চিঠি এবং নিজের কার্ড।

—‘অ্যা, সাংবাদিক!’ কেষ্ট ঘোষের চোখে মুখে সম্ভ্রম ফোটে, ‘কী উদ্দেশ্যে আগমন? কী খবর চান?’

দীপকের যাওয়ার আসল উদ্দেশ্যটা লেখেননি কুঞ্জবাবু। তাতে অযথা ঝঞ্ঝাট বাড়বে। সবাই প্রাণ ভরে দীপকের কানে ভূতুড়ে গুজব ঢালবে। দীপককে কৌশলে যাচাই করতে হবে সাঁকো ভূতের কাহিনি। চিঠিতে ছিল— কিছু খবর নিতে যাচ্ছে দীপক। তাই দীপক বলল, ‘আপনাদের গ্রামে যে কয়েকটা পানীয় জলের নলকূপ বসানোর কথা ছিল সেগুলো কদ্দূর এগোল খোঁজ নিতে এসেছি।’

দেখতে দেখতে দীপককে ঘিরে ভিড় জমে গেল। পানীয় জল, চাষবাস এবং আরও অনেক গ্রামের সমস্যার কথা শুনতে হল দীপককে

কেষ্ট ঘোষ মানুষটি ভালো। আগে কখনো কোনো জ্যান্ত রিপোর্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি, তাই দীপককে পেয়ে বেজায় খুশি। ভিড় একটু পাতলা হতে দীপক বলল, ‘ধারে কাছে দেখবার মতো কী কী আছে?’

কেষ্টবাবু বললেন, ‘আছে বৈকি। ডাকাতে কালীমন্দির। মহাবট। ওঃ, সে কী গাছ! অন্তত দেড়শো বছরের পুরোনো। চার-পাঁচ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে। এসেছেন যখন, দেখে যান। সাইকেল চালাতে পারেন তো? যাব দুজনে।’

এমনি সুযোগ খুঁজছিল দীপক। তক্ষুনি রাজি হয়ে গেল। ঠিক হল দুপুরে কেষ্টবাবুর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে বেরুনো যাবে। কেষ্টবাবুকে একটু একলা পেতেই দীপক জিজ্ঞেস করল— ‘আচ্ছা, আপনাদের গ্রামে নাকি ভূতুড়ে উপদ্রব হচ্ছে? কোন একটা সাঁকোর ওপর?

—‘হুঁ, কে বলল?’ জবাব দিলেন কেষ্ট ঘোষ।

—‘কুঞ্জবাবুর প্রতিবেশী ভবনাথ সরকারের জামাই। তার এই গাঁয়ে মাসির বাড়ি। সে নাকি স্বয়ং পড়েছিল ভূতের খপ্পরে। আমি অবশ্য নিজে শুনিনি, কানে এসেছে। কুঞ্জবাবুও শুনেছেন, এ ধরনের গুজব অবশ্য খুব ছোটে। তিল থেকে তাল হয়। সত্যি বলতে কি, এইসব ভূত-ফুতে আমার বিশ্বাস হয় না মশাই।’ কেষ্ট ঘোষ বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে ব্যাপার যা ঘটছে মোটেই উড়িয়ে দেওয়া চলে না।’

—‘কী ব্যাপার বলুন তো?’ দীপক খুব আগ্রহ দেখাল।

কেষ্টবাবু যা বললেন তা মোটামুটি কুঞ্জ মাইতির বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেল। অতিরিক্ত যা জানা গেল তা হচ্ছে— ধাক্কা নয়, ভূতে নাকি থাপ্পড় মেরে সাঁকো থেকে ফেলে দিয়েছে দুজন গ্রামের লোককে এবং ভব সরকারের জামাই মথুরাকে। গ্রামের যে দুটি লোক সাঁকো ভূতের চড় খেয়েছে তাদের একজনের নাম হারু দাম, অন্যজন নিতাই দত্ত। লোক দুটির বাড়ির হদিস জেনে নিল দীপক। তারপর কেষ্ট ঘোষকে বলল, ‘চলুন-না, সাঁকোটা একবার দেখে যাই। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।’

নসিপুরের পুব পাড়ার সীমানা ছাড়িয়ে চোখে পড়ল একটা খাল। প্রায় কুড়ি ফুট চওড়া, ছ ফুট গভীর খালটা গ্রামের পুব দিক ঘেঁষে সোজা চলে গেছে মাঠ ভেদ করে। কেষ্ট ঘোষ বললেন, ‘এদিকটায় ঢালু, তাই গাঁয়ের ভিতরকার জল গড়িয়ে এসে পড়ে এই খালে। ফলে ভরা বর্ষায় খালে দু-তিন হাতের মতো জল থাকে। এখন ভাদ্র মাস। বৃষ্টি কম। তাই খালে জল প্রায় নেই।

খালের ধারে ধারে খানিক হেঁটে গিয়ে কেষ্ট ঘোষ দেখালেন— ‘ওই যে সেই সাঁকো।’

সাঁকো বলতে লম্বা দুটি খেজুর গাছের গুঁড়ি গায়ে গায়ে ফেলা, ব্যস। ধরবার রেলিংটেলিং-এর বালাই নেই। গুঁড়িগুলোর ওপর দিকটা চাঁচা। যাতে পায়ে না লাগে।

কেষ্ট ঘোষ জানালেন, পুব পাড়ার মানুষ বাস থেকে নেমে খানিক আলে আলে এসে এই সাঁকো দিয়ে গাঁয়ে ঢুকলে শর্টকাট হয়। লোকে পুব দিকের মাঠে কাজ করতেও যাওয়া-আসা করে এই সাঁকো পেরিয়ে। নইলে গোরুর গাড়ির পথে গাঁয়ে ঢুকতে একটু ঘুর হয়। তা এখন সবাই সন্ধ্যার পর ঘুরেই আসছে। নেহাত কাদায় পড়ায় কারও তেমন লাগেনি বটে কিন্তু বড়ো দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ?

সাঁকো থেকে হাত পঁচিশ তফাতে গ্রামের দিকে খালপাড়ে একটা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। গাছটার দিকে চেয়ে দীপক ভাবল, এই গাছটাতেই ভূতের আস্তানা হওয়া বিচিত্র নয়। সে কেষ্ট ঘোষকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, এই উৎপাতের কারণটা কী? মানে কার ভূত? আন্দাজ করেছেন কিছু?’

কেষ্ট ঘোষ ভীত দৃষ্টিতে একবার পিছনে তাকিয়ে বললেন, ‘মনে হয় এ খোঁচা মিত্তিরের প্রেতাত্মা।’

—‘খোঁচা মিত্তির!’

—‘হুঁ, ওই যে ভিটে’, শখানেক হাত দূরে বড়ো বড়ো গাছ ও ঝোপঝাড়ে ভরা একটা ছোটো মাটির বাড়ি দেখালেন কেষ্ট ঘোষ, মাস ছয়েক আগে বুড়ো অক্কা পেয়েছে। এমন হাড়কঞ্জুস আর ঝগড়াটে লোক দেখা যায় না। গাঁয়ে কারো সঙ্গে ওর সদ্ভাব ছিল না। একটি মাত্র ছেলে, সেও পৃথক হয়ে অন্য জায়গায় বাস করছে। কখন কী ভাবে ও মারা গেছে কেউ জানে না। দুদিন ঘর থেকে বেরুচ্ছে না দেখে লোকে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে বিছানায় মরে পড়ে আছে। ডাক্তার বলেছে, সন্ন্যাস রোগ। ওই ভিটেতে এখন কেউ থাকে না। ওর ছেলেকে বলেছি, বাপের নামে গয়ায় পিণ্ডি চড়াতে। ছেলের গরজ নেই। দেখি তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

—‘তা এই সাঁকোয় চড়লে খোঁচা মিত্তিরের ভূতের চটবার কারণ কী?’ জানতে চাইল দীপক।

—‘আছে, আছে, কারণ আছে’, বললেন কেষ্টবাবু, ‘এই সাঁকোর সামনে খালপাড়ের খানিকটা জমি ও দখল করার তালে ছিল। গাঁয়ের লোক বাধা দেওয়ায় আর পারেনি। হয়তো সেই রাগে— ‘

দীপক সাঁকোটার ওপর দিয়ে হেঁটে একবার ওপারে গিয়ে তখুনি আবার ফিরে এল। কেষ্ট ঘোষ বললেন, ‘দিনে নয়, ভয় রাত্তিরে।’

দুপুরে মহাবট ও ডাকাতে কালী দেখতে যাওয়ার সময় দীপক খুঁতখুঁত শুরু করল, ‘ফিরতে যদি দেরি হয়ে যায়, বোলপুরের বাস পাব তো?’

কেষ্ট ঘোষ বললেন, ‘দেরি হলে না হয় এই গরিবের বাড়িতেই কাটাবেন রাতটা। আমাদের ঘরে ইলেকট্রিক লাইট বা ফ্যান নেই, তবে দেখবেন মাটির বাড়ির দোতলা কেমন ঠান্ডা আর বাতাসও খুব

দীপক তাই চাইছিল। খুশি হয়ে বলল, ‘বেশ, তবে আজ রাতটা আপনার আশ্রয়েই কাটাব। তাহলে আর ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করতে হবে না। ধীরে সুস্থে দেখা যাবে।’

মহাবট ও ডাকাতে কালী দেখে নসিপুরে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে, সন্ধ্যার মুখে দীপক কেষ্টবাবুকে বলল, ‘আমি একবার গাঁয়ের মধ্যে বেড়িয়ে আসি। দু-চারজনের সঙ্গে কথা বলব। না না, আপনাকে যেতে হবে না সঙ্গে। আপনার এই পুত্রটিকে নিয়ে যাচ্ছি। দু-একটা বাড়ি দেখিয়ে দিয়েই চলে আসবে।’ সে কেষ্ট ঘোষের দশ বছরের ছেলে বুবাইকে কাছে টেনে নিল। কেষ্টবাবু ক্লান্ত হয়েছিলেন। সঙ্গে যেতে তাই আর জোরাজুরি করলেন না।

হারু দামের বাড়ি চিনে নিয়েই দীপক বুবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল।

সাঁকো ভূতের কথা তুলতেই প্রৌঢ় ভালো মানুষ হারু যেন কেঁপে উঠল। সেই ভূতুড়ে চড়ের বর্ণনা দেওয়া তার সাধ্যে কুলাল না। বারবার শুধু বলতে লাগল, ‘উঃ, খুব বেঁচে গেছি। খোঁচা মিত্তিরের রাগ ছিল আমার ওপর। ফের ওর পাল্লায় পড়লে হয়তো প্রাণটাই খোয়াব।’

এরপর দীপক গেল নিতাই দত্তর কাছে।

যুবক নিতাইয়ের ধারণা, খোঁচা মিত্তির নয়, এ আসলে ব্যাচারামের ভূত। ব্যাচারাম ছেলেটা ভারি দুরন্ত ছিল। গত বছর তাল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মারা যায়। পিণ্ডিটা ওর নামেই দেওয়া উচিত। কারণ থাপ্পড়টা হালকা হাতের, যেন ছোটো ছেলের চড়। তেমন জোর নেই। তবে গা শিউরনো বটে।

—‘সাঁকো ভূতের হাতে প্রাণের ভয় আছে কি?’ জিজ্ঞেস করল দীপক।

—’নাঃ।’ নিতাই ঘাড় নাড়ল, তবে সাঁকোর তলায় খালের ভিতর ঝোপে বিষাক্ত সাপ থাকতে পারে। বেটাল হয়ে তাদের ঘাড়ে পড়লেই খতম।

নিতাই দত্তর ইন্টারভিউ সাঙ্গ করে দীপক ধীরে ধীরে পুব পাড়ার দিকে হাঁটা দিল। তার বুকটা দুরদুর করছে। এবার হাতে-কলমে পরীক্ষা।

খোঁচা মিত্তিরের পোড়ো বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দীপকের রীতিমতো গা ছমছম করতে লাগল। ওইটাই এদিককার শেষ বাড়ি। সন্ধ্যার পর এ-ধারটা যে এত নির্জন হয়ে যায়, সে ভাবতে পারেনি। আকাশ মেঘলা। তাই হালকা চাঁদের আলোটুকুও ফোটেনি। টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে সে এগোয়। তীক্ষ্ণ অদ্ভুত স্বরে কী জানি দুবার ডেকে উঠল কাছেই। দীপক কাঠ। টর্চ ঘুরিয়ে দেখল পাশের ঝোপগুলোয়। সে মোটেই ভীতু নয়। কিন্তু এই জনহীন নিস্তব্ধ জমাট অন্ধকার— এই অস্বস্তিকর পরিবেশ তার মনে রীতিমতো ছাপ ফেলে।

সাঁকোর মুখে গিয়ে দীপক চারধারে একবার টর্চের আলো ফেলল। বিশেষত তেঁতুল গাছটার গায়ে। হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে গাছে গাছে, ঝোপেঝাড়ে খসখস খুটখাট। আলো নিভতেই আঁধারে আরও চেপে ধরে। সাঁকোর ওপর চড়তে দীপকের আর পা সরে না। শেষে মনে জোর এনে সে উঠে পড়ল সাঁকোয়।

সাঁকোর ওপর আলো ফেলে পা টিপে টিপে এগোয় দীপক। সাঁকোর গুঁড়ি দুটো মিলে বড়োজোর হাতদেড়েক চওড়া। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় একটু পিছল। দিনের বেলা অবশ্য এটার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে দীপকের কোনো অসুবিধে হয়নি। এখন কিন্তু বেশ ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে পা ফসকালেই পড়বে কোন অতল খাদে।

দীপক সাঁকো পেরিয়ে গেল। কই ঘটল না তো কিছু? সে একইভাবে ফিরতে শুরু করল।

প্রায় শেষাশেষি এসে গেছে, হঠাৎ শুনল পিছনে মৃদু সোঁ সোঁ আওয়াজ এবং পরক্ষণেই তার বাঁ কানের ওপর পড়ল একটা সজোর চাপড়। মারটা এত জোরালো নয় যে তার ধাক্কায় দীপক মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকলে পড়ে যেত কিন্তু সেই অপার্থিব স্পর্শ তাকে এমন চমকে দিল যে একটা চাপা আর্তনাদ করে সে টলে গেল। প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করেও পারল না। সাঁকো থেকে পড়ল নীচে।

কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে বসে থেকে দীপক উঠে দাঁড়াল। কোমর অবধি জলকাদায় মাখামাখি। নাঃ, ব্যথা বেশি লাগেনি। শুধু ডান কনুইটা একটু ছড়ে গেছে। টর্চটা কিছু দূরে পড়ে জ্বলছে তখনো। টর্চটা কুড়িয়ে নিয়ে আগাছা সরিয়ে সে সাবধানে উঠে এল পাড়ে। মগজটা একটু সাফ হতে ভাবতে চেষ্টা করল— ঠিক কী কী ঘটেছে? আবছা মনে পড়ল, ঠিক পড়ে যাওয়ার আগে কী যেন একটা চোখে পড়েছিল! এক টুকরো গাঢ় কালো ছায়ার মতন কী যেন মাথার ওপর দিয়ে ভেসে মিলিয়ে গেল অন্ধকার ফুঁড়ে। কী ওটা! ওই কি সাঁকো ভূত?

কেষ্ট ঘোষ দীপককে দেখে আঁতকে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার মশাই?’

দীপক লাজুক হেসে জানাল, ‘পথে এক জায়গায় কাদা ছিল, পা হড়কে পড়ে গেছি।’

কেষ্টবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আসুন, আসুন। হাত-পা ধুয়ে ফেলুন। ধুতি দিচ্ছি, প্যান্টটা ছেড়ে ফেলুন। ওটা ধুয়ে দিতে বলি।’

পরদিন দীপককে দেখে সম্পাদক কুঞ্জবিহারী প্রশ্ন করলেন, ‘নসিপুরে গিছলে?’

—‘হুঁ, গিয়েছিলাম’, জবাব দিল দীপক।

—‘কী খবর?’

—‘ইনভেস্টিগেশন চলছে।’ গম্ভীর ভাবে জানাল দীপক।

কুঞ্জবাবু আর তাকে ঘাঁটালেন না।

দুদিন বাদে দীপক ছোটনকে নিয়ে দুপুরবেলা ফের নসিপুরে হাজির হল। কেষ্টবাবুর সঙ্গে দেখা করল। বলল, ‘ইটি আমার ভাইপো। ওকে মহাবট, ডাকাতে কালী এইসব দেখাতে নিয়ে এলাম। আমার কাছে গল্প শুনে অবধি খুব ধরেছিল নিয়ে যেতে।… না-না, আপনাদের কারো সঙ্গে যাওয়ার দরকার নেই। আমি তো পথ চিনে গেছি। সাইকেলে নয়, হেঁটে যাব। আমাদের পক্ষে এবড়োখেবড়ো মেঠো পথে সাইকেল চালানো মুশকিল। ও আপনাদের অভ্যেস আছে। কী এমন পথ? মাইল দু-তিন বড়োজোর। ফিরতে দেরি হলে আপনার বাড়িতে বরং আজ রাতটা অতিথি হব।’

—‘বিলক্ষণ, বিলক্ষণ, এ তো আমার সৌভাগ্য।’ জানালেন কেষ্ট ঘোষ।

—‘আমার এই ভাইপোটির গুণ আছে’, বলল দীপক, ‘নানা জীবজন্তুর ডাকের নকল করতে পারে। শোনাবেখন আজ রাতে। ফিরতে সন্ধে হলে চিন্তা করবেন না। টর্চ আছে আমাদের। একটা শক্তপোক্ত লাঠি যদি দেন— তাহলেই ব্যস।

দীপক সত্যিসত্যি মহাবট ও ডাকাতে কালী দেখাবার লোভ দেখিয়ে টেনে এনেছে ছোটনকে। কিন্তু সাঁকো ভূতের কথা ঘুণাক্ষরেও জানায়নি।

মহাবট ডাকাতে কালী ইত্যাদি দেখে নসিপুরে ফিরতে দীপক ইচ্ছে করেই দেরি করল। সেই অভিশপ্ত সাঁকোর কাছে যখন পৌঁছল তখন রাত নেমে গেছে। তবে আকাশে এক ফালি চাঁদ থাকায় অন্ধকার একটু ফিকে।

দীপক সাঁকোর গায়ে আলো ফেলে ছোটনকে বলল, ‘এর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারবি?’

ছোটন বলল, ‘কেন?

—‘গাঁয়ে ঢুকতে শর্টকাট হবে।’

ছোটন সন্দিগ্ধ ভাবে সাঁকোটাকে লক্ষ্য করতে লাগল।

—‘ভয় নেই, পড়লে হাড়গোড় ভাঙবে না।’ উৎসাহ দিল দীপক, ‘দেখি তোর ব্যালান্স কেমন?’

—‘দিনের বেলা অনায়াসে’– বিড়বিড় করে ছোটন।

—‘আরে দিনে তো যে-কেউ পারে। এ গাঁয়ের লোক নাকি এটা সাইকেলে পেরিয়ে যায় দিনে। রাতে পেরোনোই তো শক্ত। অবশ্য ভয় করলে থাক। আমি কিন্তু পেরোতে পারি এখন।’

—‘অলরাইট—’ আঁতে ঘা লাগাতে ছোটন বীরদর্পে সাঁকোর ওপর পা দিল। তবে দু পা গিয়েই সে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়ল। সাবধানে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল টর্চের আলো ফেলে।

দীপক একটু পিছিয়ে গিয়ে মাটিতে উবু হয়ে বসল। তার স্নায়ু টানটান উত্তেজনায় নিজের হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি কানে বাজছে।

সাঁকোর মাঝামাঝি পৌঁছেছে ছোটন— হঠাৎ সপাৎ সপাৎ করে একটা আওয়াজ। অমনি ‘বাপরে’ বলে আর্তনাদ করে ছোটন টলে পড়ল সাঁকো থেকে। মুহূর্তে দীপকের হাতের টর্চ জ্বলে উঠল। তীব্র আলোর ঝলক সার্চ লাইটের মতো অন্ধকার ভেদ করে বারকয়েক ঘোরাফেরা করল।

—‘কাকু, ও কাকু।’ ছোটন কয়েকবার কাতর স্বরে ডাকার পর সাড়া দিল দীপক, ‘কীরে, লাগেনি তো?’

—‘না। কিন্তু টর্চটা যে কোথায় পড়েছে—’

ওপর থেকে আলো ফেলল দীপক। দেখা গেল ছোটনের পায়ের কাছেই পড়ে আছে তার টর্চ।

পাড়ে উঠে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল ছোটন। হাঁপাচ্ছে সে। ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা কী কাকু, আমায় মারল ঘাড়ে?’

দীপক গম্ভীর গলায় জবাব দিল, ‘সাঁকো ভূত।’

—‘অ্যা ভূত!’ চমকাল ছোটন, ‘তুমি জানলে কী করে?’

—’জানি। আমিও ওর চড় খেয়েছি যে।’

—‘অ্যাঁ কাকু, তুমি জেনেশুনে আমায় সাঁকোয় তুললে!’ ছোটন কাঁদো-কাঁদো।

—‘কেন, সেদিন যে খুব বড়াই করছিলি, ভূত মানি না?’

ছোটন শিউরে উঠে নিজের মনে বলল, উঃ, তাই কী বিশ্রী ঠাণ্ডা হাত! দীপক বলল, ‘ছোটন, তুই বা আমি যে সাঁকো ভূতের চড় খেয়েছি এ কথা খবরদার এখন বলবিনে কাউকে। ওখানে একটা টিউবওয়েল আছে, যতটা পারিস ধুয়ে মুছে সাফসুফ হয়ে নে। তাও যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তোর গায়ে কাদা লাগল কী করে? বলবি, ধানক্ষেতে পড়ে গিছলি পা পিছলে।

—‘কেন? বলব না কেন?’

—‘কারণ আছে। কাল বুঝবি।’

পরদিন সকাল আটটা নাগাদ দীপক ও ছোটনকে দেখা গেল নসিপুরের ভূতুড়ে সাঁকোর কাছে তেঁতুল গাছটার তলায়। তাদের সঙ্গে একটি বছর বারো-তেরোর ছেলে। ছেলেটা কুচকুচে কালো। রোগা টিঙটিঙে। পরনে কেবল একটি হাফপ্যান্ট। ওর নাম কেলো। গাছে চড়তে ভারি ওস্তাদ। এই গ্রামেই বাড়ি। কেষ্টবাবুর ছেলে বুবাই জুটিয়ে দিয়েছে কেলোকে। ছোটন তার কাকুর মতলব কিছু আঁচ করতে পারছিল না। কেন এখানে? কী উদ্দেশ্যে? এ বিষয়ে দু-চারটে প্রশ্ন করেও সে উত্তর পায়নি কাকুর কাছে।

দীপক কেলোকে তেঁতুল গাছটা দেখিয়ে বলল, ‘ওঠ গাছে। যা বলেছি খুঁজে দেখবি ভালো করে। দু টাকা বকশিশ পাবি।

কেলো শুকনো মুখে তাকাল ওপরে। তার ভয়ের কারণটা স্বাভাবিক। সাঁকো ভূতের কথা গাঁয়ের কে না জানে? হয়তো এই গাছেই তার ডেরা। তবু গরিবের ছেলে দুটো নগদ টাকার লোভ ছাড়তে পারল না। বুঝি প্রাণের মায়া ত্যাগ করেই কেলো তেঁতুল গাছটার গুঁড়ি বেয়ে চড়তে শুরু করল। ক্রমে চলে যায় ডালপালার আড়ালে।

দীপক ও ছোটন চুপ। তারা ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকে। কেলোকে একটু আধটু চোখে পড়ছে কখনো। খুব রাগ হচ্ছিল ছোটনের। গরিবের ছেলেটাকে এইভাবে লোভ দেখিয়ে গাছে চড়ানো কি উচিত হল কাকুর! যদি কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়? হঠাৎ ওপর থেকে সরু গলায় চিৎকার শোনা গেল, ‘পেয়েছি বাবু।’

—‘বাসায় ছানা আছে কি?’ দীপক চেঁচাল।

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ’, উত্তর এল।

দীপক বলল, ‘ঠিক আছে, নেমে আয়। কাছে যাসনি, বিপদ হতে পারে।’ খানিকবাদেই কেলো সড়সড় করে নেমে এসে মাটিতে দাঁড়াল। তারপর একগাল হেসে দুহাত ছড়িয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এই এত বড়ো হুতুম।’

—‘কী কাকু?’ ছোটন উত্তেজিত হয়ে জানতে চায়।

—‘হুতুম প্যাঁচা ওরফে সাঁকো ভূত।’ দীপকের জবাব।

—‘মানে!’ ছোটন থ‍ই পায় না।

দীপক বলল, ‘মানে এই গাছের কোটরে প্যাঁচাটা বাচ্চা ফুটিয়েছে। এই সময় প্যাঁচা মায়ের মেজাজ ভীষণ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। কেউ তার বাসার কাছে গেলেই আক্রমণ করে। এও তাই সাঁকো দিয়ে কাউকে আসতে দেখলেই তেড়ে যেত। পাখার ঝাপটা মারত পিছন থেকে। লোকে ভাবত ভূতুড়ে চড়। প্যাঁচা কেবল রাতে বেরোয়। তাই আক্রমণটা হত রাত্তিরে। সেদিন ভূতুড়ে চড় খেয়েই আমার সন্দেহটা জাগে। মনে পড়ে যায়, এমনি ঘটনা আমি শুনেছি আগে।

‘কাল প্যাঁচাটা তোকে ঝাপটা মারা মাত্র টর্চ ফেলে দেখলাম— হুঁ, যা ভেবেছি ঠিক। এবং দেখলাম, ও সোজা উড়ে গিয়ে ঢুকল তেঁতুল গাছটার ভিতরে।

‘বুঝলি, এই হচ্ছে সাঁকো ভূত রহস্য।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *