ঘেঁচুমামার কল্পতরু

ঘেঁচুমামার কল্পতরু

ঘেঁচুমামার চিঠিটা পেয়ে নাড়ু বেশ ঘাবড়ে গেল। ঘেঁচুমামা লিখেছেন—

স্নেহের নাড়ু,

কেমন আছিস? ভালোভাবে বি. এ. পাস করেছিস জেনে খুশি হলাম। ডিসেম্বরে বড়োদিনের ছুটিতে কলকাতায় আড্ডা না দিয়ে বরং এখানে কদিন ঘুরে যা। এ যুগের এক আশ্চর্যতম আবিষ্কারকে স্বচক্ষে দেখতে চাস তো দেরি না করে চলে আয়।

ইতি তোর
ঘেঁচুমামা

পুঃ এখানে মুরগি বেজায় সস্তা।

ঘেঁচুমামা হচ্ছেন নাড়ুর ছোটোমামা। ঘোর বদরাগী ও খামখেয়ালি ঘেঁচুমামাকে আত্মীয়স্বজন যথাসাধ্য এড়িয়ে চলে। ঘেঁচুমামার এই খাপছাড়া স্বভাবের জন্য দায়ী তার একটি নেশা— গবেষণা।

ঘেঁচুমামা উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তাঁর কলকাতার বাড়ির একফালি জমিতে ও টবে তিনি নানান ফুলফলের গাছ লাগাতেন। নিত্য নতুন গবেষণা চালাতেন।

বাড়িতে লোকজন বেড়াতে আসা তিনি মোটে পছন্দ করতেন না। সঙ্গে ছোটো ছেলে-মেয়ে আনা তো রীতিমতো নিষিদ্ধ ছিল। তারা নাকি ঘেঁচুমামার রিসার্চ স্টেশনে (অর্থাৎ বাগানে) ঢুকে পড়ত। ফুল-ফল ছিঁড়ত। এরপর মাথা ঠান্ডা রেখে ভদ্রতা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ত।

এই গাছপালা নিয়ে রিসার্চের নেশা তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। নাড়ু শুনেছে, মাত্র বারো বছর বয়সে গ্রামের বাড়িতে বুনো মানকচুর কুটকুটুনি দূর করা নিয়ে ঘেঁচুমামা একটা এক্সপেরিমেন্ট করেন। সেই কচুর একটা বন্ধু মেধোকে দেন। বলেন, একদম কুটকুটে নয়, খেয়ে দেখিস। ওই কচু ভাতে খেয়ে মেধোর বাড়ির সবার গলা ধরে একাক্কার। ঘেঁচুমামার বাবার কাছে নালিশ করা হয়। পিটুনি খাওয়ার ভয়ে ঘেঁচুমামা পালিয়ে গিয়ে হাওড়ায় তাঁর মাসির বাড়িতে সাতদিন লুকিয়ে ছিলেন। তখনই মেধোর পিসিমা খেপে গিয়ে তাঁর নামকরণ করেন— বেচু পালটে ঘেঁচু; অতঃপর তাঁর এই ডাকনামটাই চালু হয়ে গেল।

ঘেঁচুমামার মাথা ছিল খুব সাফ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো ভালোভাবে উতরে গিয়ে তিনি কলকাতার একটা কলেজে অধ্যাপনা নিলেন। তবে গবেষণার নেশা কমল না, বরং বেড়েই চলল।

একবার তিনি কালীঘাটে নাড়ুদের বাড়িতে পাঁচ-ছটা কাঁচালঙ্কা পাঠান। সঙ্গে চিরকুটে লেখেন— সাবধান। লঙ্কাগুলো সাধারণ লঙ্কা থেকে একশো গুণ বেশি ঝাল। তাই পড়ে নাড়ুর বাড়ির সবাই খুব হাসাহাসি করল। তার থেকে মাত্র একটি লঙ্কা মাছের ঝোলে পড়েছিল। ব্যাস, সেই ঝোলমাখা ভাত এক গরাসের বেশি কেউ মুখে তুলতে পারেনি। বাপ রে, কী আগুন ঝাল!

‘উদ্ভিদ সমাচার’-এ ঘেঁচুমামা মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখতেন। সেইসব নিতান্ত মৌলিক গবেষণামূলক রচনার আবির্ভাবে বিজ্ঞানীমহলে দারুণ হৈ-চৈ পড়ে যেত। বিরূপ সমালোচনাই হত বেশি। ঠাট্টা-বিদ্রূপ কানে আসত। শেষটায় ঘেঁচুমামা সক্কলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় তুলেই দিয়েছিলেন। প্রবন্ধও আর লিখতেন না। এর কিছুদিন বাদে তিনি কলেজ ছাড়লেন। তারপর কলকাতাও।

কলেজে একঘেয়ে পাঠ্যপুস্তক পড়ানো। ঘেঁচুমামার নিতান্ত অপছন্দ ছিল। বরং তিনি ছাত্রদের উদ্ভিদবিজ্ঞানের নানা জটিল রহস্যের সুলুকসন্ধান দিয়ে তাদের মনে জ্ঞানপিপাসা জাগাবার চেষ্টা করতেন। ফলে পরীক্ষার কোর্স শেষ হত না এবং ফি বছরই এই নিয়ে অভিযোগ উঠত। তাছাড়া সহকর্মীদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে অষ্টপ্রহর তর্কযুদ্ধ লেগেই থাকত। বিরক্ত হয়ে ঘেঁচুমামা কলেজের কাজে ইস্তফা দিয়ে পুরোপুরি গবেষণায় মন দিলেন।

কিন্তু কলকাতায় থেকে শান্তিতে গবেষণা করা তাঁর বেশিদিন পোষাল না। কারণ পাড়ার লোকের সঙ্গে বেজায় খটাখটি লেগে গেল।

ঘেঁচুমামা তাঁর গাছপালার স্বাস্থ্যবিধির খাতিরে সকাল-সন্ধ্যা তাদের রাগ-রাগিণী শোনাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। বাগানে গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজত দৈনিক ভোরে ও সন্ধ্যায় কটা একই রেকর্ড শুনতে শুনতে পাশের বাড়ির লোকদের কান তো ঝালাপালা। এদিকে প্রতিবেশী-বাড়িতে দুপুরবেলা রেডিওতে সজোরে আধুনিক বা ফিল্মি গান চালানো বরদাস্ত করতে পারতেন না ঘেঁচুমামা। ওতে নাকি তাঁর গাছেরা চমকে যায়। তাদের শান্তি নষ্ট হয়। ফলে ঝগড়া বাধল। এবং ঘেঁচুমামার বাগানে অদৃশ্য হস্তে ইট-পাটকেল, ডিমের খোলা, তরকারির খোসা ইত্যাদি নিক্ষিপ্ত হতে থাকল।

তখন ‘দুত্তোর’ বলে ঘেঁচুমামা কলকাতা ছাড়লেন। বিহারের দুমকায় নিরিবিলিতে অনেকখানি জায়গা-ঘেরা একটা বাড়ি নিয়ে শহরের বিষাক্ত পরিবেশ থেকে দূরে তিনি নিশ্চিন্তে গবেষণায় মন দিলেন।

এসব হল বছর পাঁচেক আগেকার কথা। এরপর ঘেঁচুমামার খবর পাওয়া যেত কদাচিৎ। তবে মাঝে-মধ্যে তিনি নাড়ুকে এক-আধটা উটকো চিঠি ছাড়তেন। চিরকালই তিনি ভাগনে নাড়ুকে কিঞ্চিৎ লাই দিয়ে এসেছেন। বোধকরি নাড়ু তাঁর যুগান্তকারী বক্তব্যগুলো ধৈর্য ধরে শুনত বলে। নাড়ু কিছু বুঝত না ছাই। স্রেফ কিছু প্রাপ্তির আশায় ঘণ্টাখানেক কষ্ট করে চোখ বড়ো বড়ো করে শোনা এবং তালমাফিক মাথা নেড়ে সায় দেওয়ার পরে মামার কাছে ফুচকা আলুকাবলি মায় সিনেমার পয়সার জন্য আবেদন করলেও মঞ্জুর হয়ে যেত।

আপাতত চিঠিটা পেয়ে কী করা যায় ভাবতে থাকে নাড়ু। যাওয়াই যাক। নাড়ু মাকে ধরল। চিঠির কথাটা গেল চেপে। বলল, ‘ঘেঁচুমামার কাছ থেকে কদিন ঘুরে আসি। অনেকদিন দেখিনি। দুমকা জায়গাটা শুনেছি খাসা।’

মা নাড়ুর বাবাকে বলে অনুমতি আদায় করে দিলেন।

নাড়ুকে দেখে ঘেঁচুমামা খুশি হয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘এলি তাহলে। বেশ বেশ। এখন খা দা, ফুর্তি কর।’

চারটে দিন কাটল। ঘেঁচুমামার সংসারে মাত্র দুটি প্রাণী। ঘেঁচুমামা এবং তাঁর পুরোনো কাজের লোক গঙ্গারাম। ঘেঁচুমামা দিব্যি গল্পগুজব করেন। নাড়ুকে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন পাহাড়ে, মাঠে, নদীর ধারে। কিন্তু সেই আশ্চর্যতম আবিষ্কারের কথাটা আর তোলেন না। নাড়ু ছটফট করছে। শেষে বলেই ফেলল, ‘মামা, তোমার সেই আবিষ্কারটা?’

—‘হবে হবে। তাড়া কীসের? আচ্ছা বেশ কাল দেখাব,’ বললেন ঘেঁচুমামা।

পরের দিন বিকেলে চা খেতে খেতে ঘেঁচুমামা রহস্যময় আলাপ শুরু করলেন। ‘আচ্ছা নাড়ু, তোর নিশ্চয় বাগান করতে ভালো লাগে?’

কোনোদিন বাগান করার উৎসাহ না হলেও মামাকে খুশি করতে নাড়ু তক্ষুনি সায় দিল, ‘হ্যাঁ লাগে।’

—‘তোদের বাড়িতে তো একটুখানি জমি। বেশি গাছ লাগাবার উপায় নেই।’

–’হুঁ।’

—‘সত্যি ভারী মুশকিল।’

—‘কলকাতা শহরে কটা বাড়িতে আর অনেক গাছ লাগাবার জায়গা আছে?’ ঘেঁচুমামার ভাবনার মানে বোঝে না নাড়ু।

—‘আচ্ছা, তোর আম খেতে ভালো লাগে?’ জানতে চাইলেন ঘেঁচুমামা।

—ভীষণ।’ নাড়ুর তৎক্ষণাৎ জবাব।

—‘কিন্তু এখন আম পাবি কোথায়? কোল্ড-স্টোরেজে রাখা বাসি আম নয়। টাটকা, ফ্রেশ। চাইলেও পাবি না।’ হতাশভাবে মাথা নাড়েন ঘেঁচুমামা।

নাড়ু বলল, ‘তা চাইব কেন? এখন বুঝি আমের সময়? ও তো গ্রীষ্মের ফল।’ —’অর্থাৎ তোকে সেই গ্রীষ্মকাল অবধি হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে। কী সব বেআক্কেলে বন্দোবস্ত বল দেখি?’

নাড়ু বলল, ‘বাঃ, তাই তো নিয়ম।’

—‘নিয়মটা পালটাতে হবে,’ ঘেঁচুমামা দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেন, ‘শোনা যায় পুরাকালে মুনি-ঋষিরা তপস্যার বলে কল্পতরু নামে একরকম গাছ তৈরি করতেন। সেই গাছের কাছে যখন যা প্রার্থনা করা যেত তখনই নাকি তাই পাওয়া যেত। তা কলিযুগে সেরকম তপস্যার জোর আর নেই। কল্পতরুও তাই আর মেলে না। তবে হ্যাঁ, এখন হচ্ছে বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষের কিছুটা ইচ্ছাপূরণ করা চলে। আর এই বিজ্ঞান সাধনার হিম্মতেই আধুনিক যুগ লাভ করবে ব্যাচারাম চাটুজ্যের আশ্চর্যতম আবিষ্কার— কলির কল্পতরু দ্য ওয়ান্ডার।’

—‘সে আবার কী?’ নাড়ুর প্রশ্ন।

—‘আয় আমার সঙ্গে।’ উঠলেন ঘেঁচুমামা।

ঘেঁচুমামা নাড়ুকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে ঢুকলেন। প্রায় বিঘে দুই জমিতে নানা ফল-ফুলের গাছ। উঁচু পাঁচিল ঘেরা। এই এলাকায় ঘোরা ঘেঁচুমামার অপছন্দ জেনে এতদিন বাগানে পা দেয়নি নাড়ু।

বাগানের একধারে অনেকটা জায়গা তারের জাল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে পাশাপাশি তিনটে গাছ। তারে ঘেরা অংশটায় ঢোকার জন্য কাঠের ফ্রেমে জাল আটকানো দরজা। দরজায় তালা দেওয়া। চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘেঁচুমামা ভিতরে ঢুকলেন— পিছনে পিছনে নাড়ু।

থামলেন ঘেঁচুমামা। গাছ-তিনটের দিকে আঙুল দেখিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘এই। এই এরা হচ্ছে কল্পতরু। এদের কাছে কড়া পাকের সন্দেশ বা টেস্ট-ক্রিকেটের সিজন টিকিট আবদার করলে অবিশ্যি পাবি না। তবে ইচ্ছেমতো নানান ফল যখন-তখন খেতে পাবি। দেখ। ভালো করে দেখ—

দেখতে দেখতে নাড়ু থ। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। এগুলো আবার কী গাছ? একটা গাছেই এক-একটা ডাল এক-একরকম। তাতে আলাদা রকম পাতা— ফল।

প্রথম গাছটা প্রায় দেড়মানুষ উঁচু। তাতে ফলছে হরেক রকম লেবু। কোনো ডালে কমলা। কোনোটায় বাতাবি। কোনোটায় মোসাম্বি। কোনো ডালে বা পাতিলেবু।

পরের গাছটা অনেক বেঁটে। তাতে ফলেছে টমাটো। নানা জাতের লঙ্কা। আবার কয়েকটা বেগুনও ঝুলছে।

তৃতীয় গাছটা প্রথম গাছটা থেকে উঁচু। সেটায় গুঁড়ি থেকে বেরিয়েছে আম, আমড়া এবং কী এক অচেনা গাছের ডাল। ফল ধরেছে ডালে ডালে।

নাড়ুর মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।

ঘেঁচুমামা বললেন, ‘ঘাবড়ে গেছিস? লজ্জা কী? আমার কল্পতরু প্রথমে দেখলে অনেক বীরপুরুষেরই চক্কর লাগবে।’

‘কী করে বানালেন।’ নাড়ু গোল গোল চোখ করে জানতে চাইল।

‘প্লাস্টিক সার্জারির কায়দা,’ বললেন ঘেঁচুমামা, ‘নানান গাছের দেহ-কোষ জোড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে এক-একটা যৌগিক বৃক্ষ— মানে এই কল্পতরু। ব্যাপারটা জটিল। এত চট করে তোর মাথায় ঢুকবে না। তাছাড়া যাকে-তাকে বলে ফেলবি। এখুনি সব ফাঁস হয়ে যাবে। আগে পেটেন্ট নিই। তারপর এই বিষয়ে একখানা বই লিখব সোজা ভাষায়। তখনো পড়ে নিস। মোটকথা এখন থেকে আর আলাদা আলাদা গাছ লাগাবার ঝামেলা থাকবে না। প্রত্যেকটা গাছের জন্যে আলাদা আলাদা জমি, আলাদা তদবিরের দরকার নেই। বি. আর. চাটুজ্যের ফর্মুলা— ১০১ অ্যাপ্লাই করে যে যার পছন্দমতো হরেক রকম ফল একই গাছে ফলাতে পারবি। জমি বাঁচবে। সময় বাঁচবে। তাছাড়া ফলনের সময়গুলোও ইচ্ছেমতো পালটে দেব। গ্রীষ্মে আম তো এমনিই পাই। তখন বাজার থেকে আম কিনে খাওয়া যায়। আমার কল্পতরু ফলাবে শীতকালে আম। ওই দেখ।’

তৃতীয় গাছটার দিকে আঙুল দেখালেন ঘেঁচুমামা। ‘আর এই লেবুগাছটা দেখছিস? সব শীতে ফলবে। কমলা না হয় শীতের ফল। মোসম্বি, বাতাবি শীতে ফলাতে পারবি? আর-একটা কল্পতরু লাগিয়েছি, সব কটা লেবু গ্রীষ্মে ফলবে। তখন গরমকালে কমলা পাবি এক্কেবারে টাটকা গাছপাকা। আবার কিছু-কিছু ফল বারবার খেতে পাবি। সাধারণত বছরে হয়তো একবার ফলে। আমার কল্পতরুতে ফলবে বছরে দুবার, তিনবার।

‘তা বলে কি বাপু একই গাছে যা ইচ্ছে একসঙ্গে চাইলে পাবি? তা হয় না। মোটামুটি মিল আছে এমন সব গাছের মিশ্রণে এক-একটা কল্পতরু তৈরি সম্ভব। এই যেমন আপাতত তিনটে বানিয়েছি। কল্পতরু নাম্বার ওয়ান, টু অ্যান্ড থ্রি। আরও কত কল্পতরু আবিষ্কার হবে। শুধু ফলের নয়, ফুলের, সবজির। যে-সব উদ্ভিদের মধ্যে এখনও মিশ খাওয়াতে পারিনি, পরে হয়তো পারব। আমি না পারলে তুই পারবি।’

—‘আমি!’ নাড়ু আঁতকে ওঠে।

—‘হ্যাঁ। মানে তুই না হলেও অন্য কেউ। মানে যারা এই লাইনে রিসার্চ করবে আর আমাকে গুরুদেব বলে পেন্নাম ঠুকবে। হুঁ, এইবার দেখিয়ে দেব উদ্ভিদবিজ্ঞানের রথী-মহারথীদের ব্যাচারাম চাটুজ্যের দৌড় কদ্দূর। বুঝলি?’

ফূর্তির চোটে নাড়ুর কাঁধে ফটাস করে এক চাপড় কষিয়ে ঘেঁচুমামা বললেন, ‘চ, এখন একটু বেড়িয়ে আসি। তাহলে রাতে খিদেটা বেশ চাগবে।’

রাতে খেতে বসে ঘেঁচুমামা দুহাত ছড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘নাড়ু, আজ তোর জীবনে এক মহৎ দিন। জেনে রাখ, তুই হচ্ছিস প্রথম মানব যে আমার কল্পতরু ফল টেস্ট করার সৌভাগ্য অর্জন করবে। এ গ্রেট গ্রেট অনার। তোর নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে। গঙ্গারাম—’

অমনি গঙ্গারাম খাবার টেবিলে এনে সাজিয়ে রাখতে লাগল, রুটি মাংস টমাটো-স্যালাড, পুডিং এবং অনেক রকম ফল।

নাড়ু একখানা মুরগির ঠ্যাং তুলে কামড়ে দিতেই ঘেঁচুমামা বাধা দিলেন, ও-সব তো রোজই গিলছিস, আগে স্যালাড খা। টমাটোটা চাখ। কল্পতরু প্রোডাক্ট।’

টমাটো খেতে নাড়ুর ভালো লাগে না তাই এড়িয়ে যাচ্ছিল। নেহাত মামার কথায় বাধ্য হয়ে এক টুকরো মুখে পুরেই সে আর্তনাদ করে উঠল।

—‘কী হল?’ ঘেঁচুমামা ব্যস্ত হয়ে বললেন।

—‘উরিব্বাস, কী ঝাল!’

—‘ঝাল!’ ঘেঁচুমামা অবাক। ‘গঙ্গারাম কী ব্যাপার! স্যালাডে এত ঝাল কেন?’

—‘আমি তো বাবু মাত্তর আধাখানা লঙ্কা কুঁচিয়ে দিইচি। ঝাল হবে কেন?’ গঙ্গারাম ভেবে পায় না।

—‘মামা, এ নিশ্চয়ই তোমার সেই স্পেশাল ব্রান্ড। সেই একশো গুণ ঝাল লঙ্কা,’ নাড়ু বাতলায়।

—‘না না, সে লঙ্কা দিই নাই। সে লঙ্কা আলাদা করা আছে।’ গঙ্গারাম প্রতিবাদ জানায়।

‘নিশ্চয়ই ভুল করে মিশিয়ে দিয়েছে,’ ঘেঁচুমামা হুংকার ছাড়েন, ‘দিন-দিন তোমার ভীমরতি হচ্ছে। ঠিক আছে নাড়ু, তুই বরং আমটা টেস্ট কর। মিষ্টি আম। জিভের জ্বলুনি কমবে।’

এক চাকলা আম মুখে দিয়েই নাড়ু মুখ ভেটকাল— ‘এঃ, কী বিশ্রী খেতে।’

—’সে কী! ভালো জাতের ল্যাংড়া।’

ঘেঁচুমামা নিজে এক চাকলা আম তুলে কামড় দিয়ে নাড়ুর মতোই মুখ করলেন।

কেমন যেন আমড়ার টেস্ট, তাই না?’

—‘এ কোথাকার ল্যাংড়া?’ বলল নাড়ু।

-–‘আমড়া? হুম।’ ঘেঁচুমামা গম্ভীর।

কিছু ছাড়ানো কমলালেবু ছিল প্লেটে। তাই থেকে এক কোয়া মুখে ফেলেই থু-থু করে উঠল নাড়ু।— ‘ইশ, কী টক!’

—‘টক!’

—‘হ্যাঁ, যেন পাতিলেবুর মতন।’

—‘দেখি।’ ঘেঁচুমামা নিজে এক কোয়া কমলা খেয়েই থু করে ফেলে দিলেন। বললেন, ‘এই কমলা তো টক হবার নয়। আমার বাগানে আগেও ফলিয়েছি। চমৎকার মিষ্টি। কী ব্যাপার?’ ঘেঁচুমামা থই পান না।

নাড়ুর মাথায় একটা আইডিয়া এল। সে এক টুকরো পাতিলেবু তুলে চুষে বলল, ‘বাঃ, এতে যে কমলালেবুর টেস্ট।’ তারপর সে একটা কাঁচালঙ্কা তুলে সাবধানে দাঁতে কেটে বলল, ‘এঃ, কেমন টমাটোর মতো। দেখো খেয়ে।’

ঘেঁচুমামা লেবু ও লঙ্কা চেখে মাথা ঝাঁকালেন। ‘হুঁ ঠিক।’

—‘আমার কী মনে হচ্ছে জানো?’ বলল নাড়ু।

—‘কী?’

—‘মানে, স্বাদগুলো বোধহয় ওলটপালট হয়ে গেছে।’

—‘হুঁ, তাই। কিন্তু আমার এতদিনকার সাধনা? ওঃ সব গেল। ভেবেছিলাম কালই চিঠি ছাড়ব। ডেকে পাঠাব কয়েকজন সায়ান্টিস্ট আর কাগজের রিপোর্টারকে। দেখাব আমার আবিষ্কার। তাদের টেস্ট করাব আমার কল্পতরু প্রোডাক্ট। সব যে গুবলেট হয়ে গেল। ওফ!’

—‘তাতে কী, এও তো দারুণ আবিষ্কার। নতুন রকম টেস্ট। বলা যায় নতুন ফল আবিষ্কার।’ নাড়ু সান্ত্বনা দেয়।

—‘না না, ওসব নতুন-ফতুন বোঝে না লোকে। সবাই তো আর তোর মতন নয়। জানিস, একবার একটা নতুন সবজি বানিয়েছিলাম। আলু আর বেগুন মিশিয়ে। ভাবলাম, লোকে আলু-বেগুন ভাতে খেতে ভালোবাসে। তা এই একটাতেই কাজ চলবে। কষ্ট করে আর আলাদা আলাদা সিদ্ধ করে মাখতে হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, চলল না। আমার আলুবেগুন কোনো বেটার মুখে রুচল না। গঙ্গারামটা অবধি রিফিউজ করল। নাঃ, আবার আমায় নতুন করে ভাবতে হবে। রিসার্চ করতে হবে! স্বাদগুলো যেন ঠিকঠাক থাকে।’

ঘেঁচুমামা হাঁড়িপানা মুখ করে উঠে গেলেন।

এরপর ঘেঁচুমামার ওখানে আর জমল না। ঘেঁচুমামার গল্পগুজব বন্ধ। সারাদিন তিনি ল্যাবরেটরিতে বা বাগানে কাটান। নিজের মনে পায়চারি করেন। বিড়বিড় করে বকেন। খাবার টেবিলে একসঙ্গে বসলেও আনমনা। দুদিন একা-একা এদিক-সেদিক ঘুরে কাটিয়ে নাড়ু বাড়ি ফিরে গেল।

প্রায় আড়াই বছর বাদে ঘেঁচুমামার চিঠি পেল নাড়ু। লিখেছেন— ‘তোর সব কটা চিঠিই পেয়েছি। উত্তর দেবার সময় পাইনি। এক্সপেরিমেন্ট চলছে। দুটো নতুন কল্পতরু লাগিয়েছি। তাদের প্রথম ফলনটায় সামান্য গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কমলার টেস্ট বাতাবি লেবুর মতো আর টমাটোগুলো কেমন বেগুন- বেগুন খেতে হয়েছিল। কিন্তু এবার লঙ্কাগুলোয় এক্কেবারে খাঁটি লঙ্কার ঝাল। আর আমে আমড়ার স্বাদও অনেকখানি কমেছে। উপায় ভেবে ফেলেছি। খুঁতগুলো শুধরে ফেলব। আশা করছি শিগগিরি শিওর সাকসেস। তারপর গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন। এক্সপেরিমেন্ট সফল হলেই খবর দেব। পত্রপাঠ চলে আসিস।’

এরপর বহুদিন কেটে গেছে। ঘেঁচুমামার কাছ থেকে নাড়ু কিন্তু আর কোনো চিঠি পায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *