ড্রাগন ফ্লাই
সকালবেলা দৈনিক প্রভাতী সংবাদপত্রটা নিয়ে সবে মাত্র বসেছি এমন সময় ফোন বেজে উঠল। সুনন্দ ফোন করছে— ওরা মাত্র গতকালই নাকি কলকাতায় ফিরেছে। আমার প্রতি আদেশ হল যে সেদিনই বিকেলে ওর বাড়িতে হাজির হতে হবে— আড্ডা মারতে। অনেকদিন সে আড্ডা মারতে পারেনি।
সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
আমি জানতাম সুনন্দরা অর্থাৎ সুনন্দ এবং তার মামা নবগোপালবাবু দক্ষিণ আমেরিকার কোথায় জানি গিয়েছেন। সুনন্দ আমার স্কুলের বন্ধু। ও প্রাণীবিদ্যায় Msc. পাস করে প্রোফেসর নবগোপালবাবুর অধীনে গবেষণা করছে। নবগোপালবাবু একজন বিখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানী। অবশ্য আরও নানান বিষয়েও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। চিরকুমার নবগোপালবাবুর সংসারে ওই একমাত্র ভাগনে সুনন্দ ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। বালিগঞ্জে নবগোপালবাবুর নিজের বাড়িতে মামা-ভাগনের বাস।
বিকেলে সুনন্দের বাড়ি হাজির হলাম। আমায় দেখেই পরম উল্লসিত সুনন্দ দুর্বোধ্য ভাষায় হড়বড় করে কীসব বকে যেতে লাগল। গালমন্দ করাতে আপত্তি জানালে সুনন্দ বলল, সে নাকি রেড-ইন্ডিয়ান ভাষায় আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে।
গম্ভীর হয়ে জানাই যে ইন্ডিয়ান হলেও আমি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কাজেই বাংলোতেই কথাবার্তা হোক।
ড্রইংরুমে ঢুকে জুত করে বসলাম আড্ডা জমাতে। একটুক্ষণ পরে হঠাৎ দেয়ালের গায়ে ঝোলানো একটা শো-কেসের দিকে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হল। শো কেসের মধ্যে পিচবোর্ডের ওপর নীলচে পাখিওয়ালা ইঞ্চিতিনেক লম্বা মস্ত একটা ফড়িং পিন দিয়ে আটকানো রয়েছে। এটা আবার কোত্থেকে এল? আগে তো দেখিনি!
সুনন্দকে জিজ্ঞেস করি— ‘কী ব্যাপার। রেড ইন্ডিয়ান কায়দায় ঘর সাজানো হয়েছে বুঝি?
সুনন্দ বেশ চটে গেল। বলল, ‘আজ্ঞে না। এটা একটি স্মৃতিচিহ্ন। জেনে রাখ এদের কৃপাতেই সেদিন প্যামপাসের তৃণভূমিতে পৈতৃক প্রাণটা রক্ষা পেয়েছিল। আর এদের কল্যাণে কিছু অর্থপ্রাপ্তিও ঘটে গেছে।’
—‘তার মানে?’ আমি এবারে অথৈ জল। ‘দয়া করে খুলে বল।’ সুনন্দ ফড়িংটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওটা কি বল তো?’
—‘ফড়িং।’
—‘হুঁ। ড্রাগন-ফ্লাই।’
—‘আরে বাপ। সে আবার কী?’ আমার তো পিলে চমকানোর জোগাড়।
সুনন্দ আশ্বাস দেয়, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই বন্ধু। নামটা রাক্ষুসে হলেও এগুলো একজাতের বড়ো ধরনের ফড়িং-ই। নেহাতই নিরীহ। ভারতবর্ষে এবং পৃথিবীর আরও অনেক জায়গাতেই এদের পাওয়া যায়। বোধহয় লক্ষ্য করে থাকবি এই বাংলাদেশে বৃষ্টির ঠিক আগে বা পরে এইরকম ফড়িং ঘাসবনে ফরফর করে উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। অবশ্য আমাদের দেশে এতবড়ো ‘ড্রাগন ফ্লাই’ সাধারণত দেখা যায় না। দুজোড়া পাতলা ঝিল্লিযুক্ত পাখাওয়ালা এই-জাতীয় ফড়িংকে ইংরেজিতে ‘ড্রাগন ফ্লাই’ বলে।’
অধৈর্য হয়ে ওকে থামিয়ে দিই— ‘বুঝেছি, আপাতত ফড়িং-এর ওপর লেকচার বন্ধ রেখে ওই, প্রাণরক্ষা আর অর্থপ্রাপ্তি সম্বন্ধে কী যেন বলছিলি, সেটা খোলসা কর।’
সুনন্দ বলে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে তাই বলছি। তা তোরা হলি শহরের ছেলে। জীবজন্তুর সম্বন্ধে ধারণা কম। তাই ‘ড্রাগনফ্লাই’ সম্পর্কে একটু প্রাথমিক জ্ঞান বিতরণ করলাম। নে চা খা, আরম্ভ করছি।’
ইতিমধ্যে দুজনের সামনে ধূমায়িত চা পরিবেশন করা হয়েছিল। চায়ে এক চুমক মেরে সুনন্দ তার কাহিনি আরম্ভ করল।
বোধহয় জানিস আমরা দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেনটিনায় গিয়েছিলাম। আর্জেনটিনার দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমির জীবজন্তু নিয়ে গবেষণা করাই ছিল মামাবাবুর উদ্দেশ্য। ওই তৃণভূমির নাম ‘প্যামপাস’। পূর্বে ‘প্যারানা’ নদীর কিছু পর হতে আরম্ভ করে পশ্চিমে ‘আন্ডিস’ পর্বতমালার প্রায় পাদদেশ পর্যন্ত এবং উত্তরে ৩০ ডিগ্রি অক্ষরেখা থেকে দক্ষিণে কলোরাডো নদী অবধি প্রায় দশ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত এই প্রেরী-জাতীয় তৃণভূমি অঞ্চলে নানান বিচিত্ৰ পশুপক্ষী কীটপতঙ্গের বাস। কিছুদিন আগে মামাবাবু এই অঞ্চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু সময়ের অভাবে সেবার নাকি ভালো করে অনুসন্ধান করতে পারেননি।
আমরা জাহাজে চড়ে আর্জেনটিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ার্সে এসে হাজির হলাম। এখানে দিন তিনেক কাটালাম একটা হোটেলে। মামাবাবুর এখানে পরিচিতের সংখ্যা বড়ো কম নয়। বিশেষত তাঁর পুরোনো বন্ধু খনিজ ব্যবসায়ী মি. অ্যান্ডারসন তো রয়েছেনই।
এখান থেকে একটা বড়ো স্টেশন ওয়াগন ভাড়া করে তাতে নানারকম জিনিসপত্র বোঝাই করে আমরা প্যামপাসের দিকে যাত্রা করলাম। তৃণভূমিতে ঢোকবার ঠিক মুখে একটা ছোটো গ্রামে এসে থামলাম। এখানে একটা সরাইখানায় আমাদের কিছু মালপত্র জমা রেখে, তাঁবু, খাবারদাবার, জীবজন্তু ধরার জাল ও গবেষণার দরকারি কাগজপত্র ও যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে সেই মোটরে করেই আমরা প্যামপাসের অভ্যন্তরে যাত্রা করলাম।
এছাড়াও আমাদের সঙ্গে ছিল মামাবাবুর নিত্যসঙ্গী রাসায়নিক গবেষণার প্রয়োজনীয় কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র ভরা একটি ছোটো বাক্স।
আমরা তিনজন— আমি, মামাবাবু আর টমাস। টমাস মামাবাবুর পূর্বপরিচিত ওই অঞ্চলের আদিবাসী, গুয়াচো সম্প্রদায়ভুক্ত রেড ইন্ডিয়ান। অতি বিশ্বস্ত ও সাহসী সহচর। ওই ছিল আমাদের ড্রাইভার। আর তার ওপরে যা রান্নার হাত কী বলব!
প্যামপাসের ভিতরে প্রায় পঞ্চাশ মাইল ঢুকে গিয়ে পথচারীদের জন্য খোঁড়া একটা কূপের পাশে আমাদের তাঁবু পড়ল। গ্রীষ্মকাল, প্রায় সমস্ত তৃণভূমি ৭।৮ ফুট লম্বা শুষ্ক শ্বেততৃণদ্বারা আচ্ছাদিত। মাঝে মাঝে বাবলা-জাতীয় একপ্রকার কাঁটা ঝোপ।
জনহীন সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চল। মাঝে মধ্যে কেবল আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান জাতীয় ‘গুয়াচো’রা ঘোড়ায় চড়ে প্যামপাসের মধ্যে শিকার করতে আসে। তবে রক্ষে যে একমাত্র পুমা ছাড়া হিংস্র জন্তু নেই বলে এই নির্জনে থাকতে আমাদের বিশেষ ভাবনা হচ্ছিল না।
সারাদিন দুর্লভ জীবজন্তু কীটপতঙ্গের অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতাম। কোনো কোনো দিন আমি আর মামাবাবু একসঙ্গে বেরোতাম। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই আমরা আলাদা আলাদা বেরিয়ে পড়তাম।
পিঠে একটা থলিতে নিতাম খাবার আর জল। হাতে পাখি বা কীটপতঙ্গ ধরবার জাল। গলায় ঝোলাতাম বায়নকুলারটা আর কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে এক-এক দিন এক-একদিকে বেরিয়ে পড়তাম। অবশ্য কম্পাস আর দু-একটা গবেষণার দরকারি জিনিসও সঙ্গে থাকত।
সারাদিন ঘুরতাম। কোনো একটা ঝোপের মধ্যে এসে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নিতাম। তারপর তাঁবুতে ফিরতাম বিকেলে, সূর্য ডোবার ঠিক আগে। মামাবাবুও ওই সময়ে ফিরতেন। দুজনে সারাদিনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রহ নিয়ে খানিক আলোচনা করতাম, আর তখন নিজের তাঁবুর সামনে টমাস আগুন জ্বেলে রাতের খাবার তৈরি করত।
এরপর খাওয়া ও শোওয়া। আমি খেয়েই শুয়ে পড়তাম, কিন্তু মামাবাবু মাঝে মাঝে রাত জেগে কী সব আঁকা-জোঁকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ওই সময়ে বুঝতাম তিনি একা থাকতে চাইছেন। কারো সঙ্গ তিনি পছন্দ করতেন না।
এক-এক দিন অনেক রাত অবধি চোখে ঘুম আসত না। আমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা পাশাপাশি তিনটি তাঁবু। নিজের তাঁবুতে নিদ্রাহীন শুয়ে শুয়ে ভাবতাম। সুদূর বাংলাদেশ— বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের কথা মনে হত। কোথায় সেই কলকাতায় আড্ডা হৈ চৈ ছেড়ে এই তেপান্তরের মাঠের মাঝে পড়ে আছি। সবটাই কীরকম অবিশ্বাস্য অবাস্তব মনে হত! তাঁবুর দরজা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। তখন শুক্লপক্ষ চলছে। জ্যোৎস্নারাতে শ্বেতশুভ্র দিগন্ত বিস্তৃত সীমাহীন তৃণভূমি। মৃদু মৃদু বাতাসে ঘাসবনের স্বল্প আন্দোলন— রহস্যের কুহক রাতের মায়ায় মগ্ন হয়ে যেতাম। মনে হত কোনো রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি।
মামাবাবুর তাঁবু থেকে মাঝে মাঝে নস্যি নেওয়ার আওয়াজ ও সজোরে হাঁচির শব্দ পাওয়া যেত।
ক্রমে চোখে ঘুম নেমে আসত।
এইভাবে দিনসাতেক কেটে গেছে। সেদিন সন্ধ্যার সময় দৈনিক পরিভ্রমণ সেরে এসে আমরা তাঁবুর বাইরে বসে আছি। বেশ গরম আর গুমোট। ক্লান্ত দেহে কথাবার্তা বলছি আর মাঝে মাঝে মাংসের হাঁড়ি নিয়ে ব্যস্ত, টমাসের কাছ থেকে ভেসে আসা অপূর্ব সুগন্ধের আঘ্রাণ নিচ্ছি… এমন সময় হঠাৎ খুব কাছে দুটো ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ পাওয়া গেল। ভাবলাম হয়তো দুজন রেড ইন্ডিয়ান শিকারি তৃষ্ণা উপশমের উদ্দেশে আমাদের তাঁবুতে আসছে।
দ্রুত দুজন অশ্বারোহী তাঁবুর কাছে এসে থামল। লাফ দিয়ে নেমে পড়ে তারা রান্নার আগুনের পাশটাতে এসে দাঁড়াল। তাদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম— এরা আবার কারা! স্থানীয় লোক তো নয়।
দুজনেরই গুন্ডা প্রকৃতির চেহারা। একজন বেজায় ঢ্যাঙা। ছোটো ছোটো ধূর্ত চোখ আর মাঝখানে খাঁড়ার মতো নাকটা। সঙ্গীটা মোটা ও বেঁটে। গোল গোল রসগোল্লার মতন চোখ দুটোতে বোকা বোকা ভাব। দুজনেরই চুল কদমফুলের মতো ছোটো করে ছাঁটা। আর দুজনেরই কোমরে মোটা বেল্ট এবং হাতে উদ্যত রিভলবার! আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
ঢ্যাঙা লোকটা স্প্যানিশ ইংরেজির খিচুড়ি ভাষায় কর্কশ গলায় হুংকার ছাড়ল, ‘খবরদার কেউ নড়বে না। বেয়াদপি দেখলেই মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। শয়তানের শপথ।’
টমাসকে বলল, ‘তুই এখানে এসে দাঁড়া।’ বলে আমাদের পাশটা দেখিয়ে দিল।
টমাস আধসিদ্ধ মাংসটা ছেড়ে আসতে একটু ইতস্তত করায় বিষম এক তাড়া লাগাল। টমাস নিরুপায় হয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। ‘লোক দুটোকে কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি’ ব’লে ঢ্যাঙা মোটাকে হুকুম দিল, ‘এদের সঙ্গে কোনো পিস্তল টিস্তল আছে কিনা দেখে নে।’
মোটা লোকটা তাড়াতাড়ি আদেশ পালন করল। আমাদের সঙ্গে অবশ্য তখন কোনো অস্ত্রটস্ত্র ছিল না।
ঢ্যাঙা ফের মোটাকে আদেশ দিল— ‘তুই চটপট তাঁবুগুলোর ভিতরটা খুঁজে আয়।’
মোটা তাড়াতাড়ি তাঁবুর দিকে চলে গেল, আর ঢ্যাঙাটা রিভলবার বাগিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
মামাবাবু এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, এইবার কথা বললেন— ‘কী ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না।’
ঢ্যাঙা খেঁকিয়ে উঠল, ‘আমরা ম্যাপটা চাই। বুঝলে হে। ভালোয় ভালোয় বের করে দাও, নইলে…।’
—‘ম্যাপ কিসের?’ মামাবাবু আকাশ থেকে পড়ল।
—‘সোনার খনির ম্যাপ। প্যামপাসের মধ্যে যে সোনার খনি আছে তার।’ উত্তেজনায় ঢ্যাঙা বাঁ হাত দিয়ে শূন্যে একটা ম্যাপ আঁকার চেষ্টা করে।
মামাবাবু আরও অবাক হলেন ‘প্যামপাসে সোনা! আশ্চর্য! দেখুন, আপনারা ভুল করছেন। আমরা সোনার খবর রাখি না। জীবজন্তু নিয়ে গবেষণা করতে এসেছি।’
ঢ্যাঙা খিঁচিয়ে উঠল, ‘বটে! বটে! শুধু জীবজন্তু! আমাদের বোকা ঠাউরেছিস, গিরগিটি ধরবার জন্যে এই মাঠের মাঝে পড়ে রয়েছিস? আমরা সব খবর রাখি। প্যামপাসের মধ্যে তোরা সোনার খনির খোঁজ পেয়েছিস।’
এমন সময় মোটা লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এসে বলল— ‘কোথাও পেলাম না। অনেক খুঁজলাম।’ শুনে ঢ্যাঙার মুখ চোখ ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠল
সে মোটাকে বলল, ‘তুই দাঁড়া, এবার আমি দেখছি।’
মোটা গুন্ডাটা রিভলবার বাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আর ঢ্যাঙা আমাদের জামাপ্যান্টের সব পকেটগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজল। এমনকী জুতোর মধ্যে দেখতেও ছাড়ল না। কিন্তু ম্যাপ-ট্যাপ কিছু মিলল না।
ঢ্যাঙা এবার ক্রোধে আগুন হয়ে চিৎকার করতে লাগল- ‘ভালো চাস তো ম্যাপ বের করে দে, হতভাগা ভারতীয় জোচ্চোর। আর আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। ম্যাপ না মিললে প্যামপাসের জন্য তিনটে মৃতদেহ উপহার দেব, আর তারপর সমস্ত তৃণভূমি খুঁড়ে ফেলব, দেখি সোনা পাই কিনা।’
হঠাৎ মনে পড়ল লোকদুটোকে বুয়েনস এয়ার্সে আমাদের হোটেলের কাছে দু-একবার দেখেছিলাম বটে। একবার নাকি হোটেলের রুম-বয়ের সঙ্গে ভাব জমিয়ে— আমরা কোথায় যাচ্ছি, কী করতে যাচ্ছি এইসব খবর জিজ্ঞেস করেছিল। আমি অবশ্য জানতে পেরেও ব্যাপারটাকে কোনো গুরুত্ব দিইনি।
মামাবাবু নির্বিকার হয়ে আগুনের দিকে চেয়ে আছেন। এক-একটা মুহূর্ত অতিক্রান্ত হচ্ছে আর দু-দুটো উদ্যত রিভলবারের দিকে চেয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কী ম্যাপ! সোনাই বা কোত্থেকে এল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। নিস্পন্দ ‘প্যামপাস’। মৃদু চাঁদের আলোয় স্বপ্নালোকিত তৃণভূমিতে মৃত্যুশীতল নীরবতা। মামাবাবুর ওপর বেজায় রাগ হচ্ছিল। সত্যি যদি সোনার ম্যাপ থাকে তো দিয়ে দিন-না। শেষে কি টাকার লোভে প্রাণটা খোয়াবেন।
ঢ্যাঙা গুন্ডাটা আবার হুংকার ছাড়ল, ‘আর পনেরো মিনিট।’
সহসা কেমন একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ ভেসে এল পিছনে তাঁবুগুলোর দিক থেকে। তারপরেই আকাশ ছেয়ে বিরাট এক ফড়িং-এর ঝাঁক উড়ে এল মাথার ওপর দিয়ে। ভীষণ বেগে ফড়িংগুলো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উড়ে চলে গেল। কিন্তু বেশ-কিছু ফড়িং আমাদের জামাকাপড়ে এসে অবতীর্ণ হল। মনে হল মস্ত একটা কালো মেঘ ভেসে গেল মাথার ওপর দিয়ে আর তার থেকে যেন আচমকা এক পশলা ফড়িং বৃষ্টি হয়ে গেল আমাদের ওপর। মস্ত বড়ো বড়ো এক জাতের ড্রাগন-ফ্লাই। ওগুলোরই একটা ওই শো-কেসে সাজানো রয়েছে।
আমরা এবং গুন্ডা দুজন প্রাণপণে জামাকাপড় থেকে ফড়িংগুলো ছাড়াতে লাগলাম। সহজে কি আর ফড়িং মুক্ত করা যায়। দারুণভাবে ওগুলো লম্বা ঠ্যাং দিয়ে আমাদের জামাকাপড় আঁকড়ে ধরেছিল।
এই আকস্মিক ঘটনায় গুন্ডা দুটোর মেজাজ একেবারে বিগড়ে গেল। একহাতে ফড়িং ছাড়াতে ছাড়াতে মোটা ষাঁড়ের মতো হাঁকতে লাগল— ‘ইস, জঘন্য জায়গা। এই হতভাগারা, আর দশ মিনিট, তারপর এই পাপের ফল ভোগাচ্ছি।’
মামাবাবু হঠাৎ একটা ফড়িং তুলে ধরলেন। তারপর গুন্ডা দুজনকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘এগুলো কী ফড়িং বলতে পারেন? বেশ বড়ো বড়ো তো? আর এমন দল বেঁধে উড়ে যাওয়ার মানেই বা কী? ভারি আশ্চর্য ব্যাপার কিন্তু!’
তাই শুনে দুজনে রাগে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। ঢ্যাঙা মুখ বিকৃত করে বলে ওঠে, ‘বটে! রসিকতার আর সময় পেলি না— কী ফড়িং। খুব মজার খেল। প্রাণে বহুৎ রস আছে তো?’
মামাবাবু কিন্তু নিরীহ স্বরে আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আমি জীবজন্তু নিয়ে গবেষণা করি কিনা তাই। তা আপনারা ফড়িং-এর ঝড়ের কথা কিছু জানেন না। সত্যি?’
টমাস এই সময় মৃদুস্বরে কী জানি বলতে গেল। মামাবাবু তাকে ধমক দিলেন— ‘চুপ।’ টমাস তৎক্ষণাৎ ভাবলেশহীন মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঢ্যাঙা এদিকে তেড়েফুড়ে উঠল, ‘আলবাৎ জানি না। আর সাত মিনিট। তারপর প্রাণভরে গবেষণা করিস। অনন্তকাল ধরে সময় পাবি।’
মামাবাবু আনমনে কী জানি একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘দেখুন, যদি এক টিপ নস্যি নিই তো আপত্তি আছে? যা বিপদে পড়েছি, মগজটা সাফ করা একান্ত দরকার।’ এই বলেই বুক পকেট থেকে তাঁর নস্যির ডিবাটা বের করলেন। হরিণের শিঙের বেশ বড়ো নস্যির কৌটা।
মোটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল, ‘খবরদার, কোনো চালাকির চেষ্টা যদি করেছিস তো আর আস্ত রাখব না বলছি।’
মামাবাবু শশব্যস্ত হল— ‘না না, কোনো চালাকি নেই, কেবল এক টিপ নস্যি…।’ এই বলে নস্যির কৌটাটা খুলে ফেললেন; তারপর বললেন, ‘যাঃ, নস্যিটা দেখছি একদম জমে গেছে।’ এই বলে বাঁ হাতের তালুতে সমস্ত নস্যি ঢেলে ফেললেন। অনেকখানি নস্যি প্রায় একমুঠো হবে। তারপর তিনি ডানহাতের দু আঙুলে এক টিপ নস্যি নিয়ে নাকে গুঁজে দিলেন। দুটো প্রচণ্ড হাঁচলেন, অতঃপর গুন্ডা দুজনের দিকে ফিরে বললেন— ‘তা হলে সত্যিই আপনারা ম্যাপ না নিয়ে ছাড়বেন না?’
দুজনের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মোটা ঘোঁৎ করে উঠল, ‘এবার বাবা পথে এসো। তোর নস্যির গুণ আছে দেখছি।’
মামাবাবু করুণ মুখ করে বললেন, ‘কিন্তু আমি তো ম্যাপ এখনও তৈরি করিনি, করব ভাবছিলাম।’
মনে মনে মামাবাবুর ওপর খুব রাগ হল। উঃ, সত্যি তাহলে সোনার খবর জানেন। আর এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। ভাগ্যিস এখন সুবুদ্ধি হয়েছে।
ঢ্যাঙা বললে, ‘কুছ পরোয়া নেই। জায়গাটার হদিস দিয়ে দাও, খুঁজে নেব। তবে হ্যাঁ, চালাকি যদি করেছা তো…।’
তাকে থামিয়ে দিয়ে মামাবাবু বললেন, ‘আমরা ছাড়া পাব তো?’
—‘হ্যাঁ জরুর, বলে দিলেই পাবে।’ ঢ্যাঙা আর ধৈর্য রাখতে পারছিল না। মামাবাবু চকিতে একবার পিছন ফিরে তাঁবুর দিকে তাকিয়ে নিলেন। মনে হল কান পেতে কী জানি শোনবার চেষ্টা করলেন। তারপরেই ডানহাত দিয়ে জামার বুকপকেট থেকে একটা ছোটো পাথুরে ঢেলা বার করলেন। হাত বাড়িয়ে গুন্ডা দুটোর দিকে ঢেলাটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দেখুন, এটা চিনতে পারেন? আকরিক সোনা।’
ঢ্যাঙা আর মোটা পরম আগ্রহে হাত বাড়াল।
ওরা কিন্তু ভারি হুঁশিয়ার। ঢ্যাঙা প্রথমে ঢেলাটা পরীক্ষা করল, মোটা আমাদের দিকে রিভলবার বাগিয়ে ধরে থাকল। তারপর মোটা পরীক্ষা করল আর ঢ্যাঙা তাক করে রইল। দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দিল— হ্যাঁ, সোনার আকরই বটে। ছোট্ট একটা আগ্নেয়শিলার টুকরো। চকচক করছে। সোনা আছে বেশ বোঝা যায়।
লক্ষ্য করছিলাম মামাবাবু এই সময় একমনে কী জানি শোনবার চেষ্টা করছিলেন। আমারও হঠাৎ মনে হল বহুদূরে আমাদের পিছন দিক থেকে কেমন একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। ঘাস বনে জোরে হাওয়া দিলে যেমন হয়।…
মামাবাবু চকিতে আবার যেন সজাগ হয়ে উঠলেন। তাঁর কথাবার্তা কাণ্ডকারখানা কীরকম আমার অদ্ভুত ঠেকছিল। সহসা তিনি বুকপকেট থেকে তাঁর ঝরনা কলমটা খুলে নিলেন। তারপর কী এক কায়দায় কলমটার ওপর দিকে চাপ দিতেই মাথার দিকটা গেল খুলে। মাটির ওপর খোলা দিকটা উপুড় করে ধরলেন আর অমনি ভেতর থেকে কতকগুলো ছোট্ট ছোট্ট ধাতুর টুকরো ঝরে পড়ল মাটিতে। তখন তিনি একটি টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে ডানহাতের দু-আঙুলে তুলে ধরে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন— ‘ভালো করে দেখুন একটি সোনার টুকরো। আর এই সোনা আমি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বের করেছি ওই আকর থেকে। এখন এই আবিষ্কারের জন্য কিছু ভাগ আশা করা কি আমার অন্যায় হবে? বলুন আপনারা?
আগুনের আভায় হলদে সোনার টুকরোটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গুন্ডা দুজনের চোখও লোভে উঠল জ্বলে। দুজনেই কাছে এগিয়ে এল।
মামাবাবু আবার কণ্ঠস্বরকে আরও কয়েক পর্দা উঁচুতে তুলে চিৎকার করে উঠলেন। এত জোরে কথা বলাটা আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকল।
—’ভালো করে দেখুন খাঁটি সোনা। আমার অনেক কষ্টের ফল।’
দু জোড়া চোখ আরও কাছে এগিয়ে এল।
আমার কানে এল সেই সাঁ সাঁ আওয়াজটা। মনে হল খুব কাছে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ দেখলাম মামাবাবুর নস্যিভর্তি বাঁ হাতের মুঠোটা একটু একটু করে ওপরে উঠছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা ঠান্ডা ঝোড়ো দমকা বাতাস প্রবল বেগে, চারদিক লন্ডভন্ড করে আমাদের ওপর এসে পড়ল। ঝড়টা এগিয়ে এল আমাদের পিছন দিক থেকে অর্থাৎ গুন্ডা দুটোর সামনাসামনি। মুহূর্তে মামাবাবুর বাঁ হাতের মুঠোটা আততায়ী দুজনের মুখের সামনে খুলে গেল আর অমনি হাতে ধরা সমস্ত নস্যিটা বাতাসের বেগে লোক দুটোর চোখমুখের ওপর উড়ে গিয়ে পড়ল।
বিকট চিৎকার করে দু-হাতে মুখ ঢেকে দুজনেই মাটিতে বসে পড়ল, আমরাও তৎক্ষণাৎ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
ঝড়ের বেগ মিনিট দশেক পরে কমে গেল। লোক দুটো তখন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে সমানে চেঁচাচ্ছে, চোখ রগড়াচ্ছে এবং গালাগালি দিয়ে আমাদের চতুর্দশ পুরুষকে উদ্ধার করছে। মামাবাবু ইতিমধ্যে একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর পা তুলে জুত করে বসেছিলেন। তিনি তাদের সম্বোধন করে বললেন— ‘মহাশয়রা খুব সম্ভব স্থানীয় অধিবাসী নন?’
—‘না। তাতে ক্ষতিটা কী হয়েছে?’ ঢ্যাঙার তেজ তখনও কমেনি।
—‘তা ক্ষতি একটু হয়েছে বৈকি। আচ্ছা আপনাদের ভাষা ও উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে মহাশয়রা ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিবাসী? কেমন, ঠিক বলিনি?’
—‘হুম। জ্যামাইকান।’ মোটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে।
—‘তা বেশ। যা হোক, প্যামপাসে ড্রাগন ফ্লাই-এর ঝড়ের রহস্য না জানার জন্য আপনাদের আর এ যাত্রায় সোনার ম্যাপ মিলল না বলে দুঃখিত।’
উনি এবার আমার দিকে ফিরলেন— ‘কী? ঝড়ের বৃত্তান্ত জান না কি!’
মাথা নাড়লাম— ‘না।’
—‘বেশ তবে শোনো।’ এই বলে মামাবাবু আমাদের তিনজনের দিকে উৎসাহিত দৃষ্টিতে তাকালেন (টমাস ততক্ষণে আবার মাংসের হাঁড়ি নিয়ে ব্যস্ত)। অতঃপর এক টিপ নস্যি নিয়ে সজোরে গোটা দুই হাঁচলেন। ইতিমধ্যে তাঁর বন্দী শ্রোতা দুজন স্প্যানিশ ইংরেজির খিচুড়ি ভাষার তোড় ছুটিয়ে দিল— তাদের আপাতত এই অসম্মানজনক বন্ধনদশার প্রতিবাদে।
শ্রোতাদের অমনোযোগিতায় অসন্তুষ্ট মামাবাবুর ভ্রূ কুঞ্চিত হল। ডান হাতের তর্জনী উত্তোলন করে ধমক লাগালেন— ‘আঃ, চুপ। আমায় বলতে দিন।’
এই কড়া মাস্টারের মেজাজে ভীত হয়ে অথবা ফড়িং ঝড়ের রহস্য জানাবার আগ্রহে, যে কারণেই হোক-না-কেন তারা এবার মুখ ছোটানো ক্ষান্ত দিয়ে চুপচাপ মামাবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইল। যেন ক্লাসে লেকচার দিচ্ছেন এমনি ভঙ্গিতে মামাবাবু বলতে আরম্ভ করলেন—
‘প্যামপাসে মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা উত্তর-পশ্চিম বায়ুর স্বল্পস্থায়ী ঝড় ওঠে। এর নাম এদেশে ‘প্যামপেরো’। ঝড়ের পূর্বে আকাশে মেঘের সঞ্চার হয় না তাই ঝটিকার আগমন হয় নিঃশব্দে প্রচণ্ড বেগে। নীলচে রঙের এই-জাতীয় ফড়িং বা ‘ড্রাগন ফ্লাই’-এর ঝাঁক হল এইরকম ঝড়ের অগ্রদূত। ঝড়ের আগে আগে এরা ধেয়ে চলে বোধহয় পশ্চাদ্ধাবমান ঝড়ের কবল থেকে বাঁচবার আশায়। ফড়িং-এর ঝড়ের মিনিট দশেকের মধ্যেই আসল ঝড়ের আবির্ভাব হয়। এটা হচ্ছে প্যামপাসের আবহাওয়ার সম্পূর্ণ নিজস্ব এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। আমি আগের বার এই অঞ্চলে এসে এই ‘প্যামপেরো’ সম্বন্ধে অবহিত হই, আর তাই ফড়িং-এর ঝাঁকের আগমন দেখেই পশ্চাদ্ধাবনকারী ঝড়ের সম্ভাবনায় মুঠো ভরা নস্যি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। যতক্ষণ না ঝড়টা এসে পড়ে ততক্ষণ এই অতিথি দুজনকে আমার সোনা আবিষ্কারের খবরাখবর নিয়ে কালক্ষেপ করছিলাম আর উন্মুখ কান পেতে ছিলাম ত্রাণকর্তা পবনদেবের আবির্ভাব শোনার আশায়।
মামাবাবু এইবার টমাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমি তো বাপু আর একটু হলে বলেই ফেলেছিলে আর কি।’ টমাস লজ্জিত ভাবে একটু হাসল।
পরদিন সকালেই আমরা তাঁবু গুটোলাম। বন্দী দুজনকে সঙ্গে নিয়ে তৃণভূমির নিকটে যে গ্রামে আমাদের জিনিসপত্র রেখে এসেছিলাম সেখানে উপস্থিত হলাম।
মামাবাবুর সঙ্গে স্থানীয় পুলিস ইন্সপেক্টরের কী জানি কথাবার্তা হল। সেদিন দুপুরে ইন্সপেক্টর সাহেব আমাদের কাছে নেমন্তন্ন খেলেন। প্রচুর চর্বচোষ্য গলাধঃকরণ করে তিনি পরম পরিতৃপ্তি লাভ করলেন। এর ওপর আবার মামাবাবুর প্রদত্ত গোটা কয়েক দামি উপহারও পকেটস্থ করলেন। মোট কথা মামাবাবুর সঙ্গে তার বেজায় খাতির জমে গেল। তারপর বন্দীদের ইন্সপেক্টরের জিম্মায় রেখে দিয়ে জিনিসপত্র সব সঙ্গে নিয়ে আমাদের মোটর পরদিন সকালে বুয়েনস এয়ার্সে যাত্রা করল।
পথে কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে মামাবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা মামাবাবু সোনার ব্যাপারটা কি সত্যি?’
মামাবাবু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানান ‘তা সত্যি বটে। আগের বার যখন এখানে আসি তখন একজন স্থানীয় ‘গুয়াচোর’ কাছে কয়েকটা আকরিক সোনার পাথুরে ঢেলা দেখতে পাই। লোকটা বলে প্যামপাসের মধ্যে এক জায়গায় সে এই চকচকে পাথরগুলো কুড়িয়ে পেয়েছে। দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম যে এইগুলি প্রচুর পরিমাণ সোনা মিশ্রিত একপ্রকার আগ্নেয় শিলা। তা সেবার হাতে সময় না থাকায় অনুসন্ধান করতে পারিনি। কেবল মোটামুটিভাবে যেখান থেকে পাথরগুলো কুড়িয়ে পেয়েছে সেই জায়গাটার একটা আন্দাজ নিয়ে ফিরে যাই। এবার ভেবে রেখেছিলাম জায়গাটা খুঁজে বার করব। পরীক্ষা করছি, জায়গাটাতে সত্যিই একটা সোনার খনি রয়েছে।’
—‘কিন্তু গুন্ডা দুটো জানল কী করে?’
—‘আরে বুয়েনস এয়ার্সে একটা রেস্তোরাঁয় বসে অ্যান্ডারসনকে ব্যাপারটা বলছিলাম, তখন পাশের টেবিলে ওরা বসে ছিল। মাতাল ভেবে খেয়াল করিনি, ব্যাটারা কিন্তু সব শুনছিল। আর তারপর থেকে সমানে পিছনে লেগেছিল। ডুবিয়ে দিয়েছিল আর কি, ভাগ্যিস সময়মতো ফড়িং-এর ঝড়টা এল। বাঁচার উপায়টাও তখন চট করে মাথায় খেলে গেল, নইলে ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলাম না?’
—‘কিন্তু ম্যাপ?
—‘হয়ে গেছে। এই কলারের মধ্যে আছে।’ মামাবাবু তাঁর জামার কলারে দুবার টোকা মারলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘লোক দুটোর কী করলেন?’
—‘ওঃ, থানায় জমা দিয়ে দিলাম, গুন্ডামির অপরাধে। ইন্সপেক্টর বলেছেন তিনি ওদের উত্তম শিক্ষা দিয়ে দেবেন। তাঁর এলাকায় গুন্ডামি করে এত বড়ো সাহস! আর এই শিক্ষা দান করতে অন্তত তিনদিন সময় লাগা উচিত বলে তিনি মনে করেন। অবশ্য ওই তিনদিন সময়টা আমারই সাজেশন। কারণ আমাদের কার্যোদ্ধারের জন্য তিনদিন সময়ই যথেষ্ট।’
সেইদিন সন্ধ্যায় বুয়েনস এয়ার্সে পৌঁছলাম। পরদিন মামাবাবু সমস্তদিন ব্যস্ত থাকলেন। খুব ঘোরাঘুরি করলেন। আর সেইদিন রাত্রিতে আমরা দুজন কলিকাতা-গামী প্লেনে চড়লাম।
প্লেন যখন আকাশে উঠেছে মামাবাবু আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলেন- ‘মাত্র পাঁচ হাজার ডলারে ম্যাপটা অ্যান্ডারসনকেই বিক্রি করে দিলাম, বুঝলে। হাজার হোক বন্ধু লোক। কী বল? আর এতক্ষণে ওর ম্যাপে নির্দিষ্ট জায়গাটা ইজারা নেবার সব বন্দোবস্তও আশা করি কমপ্লিট হয়ে গেছে।’
দেখলাম মামাবাবু জামার বুকপকেট থেকে অতি সন্তর্পণে একটি মৃত ‘ড্রাগন ফ্লাই’ বের করলেন। অর্ধনিমীলিত চক্ষে ফড়িংটির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন— ‘সবই এঁদের কৃপায়, বুঝলে সুনন্দ। সবই…।’
সুনন্দের বিবরণী শেষ হল
আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ সুনন্দের ডাকে আমার চমক ভাঙে, ‘কী রে চা খেলি না, একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।’
জবাব না পেয়ে শো-কেসটার দিকে তাকিয়ে থাকি।