মধুর ভাগ

মধুর ভাগ

মাটির ওপর ক্যানভাস বিছিয়ে পিঠোপিঠি বসেছিলেন প্রফেসর নবগোপাল ঘোষ এবং বিল। প্রফেসর ঘোষ একটি ক্যামেরা পরীক্ষা করছেন। বিলের পাশে শোয়ানো রয়েছে একটি রাইফেল ও একটি পিস্তল। আর একটা রাইফেলের কলকব্জায় বিল তেল লাগাচ্ছেন সযত্নে।

মাথার ওপর ঝাঁকড়া গাছটার ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে ভোরের সূর্যের আলো এসে পড়েছে মাটিতে। আলোছায়ার রকমারি নকশা বুনেছে।

কিছু দূরে দুটো তাঁবু পড়েছে। অনেক লোক তাঁবুগুলির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে নানা কাজে। কয়েকজন মাটিতে বসে করছে গল্পগুজব। রাঁধুনি বিশালকায় জাম্বো— একা একটা গাছের তলায় বসে কুটছে একরাশ তরকারি।

প্রায় একশো মিটার দূরে উত্তর দিকে শুরু হয়েছে জঙ্গল। ঘন নয়, পাতলা বনভূমি। একটি ক্ষীণকায়া নদী এসে ছোটো জলাভূমি তৈরি করেছে ওখানে, তারই আশেপাশে গাছপালা ঝোপঝাড় জন্মে ওই বনভূমির সৃষ্টি। তাঁবু পড়েছে যেখানে সেখানটা বেশ খোলামেলা, শুধু মাঝে মাঝে এক-একটা বড়ো ঝাঁকড়া গাছ। পিছনে দক্ষিণ দিকে দেখা যাচ্ছে খোলা প্রান্তর। সেখানে বড়ো গাছ খুব কম। আবহাওয়া গরম হলেও এখনও বৃষ্টি নামেনি, তাই খোলা মাঠ বেশ রুক্ষ, প্রায় তৃণহীন।

এই জায়গাটা আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ অংশে বেচুয়ানাল্যান্ডের (অধুনা বতসোয়ানা) অন্তর্গত। প্রফেসর ঘোষ আফ্রিকায় সাফারিতে বেরিয়ে কয়েকদিন হল এখানে তাঁবু ফেলেছেন। শিকারি বিল তাঁর বন্ধু এবং এই অভিযানে পথপ্রদর্শক।

কিচ কিচ কিচ! কোনো পাখির তীক্ষ্ণ গলা শুনে ঘোষ মাথা তুললেন। দেখলেন, জাম্বো যে গাছের নীচে বসেছে সেই গাছের ডালে বসে টুনটুনির মতো একটি ছোট্টপাখি। নাচানাচি করছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে আর ডাকছে সমানে। পাখিটির পাখা ও মাথার রং কালচে, হলুদ রঙা ঠোঁট, পেট ধূসর বর্ণ।

বিলও দেখছিলেন পাখিটাকে। বললেন, ‘এই পাখির নাম হনি গাইড (Honey Guide )।’

প্রফেসর ঘোষ বললেন, ‘ও এই হচ্ছে হনি-গাইড। বাঃ! আফ্রিকার এই বিশেষ জাতের পাখির কথা আমি পড়েছি। বৈজ্ঞানিক নাম ইনডিকেটর জ্যানথোনোটাফ (Indicator Xanthonotuf)। এই পাখিরা নাকি মানুষকে বা ভালুককে ডেকে নিয়ে যায় কোনো লুকোনো মধুভরা মৌচাকের কাছে। ওরা কেউ সেই মৌচাক ভাঙলে একটু মধু আর মৌকীট ভাগ পাওয়ার আশায়।’

তারপর নিজের মনেই বলেন, ‘তাহলে বাংলায় এদের নাম দেওয়া যায় মধুপ্ৰদৰ্শক।’

বিল বললেন, ‘হুঁ তাই। আমি এই পাখি দেখেছি আগে। এদের এই গল্পও শুনেছি। এই অঞ্চলে যখন এসেছিলাম আগের বার। তবে এদের মৌচাকের হদিশ দেওয়ার ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখার সুযোগ পাইনি।’

প্রফেসর ঘোষ ক্যামেরা বাগিয়ে হনি-গাইড বা মধু-প্রদর্শক পাখির কয়েকটা ফোটো তুললেন।

পাখিটা ডাকছিল, নাচানাচি করছিল ডালে-ডালে জাম্বোর ঠিক মাথার ওপর যেন সে জাম্বোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। জাম্বো আফ্রিকান উপজাতির লোক। এ পাখির স্বভাব নিশ্চয়ই জানে। কারণ জাম্বো বারবার মাথা তুলে আগ্রহভরে দেখছিল পাখিটাকে। মাঝেমাঝেই সে আড়চোখে নজর করছিল ঘোষ ও বিলকে। হয়তো তার পাখিটার পিছু পিছু মধুর লোভে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। কর্তাদের সামনে কাজ ফেলে যাবে কিনা ভেবে ইতস্তত করছে।

অবশেষে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়ায় জাম্বো। রান্নার কাজ রইল পড়ে। দলের আরও কয়েকজন মালবাহক উপজাতীয় মানুষ পাখিটার ডাকাডাকি শুনে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল ওই দিকে। জোজো নামে তাদেরই একজনকে কী জানি ইশারা করল জাম্বো। মনে হল যেন ওর সঙ্গে যেতে ডাকছে। জোজো কিন্তু ঘাড় নাড়ল। অর্থাৎ চায় না যেতে। জাম্বো একটু মুখভঙ্গি করে প্রফেসর ঘোষ ও বিলকে একবার টেরিয়ে দেখে নিয়ে পাখিটাকে অনুসরণ করতে শুরু করল।

যেই জাম্বো পা চালিয়েছে, হনি-গাইড পাখিটার ফুর্তি যেন গেল বেড়ে। সে অমনি কাছে আর একটা গাছে উড়ে গিয়ে ডাকাডাকি লাফালাফি করতে থাকে। জাম্বো সেই গাছটার তলায় গিয়ে পাখিটার দিকে তাকাতেই পাখিটা খানিক তফাতে আর একটা গাছে উড়ে যায়। সে নাগাড়ে ডাকছে, নাচছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে উত্তেজিত ভাবে। কিচ কিচ কিচ— মধু। মধু পাবে। এসো চটপট আমার সঙ্গে।

পাখির হাবভাব বুঝতে অসুবিধা হয় না জাম্বোর। সে পাখিটার ওপর নজর রেখে পায়ে-পায়ে এগোয়। পাখিটি ক্রমেই জঙ্গলের কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জাম্বোকে। নিশ্চয়ই ওই বনের ভিতর কোথাও সে মৌচাকের সন্ধান পেয়েছে।

—‘হুজুর, জাম্বোকে যেতে বারণ করুন পাখিটার সঙ্গে।’

পিছনে টিকের গলা শুনে ঘোষ অবাক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে বলল— ‘কেন?’

টিক আফ্রিকান উপজাতির লোক। এই অভিযাত্রী দলের সঙ্গে এসেছে কাজ করতে। টিক বলল— ‘হুজুর, ওই পাখি জাম্বোকে ঠিক বিপদে ফেলবে।’

—‘বিপদে ফেলবে? কীভাবে?’

—‘তা জানি না। তবে ফেলতে পারে কোনো বিপদে। কারণ ওই পাখিটা গতকাল জাম্বোকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বনের ভিতর গাছে একটা মৌচাক দেখিয়েছিল। লোভী জাম্বো পাখিকে ফাঁকি দিয়েছে। গোটা চাকটা ভেঙে নিয়ে চলে আসে। পাখিকে একটুও তার ভাগ দেয়নি।’

—‘তাতে হয়েছেটা কী?’

—‘হুজুর ওই পাখিরা ভীষণ চালাক। ওরা মধু খেতে খুব ভালোবাসে। নিজেরা মৌচাক থেকে মধু খেতে পারে না মৌমাছির ভয়ে। তাই ওরা কোনো মানুষকে কষ্ট করে ডেকে এনে দেখায় চাকটা। কিন্তু ওই মৌচাক ভেঙে মধুর ভাগ না দিলে বেজায় চটে যায়। তখন সেই মানুষকে বিপদে ফেলার ফন্দি করে। আমার খুড়ো একবার ওইরকম একটা পাখিকে ঠকিয়েছিল। ভাগ দেয়নি মৌচাকের মানে মধুর। পরদিন সেই পাখি খুড়োকে ডাকাডাকি করে নিয়ে গিয়ে সোজা হাজির করে এক সিংহর সামনে। ভাগ্যিস খুড়ো ছিল গাছে চড়তে ওস্তাদ। সিংহ আক্রমণ করার আগেই তরতর করে উঠে যায় কাছে একটা উঁচু গাছের মগডালে। ঘণ্টা দুই সেই গাছের নীচে ঘোরাফেরা করে সিংহটা চলে গেলে তবে নেমে পালায়। বরাতজোরে সেবার খুব বেঁচে গিয়েছিল খুড়ো। এমন ভুল সে আর করেনি। জাম্বো পুব দেশের লোক। এই জাতের পাখির হালচাল ঠিক জানে না। আমরা এই অঞ্চলের লোকরা জানি।’

বিল মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘হুঁ। এই ব্যাপারটা আমিও শুনেছি সেবার।’

প্রফেসর ঘোষ বললেন, ‘জাম্বো যে পাখিটাকে ভাগ দেয়নি তুমি জানলে কী করে?’

‘হুজুর কাল নিজের চোখে দেখলাম দূর থেকে। জাম্বো একটা পাত্রে মৌচাকটা ভরে নিয়ে বন থেকে বেরিয়ে এলো। পাখিটা তার পেছন পেছন সমানে আসছিল উড়ে-উড়ে, ডাকতে-ডাকতে। ওই ডাকের ভাষা আমরা বুঝি একটু মধুর ভাগ চাইছে। জাম্বো ঢিল ছুড়ে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিল পাখিটাকে।’

—‘তুমি তখন বললে না জাম্বোকে, পাখি কী চাইছে?’– বিল জানতে চাইলেন।

—‘বলেছিলাম হুজুর। জাম্বো বিশ্বাস করল না। ভাবল মজা করছি। তাছাড়া পাখিটা ততক্ষণে চলে গেছে।’

প্রফেসর ঘোষ একটু উদবিগ্ন ভাবে হনি-গাইডের পিছু পিছু জাম্বোর চলা দেখতে থাকেন। বিলও ভুরু কুঁচকে গুম মেরে রইলেন। টিক সরে গেল তফাতে।

এই ফাঁকে প্রফেসর নবগোপাল ঘোষ এবং বিল-এর পরিচয়টা জানাই। ডক্টর নবগোপাল ঘোষ বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী। অধ্যাপক। বাঙালি। নিবাস কলকাতা শহরে। দেশে-বিদেশে প্রায়ই ঘোরেন গবেষণার উদ্দেশ্যে বা বক্তৃতা দিতে। বিল ইউরোপীয়। পুরো নাম উইলিয়াম হার্ডি। থাকেন পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ায়। রোদে-জলে পোড় খাওয়া দীর্ঘ পাকা বাঁশের মতো কাঠামো। একদা দুর্ধর্ষ শিকারি এই ব্যক্তি সারা পূর্ব-আফ্রিকায় ডেয়ারিং বিল নামে খ্যাত। বহু বছর ধরে বাস করছেন আফ্রিকায়। তবে বিল এখন শিকার ছেড়ে দিয়েছেন। যারা আফ্রিকায় বেড়াতে আসে তাদের গাইডের কাজ করেন। প্রফেসর ঘোষ আগেও কয়েকবার এসেছেন আফ্রিকা মহাদেশে। বিলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছে তখন। ঘোষ ও বিল ছাড়া এই সাফারি পার্টির বাকিরা সবাই নানা কাজের জন্য ভাড়া করা উপজাতীয় লোক। বিল উপজাতিদের ভাষা দিব্যি জানেন। প্রফেসর ঘোষও শিখেছেন অল্পস্বল্প। দেশি লোকেরাও অল্পস্বল্প ইংরিজি বুঝতে ও বলতে পারে।

বেচুয়ানাল্যান্ডে প্রফেসর ঘোষ আগে কখনো আসেননি। এবার তাঁর আফ্রিকা-ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য এই মহাদেশের কিছু অঞ্চলের জীবজন্তুর ফোটো তোলা এবং এখানকার কিছু দুর্লভ কীটপতঙ্গের স্পেসিমেন সংগ্রহ করা

প্রফেসর ঘোষ ও বিল দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। নবগোপাল ঘোষ মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি স্বাস্থ্যের, নিরীহ অধ্যাপক সুলভ দেখতে। চেহারার অমিল থাকলেও স্বভাবে এক জায়গায় প্রফেসর ঘোষ এবং ডেয়ারিং বিলের বেজায় মিল। উভয়েই দুরন্ত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় এবং প্রকৃতিপ্রেমী। দেখতে দেখতে হনি-গাইড পাখিটাকে অনুসরণ করে জাম্বো অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের ভিতরে।

বিল হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘চলুন প্রফেসর, ব্যাপারটা দেখা যাক।’ কী ভেবে বিল তাঁর পিস্তলটাও তুলে নিলেন। ঘোষও উঠলেন। বনের দিকে রওনা দিলেন। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দলের কয়েকজন দেশি লোক ঘোষ ও বিল-এর পিছু নিল কৌতূহলে।

বনের মধ্যে কোথায় রয়েছে জাম্বো বোঝা মুশকিল। এদিক-সেদিক ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎ হনি-গাইড পাখির তীক্ষ্ণ স্বরের ডাক কানে আসে। পাখির ডাক লক্ষ্য করে জংলা সরু পথ ধরে চলেন ঘোষ ও বিল। সহসা দেখা পেলেন জাম্বোর।

চারপাশে মোটামুটি ঘন গাছপালার মাঝে খানিক ফাঁকা জায়গা। সেখানে অল্প কিছু বেঁটে-বেঁটে ঝোপ আর মধ্যিখানে এক বড়ো গাছ। গাছটার গুঁড়ি সোজা উঠে গেছে প্রায় দশ-বারো ফুট। তারপর ডাল বেরিয়েছে।

হনি-গাইড সেই গাছটায় বসে ডাকছে। আর জাম্বো নীচে দাঁড়িয়ে দেখছে মাথা তুলে।

পাখিটা এডালে-ওডালে বসছে উড়ে-উড়ে আর বারবার গাছের গুঁড়ি থেকে প্রথম যে ডালটা বেরিয়েছে সেই জোড়ের কাছে বসে ডাকছে জোরে জোরে এবং ডানা ঝাপটাচ্ছে।

বিল নজর করেন যে ওই প্রথম ডাল বেরুনোর জোড়ের ঠিক ওপরে গুঁড়ির গায়ে একটা মাঝারি গর্তের বা ফোকরের মুখ। তিনি প্রফেসরকে দেখালেন ফোকরটা। পাখিটা যেন জাম্বোকে প্রাণপণে ওই ফোকরটা দেখাবার চেষ্টা করছে, আহ্বান জানাচ্ছে, আবার সরে যাচ্ছে অন্য ডালে।

—‘ওই গর্তে কি মৌচাক আছে?’—বলেন প্রফেসর ঘোষ।

—‘থাকতেও পারে। কী জানি?’

ওই ফোকরটা জাম্বোর চোখেও ধরা পড়েছিল। পিছনে যে বিল ও ঘোষ এসে হাজির হয়েছেন তা সে টের পেয়েছে। মুখ ঘুরিয়ে দেখেছে একবার। মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার জানিয়েছে হুজুরদের। তবে বিল ও ঘোষের দিকে আর সে দৃকপাত করেনি। আপাতত সে মধুর প্রলোভনেই মজে আছে।

জাম্বো গাছটায় উঠতে লাগল। তার দেহ বিরাট এবং ভারী। তাই সে সাবধানে উঠল, গুঁড়ির খাঁজে-খাঁজে হাতে পায়ে আঁকড়ে প্রথম মোটা ডালটায় চড়ে বসল জাম্বো। তারপর ডাল পাকড়ে ফোকরের কাছে গিয়ে যেই উঁকি মারতে যাবে ভিতরে, মৌচাকটা দেখতে, বিল হেঁকে বললেন তাকে, ‘ওহে ওই গর্তে হাত ঢুকিয়ো না। বেশি কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ো না। আগে একটা ডাল ভেঙে খানিক দূর থেকে ঢোকাও গর্তে।’

—‘কেন হুজুর?’— জাম্বো অবাক, ‘ঠিক আছে, হাত ঢোকাচ্ছি না। আগে ভালো করে দেখে নিই মৌচাক আছে কিনা। তারপর ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়িয়ে মৌচাক কেটে বের করব। এখন লাঠি দিয়ে খোঁচালে মৌমাছিরা যে রেগে গিয়ে কামড়াবে আমায়।’

—‘যা বলছি করো।’— বিল কড়া সুরে বলেন।

জাম্বো বিরক্ত মুখে একটু পিছিয়ে গিয়ে গাছে ঝুলে থাকা একটা সরু লম্বা ডাল ভেঙে আস্তে আস্তে ঢোকায় গর্তে।

ফোঁস! একটা সাপের হাঁ করা মাথাসুদ্ধ শরীরের ফুটখানেক আবির্ভূত হয় গর্তের ভিতর থেকে। ফটাস। ছোবল পড়ে লাঠিতে অর্থাৎ ডালটায়।

—‘বাপরে!’ আর্তনাদ করে জাম্বো ডালটা ফেলে দেয়। বিদ্যুৎ গতিতে একটা মোটা সাপ তেড়ে বেরিয়ে আসে। ফুট তিনেক লম্বা সাপ। রাগে ফুঁসছে। জাম্বো প্রাণভয়ে পেছোতে চেষ্টা করে ডাল বেয়ে। মাত্র কয়েক হাত দূরে সাপটা। জাম্বো নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার আগেই হয়তো ছোবল খাবে।

দুম! বিলের পিস্তল গর্জে ওঠে। পিস্তলের গুলিতে সাপের মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। প্রাণহীন সরীসৃপের দেহটা মাটিতে আছড়ে পড়ে ধড়ফড় করতে করতে স্তব্ধ হয়।

—‘প্যাফ অ্যাডার!’– পিস্তল পকেটে রেখে সাপের দেহটা দেখে মন্তব্য করেন বিল, ‘ভীষণ বিষাক্ত সাপ! এই ভয়টাই করছিলাম। গর্তে সাপ থাকতে পারে।’

প্রফেসর ঘোষ সাপটা দেখতে দেখতে বলেন, ‘অ্যাডার। মানে ভাইপার অর্থাৎ বোড়া গোত্রের সাপ। চন্দ্রবোড়া জাতীয়। ওঃ দারুণ টিপ তোমার বিল! জাম্বো আজ খুব বেঁচে গেছে।’

এবার জাম্বোর দিকে নজর ফেরে। সে তখন গাছের ডাল আঁকড়ে প্রায় ঝুলছে। চোখ বিস্ফারিত।

—‘নেমে এসো।’— জাম্বোকে ডাকেন বিল।

জাম্বো মাথা নাড়ে। মনে হল, গাছ বেয়ে নেমে আসার শক্তিটুকুও সে হারিয়ে ফেলেছে।

—‘জাম্বোকে নামিয়ে আনো।’— পিছনে জড়ো হওয়া স্তম্ভিত লোকগুলিকে আদেশ দেন বিল।

তারা গাছে উঠে দড়ির মই লাগিয়ে প্রায় ঘাড়ে করে নামিয়ে আনে জাম্বোকে। মাটিতে নেমেই ধপ করে বসে পড়ে জাম্বো। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে তার মুখ তখনও ফ্যাকাশে। থরথর করে কাঁপছে শরীর। ধাতস্থ হতে তার মিনিট দশেক সময় লেগে যায়।

ঘোষ এবার প্রশ্ন করলেন জাম্বোকে— ‘আচ্ছা জাম্বো, এই পাখি যে মৌচাকের সন্ধান দেয় তুমি আগে জানতে?

—‘আজ্ঞে না। এখানে এসে শুনলাম।’

—‘কার কাছে?’

—‘জোজো। গতকাল এমনি একটা পাখি এসে ডাকাডাকি করছিল। তখন জোজো বলল আমায়।’

—‘কাল নাকি এই পাখিটার দেখানো মৌচাক পেয়ে তুমি পাখিকে ভাগ দাওনি মধুর?’— জিগ্যেস করেন বিল।

—‘এই পাখিটা?— কেমন ধাঁধায় পড়ে জাম্বো, কী জানি। তবে ঠিক এমনই দেখতে ছিল পাখিটা।

—‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সেই পাখিটাই এসেছিল আজ। তুমি কি কাল ভাগ দিয়েছিলে ওকে মৌচাকের? পাখির পাওনা মজুরি।’

—‘না।’

—‘কেন? জোজো বলেনি তোমায়? এই হনি-গাইড পাখিরা তাদের দেখানো মৌচাক থেকে মধুর ভাগ না পেলে খুব চটে যায়। শোধ নেওয়ার চেষ্টা করে। ফাঁদে ফেলে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, যে ফাঁকি দিয়েছে তাকে।’

—‘না, বলেনি তো!’

—‘আশ্চর্য! জোজো এই অঞ্চলের লোক। হনি-গাইডের এই স্বভাব তার না জানার কথা নয়। জোজো কি কাল তোমার সঙ্গে গিয়েছিল জঙ্গলে মৌচাক ভাঙার সময়?’

—‘হ্যাঁ গিয়েছিল।’

—‘চাকটা কে ভেঙেছিল? তুমি না জোজো?’

—‘আমি।’

—‘চাক নিয়ে ফেরার সময় পাখি ওর ভাগ চায়নি? মানে, পিছন পিছন আসেনি ডাকতে-ডাকতে?’

—‘হ্যাঁ, আসছিল। কিন্তু জোজো বলল, এই পাখিরা মৌমাছির শত্রু। চাক ভাঙতে মৌমাছিরা জব্দ হয়েছে, তাই ভারি খুশি হয়ে ডাকছে পাখিটা। ধন্যবাদ জানাচ্ছে আমাদের।’

—‘জোজো কি ওই মৌচাকের মধু খেয়েছে?’

—‘খেয়েছে। তবে তখন নয়। পরে রাতে। আমি তখুনি একটু মধু চেখে দেখলাম। জোজো খেল না। ও বলল, জরুরি কাজ আছে। তাই চলে গেল তখন। মৌচাক নিয়ে আমি একাই ফিরলাম। পাখিটা বড্ড জ্বালাচ্ছিল তাই তাড়িয়ে দিলাম।’

বিল ঘোষকে বললেন, ‘বুঝেছেন প্রফেসর, জোজো ইচ্ছে করেই বিপদে ফেলতে চেয়েছিল জাম্বোকে। কিন্তু কেন?’

এবার প্রফেসর ঘোষ প্রশ্ন করলেন জাম্বোকে, ‘আচ্ছা তোমার সঙ্গে কি জোজোর ঝগড়া হয়েছে কখনো?’

—‘হ্যাঁ হুজুর, হয়েছে। একটু লজ্জিত ভাবে জানায় জাম্বো। ও বেশি মাংস খেতে চাইছিল অন্যদের চেয়ে। আমি দিইনি। জোজো রেগে খারাপ একটা গালি দিল আমায়। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। জোজোকে মারতে গেলাম। অন্যরা অনেক কষ্টে থামায় আমাকে। নইলে মোক্ষম দু-ঘা লাগাতাম জোজোকে। অন্যরা অবশ্য জোজোকে খুব দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ওরই দোষ। যা হোক পরে মিটে গেছিল ব্যাপারটা। পরে জোজো একা এসে আমার কাছে মাপ চেয়ে নেয়। আমিও রাগ পুষে রাখিনি আর।’

প্রফেসর ঘোষ বললেন, ‘সেই ঝগড়া হয়েছিল কবে?’

—‘এই পাখি মৌচাক দেখানোর দুদিন আগে।

এবার প্রফেসর ঘোষ বিলকে বললেন, ‘আসল ব্যাপারটা বুঝছেন বিল? জাম্বোর সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে উঠবে না তাই শয়তান জোজো এই মতলব করেছিল জাম্বোকে জব্দ করতে। প্রতিশোধ নিতে। জাম্বো রাগ পুষে রাখেনি বটে, কিন্তু জোজো রেখেছিল। ওঃ! ভাগ্যিস তুমি জাম্বোকে ফলো করলে।’

ভয়ানক রেগে বিল হুংকার দিলেন, ‘জোজোকে ধরে আনো।’

পিছনে দর্শক দেশি লোকরা ইতিউতি তাকিয়ে বলল, ‘আরে জোজো গেল কোথায়? এই তো একটু আগেই সে ছিল এখানে। আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছিল।’

তারা ছুটল তাঁবুর দিকে।

কিন্তু জোজোর পাত্তা পাওয়া গেল না।

কিছু লোক হইহই করে ছুটছিল জঙ্গল ছুঁড়ে জোজোকে ধরে আনতে। প্রফেসর ঘোষ তাদের বাধা দিলেন, ‘থাক ওর পেছনে আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই। ও একা একাই ফিরুক ওর গ্রামে। এই মাসের মাইনেটা যে আর পেল না, এটাই ওর কাছে মস্ত লোকসান। ভালোরকম শাস্তি।’

তারপর মুচকি হেসে বললেন, ‘সাবধান জাম্বো! ভবিষ্যতে আর কখনো এই হনি-গাইড পাখি মৌচাকের খোঁজ দিলে পাখিকে তার ভাগ দিতে ভুলো না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *