কুমিউসি

কুমিউসি

এক

দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগ। প্রায় আটশো বছর আগেকার কথা।

মধ্য-এশিয়ার গোবি মরুভূমির এক জনহীন প্রান্তর। প্রান্তরের বুকের ওপর দিয়ে এক চওড়া পায়ে-চলা পথ ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে দুটি মানুষ। একটি মধ্যবয়সি পুরুষ, অন্যটি কিশোর। আধবয়সি লোকটির গায়ে গেরুয়া রঙের আলখাল্লা। তার মুণ্ডিত মাথায় এক টুকরো হলদে কাপড় জড়ানো।। পায়ে পথ-চলার মোটা পশমের জুতো। উচ্চতা মাঝারি। শীর্ণ মুখ। রোদে পুড়ে তামাটে রঙ প্রায় কালচে হয়ে গেছে। কিন্তু তার মুখে এক অতি চমৎকার প্রশান্ত ভাব। স্নিগ্ধ চোখ দুটি বুদ্ধি মাখানো, উজ্জ্বল। পথিককে দেখে বোঝা যায় তিনি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী-ভিক্ষু।

কিশোরটির পরনে সাদা রঙের ঢোলা লম্বা জামা ও ইজের। মাথায় কালো চিনা টুপি! পায়ে জুতো। উচ্চতায় সে ভিক্ষুর মাথা ছাড়িয়েছে। ছিপছিপে গড়ন, ফরসা রুক্ষ, চোখা নাক, সুন্দর মুখশ্রী। দুজনের কাঁধে দুটি ঝুলি।

ভিক্ষু কোমল স্বরে বললেন, ‘হর্ষ, ক্লান্তি লাগছে নাকি?’

কিশোর আগে আগে চলছিল। ঘাড় ফিরিয়ে হাসি মুখে উত্তর দিল, ‘উঁহু।’ তারপর যেন একটু উদবিগ্নভাবে বলল, ‘বিকেল হয়ে গেল যে, সরাইখানা আর কদ্দূর? সন্ধের আগে পৌঁছতে পারব তো? রাত্রি হয়ে গেলে সরাইয়ের দরজা যদি বন্ধ করে দেয় তখন বাইরে ঠান্ডায় রাত কাটাতে হবে। উঃ, যা দেশ! দিনে যেমনি গরম, রাত্তিরে তেমনি ঠান্ডা। যেন হাড়ে কাঁপুনি ধরে।’

ভিক্ষু বললেন, ‘সন্ধের আগেই তো পৌঁছবার কথা।’

‘জল চাই। আমাদের খাবার জল ফুরিয়ে গেছে।’ হর্ষ বলল। ভিক্ষু বললেন, ‘ভয় নেই, সরাই আর বেশি দূর নয়। তারপর তিনি একটু থেমে বললেন, ‘বাক্সটা ঠিক আছে তো?’ হর্ষ বলল— ‘আছে।’— ‘মানে দুপুরে যখন আমরা পাথরের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করেছিলাম তখন তুই ওটা বের করেছিলি। ঝোলায় পুরেছিস তো?’ কিশোর একটু জোরের সঙ্গে বলে— ‘হ্যাঁ পুরেছি। তোমায় অত ভাবতে হবে না। আমি কি ছেলেমানুষ যে হারিয়ে ফেলব। দেখো, তোমার দেশে পৌঁছে বাক্স ঠিক তোমার হাতে তুলে দেব। ভিতরের কোনো জিনিস খোয়া যাবে না।

ভিক্ষু বললেন— ‘বেশ বেশ।’

ভিক্ষু পথের ডানপাশে দেখতে থাকেন।— বহুদূর অবধি উঁচুনীচু পাথুরে জমি। আরও দূরে দেখা যাচ্ছে বালুরাশি। মরুভূমির প্রান্তরেখা। শেষ বিকেলের রাঙা রোদ পড়ে চকচক করছে বালুকণা। কী নীরস প্রান্তর। এতটুকু সবুজের ছোপ নেই কোথাও। নেই কোনো গাছ বা ঘাস। একটিও প্রাণীর চিহ্ন নেই প্রান্তরের বুকে। প্রাচ্যতুর্কিস্তান বা মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলেই এইরকম দৃশ্য চোখে পড়ে। শুধু আকাশে কয়েকটা শকুন পাক খাচ্ছে। তীক্ষ্ণ চোখে খুঁজছে শিকার। যদি কোনো হতভাগ্য মানুষ বা পশু মরুরাজ্যে পথ হারিয়ে খাবার ও জলের অভাবে প্রাণ হারায় ওরা তখন

নেমে আসবে তাদের লক্ষ্য ক’রে।

বাঁ পাশে তাকালেন ভিক্ষু। এদিকে শুধু পাথর আর পাথর। ছোটো বড়ো অজস্র শিলাখণ্ড ছড়িয়ে আছে। জমি ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে এক পাহাড়ের দিকে। আরও পিছনে আকাশের গায়ে মেঘের মতো দেখা যাচ্ছে এক বিশাল পর্বতমালার উঁচু উঁচু শিখরগুলি। তিনি কিশোরকে ডাক দিলেন— ‘হর্ষ, ওই বাঁদিকে দেখ কুনলুঙ পর্বতমালা। জানিস ওই পাহাড়ে অনেক গুহা আছে। সাধু সন্ন্যাসীরা গুহায় নির্জনে তপস্যা করেন। একবার দেখতে ইচ্ছে করে।’

কিশোর একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তুমি ওই পাহাড়ে যাবে নাকি।’

ভিক্ষু হাসেন।— ‘না রে, আমি এখন সোজা দেশে ফিরব। এই যে কুনলুঙ পর্বত ওর দক্ষিণে রয়েছে বিরাট দুই পর্বতমালা— হিমালয় ও হিন্দুকুশ। সেই দুই পর্বত প্রাচীরের ওপাশে হচ্ছে ভারতবর্ষ। হিন্দুস্থান। আর ভারতবর্ষের পূর্ব কোণে আমার দেশ। দেখবি কী সুন্দর শ্যামল সে দেশ! কত গাছপালা নদনদী। চোখ জুড়িয়ে যাবে।’

হর্ষ বলল, ‘আর কতদিন লাগবে তোমার দেশে পৌঁছতে?’

‘আরও বছরখানেকের ওপর তো বটে। এখনও তো অর্ধেক পথ পেরোইনি। এই রাস্তা ধরে আমরা কাশগরে পৌঁছব। আর দুদিনের পথ। কাশগর থেকে যেতে হবে দক্ষিণ-পশ্চিমে। পৌঁছব হুনদের রাজ্য বাদাস্কান। সেখান থেকে গিরিপথের ভিতর দিয়ে কাবুল নদীর তীর বেয়ে ঢুকব ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমানায় পরুষপুর (পেশোয়ার) নগরে। তারপর যাব ভারতের পূর্ব অংশে। এখনও অনেক পথ বাকি।’

—‘বাপরে! আরও বছরখানেক।’ হর্ষ মুখভঙ্গি করে বলে।

—‘এক বছর ধরে তো হাঁটছি। সেই কবে চীন দেশ থেকে রওনা হয়েছি।’ সে একবার চারদিক দেখে বলল, ‘কী বিচ্ছিরি দেশ। কেবল ধূ ধূ মাঠ, মরুভূমি, নেড়া পাহাড়। যেন ফুরোয় না। পথে দেখল কতগুলো নগরকে মরুভূমি প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। লোকজন পালিয়ে যাচ্ছে নগর ছেড়ে।’

—‘হুঁ।’ বিষণ্নভাবে ভিক্ষু জবাব দেন। সত্যি অনেক দূরে দূরে নদীতীরে বা মরূদ্যানে যে কটি জনপদ এখানে গড়ে উঠেছিল, সেগুলি ক্রমে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মরুভূমির আক্রমণে। অথচ হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণকাহিনিতে আছে তখন এই নগরগুলি কত সমৃদ্ধ ছিল। গাছপালা ফুলফলে সাজানো থাকত

হিউয়েন সাং-এর কথা ভাবতেই ভিক্ষুর মনে হয় যে পথ দিয়ে তাঁরা চলেছেন, এই পথ ধরে হিউয়েন সাং হয়তো একদিন ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন। এই দুর্গম রাস্তা দিয়ে যুগযুগান্তর ধরে শুধু যে নানাদেশের বণিকরা যাতায়াত করছে তাই নয়, কত জ্ঞানী, গুণী ধর্মপ্রচারকও গিয়েছেন। কেউ চীনদেশ থেকে ভারতবর্ষে গিয়েছেন। কেউ বা ভারতবর্ষ থেকে মধ্য এশিয়া ও চীনদেশে এসেছেন।

বৌদ্ধধর্ম ও ভারতীয় সভ্যতা প্রচার হয়েছে এখানে। এ পথের ধূলিকণা পবিত্র হয়ে আছে তাঁদের পাদস্পর্শে।

নিজের চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন ভিক্ষু। হঠাৎ হর্ষের উৎফুল্ল কণ্ঠে চমক ভাঙে।— ‘অভিরাম দাদা ওই দেখো সরাইখানা দেখা যাচ্ছে।’

চোখ তুলে ভিক্ষু দেখলেন পশ্চিম দিগন্তের বুকে একটি দুর্গের মতো বাড়ির মাথা জেগে উঠেছে। কালো পাথরে তৈরি উঁচু তোরণের পিছনে গোধূলির রক্তিম আকাশ ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে। সারাদিন হাঁটার পর বিশ্রামের আশায় দুজনেরই চলার গতি বেড়ে যায়।

পথের পাশে সরাইখানা বাড়িটা প্রায় পনেরো হাত উঁচু পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রকাণ্ড সিংহদরজা হাট করে খোলা। মানুষ ও পশুর বহু কণ্ঠের কলরব ভেসে আসছে ভিতর থেকে। সরাইয়ের কাছেই কয়েকটি তাঁবু পড়েছে। তাঁবুগুলির আশেপাশে অনেক মেয়ে পুরুষ। সবাই বেশ শক্ত সমর্থ। মেয়েরা রান্নার জোগাড় করছে। পুরুষরা করছে গল্পগুজব। অনেক ভেড়া ও গাধা ঘুরছে কাছাকাছি। ভিক্ষু একটুক্ষণ দেখে বললেন— ‘যাযাবর তুর্কি। ওরা সরাইয়ের ভিতরের চেয়ে বাইরে খোলা মাঠে থাকতে ভালোবাসে।’

হর্ষর ইচ্ছে যাযাবরদের সঙ্গে একটু ভাব জমায়। কিন্তু ভিক্ষু বারণ করলেন। ‘চল, সরাইয়ে ঢুকি, সন্ধ্যা হয়েছে। এবার ফটক বন্ধ করে দেবে।’

দুজনে সরাইয়ের ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকল।

হঠাৎ মনে হল যেন দমবন্ধ হয়ে যাবে। কেমন চাপা ভ্যাপসা ভাব। বিচ্ছিরি গন্ধ। হট্টগোল। পিছন ও দুপাশের দেওয়াল ঘেঁষে সারি সারি ঘর। ইটের তৈরি। ঘরগুলির সামনে বারান্দা। ঘরগুলির মাঝে ও ফটকের সামনে অনেকখানি উঠোন। উঠোনের এক কোণে পাঁচিল ঘেঁষে হরেক রকম পশু গাদাগাদি করে রয়েছে। উট, ঘোড়া, গাধা, বলদ। তারা নিশ্চিন্ত মনে জাবর কাটছে। এরা ভারবাহী পশু, মরুপথের একান্ত দরকারি জীব। মানুষের ভিড় চত্বরের ভিতর দিকে— বারান্দায়। ছোটোছোটো ঘরগুলিতে। অনেক প্রদীপ জ্বলছে সরাইয়ের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসেছে লোকে। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছোটো বড়ো দলে অনেক লোক বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কথা বলছে। কেউ নীচুস্বরে। কেউ হই হই করে। বারান্দার ওপর বড়ো বড়ো মালের গাঁটরি থাক থাক করে সাজানো। উঠোনের মধ্যে একটি কুয়ো। অনেকে পাত্র হাতে তার চারপাশে ভিড় করেছে। একজন বালতি ডুবিয়ে জল তুলছে, তারপর মেপে মেপে জল দিচ্ছে। মরুরাজ্যে জল বড়ো মূল্যবান জিনিস।

হর্ষ বলল, ‘শোবার জায়গা পাব তো?’ ভিক্ষু বললেন, ‘দেখি। চলো ভিতরে এগোই।’

উঠোনে দাঁড়িয়ে দুজনে এদিক-ওদিক চাইছে এমন সময় একটি লোক এগিয়ে এল। লোকটি জাতিতে চীনা। বলল— ‘ভিক্ষু স্বাগত। আমি সরাইওলা। আপনাদের কী প্রয়োজন? ঘর? খাবার? আগুন?’

ভিক্ষু বললেন, ‘ধন্যবাদ। ঘর দরকার নেই, বারান্দার এক কোণে একটু রাতের আশ্রয় চাই। খাবার সঙ্গে আছে।’

সরাইওলা বলল, ‘ওই কোণটায় থাকতে পারেন। ওখানে বাতাস কম আসে। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন।’

ঘুপসি কোণ। ভালোই। বেশ নিরিবিলি। ভিক্ষু কাঁধের ঝোলা নামিয়ে রাখলেন। হর্ষ ধপ করে তার ঝোলা মেঝেতে ফেলল। ভিক্ষু চমকে বললেন- ‘গেল বোধহয় বাক্সটা। তোর কাছে রাখতে দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে।’ হর্ষ একগাল হেসে বলল, ‘কিস্সু হবে না। কম্বলে ভালো করে জড়িয়ে রেখেছি। পিঠে লাগছিল কিনা।

ভিক্ষু জুতো খুলে একটি ভেড়ার লোমের মোটা আসন বের করে পেতে বসলেন। হর্ষকে বললেন, ‘বস।’ হর্ষ বলল— ‘দাঁড়াও, জল আনি।’ একটা ঘটি হাতে সে কুয়ো পারে গেল। একটু পরে জল নিয়ে এল। চমৎকার ঠান্ডা জল। ভিক্ষুর প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এই সরাইয়ের নাম শুনেছিলাম— মিষ্টি-জল? সাৰ্থক নাম।

হর্ষ বলল, ‘আমি একটু ঘুরে আসি। তুমি জিরোও।’ সে চত্বরের দিকে পা বাড়াল।

ভিক্ষু হাসেন। উঃ, কী ছটফটে ছেলে। সব সময় টগবগ করছে। ওকে দেখে নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়। ভাবেন, ‘আমিও এমনি অস্থির ছিলাম। দিনরাত হই হই। লেখাপড়ার বালাই নেই। কেবল বকুনি খেতাম।’

কিন্তু এ ছেলেটার কি আর পড়াশুনা হবে? অনেক চেষ্টা তো করছেন। এদিকে বুদ্ধি বেশ। ভারি সরল স্বভাব। সর্বদা হাসিখুশি। লোকের সঙ্গে আলাপ জমাতে ওস্তাদ। কিন্তু পড়ায় মন নেই। দুবছর আগে হর্ষকে নিয়ে চীনের পূর্বদিকে নিপ্পন দ্বীপপুঞ্জে (জাপান) গিয়েছিলেন। সেখানে থাকেন প্রায় এক বছর। হর্ষকে কিয়োতো শহরে এক নিপ্পনীর কাছে রেখে তিনি সারা দেশময় ঘুরে বেড়ান। মঠে মঠে তাঁকে আহ্বান করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পণ্ডিতদের সঙ্গে বৌদ্ধশাস্ত্ৰ নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা করেন। ভিক্ষু ভাবেন, অনেকদিন তখন কাছে ছিল না। এই ফাঁকে ছেলেটা কী করেছে কে জানে? যে কটি বই পড়তে বলে গিয়েছিলাম, তার একটিও পড়েনি সে।

সরাইখানার ফটক সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে তারা ফুটছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চাঁদ এখনও ওঠেনি। কয়েকটা মশাল জ্বলে উঠল উঠোনে। ভিক্ষু চুপচাপ বসে যাত্রীদের লক্ষ্য করতে থাকেন।

সরাইয়ের ভিতর আলো-আঁধারির জগৎ। কত জাতের, কত দেশের লোক এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের চেহারা বেশবাস দেখে ভিক্ষু তাদের জাতি বোঝার চেষ্টা করেন।— চীনা, মঙ্গোল, তুর্কি, পারসিক, তিব্বতী। আরও কিছু লোক রয়েছে, তাদের ঠিক চিনতে পারেন না। এরা সবাই প্রায় ব্যবসায়ী, ঘুরে ঘুরে বাণিজ্য করে।

নানা ভাষার টুকরো টুকরো কথা কানে আসে। ভিক্ষু চীনা ভাষা ভালো জানেন। তুর্কি আরবিও কিছু কিছু শিখেছেন। চত্বরের মাঝখানে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে বসে একদল মঙ্গোল হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে। জোরে জোরে তাল ঠুকছে।

মাথায় চোঙা টুপি, ঝলমলে ঢোলা পোশাক গায়ে। ছুঁচলো দাড়ি। লিকলিকে ঢেঙা এক তুর্কি, হাত মুখ নেড়ে কী জানি বলছে। কয়েকজন চীনা মন দিয়ে শুনছে। ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হর্ষ। মশগুল হয়ে গল্প গিলছে। ভিক্ষু কান পেতে শুনতে চেষ্টা করেন।— কোথায় জানি যুদ্ধ হয়েছে তার বর্ণনা। এমনি করেই এখানে লোকে দেশবিদেশের খবর পায়। এক দেশের খবর অন্য দেশে ছড়ায়।

কয়েকজন তিব্বতি মাটিতে অনেকগুলো পশুর চামড়া বিছিয়ে বসেছে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে এক লম্বা ফরসা সুপুরুষ ব্যক্তি। তার গায়ে দামি পোশাক। মাথার পাগড়িতে জরি চকচক করছে। মুখে লম্বা কালো দাড়ি। মৃদু স্বরে কথা হচ্ছে। তিব্বতিরা হাত নাড়ছে, ঘাড় দোলাচ্ছে। বোধহয় লোকটি চামড়া কিনতে চায়। দরদস্তুর চলছে। ভিক্ষু দেখলেন, দরাদরি শেষ হল। বণিক একটি থলি থেকে কিছু মুদ্রা বের করে দিল তিব্বতিদের হাতে। একজন লোক? বোধহয় বণিকের অনুচর এসে চামড়াগুলো গুছিয়ে তুলে নিয়ে গেল। বণিক সরে গেল। এবার তিব্বতিরা ঝুড়ি খুলে মোটা মোটা চাপাটি ও মাংসের কাবাব বের করে আনন্দে খেতে শুরু করল।

ভিক্ষুর এখনও খিদে পায়নি। হর্ষরও পাত্তা নেই। থাক, খানিক পরে খাওয়া যাবে। তার সঙ্গে আছে সামান্য খাদ্য— রুটি, শুকনো খেজুর ও নুন

কিছুদূরে বারান্দায় চারজন সম্ভ্রান্ত চেহারার চৈনিক মুখোমুখি বসে। তারা ছোটো ছোটো বাটিতে কোনো গরম পানীয় আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। ভিক্ষু ভাবলেন— নিশ্চয় চা। এই পানীয় তিনি চীনদেশে কয়েকবার খেয়েছেন। বেশ খেতে। শীত কমে।

যে সদাগর চামড়া কিনেছিল, সে হঠাৎ কোথা থেকে এসে ভিক্ষুর সামনে দাঁড়াল। মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে আরবিতে বলল— ‘ভিক্ষু, নমস্কার। আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলাম। আমার বাড়ি সমরকন্দ। পেশা বাণিজ্য। এ পথে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আর বড়ো দেখা যায় না। তাই কৌতূহল হল।’

ভিক্ষু বললেন, ‘ভগবান তথাগত আপনার মঙ্গল করুন। আপনি কি বৌদ্ধ?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

—‘সমরকন্দে কত বৌদ্ধ আছেন?’

—‘এখন খুব কম। তবে একসময় আমাদের দেশে বৌদ্ধধর্মের বেশ প্রভাব ছিল।’

ভিক্ষু বললেন, ‘হ্যাঁ জানি। কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। একটা কম্বল পেতে দিই।’ বণিক বলল, ‘আমি বসছি। আপনি ব্যস্ত হবেন না।’ সে ঘাড় ফিরিয়ে ইঙ্গিত করতেই তার এক অনুচর একটি দামি আসন সামনে পেতে দিল। বণিক বসল। ‘আপনি কোন দেশ থেকে আসছেন?’ সে প্রশ্ন করল।

—‘চীনদেশ থেকে।’ ভিক্ষু বললেন।

—‘কোথায় যাবেন?’

—‘হিন্দুস্থান।’

—‘আপনি কি হিন্দুস্থানের অধিবাসী?’

—’হ্যাঁ।’

—‘তাহলে আমি ঠিকই অনুমান করেছিলাম।’ বণিক বলে। ‘আচ্ছা হিন্দুস্থানের কোন প্রদেশে যাবেন?’

—‘বঙ্গদেশ। গৌড়বঙ্গের নাম শুনেছেন?’ ভিক্ষু বলেন। ‘হিন্দুস্থানের পূর্বপ্রান্তে এই প্রদেশ। আমি বঙ্গদেশের লোক।’

—‘বঙ্গদেশের নাম শুনেছি বইকি। গৌড়রাজ্যের অন্তর্গত এই প্রদেশ। রাজধানী গৌড় নগরী নাকি অতি সুন্দর। বঙ্গদেশের রেশমের কাপড় কতবার কিনেছি। অমন রেশম চীনদেশেও তৈরি হয়নি। আচ্ছা গৌড়ের রাজা এখন কে?’ ভিক্ষু উত্তর দিলেন, ‘আমি দেশ ছাড়ার সময় গৌড়াধিপতি ছিলেন রামপাল অনেক বছর কেটে গেছে। দেশের খবর পাইনি। জানি না রামপাল এখনও রাজা আছেন কিনা।’

—‘কতদিন দেশ ছেড়েছেন?’

—‘প্রায় পনেরো বছর হল।’

—‘ওঃ, এতদিন আগে। কী কাজে চীনদেশে গিয়েছিলেন? জানতে আগ্রহ হচ্ছে। ধর্মপ্রচার করতে?’

—‘না। বিক্রমশীলা মহাবিহারে দুজন চীনা ভিক্ষুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাঁরা চীনদেশে বসে সংস্কৃত ভাষায় লেখা কিছু বৌদ্ধশাস্ত্র চীনাভাষায় অনুবাদ করবেন। এ কাজে তাঁদের সাহায্য করতে একজন সংস্কৃত জানা ভারতীয় ভিক্ষুকে তাঁরা চীনদেশে নিয়ে যেতে চান। আমি যেতে রাজি হই। তারপর তাঁদের সঙ্গে চীনদেশে চলে যাই। কাজ শেষ হয়েছে, তাই এবার ফিরছি।’

—‘যাবার সময় কি এ পথ দিয়ে গিয়েছিলেন?’

—‘না। গিয়েছিলাম তিব্বতের ভিতর দিয়ে। কিন্তু এখন বয়স বেড়েছে। হিমালয়ের উঁচু উঁচু গিরিপথগুলি ডিঙোতে আর সাহস হল না। তাই এ পথে চলেছি। এ পথে সময় বেশি লাগবে। তবে এ দেশটি দেখারও ইচ্ছা ছিল মনে।’

কয়েকজনের তর্কাতর্কি শোনা গেল। তাদের গলা ক্রমে চড়ছে। ভিক্ষু একটু উদ্‌বিগ্নভাবে সে দিকে তাকালেন।— হুঁ, ঠিক যা ভেবেছেন। হর্ষ লোকগুলোর কাছে দাঁড়িয়ে। একটা হুজুগের গন্ধ পেলেই ও সেখানে গিয়ে জুটবে।

বণিক বলল, ‘ভয় নেই, তর্ক হাতাহাতিতে গড়াবে না। তেমন সম্ভাবনা দেখলে অন্যরা গিয়ে ঝগড়া মিটিয়ে দেবে।’ ভিক্ষু বললেন, ‘তা হলেই ভালো। ছেলেটা আবার ওখানে গিয়ে জুটেছে।’

—‘কে ছেলেটি?’ বণিকের কণ্ঠে কৌতূহল। ‘আপনার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। দেখে তো ভারতীয় মনে হয় না।’

—‘না, ভারতীয় নয়। বোধহয় ইরানি, ভিক্ষু বললেন, ‘ওর সঠিক পরিচয় আমি জানি না। প্রায় দশ বছর আগে চীন থেকে মরুভূমির ভিতরে এক বৌদ্ধ বিহার দর্শন করতে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় ছেলেটাকে পথের পাশে কুড়িয়ে পাই, অজ্ঞান, মৃতপ্রায় অবস্থায়। অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে তুলি। তখন ওর বয়স মাত্র পাঁচ-ছয় বছর। তার পর থেকে আমার সঙ্গেই আছে।’

ভুরু কুঁচকে বণিক বলল, ‘হয়তো ক্রীতদাস। মরে যাবে ভেবে কেউ ফেলে রেখে গিয়েছিল। যাক ভালোই হয়েছে, আপনার আশ্রয় পেয়েছে।’

ভিক্ষু বললেন, ‘ভেবেছিলাম চীনদেশেই কারো কাছে ওকে রেখে আসব। কিন্তু কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে চলেছি। বড়ো দুরন্ত স্বভাব।’

এই অচেনা বিদেশি সদাগরের সম্বন্ধে জানতে ভিক্ষুর কৌতূহল হচ্ছিল। পুঁথির রাজ্যে বাস করলেও তাঁর মন সরস আছে। দেশভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। দেশবিদেশের লোকের কথা জানতে তাঁর ভালো লাগে। বললেন—’মহাশয়, নিজের কথাই কেবল বলছি। আপনার কথা তো কিছু শুনলাম না। আপনি কি প্রতি বছর এদিকে বাণিজ্য করতে আসেন?’

‘হ্যা প্রায় প্রতি বছর,’ বণিক জবাব দেয়। ‘দু-একবার হিন্দুস্থানেও গিয়েছি। একবার দিল্লি হয়ে মথুরা অবধি গিয়েছিলাম। আর একবার জাহাজে যাই পোরবন্দর, মুক্তো কিনতে।’

‘সাধারণত কী কী বাণিজ্য করেন?’

বণিক হাসে। ‘শুনবেন? বেশ।— সঙ্গে নিয়ে আসি পারস্যের গালিচা, ইতালি ও গ্রিসের আয়না, দমস্কের তরবারি, বুখারা সমরকন্দের লোমওলা ভেড়ার চামড়ার জামা।— এই সব। আর এসব জিনিস বিক্রি করে, কিনে নিয়ে যাই— চীনা ও ভারতীয় রেশম, মসলিন। ভারতের হাতির দাঁত ও রত্ন পাথর, চীনা কাগজ, চীনামাটির পাত্র, খোটান কাশগরের কম্বল ও পশম, কাবুল কান্দাহারের কিসমিস, আখরোট, বাদাম। কখনো তিব্বতি ও মঙ্গোলদের কাছ থেকে কিনি পশুচর্ম। এমনি যখন যা যা সুবিধা পাই। এবার গিয়েছিলাম ইয়ারকন্দ অবধি। এখন দেশে ফিরছি।’

আবার গোলমাল শোনা গেল। লোকগুলোর মেজাজ যেন চড়ছেই। ভিক্ষু ব্যস্ত হয়ে তাকালেন। হ্যাঁ, হর্ষ ভিড়ের মধ্যে তখনো দাঁড়িয়ে আছে।

বণিক বুঝল। ‘ছেলেটার জন্যে ভয় পাচ্ছেন। বেশ ডেকে দিচ্ছি।’ সে ডাক দিতেই তার এক অনুচর দৌড়ে এল। হর্ষের দিকে আঙুল দেখিয়ে কী জানি বলল বণিক। লোকটি ভিড়ের মধ্যে ঢুকে হর্ষকে কিছু বলতেই, সে তার সঙ্গে চলে এসে ভিক্ষুর সামনে দাঁড়াল।— ‘আর্য, আমায় ডাকছেন?’

ভিক্ষুর হাসি পেল। ছেলেটার এই এক রোগ। বাইরের কারও সামনে ভিক্ষুকে সম্মান দেখাতে এমনি সাধু ভাষা বলবে। অথচ আড়ালে একা থাকলে দিব্যি অভিরামদাদা, তুমি, বলে। অভিরামদাদা বলে ডাকতে তিনিই শিখিয়েছেন। ছোটোছেলের মুখে ওই আর্যটার্য কেমন পাকা পাকা শোনায়। এসব পোশাকি ভদ্রতা তিনি পছন্দ করেন না। ভিক্ষু বললেন— ‘এবার চুপ করে বসো। অনেক ঘুরেছ।’ হর্ষ সমরকন্দের বণিককে একবার দেখে নিয়ে ভিক্ষুর পাশে বসল।

একটি লোক কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বণিক তাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল— ‘আদাব আলিভাই। সব কুশল তো? তোমাকে একবারও দেখিনি। শুনলাম সরাইয়ে উঠেছ। কাবুল কান্দাহারের খবর কী?’

লোকটি দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উত্তর দিল- ‘আদাব শাহীভাই। ভালো আছ তো। তবিয়ত একটু গরবর করছিল তাই শুয়ে ছিলাম। কাবুল কান্দাহার এখন ঠান্ডা। আরবদের উৎপাত কমেছে। চললাম, ভাই।’

বণিক একটু ইতস্তত করে বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, মাপ করবেন। আপনাদের রাতের খানা কি হয়ে গেছে?’

ভিক্ষু বললেন— ‘না, এখনও হয়নি। কেন?

—‘যদি আমার সেবা গ্রহণ করেন তো কৃতার্থ হই। ইয়ারকন্দের তরমুজ। চিনির মতো মিষ্টি। সন্ন্যাসী তৃপ্তি পেলে আমার পুণ্য হবে।’

ভিক্ষু স্মিত মুখে বললেন, ‘বেশ, দিন।’

বণিক তার এক অনুচরকে ডেকে কিছু বলতেই সে নিয়ে এল হলদে সবুজ রঙের বেশ বড়ো একটি তরমুজ। বণিক নিজের হাতে সেটি ভিক্ষুর পায়ের কাছে রাখল। হর্ষর চোখ চকচক করে উঠল তরমুজ দেখে।

বণিক বলল, ‘এবার আপনারা বিশ্রাম করুন। আমি যাই। আপাতত কাশগর যাবেন তো। ভোরে বেরবেন নিশ্চয়? আমিও সকালে বেরব। আচ্ছা সেলাম।’ বণিক ভিক্ষুদের কাছেই একটি কুঠুরিতে ঢুকল।

ভিক্ষু ও হর্ষ খাওয়া সারল। তরমুজের বেশির ভাগই গেল হর্ষের পেটে। হর্ষ সমানে বকবক করছিল। আজ কোথায় কী কী শুনেছে, তার গল্প। কোন মরূদ্যানে নাকি পূর্ণিমা রাতে জিন পরিরা নাচগান করে। সেদিন রাতে কেউ বাইরে থাকে না। একজন বেরিয়েছিল। তারপর পরিদের পাল্লায় পড়ে সারারাত ধেই ধেই করে নেচেছে। পরদিন কোমরের ব্যথায় কুপোকাত। জোর বরাত তাই প্রাণে বেঁচে গেছে। পশ্চিম দেশে খুব যুদ্ধ হয়েছে আরব আর তুর্কিতে। আরবরা হেরে ভূত হয়ে গেছে। এমনি কত খবর।

ভিক্ষু কিন্তু আনমনে ভাবছিলেন সমরকন্দের বণিকের কথা। কী অদ্ভুত জীবন! সারা বছর পথে পথে ঘোরে। দেশের বাড়িতে থাকে আর কতটুকু।

হর্ষ হঠাৎ চাপা স্বরে বলল— ‘জান, ওরা বলাবলি করছিল কতগুলো ডাকাত নাকি সৈন্যদের তাড়া খেয়ে এদিকে পালিয়ে এসেছে।’– ‘তাই নাকি?’ ভিক্ষু অন্যমনস্কভাবে জবাব দেন।

‘আচ্ছা কোনো দলের সঙ্গে কাশগর অবধি গেলে হয় না?’– ‘নাঃ’, ভিক্ষু

ঘাড় নাড়েন। ‘একগাদা লোকের সঙ্গে চলতে আমার ভালো লাগে না। একা একা বেশ দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে যাওয়া যায়। তাছাড়া দস্যুরা আমাদের কিছু বলবে না। তারা জানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে ধনরত্ন থাকে না। যদি বা ধরে, নেবে কী?’

—‘কেন, যদি বাক্সটা কেড়ে নেয়?’

—‘বাক্স? হুঁ।’ ভিক্ষুর মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। একটুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন— ‘দেখো আমার মনে হচ্ছে ভাবনার কোনো কারণ নেই। এতটা পথ এলাম। কোনো চোর ডাকাত তো কই আমাদের দিকে ফিরেও চায়নি। আমরা একাই যাব। নাও, কম্বল বের কর। শুই।’

বেশ ঠান্ডা পড়েছে। কালো আকাশপটে অজস্র জ্বলজ্বলে তারা। আধখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে! উঠোন প্রায় ফাঁকা। মাত্র কয়েকজন তখনও আগুনের ধারে বসে। বারান্দার এখানে-ওখানে লোকে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। কেউ

শোয়ার আয়োজন করছে। ঘরের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের কয়েক হাত দূরে তিন-চারজন আপাদমস্তক ঢেকে শুয়েছে। মধ্যিখানের ফাঁকা জায়গায় খানিক কাঠ কয়লার আগুন জ্বলছে! ভালোই হল। তারাও একটু আগুনের তাত পাবে। যা শীত। মশাল ও প্রদীপগুলো প্রায় নিবিয়ে ফেলা হয়েছে। চাঁদের আলোয় যেটুকু দেখা যায়। ভিক্ষুদের উল্টোদিকে বারান্দার কোণে একটা লোক বসে আছে। ভিক্ষু নজর করেছেন, যখন তিনি সমরকন্দের বণিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন লোকটা এসে বসল। তারপর থেকে ও চুপচাপ ঠায় বসে আছে।

হর্ষ ভিক্ষুর ঝুলি থেকে দুটো কম্বল বের করল। একটা পাতল মেঝেতে অন্যটা ভিক্ষু গায়ে দেবেন। তারপর সে নিজের ঝুলি থেকে টান মেরে একটা কম্বল বের করতেই খটাস করে ভারি কোনো জিনিস মেঝেতে পড়ল।

হর্ষ জিব কেটে আঁতকে ওঠে— ‘ওই যা! বাক্সটা কম্বলে জড়ানো ছিল ভুলে গেছি।’ সে তাড়াতাড়ি জিনিসটা কুড়িয়ে নিল।— ‘দেখি ভাঙল কি না?’ পাশে আগুনের আভায় হর্ষ সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল।

জেড পাথরের ভারি সুন্দর সবুজ রঙের একটি চৌকো বাক্স। প্রায় আধ হাত লম্বা, ছয় আঙুল মতো চওড়া।— ‘নাঃ, ফাটে-টাটে নি।’

খুট করে শব্দ হল। বাক্সর ডালা একটু খুলে সে ভিতরে উকি মারল। তারপর সেটা বন্ধ করে ভিক্ষুর হাতে দিল।— ‘দেখো, কিছু নষ্ট হয়নি।’ ভিক্ষু বাক্স নিয়ে— ‘এটা এখন আমার কাছে থাক’ বলে সেটা নিজের ঝোলায় পুরে, ঝোলাটা মাথার নীচে গুটিয়ে রেখে শুয়ে পড়লেন। হর্ষ গোমড়া মুখে ব্যাপারটা দেখল। তারপর সেও পাশে শুয়ে পড়ল।

দুই

ভিক্ষুর যখন ঘুম ভাঙল, তখনও রাত কাটেনি। অন্ধকার একটু ফিকে হয়েছে মাত্র। সরাইয়ের জীবন সবে জাগছে। আবছা আলোয় দু-একজন চলাফেরা করছে। ভিক্ষু হর্ষকে ডেকে তুললেন। হাতমুখ ধুয়ে ঝোলাঝুলি গুছিয়ে প্রস্তুত হলেন। সরাইয়ের ফটক খুললেই বেরিয়ে পড়তে হবে।

সমরকন্দের বণিকও ভোরে বেরবে বলেছে। দেখা হলে যদি আবার একসঙ্গে যেতে অনুরোধ করে তো মুশকিল। খানিক পরে পুব আকাশ রাঙা হয়ে উঠল। উঠোনে লোকের আসা-যাওয়া বেড়েছে। উট-ঘোড়াদের সাজ পরিয়ে তৈরি করানো হচ্ছে। গাড়ি জোতা হচ্ছে। ক্যাঁচ কোঁচ শব্দে ফটক খুলে গেল। ভিক্ষু উঠে পড়লেন। এই সময় তাঁর চোখ পড়ল তাদের সামনে বারান্দার অন্য কোণে বসা সেই একটা লোকের দিকে। লোকটি উঠে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাঁদের দেখছে। খুব জোয়ান চেহারা। দেখে মনে হয় মঙ্গোল। মুখের ভাব রুক্ষ। তার তাকাবার ভঙ্গিতে ভিক্ষুর কেমন অস্বস্তি লাগছিল। দুজনে সরাই থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

বাইরে চমৎকার ঠান্ডা বাতাস বইছে। আরামে গা জুড়িয়ে গেল। এখন প্রান্তরের দৃশ্যও বড়ো সুন্দর। পূর্বদিকে মস্ত থালার মতো টুকটুকে লাল সূর্যটা এখনও পুরোপুরি দিগন্তের আড়াল ছাড়িয়ে ওপরে উঠতে পারেনি। দূর পাহাড়ের শিখরগুলি যেন আবির মেখে রাঙা হয়ে উঠেছে। ভিক্ষু দেখলেন সেই যাযাবরদের তাঁবুগুলি নেই। ওরা রাতেই কোথাও রওনা দিয়েছে।

দুজনে বেশ স্বচ্ছন্দে পা চালায়। হর্ষ কিছুটা এগিয়ে গেছে। সে গুনগুন করে গান ধরেছে। ভিক্ষু মৃদুকণ্ঠে তথাগত বুদ্ধের স্তব করতে করতে চলেছেন। প্ৰায় এক দণ্ড চলার পর পথ ক্রমশ একটা পাহাড়ের দিকে বেঁকে যেতে থাকে। ওই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যেতে হবে।

পিছন থেকে খটাখট শব্দ এল ভেসে। কে আসে? দুজনে ফিরে তাকায়। একজন ঘোড়ায় চড়ে বেগে এই পথে আসছে। ঘোড়ার খুরের ঘায়ে ধুলোর মেঘ উঠছে।

দেখতে দেখতে অশ্বারোহী কাছে এসে পড়ল। ভিক্ষুরা পথের ধারে সরে দাঁড়ায়। অশ্বারোহী ঠিক তাদের পাশে এসে ঘোড়ার রাশ টানল। তারপর লাফিয়ে নামল। ভিক্ষু দেখলেন আরোহী সেই দুশমন চেহারার মঙ্গোল, তাঁদের উল্টো দিকে বারান্দায় যে বসেছিল। লোকটি সত্যি দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বিরাট। মাথায় সে ভিক্ষুর চেয়ে অন্তত এক বিঘত উঁচু। নিরেট চওড়া শরীর। রঙচঙে পোশাক পরেছে। গলায় দুলছে একটা সোনার হার। কী ব্যাপার! লোকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে ভিক্ষুর সামনে এসে কর্কশ স্বরে চীনাভাষায় বলল— ‘বাক্সটা দাও।’

‘বাক্স!’ ভিক্ষু অবাক। জানল কী করে।— ‘হ্যাঁ, সেই সবুজ পাথরের বাক্সটা। বের করো শীগগিরি। নইলে—’ মঙ্গোল একটা ভয় দেখানোর ভঙ্গি করে।

ভিক্ষু শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কেন কী দরকার?’

‘দরকার আছে। দাও।’ লোকটা চাপা হুংকার দিল।

ভিক্ষু ঝোলা থেকে বাক্সটা বের করলেন। বললেন— ‘এটা কী জন্যে চাইছ বুঝছি। কিন্তু এর মধ্যে কোনো দামি জিনিস নেই। মানে তোমার কাজে লাগবে না। এতে—’

ভিক্ষুর কথা শেষ হয় না। মঙ্গোল থাবা বাড়িয়ে খপ করে বাক্স ভিক্ষুর হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়।— ‘আগে দেখি, পরে কথা শুনব।’

ভিক্ষু লক্ষ্য করলেন, তাঁর পাশে দাঁড়ানো হর্ষ কাঁধের ঝুলি মাটিতে নামাচ্ছে তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। একটা হাঙ্গামা বাধাল বোধহয়। ভিক্ষু মৃদুস্বরে ধমক দেন— ‘আঃ, শান্ত হও। ধৈর্য ধরো।’

হর্ষর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

বাক্স ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে লোকটা। তার মুখ উৎকট হাসিতে ভরে যায়।

সে চাপ দিয়ে খুট করে বাক্সর ডালা খুলে ফেলল।

ভিক্ষু ব্যগ্রভাবে বলে ওঠেন, ‘তুমি ভুল ভাবছ। আমার কথা শোনো—’

মঙ্গোল ভিক্ষুর কথায় কর্ণপাত করে না।

বাক্সর নীচের অংশে পাথর কুঁদে ছোটো ছোটো কৌটোর মতো কতকগুলি খোপ বানানো হয়েছে। প্রত্যেকটি কৌটোর মুখে রুপোর ঢাকনি লাগানো। মোট দশটি কৌটো।

মঙ্গোল একটা কৌটোর ঢাকনি আঙুলে চেপে টানল। বেশ শক্ত করে আঁটা। ঢাকনি খুলল না। সে আরও জোরে টানল। ঢাকনি খুলে এল। ঝাঁকুনি খেয়ে বাক্সটা একটু কাত হল।

কৌটো থেকে পাতলা ঝিরঝিরে কাঠির মতো কতগুলো কী জানি চারপাশে মাটি ও বালির ওপর ছড়িয়ে পড়ল।

‘ইস, একী করলে। কী করলে—’ বলতে বলতে ভিক্ষু মাটি থেকে সেগুলি কুড়োবার চেষ্টা করে। কিন্তু মাত্র কয়েকটির বেশি খুঁজে পায় না। সব মাটিতে মিশে গেছে।

মঙ্গোল বোকার মতন চেয়ে আছে। ভিক্ষু বললেন, ‘বললাম তুমি যা ভাবছ তা নয়। এগুলো ফুলের বীজ। আমার ভারি ফুলের শখ। আমার বাবা ছিলেন রাজ-উদ্যানের মালী।’

মঙ্গোলের চোখে এখনও সন্দেহ।

এমন দামি বাক্সে এমন একটা অতি সাধারণ জিনিস থাকতে পারে সেটা সে বিশ্বাস করছে না।

ভিক্ষু ব’লে চলেন, ‘এ অতি মূল্যবান জিনিস। দুর্লভ সুন্দর সুন্দর ফুলের বীজ এগুলো। এসব ফুল আমাদের দেশে হয় না। তাই চীনদেশ থেকে বীজ নিয়ে চলেছি। আমার দেশের মাটিতে এই ফুলগুলি ফোটাতে চেষ্টা করব। একজনের কাছে একটা বাক্স চেয়েছিলাম। যাতে বীজগুলি পড়ে না যায়। শুকনো থাকে। লোকটি ধনী। এই চমৎকার বাক্সটা দিয়েছে।’

মঙ্গোলের মুখ রাগে কালো হয়ে যায়। তার কুতকুতে চোখের তীব্র দৃষ্টি ভিক্ষুকে লক্ষ্য করে। এতক্ষণে সে কথা বলে।

—‘এগুলো ফুলের বিচি নয়, এগুলো ওষুধ। জরিবুটি। হেকিমকে দেখাব যদি কেনে। আর কৌটোর মাল যেমন-তেমন হলেও বাক্সটা বিক্রি করলে ভালো পয়সা মিলবে মনে হয়।’

ভিক্ষু কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আচ্ছা বাক্স নাও। কিন্তু বীজগুলো আমায় দিয়ে যাও। আমার অনেক দিনের পরিশ্রম। কিন্তু ও জিনিস কেউ কিনবে না। আমি টুকরো টুকরো কাপড় দিয়ে বেঁধে নিচ্ছি। দাও ঢেলে নিই।’

তিনি মঙ্গোলের দিকে একটু এগোতেই সে হুংকার দিল— ‘চোপ। তফাত যাও।’

হর্ষ এতক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটিও কথা বলেনি। হঠাৎ সে এগিয়ে গিয়ে চট করে লোকটার হাত থেকে বাক্সটা কেড়ে নিয়ে কয়েক পা সরে গেল।

প্রথমে চমকে যায় মঙ্গোল। কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে থাকে হর্ষর দুঃসাহসে। তারপর গর্জন ছাড়ে– ‘অ্যাই ছোকরা। দে বাক্স।’

—‘বীজ ঢেলে নিয়ে তবে বাক্স দেব।’ হর্ষর স্বর দৃঢ় কঠিন। ‘আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাক্সই পাবে না।’

ভিক্ষু প্রমাদ গোনেন।

—‘তবে রে বেটা!’ কিন্তু মঙ্গোল হিংস্র জানোয়ারের মতো লাফ দিয়ে গিয়ে বাঁ হাতে হর্ষর কাঁধের কাছে জামা চেপে ধরে। আর সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের টানে কোমর বন্ধনী থেকে বের করে আনে এক মস্ত ছোরা। হর্ষর বুকের সামনে ঝকঝক করে ওঠে ছোরার তীক্ষ্ণ ফলাটা।

ভিক্ষুর গলা দিয়ে একটা আর্তরব বেরয়— ‘মেরো না।’ তিনি হাত তুলে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেন দুজনের মাঝে। কিন্তু তখনি যেন এক ভেলকি খেলে গেল চোখের সমুখে

পলকে হর্ষ বাক্স মাটিতে ফেলে দিল। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে সে এক হাতের মুঠোয় দস্যুর অস্ত্রধরা হাতের কবজি চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কেমন কায়দায় জানি মোচড় দিল তার কবজিতে। ‘আঁক’— কাতরে উঠল লোকটা। তার মুঠো থেকে ছোরা পড়ল খসে। পরক্ষণেই লোকটার ডানহাত হৰ্ষ দুহাত দিয়ে পেঁচিয়ে আটকে ধরে জোরে চাপ দিল। ‘আঁ আঁ—’ লোকটা যন্ত্রণায় বিকট চিৎকার করে ওঠে।

সে বাঁ হাত তুলল হর্ষকে মারবে বলে। সঙ্গে সঙ্গে আবার তার হাতে চাপ দিল হর্ষ।

আর্তনাদ করে ওঠে মঙ্গোল। তার উদ্যত বাঁ হাত নেতিয়ে পড়ে।- ‘খবরদার। বাঁ হাত তুলেছ কি এ হাতটা ভেঙে দেব।’ হর্ষ শাসায়। তার মুখ তখন হিংস্র রক্তবর্ণ।

—‘কী হে বাছাধন কেমন লাগে। বড়ো যে তেজ দেখাচ্ছিলে?’ বিদ্রূপের সুরে বলতে বলতে হর্ষ আরও কয়েকবার চাপ দিল তার হাতে। দুর্দান্ত মঙ্গোল তখন অসহায়। ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠেছে। হর্ষ হঠাৎ একটু নীচু হয়। তারপর অদ্ভুত কৌশলে লোকটার পা নিজের পা দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে সজোরে এক ঝটকা মারতেই লোকটার অতবড়ো বিরাট দেহ গোড়াকাটা কলাগাছের মতো দড়াম করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। ভাগ্যে পাথরের ওপর পড়েনি। তাহলে নির্ঘাত হাড়গোড় ভেঙে যেত। হর্ষ চকিতে ছোরাটা কুড়িয়ে নিয়ে বাঘের মতো লাফ দিয়ে লোকটার মাথার কাছে দাঁড়াল— ‘এইবার?’

চিত হয়ে অসাড় ভাবে লোকটা পড়ে আছে মাটিতে। ওঠার শক্তি নেই যেন। নেই আত্মরক্ষার ক্ষমতা। হর্ষর উদ্যত ছুরি ধীরে ধীরে তার কণ্ঠনালি লক্ষ্য করে নেমে আসে। ছুরির ডগা আলতো ভাবে তার গলা স্পর্শ করে। এবার এক হঠাৎ চাপ। ব্যস। হর্ষের ঠোটের কোণে, তীব্র চাউনিতে যেন চাপা রসিকতার ছোঁয়াচ। বেড়াল যেমন তার শিকারকে বাগে পেয়ে খেলিয়ে মারে তেমনি হর্ষ বুঝি খেলছে ওকে নিয়ে।— ‘কী, ভগবানের নামটাম করবে নাকি? ঝটপট সেরে ফেলো।’ হর্ষ বলল। দস্যু নিস্পন্দ। শুধু তার চোখ মৃত্যুর আতঙ্কে বিস্ফারিত। হর্ষ একবার আড়চোখে ভিক্ষুর পানে তাকায়। তারপর সহসা তার ছুরি ধরা হাত গুটিয়ে নেয়। বলে— ‘যা পালা, ছুঁচো কোথাকার। আর কখনো আমার সঙ্গে লাগতে এলে তোর ঘাড় ভেঙে দেব। মনে রাখিস।’

লোকটা কিন্তু কিছুক্ষণ উঠতে পারল না। পরে কোনোরকমে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। বাঁ হাতে সে তার ডান হাতের কনুই ধরে আছে। মুখে যন্ত্রণার ছাপ। সে আস্তে আস্তে তার ঘোড়ার কাছে গেল। কাছেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘোড়াটা। সে কয়েক বারের চেষ্টায় ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল। তারপর ঘোড়া চালাল

ধীর কদমে ঘোড়া চলল সোজা পাহাড়ের দিকে। একটু পরেই অশ্বারোহী পাথরের ঢিপির আড়ালে অদৃশ্য হল।

হতভম্ব দর্শক ভিক্ষু উচ্চারণ করেন— ‘এ কী করে করলি? অতবড়ো জোয়ানটাকে খালি হাতে…’

হর্ষ মাটি থেকে বাক্স কুড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ওঃ, এ একরকম কুস্তির প্যাঁচ। নিপ্পনি প্যাঁচ। এ দিয়ে নিজের চেয়ে ঢের বড়ো জোয়ানকে খালি হাতে কাবু করা যায়। ছোরাছুরি আটকানো যায়। আমি ইচ্ছে করলে লোকটাকে দারুণ জখম করতে বা একদম শেষ করে দিতে পারতাম। নেহাত তুমি রয়েছ তাই—’

—‘এ কোথায় শিখলি?’

—‘নিপ্পন দ্বীপে।’

—‘কে শেখাল?’ ভিক্ষু জিজ্ঞেস করেন।

তার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে। হর্ষ বলল, ‘যে বাড়িতে আমি থাকতাম তার পাশের বাড়িতে এক নিপ্পনি যোদ্ধা থাকত। প্রায়ই যেতাম তার বাড়ি। যোদ্ধার স্ত্রী আমায় খুব ভালোবাসত। এটা-ওটা খেতে দিত। আবিষ্কার করলাম সেই যোদ্ধা সকাল সন্ধ্যা তার দুই শাকরেদকে নিয়ে এ ধরনের প্যাঁচ অভ্যেস করে। ব্যস, ওস্তাদের পিছনে লাগলাম। আমায় শেখাতেই হবে এই প্যাঁচ। শেখাতে কি চায়! বলে, এ নাকি গোপন বিদ্যে। যাকে-তাকে শেখানো হয় না। আমি আবার বিদেশি। আমিও নাছোড়বান্দা। লেগে রইলাম ছিনেজোঁকের মতো। খোশামোদ চালিয়ে গেলাম। বললাম— অস্ত্রছাড়া শুধু হাতে দেশবিদেশে ঘুরি দুজনে। যদি দুষ্টু লোকের পাল্লায় পড়ি। আত্মরক্ষা করব কী করে। দয়া করে শেখাও দাদা। শেষে ওস্তাদ রাজি হল। অনেকটা তোমার কথা ভেবেই। মানে তোমায় আমি বাঁচাব। খুব ভক্তি যে তোমার ওপর। তবে শর্ত করে নিল— ভারতবর্ষে না পৌঁছে কাউকে জানাবে না এ কথা। শুধু খুব বিপদে পড়লে তবেই প্রয়োগ করবে এই প্যাঁচ। খুব গোপনে আমায় শেখাল। ভারি শক্ত! অনেক কসরত করতে হয়। মাত্র কয়েকটা প্যাঁচ শিখতে পেরেছি। ভাগ্যিস শিখিয়েছিল!’

ভিক্ষুর কাছে নিপ্পনের রহস্য এখন পরিষ্কার। কিঞ্চিৎ অভিমানের সুরে বলেন— ‘কই আমায় বলিসনি তো?’

‘ভয় হচ্ছিল। যদি তুমি রাগ কর। এদিকে পড়া করিনি। যা করতে বলে গিয়েছিলে। তাছাড়া ওস্তাদ যে বারণ করেছিলেন কাউকে বলতে। এমনকী তোমাকেও না।’

ভিক্ষু কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘তুমি একটি আস্ত গুন্ডা।’

পিছনে অনেক দূর থেকে কতগুলো আওয়াজ ভেসে এল। মানুষের কথাবার্তা গাড়ির চাকার ক্যাঁচকোঁচ। ভিক্ষু খুশি হয়ে বলে ওঠেন, ‘হর্ষ, সরাইখানা থেকে কোনো যাত্রীদল আসছে এ পথে। চলো দেখি।’

হর্ষ ভিক্ষুর মনোভাব বুঝতে পেরেছিল। সে সায় দেয়। দুজনে ফিরে চলে। তারা দেখে বেশ বড়ো একটা দল এগিয়ে আসছে। অনেক লোক। উট, গাধা, ঘোড়ায় টানা গাড়ি। উটের পিঠে আট-দশজন সশস্ত্র সৈনিকও আসছে সঙ্গে।

দুজনে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রমে দল কাছে এসে পড়ে। সৈনিকরা তাদের লক্ষ্য করছে সন্দিগ্ধভাবে। হঠাৎ তারা দেখল, একজন ঘোড়ার গাড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে উঠে তাদের দিকে হাত নাড়ছে। ভিক্ষু চিনতে পারেন— সেই সমরকন্দের বণিক।

বণিক ভিক্ষুর সামনে এসে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘আচার্য, আমার সৌভাগ্য আপনার দেখা পেয়ে গেলাম। কাল রাতে ভাবছিলাম বলি- আমার সঙ্গে কাশগর অবধি চলুন। পথে দুটো ভালো কথা শুনতে পাব। কিন্তু বলিনি, যদি আপনার অসুবিধা হয়। এখন যখন দেখা পেয়েছি আর ছাড়ছি না। আমার অনুরোধ কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গলাভ থেকে আমায় বঞ্চিত করবেন না।’

ভিক্ষু মৃদু হেসে বললেন, ‘বেশ। চলুন তাই যাই।’ ভিক্ষু উঠলেন বণিকের গাড়িতে। তারপর হর্ষের দিকে ফিরে বললেন, ‘প্যাঁচের নামটা তো বললি না তুই?’ হর্ষ একটা উটের পিঠে মহানন্দে জাঁকিয়ে বসেছে। সে অভিরামের দিকে চেঁচিয়ে বলল, ‘কুমিউসি!’

এই কুমিউসি আরও প্রায় চারশো বছর পরে জাপানে যুযুৎসু প্যাঁচ নামে খ্যাতি লাভ করে।

১৩৮০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *