স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ৯

অধ্যায় ৯

বিল্ডিংয়ের ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। লোকজন না থাকায় নিজের পায়ের শব্দই কানে এসে বাজছে; যদিও পরনের ট্রেইনার জুতোর সোলগুলো রাবারের।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় ওঠার পর অবশেষে একজনের দেখা পাওয়া গেল। চশমা পরা একটা ছেলে। খানিকটা বিস্ময়ের দৃষ্টিতেই ওর দিকে তাকালো ছেলেটা। বোধহয় খুব বেশি অপরিচিত নারীকে এখানে দেখেনি, মনে মনে বলল কাওরু উতসুমি।

শেষবার এখানে পা পড়েছিল বেশ কয়েক মাস আগে, ফোর্সে জয়েন করার পর প্রথম তদন্তের একটা কাজে। ভেবে অবাক হয়েছিল, কুসানাগি কেন একজন পদার্থবিদের কাছে কেসের ব্যাপারে পরামর্শের জন্যে পাঠাচ্ছে তাকে। কোথায় যেতে হবে মনে আছে এখনও।

১৩ নম্বর ল্যাবরেটরি আগের জায়গাতেই আছে। একটা সাদা হোয়াইট বোর্ড ঝুলছে দরজায়। ল্যাবের লোকজন কে কোথায় আছে তার বিস্তারিত লেখা আছে সেখানে। ‘ইউকাওয়া’ নামটার পাশে একটা লাল রঙের চুম্বক লাগানো। ভেতরেই আছেন তিনি। লম্বা একটা শ্বাস নিল উতসুমি। যাক, অন্তত একই কাজে দ্বিতীয়বার আসতে হচ্ছে না।

বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ল্যাবের অন্য সবাই এ মুহূর্তে বাইরে। এটাও স্বস্তির একটা কারণ। অন্য কারো সামনে কেস নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগতো না।

দরজায় কড়া নাড়লো উতসুমি। “আসুন।” অপেক্ষা করতে লাগলে সে।

“দরজাটা অটোম্যাটিক নয়,” কিছুক্ষণ পর আবারো বলল ভেতরের কন্ঠস্বর।

হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। উতসমির দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে একজন। পরনে কালো রঙের টিশার্ট। মনোযোগ সামনের স্ক্রিনের দিকে। আশপাশে নানারকম যন্ত্রপাতি সাজানো।

“সিঙ্কের পাশের কফিমেকারের সুইচটা দিতে পারবেন?” না ঘুরেই জিজ্ঞেস করল লোকটা। “খুব বেশি সময় লাগবে না।”

সিঙ্ক ওর ডানদিকে। কফিমেকারটা দেখে নতুন মনে হচ্ছে। সুইচে চাপ দিতেই শব্দ করে চালু হয়ে গেল ওটা।

“আমি শুনেছিলাম আপনার ইন্সট্যান্ট কফি পছন্দ,” বলল উতসুমি।

“ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে জেতার পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছি জিনিসটা। ভাবলাম কাজে লাগিয়ে দেখি। খারাপ না যন্ত্রটা, প্রতি কাপে খরচও তুলনামূলক কম।”

“তাহলে তো আরো আগে নিলেই ভালো হতো।”

“না। একটা ঝামেলা আছে।”

“কি?”

“স্বাদ ইন্সট্যান্ট কফির মতন হয় না,” কিবোর্ডের একটা বাটনে শব্দ করে চাপ দিয়ে বলল মানার ইউকাওয়া। পরমুহূর্তে ঘুরে উতসুমির দিকে তাকালো। “ফোর্সে মানিয়ে নিচ্ছেন তাহলে?”

“নিচ্ছি ধীরে ধীরে।”

“আমার একটা থিওরি আছে। ধীরে ধীরে তদন্তের কাজের সাথে মানিয়ে নেয়া আর মনুষত্য বিসর্জন দেয়া অনেকটা একই রকম।”

“ডিটেক্টিভ কুসানাগিকে আপনার এই থিওরির ব্যাপারে বলেছেন?”

“বেশ কয়েকবার। তবে ও বুঝেছে বলে মনে হয় না,” আবারও মনিটরের দিকে দৃষ্টি ফেরালো ইউকাওয়া। হাত মাউসে।

“কি এটা?”

“ফেরাইটের ক্রিস্টালাইন স্ট্রাকচার। স্ফটিক তো চেনেন?” ফেরাইট…মানে চুম্বক?”

একবার ভ্রু নাচালো ইউকাওয়া। “ফেরোম্যাগনেটিক আসলে …তবে আপনি ঠিক পথেই এগোচ্ছেন।”

“একবার পড়েছিলাম কোথায় যেন। ম্যাগনেটিক হেড বানাতে ব্যবহৃত হয় এগুলো, তাই না?”

“কুসানাগি এখনও জানে না কী রকম সহকারি পেয়েছে,” বিড়বিড় করে বলল ইউকাওয়া। মনিটরটা বন্ধ করে উতসুমির দিকে ফিরলো সে। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করা যাক। আমি করছি প্রথমটা। আপনার এখানে আসার ব্যাপারে কেন কুসানাগিকে কিছু জানাবো না?”

“সেটা ব্যাখ্যা করতে হলে আমাকে আগে কেসটার ব্যাপারে জানাতে হবে।”

ধীরে মাথা ঝাঁকালো ইউকাওয়া। “আপনি যখন ফোন দিয়েছিলেন, প্রথমে না করেছিলাম। কারণ পুলিশের কেস নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু মত বদলেছি যখন আপনি বললেন, কুসানাগি আপনার এই আগমনের ব্যাপারে কিছু জানবে না। ব্যাপারটা কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে আমার কাছে। সেজন্যেই ব্যস্ত শিডিউল সত্ত্বেও আপনাকে আসতে বলেছি। তাই আগে এই প্রশ্নেরই উত্তর দিন। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নেব, আপনার অন্য কথাগুলো শুনবো কি না।“

কথা বলার সময়টুকু প্রফেসরের চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিল উতসুমি। কুসানাগি তাকে বলেছিল যে ‘ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও’ পুলিশি তদন্তে অনেকবারই সাহায্য করেছে। কিন্তু বিশেষ একটা কেসের কারণে তাদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমে গেছে। কেউ অবশ্য সেই কেসটার ব্যাপারে উসুমিকে কিছু বলেনি।

“কেসের ব্যাপারে না বললে কেন এই গোপনীয়তা, সেটা ব্যাখ্যা করাটা কঠিন হয়ে যাবে।“

“মনে হয় না। আপনি যখন কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, তখন কি তাকে পুরো কেস সম্পর্কে খুলে বলেন? ওরকম ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ করেন, সেটাই করুন না হয়। আর দ্রুত। যত বেশি সময় নষ্ট করবেন, ল্যাবে মানুষ আসার সম্ভাবনা ততই বেড়ে যাবে।”

প্রফেসরের চাঁছাছোলা কথা বলার ধরণ পছন্দ হলো না উতসুমির।

“কোন সমস্যা?” চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল ইউকাওয়া। “কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?”

“ওরকম কিছু না।“

“তাহলে যত দ্রুত বলবেন, আপনার জন্যেই মঙ্গল। খুব বেশি সময় নেই আমার হাতে।”

“বেশ,” ভেতরে ভেতরে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল উতসুমি। “ডিটেক্টিভ কুসানাগি…” ইউকাওয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে শুরু করল সে, “… প্রেমে পড়েছেন।”

“কি?” ইউকাওয়ার কন্ঠস্বরের শীতল ভাবটা দূর হয়ে কৌতূহল ভর করল। ক্ষণিকের জন্যে বিস্ময় খেলা করে গেল তার চোখে। “প্রেম?”

“হ্যাঁ,” উতসুমি বলল।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো ইউকাওয়া। হাত দিয়ে চশমা ঠিক করল একবার। “কার প্রেমে?” উতসুমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।

“সন্দেহভাজনের,” জবাব দিল উসুমি। “আমাদের বর্তমান কেসের একজন সন্দেহভাজনের প্রেমে পড়ে গিয়েছেন তিনি। এতে তার চিন্তাধারা ব্যহত হচ্ছে। সেজন্যেই চাচ্ছিলাম না, আমার এখানে আসার ব্যাপারটা তার কানে যাক।“

“তাহলে এক্ষেত্রে সে কোনরকম পরামর্শে আশা করছে না আমার কাছ থেকে?”

“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল উতসুমি।

বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে চোখ বুঝলো ইউকাওয়া। চেয়ারে হেলান দিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিল কয়েকবার। “আমি আসলে আপনাকে খাটো করে দেখছিলাম এতক্ষণ। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে আপনি কারণটা বলা মাত্রই সাহায্যের ব্যাপারে মানা করে দেবো। কিন্তু যা বললেন…একদমই অপ্রত্যাশিত। প্রেম? আপনি কি আসলেই ডিটেক্টিভ কুসানাগির ব্যাপারে কথা বলছেন?”

“এবারে কি আপনাকে কেসটা সম্পর্কে বলতে পারি?” উতসুমি জিজ্ঞেস করল বিজয়ীর সুরে।

“আগে কফি খেয়ে নেই। বিস্তারিত আলোচনার আগে একটু ক্যাফেইন দরকার আমার।”

উঠে দাঁড়িয়ে দু’টা কাপে কফি ঢাললো ইউকাওয়া।

“সবকিছু এটাকে ঘিরেই,” একটা কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল উতসুমি।

“মানে?”

“কফি। কেসের শুরুটা কফি দিয়েই।”

“শুরু করুন তাহলে,” চেয়ারে বসে বলল ইউকাওয়া।

ইয়োশিতাকা মাশিবার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যা যা জানে সবকিছু ধারাবাহিকভাবে খুলে বলল উতসুমি। আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য ফোর্সের বাইরের কাউকে কোন কেস সম্পর্কে তথ্য দেয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু কুসানাগি তাকে আগেই বলে দিয়েছিল, ইউকাওয়ার কাছ থেকে কিছু লুকানোর অর্থ তার সাহায্য পাবার সম্ভাবনা শূন্য। তাছাড়া ডিটেক্টিভ গ্যালিলিওর প্রতি ভরসা আছে উতসুমির।

সব কিছু শুনে শূন্য কফির কাপের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ইউকাওয়া।

“অর্থাৎ-আপনি ভিক্টিমের স্ত্রীকে সন্দেহ করেন, কিন্তু কুসানাগি করে না। বরং মহিলার প্রেমে পড়ে গিয়েছে সে, এইজন্যে পরিস্কারভাবে চিন্তাভাবনাও করতে পারছে না।”

“হয়তো শুরুতেই ‘প্রেম’ বলাটা উচিত হয়নি আমার। আপনার মনোযোগ আকর্ষণের কারণে বলেছিলাম। কিন্তু এটা সত্য, মিসেস মাশিবার প্রতি একটু হলেও আকৃষ্ট ডিটেক্টিভ কুসানাগি। তার আশপাশে অদ্ভুত আচরণ করেন তিনি। তার সম্পর্কে কথা বলার সময়েও একই অবস্থা।“

“আমি এটা জিজ্ঞেস করবো না, কিভাবে আপনি এতটা নিশ্চিত হলেন এই ব্যাপারে। মেয়েরা এসব জিনিস বরাবরই ভালো বোঝে।”

“কথাটা প্রশংসা হিসেবেই নিলাম।”

ভ্রু কুঁচকে কফি কাপটা ডেস্কে নামিয়ে রাখলো ইউকাওয়া। “তবে আপনার কথা শুনে কিন্তু এটাও মনে হচ্ছে না যে, কুসানাগির চিন্তাধারা একদম ভুল। আয়ানে মাশিবা বললেন না মহিলার নাম? তার অ্যালিবাই তো শক্তপোক্তই।”

“হত্যাকাণ্ডে যদি ছুরি বা বন্দুক ব্যবহার করা হতো তাহলে আমিও ডিটেক্টিভ কুসানাগির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করতাম না। কিন্তু এটা বিষ প্রয়োগে হত্যা। ইচ্ছে করলে আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখা সম্ভব।”

“এখন আপনি চাইছেন, আমি বের করি কিভাবে সেটা করা হলো?” চুপ করে থাকলো উতসুমি।

একটা পরিচিত হাসি ফুটলো পদার্থবিদের চেহারায়। “আমার সম্পর্কে আপনি বোধহয় ভুল শুনেছেন। পদার্থবিজ্ঞান কোন জাদুবিদ্যা নয় যে ছড়ি ঘুরালাম আর উত্তর সামনে চলে আসবে।”

“কিন্তু এর আগে আপনি অনেক জটিল জটিল কেসের সমাধান করেছেন।”

“অপরাধের কৌশল আর জাদুর কৌশলের মধ্যে পার্থক্য আছে। জানেন সেটা কি?” উতসুমির মাথা ঝাঁকানো অবধি অপেক্ষা করে নিজেই উত্তর দিল ইউকাওয়া। “দুটো কৌশলই গোপন। কিন্তু জাদুর ক্ষেত্রে প্রদর্শনীর পর দর্শকদের কোন সুযোগ থাকে না গোপন কৌশলটা জানার। কিন্তু অপরাধের ক্ষেত্রে সব খুঁটিনাটি বিবেচনা করা হয় কৌশল উদঘাটনের উদ্দেশ্যে। যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে অপরাধ সংঘটনের পর সবকিছু ধামাচাপা দেয়া, এ ব্যাপারে তো আপনি আমার সাথে একমত?”

“যদি এই কেসে সবকিছু আসলেই ঠিকমতো ধামাচাপা দেয়া হয়ে থাকে?”

“আপনার কাছ থেকে যা যা শুনলাম, মনে তো হচ্ছে সে সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ। মি. মাশিবার প্রেমিকার নাম যেন কী বললেন?”

“হিরোমি ওয়াকাইয়ামা।”

“সে ভিক্টিমের সাথে কফি খাওয়ার কথা স্বীকার করেছে, তাই না? কফি বানানোর কথাও বলেছে। যদি আসলেই কোনভাবে কফিতে বিষ মেশানো হয়ে থাকে তাহলে তারও মারা যাবার কথা। তা হলো না কেন? আপনি কোন গোপন উপাদানের কথা বলছেন, যা হয়তো স্বাদ বাড়ানোর জন্যে মেশানো হতে পারে। সেটা একটা ভালো সম্ভাবনা। অর্থাৎ ভিক্টিম নিজ হাতেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনবে। কোন গোয়েন্দা উপন্যাসের জন্যে এটা ভালো প্লট, কিন্তু বাস্তবে কতটা সম্ভব সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়।”

“কেন?”

“ধরুন আপনিই অপরাধী। আপনি ভিক্টিমকে উপাদানটা ব্যবহারের কথা বললেন, কিন্তু সেটা সে বাসার বাইরে নিয়ে গেল। বন্ধুর বাসায় গিয়ে স্ত্রীর দেয়া উপাদানটা মিশিয়ে একসাথে কফি খেল, তখন?”

ঠোঁট কামড়ে ধরলো উতসুমি। যুক্তি আছে ইউকাওয়ার কথায়।

“স্ত্রী-ই যদি খুনি হয়ে থাকে তাহলে তাকে তিনটি প্রধান বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে,” তিন আঙুল দেখিয়ে বলল ইউকাওয়া। “এক, মুখে দেয়ার আগে এ ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ পোষণ করা যাবে না যে কফিতে বিষ মেশানো আছে। সেক্ষেত্রে, অ্যালিবাই তৈরি করেও কোন লাভ বেই। দুই, তাকে নিশ্চিত হতে হবে, একমাত্র মি. মাশিবাই বিষ মেশানো কফি খাবেন। তিন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায় এরকম কোন পদ্ধতি হতে হবে। হোক্কাইদো যাবার আগের রাতে তাদের বাসায় দাওয়াত ছিল, তাই তো? যদি বেশি আগে বিষ মেশানো হয় তাহলে অন্য কেউ সেটা মুখে দিয়ে ফেলতে পারে, সেক্ষেত্রে লোকজন চলে যাবার পরেই কাজ সারতে হবে তাকে। আর সেটা কিভাবে সম্ভব, তা আমার মাথায় আসছে না। দুঃখিত।”

“এই বাঁধাগুলো অতিক্রম করা কি আসলেও এতটা কঠিন?”

“আমার কাছে তো কঠিনই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রথমটা। মিসেস মাশিবা নির্দোষ সেটা ধরে নেয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত।”

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো উতসুমির বুক চিড়ে। ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও নিজেই যদি বলেন এটা অসম্ভব, তাহলে বোধহয় আসলেই তাই। তার মোবাইল বেজে উঠল এসময়। রিসিভ বাটনে চাপ দেয়ার সময় আড়চোখে ইউকাওয়াকে আবারো কাপে কফি ঢালতে দেখলো।

“কোথায় তুমি?” খানিকটা রুক্ষ শোনালো কুসানাগির কন্ঠস্বর।

“একটা ফার্মেসিতে এসেছি আর্সেনাস এসিড সম্পর্কে টুকটাক প্ৰশ্ন করতে। কিছু হয়েছে?”

“ফরেনসিকের রিপোর্ট এসেছে। কফি ছাড়াও অন্য জায়গাতে বিষের অস্তিত্ব পেয়েছে তারা।“

শক্ত করে ফোনটা চেপে ধরলো উতসুমি। “কোথায়?”

“স্টোভে চাপানো কেতলিতে।”

“কেতলিতে? আসলেই?”

“খুব অল্প পরিমাণে, কিন্তু হ্যাঁ। হিরোমি ওয়াকাইয়ামাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে আসছি আমি।”

“তাকে? কেন?”

“কেতলিতে তার হাতের ছাপ ছিল।”

“তা তো থাকবেই। রবিবার সকালে সে-ই কফি বানিয়েছিল।”

“অর্থাৎ তার পক্ষে বিষ মেশানো সম্ভব।

“শুধুমাত্র তার হাতের ছাপই কি পাওয়া গিয়েছে?”

“না, মি. মাশিবার হাতের ছাপও মিলেছে।

“মিসেস মাশিবার?”

ওপাশে লম্বা শ্বাস ছাড়লো কুসানাগি। “তা তো মিলবেই। উনি ওখানেই থাকেন। কিন্তু শেষ স্পর্শ তার ছিল না, এটা ফরেনসিক থেকে নিশ্চিত করেছে। সেই সাথে তারা এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে, গ্লোভস পরে কেউ কেতলিতে হাত দেয়নি।”

“গ্লোভস পরে হাত দিলেও অনেক সময় বোঝা যায় না।”

“সেটা জানি আমি। কিন্তু তুমি আরেকটু ভালোভাবে আলামতগুলো নিয়ে চিন্তা করে দেখো। মিস ওয়াকাইয়ামা বাদে অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয় কেতলিতে বিষ মেশানো। তাকে স্টেশনে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তুমিও থাকবে।”

উতসুমি কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল।

“কিছু জানতে পেরেছেন মনে হচ্ছে?” কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল ইউকাওয়া।

কুসানাগির বলা কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করল উতসুমি।

“কেতলিতে? আসলেই?”

“আমিও অবাক হয়েছি। হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিলাম। রবিবার সকালে হিরোমিকা ওয়াকাইয়ামা ঐ কেতলিতে কফি বানিয়েছে। অর্থাৎ তখন কেতলিতে বিষ ছিল না। আয়ানে মাশিবার পক্ষে বিষ মেশানো সম্ভব নয় কেতলিতে।”

“তাহলে এটাও মেনে নিচ্ছেন না কেন যে আয়ানে মাশিবার বিষ মেশানোর কোন দরকারই ছিল না?”

কি বলবে খুঁজে পেলো না উতসুমি।

“এইমাত্রই কিন্তু আপনি স্বীকার করলেন, মিসেস মাশিবার পক্ষে কাজটা করা সম্ভব নয়,” ইউকাওয়া বলল, “কিন্তু সেটা একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন মি. মাশিবা শেষবার কেতলিতে ব্যবহারের আগে অন্য কেউ ওটা ব্যবহার করবে ঠিকই, কিন্তু তার কোন ক্ষতি হবে না। যদি এরকম হতো যে অন্য কেউ কেতলিটা ব্যবহার করেনি তাহলে কিন্তু পুলিশ প্রথমেই মিসেস মাশিবাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো। এগুলো তো তার জানার কথা, সেক্ষেত্রে অ্যালিবাই তৈরি করারও কোন উপযোগিতা থাকতো না।”

“তা ঠিক বলেছেন,” মাথা নিচু করে বলল উতসুমি। “দু’ভাবে চিন্তা করলেই মিসেস মাশিবাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায়, তাই না?”

ইউকাওয়া জবাব দিল না, কেবল তাকিয়ে রইলো উতসুমির দিকে। কিছুক্ষণের নীরবতার পর বলল, “তাহলে এখন কী করবেন? কুসানাগির সাথে আপনিও হিরোমি ওয়াকাইয়ামাকে সন্দেহ করা শুরু করবেন?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল উতসুমি। “নাহ।”

“বেশ আত্মবিশ্বাসী আপনি। কেন সন্দেহ করবেন না, জানতে পারি? দয়া করে এটা বলবেন না, মি. মাশিবাকে ভালোবাসে মিস ওয়াকাইয়ামা,” চেয়ারে পা ভাঁজ করে বসে বলল ইউকাওয়া।

আবারও কথার খেই হারিয়ে ফেলল উতসুমি। এই কথাই বলতে চলেছিল সে। এছাড়া অন্য কোন কারণ মাথায় আসছে না।

কিন্তু কেন যেন তার মনে হচ্ছে, ইউকাওয়াও বিশ্বাস করে না যে হিরোমি ওয়াকাইয়ামা দোষী। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণও আছে।

কেসটা সম্পর্কে উতসুমি তাকে যতটুকু বলেছে কেবল সেটুকুই জানেন তিনি। সুতরাং এই তথ্যগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে উত্তরটা।

“ওহ!” কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বলে উঠল উতসুমি

“কি?”

“কেতলিটা ধুয়ে রাখতো সে!”

“মানে?”

“কেতলিতে যদি মিস ওয়াকাইয়ামা বিষ মেশাতেন, তাহলে পুলিশের লোক আসার আগেই সেটা ধুয়ে ফেলতেন। পর্যাপ্ত সময় ছিল তার কাছে।“

সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ইউকাওয়া। “ঠিক ধরেছেন। সেই সাথে এটাও বলা যায় যে তিনিই যদি খুনি হতেন তাহলে কেতলিটা ধুয়ে ফেলার পাশাপাশি পুরনো কফি বিনগুলো আর ব্যবহৃত পেপার ফিল্টারও সরিয়ে নিতেন। আমি হলে মৃতদেহের পাশে কিছুটা বিষ ছড়িয়ে দিতাম, যাতে আত্মহত্যা মনে হয়।“

একবার বাউ করল উতসুমি। “আপনার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল। ধন্যবাদ।”

ঘুরে দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল সে। “ডিটেক্টিভ,” পেছন থেকে ডাক দিল ইউকাওয়া। থেমে গেল উতসুমি।

“আমার পক্ষে তো ঘটনাস্থলে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি যদি ক্রাইম সিনের কিছু ছবি…

“কিসের ছবি?”

“রান্নাঘরটা, যেখানে কফিতে বিষ মেশানো হয়েছিল। এ ব্যাপারটা আমাকে কৌতূহলী করে তুলছে যে কিভাবে হোক্কাইদো থেকে একজনের পক্ষে টোকিওতে বিষ মেশানো সম্ভব হলো।”

চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারলো না উতসুমি। কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে ইউকাওয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। “নিন।”

“কি এটা?”

“আপনি যে ছবিগুলো চাচ্ছিলেন। সকালেই ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।”

ফাইলটা হাতে নিয়ে ভেতরে চোখ বোলালো ইউকাওয়া।

“আমরা যদি বের করতে পারি, কিভাবে কফিতে বিষ মেশালেন মিসেস মাশিবা,” ইউকাওয়া হেসে বলল, “কুসানাগির চেহারাটা যা হবে না!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *