স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ২২

অধ্যায় ২২

ইদাবাশি স্টেশন থেকে বের হয়ে কাগুরা অ্যাভিনিউ ধরে কিছুদূর এগিয়ে গেল কুসানাগি। এই এলাকাটায় এখনও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। বেশিরভাগই পুরনো স্থাপনা। ফাঁকে ফাঁকে ছোট র‍্যামেন বা সুশি রেস্তোরাঁ। আমোনতেন মন্দিরের কাছে এসে বামপাশের ঢালু রাস্তাটায় প্রবেশ করল সে। ঢালের শেষ মাথায় অবস্থিত অফিস ভবনটাই তার গন্তব্য।

ভবনের প্রবেশ ফটকের পাশে একটা লম্বা ফলকে কোন তলায় কোন কোন কোম্পানির অফিস তার বিস্তারিত লেখা। কুনুগি পাবলিশিংয়ের পাশে লেখা-তৃতীয় তলা।

লিফট থাকলেও সিঁড়ি বেয়েই ওপরে উঠতে লাগলো কুসানাগি। তবে সিদ্ধান্তটা যে ভালো হয়নি তা একতলা ওঠার পর সিঁড়ির পাশে স্তূপ করে রাখা কার্ডবোর্ডের বাক্স দেখেই বুঝতে পারলো। অগ্নিনির্বাপণ বিধি লঙ্ঘন করার অপরাধে চাইলে ভবনের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।

তিনতলায় পৌঁছে দেখতে পেলো কাচের দরজার অপর পাশে কাজে মগ্ন কয়েকজন কর্মি। দরজার সবচেয়ে কাছে বসে থাকা মহিলা কুসানাগিকে দেখে এগিয়ে এলো।

“আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“মি. সাসোকা আছেন? তার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল আমার।”

“ওহ, হ্যাঁ। হ্যালো,” মহিলার পেছনে এসময় উদয় হলো টেকো মাথার একটা লোক।

“আপনিই মি. সাসোকা?”

“জি! ইয়ে…” বলে পাশের ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা কার্ড বের করে কুসানাগির দিকে বাড়িয়ে ধরলো সে। “আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে!”

কুসানাগিও নিজের কার্ড ধরিয়ে দিল ভদ্রলোকের হাতে। সাসোকার কার্ডটায় লেখা :

কুনিও সাসোকা
সিইও, কুনুগি পাবলিশিং হাউজ

“এই প্রথম কোন পুলিশ অফিসার সরাসরি আমাকে তার কার্ড দিলেন,” উৎফুল্ল কন্ঠে বলল মি. সাসোকা। “কার্ড জমানো আমার শখ,” বলে ওটা উল্টে চমকে গেল সে। “মি. সাসোকাকে ১৩/৯/২০০৭ তারিখে প্রদত্ত’ লেখা সেখানে। নিচে কুসানাগির সই

“কার্ডটা যাতে ব্যক্তিগত কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারি, সেজন্যে লিখেছেন এটা, তাই না?”

“দয়া করে কিছু মনে করবেন না। এটাই নিয়ম।”

“না, না-কোন সমস্যা নেই,” বলল সাসোকা। সিইও’র পাশাপাশি কুনগি পাবলিশিং হাউজের সম্পাদকও সে। “তা আপনি কি এখানেই কথা বলবেন, না কি কোন ক্যাফেতে গিয়ে বসবেন?”

“এখানেই কথা বলা যাক।”

কুসানাগিকে অফিসের ছিমছাম মিটিং রুমটাতে নিয়ে গেল সাসোকা। “অফিস চলাকালীন সময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, “ একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল কুসানাগি।

“আরে, এটা কোন ব্যাপারই না। এই সময়ে খুব বেশি একটা কাজ থাকে না এখানে। আমরা তো প্রথম সারির কোন প্রকাশনা সংস্থা নই যে সবসময় লেখক-সম্পাদকদের ভিড় লেগে থাকবে।”

“আপনাকে ফোনে যেমনটা বলেছিলাম। মিস জুঞ্জি সুকুইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

মুখ থেকে হাসিটা মুছে গেল সাসোকার। “ওহ হ্যাঁ…আমিই ছিলাম তার সম্পাদক,” বিষণ্ণ কন্ঠে বলল সে। “খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা।”

“তাকে কি লম্বা সময় ধরে চিনতেন আপনি?”

“এই ধরুন দুই-আড়াই বছর। আমাদের জন্যে কয়েকটা বইয়ের কাজ করেছিলেন তিনি…” বলে উঠে গিয়ে নিজের ডেস্ক থেকে দুটো বই নিয়ে আসলো সে। “এই যে দেখুন।”

প্রথমটার নাম তুষারমানবের অভিযান এবং দ্বিতীয়টার বন্দি কুকুরছানা। “বাচ্চারা পছন্দ করে এরকম চরিত্রদের নিয়ে লিখতে পছন্দ করতেন তিনি। এমনকি বৃষ্টি নিয়েও একটা বই লিখেছিলেন,” সাসোকা বলল।

“হ্যাঁ, ওটা দেখেছি আমি,” ইয়ামামোতোর দেখানো বইটার কথা বলল কুসানাগি।

মলিন একটা হাসি ফুটলো সাসোকার মুখে। “মিস সুকুই পরিচিত সব চরিত্রদের নিয়ে এমন এমন গল্প লিখতেন, বাচ্চারা কয়েকবার করে পড়তো। তাকে বড্ড মিস করি আমরা সবাই।”

“তার মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু মনে আছে আপনার?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে। আমার উদ্দেশ্যে একটা চিঠিও লিখে রেখে গিয়েছিলেন তিনি।”

“হ্যাঁ…তার পরিবারের লোকদের কাছে শুনেছি মৃত্যুর আগে পরিচিত বেশ কয়েকজনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মিস সুকুই।”

জুঞ্জি সুকুইয়ের পারিবারিক নিবাস হিরোশিমায়। তার মার সাথে ফোনে কথা হয়েছে কুসানাগির। ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করবার পূর্বে পেশাগতভাবে চেনা তিনজন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে যায় সে।

এভাবে কাজ হুট করে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি,” মাথা দুলিয়ে বলল সাসোকা। “মারা যাবার কিছুদিন আগেই তাকে নতুন একটা বইয়ের কাজ শুরু করার কথা বলেছিলাম। তিনি জানতেন যে ওটা কখনো আলোর মুখ দেখবে না, তাই…”

“কেন আত্মহত্যা করলেন, এই ব্যাপারে কিছু লেখেননি?”

“নাহ। শুধুমাত্র কাজটা সম্পূর্ণ করে যেতে পারছেন না দেখে দুঃখপ্রকাশ করেন চিঠিতে। এরকম একটা মানুষের ওপর রাগ করে থাকা যায়, বলুন?”

আত্মহত্যা করার আগে নিজের মা’র উদ্দেশ্যেও একটা চিঠি লিখে সুকুই। চিঠিটা হাতে পাওয়ার পরপরই তিনি মেয়েকে ফোন দেন, কিন্তু কেউ রিসিভ করে না। তখন পুলিশকে জানানো হলে তারা এসে সুকুইয়ের মৃতদেহ আবিষ্কার করে।

মা’র কাছে পাঠানো চিঠিতেও কেন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি সুকুই। বরং, তাকে সে ধন্যবাদ জানায় এই পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্যে। এভাবে হুট করে জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছে দেখে দুঃখপ্রকাশও করে।“

“আমরা এখনও জানি না কেন ও কাজটা করল,” ফোনেই কাঁদতে কাঁদতে কুসানাগিকে বলেছিলেন সুকুইয়ের মা। দুই বছর পরেও সন্তান হারানোর বেদনা যে বিন্দুমাত্র কমেনি তা তার কন্ঠস্বর শুনেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিলো।

“আপনারা কি কিছু জানেন এ সম্পর্কে? কেন আত্মহত্যা করতে পারেন সুকুই?”

কপাল কুঁচকে গেল সাসোকার। “দুই বছর আগেও আমাকে বিস্তারিত প্রশ্ন করা হয়েছিল মিস সুকুইয়ের মৃত্যু সম্পর্কে। আত্মহত্যার দুই সপ্তাহ আগে তার সাথে দেখা হয়েছিল আমার, তখন কিন্তু সবকিছু একদম স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল।“

শুধু আপনি নন, মনে মনে বলল কুসানাগি। অন্যরাও কিছু বুঝতে পারেনি।

জুঞ্জি সুকুই মি. সাসোকা বাদে অন্য যে দু’জনকে চিঠি দিয়েছিল তাদের সাথেও কথা হয়েছে কুসানাগির। সবাই একই কথাই বলেছে। কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি।

“আপনি কি এটা জানতেন যে তখন কারো সাথে সম্পর্ক ছিল কি না তার?” ইচ্ছে করেই কথার বিষয়ে পরিবর্তন আনলো ডিটেক্টিভ।

“ভাসা ভাসা শুনেছিলাম। কিন্তু কার সাথে সম্পর্ক ছিল এটা জানতে পারিনি। ইদানীং তো এসব ব্যাপারে খুব খেয়াল করে কথাবার্তা বলতে হয়। কখন কে মানহানি বা যৌন হয়রানির মামলা করে দেয়,” বলল সাসোকা।

“আচ্ছা বয়ফ্রেন্ডের কথা বাদ দিন। তার কি ভালো কোন বান্ধবী ছিল?”

কাঁধ ঝাঁকালো সাসোকা। “আগেও এই প্রশ্নটা করা হয়েছে আমাকে। সত্যি কথা বলতে আমার ধারণা একা একা থাকতেই পছন্দ করতেন মিস সুকুই। কারো সাতে পাঁচে জড়াতেন না। আমি আসলে অবাকই হয়েছিলাম এটা শুনে যে তার জীবনে কেউ এসেছে।”

আয়ানের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যাচ্ছে, ভাবলো কুসানাগি। ব্যতিক্রম হচ্ছে স্যাপ্পোরোতে ভালো একজন বান্ধবী আছে তার। এখানে তো সারাদিন বাসার লিভিংরমে বসে একা একা সেলাই নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।

হয়তো এরকম একাকী মহিলাদের সাথেই প্রেমের সম্পর্ক করতো ইয়োশিতাকা। তাতসুহিকো ইকাইয়ের বলা কথাটা মনে পড়লো তার। একাকী নারীদের সাথে সম্পর্কে জড়াতো ইয়োশিতাকা কারণ বাচ্চার মা হিসেবে তারা একদম আদর্শ। আর যদি এরকমটা হয়েই থাকে তাহলে তার সম্পর্কগুলোতে ‘ভালোবাসা’ জিনিসটা ছিল কি না সে সন্দেহটা থেকেই যায়। প্রেমিকারা নিশ্চয়ই মন থেকেই ভালোবাসতো তাকে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন।

“ডিটেক্টিভ?” নীরবতা ভেঙে কিছুক্ষণ পর বলল সাসোকা। “আমি কি এটা জানতে পারি যে কেন এতদিন পরে তার আত্মহত্যা নিয়ে খোঁজখবর করছেন আপনি? তখন তো নিশ্চিত করে বলা হয়েছিল যে, আত্মহত্যাই ছিল ঘটনাটা, যদিও মোটিভটা জানা যায়নি।”

“আসলে তার আত্মহত্যার সাথে আমি যে কারণে খোঁজখবর করছি সেটার কোন সম্পর্ক নেই,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কুসানাগি। “কিছুদিন আগে একটা কেসের তদন্তের সময় তার নাম জানতে পারি।”

“ওহ আচ্ছা,” সাসোকা যে আরো জানতে আগ্রহী সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একজন ডিটেক্টিভকে তথ্যের জন্যে চাপ দেয়ার সাহস পাচ্ছে না।

লোকটা আরো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কুসানাগি। “আমার ওঠা উচিত এখন,” বলল সে। “আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে ধন্যবাদ।”

“আর কিছু জানার নেই আপনার? আমি তো এক কাপ চা-ও খাওয়াতে পারলাম না আপনাকে।”

“সমস্যা নেই। আমি কি এই বইদুটো কিছুদিনের জন্যে নিতে পারি?” হাতের ছবির বইদুটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।

“এদুটো? অবশ্যই। আপনাকে দিয়েই দিলাম, যান।”

“আসলেই?”

“হ্যাঁ। এক সময় না এক সময় সরিয়েই ফেলতে হতো।”

“ঠিক আছে তাহলে, ধন্যবাদ,” বলে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল কুসানাগি। সাসোকা আসছে পেছন পেছন।

“আমি আসলে খুবই অবাক হয়েছিলাম ওনার মৃত্যুর সংবাদ শুনে। এমনকি মারা গেছেন শোনার পর এটা মাথাতেই আসেনি, আত্মহত্যা করেছেন সুকুই। পুরো ঘটনাটা জানার পর লম্বা সময় তর্ক করেছিলাম বন্ধুদের সাথে। কয়েকজনের তো ধারণা ছিল যে খুন করা হয়েছে তাকে। কে স্বেচ্ছায় ওরকম জিনিস পান করবে বলুন? ভীষণ কষ্ট হবার কথা।

“থেমে সম্পাদকের মুখোমুখি হলো কুসানাগি। “কি বললেন? পান করেছিলেন মানে?”

“বিষের কথা বলছি।”

“বিষ? ঘুমের ঔষধ না?”

মি. সাসোকার গোল মুখটা হা হয়ে গেল। “আপনি জানেন না! আর্সেনিক খাওয়ার কারণে মারা গেছেন মিস সুকুই।

“জমে গেল কুসানাগি। “আর্সেনিক?”

“হ্যাঁ, কিছুদিন আগে একটা রেস্তোরাঁয় যে কারণে অনেকের একসাথে ফুড পয়জনিং হলো।”

“মানে আর্সেনাস এসিড?”

“হ্যাঁ! ওটাই।”

কুসানাগির মনে হলো যে তার হৃৎপিণ্ড বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসবে। দ্রুত বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। ভবনের বাইরে পা রেখেই কিশিতানিকে ফোন দিয়ে বলল জুঞ্জি সুকুইয়ের আত্মহত্যার কেসটা যে পুলিশ স্টেশন সামলেছিল সেখানে খোঁজ নিতে

“এখনও ঐ লেখিকাকে নিয়েই পড়ে আছেন?” কিশিতানি জিজ্ঞেস করল। “নতুন কিছু জানতে পেরেছেন না কি?”

“চিফের সাথে আমার এ ব্যাপারে কথা হয়েছে, তিনি অনুমতি দিয়েছেন মিস সুকুইয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর করার। তোমাকে যেটা বলছি সেটা করো ঠিকমতো,” বলে ফোন কেটে দিল কুসানাগি। হাত উঁচিয়ে একটা ট্যাক্সি থামালো। “মেগুরো পুলিশ স্টেশনে চলুন, দ্রুত।”

ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে কেসটা নিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল কুসানাগি। ইতোমধ্যে বেশ লম্বা একটা সময় ব্যয় করে ফেলেছে ওরা মি. মাশিবার খুনের তদন্তে। বিষ কিভাবে কফিতে মিশলো সেটা জানতে না পারা এবং উপযুক্ত সন্দেহভাজনের অভাব এই দেরির মূল কারণ। সত্যি কথা বলতে আপাতদৃষ্টিতে মোটিভ একজনেরই আছে বলে মনে হবে। আয়ানে মাশিবা। কিন্তু তার অ্যালিবাইটা মিথ্যে প্রমাণ করার কোন উপায় নেই।

দু’দিন আগে চিফ মামিয়াকে কুসানাগি বলে যে ঘটনার দিনে মাশিবাদের বাড়িতে তৃতীয় কোন ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল-এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। মিস জুঞ্জি সুকুইয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার অনুমতিও চায় তখন।

“কিন্তু তিনিও তো মারা গেছেন?” মামিয়া জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ, সেজন্যেই আরো ভালোমতো খোঁজ নিতে চাই,” কুসানাগি তাকে বলে। “যদি ইয়োশিতাকা মাশিবার কারণেই আত্মহত্যা করে থাকেন মিস সুকুই, তাহলে সেটা তার ঘনিষ্ঠ কারো জন্যে মোটিভ হিসেবে কাজ করতে পারে।”

“প্রতিশোধের কথা বলছো? মিস সুকুইয়ের আত্মহত্যার দুই বছরের বেশি হতে চলল। এটা যদি প্রতিশোধই হয়ে থাকে, তাহলে আরো আগে কাজটা করল না কেন আততায়ী?”

“সেটা বলতে পারবো না। হয়তো খুনি চেয়েছিল সবাই আত্মহত্যার ব্যাপারটা ভুলে যাক, যাতে কেউ দুটো ঘটনার যোগসূত্র না স্থাপন করতে পারে।”

“তাহলে তো বলতে হবে আমাদের খুনির ধৈর্য্য অনেক। রীতিমত সাধুদের মতন। দুই বছর ধরে একটা মানুষকে খুন করার অপেক্ষা কিন্তু যা- তা ব্যাপার নয়।”

মামিয়াকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছিল না যে কুসানাগির ব্যাখ্যায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট সে, তবে মানা করেনি জুঞ্জি সুকুইয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিতে। কুসানাগিও সময় নষ্ট করেনি। বৃষ্টির ঠিকানা বইটার সম্পাদক তাকে সুকুইয়ের বাসার ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেন। এরপর ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায় সিনিয়র ডিটেক্টিভের। আত্মহত্যার আগে যাদের যাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল সুকুই, তাদের সবার সাথে কথা বলে সে।

তবে কেউই তার আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেনি এমন কিছুও বলেনি যেটায় ইয়োশিতাকা মাশিবার সাথে জুঞ্জি সুকুইয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে। অনেকে জানতোই না যে কারো সাথে প্রণয় ছিল লেখিকার। তার মা বলেন যে সুকুইয়ের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েও তার কখনো মনে হয়নি যে সেখানে কোন পুরুষের পা পড়েছে। তাছাড়া সুকুইয়ের আত্মহত্যার সাথে প্রেম ভালোবাসার কোন সম্পর্ক নেই বলেই ধারণা তার। সুকুই আর মাশিবাকে চায়ের দোকানটায় একসাথে দেখা গিয়েছিল তিন বছর আগে। যদি এর পরপরই তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায় তাহলে হয়তো আসলেও মি. মাশিবার সাথে তার আত্মহত্যার কোন সম্পর্ক নেই।

আর যদি সম্পর্ক থেকেও থাকে, তবুও কারো পক্ষে প্রতিশোধ নেয়ার সম্ভাবনা খুব কম, কারণ কেউ তো তাদের প্রণয়ের ব্যাপারে জানতোই না। মামিয়ার কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার পরও কুসানাগির মনে হচ্ছিল যে আরেকটা কানাগলিতে প্রবেশ করতে চলেছে সে।

কিন্তু এই আর্সেনাস এসিডের ব্যাপারটা বদলে দিয়েছে তার ধারণা।

যদি আগেই সে জুঞ্জি সুকুইয়ের আত্মহত্যার কেস ফাইলটা দেখতো তাহলে এখন এতটা তাড়াহুড়ো করতে হতো না। কিন্তু লেখিকার মা’র বক্তব্য শুনে কিছুটা হতাশ হয়েই আর খোঁজ খবর নেয়নি সে ব্যাপারে। যদি কেসটার তদন্তকারী অফিসাররাও ঘটনাটাকে আত্মহত্যা বলে মেনে নেয়, তাহলে তার মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?

কিন্তু বিষ পান করে আত্মহত্যা…

অবশ্য এমনটাও হতে পারে যে দুটো কেসের ক্ষেত্রেই একই বিষের অস্তিত্বের ব্যাপারটা কাকতালীয়। রেস্তোরাঁয় ফুড পয়জনিংয়ের ঘটনাটা সব টিভি চ্যানেলেই ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। সেখান থেকে অনেকেই বিষটার কার্যকরিতা সম্পর্কে জেনে গেছে।

কিন্তু একজন লোক তার প্রাক্তন প্রেমিকার আত্মহত্যার দু’বছর পর একই বিষের কারণে নিহত হলো- এ ব্যাপারটা কুসানাগির মেনে নেয়ার পক্ষে একটু বেশি কাকতালীয়।

এসব নিয়েই ভাবছে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল তার। ইউকাওয়ার নাম দেখাচ্ছে ডিসপ্লেতে।

“আবার ফোন করেছো? স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের থেকেও তো তোমার বিল বেশি আসবে এই মাসে।”

“বলার মত কিছু পেলে চুপ করে বসে থাকবো না কি?” শান্তস্বরে বলল ইউকাওয়া। “আজকে দেখা করতে পারবে?”

“পারবো। কিন্তু কেন? কফিতে বিষ কিভাবে মিশলো এটা জানতে পেরেছো অবশেষে?”

“জানতে পেরেছি বলাটা উচিত হবে না। ধরে নাও একটা সম্ভাব্য পথ আবিষ্কার করেছি।”

পদার্থবিদের এরকম পেঁচিয়ে কথা বলার ধরণে বরাবরের মতনই বিরক্ত হলেও ফোনটা শক্ত করে কানের সাথে চেপে ধরলো সে। ইউকাওয়া যখন

“সম্ভাব্য পথের ব্যাপারে কথা বলা শুরু করে তখন মূল সমাধানটা পেতে সাধারণত আর খুব বেশি দেরি হয় না।

“উতসুমির সাথে কথা বলেছো এ ব্যাপারে?”

“না, এখনও না। সত্যি কথা বলতে তোমাকেও বলবো কি না জানি না। সুতরাং খুব বেশি আশান্বিত না হওয়াই ভালো।”

“মানে কি? তাহলে দেখা করতে চাচ্ছো কেন?”

“তদন্তের ব্যাপারে আমার বিশেষ একটা অনুরোধ আছে। আমি যে সম্ভাব্য পথটার কথা ভেবেছি, খুনিকে সেটা অবলম্বন করতে হলে কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে। সেগুলো সম্বন্ধেই নিশ্চিত হতে চাই।”

“তাহলে তুমি আমাকে খুনের এই কৌশলটা সম্পর্কে কিছু বলবে না, কিন্তু আমি ঠিকই তথ্য দিয়ে তোমাকে সাহায্য করবো? তুমি নিশ্চয়ই ভালো করেই জানো যে সিভিলিয়ানদের সাথে কোন চলমান কেসের ব্যাপারে কথা বলাটা নিয়মের বাইরে?”

“তোমার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে আসলেও অবাক হলাম, “ কিছুক্ষণ নীরবতার পর বলল ইউকাওয়া। “যাইহোক, কেন তোমাকে কৌশলটা সম্পর্কে এখনই কিছু বলতে পারবো না, তার যুক্তিযুক্ত একটা কারণ আছে। সেটা সামনাসামনি দেখা হলে ব্যাখ্যা করবো।”

“টোপ দিচ্ছো, না? আমি এখন মেগুরো স্টেশনে যাচ্ছি, সেখানে কাজ সেরে ভার্সিটিতে আসবো। আটটার মতন বাজবে।”

“তাহলে এখানে এসে আমাকে একটা ফোন দিও। সে সময় ল্যাবে না- ও থাকতে পারি।”

“ঠিক আছে,” বলে ফোন কেটে দিল কুসানাগি। ভেতরে ভেতরে কেসটা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে তার। ইউকাওয়া খুনের কৌশল সম্পর্কে কি ধরতে পেরেছে সেটা এখনই জানতে ইচ্ছে করছে। অনুমান করে কোন লাভ হবে না। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে এটা ভেবে যে ইউকাওয়ার ব্যাখ্যাটা আয়ানেকে আবারো সন্দেহভাজনের তালিকায় নিয়ে আসবে কি না। যদি তার বন্ধু এমন কিছু বলে যেটায় আয়ানের অ্যালিবাইয়ে ছেদ সৃষ্টি হয়, তখন?

আর কোন উপায় থাকবে না, মনে মনে বলল সে তবে আয়ানের কথা ভেবে নয়, নিজের কথা ভেবে। বিধবাকে সন্দেহ না করার আর কোন উপায় থাকবে না। মনে মনে নিজেকে যা-ই বোঝাক না কেন সে। অন্য সময় হলে ইউকাওয়ার ফোন পেয়ে খুশিই হতো সে। কিন্তু আজকে খুশি তো দূরে থাক, সামান্য উত্তেজনাও কাজ করছে না।

মেগুরো স্টেশনে পৌঁছে কিশিতানিকে একটা ফ্যাক্সের কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো কুসানাগি। জুঞ্জি সুকুইয়ের খুনের ব্যাপারে বিস্তারিত লেখা আছে সেখানে। মামিয়াও আছে পাশে।

“এখন বুঝতে পারছি যে কেন আরো তথ্য দরকার ছিল আপনার, কিশিতানি বলল কাগজটা সামনে এগিয়ে দিয়ে রিপোর্টে এক নজর চোখ বোলালো কুসানাগি। নিজের অ্যাপার্টমেন্টের বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সুকুইকে। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ছিল একটা আধখালি পানির গ্লাস আর একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। সেই ব্যাগেই ছিল অক্সিডাইজড আর্সেনিক বা আর্সেনাস এসিড।

“কিভাবে আর্সেনাস এসিড জোগাড় করলেন তিনি সে ব্যাপারে কিছু লেখা নেই। জানতে পারেনি তারা?”

“হয়তো খোজঁই নেয়নি,” মামিয়া বলল। “খুনের সম্ভাবনার ব্যাপারটা মাথায় আসেনি তাদের। তাছাড়া আর্সেনাস এসিড জোগাড় করাটা ওরকম কঠিন কোন কাজ না। তাই সময় নষ্ট করতে চায়নি।”

“তবুও, মাশিবার প্রাক্তন প্রেমিকা যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে, সেই বিষ প্রয়োগেই হত্যা করা হলো তাকে এ ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়ার মতন বিষয় নয়। ভালো দেখিয়েছেন, বস,” কিশিতানি বলল কুসানাগির উদ্দেশ্যে।

“আলামত হিসেবে আর্সেনাস এসিডের ব্যাগটা কি সংরক্ষণ করেছে তারা?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“না, আমরাও জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা। দুই বছর রাখার কথাও না,” মামিয়া বলল। যদি আসলেও সংরক্ষণ করা হতো তাহলে হয়তো তুলনা করে দেখা যেত যে দুই কেসেই বিষের উৎস এক কি না।

“তারা কি মিস সুকুইয়ের পরিবারের লোকদের বিষের ব্যাপারে কিছু বলেনি?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“মানে?” কিশিতানি বলল।

“মিস সুকুইয়ের মা আমাকে ফোনে বলেছিলেন যে অতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ সেবনে মৃত্যু হয়েছিল তার মেয়ের।”

“হয়তো ভুল শুনেছিলেন তিনি।”

“হতে পারে…” কুসানাগি বলল। কিন্তু একজন মা’র তার মেয়ে কিভাবে মারা গিয়েছে সেটার ব্যাপারে ভুল করাটা একটু অদ্ভুতই ঠেকলো তার কাছে।

“যাক, কুসানাগির এই আবিষ্কার আর উতসুমি তখন যা বলল-তদন্তের উন্নতি হচ্ছে দেরি করে হলেও,” মামিয়া বলল।

“কি বলেছে উতসুমি?” চট করে মাথা উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও যোগাযোগ করেছিল তার সাথে,” চিফ বলল। “মাশিবাদের বাসার পানির ফিল্টারটা আবারও পরীক্ষা করে দেখতে বলেছে সে। কোথায় যেন পাঠিয়েছে এবার…”

“স্প্রিং-এইট,” কিশিতানি মনে করিয়ে দিল।

“হ্যাঁ। ইউকাওয়া না কি বিশেষ করে বলে দিয়েছে যাতে ওখানেই পাঠানো হয় ফিল্টারটা টেস্টের জন্যে। উতসুমি সেটা নিয়েই ব্যস্ত এখন।”

স্প্রিং-এইট হিয়োগো বিভাগের বিখ্যাত একটা রেডিওলজি ফ্যাসিলিটির নাম। জটিল সব কেসের ক্ষেত্রে সাধারণত এই ফ্যাসিলিটির সাহায্য নেয়া হয়। যখন অন্য সব সাধারণ ল্যাব কোন বিশেষ পদার্থের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়, তখন স্প্রিং-এইট তাদের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সহায়তায় ত্রাতার ভূমিকা পালন করে। একদমই সামান্য পরিমাণেও যদি সে পদার্থের অস্তিত্ব থেকে থাকে, সেটাও বের করতে সক্ষম ওখানকার টেকনিশিয়ানরা। রেস্তোরাঁয় ফুড পয়জনিংয়ের ঘটনার তদন্তের সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করে স্প্রিং-এইট।

“তাহলে ইউকাওয়ার ধারণা ফিল্টারেই বিষ মেশানো হয়েছিল?”

“ফিল্টারে আবার বিষ মেশায় কিভাবে?”

“মেশানো বলতে আসলে বোঝাচ্ছি… হয়তো ছিটিয়ে রাখা হয়েছিল।”

“হ্যাঁ, উতসুমিও সেটাই বলেছে।”

“কিন্তু ইউকাওয়া তো বলছিল এটা কোনভাবেই—” বলতে গিয়েও থেমে গেল কুসানাগি।

“কি?” ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল মামিয়া

“কিছু না। আজকে ওর সাথে দেখা করার কথা আমার। ও বলছিল যে বিষ মেশানোর সম্ভাব্য পথ সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছে। হয়তো ফিলট্রেশন সিস্টেম পর্যন্ত বিষ কিভাবে পৌঁছুলো সে ব্যাপারে কিছু বলবে।”

“উতসুমিরও একই ধারণা ইউকাওয়া হয়তো আসলেও ধরতে পেরেছে ব্যাপারটা। কিন্তু তাকে না কি সে সম্পর্কে কিছু জানাতে রাজি হয়নি প্রফেসর। যেরকম বুদ্ধিমান, সেরকমই গোঁয়ার লোকটা,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মামিয়া।

“আমাকেও না কি বলবে না,” কুসানাগি বলল।

শুকনো একটা হাসি ফুটলো চিফের মুখে। “কোন স্বার্থ ছাড়াই কিন্তু আমাদের সাহায্য করছে সে। সুতরাং অভিযোগ করাটা উচিত হবে না। আর সে যেহেতু তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, নিশ্চয়ই জরুরি কিছু বলার আছে। যাও, শুনে এসো কি বলে সে।”

আটটার কিছুক্ষণ পর ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছুলো কুসানাগি। ট্যাক্সি থেকে নেমে কয়েকবার ফোন দিল সে, কিন্তু ধরলো না প্রফেসর। ক্যাম্পাসের অর্ধেক পার হয়ে আবারো ফোন দিল; এবার কয়েকবার রিং হবার পর অবশেষে কল ধরলো ইউকাওয়া।

“দুঃখিত, রিং শুনতে পারিনি।

“তুমি কি ল্যাবে?”

“না, জিমে। মনে আছে কোথায় ওটা?”

“ভুলবো কিভাবে?”

ফোন কেটে দিয়ে জিমের দিকে হাঁটা শুরু করল কুসানাগি। ইউনিভার্সিটির প্রবেশ ফটকের বামপাশেই ধূসর ভবনটার নিচতলায়। ছাত্র জীবনে হোস্টেলের চাইতে এখানেই বেশি সময় কাটিয়েছে কুসানাগি। ইউকাওয়ার সাথে পরিচিত হয়েছিল এখানেই। তখন দু’জনের শরীরই ছিল একদম শুকনো, খেলাধূলার জন্যে আদর্শ। কিন্তু এখন কেবল ইউকাওয়ার ফিগারই আগের মত আছে।

অ্যাথলেটিক ফ্যাসিলিটিতে ঢোকার সময় গোমড়া মুখ করে এক ছাত্রকে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলো কুসানাগি। হাতে একটা র‍্যাকেট তার কুসানাগির উদ্দেশ্যে একবার মাথা নাড়লো ছেলেটা। ভেতরে ঢুকে কোর্টের পাশে একটা বেঞ্চে ইউকাওয়াকে বসা অবস্থায় পেলো ডিটেক্টিভ।

“এখন বুঝতে পারছি, কেন ইউনিভার্সিটিতে বয়স্ক প্রফেসরের সংখ্যা বেশি। এখানকার সুযোগ সুবিধার মায়া কাটাতে পারে না তারা।”

ইউকাওয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। “জিম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন সুবিধা দেয়া হয় না কাউকেই। অন্য সবার মতন আমারো আগে থেকে বলে রাখতে হয়। আর তোমার যুক্তি খুব একটা ভুল নয়। একে তো কাউকে প্রফেসর হতে হলে খাটতে হয় অন্যদের চেয়ে বেশি, সেজন্যে সময়ও বেশি লাগে। তাছাড়া কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে হয়, এটা বোধহয় তোমার জানা নেই।”

চুপচাপ কথাগুলো হজম করল কুসানাগি। “কিসের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে ডেকেছো?”

“এত তাড়াহুড়ার কি আছে? খেলবে না কি?” বলে একটা র‍্যাকেট কুসানাগির দিকে বাড়িয়ে ধরলো ইউকাওয়া।

“এখানে খেলতে আসিনি আমি,” বলল কুসানাগি।

“কাজের প্রতি তোমার সমীহ আসলেও প্রশংসার দাবিদার,” শুকনো কন্ঠে বলল ইউকাওয়া। “কিন্তু শরীরের দিকে খুব একটা মনোযোগ দাও না বোধহয় ইদানীং। কোমর তো খালি বাড়ছেই দেখি। জিজ্ঞাসাবাদের কাজে খুব একটা হাঁটাচলা করতে হয় না, না কি?”

“এভাবে যখন খোটা দিচ্ছ…” বলে পরনের জ্যাকেটটা খুলে র‍্যাকেটটা হাতে নিল কুসানাগি।

গত বিশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতন ব্যাডমিন্টন কোটে মুখোমুখি হলো দু’জনে। অবশ্য সময়ের এই দীর্ঘ ব্যবধান সত্ত্বেও কোন কিছু অপরিচিত ঠেকলো না কুসানাগির কাছে-র‍্যাকেট হাতে নেয়ার অনুভূতি, মেঝেতে কেডসের শব্দ, নেটের উচ্চতা সব একই আছে। তবে র‍্যাকেটটা কিভাবে ধরতে হবে, শাটলকক কতটা জোরে মারতে হবে, কোনদিকে মারলে সুবিধা হবে-এগুলো কিছুটা ভুলে গেছে অভ্যাস না থাকার কারণে। স্ট্যামিনাও কমে গেছে তার। দশ মিনিটের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠল।

ইউকাওয়াকে দেখে মনেও হচ্ছে না এই দশ মিনিটে কোর্টে দৌড়েছে সে। মেঝেতেই বসে পড়লো কুসানাগি। “বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আসলেই,” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। “তবে তোমার কম বয়সী ছাত্রদের এখনও পাঞ্জায় হারাতে পারবো।“

“পাঞ্জা লড়তে হাতের যে পেশিগুলো ব্যবহৃত হয় সেগুলো কয়েকদিনে অনুশীলনে ফলেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। কিন্তু স্ট্যামিনা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সে যুক্তি খাটবে না। নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। কারণ হৃৎপিণ্ডের পেশী আর হাতের পেশির মধ্যে পার্থক্য অনেক। তোমার উচিত অন্তত ব্যায়াম করা প্রতিদিন,” শান্ত কন্ঠে বলল ইউকাওয়া। কুসানাগির মত হাঁপাচ্ছে না সে।

হারামি কোথাকার, মনে মনে বলল কুসানাগি। দেয়ালে ঠেস দিয়ে আছে সে এখন। একটা পানির বোতল পাশের ব্যাগ থেকে বের করে বন্ধুর দিকে এগিয়ে দিল ইউকাওয়া। প্লাস্টিকের গ্লাসে পানি ঢেলে চুমুক দিল ডিটেক্টিভ।

“ভার্সিটি জীবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পার্থক্য একটাই যে আমার শরীর আর আগের মত পরিশ্রম করতে পারে না।“

“যদি শরীর চর্চা না করো, একসময় দেখবে শক্তিও কমতে শুরু করেছে। আমি নিয়মিত অনুশীলন করেছি, তুমি করোনি-এই যা।”

“সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছো?”

“না,” ইউকাওয়া বলল মৃদু হেসে। “তোমাকে কি সান্ত্বনা দেয়া উচিত আমার?”

কুসানাগিও হাসলো। মেঝে থেকে উঠে গ্লাসটা এগিয়ে দিল প্রফেসরের দিকে। “তাহলে তোমার ধারণা বিষ ছিল ফিল্টারে?”

মাথা নাড়লো ইউকাওয়া। “তোমাকে ফোনে যেমনটা বলছিলাম, দাবিটা প্রমাণ করতে পারবো না আমি। কিন্তু মোটামুটি নিশ্চিত এ ব্যাপারে যে ওখানেই মেশানো হয়েছিল বিষ।”

“কোন ফলো-আপ টেস্ট করেছো?”

“হ্যাঁ, এখানেই চেষ্টা করেছি—মানে ভার্সিটির ল্যাবে। একই মডেলের চারটা ফিল্টার নিয়ে এসে আর্সেনাস এসিড ছিটিয়ে দিয়েছিলাম ভেতরে। এরপর কয়েকবার পানি দিয়ে ধোঁয়ার পর আর্সেনাস এসিডের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কি না টেস্ট করে দেখি। তবে আমাদের ল্যাবে ইনডাকশন কাপলড প্লাজমা অ্যানালাইসিস করা সম্ভব না।”

“ইনডাকশন কি?”

“থাক তোমার বুঝতে হবে না। শুধু মনে করো খুবই জটিল আর কার্যকরী একটা পদ্ধতি। চারটা ফিল্টারই টেস্ট করি আমরা, এর মধ্যে দুটোয় আর্সেনাস এসিডের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। অন্য দুটোর ফলাফল আশানুরূপ ছিল না। আসলে ফিল্টারটা তৈরিতে এমন উপাদান ব্যবহার করা হয় যাতে কোন কিছু সহজে লেগে থাকতে না পারে। উতসুমির মতে তোমাদের ফরেনসিক ল্যাবে অ্যাটমিক অ্যাবজর্পশন অ্যানালাইসিস করে দেখা হয়েছিল মাশিবাদের ফিল্টারটার। আমি যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করেছি, তার চেয়েও কম কার্যকরী ওটা। তাই, স্প্রিং-এইটে পাঠালাম।”

“তুমি নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট এবারের সমাধানটা নিয়ে। না-হলে এত ঝামেলা করতে না।”

“পুরোপুরি সন্তুষ্ট বা নিশ্চিত-কিছুই বলবো না। কিন্তু এটাই একমাত্র উপায় বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।”

“খুনি কিভাবে বিষ মেশালো ফিল্টারে? মেশানো শব্দটা ব্যবহার করাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু অন্য কি বলবো বুঝতে পারছি না,” কুসানাগি বলল।

জবাব দিল না ইউকাওয়া। একটা তোয়ালে শক্ত করে ধরে আছে দু’হাতে।

“আমার কাছ থেকে কেন লুকোচ্ছো ব্যাপারটা?” অসহিষ্ণু কষ্ঠে কুসানাগি বলল কিছুক্ষণ পর।

“যেমনটা উতসুমিকে বলেছি, আমি চাই না আগে থেকেই কিছু একটা ধারণা করে রাখো তোমরা।”

“আগে থেকে কিছু ভেবে রাখলাম কি না সেটার সাথে ফিল্টারে বিষ মেশানোর কি সম্পর্ক?”

“সম্পর্ক আছে বলেই তো বলছি,” কুসানাগির দিকে তাকিয়ে বলল ইউকাওয়া। “আমি যে সম্ভাবনার কথা ভেবেছি, সেটা যদি আসলেও সত্য হয়ে থাকে তাহলে অতি সামান্য পরিমাণে হলেও আর্সেনাস এসিড খুঁজে পাবার কথা। সেজন্যে ফিল্টারটা স্প্রিং-এইটে পাঠিয়েছি। তবে যদি না-ও পাওয়া যায়, তবুও এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। সমস্যাটা এতই জটিল।”

“তাও, বলে দিলে ক্ষতি কি?”

“আচ্ছা ধরো তোমাকে বললাম আমি সমাধানটা। পরে টেস্টে যদি আর্সেনাস এসিডের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তাহলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি না পাওয়া যায়? তাহলে কি তোমরা আবারো নিরপেক্ষভাবে আগের মত করে ভাবতে পারবে? কিংবা এটা কি মেনে নিতে পারবে যে এই কৌশলটা অবলম্বন করা হয়নি।”

আবারো কথা প্যাঁচাচ্ছে, মনে মনে বলল কুসানাগি। “যদি প্রমাণ না পাই যে কৌশলটা আসলেও অবলম্বন করা হয়নি, তাহলে মানবো,” নিজেও ঘুরিয়ে জবাব দিল সে।

“এটা নিয়েই সমস্যা আছে আমার,” বলল ইউকাওয়া।

“বুঝিয়ে বলো।”

“আমি চাই না তোমরা প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও কাউকে সন্দেহ করো। আর এই কৌশল অবলম্বন করা কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব।“

ইউকাওয়ার চোখের দিকে তাকালো কুসানাগি। “আয়ানে মাশিবা?” গম্ভীর স্বরে বলল।

পদার্থবিদ কিছু না বলায় মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিল ডিটেক্টিভ। “বেশ,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল সে। “আমার তদন্ত চালিয়ে যাবো আমি। আশা করি রহস্যটার সমাধান হবেই। ভালো একটা জিনিস জানতে পেরেছি আজকে।”

“বলো দেখি কি জেনেছো।”

“ইয়োশিতাকা মাশিবার এক প্রাক্তন প্রেমিকার খোঁজ বের করেছি। তার সাথে এই কেসের সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে হচ্ছে।” জুঞ্জি সুকুইয়ের ব্যাপারে যা যা জেনেছে সব খুলে বলল কুসানাগি।

“এটা দুই বছর আগের ঘটনা?” জিজ্ঞেস করল ইউকাওয়া।

“হ্যাঁ, আর সেজন্যেই আমি নিজের মত করে তদন্ত করে খুশি। এই কেসটা শুরুতে খুব সহজ মনে হয়েছিল। পরকীয়ার কারণে স্বামীকে শাস্তি দিতে তাকে হত্যা করেছে স্ত্রী-এরকমটা ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসলে ভীষণ জটিল একটা কেস।”

কুসানাগির দিকে তাকিয়ে দরাজ হাসলো ইউকাওয়া।

“হাসছো কেন?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি। “নিশ্চয়ই ভাবছো যে আবারো ভুল পথে দৌড়াচ্ছি আমি, তাই না?”

“মোটেও না। আসলে ভাবছিলাম, তোমাকে বোধহয় কষ্ট করে এতদূর না ডেকে আনলেও পারতাম।”

কিছু না বলে ভূকুটি করে তাকিয়ে থাকলো কুসানাগি।

“তোমাকে আসলে একথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম আমিঃ এই কেসটার মূল অনেক গভীরে প্রোথিত। সাহিত্যিকদের মত করে কথা বলছি না কি? যাইহোক, শুধু মি. মাশিবা কিভাবে মারা গেলেন সেটা নিয়ে ভাবলে চলবে না আমাদের। যতটা সম্ভব অতীতে গিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। সবগুলো সম্ভাবনা যাচাই-বাছাই করে তবেই প্রকৃত সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব। তুমি যা জানতে পেরেছো তার আসলেও গুরুত্ব আছে। মানে-মিস সুকুইয়ের আর্সেনাস এসিড ব্যবহার করে আত্মহত্যার কথা বলছি।”

“তোমার কথা আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি,” কুসানাগি বলল। “তুমি তো মিসেস মাশিবাকে সন্দেহ করো। সেটার সাথে অতীতের কি সম্পর্ক?”

“সম্পর্ক আছে,” বলে র‍্যাকেট আর জিম ব্যাগটা ভুলে নিল ইউকাওয়া। “ল্যাবে ফিরবো এখন। কফি খাবে?”

“আর কিছু কি বলার আছে তোমার?”

“আপাতত নেই।”

“তাহলে আজকে আর কফি খাবো না। অন্য কোন দিন। স্টেশনে ফিরতে হবে দ্রুত।”

“বেশ,” বলে দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল ইউকাওয়া।

“দাঁড়াও,” পেছন থেকে ডাক দিল কুসানাগি। “আয়ানে মাশিবা তার বাবার জন্যে একটা জ্যাকেট সেলাই করে দিয়েছিলেন। কোমরের কাছটায় বেশ মোটা করে কাপড় দেয়া, যাতে বরফে পা পিছলে পড়ে গেলে ব্যথা না পান।

“আর?” ঘুরে বলল ইউকাওয়া।

“বিবেক বিসর্জন দিয়ে অযৌক্তিক কিছু করার কথা না তার। অনেক বুঝে শুনে কাজ করেন। আমার মনে হয় না এরকম কারো পক্ষে হুট করে স্বামীকে খুন করা সম্ভব।”

“আসলে তুমি কি নিজে এটা বিশ্বাস করো? না কি বিশ্বাস করতে চাইছো?”

“আমি আমার মতামত ব্যক্ত করলাম কেবল। তোমার আর উতসুমির যদি এই ধারণা থেকেও থাকে যে মিসেস মাশিবার প্রেমে পড়েছি আমি, সেটায় কিছু আসে যায় না।”

এক মুহূর্ত মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলো ইউকাওয়া। এরপর মুখ তুলে বলল, “তুমি মিসেস মাশিবার প্রেমে পড়েছো কি না, সেটায় আমারো কিছু আসে যায় না। কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় না তুমি এতটা দূর্বল যে নিজের কাজের সাথে আবেগ মেশাবে। আরেকটা ব্যাপার,” আঙুল তুলে বলল পদার্থবিদ। “আয়ানে মাশিবা আর যা-ই হন না কেন, বোকা নন।”

“তাহলে তাকে সন্দেহ করো না তুমি?”

জবাবে একবার হাত নেড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল ইউকাওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *