স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ১৮

অধ্যায় ১৮

রিসিপশন এরিয়ার সোফায় বসে সামনের দেয়ালে ঝোলানো চিত্রকর্মের দিকে তাকিয়ে আছে কুসানাগি। গোলাপ ফুলের নকশাটা পরিচিত ঠেকছে তার কাছে। কোন ওয়াইনের বোতলের গায়ে হয়তো দেখেছিল একসময়।

“এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন?” জিজ্ঞেস করল কিশিতানি। “ছবিটার সাথে আমাদের কেসের কোন সম্পর্ক নেই। নিচে দেখুন স্বাক্ষর করা আছে, বিদেশী কেউ এঁকেছে ওটা।”

“আমাকে কি তোমার গর্দভ মনে হয়?” দেয়ালের দিক থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করল কুসানাগি। সত্যি কথা বলতে কিশিতানির বলার আগ পর্যন্ত স্বাক্ষরটা আসলেও চোখে পড়েনি তার।

আবারো চিত্রকর্মটার দিকে তাকালো জুনিয়র ডিটেক্টিভ। “তাছাড়া প্রাক্তন প্রেমিকার ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে কেন রাখবে কেউ? আমি হলে তো ফেলে দিতাম।”

“তুমি হলে ফেলে দিতে। ইয়োশিতাকা মাশিবা হয়তো না-ও ফেলতে পারতেন।”

“আপনার তাই মনে হচ্ছে? আমরা কিন্তু বাসায় ছোটখাটো কিছু লুকিয়ে রাখার কথা বলছিনা। একটা বড় কোম্পানির রিসিপশন রুমে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ছবিটা। আমি হলে পারতাম না প্রতিবার অফিসে ঢোকার সময় প্রাক্তনের কিছু দেখতে।”

“হয়তো তিনি ঝোলাননি ছবিটা।”

“অফিসে একটা ছবি নিয়ে এসে না ঝোলানোর মানে কি? ধরুণ কোন কর্মী ছবিটা খুঁজে পেলো, তখন কি বলতো সে?”

“জানি না। কিছু একটা বানিয়ে বলে দিত হয়তো। কেউ উপহার দিয়েছে।”

“সেটা আরো গোলমেলে। কেউ যদি ছবি উপহার দেয়, তাহলে সেটা ঝুলিয়ে রাখাটাই স্বাভাবিক।”

“চুপ করবে, কিশিতানি? আমার মনে হয় না ইয়োশিতাকা মাশিবা এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার মত লোক ছিল।”

এসময় রিসিপশন ডেস্কের পাশের দরজা থেকে সাদা স্যুট পরিহিত এক মহিলা বেরিয়ে এলো। পাতলা রিমের চশমা তার চোখে। “অপেক্ষা করার জন্যে ধন্যবাদ,” বলল সে। “ডিটেক্টিভ কুসানাগি…?”

“আমি কুসানাগি,” উঠে দাঁড়িয়ে বলল সিনিয়র ডিটেক্টিভ। “আমাদের সাথে দেখা করার জন্যে ধন্যবাদ।”

“এটা আমার কর্তব্য,” বলে নিজের কার্ড বাড়িয়ে দিল সে। সেখানে তার নাম লেখা এইকো ইয়ামোমোতো- পাবলিক রিলেশন্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান। “মি. মাশিবার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র দেখতে চাচ্ছিলেন বোধহয়?”

“হুম, যদি সম্ভব হয়।”

“অবশ্যই সম্ভব। আসুন আমার সাথে।”

“মিটিং রুম’ লেখা একটা বিশাল ঘরে ওদের নিয়ে এলো মহিলা। “আপনারা ওনার জিনিসগুলো সিইও’র অফিসে রাখেননি?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল।

“নতুন সিইও কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি একটু বাইরে আছেন এখন, না-হলে নিজেই দেখা করতেন আপনাদের সাথে।”

“সমস্যা নেই। আপনারা নতুন সিইও খুঁজে নিয়েছেন শুনে ভালো লাগলো।”

“জি। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পরপরই নতুন অফিস রুমটা ঠিক করে ফেলি আমরা। মি. মাশিবার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব এখানে সরিয়ে আনা হয়। ভাবছিলাম তার বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। কিছু ফেলা হয়নি কিন্তু। আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজর মি. ইকাইয়ের বুদ্ধি ছিল এটা।“

না হেসেই কথাগুলো বলল মিস ইয়ামোমোতো। তার কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে প্রতিটা কথা বলার আগে একবার মনে মনে অনুশীলন করে নিচ্ছে। তাছাড়া এই কথাগুলোর অন্তর্নিহিত বার্তাটাও পরিস্কার-সিইও’র মৃত্যুর সাথে কোম্পানির কোন যোগসাজশ নেই। তাহলে কেন কিছু নষ্ট করা হবে?

“আমরা কি এগুলো দেখতে পারি?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল। “নিশ্চয়ই, সময় নিয়ে দেখুন। চাইলে আপনাদের জন্যে ড্রিঙ্কসের ব্যবস্থা করতে পারি। কি খাবেন বলুন।”

“ধন্যবাদ, কিছু লাগবে না আমাদের।”

“বেশ,” বলে শেষবারের মত ওদের দিকে শীতল দৃষ্টি হেনে রুমটা থেকে বেরিয়ে গেল মিস ইয়ামোমোতো।

“আমাদের আসাটা খুব একটা পছন্দ হয়নি, বোঝাই যাচ্ছে, “ কিশিতানি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল।

“কোন কোম্পানিই তাদের অফিসে আমাদের আসাটা পছন্দ করবে না। এখানে যে ঢুকতে দিয়েছে সেটাই অনেক।

“কোম্পানির ভাবমূর্তির জন্যে হলেও তো তাদের উচিত আমাদের সাহায্য করা, যাতে কেসটা দ্রুত সমাধান করা যায়। কিংবা সামান্য হাসলেও হতো। একদম রোবটের মতন ব্যবহার।”

“কেসটা মিডিয়ায় আলোচিত না হলেই এদের জন্যে ভালো। সমাধান হোক বা না হোক তাতে কিছু আসে যায় না। এখানে আমাদের উপস্থিতিও তাদের জন্যে সমস্যা। চিন্তা করো, নতুন সিইও এসে দেখল পুলিশের লোক ঘোরাফেরা করছে অফিসে। তুমি তার জায়গায় হলে হাসতে? যাইহোক, কাজ শুরু করি চলো,” বলে হাতে ল্যাটেক্স গ্লাভস পরে নিল কুসানাগি।

আজকের কাজটা নিয়ে আসলে বেশ আশাবাদী কুসানাগি। ইয়োশিতাকার প্রাক্তনদের কেউ একজন আর্টিস্ট ছিল-এ’টুকু প্রমাণিত হবার মত কোন আলামত পেলেই চলবে তার। তবে কি ধরণের আর্টিস্ট সেটা না জানাতে একটু অসুবিধা হবে বৈকি।

স্কেচবুক হাতে করে ঘুরে বেড়াতো দেখেই যে সে একজন চিত্রশিল্পী হয়ে যাবে, এমনটা নয় কিন্তু,” কিশিতানি মন্তব্য করল এ সময়। “একজন ফ্যাশন ডিজাইনার বা মাঙ্গা আঁকিয়েও হতে পারে।”

“তা ঠিক,” স্বীকার করল কুসানাগি। “জিনিসপত্রগুলো দেখার সময় সব সম্ভাবনাই মাথায় রেখো। সে একজন আর্কিটেক্টও হতে পারে।”

“ঠিক আছে,” বিড়বিড় করে বলল কিশিতানি।

“তোমাকে দেখে খুব একটা আগ্রহী মনে হচ্ছে না।”

নিরাশ দৃষ্টিতে কুসানাগির দিকে তাকালো কিশিতানি। “আগ্রহের ব্যাপার না। আসলে…আমি না ঠিক বুঝতে পারছি না। খুনের দিন থেকে আজ অবধি আমরা এমন কোন আলামত পাইনি যেটা নির্দেশ করবে যে হিরোমি ওয়াকাইয়ামা বাদে অন্য কেউ মাশিবাদের বাসায় পা রেখেছিল।”

“সেটা জানি আমি। কিন্তু আমরা কি আসলেই নিশ্চিত হয়ে এটা বলতে পারবো যে অন্য কেউ সেখানে ছিল না?”

“সেটা…”

“যদি কেউ না এসেই থাকে, তাহলে কেতলিতে বিষ মিশলো কিভাবে? সেটা বলো আমাকে।“

চুপ করে কুসানাগির দিকে তাকিয়ে থাকলো কিশিতানি।

“উত্তরটা জানা নেই তোমার, তাই না?” কুসানাগি বুলো। “জানার কথাও না। আমাদের বিখ্যাত ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও নিজেও এবার কোন কূল কি নারা খুঁজে পাচ্ছে না। এর কারণ উত্তরটা একদম সহজ। কোন কূট কৌশল অবলম্বন করা হয়নি। খুনি বাড়িতে প্রবেশ করে কেতলিতে বিষ মিশিয়ে চলে গেছে—ব্যস এটুকুই। আর আমি বোধহয় তোমাদের আগেও বলেছি যে কেন আমরা কারো প্রবেশের আলামত খুঁজে পাচ্ছি না।“

“কারণ মি. মাশিবা চাননি অন্য কেউ ব্যাপারটা সম্পর্কে জানুক।”

“তাহলে আমার কথায় আসলেও মাঝে মাঝে মনোযোগ দাও তুমি! যখন একজন পুরুষ কারো আগমনের ব্যাপারে তথ্য গোপন করতে চায়, তখন ধরেই নেয়া যায় যে সেই আগন্তুক একজন নারী। আমি কি ভুল কিছু বলছি?”

“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কিশিতানি।

“এবার তাহলে কাজ শুরু করা যাক, না কি? অঢেল সময় নেই আমাদের হাতে।”

মাথা নেড়ে নীরবে কার্ডবোর্ডের বাক্সগুলোর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো কিশিতানি।

কিশিতানি মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করল না। এতটাও বিরক্ত হবার মত কিছু হয়নি, মনে মনে নিজেক গাল দিল একবার। একসাথে কাজ করা সঙ্গী ডিটেক্টিভের ভিন্ন মত থাকতেই পারে। ওসব গায়ে লাগানো উচিত না একদমই। তবুও কেন যেন এই কেসটার ক্ষেত্রে একটুতেই অন্যদের ওপর বিরক্ত হচ্ছে সে।

আসল সমস্যাটা হচ্ছে সে নিজেও মনে মনে হতাশ হয়ে পড়ছে। এখন ওরা যা করছে সেটায় কি আসলেও কোন লাভ হচ্ছে? ইয়োশিতাকা মাশিবার পুরনো সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে ঘাঁটাঘাঁটি করে জরুরি কিছু জানা যাবে কি?

অনিশ্চয়তা যে কোন তদন্তের নিত্য সঙ্গী। কানাগলিতে আটকা পড়ার ভয় যদি কোন ডিটেক্টিভের থেকে থাকে, তাহলে তার উচিত কাজের ক্ষেত্র বদলানো।

এতকিছু সত্ত্বেও কুসানাগি জানে যে এই অস্বস্তি ভাবের মূল কারণটা কি। মনে মনে তার একটা ভয় কাজ করছে যে যদি সে উপযুক্ত প্রমাণ খুঁজে বের করতে না পারে, তাহলে আয়ানে মাশিবাকেই একমাত্র সন্দেহভাজন মনে করা শুরু করবে সবাই। উসুমি বা কিশিতানি কি ভাবলো তাতে কিছু আসে যায় না কুসানাগির। বরং সে নিজেই যদি আয়ানেকে সন্দেহ করা শুরু করে, তখন কি হবে?

গেল কয়েকদিনে যতবারই দেখা হয়েছে আয়ানের সাথে, মনে হয়েছে যেন কেউ একজন ছুরি ধরে আছে ওর গলার কাছে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায় আপনা আপনি। ফর্সা মুখটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। কিন্তু এরকম অনুভূতির কারণ সম্পর্কে ভাবতে গেলে এমন কিছু ভাবনা মাথায় ভর করে যেটায় অস্বস্তির পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।

কাজের খাতিরে এরকম অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে কুসানাগির, যারা আসলেও ভালো মানুষ, কিন্তু পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে কাউকে খুন করতে বাধ্য হয়েছে। এদের ব্যাপারে বরাবরই অব্যাখ্যাত এক ধরণের অনুভূতি কাজ করে ওর। যেন তাদের ঘিরে রাখা অদৃশ্য একটা বলয় ধরা পড়ে ওর মনের রাডারে। এসকল অপরাধীদের পাপবোধ এতটাই তীব্র যে সচরাচর সাধারণ মানুষের চোখে যা ধরা পড়ে না, তাদের চোখে খুব সহজেই সেগুলো ধরা পড়ে যায়। উন্মাদনা আর স্বাভাবিকতার মাঝামাঝি ধূসর একটা স্থানে তাদের আবাস।

আয়ানের কাছকাছি থাকার সময় কুসানাগির ঠিক এরকমটাই মনে হয়। চাইলে ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারে সে। কিন্তু ডিটেক্টিভ মাত্রই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে সবসময়। সেটাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাহলে আমি ইচ্ছেকৃতভাবে কানাগলিতে ঘুরে মরছি সন্দেহগুলোকে গলা টিপে হত্যা করার জন্যে। এই অন্তর্দ্বন্ধের কারণেই একটুতেই বিরক্ত হচ্ছে সে।

প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। এখন অবধি ওরা এরকম কিছু খুঁজে পায়নি যেটা কোন আর্টিস্টের হতে পারে। বাক্সগুলোর ভেতরে থাকা বেশিরভাগ জিনিসই উপহার হিসেবে পাওয়া।

“এটা কি বলতে পারেন?” কিশিতামি একটা স্টাফড টয় উঁচু করে বলল। প্রথম দেখায় ওটাকে বিটগাছের মূল মনে হবে, মাথায় পাতাও লাগানো আছে।

“বিটরুট।”

“হ্যাঁ, সেই সাথে একটা এলিয়েন।”

“কিভাবে?”

“দেখুন,” বলে বিটরুটটাকে উল্টো করে টেবিলে রাখলো কিশিতানি। এবারে সেদিকের সাদা অংশে চেহারার মতন অবয়ব চোখে পড়লো কুসানাগির। কার্টুনে দেখানো জেলিফিশ আকৃতির এলিয়েনদের মতন মনে হচ্ছে। “বাহ,” ভাবলেশহীনভাবে বলল সে।

“এখানে একটা ইনস্ট্রাকশন কার্ডও আছে,” জুনিয়র ডিটেক্টভের উৎসাহে ভাটা পড়লো না। “এ হচ্ছে বিটেলিক্স গ্রহের বাসিন্দা বিটন। কপিরাইট সিলটা দেখুন, মাশিবাদের কোম্পানিই বানিয়েছে।”

“ঠিক আছে, বুঝলাম। কিন্তু এটা আমাকে দেখাচ্ছো কেন?”

“এটা বানানোর আগে তো নিশ্চয়ই নকশা করতে হয়েছে, তাই না? আর যে নকশা করেছে তার পক্ষে স্কেচবুক ব্যবহার করাটাই সমীচিন হবে।”

এবারে আগের চেয়ে মনোযোগ দিয়ে পুতুলটা দেখলো কুসানাগি। “হ্যাঁ, সেটা খুবই সম্ভব।”

“হাসিখুশি মিস ইয়ামামোতোকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে,” দাঁড়িয়ে বলল কিশিতানি।

ডেকে পাঠানোর কিছুক্ষণের মধ্যে ওখানে উপস্থিত হলো ইয়ামোমোতো। “হ্যাঁ, এটা আমাদের কোম্পানিরই বানানো। একটা অনলাইন অ্যানিমের মাস্কট হিসেবে বানানো হয়েছিল।”

“অনলাইন অ্যানিমে?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল।

“আমাদের ওয়েবসাইটের হোম পেইজে ঢুকলে দেখা যেত ওটা। আপনি দেখতে চান?”

“নিশ্চয়ই,” কৌতূহলী কণ্ঠে বলল কুসানাগি।

একটা অফিসরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ কম্পিউটারে পুরনো ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে অবশেষে ‘বিটন গো!’ নামের অ্যানিমেটা খুঁজে বের করল মিস ইয়ামোমোতো। প্লে বাটনে চাপ দেয়ার পর দেখা গেল বিটন চরিত্রটা একটা স্পেসশিপ থেকে পৃথিবীতে নামছে। প্রায় পাঁচ মিনিট চলল পর্বটা।

“এটা এখন আর অনলাইনে দেখা যাবে না?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“না। অল্প কিছু সময়ের জন্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। তাই কোম্পানির পক্ষ থেকে মাসকটটা বানানো হয়। একসময় বাতিল হয়ে যায় শোটা।”

“আপনাদের কোন কর্মী এঁকেছিল চরিত্রটা?”

“না। প্রায় তিন বছর আগে এটার ডিজাইনার তার নিজস্ব ব্লগে চরিত্রটা নিয়ে কিছু পোস্ট দিয়েছিল, সেখান থেকে আমরা বেছে নেই।”

“ঐ ডিজাইনার কি একজন পেশাদার ইলাস্ট্রেটর?”

“না, আসলে তিনি একজন সাধারণ স্কুল টিচার। এমনকি আর্ট টিচার ও না।”

“ওহ!”

তাহলে কি এটাই সেই আর্টিস্ট? মনে মনে বলল কুসানাগি। তাতসুহিকো ইকাই জোর দিয়ে বলেছিল যে কাজ আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনো এক করবে না মাশিবা। কিন্তু যদি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়, তখন?

“আমরা বোধহয় আরেকটা কানাগলির শেষ মাথায় এসে আটকা পড়লাম,” কিশিতানি বলল হতাশ কণ্ঠে। “ইনি দেখছি একজন পুরুষ।”

“কিভাবে বুঝলে?”

“আর্টিস্ট প্রোফাইল দেখুন।”

স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল কুসানাগির।

“আমাদের আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল,” কিশিতানি বলল। “কিউট কিছু দেখলেই যে সেটা মেয়েদের আঁকা হবে এটা মনে করাটা ঠিক নয়।”

“আমি নিজেও ধরে নিয়েছিলাম এটার আঁকিয়ে একজন নারী,” কুসানাগি বলল,

“মাফ করবেন,” এসময় পাশ থেকে বলল মিস ইয়ামোমোতো। “আর্টিস্ট পুরুষ তো কি হয়েছে?”

“না, আসলে আমরা একজন নারী আঁকিয়ের খোঁজ করছিলাম। তদন্তের কাজে তিনি সাহায্য করতে পারতেন,” ব্যাখ্যা করে বলল কুসানাগি।

“তদন্ত বলতে তো মি. মাশিবার খুনের তদন্তের কথা বলছেন, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“এই ইন্টারনেট অ্যানিমের সাথে কোন সম্পর্ক আছে সেটার?”

“সবকিছু খুলে বলা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু জেনে রাখুন, অ্যানিমেটার আঁকিয়ে যদি একজন নারী হোতো, তাহলে কেসটার সাথে তার সম্পৃক্ততা থাকার একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বিটনের ডিজাইন যেহেতু একজন ভদ্রলোক করেছেন…” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কুসানাগির বুক চিড়ে। “এখানে আমাদের কাজ আজকের মত শেষ।“

“হ্যা,” কিশিতানির কাঁধও ঝুলে পড়েছে।

ওদেরকে সামনের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল মিস ইয়ামোমোতো। “দুঃখিত আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্যে,” পেছনে ঘুরে বলল কুসানাগি। “তবে সামনে প্রয়োজন হলে আবারো আসতে হতে পারে, সেজন্যে আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি।”

“যে কোন সময় আসতে পারেন,” ইয়ামোমোতো বলল। প্রথমে ওদের সাথে যে অভিব্যক্তি নিয়ে দেখা করেছিল সেটা বদলে গেছে অনেকটাই। এখন বরং কৌতূহল খেলা করছে তার চোখে।

দুই ডিটেক্টিভ অফিস থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে ডাক দিল মিস ইয়ামোমোতো। “ডিটেক্টিভ?”

“হুম?” ঘুরে তাকিয়ে বলল কুসানাগি।

“দুই তলায় একটা লাউঞ্জ আছে। ওখানে গিয়ে একটু অপেক্ষা করতে পারবেন? আপনাদের সাথে কিছু কথা আছে আমার,” ওদের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল মহিলা।

“কেসের সাথে কোন সম্পর্ক আছে ব্যাপারটার?”

“আমি নিশ্চিত নই। আসলে বিটনের ব্যাপারে কথা বলতাম, মানে ওটার আঁকিয়েকে নিয়ে।”

একবার আড়চোখে কিশিতানির দিকে তাকালো কুসানাগি। “অবশ্যই, আমরা অপেক্ষা করছি।”

“যত দ্রুত সম্ভব, আসছি,” ওদের উদ্দেশ্যে বলে অফিসে ফিরে গেল মহিলা।

দোতলার লাউঞ্জটা বেশ বড়। ‘ধূমপান নিষেধ’ সাইনটার দিকে বিষদৃষ্টি হেনে কফির কাপে চুমুক দিল কুসানাগি।

“কি নিয়ে কথা বলতে চায় মহিলা?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“কে জানে? আমার মনে হয় না কোন পুরুষ আঁকিয়ের সাথে এই কেসের কোন সম্পর্ক আছে। দেখা যাক কী বলে।“

কিছুক্ষণ পরেই সেখানে উপস্থিত হলো ইয়ামোমোতো। সন্তর্পণে একবার আশপাশে নজর বুলিয়ে সাদা রঙের একটা খাম বের করে রাখলো টেবিলের ওপর। “আপনাদের অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্যে দুঃখিত,” ওদের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বলল সে। এসময় ওয়েট্রেস তার দিকে এগিয়ে আসলে হাতের ইশারায় তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলল।

খুব বেশি সময় নষ্ট করতে চায় না, ভাবলো কুসানাগি। “কিসের ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিলেন?”

আরেকবার আশপাশে তাকালো পাবলিক রিলেশন্স অফিসার। “আসলে আপনাদের যে কথাগুলো বলবো সেগুলো অফিসের বাইরে কাউকে বলা নিষিদ্ধ। এমনকি অফিসেরও অনেকে জানে না ব্যাপারটা। যদি কখনো বাইরের লোক জেনেও যায়… দয়া করে বলবেন না, আমি বলেছি কথাগুলো।”

একটু অবাকই হলো কুসানাগি। তথ্যের ধরণের ওপর ব্যাপারটা নির্ভর করে যে তথ্যদাতাম নাম কেউ জানবে কি না। কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে যে তার নাম কাউকে বলা যাবে না? অবশ্য প্রশ্নটা এখন করলে হয়তো উঠে চলে যাবে ইয়ামোমোতো। তাই চুপ থাকলো কুসানাগি। যখনকারটা তখন ভাবা যাবে।

“ঠিক আছে, আমাদের মধ্যেই থাকবে ব্যাপারটা,” কিছুক্ষণ পর বলল। “আপনারা যে বিটরুট এলিয়েনটা দেখেছিলেন একটু আগে, ওটা আসলে এক নারীর ডিজাইন করা,” ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল ইয়ামোমোতো।

“কি?” বিস্ময় গোপনের কোন চেষ্টা করল না কুসানাগি। “আসলেই?” সোজা হয়ে বসলো সে।

“হ্যাঁ, কিছু বিশেষ কারণে আমাদের ওয়েব সাইটে মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে।”

সমঝদার ভঙ্গিতে পাশ থেকে মাথা নাড়লো কিশিতানি। “এরকমটা হয় অ্যানিম ইন্ডাস্ট্রিতে। আর্টিস্টের নাম, বয়স, সে নারী না পুরুষ-এসব ব্যাপারে প্রায়ই মিথ্যে বলা হয় অনলাইনে।“

“সে যে একজন টিচার, এই ব্যাপারটাও কি মিথ্যা?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল।

“না- আসলে আমাদের ওয়েবসাইটে যে টিচারের নাম বলা হয়েছে তিনি আসলেও আছেন। ব্লগটা মূলত তারই লেখা। কিন্তু চরিত্রটা অন্য একজনের। ওনাদের দু’জনের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই।”

কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়লো কুসানাগির। “তাহলে মিথ্যের আশ্রয় নেয়ার কারণ কি?” হাতদুটো টেবিলের ওপর রাখলো সে।

পরবর্তী কথাটা বলার আগে বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত বোধ করল ইয়ামামোতো। “আসলে সবকিছু আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল।”

“বুঝলাম না।”

“আপনাদের আমি কিছুক্ষণ আগে যে গল্পটা শোনালাম যে স্কুল টিচারের ব্লগের মাধ্যমে বিটন চরিত্রটা জনপ্রিয় হয়েছিল…”

“ওরকমটা হয়নি?”

“আসলে পুরো ব্যাপারটা একদম উল্টো। আমরা প্রথমে চরিত্রটা বাছাই করি। লক্ষ্য ছিল ছোট একটা প্রাইভেট ব্লগের মাধ্যমে সেটাকে জনপ্রিয় করা হবে। সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন এবং অনলাইনে আরো কিছু কাজের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা হয় যাতে ব্লগটা লোকের চোখে পড়ে। একবার যখন চরিত্রটা জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তখন এই গল্প ছড়িয়ে দেয়া হয় যে প্রাইভেট ব্লগটা আমাদের কোম্পানির নজরে পড়েছে এবং আমরা সেটা ইন্টারনেট অ্যানিমেতে রূপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি টাকা খরচ করে।”

“একটু বেশি কষ্ট করা হয়ে গেল না?” বুকের ওপর হাতজোড়া ভাঁজ করে রেখে বলল কুসানাগি।

“অনলাইনে লোকজন এরকম প্রাইভেট ব্লগ থেকে জনপ্রিয় হওয়া চরিত্রকে গুরুত্ব দেয় বেশি। আমাদের সিইও’র আইডিয়া ছিল এটা।”

কিশিতানির দিকে তাকালে সে-ও মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করল। ‘ঠিকই বলেছেন উনি। জনপ্রিয় নয় এরকম কোন অ্যানিমে আর্টিস্টের কোন চরিত্র হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে গেলে লোকে সেটাকে লুফে নেয়। কয়েকদিনের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়।”

“তাহলে,” কুসানাগি বলল, “বিটনের ডিজাইনার আপনাদের কোম্পানীর কোন কর্মী?”

“না। আমরা একটু কম পরিচিতি আছে এরকম মাঙ্গা আর্টিস্টদের খোঁজ চালিয়েছিলাম। তারা নানারকম চরিত্রের আইডিয়া দিলে আমরা একটা বেছে নেই। আর্টিস্টের সাথে চুক্তি ছিল, সে এই কথাটা কোথাও প্রকাশ করতে পারবে না। তখন তাকে দিয়ে টিচারের ব্লগের জন্যে কিছু ছবি আঁকানো হয়। প্রথমদিকের সব কাজ সেই মহিলারই করা, তবে পরে আমরা অন্য আর্টিস্টের সাথে চুক্তি করি। আপনারা নিশ্চয়ই এটাও বুঝে গেছেন যে প্রাইভেট ব্লগটার লেখকও আমাদের কাছ থেকে টাকা পেতো।”

“এ তো বিরাট ব্যাপার স্যাপার,” মন্তব্য করল কুসানাগি।

“বর্তমানে একটা চরিত্রকে জনপ্রিয় করার জন্যে অনেক খাটতে হয়,’ ইয়ামামোতো বলল। “তবে আমাদের খাটনি খুব একটা কাজে যে লেগেছে সেটা বলা যাবে না।“

“তাহলে কোন আর্টিস্টকে বেছে নিয়েছিলেন আপনারা?”

“সে মূলত বাচ্চাদের ছবির বই আঁকিয়ে ছিল। কয়েকটা বইও প্রকাশিত হয়েছিল তার,” বলে খাম থেকে একটা চিকন বই বের করে দেখালো ইয়ামোমোতো।

বইটা হাতে নিয়ে পাতাগুলো ওল্টালো কুসানাগি। বৃষ্টির ঠিকানা- নাম বইটার। একটা দলচ্যুত হয়ে পড়া বৃষ্টির কণার কাহিনী নিয়ে বইটা আর্টিস্টের নাম লেখা সুমিরে উকো। বেগুনী প্রজাপতি-মনে মনে বলল কুসানাগি। অবশ্যই একটা ছদ্মনাম।

“আপনাদের সাথে কি এই আর্টিস্টের এখনও যোগাযোগ আছে?”

“না। সে শুধু প্রথমদিকে কয়েকটা ছবি এঁকেছিল। চরিত্রটার কপিরাইট আমাদের কোম্পানির।”

“তার সাথে কখনো দেখা করেছেন আপনি?”

“না। যেমনটা বললাম, তার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল। একমাত্র আমাদের সিইও এবং হাতে গোণা কয়েকজনের সাথে দেখা করেছিল। সিইও সাহেবই তার সাথে সব ধরণের চুক্তি করেছেন, নিজে গিয়ে।“

“মি. মাশিবা?”

“হ্যাঁ। তিনি ছিলেন বিটনের সবচেয়ে বড় ফ্যান,” ইয়ামোমোতো বলল।

আবারো বইয়ের দিকে নজর ফেরালো কুসানাগি। লেখক পরিচিতি অংশে বলতে গেছে কিছুই লেখা নেই। শুধু ছদ্মনাম আর হাবিজাবি তথ্য।

তবে এটা মোটামুটি পরিস্কার যে এই মহিলাকেই খুঁজছিল সে। “আমি কি বইটা নিতে পারি?”

“নিশ্চয়ই,” বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইয়ামামোতো। “আমার যাওয়া উচিত এখন। আশা করি তথ্যগুলো আপনাদের কাজে আসবে।”

“অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে,” মাথা নিচু করে বলল কুসানাগি।

মহিলা চলে যাবার পর কিশিতানির দিকে বইটা বাড়িয়ে ধরলো সিনিয়র ডিটেক্টিভ। “প্রকাশনীর অফিসে একটা ফোন দাও।”

“আপনার কি মনে হচ্ছে? ইনিই সে?”

“ভালো সম্ভাবনা আছে। আমরা অন্তত এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে তার এবং ইয়োশিতাকা মাশিবার মধ্যে যোগাযোগ ছিল।“

“আপনাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে।”

“মিস ইয়ামামোতোর চেহারা খেয়াল করেছিলে কথা বলার সময়? তিনি আগেই সন্দেহ করেছিলেন যে দু’জনের মধ্যে কিছু একটা আছে।”

“তাহলে আজকের আগে কিছু বলল না কেন? কোম্পানির লোকদের সাথে তো আমাদের অফিসাররা আগে কথা বলেছে।”

“হয়তো অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। আমরা তো তখন এটা বলিনি যে আপনাদের আগের সিইওর প্রাক্তন প্রেমিকাদের সম্পর্কে যা জানুন বলুন। কিন্তু এবারে যখন একজন আর্টিস্টের কথা জিজ্ঞেস করলাম, তখন দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সমস্যা হয়নি তার।“

“হুম। তাকে রোবট বলাটা ঠিক হয়নি আমার।

“প্রকাশনীর অফিসে ফোন দিয়ে সেটার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারো এখন।“

মোবাইল ফোন বের করে হাতে বইটা নিয়ে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে গেল কিশিতানি। বিল্ডিংয়ের লবিতে দাঁড়িয়ে তাকে ফোনে কথা বলতে দেখলো কুসানাগি। সামনে রাখা ঠাণ্ডা কফির কাপটায় চুমুক দিল একবার।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো কিশিতানি, মুখ একদম গম্ভীর।

“যোগাযোগ করতে পারোনি?”

“পেরেছি।”

“কিন্তু তারা মিস উকো নামে কাউকে চিনতো না?”

“চিনতো।”

“তাহল চেহারা অমন লটকিয়ে রেখেছো কেন?”

“মহিলার আসল নাম জুঞ্জি সুকুই। এই বইটা প্রকাশিত হয়েছিল চার বছর আগে। এখন আউট অফ প্রিন্ট,” বলল কিশিতানি।

“ফোন নম্বর পেয়েছো?”

“না, কোন ফোন নম্বর নেই,” বইটা থেকে মাথা উঠিয়ে বলল কিশিতানি। “মারা গেছেন তিনি।”

“কি? কবে?”

“দুই বছর আগে। নিজের বাসাতেই আত্মহত্যা করেছেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *