অধ্যায় ১৬
“হ্যালো…আমরা কিছুক্ষণ আগেই এসেছি,” অবশেষে যেন কন্ঠস্বর খুঁজে পেল কুসানাগি। কথাটা যে বড্ড ঠুনকো শোনাচ্ছে তা নিজেও বুঝতে পারছে। “কোন জরুরি কাজ আছে এখানে?”
“না,” জবাব দিল আয়ানে। “কিছু কাপড় নিতে এসেছি। উনি কে জানতে পারি?”
“ওহ! ও হচ্ছে ইউকাওয়া। ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।”
কিছু বলল না ইউকাওয়া।
“অধ্যাপক?” আয়ানের কন্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে অবাক হয়েছে।
“সেই সাথে আমার বন্ধু,” কুসানাগি ব্যাখ্যার স্বরে বলল। “প্রায়ই আমাদের কেসে সাহায্য করে। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক বিষয়ের তদন্তে। আজকেও এখানে সেজন্যেই এসেছে।”
“আচ্ছা,” বলল আয়ানে। এখনও তার হতবুদ্ধি ভাবটা কাটেনি, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আর কথা বাড়ালো না সে। বরং জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি বাসার জিনিসপত্র স্পর্শ করি, সমস্যা হবে?”
“না। যা ইচ্ছে করুন। আমি দুঃখিত যে আমাদের এত বেশি সময় লাগছে।“
“দুঃখিত হবার কিছু নেই। আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করছেন,” বলে হলওয়ের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল সে। কিন্তু দু’কদম হেঁটেই থেমে গেল। আবারো ফিরে তাকালো কুসানাগি আর পদার্থবিদের দিকে। “আমার বোধহয় জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু এখানে কি খুঁজছিলেন আপনারা?”
“ইয়ে মানে,” একবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিল কুসানাগি। “আমরা আসলে এখনও বুঝতে পারছি না যে কফিতে বিষ কিভাবে মিশলো। তাই কিছু ফলো-আপ টেস্ট করতে হচ্ছে। আশা করি আপনার আপত্তি নেই এই বিষয়ে। খুব দ্রুতই কাজ শেষ হয়ে যাবে আমাদের।”
“কোন আপত্তি নেই,” বলল আয়ানে। “কৌতূহল হচ্ছিল, তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। যদি কিছু দরকার হয়, আমাকে জানাবেন। ওপরেই আছি।”
“ঠিক আছে, ধন্যবাদ।”
কুসানাগির উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে ওপরে যাওয়ার জন্যে ঘুরতে যাবে আয়ানে, এমন সময় কথা বলে উঠল ইউকাওয়া। “আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”
“জি, করুন,” বলল সদ্য বিধবা মহিলা। তার চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ইউকাওয়ার উপস্থিতি সহজ ভাবে নিতে পারছেন না।
“আপনার রান্নাঘরের সিঙ্কে একটা ওয়াটার ফিল্ট্রেশন সিস্টেম আছে। ওটার ফিল্টার তো নিয়মিত বদলাতে হয়। শেষ কবে বদলিয়েছিলেন?”
“ওটা…” রান্নাঘরে একবার চোখ বোলালো আয়ানে। “আসলে ওটা বোধহয় একবারও পরিবর্তন করা হয়নি।”
“একবারও না?” ইউকাওয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।
“গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ভাবছিলাম যে ফিল্টার কোম্পানিতে ফোন করে বদলিয়ে দিয়ে যেতে বলবো। আমরা এই বাসায় ওঠার পর নতুন ফিল্টার লাগানো হয়েছিল, সেটা প্রায় এক বছর হতে চলল। আর এই মডেলের ফিলট্রেশন সিস্টেমের ফিল্টার এক বছর পরপরই পরিবর্তন করতে হয় সাধারণত।”
“তাহলে এক বছর আগে ফিল্টার বদলানো হয়েছিল?”
“আমি কি…ভুল কিছু করেছি?”
“না, না!” দ্রুত বলল ইউকাওয়া। “আমি এমনি জানতে চাচ্ছিলাম। আপনি ওপরে যান, আর সময় নষ্ট করবো না আপনার। তবে দ্রুত বদলে নেবেন ফিল্টারটা। পুরনো ফিল্টার ব্যবহারে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতে পারে, এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত।”
“ঠিক আছে, বদলে ফেলবো,” আয়ানে বলল। “তবে তার আগে সিঙ্কের নিচটা পরিস্কার করা উচিত। ওখানে অনেক ময়লা জমে গিয়েছে।“
“সব বাসাতে একই অবস্থা,” ইউকাওয়া বলল। “আমাদের ল্যাবরেটরির সিঙ্কের নিচে তো তেলাপোকার বাসা ভর্তি-তবে আমার বোধহয় ল্যাবরেটরির সাথে আপনার বাসার তুলনা করাটা উচিত হচ্ছে না। আপনার কাছে যদি-” বাক্যটা শেষ করার আগে কুসানাগির দিকে এক ঝলক তাকালো ইউকাওয়া। “ফিল্টার কোম্পানির সার্ভিসম্যানের নম্বর থেকে থাকে, তাহলে কুসানাগি খুশিমনেই তাকে ফোন দিতে পারবে। এসব কাজ যত দ্রুত সম্ভব সেরে ফেলা উচিত।”
ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে ইউকাওয়ার দিকে তাকালো কুসানাগি, কিন্তু সেটা পাত্তা দিল না পদার্থবিদ। বরং আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেমন আমার আইডিয়াটা?”
“মানে এখন ফোন দেয়ার কথা বলছেন?”
“যদি আপনার কোন সমস্যা না থেকে থাকে। তাছাড়া তদন্তেও সুবিধে হতো এতে।”
“বেশ, আমার কোন সমস্যা নেই।”
মুচকি হেসে কুসানাগির দিকে ফিরলো ইউকাওয়া। “ফোন দাও তাহলে।”
কুসানাগির দৃষ্টিতে প্রচ্ছন্ন রাগের আভাস থাকলেও সে জানে যে অনর্থক কোন কাজ করার মত মানুষ নয় তার বন্ধু। ডিটেক্টিভ গ্যালিলিও যখন একটা কাজ করতে বলেছে, নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে এর পেছনে। “নম্বরটা হবে আপনার কাছে?” আয়ানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল সে।
“হ্যাঁ, দাঁড়ান একটু।”
আয়ানের রান্নাঘর থেকে বের হওয়া অবধি অপেক্ষা করল কুসানাগি, এরপর ইউকাওয়ার দিকে ফিরে বলল। “আমাকে আগে থেকে একটু সতর্ক করে রাখলেই পারতে।”
“সময় ছিল না। এখন অভিযোগ করা বাদ দিয়ে চটপট একটা কাজ করে ফেলো”।
“কি?”
“ফরেনসিকের লোকজনকে এখানে আসতে বলো, এখনই। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, ফিল্টার কোম্পানি সার্ভিসম্যান গুরুত্বপূর্ণ কোন আলামত নষ্ট করুক? তোমাদের ফরেনসিকের কারো উচিত ফিল্টারটা প্রথমে বের করা।”
“মানে পুরনো ফিল্টারটা ওদের সাথে করে নিয়ে যাওয়া উচিত?”
“হ্যাঁ, সেই সাথে কানেকশন পাইপটাও,” নিচুস্বরে বলল ইউকাওয়া। তার চোখে আবিষ্কারের নেশায় পাওয়া বিজ্ঞানীর দীপ্তি। আয়ানে ফিরে এলো এ সময়।
*
প্রায় এক ঘন্টা পর মেট্রোপলিটন ফরেনসিক ডিভিশনের একজন অফিসার ফিলট্রেশন সিস্টেমের ফিল্টার আর কানেকশন পাইপটা সিঙ্কের নিচ থেকে সাবধানে বের করে আনতে সক্ষম হলো। পাশে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে গোটা ব্যাপারটা দেখলো দুই বন্ধু। ধীরে-সুস্থে একটা অ্যাক্রিলিক কেসের মধ্যে জিনিসদুটো ঢুকিয়ে রাখলো ফরেনসিক অফিসার।
“গিয়েই টেস্টের ব্যবস্থা করছি,” বলে মাশিবাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেল সে।
ফিল্টার কোম্পানির লোক আসলো আরো কিছুক্ষণ পর। তাকে কাজ করতে দিয়ে লিভিং রুমে চলে এলো কুসানাগি। বিষণ্ন বদনে সোফায় বসে আছে আয়ানে। তার পাশে কাপড় ভর্তি একটা ব্যাগ।
এখানে ফিরতে তাহলে দেরি আছে তার, মনে মনে বলল কুসানাগি। “এতসব ঝামেলার জন্যে দুঃখিত।“
“না, ঠিক আছে,” বলল আয়ানে। “এত কিছুর মধ্যেও যে ফিল্টারটা বদলানো গেল, এতেই খুশি আমি।”
“চিফকে খরচের ব্যাপারটা জানিয়ে দেব আমি।”
“আরে নাহ, আপনারা কেন খরচ দেবেন? এটা তো বদলাতে হতোই,” ক্ষণিকের জন্যে হাসি ফুটলো আয়ানের চেহারায়, কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল। “ফিল্টারে কি কোন সমস্যা ছিল? ওখানেই কি কোন কারসাজি করে বিষ মেশানো হয়েছে?”
“আমরা নিশ্চিত নই এখনও। আসলে সব সম্ভাবনাই যাচাই করে দেখা হচ্ছে।”
“কিন্তু ফিল্টারে কি কোনভাবে বিষাক্ত কিছু যুক্ত করা সম্ভব? ওটার কাজই তো হচ্ছে ক্ষতিকর পদার্থ ছেঁকে বের করে দেয়া।”
“ভালো প্রশ্ন…” দ্বিধান্বিত স্বরে বলে ইউকাওয়ার দিকে তাকালো কুসানাগি। রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সার্ভিসম্যানের কাজ দেখতে ব্যস্ত সে। “ইউকাওয়া,” ডাকলো ডিটেক্টিভ।
ঘুরে দাঁড়ালো ইউকাওয়া, কিন্তু তার দৃষ্টি আয়ানের দিকে, ডিটেক্টিভের দিকে নয়। “আপনার স্বামী কি আসলেই কেবল বোতলজাত পানি খেতেন?” জিজ্ঞেস করল সে।
কিছু বলার সুযোগও পেলো না কুসানাগি, কেবল দেখতে লাগলো আয়ানের প্রতিক্রিয়া কি হয়।
“জি। সেজন্যেই আমাদের ফ্রিজে সবসময় মিনারেল ওয়াটার মজুদ থাকতো,” মাথা নেড়ে বলল মহিলা।
“তিনি না কি কফি বানানোর সময়েও বোতলজাত পানি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আপনি মাঝে মাঝে সেটা করতেন না। ঠিক বলেছি?”
কুসানাগি অবাক হয়ে গেল। সে ইউকাওয়াকে এসব কিছু বলেনি। অর্থাৎ উতসুমি এসব তথ্য ডিপার্টমেন্টের বাইরের লোকদের বলে বেড়াচ্ছে। ভেতরে ভেতরে রেগে উঠল সিনিয়র ডিটেক্টিভ।
“আসলে খরচ বাঁচানোর জন্যে কাজটা করতাম আমি,” আয়ানে জবাব দিল। “তাছাড়া আমার কখনো মনে হয়নি, ট্যাপের পানির কোন ক্ষতিকর দিক আছে। আর গরম পানি ফুটতে সময়ও কম লাগে। ও অবশ্য কখনো ব্যাপারটা ধরতে পারেনি।
“আপনার সাথে একমত আমি,” পদার্থবিদ বলল। “কফির স্বাদের ওপর আলাদা কোন প্রভাব ফেলে না মিনারেল ওয়াটার।”
নিজে ইন্সট্যান্ট কফি খেয়ে অভ্যস্ত, এখন জ্ঞান দিচ্ছে।
বিদ্রুপের দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকালো কুসানাগি।
ইউকাওয়া ব্যাপারটা খেয়ালই করল না, অথবা খেয়াল করলেও উপেক্ষা করল পুরোপুরি। “রবিবার যিনি কফি বানিয়েছিলেন,” বলল সে। “ কি যেন নাম তার? আপনার সহকারি…”
“হিরোমি ওয়াকাইয়ামা,” পাশ থেকে কুসানাগি মনে করিয়ে দিল তাকে।
“হ্যাঁ, মিস ওয়াকাইয়ামা। তিনিও কি ট্যাপের পানি ব্যবহার করতেন কফি বানানোর জন্যে… আপনার নির্দেশনা অনুযায়ী? সেটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে অনেকে ধরে নেবে যে বিষ মেশানো হয়েছিল বোতলের পানিতে। কিন্তু এখানে আরেকধরণের পানির উৎস আছে। ফিলট্রেশন সিস্টেমের ফিল্টার করা পানি। এমনটাও হতে পারে যে বোতলের পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্যে মি. মাশিবা এই পানি ব্যবহার করতেন। সেই সম্ভাবনা থেকেই ফিলট্রেশন সিস্টেম পরীক্ষা করে দেখার কথা মাথায় এসেছে আমার।
“হ্যাঁ, সেটা সত্যি…কিন্তু কোন ফিলট্রেশন সিস্টেমে কি আসলেও বিষ মেশানো সম্ভব? বিষ কি ছেঁকে বের করে দেবে না?”
“নাহ, না-ও বের হতে পারে। যাইহোক, ফরেনসিকের রিপোর্ট পেলেই সব জানা যাবে।“
“বেশ… ফিলট্রেশন সিস্টেমে যদি বিষ মেশানো হয়েই থাকে, তাহলে সেটা কবে করা হতে পারে?” কুসানাগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আয়ানে। “আপনাকে তো আগেও বলেছি অনেকবার, শুক্রবার রাতে মেহমান এসেছিল আমাদের বাসায়। সেদিন তো ফিলট্রেশন সিস্টেম ঠিকঠাকই কাজ করছিল।”
“তাহলে বলতে হবে যে শুক্রবারের পরে বিষ মেশানোর কাজটা করা হয়েছে। যদি আমরা ধরে নেই যে খুনির উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র আপনার স্বামীকেই হত্যা করা, তাহলে সে এমন একটা সময় বেছে নেবে যখন তিনি একা থাকবেন বাসাতে।”
“অর্থাৎ আমি চলে যাবার পর। যদি আমি নিজেই খুনি হয়ে থাকি, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।“
“একদম ঠিক বলেছেন,” ইউকাওয়া বলল।
“এখনই কিছু ধরে নেয়া উচিত হবে না আমাদের,” সাবধানী স্বরে বলল কুসানাগি। “ফিলট্রেশন সিস্টেমে কোন কারসাজি আদৌ করা হয়েছিল কি না সেটা এখনও নিশ্চিতভাবে জানি না,” বলে উদ্দেশ্যপূর্ণ দৃষ্টিতে ইউকাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।
হলওয়ের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর ইউকাওয়া আসলো সেখানে। “কি করছো তুমি?” নিচু কিন্তু তীক্ষ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।
“কি করছি মানে?”
“বুঝছো না কি বলছি? তুমি তো আরেকটু হলে তার মুখের সামনেই বলে দিয়েছিলে যে ‘আপনি একজন সন্দেহভাজন’। উসুমি প্রথমে তোমার সাহায্য চেয়েছে দেখে যে তার পক্ষই নিতে হবে তোমাকে, এমন কোন কথা নেই।”
কপালে ভাঁজ পড়লো ইউকাওয়ার। “আমি আবার কখন উতসুমির পক্ষ নিলাম,” নিখাদ বিস্ময় তার কন্ঠে। “আমি ঠাণ্ডা মাথায় সূত্রগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছি। তুমি নিজেও সে চেষ্টা করে দেখতে পারো। তোমার চেয়ে তো বিধবা মহিলাকে মানসিকভাবে শক্ত মনে হচ্ছে।”
জবাবে কড়া কিছু বলতে যাবে এমন সময় লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে এলো সার্ভিসম্যান, আয়ানেও তার পেছন পেছন আসছে।
“ফিল্টার বদলানো শেষ,” ওদের উদ্দেশ্যে বলল মহিলা।
“ধন্যবাদ আপনাকে,” সার্ভিসম্যানকে বলল কুসানাগি। “আপনার বিল…”
“আমি দিয়ে দিয়েছি,” আয়ানে বলল।
“ওহ,” দূর্বল কন্ঠে বলল কুসানাগি।
সার্ভিসম্যান বের হয়ে যাবার পর ইউকাওয়া নিজেও জুতো পরে নিল। “আমিও বের হই তাহলে,” বলল সে। “কুসানাগি?”
“আমি আরো কিছুক্ষণ আছি এখানে,” ডিটেক্টিভ বলল জবাবে। “মিসেস মাশিবার সাথে কিছু কথা আছে।”
“ঠিক আছে। আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্যে,” পরের কথাটা আয়নের উদ্দেশ্যে বাউ করে বলল ইউকাওয়া।
“আপনাকেও ধন্যবাদ,” বলল আয়ানে। বন্ধুকে বের হয়ে যেতে দেখলো কুসানাগি। এরপর লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, “সরি। ও মানুষ হিসেবে খারাপ না। কিন্তু মাঝে মাঝে চিন্তা ভাবনা না করেই কাজ করে ফেলে। একটু খামখেয়ালী স্বভাবের বলতে পারেন।
“তাই?” আয়ানেকে দেখে মনে হলো কুসানাগির কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করেনি সে। “আপনি কেন সরি বলছেন? আমি কিছু মনে করিনি তো।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
“তিনি ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বলছিলেন না? আমি তো অধ্যাপক বলতে সবসময় গম্ভীর কাউকে কল্পনা করে এসেছি। কিন্তু তিনি বোধহয় ওরকম নন, তাই না?”
“বিশ্ববিদ্যালয়ে নানারকমের অধ্যাপক আছেন। কিন্তু ও একটু বেশিই অন্যরকম।”
“আপনারা দু’জন যে ঘনিষ্ঠ তা বুঝতে পেরেছি,” আয়ানে হেসে বলল। “ওহ…আপনাকে তো বলা হয়নি। আমরা দু’জন একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। সাবজেক্ট অবশ্য ভিন্ন ছিল।”
কথা বলতে বলতে লিভিং রুমে ফিরে গেল দু’জনে। ওখানে সোফায় বসে ব্যাডমিন্টন ক্লাবের স্মৃতি আর কিভাবে ইউকাওয়া ওদের কেসে সাহায্য শুরু করল সেটা বলল কুসানাগি।
“মানুষকে কাজের খাতিরে হলেও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে দেখলে আমার ভালো লাগে।”
“মাঝে মাঝে অবশ্য মনোমালিন্যও হয়।”
“সেটা তো সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হয়।”
হাসলো কুসানাগি। “আপনার অন্তত এরকম একজন বন্ধু আছে যার সাথে চাইলে হট স্প্রিং রিসোর্টে ঘুরতে যেতে পারেন।”
মাথা নাড়লো আয়ানে। এরপর হঠাৎই কথাটা মনে পড়ে গেল তার। “আপনি তো আমার বাবা-মা’র বাসায় গিয়েছিলেন। মা ফোন দিয়ে জানিয়েছিল।”
“হ্যাঁ, তদন্তের কাজে গিয়েছিলাম। অবশ্য গিয়ে কি লাভ হয়েছিল সেটা এখন অবধি জানি না। কিন্তু সব কেসের ক্ষেত্রেই এরকম কিছু কাজ করতেই হয়,” কুসানাগি বলল।
আবারো হাসলো আয়ানে। “আমি আসলেই বাড়ি গিয়েছিলাম কি না সেটা তো আপনাদের নিশ্চিত হতেই হতো।”
“আপনি ব্যাপারগুলো সহজভাবে নিচ্ছেন দেখে ভালো লাগছে। আমি চাইনা আপনি ভাবুন যে আপনাকে সন্দেহ করা হচ্ছে।”
“মা আপনার প্রশংসা করেছে। আমিও তাদের বলেছি, যোগ্য লোকই তদন্ত করছে।”
রক্তিম হয়ে উঠল কুসানাগির চেহারা। লজ্জায় মাথা নিচু করে গাল চুলকালো সে।
“আমার বান্ধবির সাথেও আপনার দেখা হয়েছিল বোধহয়, মিস সাকিকো মোতুকা?” আয়ানে জিজ্ঞেস করল।
“আসলে, উতসুমি গিয়েছিল তার সাথে দেখা করতে। মিস মোতুকা তাকে বলেছেন যে দুর্ঘটনাটার আগে থেকেই আপনাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। খুব বেশি ক্লান্ত আর বিপর্যস্ত মনে হচ্ছিল আপনাকে।”
একটা মলিন হাসি ফুটলো আয়ানের চেহারায়। “পুরনো বন্ধুরা এমনই হয়। যতই লুকোনোর চেষ্টা করুন না কেন, লাভ হবে না,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল সে।
“কিন্তু আপনি তো তার সাথে আপনার আসন্ন ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছু বলেননি?”
মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল আয়ানে। “আসলে বলার ইচ্ছেও ছিল না। বলতে পারেন ক্ষণিকের জন্যে ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম সবকিছু। তাছাড়া ব্যাপারটা এমন ছিল যে…কারো সাথে কথা বলতেও বাঁধতো। বিয়ের আগে আমরা একে অপরকে কথা দিয়েছিলাম যে যদি বাচ্চা না হয়, তাহলে আলাদা হয়ে যাব। অবশ্য আমার বাবা-মা এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না।”
“মি. ইকাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি আপনার স্বামী বিয়েই করেছিলেন বাচ্চা নেয়ার জন্যে, অন্য সকল উদ্দেশ্যে গৌণ এই উদ্দেশ্যের কাছে। সত্যি বলতে কি, কেউ যে এভাবে ভাবতে পারে তা জেনেও অবাক হয়েছিলাম।”
“আমারো বাচ্চা নেয়ার ইচ্ছে ছিল,” আয়ানে ব্যাখ্যা করল। ভেবেছিলাম বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই সবকিছু হয়ে যাবে। তাই তখন শর্তটা নিয়ে মাথাও ঘামাইনি। কিন্তু যখন এক বছরের মধ্যেও কিছু হলো না…ঈশ্বর মাঝে মাঝে খুব নিষ্ঠুর আচরণ করেন,” এক মুহূর্তের জন্যে মাথা নিচু করে ফেলল আয়ানে। এরপর ডিটেক্টিভের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কি বাচ্চাকাচ্চা আছে, ডিটেক্টিভ কুসানাগি?”
“নাহ,” মৃদু হেসে বলল কুসানাগি। “আমি এখনও সিঙ্গেল।”
“ওহ,” বলল আয়ানে, “সরি।“
“আরে সরি বলছেন কেন? লোকে প্রায়ই বলে যে দেরি করে ফেলছি, কিন্তু যখন মনের মত কাউকে খুঁজেই পেলাম না…থাক সেসব কথা। ইউকাওয়াও বিয়ে-শাদি করেনি।
“হ্যাঁ, তাকে দেখেই সিঙ্গেল মনে হচ্ছিল। তার পক্ষে সংসার করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।”
“ও আপনার স্বামীর পুরোপুরি উল্টো, বাচ্চাদের সহ্য করতে পারে না। ওদের ‘যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার অক্ষমতা’ না কি পাগল করে তোলে ওকে। এরকম কথাও বলে মানুষ, বিশ্বাস হয়?”
“আসলেও একটু অন্যরকম তিনি।”
“তাকে বলবো যে আপনি এ কথা বলেছেন। আচ্ছা, আপনার স্বামীর ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“জি?”
“তার কি চিত্রশিল্পী কোন বন্ধু বা বান্ধবী ছিল?”
“চিত্রশিল্পী, মানে আর্টিস্ট?”
“হ্যাঁ, এমন কোন আর্টিস্টের কথা কি বলেছিলেন যাকে আগে চিনতেন তিনি?”
কিছুক্ষণ ভাববার পর কৌতূহলী চোখে কুসানাগির দিকে তাকালো আয়ানে। “এই আর্টিস্ট, মানে যার কথা জিজ্ঞেস করছেন, সে কি ঘটনার সাথে কোনভাবে জড়িত?”
“সেটা আমি নিজেও জানি না। আপনাকে তো বলেছি, আপনার স্বামীর আগের সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছি। সেই সূত্রেই জানতে পেরেছি, খুব সম্ভবত একজন আর্টিস্টের সাথে একসময় সম্পর্ক ছিল তার।”
“ওহ আচ্ছা। সরি, কিন্তু আমি কোন আর্টিস্টের ব্যাপারে কখনো কিছু শুনিনি ওর কাছ থেকে। এটা বলতেন পারবেন যে এই সম্পর্কটা কবেকার?”
“আন্দাজ করতে পারি। বছর তিনেক।“
“সরি,” কিছুক্ষণ পর আবারো বলল আয়ানে। “সাহায্য করতে পারছি না আপনাকে।”
“ঠিক আছে, সমস্যা নেই,” বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো কুসানাগি। “আপনার এতগুলো সময় নষ্ট করার জন্যে দুঃখিত। এবার যাওয়া উচিত আমার।”
“আমি নিজেও হোটেলে ফিরবো এখন।” ব্যাগ হাতে আয়ানেও উঠে দাঁড়ালো।
একইসাথে বাসা থেকে বের হলো দু’জন। দরজায় নিজহাতে তালা দিল আয়ানে।
“ব্যাগটা আমাকে দিন নাহয়। ট্যাক্সিস্ট্যান্ড পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দেই,” বলে হাত বাড়িয়ে দিল কুসানাগি।
ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যাগটা ওর হাতে তুলে দিল আয়ানে। এরপর পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা নির্জন বাড়িটার ফিরে বলল, “আর কখনো এখানে ফিরতে পারবো কি না, কে জানে!”
বলার মত উপযুক্ত কিছু খুঁজে না পেয়ে চুপ থাকারই সিদ্ধান্ত নিল কুসানাগি।