স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ১

অধ্যায় ১

অপরাজিতা ফুলগুলো ফুটেছে বেশ কয়েকদিন পর, থোকায় থোকায়। ওগুলোর রঙে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারপাশ। চারদিকের শুকনো মাটিও ক্ষুন্ন করতে পারেনি পাপড়িগুলোর সৌন্দর্য। খুব বিরল জাতের হয়তো নয়, কিন্তু আমার পছন্দের, বারান্দার কাচের দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে মনে বলল আয়ানে। নিয়ম করে পানি দিতে হবে।

“আমার একটা কথাও কি তোমার কানে ঢুকেছে?” বিরক্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল ইয়োশিতাকা।

ঘুরে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্যে একটা হাসি দিল সে, “হ্যাঁ, সব শুনেছি। না শোনার কি হলো?”

“তাহলে দয়া করে একটু দ্রুত জবাব দিয়ে আমাকে বাধিত করবে এরপর থেকে,” পা ভাঁজ করে সোফায় বসতে বসতে বলল ইয়োশিতাকা। নিয়মিত ব্যায়াম করে সে, কিন্তু খেয়াল রাখে যাতে পায়ের পেশি বেশি স্ফীত না হয়। ওতে করে চাপা জিন্স পরতে অসুবিধে হয়।

“অন্য কিছু ভাবছিলাম।“

“তাই? আগে তো কখনও এমন করোনি,” একপাশের ভ্রু উঁচু করে মন্তব্য করল তার স্বামী।

“তুমি যা যা বললে সেগুলো কিন্তু অবাক করেছে আমাকে।”

“অবাক হওয়ার কি আছে? এতদিনে তো আমার জীবন-যাপনের ধরণের

সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা তোমার।

“অভ্যস্ত…হয়তো।”

“যা বলতে চাচ্ছো স্পষ্ট করে বলো, ভণিতা ভালো লাগে না আমার, আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে হাত জোড়া মাথার ওপরে নিয়ে বলল – ইয়োশিতাকা। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আয়ানের বলা কথাগুলোর কোন গুরুত্ব নেই তার কাছে। আসলেই কি এতটা উদাসীন সে, না কি অভিনয় করছে?… সন্দেহ হলো আয়ানের।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ইয়োশিতাকার সুন্দর চেহারাটার দিকে তাকালো সে।

“ব্যাপারটা এত গুরুত্বপূর্ণ তোমার কাছে?”

“কি এত গুরুত্বপূর্ণ?”

“বাচ্চা নেয়া?”

একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠল ইয়োশিতাকার মুখের কোণে। ক্ষণিকের জন্যে বাইরে তাকিয়ে আবারও আয়ানের চোখে চোখ রাখলো সে। “আমার কোন কথাই শোননি তুমি, তাই না?”

“শুনেছি,” চোখ বড় করে জবাব দিল আয়ানে, “সেজন্যেই জিজ্ঞেস করছি।”

হাসিটা উধাও হয়ে গেল তার। শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো একবার। “হ্যাঁ, এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমাদের কোন বাচ্চা না হয়, তাহলে এই বিয়ের কোন অর্থ নেই আমার কাছে। একজন পুরুষ আর নারীর মধ্যে রোমান্টিকতা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না, সময়ের সাথে ফিকে হয়ে আসে। লোকে একসাথে থাকে একটা পরিবার গঠনের জন্যে। নারী-পুরুষের বিয়ে হয়, এরপর তারা সন্তান নেয়। তখন পরিচয় বদলে তারা হয়ে যায় বাবা আর মা। কেবলমাত্র তখনই তারা প্রকৃত জীবনসঙ্গীতে পরিণত হয়। এটার সাথে তো তুমি একমত?”

“আমার কাছে বিয়ের সংজ্ঞাটা ঠিক এরকম নয়।”

মাথা ঝাঁকালো ইয়োশিতাকা। “হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে বিয়ের সংজ্ঞা এটাই। আর এ ব্যাপারে আমার মত কিছুতেই বদলাবে না। আমাদের যদি বাচ্চাকাচ্চা না হয়, তাহলে আমি আর তোমার সাথে সময় নষ্ট করতে রাজি নই।”

দুই হাত দিয়ে কপালের দু’পাশ চেপে ধরলো আয়ানে। বেশ খানিকক্ষণ ধরেই মাথাব্যথা করছে। এরকম কিছু আশা করেনি সে। “অর্থাৎ,” কিছুক্ষণ পর বলল আয়ানে, “যে নারী তোমাকে বাচ্চা দিতে পারবে না, তাকে দরকার নেই তোমার। আমাকে জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে জায়গায় অন্য কাউকে বিয়ে করবে তুমি, তাই তো?”

“এভাবে কেন বলছো?।”

“কিন্তু এটাই তো সত্য!“

সোজা হয়ে বসলো ইয়োশিতাকা। পরবর্তী কথাগুলো বলার আগে কিছুক্ষণ ভাবলো। “হ্যাঁ, তোমার দিক থেকে চিন্তা করলে ব্যাপারটা সেরকমই ঠেকবে বোধহয়। তোমাকে বুঝতে হবে, জীবন নিয়ে একটা আলাদা পরিকল্পনা আছে আমার। আর সেই পরিকল্পনার গুরুত্ব অনেক বেশি আমার কাছে।”

একটা হাসি ফুটলো আয়ানের মুখে, যদিও এই মুহূর্তে হাসার মত মানসিকতা নেই তার। “এই কথাটা সবাইকে শোনাতে খুব ভালো লাগে তোমার, তাই না? জীবন নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা আছে তোমার আর সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যখন প্রথম দেখা হয়েছিল তখনও বলেছিলে।”

“এত মন খারাপ করছো কেন, আয়ানে? কিসের অভাব আছে তোমার, শুনি? যদি তোমাকে কিছু দিতে ভুলে যাই আমি, তাহলে মনে করিয়ে দাও। তোমার জন্যে যা যা করা সম্ভব, সব করতে রাজি আছি। তাই আপাতত এই ফালতু আলোচনা বন্ধ করে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি বরং। না কি অন্য কোন উপায় জানা আছে তোমার?”

দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল আয়ানে। বড় একটা ট্যাপেস্ট্রি ঝুলছে সেখানে, তিন মাস লাগিয়ে ওটা সেলাই করেছে সে; সরাসরি ইংল্যান্ড থেকে অর্ডার দিয়ে কিছু উপকরণ আনতে হয়েছিল।

জীবনে বাচ্চাকাচার গুরুত্ব ইয়োশিতাকার কাছ থেকে শিখতে হবে না তার। সে নিজেও মা হতে চায় খুব করে। কতবার স্বপ্ন দেখেছে, একটা রকিং চেয়ারে বসে বাচ্চার কাঁথা সেলাই করছে, দিন দিন ফুলে উঠছে তার পেট কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয়নি। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছে সে-জীবনের সব স্বপ্ন তো আর পূরণ হবার নয়। ভেবেছিল তার স্বামীও হয়তো মানিয়ে নেবে।

“প্রশ্নটা হয়তো বোকার মত শোনাবে, তারপরও না জিজ্ঞেস করে পারছি না।”

“কি প্রশ্ন?”

তার দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিল আয়ানে। “আমার জন্যে তোমার ভালোবাসার কি হলো?”

যন্ত্রনার ছাপ ফুটে উঠল ইয়োশিতাকার চেহারায়, এরপর ধীরে ধীরে একটা হাসি জায়গা করে নিল সেখানে। “তোমার জন্যে আমার ভালোবাসা একটুও কমেনি,” বলল সে, “তোমাকে এখনও আগের মতই ভালোবাসি আমি।

কথাটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে তা ভালো করেই জানা আছে আয়ানের। তবুও জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, সেটাই যথেষ্ট। অন্য কোন উত্তর জানাও নেই তার।

“চলো এখন,” উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল ইয়োশিতাকা।

নিজের ড্রেসারের দিকে তাকালো আয়ানে। ওটার সবচেয়ে নিচের ড্রয়ারে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু সাদা পাউডার লুকানো আছে।

ওগুলো ব্যবহারের সময় ঘনিয়ে এসেছে, ভাবলো সে, আশার শেষ প্রদীপটাও নিভে গেছে কিছুক্ষণ আগে।

দরজা দিয়ে বের হবার সময় এক দৃষ্টিতে ইয়োশিতাকার দিকে চেয়ে রইলো, ভাবছে, এ পৃথিবীতে যে কোন কিছুর চেয়ে তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি। সেজন্যেই তোমার কথাগুলো ছুরির ফলার মত বিঁধেছে আমার হৃদয়ে।

আর সে জন্যেই মরতে হবে তোমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *