অধ্যায় ২৫
“মিসেস সুকুইয়ের কথা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরুনোর পরপরই একটা চাকরি পান জুঞ্জি। কিন্তু তিন বছর পর চাকরি ছেড়ে দেন কারণ তার ইচ্ছে ছিল প্যারিসে চিত্রকলা বিষয়ে পড়াশোনা করবেন। দু’বছর ইউরোপে কাটান তিনি। পোস্টকার্ডটা তখনকারই পাঠানো।”
জুনিয়র ডিটেক্টিভের বলা কথাগুলো যতই শুনছে মনের ঈষাণ কোণ ততই অন্ধকার হয়ে আসছে কুসানাগির। ভেতরে ভেতরে উতসুমির বলা কথাগুলো বিশ্বাস করতে চাইছে না সে, আবার না করেও পারছে না।
“তাহলে তুমি বলতে চাইছো যে মিস সুকুই এবং মিসেস মাশিবা একে অপরকে চিনতেন?” চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল মামিয়া।
“আপাতদৃষ্টিতে তো সেটাই মনে হচ্ছে। পোস্টকার্ডের পেছনে যে সালটা লেখা আছে, সেই সময়েই লন্ডনে পড়তে গিয়েছিল আয়ানে মাশিবা। আর তার পৈতৃক নিবাসও হোক্কাইদোতে। আমার মনে হয় না এটা কাকতালীয় কোন ঘটনা।”
“এত নিশ্চিত হচ্ছো কি করে?” বলল কুসানাগি। “কাকতালীয় ব্যাপার হতেও তো পারে। লন্ডনে আমাদের দেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী পড়তে যায়।”
“আহহা, তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন?” কুসানাগির উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বলল মামিয়া। “আচ্ছা উতসুমি, ধরো তারা আসলেও বন্ধু ছিলেন। তাহলে সেটার সাথে আমাদের বর্তমান কেসের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?”
“এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারি, “ জবাব দিল উতসুমি। “যে আর্সেনাস এসিড পানিতে মিশিয়ে আত্মহত্যা করেছিল জুঞ্জি সুকুই, সেটাই পরবর্তীতে মিসেস মাশিবা ব্যবহার করেছেন,” আয়ানেকে সন্দেহের ব্যাপারে আর কোন রাখঢাক করল না জুনিয়র ডিটেক্টিভ।
“ফরেনসিকের ওরা টেস্ট করে দেখবে যে দুই ক্ষেত্রে একই উৎসের বিষ ব্যবহার করা হয়েছিল কি না। তবে এতদিন পরে টেস্ট করে আদৌ কোন লাভ হবে কি না সন্দেহ আছে। তোমার ভাষ্যমতে তাহলে নিজের বান্ধবীর প্রাক্তন প্রেমিককে বিয়ে করেছিলেন মিসেস মাশিবা?”
“হুম।”
“ব্যাপারটা কি একটু অদ্ভুত ঠেকছে না তোমার কাছে?”
“সত্যি কথা বলতে… অদ্ভুত লাগছে না।
“কেন না?”
“অনেক নারীই তাদের বান্ধবীর প্রাক্তনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি নিজেও এমন কয়েকজনকে চিনি।”
“কিন্তু মিস সুকুই তো আত্মহত্যা করেছেন। এই ঘটনার পরেও তার প্রেমিকের সাথে সম্পর্কে জড়ালেন আয়ানে?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল। ‘এমনটাও তো হতে পারে যে প্রেমিকের অবহেলার কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন মিস সুকুই। সেটা জানার পর কেন এরকম একটা লোকের সাথে সম্পর্কে জড়াবে কেউ?”
“হয়তো তিনি ভেবেছিলেন যে আত্মহত্যার সাথে ইয়োশিতাকার কোন সম্পর্ক নেই, কিংবা জানতেনই না।“
“একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ভুলে যাচ্ছো তুমি,” অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল কুসানাগি। “আয়ানের সাথে ইয়োশিতাকার দেখা হয়েছিল একটা পার্টিতে। সেখানেও কি কাকতালীয়ভাবে বান্ধবীর প্রাক্তনের সাথে মোলাকাত হয় তার?”
“অসম্ভব কিছু না। তারা দু’জনই সেসময় সিঙ্গেল ছিলেন।”
“আর দেখা হবার কয়েকদিনের মধ্যেই একে অপরের প্রেমে পড়ে যান? সরি, আমি এই থিওরি সহজে মানতে পারছি না।“
“হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয় ছিল না।”
“মানে?”
ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকালো উতসুমি। “হয়তো আগে থেকেই মি. মাশিবাকে ভালো লাগতো আয়ানের কিন্তু মিস সুকুইয়ের কারণে কিছু করতে পারছিলেন না। তিনি মারা যাবার পর ব্যাপারটা কাছাকাছি নিয়ে আসে দু’জনকে। পার্টির আগেও দেখা হতে পারে তাদের, আর সেটাও হয়তো কাকতালীয় ছিল না।”
“ফালতু কথা!” গলা চড়িয়ে বলল কুসানাগি। “উনি ঐ ধরণের মহিলাই নন।”
“তাহলে কেমন মহিলা তিনি? তার সম্পর্কে ঠিক কতটা জানেন আপনি, ডিটেক্টিভ কুসানাগি?” উতসুমিও একই স্বরে জবাব দিল।
“যথেষ্ট হয়েছে!” উঠে দাঁড়িয়ে বলল মামিয়া। “উতসুমি, এবারে বোধহয় একটু বেশি কল্পনা করে ফেলছো তুমি। আগে আমাদের হাতে আরো প্রমাণ আসুক, তখন নাহয় এসব বলো। আর কুসানাগি, অন্য কেউ যখন কোন কেসের ব্যাপারে নিজের মতামত দেয়, হোক সে জুনিয়র-সেটা চুপচাপ শোনা উচিত। অভিযোগ থাকলে পরে বলবে। এতদিন বাদেও যদি তোমাকে এসব শেখাতে হয়। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ভালো একজন শ্রোতা। কিন্তু এবার হলোটা কি তোমার?”
কিছু না বলে কেবল মাথা নাড়লো কুসানাগি। উতসুমি লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। “সরি,” বলল সে।
চেয়ার টেনে নিয়ে আবারো বসে পড়লো মামিয়া। “যা বললে, তা যদি সত্যি হয় তাহলে কেসের মোড় ঘুরে যাবে, উসুমি। কিন্তু আমরা যেহেতু নিশ্চিত নই, তাই এখনই কোন সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক হবে না। আমাদের আগে জানতে হবে যে মিসেস মাশিবার কাছে আর্সেনাস এসিডটুকু আসলো কিভাবে। আর এটার সাথে পুরো কেসের কি সম্পর্ক। অবশ্য…” বলে ডেস্কের উপর দুই হাত রেখে সরাসরি জুনিয়র ডিটেক্টিভের চোখের দিকে তাকালো চিফ। “তোমার কি মনে হয় যে বন্ধুর খুনের বদলা নিতে ইয়োশিতাকা মাশিবার সাথে সম্পর্ক করেছিলেন আয়ানে?”
“এটা আবার একটু বেশি বেশি হয়ে যায়…মানে শুধু প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে একজনকে বিয়ে করা…নাহ।”
“তাহলে আমি বলবো আপাতত অনুমান করা বাদ দেই আমরা। আগে দেখা যাক মিস সুকুইদের বাসার স্টোরেজ শেডটায় কি পাওয়া যায়।
বারোটার কিছুক্ষণ পর বাড়ী ফিরলো কুসানাগি। ভেবেছিল এসেই গোসল করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্লান্তির কাছে হার মেনে জ্যাকেট খুলে চিৎপটাং হয়ে গেল বিছানার ওপর। একজন পুলিশ অফিসার থানায় ব্যস্ত সময় পার করে ক্লান্ত হয়েই বাসায় ফিরবে, এটা একদমই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কিন্তু আজকের ক্লান্তিটুকু কতটা শারীরিক আর কতটা মানসিক সেটা বুঝতে পারছে না কুসানাগি।
“তাহলে কেমন মহিলা তিনি?”
উতসুমির বলা কথাটা অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে তার মস্তিষ্কে।
“তার সম্পর্কে ঠিক কতটা জানেন আপনি, ডিটেক্টিভ কুসানাগি?”
কিছুই না, ভাবলো সে। আয়ানের সাথে খুব কমই কথা হয়েছে তার। এতটুকু সময় একজন মানুষকে জানার পক্ষে আদর্শ নয়। তবুও…তার কেন যেন মনে হয় আয়ানেকে বুঝতে পারে সে।
আত্মহত্যা করেছে এমন বান্ধবীর প্রাক্তন প্রেমিককে বিয়ে করার ব্যাপারটা মানতেই পারছে না কুসানাগি। মনে মনে সবসময়ই একটা অপরাধবোধ কাজ করার কথা তার। জুঞ্জির মৃত্যুর সাথে ইয়োশিতাকার কোন সম্পর্ক না থাকলেও।
টাইয়ের বাঁধন আলগা করার সময় টেবিলের ওপর রাখা ছবির বই দুটোর ওপর নজর পড়লো তার। উঠে ওগুলো নিয়ে এসে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। অলস ভঙ্গিতে ওল্টাতে লাগলো তুষারমানবের অভিযান বইটার পাতা। অনেকদিন দক্ষিণের শীতে সময় কাটানোর পর হঠাৎই তুষারমানবের মনে হলো এবার কোন উষ্ণ এলাকায় যাওয়া উচিত তার। কিন্তু উত্তর দিকে কিছুদূর এগোনোর পরই বুঝতে পারলো, আর বেশি সামনে গেলে গলে যাবে সে। তাই আবারো দক্ষিণে ফিরে যেতে লাগলো। পথে একটা বাসার জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলো ভেতরের বাসিন্দারা ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে হাসিমুখে গল্পগুজব করছে। বাইরে ঠাণ্ডা কিন্তু ভেতরে আরামদায়ক উষ্ণতা-এ ব্যাপারেই কথা বলছিল তারা।
জুঞ্জি সুকুইয়ের আঁকা এই দৃশ্যটার দিকে চোখ পড়তেই তড়াক করে সোজা হয়ে বসলো কুসানাগি। আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলো।
তুষারমানব যে বাড়িটার ভেতরে উঁকি দিয়েছে সেটার দেয়ালে তার পরিচিত একটা জিনিস ঝুলছে। ফুলেল নকশা তোলা একটা ট্যাপেস্ট্রি।
প্রথমবার এই নকশা দেখে মুগ্ধ হওয়ার ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে তার। কোথায় দেখেছিল সেটাও জানে-মার্শিবাদের মাস্টার বেডরুমে।
সেলাইস্কুলের খালি দেয়ালটাতে সেদিন এই ট্যাপেস্ট্রিটাই ঝোলাতে চেয়েছিল আয়ানে।
হয়তো আমি জুঞ্জি সুকুইয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করাতেই আর ওটা ঝোলায়নি সে? জানতো যে মিস সুকুই তার একটা বইয়ে ট্যাপেস্ট্রিটার ছবি এঁকেছে নিখুঁতভাবে।
দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো কুসানাগি।
পরদিন সকালে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো তার। ঘড়ির কাটা সাড়ে আটটা ছুঁইছুঁই করছে। সোফায় শুয়ে ছিল সে। পাশের টেবিলে একটা গ্লাস আর হুইস্কির বোতল রাখা।
ঘুমই আসছিল না গত রাতে। কারণটা মনে করতে চাচ্ছে না এ মুহূর্তে।
আড়মোড়া ভেঙে ফোনটা হাত বাড়িয়ে তুললো সে। উতসুমি কল করেছে।
“এত সকালে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্যে দুঃখিত, কিন্তু ব্যাপারটা যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে জানানো উচিত বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।“
“কি?”
“স্প্রিং-এইট থেকে টেস্টের রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। ফিল্টারে আর্সেনাস এসিডের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে তারা।”