অধ্যায় ১৭
দরজায় ঝোলানো চার্টের মতে ইউকাওয়া ল্যাবরেটরিতে একাই আছে এ মুহূর্তে। উতসুমি এটাই আশা করছিল মনে মনে। দরজায় কড়া নাড়লো সে।
“আসুন,” ছোট করে জবাব এলো ভেতর থেকে। দরজা খুলতেই দেখা গেল যে কফি বানাতে ব্যস্ত ইউকাওয়া। একটা ডিপার এবং ফিল্টার ব্যবহার করছে সে।
“ভালো সময়ে এসেছেন,” বলে দু’টা কাপে কফি ঢাললো ইউকাওয়া। “আপনি দেখি কফিমেকার ব্যবহার করছেন না!”
“ভাবলাম আলসেমি ছেড়ে নিজে একটু কষ্ট করে দেখি একবার। মিনারেল ওয়াটার ব্যবহার করেছি,” একটা কাপ উতসুমির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল ইউকাওয়া।
“ধন্যবাদ,” বলে কাপটা হাতে নিয়ে একবার চুমুক দিল উতসুমি। গতবারের মতন একই জাতের কফি বিনই ব্যবহার করেছে পদার্থবিদ।
“কেমন হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল সে।
“দারুণ।”
“গতানুগতিকের চেয়ে বেশি দারুণ?”
জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ইতস্তত বোধ করল উতসুমি। “সত্যি বলবো?”
একটা হতাশ অভিব্যক্তি গ্রাস করল ইউকাওয়াকে। “দরকার নেই। আপনার প্রতিক্রিয়াও যে আমার মতনই সেটা পরিস্কার বুঝতে পারছি, * কফি কাপের দিকে তাকিয়ে বলল সে। “কিছুক্ষণ আগে আমি ট্যাপের পানি দিয়ে কফি বানিয়েছিলাম। একই রকম হয়েছিল স্বাদ।”
“আমার মনে হয় না কেউ পার্থক্য করতে পারবে।”
“কিন্তু রন্ধনশিল্পে একটা কথা প্রচলিত আছে যে পানির কারণে স্বাদের পরিবর্তন হয়,” বলে ডেস্ক থেকে একটা কাগজ তুলে নিল ইউকাওয়া। ‘পানির ক্ষারত্ব পরিমাপ করা হয় ক্যালসিয়াম আয়ন, ম্যাগনেসিয়াম আয়ন আর ক্যালসিয়াম কার্বনেটের অনুপাত থেকে। যদি অনুপাত কম হয়, তাহলে ক্ষারত্ব কম। আর যদি বেশি হয় তাহলে ক্ষারত্বও বেশি।”
“জানি আমি।”
“যে পানির ক্ষারত্ব যত কম, সেটা রান্নার জন্য তত উপযোগী। এখানে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যেমন আপনি যদি ক্যালসিয়াম বেশি আছে এমন পানি দিয়ে ভাত রান্না করতে যান, তাহলে চালের সাথে ক্যালসিয়াম মিশে যাবার ফলে ভাত শুকনো শুকনো হবে।”
“সুশি রান্নার জন্যেও তো তাহলে এই পানি সুবিধার হবে না।”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি যদি বিফ স্টক বানাতে চান তাহলে আবার ক্ষারীয় পানি ব্যবহার করাটা সুবিধাজনক। মাংস এবং হাড্ডির মধ্যে থাকা তরলের সাথে ক্যালসিয়াম মিশে সেগুলো ভেসে উঠবে। তখন আপনি একটা চামচ দিয়ে ওগুলো উঠিয়ে নিতে পারবেন। পরের বার ‘কনসোম’ রান্নার সময় এই বুদ্ধিটা মাথায় রেখেন।”
“আপনি রান্না করেন না কি?”
“মাঝে মাঝে,” কাগজটা নামিয়ে রেখে বলল ইউকাওয়া।
প্রফেসরকে একটা রান্নাঘরে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কল্পনা করার চেষ্টা করল উতসুমি। গোটা ব্যাপারটাকেই একটা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে নেবে সে নিশ্চয়ই।
“কিছু জানতে পেরেছেন?” ইউকাওয়া জিজ্ঞেস করল।
“ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট পেয়েছি,” বলল উসুমি। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে রাখলো।
“পড়ে শোনান তাহলে,” কফিতে চুমুক দিয়ে বলল ইউকাওয়া। “ফিল্টার কিংবা কানেক্টিং পাইপ, কোথাওই আর্সেনাস এসিড পাওয়া যায়নি। যদি বিষ মেশানোর পর ২০ থেকে ৪০ লিটার পানি ফিল্টার করা হয় তাহলে বিষের কোন অস্তিত্ব এমনিতেও পাওয়া যাওয়ার কথা না,” বলে একটু থামলো উতসুমি। “দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ফলে ফিল্টার এবং পাইপ দু’জায়গাতেই বেশ ভালো পরিমাণ চিটচিটে ময়লা জমা হয়েছে। সুতরাং এ থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে অন্তত গত কয়েকমাসে এগুলো কেউ ধরেনি। কারণ ফিল্টার বা পাইপটা যদি খোলা হতো তাহলে স্পষ্ট বোঝা যেতো। মি. মাশিবা যেদিন মারা যান, সেদিনও ফরেনসিকের লোকেরা সিঙ্কের নিচে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল। ওখানে যে ডিটারজেন্টের কৌটোগুলো আছে সেগুলোও অনেকদিন নাড়াচাড়া করা হয়নি।”
“অর্থাৎ শুধু ফিল্টারই নয়, সিঙ্কের নিচেও কেউ হাত দেয়নি?”
“সেটাই ধারণা করছে ফরেনসিকের সবাই।”
“আমিও তাদের সাথে একমত। গতবার যখন সিঙ্কের নিচে উঁকি দিয়েছিলাম তখন আমারো এটাই মনে হয়েছিল। তবে আরেকটা জিনিস পরীক্ষা করে দেখা উচিত ছিল তাদের।“
“আমি জানি আপনি কি বলবেন। বিষ তো ফিল্টারের অন্য দিক থেকেও মেশানো হতে পারে। ট্যাপটা দিয়ে, তাই না?”
“হ্যাঁ। তারা কিছু বলেছে এ ব্যাপারে?”
“কাগজে কলমে এটা সম্ভব,” উতসুমি বলল। “কিন্তু বাস্তবে অসম্ভব।” কফিতে চুমুক দিয়েই ভ্রু কুঁচকে ফেলল ইউকাওয়া। এমন না যে কফিটা তেতো বা ওরকম কিছু, অন্য কোন কারণ আছে-উতসুমি ভাবলো।
“আপনার বলা পদ্ধতিটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করে দেখেছে ওরা। ট্যাপের মুখ দিয়ে একটা ফাপা টিউব ঢোকানোর চেষ্টা করেছিল ফিল্টার অবধি। এরপর টিউবে বিষ মিশিয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, ট্যাপটা যেখানে ফিল্টারের সাথে মিলিত হয়, ওখানটা প্রায় সমকোণ। টিউবটা তাই ফিল্টার পর্যন্ত যেতেই পারেনি। যদি কেউ বিশেষ কোন যন্ত্র ব্যবহার করে-“
“থাক, আর বলতে হবে না,” মাথা চুলকে বলল ইউকাওয়া। “আমাদের খুনি এত ঝক্কি নিয়েছে বলে মনে হয় না। ফিল্টারের থিওরিটা বাদ দিতে হচ্ছে তাহলে। এটা নিয়ে বেশি আশা করে ফেলেছিলাম। আমাদের এখন একটু ভিন্নভাবে ভাবার চেষ্টা করতে হবে। কোন না কোন উপায় তো আছেই।”
বাকি কফিটুকু কাপে ঢেলে নিল ইউকাওয়া। কিছুটা কাপের বাইরে ছিটকে পড়ায় মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করল।
তাহলে তিনিও বিরক্ত হন, ভাবলো উতসুমি। আপাত দৃষ্টিতে খুবই সাধারণ একটা প্রশ্ন। কোথায় বিষ মিশিয়েছিল খুনি? কিন্তু সেটার উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। আমরা কেউই পাচ্ছি না।
“আমাদের সিনিয়র ডিটেক্টিভ সাহেব কী নিয়ে ব্যস্ত?” ইউকাওয়া জিজ্ঞেস করল।
“মি. মাশিবার অফিসে গিয়েছেন কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে।”
“হুম।”
“আপনাকে কিছু বলেছেন তিনি?”
মাথা ঝাঁকালো ইউকাওয়া। নিঃশব্দে চুমুক দিল কাপে। “সেদিন মিসেস মাশিবার সাথে দেখা হয়েছিল আমাদের, ওনার বাসায়।”
“শুনেছি আমি।”
“কথাও হয়েছে। খুব সুন্দরি মহিলা।”
“তার রূপ কি আপনাকেও প্রভাবিত করেছিল, প্রফেসর?”
“না, আমি শুধু যা দেখেছি সেটার বর্ণনা দিচ্ছিলাম। তবে, কুসানাগিকে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছে।”
“তাই? কিছু হয়েছে না কি?”
“না, আসলে কিছু হয়েছে কি না এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমি কি বলতে চাচ্ছি সেটা বোঝানো যাবে না। তারচেয়ে বরং একটা গল্প বলি শুনুন—তাহলে হয়তো বুঝতে পারবেন।
“আমরা যখন ভার্সিটির ছাত্র ছিলাম, কুসানাগি রাস্তা থেকে দু’টা বিড়ালের বাচ্চা কুড়িয়ে এনেছিল। একদম সদ্য জন্মানো। তাদের দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবে যে পৃথিবীতে খুব বেশি সময় কাটানোর জন্যে আসেনি তারা। তবুও তাদের নিজের ঘরে নিয়ে আসে সে, ক্লাস বাদ দিয়ে পরিচর্যা করে। একটা আই ড্রপারের সাহায্যে ছানা দু’টোকে দুধ খাওয়াতো ও। আমাদেরই এক বন্ধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল যে- এসব করে লাভ কি? ওরা তো মরেই যাবে। জবাবে কুসানাগি কেবল একটা শব্দ বলেছিল—’তো?”
উতসুমির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ইউকাওয়া। “বিড়ালগুলোকে যত্ন করার সময় যেভাবে তাকাতো, মিসেস মাশিবার দিকেও সেই দৃষ্টিতে তাকাতে দেখেছি সেদিন ওকে। সে কিন্তু জানে যে কিছু একটা ঠিক নেই। তবুও নিজেকেই বারবার বলছে-”তো?”