স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ৩

অধ্যায় ৩

দূর থেকেই বাড়িগুলোর আভিজাত্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোতেও প্রতীয়মান যে বাড়ির মালিকেরা টাকা পয়সা খরচ করতে কার্পণ্য বোধ করেনি। এই এলাকায় যারা থাকে তাদের ‘সঞ্চয়ী হিসাব’ বলে ব্যাঙ্কে কোন অ্যাকাউন্ট সচরাচর থাকে না।

মহল্লাটা সাধারণত নৈঃশব্দে ভরা থাকলেও আজ তার ব্যত্যয় ঘটেছে। বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়ি এসে জমা হয়েছে রাস্তায়। “বামে নামিয়ে দিন,” সামনে ঝুঁকে ট্যাক্সি চালকের উদ্দেশ্যে বলল কুসানাগি।

ট্যাক্সি থেকে বের হয়ে একবার হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে ক্রাইম সিনের উদ্দেশ্যে পা চালালো সে। ইতোমধ্যে ঘড়ির কাটা দশটা অতিক্রম করে ফেলেছে। সিনেমাটা দেখাই হলো না। হলে যখন দেখাচ্ছিল তখন ব্যস্ততার কারণে যেতে পারেনি। পরবর্তীতে ডিভিডি ভাড়া করতে যাবার সময় এক সহকর্মীর কাছে শোনে যে টিভিতে দেখানো হবে ওটা, তাই আর ডিভিডিও ভাড়া করেনি। কিন্তু আজ তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় রেকর্ডারটা চালু করে আসতে ভুলে গেছে।

বেশ রাত হয়ে যাওয়াতে কোন ‘উৎসাহী জনতা চোখে পড়লো না। এমনকি খবরের চ্যানেলের কর্মীরাও উপস্থিত হয়নি এখনও। সাধারণ একটা খুনের কেস হলেই ভালো, সিনেমাটা পরবর্তী সময়ে দেখে নেয়া যাবে। তবে খুব বেশি আশা করাটা যে বোকামি হবে তা ভালো করেই জানে সে।

একজন গোমড়ামুখী পুলিশ অফিসার সটান দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সদর দরজার সামনে। কুসানাগি তার ব্যাজ দেখানোর সাথে সাথে অভিব্যক্তি বদলে গেল তার। ‘শুভ সন্ধ্যা’ জানিয়ে সরে দাঁড়ালো।

সামনের লনের একপাশে ফুলঝারের ধারে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো কুসানাগি। চেহারা পরিস্কার বোঝা না গেলেও দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে চিনতে কোন অসুবিধে হলো না তার। ওদিকটায় এগিয়ে গেল সে।

“তুমি এখানে কি করছো?”

ধীরে তার দিকে ফিরলো কাওরু উতসুমি, খুব একটা অবাক হয়নি। “শুভ সন্ধ্যা, ডিটেক্টিভ।“

“বাইরে কি করছো তুমি?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“দেখছি। ব্যালকনিতেও আছে অনেকগুলো।”

“অনেকগুলো কি?”

“ফুলগাছ,” উপরের দিকে নির্দেশ করে বলল উতসুমি।

ওপরে তাকিয়ে উতসুমির কথার প্রমাণ দেখতে পেলো কুসানাগি। ব্যালকনির ফাঁক গলে ইতস্তত বেরিয়ে আছে বেয়াড়া কতগুলো পাতাভর্তি ডাল। দেখে সাধারণই মনে হচ্ছে।

ডিপার্টমেন্টে সদ্য যোগ দেয়া ডিটেক্টিভের দিকে নজর ফেরালো সে। “আবারও প্রশ্নটা করি তাহলে,” বলল কুসানাগি, “ভেতরে নেই কেন তুমি?”

“ওখানে লোকে গিজগিজ করছে, ইতোমধ্যেই ভিড় জমে গেছে।”

“ভিড় ভালো লাগে না তোমার?”

“সবাই যা দেখে ফেলেছে সেগুলো আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মধ্যে কোন যুক্তি খুঁজে পাই না আমি। তাছাড়া ফরেনসিকের লোকদের কাজের অসুবিধেও করতে চাইনি। তাই বাইরে এসে নিজের মত করে তদন্ত করছি।”

“তদন্ত? আমি তো দেখলাম ফুলের দিকে তাকিয়ে ছিলে!”

“ইতোমধ্যেই চারপাশের একবার ঘুরে আসা শেষ।”

“বেশ। ক্রাইম সিনটায় একবার উঁকি তো দিয়েছো?”

“আসলে ভেতরেই ঢুকিনি। দরজা থেকে ফিরে এসেছি,” উতসুমি জবাব দিল।

হতাশ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো কুসানাগি। তার মতে একজন ডিটেক্টিভের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ঘটনাস্থল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। কিন্তু উতসুমি যে তার সাথে একমত নয়, সেটা স্পষ্ট।

“নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে খারাপ করেছো বলবো না, তবে আমার সাথে ভেতরে আসতে হবে তোমাকে। কিছু জিনিস তদন্তকারীর নিজের চোখে দেখা উচিত।”

বাড়ীর সদর দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল কুসানাগি। চুপচাপ তার পিছু নিল উতসুমি।

ভেতরে স্থানীয় থানার লোকজন আর কুসানাগির নিজের ডিপার্টমেন্টের লোকেরা গিজগিজ করছে।

জুনিয়র ডিটেক্টিভ কিশিতানি ওকে দেখে এগিয়ে এলো। “এত তাড়াতাড়ি আপনাকে ডেকে নিয়ে আসার জন্যে দুঃখিত, স্যার,” শুকনো হাসি তার মুখে।

“ফালতু প্যাচাল রাখো,” কুসানাগি বলল গম্ভীর স্বরে। “এটা কি আসলেও খুন?”

“এখনও নিশ্চিত নই আমরা। তবে সেরকমটাই মনে হচ্ছে।”

“পুরো ঘটনা বলো আমাকে। সংক্ষেপে।“

“এই বাড়ির মালিক মারা গিয়েছে, লিভিংরুমে। একা ছিল সে।”

“একা ছিল এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত?”

“এদিকে আসুন।”

কুসানাগিকে লিভিংরুমের দিকে নিয়ে গেল কিশিতানি, তাদের পেছনে উতসুমি। বড় একটা রুম, প্রায় পাঁচশো স্কয়ার ফিট। দুটো সবুজ রঙের চামড়ার সোফা আর একটা নিচু মার্বেলের টেবিল রাখা মাঝে।

টেবিলের পাশে সাদা টেপ দিয়ে মৃতদেহের একটা আউটলাইন আঁকা হয়েছে। লাশটা সরিয়ে ফেলেছে ফরেনসিকের লোকজন। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিশিতানি বলল, “মৃতের নাম ইয়োশিতাকা মাশিবা, বিবাহিত, কোন সন্তান নেই।”

“সেটা এখানে আসার পথেই শুনেছি,” কুসানাগি বলল, “লোকটা বোধহয় কোন একটা কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ, একটা আইটি কোম্পানি। আজকে রোববার হওয়াতে অবশ্য অফিসে যায়নি। মনে হচ্ছে বাসা থেকে বের হবার সুযোগই মেলেনই তার।”

“মেঝেতে কিসের দাগ ওগুলো?” নিচের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কুসানাগি!

“কফি। মৃতদেহের পাশেই পড়ে ছিল। আমাদের ফরেনসিকের একজন সিরিঞ্জ দিয়ে কিছুটা আলামতও সংগ্রহ করেছে। একটা কফি কাপ ও পেয়েছি।”

“লাশ প্রথমে আবিষ্কার করে কে?”

“ইয়ে…” বলে পকেট থেকে নোটপ্যাড বের করে কিশিতানি। “মহিলার নাম হিরোমি ওয়াকাইয়ামা। ভদ্রলকের স্ত্রীর শিক্ষানবিশদের একজন।”

“শিক্ষানবিশ?”

“ইয়োশিতাকার স্ত্রী একজন বিখ্যাত নকশীকাঁথা শিল্পী।”

“নকশীকাঁথার আবার বিখ্যাত শিল্পীও আছে?”

“আমিও অবাক হয়েছিলাম প্রথমে। হয়তো মেয়েরা বেশি জানবে এ ব্যাপারে,” বলে উতসুমির দিকে তাকালো কিশিতানি। “তুমি কি ‘আয়ানে মিতা’ নামে কাউকে চেনো?” জিজ্ঞেস করল সে। তার নোটপ্যাডে এই নামটাই লেখা।

“না,” জবাবে বলল উতসুমি, “মেয়েরা বেশি জানবে এটা বললেন কেন?”

“এমনি, মনে হলো,” মাথা চুলকে বলল কিশিতানি।

কোনমতে হাসি চাপলো কুসানাগি। অবশেষে অর্ডার দেয়ার মতন অধীনস্থ কাউকে পেয়েছে কিশিতানি, কিন্তু ভাগ্য খুব একটা সুপ্রসন্ন মনে হচ্ছে না তার। কিভাবে উতসুমির সাথে মানিয়ে চলতে হবে এ ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই।

“কিভাবে লাশের খোঁজ মিললো?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“ভদ্রলোকের স্ত্রী গতকাল স্যাপোরো গিয়েছে, বাবা-মা’র বাড়িতে। যাওয়ার আগে বাসার চাবি মিস ওয়াকাইয়ামার কাছে দিয়ে যায় সে। কবে ফিরবেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন বিধায় চাবি রেখে গেছেন। হঠাৎ জরুরি কোন দরকার হতে পারে। মিস ওয়াকাইয়ামা বলেছেন, মি. মাশিবার কোন অসুবিধে হচ্ছে কি না সেটা জানার জন্যে বেশ কয়েকবার ফোন দেন তিনি। তবে পাওয়া যাচ্ছিলো না তাকে। মোবাইলের পাশাপাশি ল্যান্ডলাইনেও কল দেয় মিস ওয়াকাইয়ামা, কিন্তু লাভ হয় না। তাই শেষমেষ সশরীরে এসে দেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জানিয়েছেন যে প্রথম ফোনটা দিয়েছিলেন সাতটার দিকে আর এখানে এসে উপস্থিত হন আটটায়।

“তখনই মৃতদেহ দেখতে পান?”

“হ্যাঁ। নিজের ফোন থেকেই ৯৯৯-এ ফোন দেন এরপর। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে না। অ্যাম্বুলেন্সের সাথে একজন ডাক্তারও আসেন। পরীক্ষার সময় কিছুটা সন্দেহ হলে তিনি আমাদের ফোন দেন।“

“ওহ,” বলে উতসুমির দিকে তাকালো কুসানাগি। ডান পাশের কাবার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছে সে। “মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছেন যিনি, তিনি এখন কোথায়?”

“বাইরে, একটা গাড়িতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। চিফ আছেন তার সাথে।”

“কি? চিফও চলে এসেছেন? ভেতরে ঢোকার সময় তো তাকে চোখে পড়লো না,” ভ্রু কুঁচকে বলল কুসানাগি। “মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু জানা গেছে?”

“বিষজাতীয় কিছু সেবনের কারণে মৃত্যু বলে প্রাথমিক ধারণা ফরেনসিকের। এটা আত্মহত্যাও হতে পারে…তবে খুনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তা না-হলে তো আমাদের ডাকা হতো না, তাই না?”

“হুম,” আড়চোখে আবারও উতসুমির দিকে তাকালো কুসানাগি, এখন রান্নাঘরে প্রবেশ করেছে সে। “মিস ওয়াকাইয়ামা যখন এখানে আসেন তখন দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল?”

“তেমনটাই তো বলছেন।”

“জানালা আর স্লাইডিং ডোর?”

“দোতলার বাথরুমের জানালা বাদে না কি সবকিছুই বন্ধ ছিল।”

“ঐ জানালা দিয়ে কি কারও বের হওয়া সম্ভব?”

“আমি নিজে চেষ্টা করে দেখিনি, তবে মনে হয় না।”

“তাহলে সবাই কেন এটাকে খুন বলছে?” সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে দিল কুসানাগি। “তাদের ধারণা যে কফিতে বিষ মেশানো হয়েছে? তাহলে তো কফিতে বিষ মেশানোর পর আততায়ীর ঘটনা স্থল থেকে পালাতে হবে। ওরকম কিছুর আলামত তো নেই, নাহ, মিলছে না…

“আপনার সাথে আমিও একমত।”

“আর কিছু জানা বাকি আছে আমার?”

“ফরেনসিকের লোকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় মি. মাশিবার মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে একবার। ইবিসুর একটা রেস্টুরেন্ট থেকে ফোন দেয়া হয়। আজ রাত আটটার সময় দু’জনের একটা টেবিলের জন্যে রিজার্ভেশন দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের সাথে কথা হয়েছে আমার। সে জানায় যে সাড়ে ছ’টার দিকে ফোন দিয়েছিলেন মাশিবা। আর আপনাকে তো বলেছিই যে মিস ওয়াকাইয়ামা সাতটার দিকে প্রথম কল করেছিলেন, কিন্তু ফোন ধরেননি ভদ্রলোক। সাড়ে ছ’টার সময় রেস্তোরাঁয় রিজার্ভেশন দেয়া কারো জন্যে সাতটার মধ্যে আত্মহত্যা করাটা একটু বেমানান।”

“হ্যাঁ,” ভ্রু কুঁচকে বলল কুসানাগি, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে সে। “এই কথাটা আমি এখানে আসার পরপরই বলা উচিত ছিল তোমার।”

“সরি, আপনার অন্যান্য প্রশ্নের কারণে ভুলেই গিয়েছিলাম বলতে।”

“বেশ,” বলে নিজের হাঁটুতে একবার চাপড় মেরে উঠে দাঁড়ালো কুসানাগি। এ সময় রান্নাঘর থেকে উতসুমি বেরিয়ে এলে হাত নেড়ে তার মনোযোগ আকর্ষণ করল সে, “এরকম ঘোরাঘুরি করছো কেন? কিশি আমাদের এখানকার সবকিছু খুলে বলছে, সেটা বুঝতে পারছো?”

“সব শুনেছি আমি। ধন্যবাদ, ডিটেক্টিভ কিশিতানি।”

জবাবে কেবল আলতো মাথা নাড়লো কিশিতানি।

“কাবার্ডের ব্যাপারে কিছু বলবে না কি?”

“এখানটায় দেখুন?” খোলা কাবার্ডের দরজার ভেতরের দিকটায় নির্দেশ করল উতসুমি। “এই শেলফটা অন্যান্যগুলোর তুলনায় একটু খালি খালি মনে হচ্ছে না?”

খালি জায়গাটায় অনায়াসে একটা প্লেট এঁটে যাবে।

“হুম, তো?”

“রান্নাঘরে ড্রাইং র‍্যাকে পাঁচটা শ্যাম্পেইন গ্লাস দেখেছি আমি।”

“তাহলে ওগুলোই হয়তো এখানে ছিল।”

“হয়তো।”

“হঠাৎ করে শ্যাম্পেইনের গ্লাস নিয়ে আলাপ শুরু করলে কেন?”

কুসানাগির দিকে তাকালো উতসুমি। একবার কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল শেষ মুহূর্তে, যেন বলবে কি না সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে। “আসলে ওরকম কিছু না,” খানিক বাদে বলল সে, “আমার মনে হচ্ছে যে এখানে হয়তো কাওকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। শ্যাম্পেইনের গ্লাসগুলো হয়তো তখনই ব্যবহার করা হয়েছে।”

“খারাপ বলোনি, খুবই সম্ভব এটা। অবস্থাসম্পন্ন নিঃসন্তান দম্পতিরা কিছুদিন পরপরই পার্টির আয়োজন করে থাকে। কিন্তু মি. মাশিবা আত্মহত্যা করেছেন না কি খুন হয়েছেন তার সাথে এসবের কোন যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি না,” বলে কিশিতানির দিকে ঘুরলো কুসানাগি। “মানুষের পক্ষে অদ্ভুত অনেক কিছুই করা সম্ভব। এক ঘন্টা পরে ডিনারের জন্যে টেবিল রিজার্ভেশন দিয়েও যদি কেউ আত্মহত্যা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে কিছু করার নেই আমাদের।”

এবারও কেবল মাথা নাড়লো কিশিতানি।

“মহিলার কি খবর?”

“মহিলা? মানে?”

“ভিক্টিম…মানে, মৃতের স্ত্রীর কথা বলছি আমি। তাকে কেউ ফোন দিয়েছে?”

“ওহ! না, এখনও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। স্যাপোরো শহর থেকে বেশ দূরে জায়গাটা। আর কোনভাবে কথা বলা সম্ভব হলেও কালকের আগে এখানে পৌঁছুবার সম্ভাবনা নেই।“

“হ্যাঁ, হোক্কাইদো এখান থেকে অনেক দূরে,” কুসানাগি বলল, ভেতরে ভেতরে কিছুটা খুশিই হয়েছে। মহিলা যদি কাছাকাছি কোথাও থাকতো তাহলে কাউকে না কাউকে এখানে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হতো। চিফ মামিয়াকে যতটুকু চেনে সে, ওকেই থাকতে বলতেন তিনি। বেশি রাত হওয়াতে প্রতিবেশীদের সাথেও আজকে আর কথা বলা যাবে না। বাসায় ফিরে কি করবে- এসব নিয়ে ভাবছে এমন সময় মামিয়া প্রবেশ করলেন ভেতরে।

“কুসানাগি, তুমি এখানে! অবশেষে আসার সময় হলো তাহলে।”

“অনেক আগেই এসেছি আমি। কিশিতানি সবকিছু খুলে বলেছে ইতোমধ্যে।”

মাথা নাড়লো মামিয়া, এরপর ঘুরে দরজার বাইরে তাকিয়ে বলল, “ভেতরে আসুন।” ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের ছিপছিপে গড়নের এক নারী প্রবেশ করল। ঘন কালো চুল পিঠ অবধি ছড়িয়ে আছে। চুলের রঙ তার ফর্সা চেহারার ঔজ্জ্বল্য যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এ মুহূর্তে কিছুটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাকে।

হিরোমি ওয়াকাইয়ামা।

“আপনি বলছিলেন যে রুমে পা দিয়েই মৃতদেহটা চোখে পড়েছে আপনার, তাই না?” মামিয়া জিজ্ঞেস করল তাকে। “এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তখনও তো এখানেই ছিলেন?”

বেশ কিছুক্ষণ পর মেঝের দিক থেকে দৃষ্টি উঠিয়ে সোফার দিকে তাকালো হিরোমি। সন্ধ্যায় দেখা দৃশ্যটা পুনরায় মনে করার চেষ্টা করছে। প্রসাধনী কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সে ব্যাপারে ভালোই জ্ঞান রাখে সে। অবশ্য মেক-আপ ব্যবহার ছাড়াও সৌন্দর্য ম্লান হবে না তার।

“হ্যাঁ,” অবশেষে ক্ষীন গলায় বলল সে।

কুসানাগির কেন যেন মনে হলো যে হিরোমির দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। হয়তো তার ক্ষীণ কন্ঠ অথবা শারীরিক গঠনের কারণে। এখনও ঘোরের মধ্যে আছে সে, সন্দেহ নেই।

“আজকের আগে শেষবার এখানে আপনার পা পড়েছিল গত পরশু?” মামিয়া জিজ্ঞেস করল।

মাথা নেড়ে সায় জানালো হিরোমি।

“কোন পার্থক্য কি চোখে পড়ছে? কোন অসামঞ্জস্য?”

ভয়ে ভয়ে আশপাশে একবার তাকালো সে, এরপর দ্রুত মাথা ঝাঁকালো, “আমি আসলে নিশ্চিত নই। এখানে কালকে আরো কয়েকজন ছিল। ডিনার পার্টির আয়োজন করেছিলেন মাশিবা আর আয়ানে…” গলা কাঁপছে তার।

মাথা নাড়লেন মামিয়া, তার চোখে সহানুভূতি।

“আপনাকে আজকে আর খুব বেশিক্ষণ এখানে আটকে রাখবো না। বাসায় গিয়ে এখন বিশ্রাম নেয়া উচিত। কালকে আপনার সাথে যোগাযোগ করা হবে, ঠিক আছে?”

“আচ্ছা,” বলল হিরোমি, “কিন্তু খুব বেশি কিছু বলার নেই আমার। “জানি, তদন্তের জন্যে ছোটখাটো সব তথ্যই দরকার। আশা করি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন।”

“ঠিক আছে,” মাথা নিচু করেই বলল হিরোমি।

“আমার একজন লোক আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে,” বলে কুসানাগির দিকে তাকালেন মামিয়া। “তুমি এখানে এসেছো কিভাবে? গাড়ি এনেছো?”

“না, ট্যাক্সি।”

“আজকেই গাড়ি বাসায় রেখে আসলে!”

বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছিলেন মামিয়া, এমন সময় উতসুমি বলে উঠল, “আমি গাড়ি এনেছি।”

অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো কুসানাগি। “তুমি টোকিওর রাস্তায় নিজের গাড়ি নিয়ে বের হও? এই বেতনে?”

“এখানে আসার জন্যে যখন যোগাযোগ করা হয় তখন একটা রেস্তোরাঁয় ছিলাম আমি, দুঃখিত।”

“দুঃখিত হবার কিছু দেখছি না,” বললেন মামিয়া, “তুমি কি মিস ওয়াকাইয়ামাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবে?”

“অবশ্যই, তবে তার আগে তাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই আমি।”

“কি প্রশ্ন?” নতুন ডিটেক্টিভের এহেন কথায় অবাক না হয়ে পারলেন না মামিয়া।

হিরোমির চেহারায় যেন মেঘ ডেকেছে।

“মি. মাশিবা যখন মেঝেতে পড়ে যান তখন নিশ্চয়ই তিনি কফি খাচ্ছিলেন। আমি জানতে চাই, তিনি কাপের সাথে পিরিচ ব্যবহার করতেন কি না?”

হিরোমির চোখজোড়া বড় হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। “একা একা কফি খাওয়ার সময় পিরিচ না ব্যবহার করাটাই স্বাভাবিক।”

“তাহলে মনে হচ্ছে আজকে সকালে অথবা গতকাল কোন অতিথি এসেছিল তার সাথে দেখা করতে,” আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল উতসুমি। “সেটা কে হতে পারে জানেন?”

“কিভাবে বুঝলে যে এখানে কেউ এসেছিল?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল।

“সিঙ্কে এখনও একটা কফির কাপ আর দু’টা পিরিচ পড়ে আছে। মি. মাসিবা যদি একা একাই কফি খেয়ে থাকেন তাহলে দু’টা পিরিচের কি দরকার? একটাই তো বের করার কথা না।

কিশিতানি রান্নাঘরে গিয়ে একবার নিজের চোখে দেখে এলো। “ঠিক বলেছে উতসুমি। ওখানে একটা কাপ আর দু’টা পিরিচ রাখা।”

মামিয়ার সাথে একবার দৃষ্টি বিনিময় করে হিরোমি ওয়াকাইয়ামার দিকে তাকালো কুসানাগি।

“জানেন কিছু?”

মাথা ঝাঁকালো হিরোমি। “না…” ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল সে, “এখানে তো সেদিনের পার্টির পরে আর আসিনি আমি। আজকে কেউ এসেছিল কি না সেটা কিভাবে জানবো?”

আবারও মামিয়ার দিকে তাকালো কুসানাগি। উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে একবার মাথা নাড়লেন তিনি। “আপনাকে আর এখানে আটকে রাখবো না আমরা। উতসুমি, তুমি বাসায় পৌঁছে দাও তাকে। কুসানাগি, যাও ওদের সাথে।”

“জি, স্যার,” কুসানাগি বলল। মামিয়ার উদ্দেশ্য পরিস্কার বুঝতে পারছে সে। মিস ওয়াকাইয়ামা কিছু একটা লুকোচ্ছে, তার কাজ সেই তথ্য বের করা।

*

তিনজন একসাথে বাসাটা থেকে বের হলো। ওদের অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি আনতে গেল উসুমি, কাছেরই একটা পার্কিং লটে রাখা আছে সেটা।

অপেক্ষার সময়টুকুতে পাশে দাঁড়ানো হিরোমির দিকে নজর রাখলো কুসানাগি। একদম বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে তাকে। তবে বিধ্বস্ততার পেছনে লাশ আবিষ্কারের পাশাপাশি অন্য কারণও থাকতে পারে।

“আপনার কি শীত করছে?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“না, ঠিক আছি আমি।”

“আজকে কোথাও যাওয়ার কথা ছিল আপনার?”

“আজকে? কেন?”

“এমনি জানতে চাচ্ছিলাম।”

হিরোমির চেহারার উদ্বিগ্ন ভাবটা ফিরে এসেছে। কিছু বলবে কি না সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে।

“আপনি বোধহয় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফেলেছেন,” কুসানাগি বলল, “তবুও আবারো জিজ্ঞেস করছি…”

“কি?”

“মি. মাশিবাকে কেন ফোন দিয়েছিলেন সন্ধ্যায়?”

“মিসেস মাশিবা যে আমাকে চাবি দিয়ে গেছেন, সেটা জানেন বোধহয়? তাই মনে হলো একবার ফোন দিয়ে দেখি মি. মাশিবা ঠিকঠাক আছেন কি না। স্বামীকে একা ফেলে সচরাচর কোথাও যান না মিসেস মাশিবা। যদি কোন কিছু দরকার হতো…”

“তিনি যখন ফোন ধরলেন না, তখন এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেন আপনি?”

“জি,” আস্তে করে মাথা নেড়ে বলে হিরোমি।

“কিন্তু লোকে তো অনেক কারণেই ফোন না ধরতে পারে, সেটা ল্যান্ডলাইন হোক কিংবা মোবাইলেই হোক। হয়তো জরুরি কোন কাজের কারণে ধরতে পারছিল না। আপনার কি এরকম কিছু মনে হয়নি?”

“না,” কিছুক্ষণ নীরবতার পর বলল হিরোমি।

“কেন? আপনি কি নির্দিষ্ট কোন ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন?”

“না, ওরকম কিছু না। শুধু মনে হচ্ছিল যে কি যেন একটা ঠিক নেই…

“মনে হচ্ছিলো?”

“কারো খোঁজ নিতে বাসায় এসে পড়া কি বড় ধরণের কোন অপরাধ?”

“অবশ্যই না। আসলে আপনার সিদ্ধান্তে আমি অবাক হবার পাশাপাশি কিছুটা মুগ্ধও হয়েছি। অনেকেই তো প্রতিবেশী বা নিকটাত্মীয়ের কাছে বাসার চাবি রেখে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কোন প্রকার বাড়তি দায়িত্ব নিতে চায় না, চিন্তা করা তো দূরের কথা। আপনার কাজটা প্রশংসার দাবিদার।”

মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল হিরোমি। কুসানাগির কথাগুলো তার ওপর কিরকম প্রভাব ফেলেছে তা বোঝা সম্ভব হলো না।

একটা লাল রঙের মিতসুবিশি পাজেরো বাড়িটার সামনে উপস্থিত হলো এ সময়। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলো উতসুমি।

“পাজেরো!” বিস্ময় গোপন করল না কুসানাগি।

“চালিয়ে মজা,” বলল উতসুমি। “উঠে পড়ুন তাহলে,” হিরোমির জন্যে পেছনের সিটের দরজা খুলে দিয়ে বলল সে।

চালকের আসনে বসে জিপিএস সেট করতে শুরু করল উতসুমি, ইতোমধ্যেই হিরোমির বাসার ঠিকানা জেনে নিয়েছে সে। দাইগাকু রেল স্টেশনের কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্টে। গাড়ি চলতে শুরু করার অল্প সময় পর সামনে ঝুঁকে এলো হিরোমি ওয়াকাইয়ামা, জিজ্ঞেস করল, “মি. মাশিবার মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা…না কি আত্মহত্যা?”

রিয়ারভিউ মিররে উতসুমির সাথে চোখাচোখি হলো কুসানাগির। “এখনও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না,” বলল সে, “আগে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসুক।”

“কিন্তু আপনারা তো হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের লোক, তাই না?”

“হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের ডাকা হয়েছে কারণ এটা একটা হত্যাকাণ্ড ‘হতেও পারে’-তা ভেবে। এর চেয়ে বেশি কিছু এমুহূর্তে বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

“আচ্ছা,” ক্ষীণকণ্ঠে বলল হিরোমি।

“একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ ধরেই করতে চাচ্ছি আপনাকে, মিস ওয়াকাইয়ামা,” যতটা সম্ভব স্বাভাবিক স্বরে বলল কুসানাগি, “এটা যদি আসলেও হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে কে দায়ি হতে পারে সে ব্যাপারে আপনার কোন ধারণা আছে?”

“না,” আগের সুরেই বলল হিরোমি। “মি. মাশিবা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু আসলে জানি না আমি। তাকে শুধু আমার শিক্ষকের স্বামী হিসেবে চিনি।”

“বেশ। ওরকম কিছু যদি পরে মনে পড়ে তাহলে অবশ্যই আমাদের জানাবেন।”

চুপচাপ বসে রইলো হিরোমি। একবার মাথাও নাড়লো না।

*

অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটার সামনে তাকে নামিয়ে দিল ওরা। এ সময় সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে এসে বলল কুসানাগি।

“কি মনে হচ্ছে তোমার,” রাস্তার দিকে তাকিয়ে করল প্রশ্নটা। “মানসিকভাবে যথেষ্ট শক্ত মহিলা,” গাড় চালাতে চালাতে জবাব দিল উতসুমি।

“তাই?”

“হ্যাঁ। আমাদের সামনে একবারের জন্যেও কাঁদেনি।

“হয়তো অতটা কষ্ট পায়নি।”

“নাহ, আমরা পৌঁছুনোর আগে কাঁদছিল। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগ পর্যন্ত সময়টুকুতে অবশ্যই কেঁদেছে।”

“সেটা কিভাবে জানলে?”

“তার মেক-আপ। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে তাড়াহুড়ো করে ঠিক করা হয়েছে।”

জুনিয়র ডিটেক্টিভের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো কুসানাগি। “আসলেই?”

“কোন সন্দেহ নেই।“

“কিছু ব্যাপার শুধু নারীদের চোখেই পড়ে,” বলল সে, “এবং অবশ্যই সেটা একটা ভালো দিক,” দ্রুত যোগ করতে ভুললো না।

“জানি আমি,” হাসলো উসুমি, “তাকে দেখে আপনার কেমন মনে হয়েছে, ডিটেক্টিভ কুসানাগি?”

এক শব্দে বলতে গেলে-সন্দেহজনক। এরকম ফোন না ধরতেই হুট করে একজনের বাসায় এসে উপস্থিত হওয়াটা সন্দেহজনক।”

“ঠিক বলেছেন। আমি হলে এভাবে একজন অপরিচিত পুরুষ মানুষের খোঁজ নিতে বাসায় এসে হাজির হতাম না।“

“তোমারও কি মনে হয়, মি. মাশিবার সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল? না কি আমি একটু বেশিই ভেবে ফেলছি?”

“এখানে বেশি ভাবার কিছু নেই। বরং তাদের মধ্যে সম্পর্ক না থাকলেই অবাক হবো। আমার মতে আজ রাতে একসাথে ডিনার সারার পরিকল্পনা ছিল তাদের।”

“ইবিসুর রেস্তোরাঁটায়,” তুড়ি বাজিয়ে বলল কুসানাগি।

“কেউ উপস্থিত হয়নি বিধায় ফোন দিয়েছিল তারা, দু’জনের জন্যে একটা টেবিল রিজার্ভ করা হয়েছিল। অর্থাৎ মি. মাশিবার পাশাপাশি যার সাথে ডিনার করার কথা ছিল তার, সে-ও উপস্থিত হয়নি।”

“সেটা হিরোমি ওয়াকাইয়ামা হবার সম্ভাবনাই বেশি,” কুসানাগি বলল। “যদি তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে খুব দ্রুতই সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।”

“কিভাবে?”

“সিঙ্কের কফি কাপটা এখনও ধোয়া হয়নি, অর্থাৎ আঙুলের ছাপ মিলবে সেখান থেকে।”

“ঠিক। কিন্তু,” কুসানাগি ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “তাদের মধ্যে প্রণয় আছে বলেই যে হিরোমি ওয়াকাইয়ামাকে সন্দেহ করতে হবে, তেমনটা নয় কিন্তু।”

“জি,” বলে একপাশে গাড়ি থামিয়ে ফোন বের করল উতসুমি, “আমি একটা ফোন করলে কোন সমস্যা হবে?”

“কাকে ফোন দেবে?”

“মিস ওয়াকাইয়ামাকে, আর কাকে?”

কুসানাগি জবাবে কিছু বলার আগে নম্বরগুলো ডায়াল করে কানে ফোন চাপালো উতসুমি। “মিস ওয়াকাইয়ামা? আমি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে উতসুমি বলছি। বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, কিন্তু আপনার আগামীকালের শিডিউল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম…” বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সে, “আচ্ছা, ধন্যবাদ।”

ফোন কেটে দিল উতসুমি।

“কি বলল?” জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“সেরকম কোন কাজ না কি নেই। বাসাতেই থাকবে। সেলাইয়ের স্কুলে যাবে না।”

“হুম,” বলল কুসানাগি।

“আমি কিন্তু আসলে তার শিডিউল জানার জন্যে ফোন দেইনি,” আড়চোখে কুসানাগির দিকে তাকিয়ে বলল উতসুমি।

“তাহলে?”

“কাঁদছিলেন মিস ওয়াকাইয়ামা, লুকোনোর চেষ্টা করেও সক্ষম হননি। অর্থাৎ আমদের দৃষ্টির আড়াল হওয়া মাত্র নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি।”

সিটে সোজা হয়ে বসলো কুসানাগি। “এইজন্যে ফোন দিয়েছিলে? কাঁদছে কি না জানার জন্যে?”

“মানুষ অনেক সময় প্রাথমিক শকের কারণে অপরিচিত লোকের মৃত্যুতেও কাঁদে। কিন্তু ঘটনার এতক্ষণ পর…

“অর্থাৎ জীবনের ‘নিষ্ঠুর অনিশ্চয়তা’ উপলব্ধির কারণে নয়, বরং শুরুতেও মি. মাশিবার জন্যে মন থেকেই কাঁদছিলেন হিরোমি ওয়াকাইয়ামা,” তার হয়ে বাক্যটা শেষ করল কুসানাগি। মুখে হাসি ফুটেছে তার। “ভালো দেখিয়েছো, জুনিয়র ডিটেক্টিভ।”

“ধন্যবাদ, ডিটেক্টিভ কুসানাগি,” উতসুমির ঠোঁটেও হাসি। “জীবনের ‘নিষ্ঠুর অনিশ্চয়তা’–চাইলেই তো সাহিত্যিক হতে পারতেন আপনি!”

*

পরদিন সকাল সাতটায় ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কুসানাগির। চিফ মামিয়া ফোন দিয়েছেন।

“এত সকালে,” রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বলল কুসানাগি।

“বাসায় যে ঘুমোতে পেরেছো সেটার জন্যে শুকরিয়া আদায় করো। মাগুরো পুলিশ স্টেশনে কালকের ঘটনাটা একটা মিটিং আছে। আমরা সবাই সেখানেই যাবো, আজকের রাতটা ওখানে কাটাতে হতে পারে।”

“এটা বলার জন্যে এত সকালে ফোন দিয়েছেন? যাতে মিটিংয়ে যাওয়ার সময় টুথব্রাশ নিয়ে যাই?”

“নাহ। তোমাকে হানেদায় যেতে হবে আজকে।”

“হানেদা? হানেদায় কি আবার?”

“এয়ারপোর্ট! মিসেস মাশিবা স্যাপোরো থেকে ফিরবেন আজ। তাকে সেখান থেকে সরাসরি স্টেশনে নিয়ে আসবে।”

“তিনি নিশ্চয়ই জানেন এ ব্যাপারে?”

“জানা তো উচিত। উতসুমির সাথে যাবে তুমি, তার গাড়িতে। আটটার সময় ল্যান্ড করবে প্লেন।”

“সকাল আটটা!”

ফোন ছেড়ে লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলো কুসানাগি।

তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে এমন সময় বেজে উঠল ফোনটা। ইতোমধ্যেই ওর বাসার সামনে এসে পড়েছে উতসুমি। মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে, জুতো পরে দৌড়ে বাসা থেকে বের হলো কুসানাগি।

উতসুমি গাড়িতে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছিল। কুসানাগি পাজেরোর প্যাসেঞ্জার সিটটায় উঠে বসা মাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল সে।

“আবারও একই কাহিনী। ভিক্টিমের পরিবারের লোকজনের সাথে দেখা করার অভিজ্ঞতাটা কখনোই সুখকর নয়,” সিট বেল্ট লাগিয়ে বলল কুসানাগি।

“চিফ তো বললেন যে এই কাজের জন্যে আপনার চেয়ে ভালো কেউ নেই ডিপার্টমেন্টে।”

“চিফ নিজে এটা বলেছে?”

“বলেছেন যে আপনার চেহারা দেখলেই না কি এক ধরণের ‘প্রশান্তি’ বোধ করে তারা।“

“ওহ,” নাক দিয়ে শব্দ করে বলল কুসানাগি। “অর্থাৎ আমার চেহারায় গর্দভ গর্দভ ভাব আছে।”

আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছালো ওরা। এরাইভাল লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে আয়ানে মাশিবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। একটা কমলা রঙের কোট পরনে থাকার কথা তার, হাতে নীল রঙের স্যুটকেস থাকবে।

“উনিই না কি?” একজনকে এগিয়ে আসতে দেখে ইশারা করল উতসুমি।

কুসানাগিও তাকালো ওদিকে। ওদের কাছে থাকা বর্ণনার সাথে মিলে গিয়েছে মহিলার অবয়ব। দু’চোখে রাজ্যের বিষণ্নতা; তার ব্যক্তিত্বের কিছু একটা নজর কাড়লো কুসানাগির-বাড়তি গাম্ভীর্যটুকুই বোধহয়। “উনিই মিসেস মাশিবা,” নিজের কন্ঠস্বর নিজের কানেই কেন যেন কর্কশ শোনাচ্ছে তার, কথা জড়িয়ে আসছে যেন।

যেন হঠাৎই হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে গলার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও আয়ানে মাশিবার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না। কিন্তু কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *