স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ১১

অধ্যায় ১১

রাত আটটারও কিছু সময় পর হিরোমিকে নিয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে করে বের হলো উতসুমি। খুব বেশি সময় জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে থাকতে হয়নি তাকে। দুই ঘন্টা। চিফ মামিয়ার অবশ্য ইচ্ছে ছিল আরো বেশি সময় আটকে রাখা।

আয়ানে মাশিবার ফোনের কারণেই মূলত ছেড়ে দেয়া হয়েছে হিরোমিকে। কফি বানানোর ব্যাপারে স্বামীর নির্দেশনা কি ছিল, সে সম্পর্কে সবকিছু পরিস্কার জানিয়েছে সে। শুধুমাত্র বোতলের পানিই ব্যবহার করতে হতো। সেক্ষেত্রে খুনি খুব সহজেই আগে থেকে কোন একটা বোতলের পানিতে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে-অর্থাৎ, হিরোমি ওয়াকাইয়ামা কেসের একমাত্র সন্দেহভাজন নয়।

তাছাড়া প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও হিরোমিকে দিয়ে কোন কিছু স্বীকার করাতে পারেনি মাইয়া। দুই ঘন্টা টানা জিজ্ঞাসাবাদ চলে। ক্রন্দনরত হিরোমি বারবার একই কথা বলে যে তার কোন দোষ নেই। শেষ অবধি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মামিয়া। উতসুমিই প্রস্তাব দেয় যে আপাতত তাকে ছেড়ে দেয়া হোক।

এ মুহূর্তে চুপচাপ প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে হিরোমি। নিশ্চয়ই ভীষণ ক্লান্ত-মনে মনে ভাবলো উতসুমি। অনেক শক্ত লোককে ও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভেঙে পড়তে দেখেছে সে। হিরোমির চোখের পানি খুব সহজে শুকোবে বলে মনে হয় না। পুরো রাস্তা নীরবেই পাড়ি দিতে হবে। পুলিশের কারো সাথে যেচে কেন কথা বলবে, সে তো জানে আমরা সন্দেহ করছি তাকে।

হিরোমির মোবাইল ফোন বেজে উঠল এ সময়। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল সে। “হ্যালো?” শান্তস্বরে বলল। “কেবলই বের হলাম। হ্যাঁ, আমাকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে…না, মিস উতসুমি…মেগুরো স্টেশনে না, মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। একটু সময় বেশি লাগবে বাসায় পৌঁছুতে। ঠিক আছে…”

ফোন কেটে দিল সে।

“মিসেস মাশিবা ফোন দিয়েছিলেন?” কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিয়ে অবশেষে জিজ্ঞেস করল উতসুমি।

আয়ানের নাম শুনেই কিছুটা জমে গেল হিরোমি। “হ্যাঁ, কোন সমস্যা হয়েছে?”

“আপনার জিজ্ঞাসাবাদ চলার সময় ডিটেক্টিভ কুসানাগিকে ফোন দিয়েছিলেন তিনি। আপনার ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো।”

“আসলেও উদ্বিগ্ন।”

“মি. মাশিবার সাথে আপনার সম্পর্কের ব্যাপারে তার সাথে কথা বলেছেন?”

“এটা আপনাকে কে বলল?”

“মিসেস মাশিবা ডিটেক্টিভ কুসানাগিকে বলেছেন, আপনাকে যখন আনতে যাওয়া হয়েছিল।”

চুপ হয়ে গেল হিরোমি। আড়চোখে একবার তার দিকে তাকালো উতসুমি। মাথা নিচু করে কোলের ওপর রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কিছু মনে করবেন না,” উসুমি বলল, “কিন্তু ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত নয় কি? এরকম একটা ঘটনার পরেও আপনাদের ঘনিষ্ঠতা কমেনি। অন্য কেউ হলে তো চুলোচুলি লেগে যেত।”

“ও মারা গেছে।”

“তবুও, ব্যাপারটা অদ্ভুত।”

“হতে পারে,” মাথা নেড়ে বলল হিরোমি।

তার নিজের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকছে না, উসুমি বুঝতে পারলো। “আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল,” কিছুক্ষণ পর বলল সে।

“আর কী-ই বা জানার থাকতে পারে আপনার?” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল হিরোমি।

“আমি জানি যে আপনি ভীষণ ক্লান্ত এ মুহূর্তে। তবে এগুলো একদমই সাধারণ কয়েকটা প্রশ্ন। আমি চাই না আপনি এমনি এমনি কোন বিপদে পড়ুন।”

“আমার মনে হয় আমি ইতোমধ্যেই বিপদে পড়ে গেছি। যাইহোক, বলুন কি জানতে চান।“

“রবিবার সকালে তো আপনি আর মি. মাশিবা কফি খেয়েছিলেন, তাই না? কফিটাও আপনি বানিয়েছিলেন?”

“আবার সেই প্রশ্ন?” জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হিরোমি। “আমি কিছুই করিনি। বিষের ব্যাপারেও কিছু জানি না।“

“সে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করছি না আমি, শুধু জানতে চাই, কফিটা কিভাবে বানালেন। আপনার কি মনে আছে, কোত্থেকে পানি নিয়েছিলেন?”

“সরি?” হিরোমি কিছুটা অবাক হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।

“আপনি কি ফ্রিজে রাখা বোতলগুলোর পানি ব্যবহার করেছিলেন না কি ট্যাপ থেকে পানি নিয়েছিলেন?”

“ট্যাপ থেকে,” লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল হিরোমি।

“আপনি নিশ্চিত?”

“হ্যাঁ। এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

“ট্যাপ থেকে পানি নিলেন কেন আপনি?”

“অতকিছু ভেবে ট্যাপ থেকে পানি নেইনি। মনে হয়েছিল, গরম পানি ব্যবহার করলে বেশি তাড়াতাড়ি ফুটবে।”

“কফি বানানোর সময় মি. মাশিবা ছিলেন?”

“হ্যাঁ। এই কথাটা তো আগেও কয়েকবার বলেছি,” প্রচ্ছন্ন বিরক্তি তার জড়ানো কণ্ঠে।

“একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করুন। যখন আপনি কেতলিতে পানি ঢালছিলেন, তখন কি মি. মাশিবা সেখানে ছিলেন?”

তৎক্ষণাৎ কোন জবাব দিল না হিরোমি। উতসুমি জানে, এই প্রশ্নটা আগে কেউ করেনি তাকে।

“ওহ,” কিছুক্ষণ পর বলল হিরোমি। “ঠিক ধরেছেন আপনি। কেতলিটা যখন চুলোতে চাপাই, তখন ও সেখানে ছিল না। আমি কেবলই চুলো ধরিয়েছি সেসময় ভেতরে আসে। দেখতে চায়, কিভাবে কফি বানাচ্ছি।”

“আপনি নিশ্চিত?”

“হ্যাঁ, নিশ্চিত।”

রাস্তার একপাশে গাড়ি থামালো উতসুমি। ইমারজেন্সি লাইট চালু করে হিরোমির দিকে তাকালো।

“কি হয়েছে?” কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বলল হিরোমি।

“আয়ানে আপনাকে শিখিয়েছিল কিভাবে ঐ বাসায় কফি বানাতে হবে, তাই না?”

মাথা নাড়লো হিরোমি।

“কিছুক্ষণ আগে আয়ানে ফোন করে ডিটেক্টিভ কুসানাগিকে বলেছেন যে তার স্বামী ভীষণ স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন, তাই সরাসরি কখনো ট্যাপের পানি খাননি। কফি বানানোর জন্যেও সবসময় বোতলজাত পানি ব্যবহারের নির্দেশ ছিল। এটা কি আপনি জানতেন?”

বিস্ময় ভর করল হিরোমির চোখে। “হ্যাঁ, সেটা বলেছিলেন। কিন্তু সেই সাথে এটাও বলেছিলেন, খুব বেশি না ভাবতে সেটা নিয়ে।”

“তাই?”

“হ্যাঁ। সবসময় বোতলের পানি ব্যবহার করলে খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা। তাছাড়া ঠাণ্ডা পানি ফুটতেও সময় বেশি নেয়। কিন্তু আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, মি. মাশিবা যদি কখনো জিজ্ঞেস করেন, তাহলে যেন বলি, বোতলের পানিই ব্যবহার করেছি,” গালে হাত দিয়ে বলল হিরোমি। “এই কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম।”

“তাহলে আয়ানে নিজেও ট্যাপের পানি ব্যবহার করতেন?”

“মনে হয়,” উতসুমির চোখে চোখ রাখলো হিরোমি। “অন্য ডিটেক্টিভদের সাথে আলাপের সময় এসব বলার কথা মনেই ছিল না।”

হেসে একবার মাথা নাড়লো উতসুমি। “ধন্যবাদ আপনাকে, ইমারজেন্সি লাইট নিভিয়ে আবারো গাড়ি চালু করল উতসুমি।

“দয়া করে বলবেন, একথা কেন জিজ্ঞেস করলেন?” হিরোমি বলল। “ট্যাপের পানি ব্যবহার করে কি কোন ভুল করে ফেলেছি।”

“না, কোন ভুল করেননি। কিন্তু আমরা যেহেতু সন্দেহ করছি যে ইয়োশিতাকা মাশিবাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে, তাই সব খুঁটিনাটি ব্যাপার জানতে হবে।”

“ওহ…” মাথা নিচু করে ফেলল হিরোমি। কিছুক্ষণ পর আবার জুনিয়র ডিটেক্টিভের দিকে তাকালো। “মিস উতসুমি, আমার কথা বিশ্বাস করুন। ওকে মারিনি আমি।”

একবার ঢোঁক গিললো উতসুমি। চোখ রাস্তার দিকে। আরেকটু হলেই বলে ফেলেছিল, আপনার কথা বিশ্বাস করছি আমি। “আপনিই এই কেসের একমাত্র সন্দেহভাজন নন,” কিছুক্ষণ পর বলল। “আসলে এই মুহূর্তে সবাইকেই সন্দেহ করতে হচ্ছে। কেউ যদি আপনাকে বলে থাকে, পুলিশের কাজ অনেক সহজ, তাহলে মিথ্যে বলেছে তারা।”

চুপ হয়ে গেল হিরোমি।

এই উত্তরটা নিশ্চয়ই আশা করছিল না সে।

গাকুগেই ডাইগাকু স্টেশনের কাছে গাড়ি থামালো উতসুমি, হিরোমির অ্যাপার্টমেন্টটা কাছেই। ধীরে ধীরে তাকে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলো সে। এরপর গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে আশেপাশে একবার তাকিয়ে নেমে পড়লো। হিরোমির অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙয়ে ঢোকার কাচের দরজাটার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়ানে মাশিবা।

হিরোমি অবাক হয়ে গেল তাকে দেখে। উতসুমিও অবাক হয়েছে। সান্ত্বনার দৃষ্টিতে শিক্ষানবিশের দিকে তাকালো আয়ানে। কিন্তু পরমুহূর্তেই উতসুমিকে দেখে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল তার। ভ্রু কুঁচকে পেছনের দিকে তাকালো হিরোমি।

“কিছু বলতে ভুলে গিয়েছিলেন?” উতসুমিকে জিজ্ঞেস করল সে। আয়ানেও যোগ দিল ওদের সাথে।

“মি. মাশিবাকে দেখে মনে হলো একটু কথা বলে যাই,” উতসুমি বলল। “মিস হিরোমিকে এতক্ষণ স্টেশনে আটকে রাখার জন্যে দুঃখিত, “ বলে একবার বাউ করল সে।

“সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে হিরোমির নাম বাদ দিয়েছেন তাহলে?”

“সব প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিয়েছেন তিনি,” সরাসরি প্রশ্নটার উত্তর দিল না উতসুমি। “শুনলাম ডিটেক্টিভ কুসানাগিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আপনি। সেজন্যে ধন্যবাদ।”

“আশা করি আপনাদের কাজে আসবে তথ্যগুলো,” আয়ানে বলল। “আপনারা নিশ্চয়ই এখন থেকে আর হিরোমিকে জ্বালাতন করবেন না। ও কিছু করেনি।”

“সেই সিদ্ধান্তটা আমাদেরকেই নিতে দিন নাহয়। আশা করি আগামী দিনগুলোতেও আমাদের সহায়তা করবেন আপনি।”

“খুশিমনেই সহায়তা করবো। কিন্তু হিরোমি বেচারিকে আর এসবের মধ্যে টানবেন না।”

বেশ রুক্ষভাবেই কথাগুলো বলল আয়ানে। সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো উতসুমি। স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর যে মিসেস মাশিবাকে দেখেছিল ওরা, তার সাথে বর্তমানের মিসেস মাশিবার অনেক পার্থক্য।

হিরোমির দিকে ফিরলো আয়ানে। “তোমাকে কিন্তু সত্যিটাই ওনাদের খুলে বলতে হবে। যদি কিছু চেপে যাও, তাহলে নিজেরই ক্ষতি। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে এত লম্বা সময় কাটানোটা উচিত নয় তোমার।

“হিরোমির চেহারা দেখে মনে হলো না, উসুমির সামনে এসব কথা শুনতে তার ভালো লাগছে। হঠাৎই সব পরিস্কার হয়ে গেল উতসুমির কাছে। “আপনি কি ….?”

“এখনই সত্যিটা বলে দেয়া উচিত তোমার,” আয়ানে বলে উঠল ওর কথার মাঝে। “মিস উতসুমি ব্যাপারটা আঁচ করেই ফেলেছেন মনে হচ্ছে…”

“আপনি…মানে…মি. মাশিবা আপনাকে কিছু বলেছিল?” হিরোমি জিজ্ঞেস করল।

“না। কিন্তু আমি একজন নারী। তাছাড়া আমি অতটাও বেখেয়ালী না।”

উপস্থিত তিনজনের কাছেই ব্যাপারটা পরিস্কার। কিন্তু হিরোমির মুখ থেকে কথাটা শুনতে হবে উতসমির।

“মিস ওয়াকাইয়ামা, আপনি কি প্রেগন্যান্ট?”

কিছুক্ষণ জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকলো হিরোমি, এরপর বলল, “দুই মাস হতে চলেছে প্রায়।”

আড়চোখে একবার আয়ানেকে কেঁপে উঠতে দেখলো উতসুমি। সে-ও ব্যাপারটা প্রথমবারের মত শুনছে। মেয়েরা এসব ব্যাপারে আসলেও বেশি সংবেদনশীল।

কিছুক্ষণ পর উতসুমির দিকে তাকালো আয়ানে। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না তার মনে কি চলছে। “আশা করি এবারে আপনি সন্তুষ্ট? হিরোমির নিজের যত্ন নেয়া উচিত। যখন খুশি তখন তাকে ডেকে পাঠানো চলবে না। আপনি নিজেও তো একজন নারী। আশা করি বুঝতে পারছেন পরিস্থিতিটা।”

মাথা নেড়ে সায় জানানো ছাড়া কোন উপায় দেখলো না উতসুমি। গর্ভবতী নারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

“আমি আমার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলবো।”

“দ্রুত বলুন,” বলে হিরোমির দিকে তাকালো আয়ানে। এতে তোমারই মঙ্গল হলো। ব্যাপারটা চেপে গেলে হাসপাতালেও যেতে পারতে না ঠিকমতো।”

মৃদু মৃদু কাঁপছে হিরোমির ঠোঁটজোড়া। যেন যে কোন মুহূর্তে কান্না জুড়ে দেবে। জড়ানো কণ্ঠে কিছু একটা বলল সে আয়ানের উদ্দেশ্যে। ‘ধন্যবাদ’ গোছের কিছু একটা

“আরেকটা ব্যাপারে পরিস্কার হয়ে যাওয়া ভালো,” জুনিয়র ডিটেক্টিভের দিকে তাকিয়ে বলল আয়ানে। “হিরোমির সন্তানের বাবা ইয়োশিতাকা মাশিবা। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এই ঘটনার কারণেই আমাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল ও। এখন আপনাকে একটা প্রশ্ন করি-নিজের পেটে যে সন্তান বড় হচ্ছে, সেই সন্তানের পিতাকে কেন হত্যা করতে চাইবে কেউ?”

আয়ানের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু জোর করে মুখ বন্ধ রাখলো উতসুমি। এতে হিতে বিপরীত হলেও কিছু করার নেই।

বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো আয়ানে। “আপনাদের মাথায় যে কী ঘুরছে সেটা একটা রহস্য আমার কাছে। যদি মোটিভের কথাই বলেন, তাহলে ইয়োশিতাকাকে হত্যা করার কোন মোটিভই নেই হিরোমির। যদি কারো কোন মোটিভ থেকে থাকে, তাহলে সেটা আমি।”

*

হেডকোয়ার্টারে ফিরে কুসানাগি আর মামিয়াকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখলো উতসুমি। ভেন্ডিং মেশিনের কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল দু’জনে।

“কফি বানানোর পানির ব্যাপারে কি বললেন মিস ওয়াকাইয়ামা? তুমি তো তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছো, তাই না?” উতসুমিকে দেখে জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

“ট্যাপের পানিই ব্যবহার করেছিলেন।” রবিবার সকালে কফি বানানোর ব্যাপারে যা যা বলেছে হিরোমি, সব খুলে বলল উতসুমি।

“এজন্যেই তারা যখন একসাথে কফি খেয়েছিল, কিছু হয়নি কারো,” মামিয়া বলল। “বিষ মেশানো পানি তখনও ফ্রিজেই ছিল বোধহয়।”

“সে যে সত্যি কথা বলছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়,” কুসানাগি বলল।

“সেটা ঠিক, কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত তার বক্তব্যে বড়সড় কোন অসঙ্গতি ধরা পড়ছে, মুখের কথাতেই বিশ্বাস করতে হবে আমাদের। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট থেকে আশা করি শিঘ্রই আরো কিছু জানতে পারবো।”

“প্লাস্টিকের বোতলগুলোর ব্যাপারে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন?” উতসুমি জানতে চাইলো।

টেবিলে রাখা একটা রিপোর্ট তুলে নিয়ে সেটায় চোখ বোলালো কুসানাগি। “মাশিবাদের ফ্রিজে কেবল একটা পানির বোতল পায় ওরা। ক্যাপের সিল খোলা ছিল। ভেতরের পানিতে কোন বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।”

“ঠিক আছে,” উতসুমি বলল। “তাহলে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে আর কি জানার অপেক্ষায় আছেন?”

“একটু জটিল ব্যাপারটা,” ক্রজোড়া কুঁচকে বলল মামিয়া।

“তাই?”

“এক লিটারের একটা বোতল ছিল ফ্রিজে,” রিপোর্টের দিকে তাকিয়েই বলল কুসানাগি। “ওর মধ্যে নয়শো মিলিলিটার পানি তল্লাশির সময়ে পায় ফরেনসিকের লোকেরা। অর্থায় একশো মিলিলিটার খরচ করা হয়েছিল। এক কাপ কফির জন্যেও যথেষ্ট নয় ওটুকু। কিন্তু কফি মেশিনের ডিপারে দুইজনের উপযোগী বিন পাওয়া গিয়েছে।”

“অর্থাৎ আরো একটা বোতল ছিল ফ্রিজে? যেটা পাওয়া যাচ্ছে না?” উতসুমি জিজ্ঞেস করল।

মাথা নাড়লো কুসানাগি। “সেটাই তো মনে হচ্ছে।”

“আর সেই পানিতেই বিষ ছিল?”

“সবকিছু তো সেটাই ইঙ্গিত করছে,” মামিয়া বলল। “খুনি ফ্রিজ খুলে দেখে যে দু’টা বোতল সেখানে। একটার সিল খোলা, আরেকটা সিল তখনও অক্ষুন্ন। এখন সে যদি অব্যবহৃত বোতলের পানিতে বিষ মেশায়, তাহলে ভিক্টিম সাবধান হয়ে যেতে পারে। তাই সিল খোলা বোতলটার পানিতেই বিষ মেশানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে। এদিকে মাশিবা যখন কফি

বানাতে যায়, ফ্রিজ খুলে ব্যবহৃত বোতলটাই বের করে প্রথমে। যখন দেখে যে পানি একটু কম হয়েছে তখন অন্য বোতল থেকে কিছুটা ঢেলে নিয়ে আবার আগের জায়গায় রেখে দেয়।”

“ময়লা ফেলার জায়গায় ব্যবহৃত বোতল খুঁজতে হবে তাহলে।

“ইতোমধ্যে খোঁজা হয়েছে,” কুসানাগি বলল। “যতগুলো খালি বোতল পেয়েছিল সবগুলো সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে হয়েছে। কোনটায় বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত নয় তারা।“

“মানে?”

“অনেকগুলো বোতলে পরীক্ষা করার মত যথেষ্ট পরিমাণে পানিই পাওয়া যায়নি। খালি বোতলে আর কতটুকুই বা পানি থাকে। অন্য একটা ল্যাবে পাঠানো হয়েছে ওগুলো।”

মাথা নাড়লো উতসুমি। এই জন্যেই মামিয়া আর কুসানাগি দু’জনে এরকম মুখ করে বসে আছে।

“বোতলগুলোর একটাতে বিষের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেই যে খুব বড় কিছু হয়ে যাবে, তা নয়,” কুসানাগি বলল। “কেসের এখন যা অবস্থা…” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো সে।

“সন্দেহভাজনের তালিকায় আরো কিছু নাম যোগ হতে পারে তখন।”

“চিফ কি বলল বুঝতে পারোনি? খুনি যদি বোতলের পানিতে বিষ মিশিয়ে থাকে, তাহলে সে খোলা বোতলটার পানিতে বিষ মিশিয়েছিল। অর্থাৎ কফি বানানোর আগ পর্যন্ত সেই বোতলে হাত দেয়নি ভিক্টিম। এতে কী বোঝা যাচ্ছে? বিষ মেশানো এবং ভিক্টিমের সেই পানি ব্যবহারের মধ্যে সময়ের পার্থক্য খুব একটা বেশি না।”

“আমি বুঝতে পারছি না। বোতলের পানি না ব্যবহার করার সাথে খুব সময় অতিবাহিত না হওয়ার কি সম্পর্ক? হয়তো অন্য পানি ব্যবহার করেছে।

“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো, শুধু রবিবার রাতেই নয়, শনিবার রাতেও নিজেই কফি বানিয়েছিলেন মি. মাশিবা,” কুসানাগি বলল। “মিস ওয়াকাইয়ামা আমাদের জানিয়েছেন, শনিবার রাতে নিজেই কফি তৈরি করেন ইয়োশিতাকা। কিন্তু খুব বেশি কড়া হয়ে যাওয়াতে পরদিন সকালে সে তাকে দেখিয়ে দেয়, কিভাবে বানাতে হবে। অর্থাৎ শনিবার রাত অবধি বিষ মেশানো পানির বোতল ব্যবহৃত হয়নি।

“আমরা এটা কিভাবে নিশ্চিত হলাম যে শনিবার রাতে কফি বানানোর জন্যে বোতলের পানিই ব্যবহার করেছিলেন মি. মাশিবা?”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো কুসানাগি। “তুমি কি আমাদের এই কথাটা বিবেচনা থেকে বাদ দিয়ে দিতে বলছো, মি. মাশিবা সবসময় কফি বানানোর ক্ষেত্রে বোতলের পানিই ব্যবহার করতেন? তার স্ত্রী এব্যাপারে আমাদের জানানোর পরই কেসের অগ্রগতি হয়েছে।”

“বিবেচনা থেকে বাদ দিতে তো বলিনি,” নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল উতসুমি। “শুধু এটুকু বলছি, তার কথা বেদবাক্যের মত বিশ্বাস না করতে। আমরা কিন্তু এ ব্যাপারে কোন তথ্য জানি না, মি. মাশিবা আসলেও সবসময় বোতলের পানি ব্যবহার করতেন কি না। হয়তো মাঝে-সাঝে ট্যাপের পানিও ব্যবহার করতেন বেশি ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে। তাছাড়া আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে দীর্ঘদিন পর শনিবারই প্রথম নিজে কফি বানাতে গিয়েছিল সে। তাদের সিঙ্কের ট্যাপে কিন্তু ফিলট্রেশন সিস্টেম যুক্ত আছে।”

মাথা ঝাঁকালো কুসানাগি। “নিজের সুবিধার জন্যে বাস্তবকে খুব বেশি পরিবর্তন করলে কিন্তু পরবর্তীতে বিপদে পড়ে যাবে, ডিটেক্টিভ।”

“আপনি আমার কথা অন্যভাবে নিচ্ছেন। আমি শুধু এটুকুই অনুরোধ করবো, আমাদের চোখের সামনে যে আলামতগুলো আছে সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়েই যেন তদন্ত সামনে এগোয়,” বলে মামিয়ার দিকে ঘুরলো উতসুমি। “আমরা যতক্ষণ অবধি জানতে পারছি না যে শেষবার কে বোতলের পানি ব্যবহার করছিল, এটাও নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে বিষ কখন মেশানো হয়েছিল।”

হাসলো মামিয়া। “এ ধরণের বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা ভালো লাগে আমার,” বলল সে। “প্রথমে আমি কুসানাগির পক্ষেই ছিলাম। কিন্তু এখন এই বিতর্ক শুনে মনে হচ্ছে উতসুমিও খুব একটা ভুল বলেনি।”

“চিফ!” স্পষ্টতই হতাশা ফুটলো কুসানাগির চেহারায়।

“যাইহোক,” মুহূর্তে বদলে গেল মামিয়ার কন্ঠস্বর। “বিষ মেশানোর সময় নিয়ে অন্ধকারে নেই আমরা,” উতসুমির উদ্দেশ্যে দৃঢ়কণ্ঠে বলল সে। “মাশিবাদের বাসায় শুক্রবার রাতে যে দাওয়াত ছিল, সেটা তো জানো?”

“হ্যাঁ,” উতসুমি বলল। “তখন নিশ্চয়ই অনেকেই বোতলের পানি খেয়েছে-“

হাত উঁচিয়ে তাকে থামালো মামিয়া। “অর্থাৎ দাওয়াত শেষ হবার পরে বিষ মেশানো হয়েছে, কিংবা দাওয়াত চলাকালীন সময়ে।”

“হ্যাঁ। তবে আমার মনে হয় না, ইকাইদের কারো বোতলে কিছু মেশানোর সুযোগ ছিল। তারা মেহমান, রান্নাঘরে তাদের যাওয়ারই কথা না। চুপচাপ বিষ মেশানো তো দূরের কথা।”

“অর্থাৎ সেদিন সেখানে উপস্থিত অন্য দুই নারীই প্রধান সন্দেহভাজন।”

“দাঁড়ান,” কুসানাগি বলল এবারে, “হিরোমি ওয়াকাইয়ামাকে সন্দেহ করছেন, ঠিক আছে। কিন্তু মিসেস মাশিবা? তিনিই তো আমাদের বললেন, ভিক্টিম কফি খাওয়ার জন্যে বোতলের পানি ব্যবহার করেন। নিজে ফেঁসে যেতে পারেন এরকম একটা তথ্য তিনি কেন আমাদের দেবেন?”

“কারণ তিনি জানতেন যে সত্যটা এক সময় আমরা বুঝতে পারবো?” উতসুমি পাল্টা প্রশ্নের সুরে বলল। “তিনি যদি এটা অনুমান করেন যে ফরেনসিকের লোকেরা বোতলের পানিতে বিষের অস্তিত্ব খুঁজে পাবে এবং আগেই আমাদের এ ব্যাপারে বলে দেন, সন্দেহের তালিকা থেকে স্বভাবতই তার নাম বাদ দেয়া হবে।”

“তোমার সাথে কথা বললে মাথা ধরে যায় মাঝে মাঝে,” বিরক্ত কণ্ঠে বলল কুসানাগি। “কেন মিসেস মাশিবা দোষী সাব্যস্ত করার পেছনে উঠে পড়ে লেগেছো?”

“ও কিন্তু ভুল কথা বলেনি,” মামিয়া বলল, “বরং উতসুমিই হয়তো ঠিক পথে এগোচ্ছে। হিরোমি ওয়াকাইয়ামা যে খুন করেননি, সেই দাবির স্বপক্ষেও কিন্তু শক্ত যুক্তি আছে। চুলা থেকে কেতলিটা সরিয়ে রাখা হলো না কেন? তাছাড়া মি. মাশিবাকে খুন করার সবচেয়ে বড় মোটিভটা কিন্তু আয়ানে মাশিবারই।“

প্রতিবাদে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কুসানাগি। কিন্তু তার আগেই হাত তুলে তাকে থামালো উতসুমি। “মোটিভের কথা যখন উঠলই, আমার কাছে একটা নতুন তথ্য আছে। এতে মিসেস মাশিবার প্রতি সন্দেহের পরিমাণ বাড়বে বৈ কমবে না।”

“কার ব্যাপারে তথ্য?” মামিয়া জিজ্ঞেস করল।

“হিরোমি ওয়াকাইয়ামা।”

উতসুমির কথাগুলো শুনে বিস্ময়ে মুখের নকশাই বদলে গেল অপর দু’জনের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *