স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ২৮

অধ্যায় ২৮

কুসানাগি ভেতরে এসে বসার সাথে সাথে ইকাইয়ের সাথে তার কী কথা হয়েছে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল ইউকাওয়া। কিছুক্ষণ ইতস্ততবোধ করে সবকিছু খুলে বলল সিনিয়র ডিটেক্টিভ।

“ইয়োশিতাকা মাশিবা প্রথমে কথা বলে আয়ানের সাথে। তোমার থিওরির সাথে এটা সাংঘর্ষিক, উতসুমি, “ কুসানাগি বলল। “মানে, তুমি যে বলেছিলে আয়ানে আগে থেকেই জানতো সেখানে যাবে মি. মাশিবা, সেটার কথা বলছি।”

“থিওরি ঠিক না, আমি একটা সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম।”

“বেশ। সেই সম্ভাবনাটা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। তাহলে এখন কি বলার আছে তোমার?” সরাসরি জুনিয়র ডিটেক্টিভের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল কুসানাগি।

এক কাপ কফি কুসানাগির দিকে এগিয়ে দিল ইউকাওয়া। ওটা হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানালো সে।

“উতসুমির কথা ছাড়ো। তোমার কী বলার আছে সেটা শুনতে চাচ্ছিলাম,” বন্ধুকে বলল ইউকাওয়া। “আমরা যদি মি. ইকাইয়ের কথা সত্য বলে ধরে নেই, তাহলে ওনাদের প্রথমবার পার্টিতেই দেখা হয়েছিল। অর্থাৎ গোটা ব্যাপারটাই কাকতালীয়। তুমি কি এটাই মেনে নিচ্ছো?”

কাপে চুমুক দিল কুসানাগি। মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে তার। একবার কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলেও বন্ধ করে নিল। বুঝতে পারছে না যে কি বলবে।

“অর্থাৎ আইনজীবী ভদ্রলোকের কথা বিশ্বাস হয়নি তোমার?” হেসে বলল ইউকাওয়া।

“এমন নয় যে মি. ইকাই মিথ্যে বলছেন,” অবশেষে বলল কুসানাগি। “কিন্তু তিনি যা দেখেছেন সেটা সত্য কি না তা প্রমাণের কোন উপায় নেই।”

“বলতে থাকো।”

“পুরোটাই অভিনয় হতে পারে,” লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল কুসানাগি।

“অভিনয়?”

“হ্যাঁ, এতে আশপাশে উপস্থিত সবার মনে হবে যে সেখানেই প্রথম দেখা হয়েছে দু’জনের। ফলে তাদের যে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল তাও ধরতে পারবে না কেউ। ইকাইকে ইচ্ছেকৃতভাবে সাথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যাতে সে এই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে থাকতে পারে। একটা মোবাইল ফোনের কভার সম্পর্কে মন্তব্য করার পর দু’জন দু’জনার প্রেমে পড়ে যাবে, এটা বিশ্বাস করাটা একটু শক্ত বৈকি।”

“ঠিক বলেছো,” চকচক করছে ইউকাওয়ার চোখজোড়া। “এবার দেখা যাক উতসুমির কি ধারণা,” বলল সে।

মাথা নেড়ে সায় জানালো জুনিয়র ডিটেক্টিভ। “যুক্তি আছে কথায়। কিন্তু এত ঝামেলার দরকার কি ছিল?”

“এটাই তো প্রশ্ন। কেন এই অভিনয়?” বলে কুসানাগির দিকে তাকালো ইউকাওয়া। “তোমার কি মনে হয়?”

“সত্যটা লুকানোর চেষ্টা করছিল তারা, এই তো।”

“কোন সত্যটা?”

“আসলে তাদের কিভাবে পরিচয় হয়েছিল সেটা। নিশ্চয়ই জুঞ্জি সুকুই দেখা করিয়ে দিয়েছিল দু’জনের। এটাই লুকোতে চেয়েছে। চায়নি কেউ জানুক যে মৃত বান্ধবীর প্রেমিকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে আয়ানে। সেজন্যেই নতুন করে পরিচয় হবার নাটকের অবতারণা।”

“বুদ্ধিটা দারুণ কিন্তু,” শব্দ করে আঙুল ফুটিয়ে বলল ইউকাওয়া। “কারো মনে সন্দেহ কাজ করবে না। তাদের দেখা কিভাবে হয়েছিল সেটা নিয়ে কথা বলা যাক। কখন একে অপরের প্রেমে পড়েছিল দু’জনে? সুকুইয়ের আত্মহত্যার আগে না পরে?”

“আপনার কি ধারণা, মি. মাশিবার সাথে আয়ানের সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে আত্মহত্যা করেছিলেন মিস সুকুই?” চেয়ারে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল উতসুমি।

“তেমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। চিন্তা করে দেখো ব্যাপারটা, খুব কাছের দু’জন মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা। কাছের বন্ধুরাও কিন্তু ভালোবাসার মানুষের মতনই মন ভাঙার কারণ হতে পারে।”

যতই সময় গড়াচ্ছে, বুকের ওপর জড়ো হওয়ার পাথরের সংখ্যা বাড়ছে কুসানাগির। ইউকাওয়া যা বলছে তা আসলেও সম্ভব। ইকাইয়ের সাথে কথা বলার সময় তার নিজেরও এই কথাটা মনে হয়েছিল।

“তাহলে আর পার্টির নাটকটার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকবে না,” উতসুমি বলল। “কেউ যদি পরবর্তীতে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতোও, স্রেফ অস্বীকার করতো তারা। আর মি. ইকাই তাদের হয়ে সাফাই গাইতো।”

“দেখলেন? এবারে আসল সত্যের দিকে এগোচ্ছি আমরা,” সন্তুষ্টচিত্তে বলল ইউকাওয়া।

“মিসেস মাশিবাকে কি এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবো?” কুসানাগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল উতসুমি।

“কোন ব্যাপারে?”

“তাকে যদি মিস সুকুইয়ের বইয়ের ছবিটা দেখাই, তাহলে তো সে স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে একে অপরকে চিনতো তারা।”

“মানা করে দিলেও আমাদের কিছু বলার থাকবে না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কুসানাগি।

“কিন্তু…”

“ইয়োশিতাকার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারটা চেপে গিয়েছে সে। এমনকি দাবি করেছে যে, মি. মাশিবার প্রাক্তনদের ব্যাপারে কিছুই জানে না। এখন যদি তার সামনে এই ছবির বই নিয়ে যাই, মনে হয় না নিজের অবস্থান থেকে টলবে সে। বরং আমরা যে সত্যের কাছাকাছি চলে এসেছি, এটা সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যাবে।”

“কুসানাগির সাথে একমত আমি,” দাবার একটা কালো গুটি হাতে তুলে নিয়ে বলল ইউকাওয়া। “যদি চেকমেটের লক্ষ্য থাকে আপনাদের, তাহলে কোনভাবেই তাকে সাবধান হতে যাওয়া যাবে না।”

ডিটেক্টিভ গ্যালিলিওর চোখে চোখ রাখলো কুসানাগি। “তাহলে সে-ই কাজটা করেছে?”

দাবার বোর্ড থেকে চোখ সরালো না ইউকাওয়া। “এই অংশটুকুই সবচেয়ে জরুরি। আমরা এখন মিসেস মাশিবার অতীত সম্পর্কে জানি। কিন্তু কেসের সাথে কিভাবে সবকিছুর সমন্বয় করবে? একমাত্র ঐ আর্সেনাস এসিডের ব্যাপারটা দিয়ে?”

“হয়তো এটাই একমাত্র যোগসূত্র,” উতসুমি বলল ভাবুক কণ্ঠে। “তাদের দু’জনের সম্পর্কের কারণে মিস সুকুই আত্মহত্যা করেছে। তা সত্ত্বেও ইয়োশিতাকা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন আয়ানের সাথে, হিরোমি ওয়াকাইয়ামার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে। আর সেকারণেই তাকে ক্ষমা করা সম্ভব হয়নি মিসেস মাশিবার।“

“সেটা হতে পারে,” মাথা নেড়ে বলল ইউকাওয়া।

“নাহ, এভাবে ভাবেনি সে,” কুসানাগি বলল। “বান্ধবীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার প্রেমিককে ছিনিয়ে নিয়েছিল আয়ানে-ঠিক যেভাবে মিস হিরোমি ইয়োশিতাকাকে ছিনিয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে।“

“ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বোধহয় একেই বলে?” ইউকাওয়া জিজ্ঞেস করল। “মানে তুমি বলতে চাচ্ছো স্বামী কিংবা তার প্রেমিকার ওপর কোন রাগ ছিল না তার?”

“ঠিক সেটা না… আসলে বোঝাতে পারছি না।”

“তোমাদের দু’জনকেই একটা প্রশ্ন করতে চাই আমি,” দাবার বোর্ড থেকে মাথা তুলে বলল প্রফেসর। “জুঞ্জি সুকুইকে ছেড়ে কেন আয়ানের কাছে এসেছিল মি. মাশিবা?”

“জানি না,” উতসুমি বলল। “ হয়তো, মন উঠে গিয়ে—” বাক্যটা পুরোপুরি শেষ করল না সে। কিছুক্ষণ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ইউকাওয়ার দিকে, “না, আসলে অন্য একটা কারণ ছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ,” কুসানাগি বলল পাশ থেকে। “বাচ্চা হয়নি দেখে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল ইয়োশিতাকা। মি. ইকাই কি বলেছিলেন, ভুলে গেছো? তার বাচ্চার মা হতে সক্ষম এমন যে কাউকে বিয়ে করতে রাজি ছিল মি. মাশিবা। যদি দেখা যেত কোন কারণে বাচ্চা নিতে রাজি হচ্ছে না তার প্রেমিকা বা বাচ্চাধারণে অক্ষম সে, তখন তাকে ছেড়ে দিতেও কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করতো না।”

“আমরা এতক্ষণ যে সম্ভাবনাগুলো নিয়ে কথা বললাম, সবগুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে কুসানাগির কথা,” একমত প্রকাশ করে বলল ইউকাওয়া। “এখন প্রশ্ন হচ্ছে আয়ানে কারণটা জানতো কি না বিয়ের আগে। ইয়োশিতাকা যে বাচ্চা নেয়ার লক্ষ্যে তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে এটা বুঝতে পেরেছিল সে?”

“তা বলা মুশকিল…” মাথা চুলকে বলল কুসানাগি।

“আমার মনে হয় না বুঝতে পেরেছিলেন,” উতসুমি বলল। “কোন নারী নিশ্চয়ই এটা চাইবে না, এরকম একটা কারণে তাকে বেছে নিক কেউ। আর যদি বুঝেও থাকেন, তবে সেটা বিয়ের ঠিক আগ দিয়ে। ততদিনে তাদের মধ্যে এই চুক্তি হয়ে গিয়েছিল যে বিয়ের এক বছরের মধ্যে যদি বাচ্চা না হয়, তাহলে আলাদা হয়ে যাবে।”

“আমারও সেটাই ধারণা,” ইউকাওয়া বলল। “মোটিভ নিয়ে আবারো কথা বলা যাক তাহলে। আপনি বলছিলেন, মি. মাশিবার বিশ্বাসঘাতকতাই সবচেয়ে বড় মোটিভ। কিন্তু আসলেও কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সে? এক বছর পর কিন্তু আসলেও গর্ভধারণে সক্ষম হয়নি মিসেস মাশিবা, তাই অন্য একজন জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছিল। এমনটাই তো চুক্তি ছিল।”

“সেটা সত্যি; কিন্তু কারো পক্ষে কি এটা আসলেও মেনে নেয়া সম্ভব?” হাসলো ইউকাওয়া। “একটু অন্যভাবে বলি কথাটা। যদি আমরা ধরে নেই যে আয়ানেই খুনটা করেছে, তাহলে এটাও মেনে নিতে হবে যে ইয়োশিতাকার দেয়া শর্তটা মানতে কখনোই রাজি ছিল না সে। আর এটাই তার আসল মোটিভ।”

“সেটা বলতে পারেন।”

“কি বোঝাতে চাচ্ছো তুমি?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল।

“বিয়ের ঠিক আগ দিয়ে আয়ানের মনে কি চলছিল সেটা কল্পনার চেষ্টা করো। ইয়োশিতাকার চুক্তিতে রাজি হয় সে। তাহলে কি সে ধরেই নিয়েছিল যে এক বছরের মধ্যে যে কোন সময়ে প্রেগন্যান্ট হতে পারবে? না কি এটা ভেবেছিল যে এই এক বছরে তার স্বামী সরে আসবে শর্তটা থেকে?”

“আমার মতে দুটোই,” উতসুমি বলল।

“ঠিক আছে। তাহলে এবার এই প্রশ্নের উত্তর দিনঃ আয়ানে যদি এটা ভেবেই থাকে যে এক বছরের মধ্যে গর্ভধারণে সক্ষম হবে সে, তাহলে কি একবারও হাসপাতালে যাবে না?”

“হাসপাতাল?” ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল উতসুমির।

“আপনার ভাষ্যমতে, বিয়ের পরবর্তী একবছরে কোনরকম বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যায়নি আয়ানে। কিন্তু যে দম্পতি বিয়ের আগে এরকম একটা চুক্তি করেছে, তাদের তো অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করলে তো বলবো যে বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই গাইনোকলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিত ছিল মাশিবাদের।

“হিরোমি ওয়াকাইয়ামাকে আয়ানে বলে যে তারা কোনরকম চিকিৎসা করায়নি, কারণ এসবে সময় অনেক বেশি লাগে।”

“এটা নিশ্চয়ই মি. মাশিবার কথা। ইচ্ছে করলেই তো অন্য একজনকে বিয়ে করতে পারবে সে, তাহলে চিকিৎসা করে টাকা নষ্ট করার কি মানে? কিন্তু আয়ানের মনে কি চলছিল? সে-ও কি কোন প্রকার চেষ্টা করবে না?”

“করার তো কথা,” বিড়বিড় করে বলল কুসানাগি।

“তাহলে সে হাসপাতালে যায়নি কেন? এই প্রশ্নের উত্তরেই কেসের সমাধান লুকিয়ে আছে,” এক আঙুল দিয়ে চশমা ঠিক করে বলল ইউকাওয়া। “চিন্তা করে দেখো। সময় ছিল তার কাছে। টাকাও ছিল। তাহলে কেন গেল না?”

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগলো কুসানাগি। আয়ানের জায়গাকে নিজেকে কল্পনা করল, কিন্তু কোন উত্তর মাথায় এলো না।

“হয়তো সে জানতো যে কোন লাভ হবে না,” হঠাৎই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল উতসুমি।

“লাভ হবে না? মানে?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল।

“চিকিৎসায় কোন ফল পাবে না, এটা জানাই ছিল তার।“

“ঠিক ধরেছেন!” ইউকাওয়া বলল। “মিসেস মাশিবা জানতো যে হাসপাতালে গিয়ে কোনই লাভ হবে না তার। সেজন্যেই যায়নি। এটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা।”

“অর্থাৎ…..সে জানতো যে কখনোই বাচ্চা হবে না তার,” উতসুমি বলল।

“তার বয়স ত্রিশের বেশি। এর মধ্যে একবার হলেও নিশ্চয়ই গাইনি পরীক্ষা করাতে হয়েছে। হয়তো আগেই তাকে বলে দেয়া হয়েছিল যে কখনো মা হতে পারবে না সে। আর সেটাই যদি হয়, তাহলে হাসপাতালে গিয়ে কোন লাভ হতো না। বরং ইয়োশিতাকার কাছে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল।”

“দাঁড়াও!” হাত উঁচিয়ে বন্ধুকে থামালো কুসানাগি। “তুমি বলতে চাচ্ছো যে ভবিষ্যৎ নিয়ে জুয়া খেলেছিল সে? এটা জানা সত্ত্বেও যে তার কখনো বাচ্চা হবে না?”

“হ্যাঁ, এটাই বোঝাতে চেয়েছি। তার একমাত্র আশা ছিল যে বিয়ের পর হয়তো চুক্তির কথা আর মাথায় থাকবে না ইয়োশিতাকার। কিন্তু তেমনটা যে হয়নি, তা আমরা সবাই জানি। সেজন্যেই তাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। এখন একটা প্রশ্নের জবাব দাও, প্রথম কখন ইয়োশিতাকা মাশিবাকে হত্যা করার পরিকল্পনাটা মাথায় আসে তার?”

“যখন সে হিরোমি ওয়াকাইয়ামার সাথে স্বামীর সম্পর্কের–“

“না!” কুসানাগি কথা শেষ করার আগেই বলে ওঠে উতসুমি। “ইয়োশিতাকা তার শর্তে অটল থাকলে তাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় আয়ানে। আর সেরকমটা হলে বলতে হবে যে শর্তে রাজি হবার সময়েই পরিকল্পনাটা করে সে।”

“এই উত্তরটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ ধরে,” ইউকাওয়া বলল, হঠাৎই এক ধরণের বিষণ্নতা ভর করল তার চেহারায়। “আয়ানে আসলে আগেই বুঝতে পেরেছিল যে এক বছর পর এমন একটা সময় আসবে যখন ইয়োশিতাকা মাশিবাকে খুন করতে হতে পারে তাকে। সেজন্যেই আগে থেকে খুনের প্রস্তুতি সেরে রাখা সম্ভব হয়েছে তার পক্ষে।”

“কি বললে? খুনের প্রস্তুতি?” কুসানাগির চোখজোড়া যেন কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে।

উতসুমির দিকে তাকালো ইউকাওয়া। “আপনি বলেছেন যে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞদের ধারণা কেবলমাত্র একটা উপায়েই ফিল্টারের ওখানে বিষ মেশানো সম্ভব। পাইপটা খুলে নিয়ে ভেতরে বিষ ছিটিয়ে আবারো আগের জায়গা লাগিয়ে দিতে হবে, তাই না? আসলে একদম ঠিক বলেছে তারা। সেরকমটাই ঘটেছিল…এক বছর আগে।”

“অসম্ভব,” বলেই চুপ হয়ে গেল কুসানাগি।

মাথা ঝাঁকালো উতসুমি। “কিন্তু তেমনটা হলে তো ফিল্টারটা ব্যবহার করা যাবে না।”

“ঠিক বলেছেন। এক বছর ফিল্টার ব্যবহার করেনি সে।”

“কিন্তু টেস্টে তো দেখা গেছে যে ফিল্টারের ভেতরে ঠিকই ময়লা জমা হয়েছে, ব্যবহারের কারণে।”

“ময়লাটুকু আসলে গত বছরের নয়, বরং আরো আগের,” বলে ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করল ইউকাওয়া। “আপনাকে আমি ফিল্টারের ভেতরের অংশের সিরিয়াল নম্বর নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম না? প্রস্তুতকারকের অফিসে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম এই সিরিয়ালের প্রোডাক্ট কবে বাজারে ছাড়া হয়। সেখান থেকে বলা হয় যে সিরিয়াল

নম্বরটা দুই বছর আগের। এক বছর আগে সেটা কোনভাবেই বাজারে থাকার কথা না। অর্থাৎ এক বছর আগে যখন ফিল্টার বদলানো হয়, এর পরপরই খুনি সেটা বদলে আবারো পুরনো ফিল্টারটা লাগিয়ে দেয়। কারণ তদন্তের সময় যদি এটা বেরিয়ে আসে যে এক বছর ফিল্টারটা ব্যবহার করা হয়নি, তখন স্বভাবতই সন্দেহ জাগবে মনে। আর ভেতরের পাইপে তখনই বিষ ছিটিয়ে রাখে সে।”

“অসম্ভব,” ফিসফিসিয়ে বলল কুসানাগি। “এটা স্রেফ অসম্ভব। তুমি বলতে চাইছো যে বিষ ছিটিয়ে দেয়ার পর এক বছর ফিল্টারটা ব্যবহার করেনি আয়ানে মাশিবা? একবারের জন্যেও না? এটা কি করে সম্ভব? যদি অন্য কেউ ফিল্টার থেকে পানি নেয়? সেই বিপদ থাকবে না?”

“অবশ্যই থাকবে,” ঠাণ্ডা স্বরে বলল ইউকাওয়া। “কিন্তু অসাধ্যই সাধন করেছে সে। পুরো একটা বছর, যখন স্বামী বাসায় ছিল তার, কখনো বাইরে যায়নি। কাউকে রান্নাঘরের ফিলট্রেশন সিস্টেমের কাছেও ঘেঁষতে দেয়নি। যখন তাদের বাসায় কাউকে দাওয়াত দেয়া হতো, তখন নিজেই সব রান্না করতো সে। আর ফ্রিজে সবসময় মিনারেল ওয়াটার মজুদ থাকতো পর্যাপ্ত পরিমাণে। এসবই পরিকল্পনার অংশ।”

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগলো কুসানাগি। “আমি বিশ্বাস করি না। এটা অসম্ভব, ইউকাওয়া। মানে কিভাবে…?”

“আসলে, সম্ভব,” উতসুমি বলল। “প্রফেসর আমাকে দিয়ে মাশিবাদের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করিয়েছেন। মিস ওয়াকাইয়ামার সাথে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছি আমি। তখন বুঝতে পারিনি এসব প্রশ্নের কারণ, কিন্তু এখন সব পরিস্কার। আপনি আসলে জানতে চাইছিলেন, মিসেস মাশিবা বাদে অন্য কারো ফিলট্রেশন সিস্টেমটা ব্যবহার করা সম্ভব কি না, তাই না?”

“হ্যাঁ। মাশিবারা ছুটির দিনগুলো কিভাবে কাটাতো, সেটা শোনার পর সব সন্দেহ দূর হয়ে গেছে আমার। লিভিং রুমের সোফায় বসে সারাদিন সেলাইয়ের কাজ করতো আয়ানে। ঐ রুমটাই বেছে নিয়েছিল কেন সে? যাতে রান্নাঘরে নজর রাখতে পারে।”

পাগল হয়ে গেছ তুমি,” দূর্বল কন্ঠে বলল কুসানাগি।

“এটাই একমাত্র উত্তর আসলে। আমাদের খুনির মনের জোর অসম্ভব রকমের আর তার জেদও প্রচণ্ড।”

বিড়বিড় করে বারবার ‘অসম্ভব’ বলছে আর মাথা নাড়ছে কুসানাগি। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে যে সত্য কথাই বলছে ইউকাওয়া।

এসময় মি. ইকাই স্বামীর প্রতি আয়ানের ভক্তি নিয়ে যা বলেছিল সেটা মনে পড়ে গেল কুসানাগির।

“একজন আদর্শ স্ত্রী বলতে যা বোঝায়, আয়ানে মাশিবা একদম সেটাই। ইয়োশিতাকা যখন বাসায় থাকতো, তখন সবসময় লিভিংরুমের সোফায় বসে সেলাইয়ের কাজ করতো সে, যাতে যে কোন দরকারে ছুটে যেতে পারে।

আয়ানের বাবা-মা’র সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে তারা বলেন যে রান্নার বিষয়ে কখনোই আগ্রহ ছিল না তাদের মেয়ের। বিয়ের আগ দিয়ে রান্নার স্কুলে ভর্তি হয়ে সব শিখেছে।

এ দুটো কাজই সে করেছে যাতে অন্য কেউ রান্নাঘরে না ঘেঁষতে পারে।

“অর্থাৎ, যখন ইয়োশিতাকাকে খুনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সে… তখন আসলে কিছুই করতে হয়নি?”

“ঠিক বলেছেন। কিছুই না। শুধু স্বামীকে একা রেখে কিছুদিনের জন্যে দূরে চলে যেতে হতো তাকে। ওহ হ্যাঁ, খালি একটা কাজ করেছে। একটা দুটো বাদে বাকি মিনারেল ওয়াটারের বোতলগুলো খালি করে রেখে গেছে। ইয়োশিতাকা যতদিন বোতলের পানি ব্যবহার করবে, তার কিছু হবার কথা না। প্রথমবার কফি বানানোর সময় মিনারেল ওয়াটারই ব্যবহার করেছিল সে। কিন্তু দ্বিতীয়বার বানানোর সময় যখন দেখে যে মাত্র এক বোতল পানি আছে ফ্রিজে, তখন ফিল্টার করা পানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এক বছর ধরে জায়গামত থাকার পর, অবশেষে বিষটুকু মিশে যায় পানিতে।

টেবিল থেকে কফির কাপ তুলে নিল ইউকাওয়া।

“গত এক বছরের মধ্যে যে কোন সময় স্বামীকে খুন করতে পারতো আয়ানে। কিন্তু সেটা করেনি সে। বরং খেয়াল রেখেছে যাতে দুর্ঘটনাবশত ফিল্টারের পানি ব্যবহার না করে ফেলে ইয়োশিতাকা। বেশিরভাগ খুনি ভাবে যে কিভাবে খুনটা করবে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে আয়ানের সব ভাবনা ছিল কিভাবে ইয়োশিতাকাকে বাঁচানো যায় সেটাকে ঘিরে। এক বছর ধরে তাকে রক্ষা করেছে সে। এরকম খুন আগে কখনো হয়েছে কি না জানা নেই আমার। একদমই ভিন্ন অন্য সব খুন থেকে, এটা তো স্বীকার করবে তোমরা? কাগজে কলমে সম্ভব হলেও, বাস্তবে করা সম্ভব কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। সেজন্যেই কাল্পনিক সমাধান বলেছিলাম আমি।”

“আমাদের এখনই মিসেস মাশিবাকে গ্রেফতার করা উচিত, “ কুসানাগির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল উতসুমি।

জুনিয়র ডিটেক্টিভের সম্ভ্রষ্ট চেহারার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবারো ইউকাওয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরালো কুসানাগি। “কোন প্রমাণ আছে? কোর্টে কি প্রমাণ করা যাবে কাজটা সে করেছে?”

চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে নামিয়ে রাখলো ইউকাওয়া। “কোন প্রমাণ নেই,” বলল সে।

“আসলেই?” অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল উতসুমি।

“একটু ভেবে দেখুন, আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন। সে যদি মি. মাশিবা খুন হবার আগে বা পরে আসলেও কিছু করে থাকত, তাহলে হয়তো কোন প্রমাণ পাওয়া যেত। কিন্তু তাকে খুন করার জন্যে কিছুই করতে হয়নি আয়ানে মাশিবাকে। হাজার খুঁজলেও তাই কিছু পাবেন না। শুধুমাত্র ফিল্টার পাইপে বিষের অস্তিত্ব পাওয়াটাই আপনাদের একমাত্র হাতিয়ার। কিন্তু সেটা আদালতে টিকবে না। আর আমি যে সিরিয়াল নম্বরের ব্যাপারে কথা বললাম সেটাও ইচ্ছে করলে নাকচ করে দেয়া যেতে পারে। শুধু এটুকু বললেই হবে যে জিনিসগুলো দেরিতে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ আমরা কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারবো না আয়ানে মাশিবা তার স্বামীকে হত্যা করেছে।”

“আমি মানতে…” প্রতিবাদে কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল উতসুমি।

“আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম,” গম্ভীর স্বরে বলল ইউকাওয়া। “এটা একটা পারফেক্ট ক্রাইম।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *