অন্তর্যামী – ৪

চার

ছোট্ট একটা পার্কের ধারে, সিডার গাছের সারির আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে রানা ও অ্যালি। সতর্ক চোখে নজর বুলাচ্ছে আশপাশে। এর মাঝে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে, কিন্তু প্রথম যেখানে লুকিয়েছিল, সেখান থেকে তিন ব্লকের বেশি এগোতে পারেনি ওরা। এখনও এল সেডেরোর রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার গভীরে আটকা পড়ে আছে দু’জনে, চারপাশে ঘুরতে থাকা শত্রুদের মাঝখানে।

শেষ রেডিও ট্রান্সমিশনটার কয়েক মিনিট পরেই ছায়ার মত উদয় হয়েছে লোকগুলো। কাজেকর্মে অত্যন্ত দক্ষ—তল্লাশি চালাচ্ছে নিঃশব্দে, ফ্ল্যাশলাইট জ্বালছে না… ফলে তাদের লোকেশন আন্দাজ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে প্রচুর সময় নিয়ে, ভালমত দেখেশুনে আড়াল থেকে বেরোতে হচ্ছে ওদেরকে। শ্লথ হয়ে গেছে এগোবার গতি। যতটা এগিয়েছে, তার পেছনে সতর্কতার চেয়ে ভাগ্যের ভূমিকাই বরং বেশি। একেবারে প্রথম শ্রেণীর ট্রেইণ্ড প্রফেশনাল এরা, হাবভাবে পরিষ্কার প্রকাশ পাচ্ছে দক্ষতা। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, বাড়তি মুভমেন্ট বা আওয়াজ নেই, ভূতের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে সবখানে।

পার্কটা ভাল করে দেখল রানা। একপাশে সারিবদ্ধ বাড়ি ও আঙিনা; অন্যপাশটা উন্মুক্ত, রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। চল্লিশ গজ দূরে, দোলনা আর স্লিপারের সামনে দিয়ে একটা ছায়ামূর্তিকে হেঁটে যেতে দেখল। বাড়িঘরের সারির দিকে তাকাল ও। ওদের বামে রয়েছে ওগুলো, সাগরের উল্টোদিকে। ওদিকেই যাবার ইচ্ছে—আবাসিক এলাকা পেরুলেই হাইওয়ে, তার ওপাশে এল সেডেরোর কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্ট। আর কিছু না হোক, সেটা মস্ত বড় এলাকা। দোকানপাট, ওয়্যারহাউস, আর নানা ধরনের কারখানার মেলা। লুকানো সহজ, কিন্তু কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। একবার ও-পর্যন্ত পৌঁছুনো গেলে পরের পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করা যাবে।

পার্কে দেখা লোকটা রাস্তার দিকে গেছে। রাস্তা পেরিয়ে তাকে দূরের বাড়িগুলোর ছায়ায় হারিয়ে যেতে দেখল রানা। উল্টোদিকে নজর ফেরাল ও। সিডারের সারি আর বাঁয়ের বাড়িগুলোর মাঝখানের অংশটা খুঁটিয়ে দেখল। মোটামুটি সত্তর ফুট দূরত্ব পেরোতে হবে ওদেরকে। ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে জায়গাটা, কিন্তু কোনও আড়াল নেই। কেউ এদিকে নজর রাখলে দেখতে পাবে ওদেরকে।

শেষবারের মত রাস্তা আর বাড়িগুলোর দিকে তাকাল রানা। সুনসান পরিবেশ, কোথাও কেউ নেই। অ্যালির হাত ধরল ও, ইশারায় বুঝিয়ে দিল কোনদিকে দৌড়াতে হবে। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল অ্যালি। ছুট দিতে যাবে রানা, এমন সময় মুঠো শক্ত হয়ে গেল মেয়েটার, হালকা টান দিল পেছনদিকে—সঙ্কেত দিচ্ছে। ঘাড় ফেরাল না রানা, কিছু জিজ্ঞেস করল না… স্থির হয়ে গেল মূর্তির মত।

ঠিক তিন সেকেণ্ড পর সিডারের সারির সামনে দিয়ে হেঁটে গেল একটা লোক—ওরা যেখানটায় লুকিয়েছে, তার বড়জোর দশ ফুট সামনে দিয়ে। পাশ থেকে এসেছে লোকটা, গাছের সারির জন্যে দেখা যায়নি তাকে। শিশিরে ভেজা ঘাসে কোনও পদশব্দ হয়নি—এখনও হচ্ছে না। অবাক হলো রানা, লোকটার উপস্থিতি অ্যালি বুঝল কী করে? ও নিজেই তো কিছু টের পায়নি!

অপেক্ষা করতে থাকল রানা। পার্কের মাঝখানে গিয়ে থামল লোকটা। ঘুরে চারপাশ দেখল। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে সিডারের সারির ওপর স্থির হলো তার দৃষ্টি, এরপর আবার ঘুরে গেল। গাছপালা, বাড়িঘর আর গলি-ঘুপচি মিলিয়ে লুকানোর জায়গার অভাব নেই আশপাশে। এতসব জায়গা অল্প কয়েকজনের পক্ষে তল্লাশি করা কঠিন। এরা সম্ভবত তাই খোলা জায়গায় মুভমেন্ট ডিটেক্ট করতে চাইছে।

সময় নিয়ে চারপাশ দেখল লোকটা। তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। একটু আগে তার সঙ্গী যেদিকে গেছে, সেদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আবারও নিথর হয়ে গেল চারপাশ। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে নিশ্চিন্ত হতে পারল না রানা। খানিক আগেও এমনই নিথর লাগছিল, হঠাৎ লোকটা বাতাস ফুঁড়ে উদয় হলো। তাই বলে এখানে গাছের আড়ালে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। ঝুঁকি বাড়ছে।

ঘাড় ফিরিয়ে অ্যালির দিকে তাকাল রানা। এবার আর কোনও সঙ্কেত দিল না মেয়েটা। বরং মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাল, সে তৈরি।

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দু’জনে। ছুটতে শুরু করল প্রাণপণে।

পাঁচ মিনিটের মাথায় ক্লান্ত হয়ে পড়ল অ্যালি। থামল না রানা, ওকে কোলে তুলে নিল, ছুটে চলল জোর কদমে। দশ মিনিট লাগল হাইওয়ের কাছে পৌঁছুতে। রাস্তার ঢালের গোড়ায় পৌঁছে থামল। অ্যালিকে নামাল কোল থেকে। বসে পড়ল ছায়ায়।

কপালের দু’পাশ দপ দপ করছে রানার। ঠিক ব্যথা বলা যাবে না, যেন হিমশীতল কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে ওখানটায়। শরীর এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি, আন্দাজ করল ও। নইলে হালকা-পাতলা একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে দশ মিনিট দৌড়ালে কিছুই হবার কথা নয় ওর।

শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল কিছুক্ষণের ভেতর। এবার কান পাতল ও। থেকে থেকে রাস্তা থেকে ভেসে আসছে গাড়ির আওয়াজ, এই অসময়ে খুব বেশি যানবাহন নেই হাইওয়েতে। মনে মনে প্রার্থনা করল, হেলিকপ্টারের আওয়াজ যেন শুনতে না হয়। শত্রুপক্ষের ক্ষমতা সম্পর্কে যতটা আঁচ করতে পেরেছে, তাতে হেলিকপ্টার জোগাড় করা কঠিন হবার কথা নয় তাদের জন্যে। আকাশ থেকে নিচের দিকে একটা থারমাল ক্যামেরা তাক করলেই ওদের দু’জনকে জ্বলজ্বল করতে দেখা যাবে।

বিশ সেকেণ্ড অপেক্ষা করল রানা, কিন্তু শঙ্কিত হবার মত কিছু শুনতে পেল না। তার মানে এই নয় যে, বিপদ কেটে গেছে। মাথা তুলে রাস্তার ওপারে শুরু হওয়া কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্টের দিকে তাকাল। কপ্টার আসুক বা না-আসুক, লুকাতে হবে ওদেরকে। অ্যালির দিকে ফিরতে শুরু করেছিল, হঠাৎ থমকে গেল। বিপদের আভাস দিচ্ছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। তাড়াতাড়ি আশপাশে তাকাল। না, কিছুই নেই। তা হলে?

স্থির হয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল রানা। কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই, নইলে মনের ভেতর বিপদের ঘণ্টা বেজে উঠত না। দীর্ঘদিন বিপজ্জনক পেশাতে থাকায় ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। আগেভাগেই অনেক কিছু টের পেয়ে যায়। এখানেও নির্ঘাৎ কোনও ঝামেলা আছে। তারমানে… এল সেডেরোর ত্রিসীমানাতেই থাকা উচিত হবে না ওদের।

অ্যালি ওকে দেখছে। চোখের তারায় ফুটে আছে শঙ্কা, তবে মুখে কিছু বলছে না।

হাইওয়ের দিকে ইশারা করল রানা। উল্টোপাশের গাছপালার সারি পেরিয়ে, সিকি মাইল দূরে ঝলমল করছে একটা সুপারস্টোরের আলো–সারা রাত খোলা থাকে ওটা।

‘এসো,’ অ্যালিকে ডাকল ও।

.

লিয়ারির অফিসের এক ফ্লোর নিচে কম্পিউটার রুম। কামরার ভেতরে কোনও বাতি জ্বলছে না, আবছা আলো ছড়াচ্ছে ন’টা প্লাজমা মনিটর। অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে লিয়ারি, মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে তার চিফ টেকনিক্যাল অফিসার রব হুপারের দিকে। কম্পিউটারগুলোর সেটআপ নিয়ে ব্যস্ত সে, যাতে নির্বিঘ্নে মিরাণ্ডা স্যাটেলাইটের ইমেজ স্ট্রিম রিসিভ করতে পারে। এ-মুহূর্তে মনিটরগুলো শূন্য, কোনও ডেটা আসছে না। স্যাটেলাইটগুলোর অ্যাকসেস এখনও পায়নি লিয়ারি, প্রতি মুহূর্তে তার হৃৎস্পন্দন বাড়ছে।

‘সিগনেচারস্ লকড,’ খানিক পর সোজা হয়ে জানাল হুপার। ‘স্ট্রিম পেলেই ডিসপ্লে করতে পারব।’

পৃথিবীর অরবিটে আজ পর্যন্ত যত কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো হয়েছে, তার ভেতর মিরাণ্ডা সবচেয়ে অনবদ্য। ওগুলোর থারমাল ইমেজিং ক্ষমতা দুনিয়ার সেরা বিজ্ঞানীদের কল্পনার চেয়েও অন্তত দশ বছর এগিয়ে আছে। মিরাণ্ডার চোখ দিয়ে ভূপৃষ্ঠে দাঁড়ানো যে-কোনও মানুষের আকার-আকৃতি, নারী না পুরুষ—নিখুঁতভাবে বোঝা যায়। এ-কাজ যে অন্য কোনও স্যাটেলাইট করতে পারে না, তা নয়, কিন্তু সেটা খুবই সীমিত পরিসরে। ভুলভ্রান্তি থেকে যায় প্রচুর। তা ছাড়া এ-ধরনের ডিটেকশনের জন্যে ভূপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ একশো ত্রিশ মাইল ওপরে থাকতে হয় ওগুলোকে। কিন্তু দু’হাজার মাইল ওপর থেকেও ডিটেকশনের কাজ চালিয়ে যেতে পারে মিরাণ্ডা—নিখুঁতভাবে। উঁচুতে থাকার ফলে সাধারণ স্যাটেলাইটের চেয়ে অনেক বড় এলাকা কাভার করতে পারে।

পৃথিবীর চারপাশ জুড়ে তাই ওড়ানো হয়েছে অনেকগুলো মিরাণ্ডা। ওভারল্যাপিং কাভারেজের সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি ইঞ্চি মনিটর করে চলেছে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা—অনেকটা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস-এর মত। যে-কোনও মুহূর্তে, দুনিয়ার যে-কোনও বিন্দুর ওপর অন্তত তিনটে… কখনও কখনও চারটা বা পাঁচটা মিরাণ্ডা তাক করে নজরদারি করা সম্ভব। মুভিং টার্গেটের ওপরেও লক করা যায় মিরাণ্ডার দৃষ্টি—হোক সেটা কোনও জগার কিংবা ক্রুজ মিসাইল। একবার যদি সিগনাল লক করা যায়, কারও পক্ষে মিরাণ্ডার চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। যেখানেই যাক, যত দূরেই যাক, আঠার মত তার ওপর সেঁটে থাকবে মিরাণ্ডার ক্যামেরা।

তবে এসব করার আগে টার্গেটকে খুঁজে পাওয়া চাই। এখনও এল্ সেডেরোয় আছে রানা আর মেয়েটা, কিন্তু দেরি হলে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে। তখন ব্যাপারটা দাঁড়াবে খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মত। সেজন্যেই অস্থির হয়ে উঠেছে লিয়ারি। মিরাণ্ডার নিয়ন্ত্রণ পেতে যত দেরি হচ্ছে, ততই বাড়ছে ওদের পালিয়ে যাবার সম্ভাবনা।

হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠল কামরার সবক’টা মনিটর। একের পর এক মেসেজ বক্স ভেসে উঠতে শুরু করেছে। লিয়ারির সেলফোন বেজে উঠল।

‘সবগুলো মিরাণ্ডা তোমাকে দেয়া হলো,’ ওপাশ থেকে শোনা গেল পরিচিত কণ্ঠ, ‘বেস্ট অভ লাক।’

.

এক দৌড়ে সুপারস্টোরের পার্কিং লটের কাছে পৌঁছেছে রানা আর অ্যালি। এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখছে চারপাশ। লট প্রায় খালি। বিল্ডিঙের সামনে জটলার মত দাঁড়িয়ে আছে কিছু গাড়ি। সম্ভবত রাতের শিফটের কর্মচারীদের গাড়ি ওগুলো। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরও কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা রয়েছে, সেগুলোর মালিকেরা সম্ভবত ডাবল শিফটে কাজ করছে—বিকেলে যখন ডিউটিতে এসেছিল, তখন ভরা ছিল পার্কিং লট, বিল্ডিঙের সামনে কোনও জায়গা পায়নি।

অ্যালিকে নিয়ে সবচেয়ে কাছের গাড়িটার দিকে এগোল রানা। গাঢ় সবুজ রঙের একটা ফোর্ড টরাস। যত কমন মডেল হয়, ততই ভাল। গাড়ি চুরির খবর পুলিশের কাছে যেতে সময় লাগবে না, আর শত্রুপক্ষ পুলিশের রেডিয়ো কমিউনিকেশনে আড়ি পেতে বসে আছে। কমন মডেলের গাড়ি হলে সহজে মিশে যাওয়া যাবে অন্যান্য গাড়ির ভিড়ে। সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না চুরি হওয়া গাড়িটা।

কাছে গিয়ে দমে গেল রানা। টরাসটা একদম নতুন মডেলের। এগুলোয় স্মার্ট-কী থাকে, পুরনো গাড়ির মত তার জোড়া দিয়ে ইঞ্জিন চালু করা যায় না। অগত্যা মুখ ঘুরিয়ে আরেকটা গাড়ির দিকে এগোল। চল্লিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওটা।

.

কি-বোর্ডে ঝড় তুলেছে হুপারের আঙুল, পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে নির্দেশ দিয়ে চলেছে লিয়ারি।

‘নাম্বার টুয়েলভ—ওটার ফ্রেম তিন বাই তিন কিলোমিটারে নিয়ে এসো। নাম্বার ফিফটিনকে জুড়ে দাও টুয়েলভের সঙ্গে। ইনডেক্স—আউটডোর বায়োলজিক্স, হিউম্যান। নাম্বার ফোরকেও কানেক্ট করো টুয়েলভের সঙ্গে। সেইম কমাণ্ড।’

মিরাণ্ডা স্যাটেলাইট সিস্টেমের ক্ষমতা কল্পনাতীত। বড়- সড় একটা শহরকে অনায়াসে মনিটর করা যায় একেকটা স্যাটেলাইট দিয়ে। খোলা জায়গায় যত মানুষ আছে, তাদের সবাইকে ডিটেক্ট করা যায়। ডিটেকশনের পর প্রথমটার সঙ্গে আরও দুটো স্যাটেলাইটকে জুড়ে দিলে প্রত্যেকটা মানুষকে আলাদাভাবে জুম করে দেখা যাবে, বের করা যাবে তাদের বৈশিষ্ট্য। আর এই পুরো প্রসেসে সময় লাগে মাত্র ত্রিশ সেকেণ্ড।

ইতিমধ্যে কাজে নেমে পড়েছে পনেরো নম্বর মিরাণ্ডা।

একটা মনিটরে ওয়াইড শটে ভেসে উঠেছে এল সেডেরোর থারমাল ম্যাপ। সাগরটাকে দেখাচ্ছে কুচকুচে কালো। ডাঙার অংশে জ্বলজ্বল করছে লাল-নীল-হলুদ… নানা রঙের বিন্দু। বিভিন্ন মাত্রার হিট সোর্স বোঝাচ্ছে বিন্দুগুলো!

আশপাশের স্ক্রিনগুলোয় এবার একে একে ক্লোজআপ শট উদয় হতে শুরু করল। বায়োলজিক্যাল বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষগুলোকে আলাদা করছে, তাদের ছবি তুলছে ক্রমাগত। প্রথম শটটায় গোল হয়ে থাকা কয়েকজন মানুষকে দেখা গেল, মাঝখানে বড় একটা সাদা বিন্দু।

‘ক্যাম্পফায়ার,’ বলল হুপার। ‘বিচে আড্ডা দিচ্ছে। বাদ দেব এদেরকে?’

মাথা ঝাঁকাল লিয়ারি। বোতাম টিপে টার্গেটটাকে অগ্রাহ্য করবার নির্দেশ পাঠাল হুপার।

পরের কয়েকটা শটে সিসকোর টিমের সদস্যদেরকে দেখা গেল—মিলিত হবার জন্যে ভ্যানের দিকে যাচ্ছে। আদেশটা লিয়ারিই দিয়েছে। দুই শিকারকে খুঁজে পাওয়ামাত্র ওরা যেন ভ্যান নিয়ে মুভ করতে পারে, সেজন্যে।

আরও স্ন্যাপশট আসছে—কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে এক মহিলা, ডাস্টবিনে ময়লা ফেলছে এক লোক… পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে স্ক্যান করছে মিরাণ্ডা-সাগরের দিক থেকে ডাঙার অভ্যন্তরে। স্থির চোখে বড় স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে রইল লিয়ারি, পুরো এল্ সেডেরো শহর ভেসে উঠেছে ওতে। কোনার দিকে জ্বলজ্বল করছে শপিং সেন্টার জাতীয় কী যেন একটা। দশ থেকে পনেরো সেকেণ্ডের ভেতর ওখানে পৌঁছুবে মিরাণ্ডার চোখ।

.

লটের বাইরের দিকটায় নেবার মত একটা গাড়িই দেখতে পেল রানা। দূর থেকেই পছন্দ হয়ে গেল ওটা। এফ-১৫০ মডেলের একটা ফোর্ড পিকআপ। নব্বুই দশকের গাড়ি, ঝরঝরে। চুরি ঠেকানোর মত আধুনিক কোনও ব্যবস্থা নেই ওতে। চুরি হবার ভয় সম্ভবত মালিকেরও নেই। কে নেবে এই পুরনো গাড়ি? ড্রাইভারের পাশের দরজা লক করেছে, কিন্তু প্যাসেঞ্জারেরটা করেনি।

রানার ইশারা পেয়ে ওপাশ দিয়ে উঠে পড়ল অ্যালি। ঝুঁকে খুলে দিল ড্রাইভারের দরজা। ঝপট্ স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসে পড়ল রানা।

.

রকি পর্বতমালার দু’হাজার ত্রিশ মাইল ওপরে, সেকেণ্ডে চার মাইল বেগে মেক্সিকো উপসাগরের দিকে ভেসে চলেছে মিরাণ্ডা ফিফটিন। ওটার ক্যামেরা এল সেডেরোর দিকে তাক করা—ঝড়ের বেগে তুলছে হিউম্যান টার্গেটদের ছবি। সাত নম্বরটা তুলে পাঠিয়ে দিল নিচে। এরপর তুলল আট নম্বরটা। নয় নম্বরে গিয়ে থমকে গেল অনবোর্ড কম্পিউটার। প্রথম যেখানে ডিটেক্ট করা হয়েছিল, এখন সেখানে নেই টার্গেট নাইন।

মাস্টার ফ্রেম ধরে রাখার পাশাপাশি টার্গেট অ্যাসাইন করছে মিরাণ্ডা টুয়েলভ, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওটার সঙ্গে যোগাযোগ করল ফিফটিন—সমস্যাটা জানাল। মিরাণ্ডা টুয়েলভের তরফ থেকে জবাব এল, দুই দশমিক তিন সেকেণ্ড আগে’ উধাও হয়ে গেছে টার্গেট নাইন। ওই লোকেশনে এখন আর খোলা জায়গায় দাঁড়ানো দু’জন মানুষের হিট সিগনেচার পাওয়া যাচ্ছে না; পাওয়া যাচ্ছে গাড়ির ভেতরে বসা দু’জন মানুষের সিগনেচার। নিরানব্বুই শতাংশ নিশ্চয়তার সঙ্গে গাড়ির মডেলও জানানো হলো—এফ-১৫০ মডেলের একটা ফোর্ড পিকআপ, ১৯৮৮ সালে তৈরি। গ্রাউণ্ড থেকে পাওয়া কমাণ্ডে উন্মুক্ত জায়গায় টার্গেট খোঁজার কথা বলা হয়েছে, কাজেই টার্গেট নাইন বর্তমানে অকার্যকর।

সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করল মিরাণ্ডা ফিফটিন। কম্পিউটার ব্রেন নিজের যুক্তি খাটিয়ে সিদ্ধান্তে এল, যে-টার্গেট শর্ত পূরণ করছে না, তার ছবি তোলার প্রয়োজন নেই। নয় নম্বরকে অগ্রাহ্য করে পরের টার্গেটের ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল যন্ত্রটা।

.

পিকআপের গ্লাভবক্সে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার পেল রানা। ওটার সাহায্যে খুলে ফেলল ইগনিশন হাউজিং। ত্রিশ সেকেণ্ডের ভেতর দুটো তার জোড়া দিয়ে ইঞ্জিন চালু করল।

অ্যালি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কাষ্ঠ হাসি হেসে রানা বলল, ‘চুরি করছি না। ধার নিচ্ছি গাড়িটা।’

চেহারা স্বাভাবিক হয়ে এল মেয়েটার। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি।’

গিয়ার দিয়ে গাড়ি আগে বাড়াল রানা। দক্ষিণমুখী র‍্যাম্প ধরে দ্রুত উঠে পড়ল হাইওয়েতে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল অ্যালি। কুয়াশার মাঝে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে শহরের আলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও।

রানা বলল, ‘হ্যাঁ, এবার তোমার গল্প শোনাও।’

.

স্যাটেলাইটের পাঠানো ছবিগুলোর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে লিয়ারি। জুয়ার টেবিলে শেষ কানাকড়ি হারানো একজন মানুষের মত লাগছে তাকে। টার্গেট এরিয়ার আউটডোরে চোদ্দটা কন্ট্যাক্ট পাওয়া গেছে, কিন্তু সেখানে অল্পবয়েসী কোনও মেয়ে নেই।

পালিয়ে গেছে মেয়েটা!

টার্গেট এরিয়ার আয়তন খানিকটা বাড়িয়ে দ্বিতীয় দফার সার্ভেইল্যান্স শুরু করেছে হুপার, কিন্তু তাতে আশাবাদী হতে পারছে না লিয়ারি। পায়ে হেঁটে বা দৌড়ে অতদূর যাওয়া সম্ভব নয় কারও পক্ষে। দেখতে না পাবার ব্যাখ্যা একটাই—গাড়িতে উঠে পড়েছে ওরা।

চেয়ার টেনে ধপ্ করে বসে পড়ল লিয়ারি। আঙুল দিয়ে চেপে ধরল কপালের দু’পাশ। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই চিন্তা: নাগালের বাইরে চলে গেছে অ্যালিসন… চলে গেছে মুক্ত দুনিয়ায়!

এখুনি কিছু মনে করতে পারবে না মেয়েটা, জানে লিয়ারি। কিন্তু তাতে স্বস্তি পাবার কিছু নেই। বড়জোর এক সপ্তাহ স্মৃতিভ্রষ্ট থাকবে সে। শরীর থেকে সমস্ত ড্রাগ বেরিয়ে গেলেই ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যাবে তার।

মুখের ভেতরে বিস্বাদ অনুভূতিটা বেড়ে গেছে লিয়ারির। মনে হচ্ছে, আবার ফিরে গেছে বস্টনে… ওর ছোট্ট ফ্ল্যাটে। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে, এই বুঝি দরজায় টোকা দেয় পুলিশ।

‘স্যর?’ ডাকল হুপার।

‘বলে ফেলো,’ তার দিকে না-তাকিয়েই বলল লিয়ারি। ‘হেইল মেরি প্রসেসটা চালালে কিছু পাওয়া যেতে পারে।’

‘সেটা আবার কী?’

‘মিরাণ্ডার অপারেটিং সিস্টেমের নতুন সংযোজন। পেভমেন্ট থেকে হিট ট্রেইল ডিটেক্ট করার একটা কৌশল। ‘রাস্তায় গাড়ির চাকার ঘষায় তাপ উৎপন্ন হয়, জানেন নিশ্চয়ই? খুব ক্ষীণ তাপ, তবে মিরাণ্ডার ক্যামেরার সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে সেই তাপ ষাট সেকেণ্ড পর্যন্ত ডিটেক্ট করতে পারি আমরা।’

‘বলতে চাইছ, খানিক আগে যদি কোনও গাড়ি সার্চ এরিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকে, সেটাকে ডিটেক্ট করতে পারবে তুমি?’

কোত্থেকে রওনা হয়েছে… আর কোন্ পথে গেছে, সেটা যদি বুঝতে পারি আর কী। তবে ষাট সেকেণ্ডের বেশি আগে হলে পারব না।

চেয়ার ছেড়ে মনিটরের দিকে এগোল লিয়ারি। খুঁটিয়ে দেখল পুরো ম্যাপ। হঠাৎ চোখ চলে গেল এক কোণে। একটা সুপারস্টোরের কাঠামো দেখা যাচ্ছে ওখানে। সামনে বিশাল পার্কিং লট। আর পার্কিং লট মানেই গাড়ি।

‘ওখানে,’ আঙুল তুলল সে। ‘ওখানে দেখো।’

মাথা ঝাঁকিয়ে কি-বোর্ডের কয়েকটা বোতাম চাপল হুপার। পুরো স্ক্রিন জুড়ে চলে এল পার্কিং লটের ক্লোজআপ। দু’বার রিফ্রেশ হলো পর্দা। এরপরেই ভেসে উঠল একজোড়া নীল রেখা—পার্কিং লট থেকে শুরু হয়ে র‍্যাম্পের দিকে গেছে, এরপর উঠে পড়েছে হাইওয়েতে।

ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটল লিয়ারির। ‘পেয়েছি!’ বিড়বিড় করল সে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল হুপারের দিকে। ‘এক মিনিট আগের ডেটা চেক করো। আমি জানতে চাই, ওখানে কোন্ গাড়িটা ছিল।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *