অন্তর্যামী – ১৮

আঠারো

ঠিক পাঁচ মিনিট পর রওনা হলো ওরা।

গাড়িটা হোণ্ডা অ্যাকর্ড—দশ-বারো বছরের পুরনো। ব্যাকসিট ভাঁজ করে রাখা যায়, তাতে উন্মুক্ত হয়ে যায় গাড়ির কেবিন আর ট্রাঙ্কের মাঝখানের ফাঁকটা। ভাঁজ করার প্রয়োজন অবশ্য এখন পর্যন্ত পড়েনি, ট্রাঙ্কের ভেতর গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে রানা আর অ্যালি। বাড়ি ছাড়ার তিন মিনিট আর পাঁচটা বাঁক অতিক্রমের পর ওদেরকে ডাকলেন বারবারা। সিটের ওপাশ থেকে ভোঁতা শোনাল তাঁর কণ্ঠ।

‘অন-র‍্যাম্পে ওঠার আগে গাড়ি থামাচ্ছে পুলিশ, ‘ জানালেন তিনি। ‘আমি যতক্ষণ সঙ্কেত না দিচ্ছি, কোনও শব্দ কোরো না।

ত্রিশ সেকেণ্ড পর ব্রেক চাপা হলো, শামুকের মত গুঁড়ি মেরে এগোতে থাকল গাড়ি—থামছে-এগোচ্ছে-থামছে। কল্পনায় লাইনে পড়ে যাওয়া গাড়ির সারি দেখতে পেল রানা—সামনে পুলিশের গাড়ির লাল-নীল বাতি জ্বলছে আর নিভছে। একটু পরেই একটা টু-ওয়ে রেডিয়োর খড়খড়ানি শোনা গেল, অন্ধকারে আড়ষ্ট হয়ে উঠল অ্যালির দেহ। ভেসে এল অ্যাসফল্টের ওপর পদশব্দ। বাটন টিপে জানালার কাঁচ নামালেন বারবারা, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল হর্ন, ইঞ্জিন আর মানুষের হৈচৈ-এর আওয়াজ। ‘ইনিং!’ বলে উঠল একটা পুরুষ কণ্ঠ—তীক্ষ্ণ, চাঁছাছোলা। কাঠিন্যের পাশাপাশি ভদ্রতা মিশে আছে গলায়। দীর্ঘদিনের অভ্যেসের ফসল।

‘হাই!’ বললেন বারবারা। ‘এতসব চেকিং কীসের? টিভিতে যেটা দেখলাম, সেটার জন্যে?’

‘ইয়েস, ম্যাম। আপনার আই.ডি.-টা দেখাবেন?’

কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা। ব্যাকসিটের কিনার দিয়ে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল রানা। আলো ফেলে গাড়ির ভেতরটা দেখছে অফিসার।

‘কোথায় যাচ্ছেন, জানতে পারি, ম্যাম?’ জানতে চাইল লোকটা।

‘শহরের বাইরে যাচ্ছি দিনকয়েকের’ জন্যে,’ বারবারা বললেন। ‘টিভির ওই লোকটা যদি সত্যি সত্যি বোমা-টোমা নিয়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকে আমাদের শহরে, আমি বাপু এখানে বসে থেকে মরতে রাজি নই। তাই ভাবলাম কয়েকদিনের জন্যে সটকে পড়ি। সবকিছু ঠাণ্ডা হলে নাহয় ফিরে আসব।’

তাঁর কণ্ঠ শুনে মনে হলো, মনে মনে কথাগুলোর রিহার্সেল দিয়ে নিয়েছেন। বলার ভঙ্গিতে সেটা পরিষ্কার। সাজানো ডায়লগ বুঝতে অসুবিধে হয় না। কুডাক শুনতে পাচ্ছে রানা।

কয়েক সেকেণ্ড কথা বলল না অফিসার। এরপর নতুন নির্দেশ দিল সে। ‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনার ট্রাঙ্কটা খুলুন, ম্যাম। আমি ভেতরটা দেখব।’

‘সেটা কি খুব জরুরি?’ জিজ্ঞেস করলেন বারবারা।

‘সময় নেব না, ম্যাম। খুলুন ডালাটা।’

আর কিছু বলার রইল না বারবারার।

প্রমাদ গুনল রানা। সিগ-সাওয়ারটা ওর প্যান্টের ওয়েস্টব্যাণ্ডে গোঁজা আছে, কিন্তু হাত বাড়াল না ওটার দিকে। তাতে কোনও লাভ নেই। যা-ই করুক না কেন, লাভ হবে না কোনও। অন্তত ডজনখানেক পুলিশ অফিসার রয়েছে গাড়ির আশপাশে—আজ রাতে তাদের প্রত্যেকেই ঝামেলা সামলাবার জন্যে তৈরি। তা ছাড়া আকাশে চক্কর দিচ্ছে পুলিশ আর এফবিআই-এর অনেকগুলো চপার। পালাবার কোনও পথ নেই ওদের।

‘ম্যাম?’ ডাকল অফিসার।

জবাব দিলেন না বারবারা। কী করছেন তিনি, আন্দাজ করল রানা। হুইলে হাত রেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন অফিসারের দিকে। কিছু বলার চেষ্টায় ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না।

‘ম্যাম!’ এবার প্রায় ধমকে উঠল অফিসার।

‘ট্রাঙ্কে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রেখেছি,’ বলে উঠলেন বারবারা। ‘আমি চাই না ওগুলো কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করুক। যেতে দিন আমাকে!’

চড়া সুরে কথা বলছেন তিনি, নার্ভাস হয়ে গেছেন। পুলিশের মনে সন্দেহ জাগাবার জন্যে যথেষ্ট। অফিসারের পরের কথায় তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

‘ম্যাম, ট্রাঙ্কটা খুলুন বলছি! এখুনি!’

‘ওয়ারেন্ট ছাড়া আপনি এ-ধরনের হুকুম দিতে পারেন না।’

‘আমার ফোনের স্ক্রিনে ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যে ওয়ারেন্ট এনে দেখাতে পারি। আপনি কি সেটাই চান?’

‘আমি শুধু ফ্রেজনো থেকে বেরুতে চাই,’ অনুনয়ের সুরে বললেন বারবারা। ‘বোমার কথা শোনার পর থেকেই ভয়ে হাত-পা সেঁধিয়ে আসছে, আর আপনি কিনা…’

গলবার পাত্র নয় অফিসার। কড়া গলায় বলল, শেষবারের মত বলছি, ম্যাম। ট্রাঙ্কটা খুলবেন কি খুলবেন না?’

এরপরেই নেমে এল অস্বস্তিকর নীরবতা। রানা আশঙ্কা করল, এখুনি খুট করে খুলে যাবে ট্রাঙ্কের ডালা, ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ধাঁধিয়ে যাবে ওদের চোখ। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। বারবারার গলাও আর শোনা যাচ্ছে না এখন। বিরাজ করছে স্রেফ অসহ্য নীরবতা। রানা টের পেল, অ্যালি কাঁপছে। আশ্বাস দেবার জন্যে ওর কাঁধে একটা হাত রাখল ও, মেয়েটার শরীরের কাঁপুনি যেন হাত বেয়ে চলে এল ওর শরীরে।

আরও মিনিটদুয়েক বজায় রইল নীরবতা। এরপর কথা বলল অফিসার। অদ্ভুত এক শান্ত স্বরে সে বলল, ‘থাক, কিছু দেখাতে হবে না। আপনি যেতে পারেন। শুভরাত্রি।’

চুপ করে রইলেন বারবারা। কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভাবছেন, লোকটা ঠাট্টা করছে।

‘যান, যান, পেছনে লাইন পড়ে গেছে,’ এক মুহূর্ত পর বলল অফিসার। এরপর বুটের মচমচ তুলে হাঁটতে শুরু করল, চলে গেল পেছনের গাড়ির দিকে।

সংবিৎ ফিরে পেলেন বারবারা। তাড়াতাড়ি অ্যাকসেলারেটর চেপে সামনে বাড়ালেন গাড়িকে অফিসারটি ইতিমধ্যে সঙ্কেত দিয়েছে, ব্যারিকেডের একটা অংশ সরিয়ে নেয়া হলো, ফাঁক গলে বেরিয়ে এল গাড়ি। শ্লথ গতিতে এগোল কিছুদূর। তারপর ধীরে ধীরে স্পিড বাড়াল।

‘বেরিয়ে আসতে পারো,’ একটু পর ডাক শোনা গেল বারবারার। ‘বিপদ কেটে গেছে।’

ধাক্কা দিয়ে ব্যাকসিটের খাড়া অংশটা সামনের দিকে ভাঁজ করল রানা। ফোকরটা উন্মুক্ত হতেই তাজা বাতাসের ঝাপটা পেল মুখে, সেইসঙ্গে আবছা আলো প্রবেশ করল ট্রাঙ্কের ভেতর। অ্যালির দিকে তাকাল ও—ফ্যাকাসে হয়ে আছে মুখ, অসুস্থ চেহারা।

‘ঠিক আছ তুমি?’

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল অ্যালি।

‘তা হলে বেরোও।’

ফোকর গলে অ্যালিকে বের হতে সাহায্য করল রানা। এরপর নিজেও বেরুল। সিট সোজা করে বসল। জানালার ওপাশে শাঁই শাঁই করে সরে যাচ্ছে একটার পর একটা ল্যাম্পপোস্ট। ফ্রেজনো শহরকে সত্তর মাইল বেগে পেছনে ফেলছে হোণ্ডা অ্যাকর্ড।

‘ব্যাপারটা কী ঘটল?’ সুস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।

‘শুনতে পেয়েছ সব?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন বারবারা।

‘হ্যাঁ। লোকটা আপনাকে ছেড়ে দিল কেন?’

কাঁধ ঝাঁকালেন বারবারা। ‘কী জানি। যে-রকম একরোখা আচরণ করছিল, ভেবেছিলাম রক্ষে নেই। কিন্তু হঠাৎ করে কী যেন হয়ে গেল ওর। কিছুই বুঝলাম না।’

খটকা লাগছে রানার। ব্যাপারটার ব্যাখ্যা কী হতে পারে, ভাবছে। খারাপ সম্ভাবনাটাই মাথায় এল প্রথমে। হয়তো থারমাল ক্যামেরা ছিল ওখানে। সেটায় দেখা গেছে, গাড়ির ট্রাঙ্কে লুকিয়ে আছে দু’জন মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে অফিসারকে মেসেজ দেয়া হয়েছে, গাড়িটাকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। হয়তো ওখানে জনসমক্ষে কিছু করতে চায়নি, চেয়েছে গাড়িটা দূরে… নির্জন কোনও জায়গায় যাক, তারপর হামলা চালাবে। কিন্তু মেসেজটা দিল কীভাবে?

‘অফিসারের কানে কোনও ইয়ারপিস ছিল?’ জিজ্ঞেস করল ও। ‘কানে আঙুল চেপে কিছু শুনছিল লোকটা?’

‘নাহ্,’ মাথা নাড়লেন বারবারা। ‘অমন কিছু থাকলে দেখতে পেতাম। জানালার পাশে মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছিল লোকটা।’

‘কেউ ওকে কোনও ইশারা দিয়েছে?’

‘কখন? সারাক্ষণ তো আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ মত পাল্টাল। পেছনের গাড়ির দিকে যখন গেল, তখনও সাইডভিউ মিররে ওর ওপর নজর রেখেছি। কোনও অস্বাভাবিকতা দেখিনি লোকটার মাঝে।’

‘হঠাৎ যে মত পাল্টাল, সেটাই তো অস্বাভাবিক।’

‘তা ঠিক। আমি বিশ্বাসই করতে পার িলাম না।’

রানাও পারছে না। কারণ ছাড়া একজন পুলিশ অফিসার এভাবে একটা গাড়িকে ছেড়ে দিতে পারে না, বিশেষ করে ড্রাইভার যখন সন্দেহজনক আচরণ করছে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল ও—কেউ কি ফলো করছে ওদেরকে? ব্যারিকেডে জ্বলতে থাকা লাল-নীল আলো দেখতে পেল, ম্লান হয়ে এসেছে দূরত্বের কারণে। কিন্তু না, কেউ পিছু নিয়েছে বলে মনে হলো না। ব্যাপারটা কী! খুঁতখুঁতানি বেড়ে চলেছে ওর।

রানার টেনশন বারবারার মাঝেও সংক্রামিত হয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?’

আরও কয়েক সেকেণ্ড পেছনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল রানা। এরপর সোজা হয়ে বসল।

‘আমি জানি না,’ বলল ও।

.

রাত দুটো বাজার খানিক পরে মডেস্টোয় পৌছুল ওরা। রানার অনুরোধে শহরের প্রান্তে একটা সুপারশপের সামনে গাড়ি থামালেন বারবারা।

‘তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো,’ বললেন তিনি। ‘যা যা লাগবে, আমি নিয়ে আসছি। তোমরা গেলে লোকের চোখে পড়ে যেতে পারো।’

ছোট একটা লিস্ট ধরিয়ে দিল রানা। সেটা নিয়ে নেমে গেলেন বারবারা। ফিরে এলেন বিশ মিনিটের মাথায়। হাতে ছোট-বড় কয়েকটা ব্যাগ—তাতে শুকনো খাবার, ফ্ল্যাশলাইট, ব্যাটারি, ইত্যাদি টুকিটাকি নিয়ে এসেছেন। অ্যালির হাতের জন্যে নিয়ে এসেছেন অ্যান্টিসেপটিক জেল আর ব্যাণ্ডেজ। রানার জন্যে একটা বেসবল ক্যাপ আর একটা সানগ্লাসও কিনে এনেছেন।

দশ মিনিট পর রেলস্টেশনে গেল ওরা। ট্রেন ধরে ফ্রেজনোয় ফিরবেন ভদ্রমহিলা। পার্কিং লটে গাড়ি থামিয়ে ফিরলেন ওদের দিকে

‘আমাকে যেতে হয়, সাবধানে থেকো।’

‘নিশ্চয়ই, ডা. হোল্ডেন,’ বলল রানা। ‘আপনাকে আর ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করব না। আপনার উপকারের কথা কোনোদিন ভুলব না আমি।’

‘থাক, ওভাবে বলতে হবে না। আমি তো ভারমুক্ত করলাম নিজেকে। তোমার জন্যে কিছু করতে পেরে মনটা হালকা লাগছে এখন।’

‘তার জন্যে এত বড় ঝুঁকি না নিলেও পারতেন।’

‘এ-কথাটা আমিও বলেছিলাম… সেবার তুমি যখন আমার জন্যে যখন ঝুঁকি নিয়েছিলে। শোধবোধ হয়ে গেল, কী বলো?’

রানার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে অ্যালি। ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন বারবারা। তারপর বললেন, ‘খেয়াল রেখো ওর দিকে।’

‘রাখব,’ রানা বলল। ‘ডাকব ওকে?’

‘না, থাক। বিশ্রাম নিক। অনেক ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। আমি তা হলে আসি।’

দরজা খুললেন বারবারা। আর তখুনি চোখ মেলল অ্যালি। বলল, ‘গুডবাই, ডা. হোল্ডেন।

হাসলেন বারবারা। ‘গুডবাই, মাই চাইল্ড।’

গাড়ি থেকে নেমে গেলেন তিনি।

কয়েক মিনিট পরেই ফ্রিওয়ে ধরে দুরন্ত বেগে ছুটতে দেখা গেল পুরনো গাড়িটাকে। গন্তব্য: কোল্ড স্প্রিংস, ইউটাহ্। এলিয়াস ড্রাই লেকের সবচেয়ে কাছের শহর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *