অন্তর্যামী – ২

দুই

সৈকত থেকে দু’মাইল দূরে যাবার আগে কথা বলল না কেউ। ততক্ষণে শহরের উত্তরে, পুরনো অংশটায় পৌঁছে গেছে ওরা। চোখ-কান খোলা রাখছে রানা, শ্যাভেজের সঙ্গে যেন দেখা হয়ে না যায়। ভ্যান নিয়ে লোকটা এদিকেই কোথাও আছে কি না কে জানে। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে রাস্তাঘাট, কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না কোথাও। মনে হলো, এ-মুহূর্তে ওরা দু’জন ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই চরাচরে।

‘ওরা কারা?’ একসময় নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কেন তোমার পিছু নিয়েছে? তুমি কি ওদের কোনও অপকর্ম দেখে ফেলেছ?’

মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘জানি না।’

ভ্রূকুটি করল রানা। ‘এতগুলো লোক তোমাকে ধাওয়া করছে… অথচ কেন করছে, তা তুমি জানো না?’

‘ব্যাপারটা বেশ জটিল,’ ইতস্তত করল মেয়েটা। ‘শোনো, এখনও দেরি হয়নি, তুমি চাইলে এসবের সঙ্গে নিজেকে না জড়ালেও পারো। এমনিতেই যা করেছ, তা যথেষ্ট…’

‘তোমাকে একা ছাড়ছি না আমি,’ ওকে বাধা দিল রানা। ‘তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমার।’

কথাটা বলে নিজেই অবাক হলো। চেনে না, জানে না… এমন একটা মেয়েকে রক্ষার কথা কেন বলতে গেল? একটু ভাবতেই টের পেল, অবচেতন মনে সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নেয়া হয়ে গেছে—মেয়েটার সঙ্গে লুবনার মিল দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে। লুবনাকে ও বাঁচাতে পারেনি, কিন্তু একে বাঁচাবে… অতীতের ব্যর্থতার প্রায়শ্চিত্ত করবে। যেমন করে হোক।

মেয়েটাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, কিন্তু কোনও প্রশ্ন করল না। শুধু কাঁধ ঝাঁকাল খানিক পর। জিজ্ঞেস করল, ‘কী করতে চাও?’

‘পুলিশের কাছে যাবে? আর যা-ই করুক, পুলিশ স্টেশনে হামলা করার সাহস পাবে না ওরা।’

‘না, প্লিজ… পুলিশকে জড়িয়ো না।’

‘কিন্তু কেন?’

‘সেসব তুমি বুঝবে না।’

‘চেষ্টা করে দেখো। আমি বুদ্ধিমান… সত্যি।’

চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। মাথা নিচু করে হাঁটছে। রানা নরম গলায় বলল, ‘আমাদের এখনও পরিচয় হয়নি। আমি রানা… মাসুদ রানা। ‘

‘অ্যালিসন,’ নিজের নাম জানাল মেয়েটা। ‘আমাকে তুমি অ্যালি বলে ডাকতে পারো।’

‘আমার ওপর আস্থা রাখো, অ্যালি। যা-ই বলো, আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করব না। ওই লোকগুলোকে আমি দেখেছি… ওদের কথা শুনেছি। বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস। নির্ভয়ে সব খুলে বলো আমাকে।’

চুপ করে রইল মেয়েটা। মাথা নিচু করে হাঁটছে।

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ খানিক পর জানতে চাইল রানা। ‘বাড়িতে কে কে আছে? মা, বাবা, ভাই, বোন…’

‘জানি না,’ মাথা নাড়ল অ্যালি। ‘আমার কিচ্ছু মনে নেই।’

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু বাধা পড়ল কাছ থেকে বিকট একটা আওয়াজ ভেসে আসায়। খপ করে রানার হাত চেপে ধরল ও, তাকাল শব্দের উৎসের দিকে। রানাও তাকাল। মাটিতে কাত হয়ে পড়েছে একটা ডাস্টবিন, ঢাকনাটা গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটা বেড়ালকে দেখা গেল উল্টে পড়া জঞ্জালের দিকে এগোতে। তাই বলে ভয় কাটল না অ্যালির, রানার বাহু আঁকড়ে ধরে থাকল।

‘ভয়ের কিছু নেই,’ রানা বলল। ‘ওটা বেড়ালের কাণ্ড। কী যেন বলছিলে?’

কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে রইল অ্যালি, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল রানার হাত ধরে। বলল, ‘আমার কিছু মনে নেই। গত দু’মাসের বেশি কিছুই মনে করতে পারি না। এই দু’মাসে… না, কোনও আত্মীয়স্বজন দেখিনি আমি।’

ক্লান্তি-মাখা সুরে কথা বলছে ও—একটা বাচ্চা মেয়ের জন্যে তা বেমানান। এ-ধরনের সুর শুধুমাত্র যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকের গলায় শোনা যায়।

‘আজ রাতে তুমি কোথায় ছিলে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কোত্থেকে ওই লোকগুলো তোমাকে ধাওয়া করে নিয়ে এল?’

‘যেখানে আমাকে আটকে রেখেছিল,’ বলল অ্যালি। ‘গত দু’মাস ধরে ওখানেই বন্দি ছিলাম আমি। আজ রাতে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল ওরা, তাই পালিয়েছি।’

আবর্জনা ঘাঁটতে থাকা বেড়ালটাকে পেরিয়ে এল ওরা। থেমে ওদের দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল প্রাণীটা—এদের আবার ভাগ বসাবার মতলব নেই তো! তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে। পড়ে থাকা ঢাকনাটার পাশ দিয়ে যাবার সময় আচমকা একটা ভাবনা এল রানার মাথায়, জেগে উঠল আতঙ্ক। অ্যালির দিকে তাকাতেই দেখল, মেয়েটার চোখ বড় হয়ে গেছে। খটকা লেগে গেল ওর, বুঝল কী করে?

‘এখান থেকে সরে যেতে হবে আমাদেরকে,’ বলল ও। কথাটা শেষ করেই দ্রুত পা চালাল। অ্যালিকে নিয়ে ঢুকে পড়ল ছায়ায়, দুই বিল্ডিঙের মাঝ দিয়ে পেছনে পৌছুবার চেষ্টা করছে। ওই ডাস্টবিন থেকে দূরে সরে যেতে হবে।

‘শব্দটা শুনে ছুটে আসবে ওরা, তাই না?’ জিজ্ঞেস করল অ্যালি।

‘হ্যাঁ।’

পরক্ষণে কংক্রিটের ওপর পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। সামনে, বিল্ডিঙের গোড়ায় বুনো ঝোপ দেখতে পেল রানা, অ্যালিকে নিয়ে চট্‌ করে বসে পড়ল ঝোপ আর দেয়ালের মাঝখানে। একটু অপেক্ষা করে উঁকি দিল বাইরে। কয়েক মুহূর্ত পরেই একটা ছায়ামূর্তি উদয় হলো ডাস্টবিনের পাশে।

ঠোঁটের কাছে আঙুল তুলে অ্যালিকে ইশারা দিল রানা। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকল দু’জনে।

টর্চ জ্বেলে আলো ফেলল লোকটা, ডাস্টবিন আর ঢাকনা দেখল। ম্যাও করে বিরক্তি প্রকাশ করল বেড়ালটা।

‘ভাগ্‌!’ মারমুখী একটা ভঙ্গি করল লোকটা।

হার মেনে দৌড়ে পালিয়ে গেল বেড়াল। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লোকটা। কোমর থেকে কী যেন একটা তুলে আনল। পরক্ষণে স্পিকার থেকে খসখসে শব্দ হওয়ায় বোঝা গেল, ওটা ওয়াকি-টকি। মুখের কাছে তুলে কথা বলল সে, রাতের নীরবতায় পরিষ্কার শোনা গেল তার কণ্ঠ।

‘দিস ইজ থ্রি-সিক্স, নর্থ অভ থ্রি-ফোর’স পজিশন। নো কন্ট্যাক্ট।’

আরেকটা কণ্ঠ ভেসে এল স্পিকারে। খসখসে আওয়াজের মাঝেও শ্যাভেজের গলা চিনতে পারল রানা।

‘দিস ইজ থ্রি-ফোর। আমিও কিছু পাইনি। ভ্যানে ফিরে যাচ্ছি।’

‘নেগেটিভ, থ্রি-ফোর,’ তৃতীয় একটা কণ্ঠ শোনা গেল। এটা লিডারের। ‘স্ট্রিট সার্চ চালিয়ে যাও। আমাদের ধারণা, মেয়েটা আবার শহরের দিকে ফিরে গেছে। এদিকটায় দ্বিতীয়বার তল্লাশি চালিয়ে আমরা একটা লিড পেয়েছি।’

‘কপি,’ বলল ডাস্টবিনের সামনে দাঁড়ানো লোকটা। ‘কী পেয়েছ?

‘একটা ওয়ালেট,’ জানাল লিডার। ‘কজওয়ের নিচে পাওয়া গেছে। ঠিক যেখানে আমরা মেয়েটার ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেছিলাম।’

মুখের ভেতরটা তেতো লাগল রানার। চেক করার দরকার নেই, প্যান্টের পেছনের পকেটের হালকা ভাবটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, কী সর্বনাশ ঘটেছে। তাও অভ্যাসবশে হাত দিল। নেই ওর ওয়ালেট।

‘দু’জোড়া পায়ের ছাপ পেয়েছি আমরা,’ বলে চলেছে লিডার। ‘কজওয়ের তলা থেকে তোমাদের পজিশনের দিকে গেছে। থ্রি-সিক্স, পুরো টিম আমি তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। ওদেরকে নিয়ে পুরো এলাকা সুইপ করো। থ্রি-ফোর, ভ্যানে যাও, আমিও আসছি। ওয়ালেটে আই.ডি. আর একটা কি- কার্ড পাওয়া গেছে। কার্ডে এখানকার এক হলিডে রিসোর্টের নাম লেখা। আমার ধারণা, ওয়ালেটের মালিক ওখানেই থাকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *