অন্তর্যামী – ১৬

ষোলো

নির্বিঘ্নে উড়ে চলেছে ব্ল্যাক হক। টেকঅফের পর পেরিয়ে গেছে দশ মিনিট। চেঁচিয়ে চলেছে ওভারস্পিড ইণ্ডিকেটর, কিন্তু সেদিকে মনোযোগ নেই রানার। ও তাকিয়ে আছে অ্যালির দিকে।

মেয়েটার আঘাত কতটা গুরুতর, বোঝার উপায় নেই। ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখতে পারছে না, হেলিকপ্টার ওড়ানোর জন্যে কন্ট্রোলে সবক’টা হাত-পাই রাখতে হচ্ছে রানাকে। অ্যালিও পারছে না পরনের প্রক্সিমিটি স্যুটটা খুলতে। ওপর থেকে দেখেই যতটা পারে আন্দাজ করতে চাইছে রানা। হাতে গুলি খেয়েছে অ্যালি, ট্রাইসেপের কাছে দেখা যাচ্ছে গুলির গর্ত। হাতের নিচের দিক দিয়ে ঢুকেছে গুলি, তবে তার আগে শরীরের অন্য কোনও অংশ… পা, তলপেট বা ঊর্ধ্বাঙ্গ… ফুটো করেছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না।

‘ক্ষতটা চাপ দিয়ে ধরে রাখো,’ বলল রানা, ‘যত কষ্টই হোক না কেন।’

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল অ্যালি। ক্লান্ত ও আতঙ্কিত দেখাচ্ছে ওকে। শক্তি হারিয়ে ফেলছে।

‘বড় করে শ্বাস নাও,’ পরামর্শ দিল রানা। ‘ধীরে ধীরে।’

তা-ই করল অ্যালি। হেডসেটে মনোযোগ দিয়ে শব্দটা শুনল রানা। না, কষ্ট হচ্ছে না শ্বাস নিতে। ভাল লক্ষণ।

‘বুকে কোনও চাপ অনুভব করছ?’ জিজ্ঞেস করল ও। ‘এমন কি মনে হচ্ছে, পুরোপুরি দম টানতে পারছ না?’

মাথা নাড়ল অ্যালি।

এটাও ভাল লক্ষণ। তাই বলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। ফুসফুস বা হৃৎপিণ্ডে গুলি না লাগলেও ভেতরে রক্তপাত হতে পারে। আস্তে আস্তে রক্ত জমে চাপ বাড়তে থাকবে বুকের খাঁচায়… হঠাৎ করে দুটো ফুসফুসই চুপসে যাবে। আঘাতজনিত শকের কারণে প্রাথমিকভাবে অসুবিধেটা হয়তো বুঝতে পারছে না অ্যালি। সেটাই হয়।

যতটা সম্ভব নিচ দিয়ে ব্ল্যাক হককে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে রানা—মাটি থেকে দু’শো ফুট উচ্চতায়। সামনে ফ্রেজনো, মোটামুটি দশ মিনিটের দূরত্ব। শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে তার চেয়েও কম সময়ে।

অ্যালির দিকে আবারও তাকাল রানা। ডান হাত দিয়ে ক্ষতের জায়গাটা খামচে ধরে আছে ও—টর্নিকেটের বিকল্প। চারপাশের স্যুট চুইয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত। কতটা রক্তপাত হচ্ছে ওর, বোঝার উপায় নেই। ক্ষত দিয়ে যা বেরোচ্ছে, তার সিংহভাগই স্যুটের আড়ালে ওর বাহু গড়িয়ে নামছে। এখন পর্যন্ত কোনও শব্দ করেনি মেয়েটা, তবে সেটা সহ্যশক্তির কৃতিত্ব নয়। আসলে শকের কারণে এখনও ব্যথা অনুভব করেনি ও। তবে ব্যথাটা শুরু হতে চলেছে—অ্যালির হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে সেটা।

‘আর কিছুক্ষণ সহ্য করে থাকো,’ বলল ওকে রানা। জানে, এতক্ষণ যা যা ভেবেছে, সব শুনতে পেয়েছে মেয়েটা।

কোনোমতে মাথা ঝাঁকাল অ্যালি। শরীর কাঁপতে শুরু করেছে ওর। ক্ষতের ওপরে শক্ত হয়ে উঠেছে মুঠি।

এয়ারস্পিড অ্যালার্ম বেজে উঠল। অন্যমনস্ক থাকায় অনেকটা নেমে গেছে হেলিকপ্টার—বিপজ্জনক উচ্চতায়। কন্ট্রোল স্টিক টেনে ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়াতে শুরু করল রানা, যতক্ষণ না থেমে যায় অ্যালার্মের কর্কশ আওয়াজ। অ্যালার্ম থামতেই শুনতে পেল অ্যালির যন্ত্রণাকাতর গোঙানি। কান্না ঠেকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে মেয়েটা, কিন্তু পারছে না।

.

থমথমে চেহারা নিয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে লিয়ারি। তাকে এতটা গম্ভীর হতে আগে দেখেনি কেউ।

স্যাটেলাইটগুলো সহজেই ট্র্যাক করে চলেছে কপ্টারকে। বিভিন্ন দিক থেকে তিনটাকে তাক করে রাখা হয়েছে ওটার ওপর, চতুর্থ স্যাটেলাইটটা ওয়াইড ফ্রেমে পুরো ফ্রেজনো এবং তার আশপাশের চল্লিশ মাইল এলাকা তুলে ধরেছে পর্দায়। আরও কয়েকটা উড়ন্ত আকাশযান দেখা যাচ্ছে ওতে—ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সেগুলো।

‘কী বুঝছ?’ জিজ্ঞেস করল লিয়ারি।

‘কঠিন হবে ব্যাপারটা,’ বলল হুপার। ‘হয়তো একেবারে শেষ মুহূর্তে নাগালে পাব ওদেরকে।’

আলতো করে মাথা ঝাঁকাল লিয়ারি। কপালের ভাঁজ গভীর হলো তার।

.

চোখের সামনে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হচ্ছে ফ্রেজনো। শহরের বাইরের দিকটা খুঁটিয়ে দেখল রানা, প্রয়োজনমাফিক জায়গা পাওয়া যায় কি না খুঁজছে। হেলিকপ্টার ল্যাণ্ড করাবার মত যথেষ্ট স্পেস দরকার, সেইসঙ্গে মানুষজনের ভিড়। শপিং মলের পার্কিং লট হলে ভাল হয়। তেমন কিছু চোখে পড়ছে না, কিন্তু হঠাৎ পার্কিং লটের চেয়ে ভাল একটা জায়গা চোখে পড়ল।

‘ফুটবল পছন্দ করো?’ হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল ও।

‘কী জানি,’ কাঁধ ঝাঁকাল অ্যালি। ‘কেন?’

সামনে ইশারা করল রানা। সিকি মাইল দূরে ঝলমল করছে একটা স্কুল স্টেডিয়াম—রাত্রিকালীন কোনও খেলা চলছে বোধহয়। গ্যালারির মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ ভরা। কন্ট্রোল স্টিক নাড়ল ও, স্পিড কমিয়ে আনল ব্ল্যাক হকের। পনেরো সেকেণ্ডের মাথায় ফিল্ডের ওপরে পৌঁছে স্থির হলো। দেখল, খেলোয়াড় আর দর্শকদের সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ওপরদিকে।

কয়েক সেকেণ্ড হোভার করল রানা, তারপর দ্রুত নিচে নামাতে শুরু করল কপ্টার। রোটর-ওঅশে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল খেলোয়াড়রা—পড়িমরি করে ছুটছে, খালি করে দিচ্ছে মাঠ।

‘আমি তোমাকে বয়ে নিয়ে যাব,’ অ্যালিকে বলল রানা। ‘খুব ব্যথা পাবে, কিন্তু যা-ই ঘটুক, ক্ষতের ওপর থেকে হাতের মুঠো সরিয়ো না।

মাঠ থেকে চল্লিশ ফুট ওপরে এখন ব্ল্যাক হক। উচ্চতা কমছে—ত্রিশ… বিশ….

‘এরচেয়ে বেশি ব্যথা হওয়া সম্ভব কি না জানি না,’ দাঁতে দাঁত পিষে বলল অ্যালি।

‘খুব শীঘ্রি টের পাবে। যদি চেঁচাতে চাও তো চেঁচিয়ো।’ ঝপ্ করে মাটি স্পর্শ করল হেলিকপ্টার, ঝাঁকি খেল একটা। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল রানা, এরপর ঝুঁকে খুলে দিল অ্যালির পাশের দরজাটা।

‘আমি ওপাশ দিয়ে আসছি,’ নিজের দরজা খুলতে খুলতে বলল ও। ‘এক হাতে কাঁধে তুলে নেব তোমাকে।’

‘আরেক হাতে কী করবে?’ জানতে চাইল অ্যালি, পরক্ষণে পড়ে নিল রানার মনের কথা। ‘বুঝেছি।’

‘আর কোনও উপায় নেই।’

ঝটপট নেমে পড়ল রানা। ঘুরে চলে গেল অ্যালির পাশটায়। ওকে তুলে নিল কাঁধে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা। তাতে কান দিল না রানা। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল কপ্টারের রোটরের তলা থেকে। খোলা আকাশের নিচে পৌঁছে উঁচু করল মুক্ত হাতটা—ওটায় শোভা পাচ্ছে ওর সিগ- সাওয়ার। পর পর তিনটা গুলি করল আকাশের দিকে।

আতঙ্কের ঢেউ বয়ে গেল খেলোয়াড় আর দর্শকদের মাঝে। পাগলের মত এগজিট টানেলের দিকে ছুটল সবাই—বেরিয়ে যেতে চায়। টানেলগুলো যথেষ্ট চওড়া, গাদাগাদি হবার ভয় নেই; ভিড়ের কারণে টানেল আটকে যাবারও সম্ভাবনা নেই। অ্যালিকে কাঁধে নিয়ে পলায়নপর জনতার পিছু পিছু ছুটল রানাও।

অর্ধেক পথ যেতেই কেঁপে উঠল মাটি। মুহূর্তকাল পরেই আকাশে দেখা দিল দুটো এফ-এইটিন হরনেট, কানে তালা লাগিয়ে উড়ে গেল স্টেডিয়ামের ওপর দিয়ে। একদম নিচ দিয়ে উড়ছে, গ্যালারির মাত্র শ’খানেক ফুট ওপর দিয়ে গেল জেট ফাইটারদুটো। ওগুলোর পিছু পিছু ছুটে এল সনিক বুম, বিকট শব্দে ফেটে গেল স্টেডিয়ামের সব লাইট, আঁধারে ছেয়ে গেল চারপাশ।

ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল রানা—যথাসময়ে নামতে পেরেছে মাটিতে। আর কয়েক মিনিট দেরি হলেই ব্ল্যাক হককে আকাশে পেয়ে যেত ফাইটারদুটো, মিসাইল ছুঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিত।

ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল রানা। অন্ধকার আর বিভ্রান্তি ওকে সাহায্য করছে। পিস্তলটা গুঁজে রেখেছে কোমরে, কেউ বাধা দিতে এলে বের করার জন্যে তৈরি। তবে তার প্রয়োজন হলো না। টানেলের বিশৃঙ্খলার মাঝে কেউ আর মনে করতে পারছে না, আহত কিশোরীকে নিয়ে ছুটতে থাকা মানুষটাই প্রথমে গুলি ছুঁড়েছিল।

মিনিটখানেকের মধ্যেই পার্কিং লটে বেরিয়ে এল ওরা। আশপাশে তাকাল রানা, এখনও পালাতে ব্যস্ত সবাই। কেউ গাড়িতে চড়ে, কেউ বা গাড়ির পরোয়া না করেই দৌড়ে কেটে পড়ছে। পুরনো মডেলের একটা হোণ্ডা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল ও, ওটার মালিকের কোনও খোঁজ নেই। ঘুসি মেরে ভেঙে ফেলল জানালার কাঁচ, তারপর হাত ঢুকিয়ে খুলে ফেলল দরজা। অ্যালিকে সাবধানে শুইয়ে দিল পেছনের সিটে। মেয়েটার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে।

তাড়াতাড়ি ড্রাইভিং সিটে বসল রানা। ড্যাশবোর্ডের তলার তার জোড়া দিয়ে চালু করল ইঞ্জিন, হ্যাণ্ডব্রেক রিলিজ করে সামনে বাড়াল গাড়িকে। চারদিকে যেন নরক ভেঙে পড়ছে। পাগলের মত গাড়ি চালিয়ে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে লট থেকে। সেই গাড়ির মাঝে ঢুকে পড়ল রানাও। রাস্তায় নেমে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল অ্যালির দিকে। প্রায়-অচেতন অবস্থা মেয়েটার।

ঠোঁট কামড়াল রানা। কোথায় যাবে, ভাবছে। একটা নামই মাথায় এল। মনে মনে প্রার্থনা করল, যেন বাড়িতে থাকে মানুষটা… যেন তার খবর জানা না থাকে শত্রুদের।

.

বাতাস পাক খাচ্ছে কম্পিউটার রুমের ভেতর। ক্রোধে দিশেহারা হয়ে জানালার দিকে চেয়ার ছুঁড়ে মেরেছে লিয়ারি, ভেঙে গেছে কাঁচ। হু হু করে ঢুকে পড়েছে রাতের বাতাস। টেবিল থেকে উড়তে শুরু করেছে কাগজপত্র।

আতঙ্কে কাঠ হয়ে যার যার ওঅর্কস্টেশনে বসে আছে অপারেটররা। কারও সাহস নেই কাগজগুলো কুড়িয়ে তোলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *