বিশ
রানা আর অ্যালি যখন কোল্ড স্প্রিংসে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। সূর্যের তাপে ঝিমাচ্ছে পুরো শহর। রাস্তায় মানুষ আর যানবাহন নেই বললেই চলে। শহরের মূল রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছে সার বাঁধা ছোট ছোট দোকান, গ্যাস স্টেশন আর ফাস্ট ফুড শপ। সবই পুরনো, বিবর্ণ। আধ মাইল পুবে পার্বত্য এলাকা— ঢেউ খেলানো পাহাড়সারির আড়ালে ঢাকা পড়েছে দিগন্ত, পাহাড়ের চূড়ায় ঝোপঝাড় আর পাইনের অরণ্য। বাকি দিকগুলোয় যতদূর চোখ যায়, পুরোটাই সমতল মরুভূমি।
শহরে থামল না রানা, একটা পার্শ্বরাস্তা ধরে পৌঁছল পূর্ব প্রান্তে। যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেল ওখানে—একটা কাঁচা রাস্তা, পাহাড়ের দিকে গেছে। ওটা অনুসরণ করে একটু পরেই একটা পাহাড়ি চাতালে উঠে গেল ওরা, থামল অবশেষে। গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে নজর বোলাল রানা। সমতল থেকে মোটামুটি দু’শো ফুট ওপরে উঠে এসেছে ওরা, ইউ.এস. ফিফটি হাইওয়ের মোটামুটি বিশ মাইল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার—এঁকেবেঁকে নেভাদা আর ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে চলে গেছে রাস্তাটা। কোল্ড স্প্রিংসের মূল সড়কটাও দেখতে পাচ্ছে, শহরের দক্ষিণ দিক দিয়ে বেরিয়েছে ওটা। ওদিকেই, পাঁচ মাইল দূরে, ধুলোময় মরুভূমির মাঝখানে রয়েছে এলিয়াস ড্রাই লেক। চোখ পিট পিট করল রানা, লেকটা দেখা যায়, কিন্তু টাওয়ারটা দেখতে পেল না চোখ ঝলসানো রোদের কারণে।
ঝুঁকে গাড়ির কনসোল থেকে একটা কলম নিল রানা। অ্যালিকে বলল, ‘তোমার হাতটা দেখি?’
নিঃশব্দে হাত বাড়াল অ্যালি। ওর হাতের তালুতে একটা ফোন নাম্বার লিখল রানা, সেই সঙ্গে একটা নাম—ববি মুরল্যাণ্ড।
‘কে ইনি?’ জানতে চাইল অ্যালি।
‘আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। নুমা নামে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে।
ঘুরে পাহাড়ের ঢালটা দেখল রানা—আরও দু’শো ফুট উঠে গিয়ে চূড়ায় মিশেছে।
‘তোমাকে আপাতত সঙ্গে নিচ্ছি না আমি,’ অ্যালিকে বলল ও। ‘ঢাল বেয়ে পাহাড়ের ওপরদিকে উঠে যাও, লুকিয়ে পড়ো গাছপালার ভেতরে। লেকের দিকে নজর রেখো। আমি ওখানে পৌঁছুবার পর যদি কিছু ঘটে… মানে, কোনও হেলিকপ্টার বা গাড়ি উদয় হয়…. তা হলে শহরে গিয়ে কোনও একটা দোকান থেকে ওই নাম্বারটায় ফোন কোরো, ববি তোমাকে সাহায্য করবে।’
ইউটাহ্ আসার পথে সারাক্ষণই রেডিয়োর খবর শুনেছে ওরা। বলা বাহুল্য, সেখানে রানাকে ধরিয়ে দেবার জন্যে ক্রমাগত ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। কোনও এক বিচিত্র কারণে অ্যালির কথা বলা হয়নি, কোনও বর্ণনাও দেয়া হয়নি ওর। রানা আন্দাজ করছে, ওকে লাইমলাইটে আনতে চাইছে না লিয়ারি। ওর কথা যদি সারা দেশের মানুষ জেনে যায়, তা হলে মেয়েটাকে গুম করা কঠিন হয়ে পড়বে। সম্ভবত সেজন্যেই এই কৌশল। একদিক থেকে ব্যাপারটা ভাল হয়েছে রানার জন্যে। লোকে নিঃসঙ্গ একজন বোমাবাজকে খুঁজছে, কিশোরীসহ কোনও যুবককে নয়। তাই অ্যালিকে দেখলে রানার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাচ্ছে না কেউ।
‘ববিকে ফোন করে তুমি তোমার নাম বলবে,’ বলল ও। ‘বলবে, রানা অনুরোধ করেছে, ও যেন এসে তোমাকে উদ্ধার করে। সবশেষে একটা শব্দ বলবে: সিলভারফিন।’
‘ওটা আবার কী?’ জানতে চাইল অ্যালি।
‘একটা কোড। ববি আর আমার মধ্যে ঠিক করা। আর কেউ সেটা জানে না। শব্দটা বললে ববি বুঝতে পারবে, মেসেজটা সত্যিই আমি পাঠিয়েছি, অন্য কেউ নয়।’
এসবের কি কোনও প্রয়োজন আছে? আমাকে সঙ্গে নিতে চাইছ না কেন?’
‘সতর্কতা,’ বলল রানা। ‘ওখানে যদি কোনও ফাঁদ পাতা হয়ে থাকে, আমি চাই না তুমি তাতে ধরা পড়ো।’
‘কিন্তু তুমি তো ধরা পড়বে!’
‘ওটুকু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। সব যদি ঠিকঠাক থাকে, তখন নাহয় তোমাকে নেবার কথা ভাবা যাবে।’
হাতের তালুতে লেখা নাম্বারটার দিকে তাকাল অ্যালি। ওর চেহারায় দ্বিধা।
‘ওটা স্রেফ ব্যাকআপের জন্যে,’ রানা বলল। ‘আমি মনেপ্রাণে চাইছি, ববিকে যেন তোমার ফোন করতে না হয়।’
‘আমিও তা-ই ভাবছি।’
.
গাড়ি নিয়ে রওনা হলো রানা। শহর পাড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল মরুভূমিতে। কাছাকাছি যাবার পরেও বোঝা গেল না, ঠিক কোথায় মরুভূমি শেষ হয়েছে আর লেকটা শুরু হয়েছে। বাতাসের ক্রমাগত অত্যাচারে ক্ষয়ে গেছে লেকের পাড়, হয়ে গেছে মসৃণ। এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে ভূমির গভীরতা বাড়তে শুরু করায় রানা অনুমান করল, লেক-বেডে পৌঁছে গেছে। মাটি এখানে অনেক মসৃণ, গাড়ি তেমন একটা ঝাঁকি খাচ্ছে না। আশপাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে মরুর ঝোপঝাড়।
টাওয়ারটা দেখা যাচ্ছে এখন। স্টিলের তৈরি একটা স্ট্যাণ্ডার্ড কাঠামো—তার টেনে মাটির সঙ্গে বাঁধা, ওগুলোই খাড়া অবস্থায় থাকতে বাধ্য করছে টাওয়ারটাকে। আশপাশে কোনও গাছ বা বাড়িঘর না থাকায় উচ্চতা আন্দাজ করা কঠিন। রানার মনে হলো, দু’শো ফুটের কম হবে না। দূর থেকে কোনও অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ছে না। তবে কাছে গিয়ে বদলে গেল ধারণাটা।
গাড়ি থামিয়ে নিচে নামল রানা। ট্রান্সমিশন টাওয়ার সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা ওর আছে। বহুবার এ-ধরনের টাওয়ারে চড়তে হয়েছে ওকে—গোপন ট্রান্সমিটার বসানোর জন্যে। অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানদের সাহায্য পেয়েছে প্রতিবার, সেই সঙ্গে লাভ করেছে জ্ঞান। তাই ড্রাই লেকের টাওয়ারটার ত্রিশ ফুটের মধ্যে পৌছুতেই বুঝল, গড়বড় আছে ওটায়।
টাওয়ারের একটা পায়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও। স্টিলের ফ্রেমটা স্বাভাবিক—ছোট ছোট পাত দিয়ে ট্রায়াঙ্গুলার ক্রস- ব্রেসিং করা হয়েছে কাঠামোটা মজবুত করার জন্যে; ঝালাই করা জয়েন্টগুলোয় রয়েছে কপার কানেক্টর, যাতে কণ্ডাক্টিভিটি বাড়ে। এ ছাড়া অন্যান্য টাওয়ারের মত এটারও একটা পায়ের ভেতরদিকে বসানো হয়েছে ধাতব টিউব, যার ভেতর দিয়ে গেছে নানান ধরনের কেইবল। টিউবটা ঝড়বাদলের হাত থেকে রক্ষা করছে কেইবলগুলোকে। সাধারণত অ্যালিউমিনিয়াম বা স্টিলের তৈরি টিউব লাগানো হয় টাওয়ারগুলোয়, কিন্তু এই বিশেষ টাওয়ারের টিউবটা অন্য ধাতুর তৈরি। কাছে গিয়ে পরখ করে দেখল রানা, পরক্ষণে ভুরু কুঁচকে গেল। ধাতুটা ইউরেনিয়াম-তেজস্ক্রিয়তামুক্ত। মিলিটারি ট্যাঙ্কের আর্মার তৈরি হয় এ-ধাতু দিয়ে।
পিছিয়ে এসে টিউবটার শেষ প্রান্ত দেখার চেষ্টা করল ও। টাওয়ারের অর্ধেক উচ্চতায় পৌঁছে শেষ হয়েছে ওটা, মিলেছে একটা কালো সিলিণ্ডারের সঙ্গে। জিনিসটা দেখতে অনেকটা মদের পিপের মত, তৰে আকারে অন্তত পাঁচ গুণ বড়। কোনও রেডিয়ো টাওয়ারে এ-ধরনের জিনিস আগে দেখেনি রানা। কী ওটা কে জানে, তবে থমকে থাকা পরিবেশে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ওখান থেকে ভেসে আসা মৃদু গুঞ্জন।
আর কিচ্ছু নেই টাওয়ারটায়। না আছে সেলুলার ট্রান্সিভার, না আছে কোনও মাইক্রোওয়েভ রিলে। আছে স্রেফ ওই অদ্ভুত কালচে সিলিণ্ডারটা। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রানা টের পেল, গুঞ্জনটা শুধু সিলিণ্ডার থেকে নয়, আসছে টাওয়ারের পুরো শরীর থেকে। বিশাল ধাতব কাঠামোটা যেন একটা টিউনিং ফর্কের মত কাঁপছে। এমনকী পায়ের তলার জমিনেও ছড়িয়ে পড়ছে সেই কম্পন।
অ্যালিকে নিয়ে আসবে কি আসবে-না, ভাবছে রানা। এনে কোনও লাভ আছে কি? কী-ই বা বুঝবে মেয়েটা? বেকারফিল্ডে সাধারণ একটা টাওয়ার দেখে যেভাবে ঘাবড়ে গিয়েছিল, তাতে শঙ্কাও জাগে। আসল টাওয়ারটার কাছে এলে হয়তো বা আরও সিরিয়াস কোনও প্রতিক্রিয়া হবে।
আসার জন্যে জোরাজুরি করতে পারে মেয়েটা। রানা মানা করে দিতে পারে… কিন্তু তারপর কী করবে? সত্যি বলতে কী, কিছুই করার নেই। যতক্ষণ না নতুন কিছু জানতে পারছে, এগোবার মত কোনও পথ দেখতে পাচ্ছে না রানা। এর অর্থ, অ্যালিকে নিয়ে আসতে হবে টাওয়ারের কাছে।
গাড়ির কাছে ফিরে গেল রানা, কিন্তু ভেতরে ঢুকল না। অ্যালিকে যদি আনতেই হয়, তার আগে ওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনও বিপদ ঘটেনি, তাই বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না ও। টাওয়ারের ওপর শত্রুরা নজর রাখছে কি না, শিয়োর হওয়া দরকার।
আকাশের দিকে মুখ তুলল রানা, ওভাবে একটু হাঁটল। মনে হতে পারে, আকাশে কোনও বিমান আছে কি না দেখছে, আদপে ব্যাপারটা তা নয়। কেউ যদি এদিকে একটা স্যাটেলাইট তাক করে থাকে, সেটায় নিজের চেহারা দেখাল ও। আজকালকার স্যাটেলাইটগুলোর ক্যামেরা অত্যন্ত উন্নত ও শক্তিশালী। ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মত ভাল ছবি হয়তো উঠবে না, কিন্তু যতটুকু দেখা যাবে, তাতে ওর চেহারা চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয় কারও। শত্রুদের প্রতিক্রিয়াই বুঝিয়ে দেবে, সত্যিই টাওয়ারটা নজরদারির ভেতর আছে কি না।
গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল রানা। শুরু হলো প্রতীক্ষার পালা।
এক ঘণ্টা কাটল। কিছুই ঘটল না।
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা। কপালের কাছে হাত রেখে চোখ বোলাল চারদিকে। না, কোনও হেলিকপ্টার উড়ছে না। ছুটে আসছে না পুলিশ বা অন্য কোনও বিশেষ বাহিনীর গাড়ি। নিথর হয়ে আছে প্রকৃতি। কিছু ঘটার হলে এতক্ষণে ঘটে যেত। এক ঘণ্টায় লিয়ারির মত লোকের পক্ষে ছোটখাট একটা বাহিনী পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব আমেরিকার যে- কোনও প্রান্তে। অ্যালি রানার সঙ্গে নেই বলে কিছু করছে না, এমনটা ভাবারও অবকাশ নেই। কারণ সেটা জানার কোনও কায়দা নেই লিয়ারির। রাতের বেলায় গাড়ির কাঠামো ভেদ করে আরোহীদের হিট সিগনেচার ডিটেক্ট করতে পারে তার স্যাটেলাইট, কিন্তু এই ভরদুপুরে… যখন রোদের তাপে পুরো গাড়ি আগুনের মত তেতে উঠেছে, তখন গাড়ির ভেতর মেয়েটা আছে কি নেই, তা নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যে-কোনও কারণেই হোক, টাওয়ারের ওপর নজর রাখছে না শত্রুরা। অ্যালিকে ওটা দেখাবার ঝুঁকিটা নেয়া যেতে পারে। গাড়িতে আবার উঠে বসল রানা, চালু করল ইঞ্জিন।
পাহাড়ি চাতালটায় পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। গাড়ি থামাতেই ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এল অ্যালি, উঠে বসল পাশে। চেহারায় স্বস্তি।
‘কিছু পেলে?’ জিজ্ঞেস করল ও।
‘বলার মত কিছু না,’ রানা মাথা নাড়ল। ‘অন্তত আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘আমাকে দেখালে হয়তো…’
‘হ্যাঁ, দেখাব। তবে বেশি সময় নেয়া যাবে না। টাওয়ারটার কাছে যাবার পর ঠিক দু’মিনিট সময় পাবে তুমি, এরপরেই এই এলাকা ছেড়ে চলে যাব আমরা। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে।’
.
যাত্রার প্রথম তিন-চার মাইল… মানে, টাওয়ারটা দৃষ্টিসীমায় উদয় হবার আগ পর্যন্ত… আনন্দ ছাড়া আর কিছু অনুভব করল না অ্যালি। এই আনন্দ রানাকে ফিরে পেয়েছে বলে… পাহাড়ি জঙ্গলে একাকী লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে না বলে। যদিও খুব বেশি সময়ের জন্যে ওখানে থাকতে হয়নি অ্যালিকে তারপরেও অভিজ্ঞতাটা সুখকর ছিল না ওর জন্যে। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল দুশ্চিন্তা, ভয় আর উদ্বেগ। কেমন যেন হিম হয়ে আসছিল শরীর। অথচ রানাকে দেখা মাত্র কেটে গেছে সবকিছু!
অদ্ভুত এক মানুষ এই মাসুদ রানা। ওর দিকে তাকালেই ভরসা পায় অ্যালি, সাহস পায়। কেন, তা জানে না। মানুষটার মন পড়তে পারে অ্যালি, কিন্তু তারপরেও তাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না। শক্ত এক খোলসের ভেতর যেন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে রানা, সেখানে অন্তর্যামীরও প্রবেশাধিকার নেই। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পারে অ্যালি, এই মানুষটাকে বিশ্বাস করলে ঠকতে হবে না। যত ঝড়-ঝাপটা আসুক, যত বিপদ আসুক… রানা ওকে আগলে রাখবে, রক্ষা করবে—পিতার মত, ভাইয়ের মত, বন্ধুর মত।
এসব নিয়েই ভাবছিল অ্যালি, হঠাৎ সামনে ভেসে উঠল টাওয়ারের আবছা কাঠামো। সঙ্গে সঙ্গে হাসি-খুশি ভাবটা দূর হয়ে গেল ওর ভেতর থেকে, সে-জায়গা দখল করল ভয় আর অনিশ্চয়তা। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ‘ বেকারফিল্ডের টাওয়ারটা দেখে।
ওর পরিবর্তনটা লক্ষ করেছে রানা। জিজ্ঞেস করল, ‘উল্টো ঘুরব?’
মাথা নাড়ল মেয়েটা। জোর করে তাড়াতে চাইছে ভয়। ‘না, সংক্ষেপে বলল ও।
.
গাড়ি থেকে নামতেই মাটির কম্পন অনুভব করল অ্যালি। জুতোর তলা ভেদ করে উঠে আসছে যেন কম্পনটা—পা বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে।
‘খারাপ লাগছে?’ ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রানা।
‘ন্… না। আমি ঠিক আছি।’
কালো সিলিণ্ডারটার ওপর দৃষ্টি আটকে গেছে অ্যালির। এমনিতেই টাওয়ারটা দেখে ভয় করছে ওর, সিলিণ্ডারটা যেন আরও বেশি ভীতিকর। বড় করে শ্বাস নিল ও। মনে হলো ফুসফুস ঠিকমত বাতাস পাচ্ছে না। টাওয়ারের গোড়া লক্ষ্য করে পায়ে পায়ে এগোতে শুরু করল। দুনিয়া যেন দুলছে চোখের সামনে। ঘাড় ফিরিয়ে রানার দিকে তাকাল—ফেলে আসা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সে, কেউ ধাওয়া করে আসছে কি না বোঝার চেষ্টা করছে। ওকে ডাকল না অ্যালি। এ-কাজটা ওকে একাই করতে হবে।
কী করতে হবে, তা জানে অ্যালি। কীভাবে জানে, তা বলতে পারবে না। হতে পারে এটা আরেকটা কণ্ডিশনাল রেসপন্স। কাজটা করতে একদম ইচ্ছে করছে না ওর, কিন্তু কোনও উপায় নেই। অজানা এ-ভয়কে জয় করতেই হবে ওকে। গত দু’মাস থেকে ঘুরপাক খেতে থাকা প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে পেতে হবে। তাই সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে চলল ও। টাওয়ারের একদম তলায় গিয়ে থামল। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে হাত রাখল ওটার গায়ে।
মাটির কাঁপুনি এতক্ষণ গুঞ্জন’ তুলছিল অ্যালির কিন্তু এবার যেন সেটা লাউডস্পিকারের আওয়াজে পরিণত হলো। সারা শরীর কেঁপে উঠল ওর। অস্থিমজ্জা বুঝি থরথর করছে! নিজের অজান্তেই শব্দ করে উঠল ও—ফুঁপিয়ে উঠল… আর্তনাদ করল। রানার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল পরক্ষণে। ছুটে আসছে ওর দিকে। কী করতে চাইছে, তা পড়ে নিতে অসুবিধে হলো না। কাছে এসে ওকে সরিয়ে নিতে চাইছে টাওয়ারের পাশ থেকে।
‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল অ্যালি।
পেছনে এসে থেমে গেল রানা। পায়ে পায়ে চলে এল ওর পাশে।
‘অ্যালি…..’
মাথার ভেতর অদ্ভুত একটা চিন্তা উদয় হলো অ্যালির বুঝতে পারল, নড়াচড়া করা চলবে না ওর। এভাবেই টাওয়ারের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না কিছু ঘটছে। চিন্তাটায় বিস্মিত হলো ও। মানে কী এর? কী ঘটবে?
‘অ্যালি?’ আবার ডাকল রানা।
‘কিছু করতে যেয়ো না,’ ওকে বলল অ্যালি। ‘আমি ঠিক আছি।’
কী যেন বলল রানা, ঠিক শুনতে পেল না। চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেছে রৌদ্রালোকিত মরুভূমি, যেন হাজারো কণ্ঠস্বর আর ছবিতে ভরা নতুন দুনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে ও। নানা ধরনের ছবি ভাসছে অ্যালির চোখের সামনে—মানুষ, পোষা কুকুর, গাড়ি, ঘরবাড়ি…
একটা ঝাঁকি খেল অ্যালি। ছবিগুলো কীসের, বুঝতে পারছে। কয়েক মাইল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শহরটার বিভিন্ন অংশ দেখা যাচ্ছে প্রতিটা ছবিতে। ওখানকার অধিবাসীদের ভাবনাচিন্তাই ছবি হয়ে ধরা দিচ্ছে ওর চোখে। কণ্ঠগুলোও তাদের। সবার চিন্তা একজোট হয়ে বাজছে ওর কানে। মনে হচ্ছে যেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ও।
রানার দিকে চোখ পড়ল অ্যালির— ঠোঁট নড়ছে ওর… কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোল্ড স্প্রিংসের বাসিন্দাদের চিন্তাভাবনার হল্লার মাঝে মিলিয়ে গেছে ওর কণ্ঠ। এক মুহূর্ত পর রানাও হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। নতুন দৃশ্য ভেসে উঠেছে অ্যালির সামনে। ঘোলা চোখে তাকাল মাটির দিকে—ওখানে যেন একটা ট্র্যাপডোর খুলে গেছে, উন্মুক্ত হয়ে গেছে একটা সুড়ঙ্গ।
সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়ল অ্যালির দৃষ্টি, মেইল ট্রেনের মত ছুটছে ভেতর দিয়ে। চারপাশে নানা ধরনের কেইবল—খড়খড় করে উঠছে, গুঞ্জন করছে…ঠিক টাওয়ারের ওপরে লাগানো কালো সিলিণ্ডারটার মত। হঠাৎ থমকে গেল অ্যালি।
কে যেন রয়েছে সামনে… সুড়ঙ্গের ও-মাথায়… আরেকজন মানুষ!
মানুষটার চিন্তাভাবনা পরিষ্কার পড়তে পাচ্ছে অ্যালি, দেখতে পাচ্ছে তার মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকা ছবিগুলো। তুষারে ছাওয়া উঁচু-নিচু পাহাড়… একটা সুইমিং পুল…. সাঁতার কাটতে থাকা দুটি নগ্ন মেয়ে… কম্পিউটার আর নানা ধরনের যন্ত্রপাতিতে ভরা বিশাল একটা কামরা…
‘দুই নম্বরের মড সিগনালে গোলমাল দেখতে পাচ্ছি, ‘ বলে উঠল লোকটা। ‘আরে! এ কী!’
ভীষণভাবে চমকে উঠেছে মানুষটা। ভয় পেয়ে গেছে।
‘হচ্ছে কী এসব? অ্যাই, কেউ মি. চার্লটনকে ডাকো! তাড়াতাড়ি!’
সুড়ঙ্গ ধরে পিছিয়ে এল অ্যালি। এবার নতুন একটা জায়গায় চলে এসেছে। সরু একটা গলি, সামনে একটা দরজা। চোখ পিটপিট করল ও। বুঝল, এটা ওর নিজের মনের অভ্যন্তর। দরজার ওপাশে রয়েছে বিশাল একটা কামরা, সেখানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা আছে ওর সব স্মৃতি। কিন্তু এ-মুহূর্তে ওখানে ঢোকার পথ রুদ্ধ। সাদাটে পর্দার মত কী যেন টানটান হয়ে ঝুলছে দরজায়—বাধা দিচ্ছে কামরায় ঢুকতে বা বেরুতে। অ্যালির চোখের সামনেই পর্দাটা ফুলে উঠল, যেন ভেতর থেকে কেউ ঠেলছে ওটা… পর্দা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
স্মৃতি… স্মৃতিদের কাণ্ড। ওরা মুক্তি চাইছে! অ্যালির মনে হলো, টাওয়ারটাই যেন ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছে ওদের। বেরিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছে। ঝাঁকুনিটা এখনও অনুভব করছে ও। সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে।
কাঁধে রানার স্পর্শ টের পেল অ্যালি—ওকে টানছে রানা, সরিয়ে আনতে চাইছে টাওয়ারের পাশ থেকে। হাতের মুঠো শক্ত করল ও, ছাড়া পেতে চাইছে না, আরেকটু সময় চাই ওর। সাদা পর্দাটার গায়ে আঁচড় পড়তে দেখছে ও, কী যেন বেরিয়ে আসতে চলেছে ওখান দিয়ে। আচমকা চোখ ধাঁধিয়ে গেল তীব্র আলোয়—ছিঁড়ে গেছে পর্দা। আলোটা কমে গেলে নতুন একটা চেহারা দেখল অ্যালি। সুন্দরী এক নারী—গায়ে সাদা অ্যাপ্রন, চোখে মমতা, ঠোঁটের কোণে হাসি।
‘হ্যালো, অ্যালি! কেমন আছ আজ?’ বলল সেই নারী।
একে চেনে অ্যালি। কী যেন নাম? মনের গভীরে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে শুরু করল।
রানার গলা আবছাভাবে শোনা গেল। ওকে টানছে সে, টাওয়ার থেকে হাত সরাতে বলছে। গলার স্বরে উদ্বেগ আর আকুতি। আর তখুনি মনে পড়ল নামটা।
টিফানি। সুন্দরী ওই যুবতীর নাম টিফানি।
শুধুই টিফানি? না, তা নয়। আর কিছু আছে তার পরে। কী সেটা? একে কোথায় দেখেছে ও? ভাবার চেষ্টা করল। দরজাটা আবার দেখতে পাচ্ছে সামনে। পর্দাটা আছে, তবে মাঝখানটা ছিঁড়ে দিয়েছে কে যেন। পা বাড়াল ও। পর্দা পেরিয়ে ঢুকতে শুরু করল কামরায়। খিঁচুনি উঠল ওর শরীরে, কিন্তু থামল না। এগিয়ে চলল প্রাণপণে।
নিজের হাতে রানার হাতের ছোঁয়া পেল অ্যালি, ওর আঙুলগুলো ছাড়িয়ে আনছে টাওয়ারের গা থেকে। পরমুহূর্তে হ্যাঁচকা এক টানে পেছনে ছিটকে পড়ল ও। খিঁচুনি থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে, যেন বিদ্যুতের একটা সুইচ অফ করে দেয়া হয়েছে। চোখের সামনে থেকে সরে গেল সব অপার্থিব দৃশ্য, টাওয়ারের পাদদেশে পড়ে রয়েছে ও—ওকে জাপটে ধরে রেখেছে রানা।
‘অ্যালি! কী হলো তোমার? তুমি ঠিক আছ?’
উঠে বসল অ্যালি। ঘুরে রানার মুখোমুখি হলো। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘টিফানি… টিফানি ক্যানট্রেল।
‘কী!’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না অ্যালি। মনে মনে সবকিছু সাজিয়ে নিচ্ছে ও—সব চিন্তা… সব স্মৃতি—যেন লাইব্রেরির তাকে সাজিয়ে রাখছে এলোমেলো একগাদা বই। ওর মনে পড়ে গেছে, কোথায় শুনেছে ওই নাম।