তিন
নিজের অফিসের প্রাইভেট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালেক্স লিয়ারি। মুঠোয় সেলফোন… এত শক্ত করে ধরেছে যে, ফোনের স্ক্রিনটা মড়-মড় করছে।
দক্ষিণমুখী ব্যালকনিটা বিল্ডিঙের একদম ওপরতলায়। ওখানে দাঁড়িয়ে সানসেট বুলেভার্ড থেকে পুরো লস অ্যাঞ্জেলেস দেখা যায়। লিয়ারির চোখের সামনে এখন মিটমিট করছে রাত্রিকালীন মহানগরীর শত-সহস্র বাতি। আলোকিত রাস্তাগুলো যেন শিরা-উপশিরার মত বিছিয়ে রয়েছে পুরো শহরের বুকে। কিন্তু কিছুই দেখছে না সে।
চোখ বন্ধ করে গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠা উদ্বেগটা গিলে ফেলার চেষ্টা করছে লিয়ারি… চেষ্টা করছে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে। মিনিটতিনেক আগে একটা ফোনকল পেয়ে সূচনা হয়েছে এর।
সিসকো-র দল মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলেছে!
উল্টো ঘুরল লিয়ারি। স্লাইডিং ডোর পেরিয়ে নিজের ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নামিয়ে রাখল ফোনটা। মনে মনে চাইছে, আবার বেজে উঠুক ওটা। খবর আসুক, সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার ব্যালকনিতে ফিরে গেল সে।
শঙ্কা আর উত্তেজনায় মুখের ভেতরটা বিস্বাদ ঠেকছে লিয়ারির। এমন অনুভূতি আগেও হয়েছে তার—জীবনে প্রথমবার মানুষ খুন করার পর। সেটা ত্রিশ বছর আগেকার ঘটনা—কলেজের পাট চুকিয়ে তখন সে আর্মিতে ঢুকবে বলে ঠিক করেছে। থাকত বস্টনে। এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে বেসবল গেম দেখতে গিয়েছিল, খেলাশেষে সবাই মিলে ফেনওয়ের একটা বারে গিয়ে ঢুকেছিল ফুর্তি করার জন্যে। মদ্যপান একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, কখন সবাই ওকে ফেলে বেরিয়ে গেছে, বুঝতে পারেনি। মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল… বিশেষ করে বারে পরিচয় হওয়া এক সুন্দরী মেয়ের কথা ভেবে। তার সঙ্গে খোশগল্প বেশ ভালই জমেছিল, ভেবেছিল মেয়েটাকে পটিয়ে বিছানায় নিয়ে যেতে পারবে। অথচ হুঁশ ফিরতেই নিজেকে পার্কিং লটে আবিষ্কার করল লিয়ারি—বারের লোকজন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। মেয়েটাও কেটে পড়েছে ওকে কিচ্ছু না বলে। খিস্তিখেউড় করতে করতে বাস স্টপের দিকে রওনা হলো সে, পথ হারিয়ে একসময় পৌঁছুল নদীর ধারে… হার্ভার্ড ব্রিজের কাছে। তলপেটের চাপ কমাবার জন্যে প্রস্রাব করার একটা জায়গা খুঁজছিল, এরপরেই ঘটল ঘটনাটা।
এত বছর পর সেসব আর পরিষ্কারভাবে স্মরণ করতে পারে না লিয়ারি। আবছাভাবে মনে পড়ে, একটা লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল… লোকটার পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তাকে আরেকজন মাতাল কিংবা ভবঘুরে ভেবেছিল। ঝগড়া বেধেছিল দু’জনের—কী নিয়ে, কে জানে! লিয়ারি নিজেই হয়তো বাধিয়েছিল। মাতাল হয়ে গেলে নিজের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না তার, সামান্যতম বিষয় নিয়ে যার-তার সঙ্গে লেগে যায়।
সে-রাতে স্রেফ ঝগড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি ব্যাপারটা, হাতাহাতিতে গড়িয়েছিল। কিল-ঘুষি আর লাথি ছুঁড়তে শুরু করেছিল দু’জনে। হঠাৎ কায়দামত প্রতিপক্ষের চোয়ালে একটা আঘাত হানতে পেরেছিল লিয়ারি, লোকটা সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায়। পড়ে যায় মুখ থুবড়ে। তার দিকে ফিরে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে, হাঁটতে শুরু করেছিল বিজয়ের আনন্দ নিয়ে। দশ মিনিট পর… দশটা ব্লক পেরিয়ে একটা চিন্তা এসেছিল মাথায়—ব্যাটা পানিতে পড়েনি তো? শরীরের নিচের অংশ মাটিতে পড়েছে, কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু মাথা? উপুড় হয়ে পড়তে দেখেছে, যদি মুখটা পানিতে পড়ে থাকে…
খুঁতখুঁতানি লেগে গেল লিয়ারির মনে। কেন যেন মনে হলো, পানিতে পড়ার মত একটা আওয়াজ শুনেছিল। ফিরে যাবার সাহস পেল না। যদি অমন কিছু ঘটে থাকে, ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। একটা বাস ধরে ফিরে গেল নিজের ডরমিটরিতে। নিজেকে প্রবোধ দিল, পানির আওয়াজ শোনেনি… ওসব ওর কল্পনা। কিন্তু রাতভর দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না সে।
পরদিন দুপুরে পাওয়া গেল দুঃসংবাদ। টিভির খবরে বলা হলো, নদীর ধারে এক গ্র্যাড স্টুডেন্টের লাশ পাওয়া গেছে—পানিতে ডুবে মরেছে সে। পুলিশের সন্দেহ, মারধরের পর খুন করা হয়েছে তাকে। খুনির ব্যাপারে কেউ কিছু জানলে থানায় ফোন করতে বলা হলো। ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার দশা হলো লিয়ারির। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকল নানা রকম দুশ্চিন্তা—নদীর ধারে যেতে-আসতে কতগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরায় দেখা গেছে ওকে? ক্যাব- ড্রাইভার, বাসের কণ্ডাক্টর, আর রাতের পথচারীরা মিলে কতজন দেখেছে ওকে? ঘটনাস্থলে কিছু ফেলে আসেনি তো?
পরের কয়েক মাস মুখের ভেতরটা বিস্বাদই হয়ে রইল লিয়ারির—ঠিক যেমন এখন হচ্ছে। লক্ষণটা মস্ত বিপদে পড়ার… সেই ধরনের বিপদ, যেখানে অপেক্ষা ছাড়া নিজের কিছু করার থাকে না।
সেলফোন বেজে উঠল। দ্রুত পায়ে টেবিলের কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে ওটা তুলে নিল লিয়ারি।
‘আশা করি ভাল খবর দেবার জন্যে ফোন করেছ, সিসকো।’
‘শহরে চিরুনিতল্লাশি চালাচ্ছে আমাদের টিম,’ ওপাশ থেকে জানাল টিম লিডার সিসকো। ‘কিছু পেলেই আমাকে জানাবে। আমি আর শ্যাভেজ এসেছি মাসুদ রানার কটেজে। ও এখানে নেই।’
‘রিসোর্টে ঢুকলে কীভাবে? গেটে কী বলেছ?’
‘গেট দিয়ে ঢুকিনি। বাউণ্ডারি টপকে।’
‘কেউ দেখতে পায়নি তো? কটেজ খুঁজে পেতে নিশ্চয়ই সময় লেগেছে?’
‘উঁহুঁ। কি-কার্ডের গায়ে কটেজ নাম্বার দেয়া ছিল। আমরা সতর্ক ছিলাম। কটেজে ঢুকে সব পর্দা টেনে দিয়েছি। ভেতরের বাতি জ্বালিনি, টর্চ জ্বেলে তন্ন তন্ন করে সার্চ করেছি। অবশ্য… লোকটা ফিরে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এলে এতক্ষণে চলে আসত। বিচের খুব কাছেই রিসোর্ট। এত সময় লাগার কথা না। বোধহয় ওয়ালেট খোয়া যেতে দেখে বিপদ আঁচ করেছে।’
‘ওই লোক যদি মেয়েটাকে সাহায্য করে, কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?’
‘খুবই বিশ্রী টাইপের সমস্যা… বলতে বাধ্য হচ্ছি।’ চোয়াল শক্ত হলো লিয়ারির। ‘ব্যাখ্যা করো।’
‘ওয়ালেটে ভিজিটিং কার্ড আছে,’ বলল সিসকো। ‘লোকটার নাম মাসুদ রানা। ম্যানেজিং ডিরেক্টর অভ রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। একটা আই.ডি. কার্ডও আছে—নুমা, মানে ন্যাশনাল আণ্ডারওয়াটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সি থেকে ইস্যু করা। সে ওখানকার অনারারি প্রজেক্ট ডিরেক্টর। মানেটা বুঝতে পারছেন? একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর… নিশ্চয়ই অস্ত্রশস্ত্র চালাতে জানে। নুমার সূত্রে সরকারের ওপরের লেভেলেও ভাল কানেকশন থাকার কথা। একে আণ্ডার-এস্টিমেট করা একদম ঠিক হবে না।’
নিচু গলায় গাল বকে উঠল লিয়ারি। ‘এ-লোক এল সেডেরোয় কী করছে?’
‘এখনও জানি না। আমাদের কপাল খারাপ, দুনিয়ায় এত লোক থাকতে মেয়েটা কিনা গিয়ে পড়ল এরই হাতে! সাধারণ কোনও সিভিলিয়ান হলে সহজে সামাল দেয়া যেত।’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল লিয়ারি। একটা হাতে আঁকড়ে ধরেছে ব্যালকনির রেলিং। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সামনে বিস্তৃত মহানগরীর মিটমিটে আলোর দিকে।
‘স্যর?’ ডাকল সিসকো!
জবাব দিল না লিয়ারি। ঠাণ্ডা মাথায় খতিয়ে দেখছে সমস্যাটা। মেয়েটা উধাও, তাকে সাহায্য করছে একজন দক্ষ প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। কতটা দক্ষ? খোঁজ নেয়া দরকার। তবে যতটুকু শুনেছে, তাতেই বুঝতে পারছে, মোটামুটি কঠিন একজন প্রতিপক্ষ উদয় হয়েছে রঙ্গমঞ্চে।
‘কটেজটা ভাল করে সার্চ করো,’ শান্ত গলায় নির্দেশ দিল সে। ‘রানার লাগেজ, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র… সবকিছু ভাল করে দেখবে।’
‘শ্যাভেজ সে কাজেই ব্যস্ত।’
‘সাহায্য করো ওকে,’ বলে লাইন কেটে দিল লিয়ারি। একটু অপেক্ষা করে ডায়াল করল নতুন একটা নাম্বারে।
কয়েকবার রিং হবার পর ওপাশ থেকে শোনা গেল একটা ঘুম-জড়ানো কর্কশ গলা। ওয়াশিংটনে এখনও ছ’টা বাজেনি।
‘আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্যে দুঃখিত,’ বলল লিয়ারি।
‘কেন ফোন করেছ, বলে ফেলো।’
লোকটা সোজা কথার মানুষ, ঘোরপ্যাচের মধ্যে নেই। তাকে এজন্যে পছন্দ করে লিয়ারি। তবে পত্র-পত্রিকা আর টেলিভিশনে তাকে নিতান্তই আহাম্মকের ভূমিকায় উপস্থাপন করা হয়। যারা করে, তারা লোকটার সত্যিকার পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানে না। ঝটপট তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে বিফ করল লিয়ারি—কোনও ধরনের লুকোছাপার মাঝে গেল না। ওর কথা শেষ হলে ওপাশে নেমে এল নীরবতা। খানিক পর শোনা গেল গ্লাসে কিছু ঢালার আওয়াজ। পানি নয়, বুঝতে পারল লিয়ারি এ-পরিস্থিতিতে আরও কড়া কিছু প্রয়োজন হয় মানুষের।
‘এখন কী চাও তুমি?’
‘স্যাটেলাইট কাভারেজ দরকার আমার,’ জানাল লিয়ারি। ‘সবগুলো মিরাণ্ডা চাই। আমার হাতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে ওগুলোর। হোমল্যাণ্ড সিকিউরিটি আর ডিপার্টমেণ্ট অভ ডিফেন্স যেন নাক গলাতে না আসে। আমি যতক্ষণ না বলছি, ওদেরকে কিছুই জানানো যাবে না।’
টেলিফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ হলো, সম্ভবত সোফায় বসেছে সে। ‘ওপরে কথা বলতে হবে আমাকে,’ বলল লোকটা। কতটা সময় লাগবে, তা আর জানতে চাইল না লিয়ারি। লোকটার ওপরে খুব বেশি মানুষ নেই।
‘আমি আপনাকে আবার ফোন করব,’ বলল সে। ‘পনেরো মিনিট পর।’