অন্তর্যামী – ৩৬

ছত্রিশ

বরফশীতল পানির স্পর্শে চেতনা ফিরে এল রানার। ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যেতে চাইল দেহ, বুকের ভেতর যেন দামামা বাজছে! ঠকঠক আওয়াজ তুলে মেঝেতে আছড়ে পড়ল একটা বালতি। চোখ খুলল ও। ফার্মহাউসের ডাইনিং রুম, হাতে হাতকড়া, বসিয়ে রাখা হয়েছে একটা চেয়ারে। ডাইনিং টেবিলটা একপাশে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, রানা এখন কামরার ঠিক মাঝখানে।

ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালি, তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।

প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত দ্বিধায় কাটল। কীভাবে এখানে এল, বুঝতে পারছে না রানা। আবছাভাবে হেলিকপ্টার ক্র্যাশের কথা মনে পড়ছে, এরপর ও হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েছিল সাদা ধোঁয়ার মেঘটার ভেতর… কেন? কেন করতে গেল ও-কাজ? চোখ বুজে ভাবতে চাইল ও। হঠাৎ খাড়া হয়ে গেল শিরদাঁড়া। কারণটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হয়ে উঠেছে পুরোপুরি। চোখ মেলে অ্যালির দিকে তাকাল। কৌতূহল নিয়ে ওকে দেখছে মেয়েটা।

এক দেখাতেই বুঝল রানা, এই অ্যালি সেই অ্যালি নয়। বিশাল এক পরিবর্তন ঘটে গেছে মেয়েটির মাঝে। বদলে গেছে চাহনি, হাবভাব। অসহায়, ভয়ার্ত বা স্নেহের কাঙাল কোনও কিশোরী দাঁড়িয়ে নেই ওর সামনে। জানতে ইচ্ছে হলো, পুরনো অ্যালি… যে-অ্যালিকে ও চেনে…. তার কিছু কি অবশিষ্ট আছে এই মেয়েটির মাঝে?

রানার চিন্তা পড়তে পেরে একটু যেন কৌতুকের ছায়া পড়ল অ্যালির চোখে। পরক্ষণে সেখানে ভর করল শীতলতা।

‘টিফানিকে যেতে দিতে হয়েছে,’ বলল সে। গলার স্বর নরম, কিন্তু আবেগহীন। ‘ওকে থামালে তুমি সব বুঝে ফেলতে। সতর্ক করে দিতে হেলিকপ্টারটাকে।’

একপাশে সরিয়ে রাখা টেবিলটার দিকে গেল অ্যালি, তুলে নিল একটা সেলফোন। রানারটাই। কাছে এসে বাড়িয়ে ধরল রানার দিকে।

‘টিফানির নাম্বার জানো তুমি। ওকে কল করো। বলো, ফার্মহাউসে ফিরে আসা নিরাপদ।’

‘সরি, অ্যালি,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘আমি ও-কাজ করব না। চাইলে জোর খাটাতে পারো, কিন্তু নিজ থেকে আমি ফোন করছি না কিছুতেই।’

থমথমে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল অ্যালি। মনে হলো, লক করতে চলেছে। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পেরিয়ে গেলেও কিছু ঘটল না। হঠাৎ করে টিফানিকে ফোন করার কোনও ইচ্ছে জাগ্রত হলো না রানার মাঝে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অ্যালি। বলল, ‘জোর করে কথা বলালে সেটা যথেষ্ট কনভিন্সিং না-ও হতে পারে। আমি চাই, তুমি স্বেচ্ছায় ফোনটা করবে।’

‘অসম্ভব। তুমি খামোকা সময় নষ্ট করছ। আমি ফোন করব না।’

‘আমার ধারণা, তুমি করবে,’ বলল অ্যালি। কণ্ঠে মিশে আছে বিষাদের সুর। টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল ফোনটা। এক পলকের জন্যে ওটার পাশে একটা সার্জিক্যাল স্কালপেল দেখতে পেল রানা।

‘যদি ভেবে থাকো, টর্চার চালিয়ে আমাকে রাজি করাতে পারবে,’ বলল ও, ‘তা হলে মস্ত ভুল করছ।’

‘না, করছি না,’ বলল অ্যালি। ‘আমি জানি, নির্যাতন সহ্য করার সব ধরনের কৌশল জানা আছে তোমার। নির্যাতনের মুখে যাতে ভেঙে না পড়ো, সেজন্যে আলাদা ট্রেইনিং দেয়া হয়েছে তোমাকে।’ হাসল মৃদু। ‘তবে ওতে এক জায়গায় খুঁত রয়ে গেছে। নির্যাতনের বিশেষ একটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে তুমি দুর্বল।’

‘যা খুশি করতে পারো, আমি ফোন করছি না।’

‘ভুলটা ওখানেই করছ তুমি, রানা। আমি কিছু করব না। করবে তুমি… আমার সঙ্গে।’

ভ্রূকুটি করল রানা, কথাটার অর্থ বুঝতে চাইছে।

এগিয়ে এসে ওর কোলের ওপর দু’পা ছড়িয়ে বসে পড়ল অ্যালি। দু’হাত দিয়ে ধরল ঘাড়ের পেছনটা। মুখটা চলে এল রানার মুখের ছ’ইঞ্চি দূরে।

‘আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ, রানা,’ বলল সে। ‘যা কিছু করেছ আমার জন্যে… এরপর তোমাকে কষ্ট দিতে ভাল লাগবে না আমার। তাই বলছি, এখনও সময় আছে, টিফানিকে ফোন করো। ব্যাপারটা নোংরা হবার আগেই।’

চুপ করে রইল রানা।

‘বেশ,’ বড় করে শ্বাস ফেলল অ্যালি। ওর দু’হাত নেমে গেল চেয়ারের পেছনে। কয়েক মুহূর্ত পরেই ক্লিক করে আওয়াজ হলো—হ্যাণ্ডকাফের তালা খুলে গেছে। রানার দু’হাত মুক্ত হয়ে গেল।

কোল থেকে উঠে দাঁড়াল অ্যালি। পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল টেবিলের কাছে। পেছনে হাত দিয়ে তুলে আনল স্কালপেল। ধারালো ফলাটা দেখল বাতির আলোয়।

দ্রুত হিসেব কষে নিল রানা— ছ’ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। ঝাঁপ দিলে ওটুকু পেরুতে এক সেকেণ্ডও লাগবে না, চোয়াল বরাবর এক ঘুসিতে অজ্ঞান করে ফেলা যাবে অ্যালিকে। ভেরোনিকা কোথায় কে জানে, কিন্তু তাকে নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে…

ভাবনাটা শেষ হবার আগেই নিজের ভেতর পরিবর্তন অনুভব করল ও। কিছু করার ইচ্ছে যেন উড়ে গেল দমকা বাতাসে।

‘অযথা ভাবছ,’ বলল অ্যালি। ‘তোমার যে-কোনও প্ল্যান আমি দানা বাঁধার আগেই ঝেঁটিয়ে দূর করতে পারি।’

আবারও সেই বিষাদের সুর ফুটে উঠেছে ওর গলায়। কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা বিরাজ করল।

‘কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর স্কালপেলটা কেড়ে নিয়ে তুমি আমাকে আক্রমণ করবে,’ এবার বলল অ্যালি। ‘না করে উপায় থাকবে না তোমার।’

অপলক চোখে তাকিয়ে রইল রানা। মুখ ফুটে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যা বলতে চায় তা মেয়েটা এমনিতেই শুনতে পাচ্ছে।

‘একটামাত্র ফোন করে এসব এড়াতে পারো তুমি,’ ওকে বলল অ্যালি।

‘আমার মন পড়তে পারছ তুমি,’ বলল রানা। ‘তারপরেও বুঝতে পারছ না, আমি কিছুতেই কাজটা করব না?’

‘এ-মুহূর্তে কী ভাবছ, তা জানি। কিন্তু ত্রিশ সেকেণ্ড পর কী ভাববে, তা জানি না। তুমিও জানো না।’

‘জানি। টিফানিকে আমি ডাকব না।’

‘দেখা যাক।’

পরমুহূর্তে ঘটল ব্যাপারটা। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের মত অনুভূতিটা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। ভয়াবহ এক ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল রানা। দুনিয়া অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে, অ্যালিকে ছাড়া আর কিচ্ছু দেখতে পেল না ও। জেগে উঠল তীব্র ঘৃণা, জিঘাংসা! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, ক্রুদ্ধ হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটার ওপর, হাত থেকে কেড়ে নিল স্কালপেলটা।

চিৎকার করে উঠল অ্যালি। আতঙ্কে চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। ধাক্কা দিয়ে ওকে টেবিলের ওপর আধশোয়া করে ফেলল রানা। স্কালপেল চালাল ওকে লক্ষ্য করে। শেষ মুহূর্তে দু’হাত তুলে বাধা দিল মেয়েটা। গায়ে লাগল না আঘাত, তার বদলে বাম বাহুতে পড়ল ধারালো ফলার আঁচড়। কেটে গেল ওর শার্টের হাতা আর চামড়া, গভীর একটা ক্ষত সৃষ্টি হলো। তাজা রক্ত বেরিয়ে এল গলগল করে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল অ্যালি।

রক্ত দেখে আরও যেন উন্মাদ হয়ে উঠল রানা। থাবড়া দিয়ে সরিয়ে দিল অ্যালির দু’হাত, বাম হাতে মুঠো করে ধরল ওর চুল। হ্যাঁচকা টান দিতেই পেছন দিকে হেলে গেল মেয়েটার মাথা, উন্মুক্ত হয়ে গেল গলা। সেদিকে স্কালপেল নিয়ে গেল রানা—জবাই করতে চলেছে অ্যালিকে! একদম শেষ মুহূর্তে… ফলাটা যখন গলার চামড়া স্পর্শ করেছে… সব. বদলে গেল আবার।

বানভাসী খড়কুটোর মত সব ক্রোধ ভেসে গেল রানার ভেতর থেকে। যেন একটা সুইচ টিপে বন্ধ করা হয়েছে কোনও যন্ত্র। চমকে উঠল ও, হাত থেকে স্কালপেল ফেলে দিল, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত ছিটকে গেল পেছনদিকে। থামল না, পেছাতে পেছাতে কামরার দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেল, পারলে দেয়ালের ভেতরেই সেঁধিয়ে যেতে চায়। চোখজোড়া যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে, বিশ্বাস করতে পারছে না নিজেকে। দেয়ালে পিঠ ঘষটে বসে পড়ল মেঝেতে।

ক্ষণিকের জন্যে যেন পশু হয়ে গিয়েছিল, রানা। অনুভূতিটা এখনও থিকথিকে পদার্থের মত লেপ্টে রয়েছে শরীরে, দূর করতে পারছে না। কী করতে চলেছিল, তা ভাবলেই কেঁপে উঠছে। বাচ্চা একটা মেয়ে… নিরস্ত্র… কসাইয়ের মত তার গলায় ছুরি চালাতে যাচ্ছিল ও! একবিন্দু প্রতিরোধ অনুভব করেনি বিবেকের!

দরজার বাইরে পায়ের আওয়াজ। শোনা গেল ভেরোনিকার গলা।

‘অ্যালি…’

কনুইয়ে ভর দিয়ে একটু উঁচু হলো অ্যালি। গলা চড়িয়ে বলল, ‘আমি ঠিক আছি। তুমি পাহারায় থাকো।

পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল।

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল অ্যালি। বাহুর ক্ষতটা পরীক্ষা করল—বেশ গভীর, রক্ত পড়ছে। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে পেঁচিয়ে বাঁধল জায়গাটা। তারপর চেয়ার টেনে ন বসল রানার মুখোমুখি।

‘টিফানিকে ফোন করো,’ ঠাণ্ডা গলায় বলল সে।

‘আ… আমি পারব না।’

‘নিশ্চয়ই পারবে!’

‘না!’ মাথা নিচু করে রেখেছে রানা। অ্যালির দিকে তাকাতে পারছে না।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল অ্যালি। এরপর যখন কথা বলল, বেশ নরম শোনাল ওর কণ্ঠ।

‘কলোরাডোর লুসেরো বলে কোনও জায়গা চেনো?’

মাথা নাড়ল রানা।

‘আমার মা বলত ওই জায়গাটার কথা… সবসময়। ছোটবেলায় নানা-নানুর সঙ্গে ওখানে ক্যাম্পিঙে গিয়েছিল মা। পাহাড়ি এলাকা, ঘোড়ায় চড়া যায়, ক্লাইমিং করা যায়… একটা লেক আছে, সেখানে ক্যানু ভাড়া করে ভেসে বেড়ানো যায়। মায়ের কাছে স্বর্গের মত লেগেছিল জায়গাটা। বিশেষ করে রাতের বেলা লেকটা নাকি অদ্ভুত দেখাত। পানির ওপর কুয়াশা ভাসত, তখন ক্যানু নিয়ে বেরুলে মনে হতো মেঘের রাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। টিফানিকে মেসেজটা পাঠাবার আগে মা আমাকে শেষ কী কথা বলেছিল, জানো? বলেছিল, ফোর্ট ডেট্রিক থেকে ছাড়া পেলে সবার প্রথমে আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে। রাতের বেলায় ক্যানুতে চড়ে লেকে বেড়াব আমরা।’

গলা ধরে এল অ্যালির।

‘খুব বেশি কিছু তো চায়নি আমার মা,’ বলল সে। ‘বন্ধনহীন স্বাভাবিক একটা জীবন… যাতে ইচ্ছে হলেই আমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারে। সেটা কি তার অন্যায় ছিল?’

গলা খাঁকারি দিল রানা। ‘টিফানি জানত না তোমার মায়ের ভাগ্যে অমন কিছু ঘটবে। ও তো…’

‘কিছু জানার প্রয়োজনও ছিল না ওর। ছোট্ট একটা অনুরোধ করেছিলাম আমি—বাইরের কারও সঙ্গে একটু কথা বলার জন্যে। সেটা কি খুব কঠিন?’

‘ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও ভয় পেত।’

‘অন্য কেউ আমার সঙ্গে বেঈমানী করেনি, রানা। টিফানি করেছে।’

‘তার জন্যে ওর অনুতাপের শেষ নেই। ও ভাবতে পারেনি, ব্যাপারটার পরিণাম এত ভয়াবহ হবে …

‘আমি শেষ পর্যন্ত ওখানে গেছি, রানা… লুসেরোতে। বছরখানেক আগে। এখনও ক্যানু ভাড়া দেয় ওরা। রাতের বেলাতেও।’

‘টিফানি তোমার মাকে খুন করেনি, অ্যালি,’ মরিয়া কণ্ঠে বলল রানা। ‘যারা করেছে, তারা সবাই মারা গেছে। তুমি তাদেরকে খুন করে প্রতিশোধ নিয়েছ। এমনকী লিয়ারিও মারা গেছে হেলিকপ্টার ক্র্যাশে। ব্যাপারটা চুকেবুকে গেছে!’

‘না, যায়নি!’ চোখজোড়া জ্বলে উঠল অ্যালির। চোয়াল শক্ত হলো। ‘ডাকো ওকে।’

‘তুমি জানো, আমি সেটা করব না।

‘মত পাল্টাতে পারো তুমি। আরও অনেক কিছুই আছে, যা আমি তোমাকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারি। আমার সঙ্গে ওসব করার চেয়ে মরে যেতে ইচ্ছে হবে তোমার। কেমন হবে, যদি সেসময় আমার জায়গায় তোমার প্রিয় লুবনা আভান্তিকে দেখতে পাও? সহ্য করতে পারবে?’

কেঁপে উঠল রানা। শিউরে উঠেছে শরীর।

‘ফোন করো,’ থমথমে গলায় বলল অ্যালি।

‘না, প্লিজ! আমাকে বাধ্য কোরো না।’

‘দুটো পথ তোমার সামনে, রানা। হয় আমার কথা শুনবে, নয়তো…’

‘তারচেয়ে মেরে ফেলো আমাকে। আত্মহত্যা করাও। আমি তাতেও রাজি।’

‘না, রানা। আর যা-ই করি, আমি তোমাকে খুন করতে পারব না।’

কথাটায় পুরনো অ্যালির সুর খুঁজে পেল রানা। স্মৃতিভ্রষ্ট অ্যালি… সহজ-সরল অ্যালি… যে সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে বিশ্বাস করেছিল ওকে, ভালবেসেছিল। মনের কোণে আশার আলো উঁকি দিল ওর। সেই অ্যালি যদি এখনও বেঁচে থাকে এই অ্যালির মাঝে, তা হলে হয়তো সব শেষ হয়ে যায়নি। টিফানিকে হয়তো বা ক্ষমা করতে পারবে সে।

‘এতটা নিশ্চিত হয়ো না,’ বলল অ্যালি।

‘আমি আশাবাদী মানুষ,’ মলিন হাসি হেসে বলল রানা।

‘তা হলে ডাকো টিফানিকে।’

‘না, অ্যালি। আমি ডাকব না। যা খুশি করতে পারো তুমি… করাতে পারো আমাকে দিয়ে। কিন্তু জেনে রেখো, যদি জঘন্য কিছু করাও, আত্মহত্যা করব আমি। এখন না পারলে পরে। আজ নাহলে আগামীকাল। আমার মৃত্যুর জন্যে তুমি দায়ী হবে। তুমিই হবে আমার খুনি।’

রীতিমত জুয়া খেলছে রানা। দর কষাকষি করতে চাইছে নির্দয়, নিষ্ঠুর অ্যালির ভেতরে লুকিয়ে থাকা নরম মনের অ্যালির সঙ্গে।

ওর চোখে চোখ রেখে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল মেয়েটা। তারপর শ্বাস ফেলল শব্দ করে। বলল, ‘তা হলে আর একটা পথই খোলা রইল আমার সামনে।’

সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতর পরিবর্তন টের পেল রানা। যন্ত্রচালিতের মত উঠে দাঁড়াল ও। টেবিলের কাছে গিয়ে তুলে নিল ফোন, ডায়াল করল টিফানির নাম্বারে।

.

‘হেডলাইট!’ বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে জানাল ভেরোনিকা।

চোখ পিটপিট করল রানা, যেন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। হাতঘড়ি দেখল—কীভাবে জানি বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। কী করেছে এতক্ষণ, বলতে পারবে না। ওকে লক করে রেখেছিল অ্যালি।

‘শেভি ম্যালিবু,’ আবার শোনা গেল ভেরোনিকার গলা। ‘ড্রাইভওয়ে ধরে আসছে।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অ্যালি। দরজার দিকে এগোল।

‘এ-কাজ কোরো না, অ্যালি,’ পেছন থেকে বলল রানা। ‘তুমি এমন নও।’

`থামল অ্যালি। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল রানার দিকে। দৃষ্টি ভাবলেশহীন।

‘রাগ, ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা—এসব ওই ভেরোনিকা আর এলিনা ঢুকিয়েছে তোমার ভেতরে… তাও নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে,’ বলল রানা। ‘তোমার মা বেঁচে থাকলে তোমাকে এমন হতে দিত না।’

‘দুর্ভাগ্যক্রমে, রানা,’ করুণ গলায় বলল অ্যালি, ‘আমার মা বেঁচে নেই।’

জানালা আলোকিত হয়ে উঠল হেডলাইটের আলোয়। দরজা ঠেলে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল ও। হাঁচড়ে- পাঁচড়ে রানাও উঠে দাঁড়াল মেঝে থেকে, ওকে অনুসরণ করল।

বাড়ির সদর দরজা খুলে ধরে রেখেছে ভেরোনিকা। হাতে শটগান। অ্যালি দোরগোড়ায় পৌঁছুতেই সে তির্যক দৃষ্টি হানল কয়েক গজ পেছনে থাকা রানার দিকে। শটগান ঘোরাল ওদিকে।

‘ওর প্রয়োজন তো ফুরিয়ে গেছে, কী বলো?’

‘ওকে গুলি কোরো না!’ বলল অ্যালি।

বিস্ময় ফুটল ভেরোনিকার চেহারায়। ‘কেন?’

‘আমি বলছি, তাই।’

হুকুমের সুরে কথাটা বলল অ্যালি। নীরবে সেটা মেনে নিল ভেরোনিকা। লিয়ারির অনুমান তা হলে মিথ্যে ছিল না, ভাবল রানা। এখন আর ভেরোনিকার কথায় চলছে না মেয়েটা, বরং তার ইচ্ছে অনুসারে চলতে হচ্ছে ভেরোনিকাকে। শটগান নামিয়ে নিল সে। অ্যালিকে বেরিয়ে যেতে দিল, এরপর রানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি দূরে থাকো।’

ওদের পিছু পিছু বারান্দায় বেরিয়ে এল রানা। দাঁড়াল কয়েক হাত তফাতে। প্রান্তর থেকে ইতিমধ্যে মিলিয়ে গেছে ঘুমপাড়ানি গ্যাস। হেলিকপ্টারের ধ্বংসস্তূপটা জ্বলছে ধিকি ধিকি। টিফানির গাড়িটা থেমে গেছে বাড়ির সামনে এসে। সন্দেহ নেই, রেঞ্জের মধ্যে ওকে পাওয়ামাত্রই লক করেছে অ্যালি, বাধ্য করেছে আসতে। নইলে ক্র্যাশ করা হেলিকপ্টারটা দেখেই বিপদ আঁচ করার কথা ছিল টিফানির, উল্টো ঘুরে পালানো উচিত ছিল।

সিঁড়ি ধরে বারান্দা থেকে নেমে গেল ভেরোনিকা, শটগান তাক করে রেখেছে গাড়ির দিকে। অ্যালি গিয়ে দাঁড়াল সিঁড়ির মাথায়। হেডলাইট নিভে গেল, বন্ধ হলো গাড়ির ইঞ্জিন। দরজা খুলে নেমে এল টিফানি। ভেরোনিকার দিকে দৃষ্টিপাত করল না, মাথা তুলে সরাসরি তাকাল অ্যালির দিকে।

সময় যেন থমকে গেল হঠাৎ করে। সবকিছু স্থির হয়ে গেছে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে অ্যালি আর টিফানি, পলক ফেলছে না। টিফানির চেহারা বেদনার্ত, ঝুলে পড়েছে দু’কাঁধ—পরাজিত ভঙ্গিমা। মুখে কিছু বলছে না, কিন্তু অন্তরের ভাষায় যা বলছে, তা বুঝতে পারছে রানা পরিষ্কার। ক্ষমা চাইছে… দুনিয়ার সবচেয়ে নিখাদ ক্ষমাপ্রার্থনা, যেখানে কোনও অভিনয় নেই, কোনও ছলচাতুরি নেই, নেই কোনও লুকোছাপা। নিজের সমস্ত অপরাধবোধ আর অনুতাপ উজাড় করে দিচ্ছে টিফানি।

ভেরোনিকার চেহারায় বিভ্রান্তি ফুটতে দেখল রানা, পালা করে তাকাচ্ছে অ্যালি আর টিফানির দিকে। তার এই বিভ্রান্তির কারণ বুঝতে অসুবিধে হলো না। টিফানির ভাবনাগুলো পড়তে পারলেও অ্যালি সেগুলো কীভাবে নিচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছে না সে।

‘কী হলো?’ খানিক পর অধৈর্য গলায় বলে উঠল ভেরোনিকা। ‘অপেক্ষা করছ কেন?’

জবাব দিল না অ্যালি।

দু’পা এগিয়ে রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা, দশ ফুট দূর থেকে তাকাল অ্যালির দিকে। পাশ থেকে দেখছে, কিন্তু তাও পরিষ্কার দেখল, চোখ ছলছল করছে মেয়েটার।

সিঁড়ি ধরে এক ধাপ উঠে এল ভেরোনিকা। খ্যাপাটে গলায় বলল, ‘এটাই তুমি চাইছিলে, অ্যালি। ও অনুতপ্ত কি অনুতপ্ত নয়, তাতে কিছুই যায়-আসে না। নাহয় মন থেকেই ক্ষমা চাইছে, তাতে ও যে-অন্যায় করেছে, তা মুছে যাচ্ছে না।

এবারও অ্যালি নিরুত্তর। ভেরোনিকার দিকে ফিরেও তাকাল না, তাকিয়ে আছে টিফানির দিকে।

‘অ্যালি!’ চেঁচিয়ে উঠল ভেরোনিকা।

এবার নড়ে উঠল মেয়েটা। যেন সংবিৎ ফিরে পেয়েছে। চোখের পাতা ফেলে দূর করল ছলছল ভাবটা। তারপর তাকাল ভেরোনিকার দিকে।

‘শাস্তি পেতেই হবে ওকে,’ কঠিন গলায় বলল ভেরোনিকা। ‘কোনও ক্ষমা নেই। ক্ষমা দেখানো মানে হেরে যাওয়া।’

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল অ্যালি। এরপর ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল। ‘ঠিক বলেছ।’

স্বস্তি ফুটল ভেরোনিকার চেহারায়। ‘কীভাবে সারতে চাও কাজটা?’

শটগানের দিকে ইশারা করল অ্যালি। ‘ওটা ওর হাতে দাও।’

ক্রুর হাসি ফুটল ভেরোনিকার ঠোঁটে। এগিয়ে গিয়ে টিফানির দিকে বাড়িয়ে ধরল শটগান। অস্ত্রটা ধরার কোনও চেষ্টা করল না টিফানি। এখনও অ্যালির দিকে তাকিয়ে আছে সে, করুণা ভিক্ষা করছে। হঠাৎ বদলে গেল সে। পিঠ সোজা হয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে ভেরোনিকার হাত থেকে নিয়ে নিল শটগানটা। জীবনে কোনোদিন আগ্নেয়াস্ত্র ধরেছে কি না সন্দেহ, অথচ অদ্ভুত এক সাবলীলতা দেখা গেল ওর মধ্যে। সেফটি অফ করে স্লাইড রিলিজ চাপল। অ্যাকশন খুলে দেখে নিল, ভেতরে শেল আছে কি না। এরপর এক ঝটকায় আবার বন্ধ করল অ্যাকশন, কক করল শটগান।

মুখে হাসি নিয়ে পিছিয়ে এসেছে ভেরোনিকা—টিফানির আশুমৃত্যুর কথা ভেবে পুলকিত। আচমকা ওর দিকে অস্ত্রটা তুলল টিফানি, ট্রিগার চাপল। কান ফাটানো আওয়াজ হলো। বুলেটের আঘাতে উড়ে গেল ভেরোনিকার মাথার খুলির অর্ধেকটা। দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল তার প্রাণহীন দেহ।

থামল না টিফানি। আবার কক করল শটগান। ব্যারেল এবার ঘুরে গেল অ্যালির দিকে।

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল রানা।

‘এসব শেষ হওয়া দরকার,’ ফিসফিসাল অ্যালি।

সিঁড়ির ওপরের ধাপে বসে পড়ল ও। দু’হাঁটু ভাঁজ করে নিয়ে এল বুকের কাছে, হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। মাথা গুঁজল হাঁটুর ওপরে। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে এল টিফানি।

দুই লাফে সিঁড়িতে পৌঁছুল রানা। অ্যালির সামনে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে। পিঠ মেলে দিয়েছে বর্মের মত। সিঁড়ির একপাশে সরে গেল টিফানি, রানার বুকের তলা দিয়ে গুলি করতে চাইছে অ্যালিকে। রানাও সরল, আবারও আড়াল করল মেয়েটাকে।

‘থামো, অ্যালি!’ বলল ও। ‘এ-কাজ কোরো না। ছেড়ে দাও টিফানিকে।’

‘সব শেষ হওয়া দরকার,’ ভেজা গলায় বলল অ্যালি। ‘আমি চাই এসব চিরতরে শেষ হয়ে যাক। আমাকে মরতে দাও, রানা।’

‘না, অ্যালি। তোমাকে মরতে হবে না। সব এমনিতেই শেষ হয়ে গেছে।’

‘কিছুই শেষ হয়নি, রানা। রয়ে গেছে অনেকে। বেঁচে থাকলে আমাকে খুঁজে বের করবে ওরা।’

‘কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না। আমি সেটা দেখব—কথা দিচ্ছি। যতদিন বেঁচে আছি, তোমার কোনও ক্ষতি হতে দেব না। প্লিজ, এভাবে নিজেকে শেষ করে দিয়ো না। অন্তত আমার জন্যে হলেও বেঁচে থাকো। আরেক লুবনাকে আমি হারাতে পারব না কিছুতেই।’

কেঁপে উঠল অ্যালি, কাঁদতে শুরু করেছে। টিফানি থমকে গেল।

‘প্লিজ, অ্যালি!’ অনুনয় করল রানা। ‘আমার জন্যে তুমি বাঁচতে পারবে না?’

ওকে জড়িয়ে ধরল অ্যালি। কাঁদছে শব্দ করে। রানারও চোখ ভিজে উঠল। পেছন থেকে অস্ফুট আওয়াজ করে উঠল টিফানি, অ্যালির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল শটগান। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ওদের দিকে; তারপর ধীরে ধীরে উঠে এসে অ্যালির পাশে বসল। এবার রানাকে ছেড়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল অ্যালি দু’জনেই কাঁদছে অঝোরে।

কয়েক মিনিট কেটে গেল ওভাবে। কান্নার তোড় কমে – এল অ্যালির, মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে কেবল। টিফানির আলিঙ্গনে ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ল ও, যেন জ্ঞান হারিয়েছে।

সেলফোনের রিংটোন শুনতে পেল রানা—ডাইনিং রুমে বাজছে। ধরবে কি ধরবে না, দ্বিধায় ভুগল।

‘আমি আছি ওর সঙ্গে,’ নরম গলায় বলল টিফানি। মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল রানা। ডাইনিং রুমে গিয়ে রিসিভ করল কল।

‘হ্যালো?’

‘রানা? আমি ববি।’

‘এদিকে সব ঠিক আছে, ববি…’

‘দাঁড়াও, আগে আমার কথা শোনো,’ রানাকে বাধা দিয়ে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন তোমাকে বলতে বলেছেন, কেউ না আসা পর্যন্ত তোমরা যেন ফার্মহাউসে থাকো। ওকে? ওখান থেকে বেরিয়ো না। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করো।

‘আর কিছু?’

‘না। আবার বলছি, ফার্মহাউস থেকে বেরিয়ো না।’

‘এটাই মেসেজ?’

‘হ্যাঁ। টেক কেয়ার।’

লাইন কেটে গেল। ফোনটা পকেটে রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বারান্দায় ফিরল রানা। টিফানির বুকে অচেতনের মত পড়ে আছে অ্যালি, সেদিকে ফিরে তাকাল না। তার বদলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলাল বাড়ির চারপাশে।

‘রানা?’ ডাকল টিফানি।

জবাব দিল না ও। চোখ ছোট করে তাকাচ্ছে দূরে। পশ্চিমে, মাইলখানেক দূরে, একটা নিচু ঢালের ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে একজোড়া হেডলাইট। সেটার পেছনে আরও দু’জোড়া আলো দেখা গেল—খানিকটা দূরে, কিন্তু সেগুলোও যে এদিকে আসছে, কোনও সন্দেহ নেই। পুবে তাকাল, ওদিকেও একই অবস্থা। আঁধারের গায়ে ফুটে উঠেছে সারি সারি আলো। সব মিলিয়ে ডজনখানেক গাড়ি ছুটে আসছে ফার্মহাউস লক্ষ্য করে, লক্ষণটা ভাল নয়।

‘আমাদেরকে এখান থেকে সরে যেতে হবে,’ থমথমে গলায় বলল রানা। ‘এক্ষুণি।’

তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে অ্যালিকে দু’হাতের ভাঁজে তুলে নিল ও।

‘কেন?’ বিভ্রান্ত গলায় জানতে চাইল টিফানি।

‘শটগানটা নাও,’ বলল রানা। ‘গাড়িতে ওঠো। জলদি। ঝটপট সিঁড়ি ধরে নেমে গেল টিফানি, কুড়িয়ে নিল শটগানটা। এরপর এগোল গাড়ির দিকে।

‘প্যাসেঞ্জার সাইডে ওঠো,’ পেছন থেকে বলল রানা।

তা-ই করল টিফানি। ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসল। শটগানটা ঠেস দিয়ে রাখল কনসোলের সঙ্গে। নিচু হয়ে ওর কোলে অ্যালিকে তুলে দিল রানা। এরপর দৌড়ে গিয়ে উঠল ড্রাইভিং সিটে। ইগনিশনে চাবি লাগানোই রয়েছে, মোচড় দিয়ে চালু করল ইঞ্জিন।

‘কী হয়েছে, রানা?’ ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল টিফানি।

‘ববি মুরল্যাণ্ড ফোন করেছিল,’ তাকে বলল রানা।

‘তো?’

‘সিলভারফিন বলেনি। ওটা আমাদের পরিচয়-সঙ্কেত।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *