একুশ
ত্রিশ সেকেণ্ড আগ পর্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে ছিল লিরয় চার্লটন। নিজের অফিসের জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল সে, প্রসন্নচিত্তে তাকিয়ে ছিল নিচের ওঅর্কফ্লোরের দিকে। কয়েক বছর আগে, এই কম্পাউণ্ড যখন তৈরি করা হচ্ছিল, তখন বিল্ডিংটাকে বড় বড় ট্র্যাক্টরের গ্যারাজ হিসেবে ব্যবহার করত ইঞ্জিনিয়াররা। এখন আর ট্র্যাক্টরগুলো নেই, সে-জায়গায় তৈরি করা হয়েছে কাঁচঘেরা বারোটা রুম—ওপর থেকে একসঙ্গে সবগুলোই দেখতে পায় চার্লটন।
গুচ্ছ, বা ক্লাস্টারের আদলে বানানো হয়েছে রুমগুলো। মোট তিনটা ক্লাস্টার—একেকটা ক্লাস্টারে পরস্পরের সঙ্গে লাগোয়া চারটা করে রুম। ক্লাস্টারগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে স্থাপন করা তিনটা টেস্ট সাইটের প্রতিনিধিত্ব করছে—রেড সিটি, ওয়াইওমিং; কোল্ড স্প্রিংস, ইউটাহ্; এবং কুক ভ্যালি, নর্থ ডাকোটা। তিন সাইটে রয়েছে তিনটি অ্যান্টেনা।
জানালায় দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে মনে যে-প্রশান্তি অনুভব করে চার্লটন, তার তুলনা হয় না। প্রতিটা কাঁচের রুম বা স্টেশনে থাকে একজন করে কন্ট্রোলার-চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায়, মাথায় কণ্ডাক্টিভ জেলের সাহায্যে লাগানো থাকে কয়েকটা ইলেকট্রোড। লাল বাতি জ্বলে কামরায়, ডার্করুমের মত। আধো-আলোকিত পরিবেশটার সঙ্গে মাতৃজঠরের মিল খুঁজে পায় চার্লটন। দৃশ্যটা শান্তি জাগাবার মতই বটে। বিশেষ করে তার জন্যে—মোটাসোটা গড়নের খাটো, টাকমাথা একজন মধ্যবয়েসী মানুষ সে… তিন দশক আগে ডার্টমাথ থেকে সামান্য একটা ফিনান্সের ডিগ্রি নিয়ে যে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিল। জীবনের নানা মোড়ে ঠোকর খেতে খেতে, চরম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে… আজ সে এসে পৌঁছেছে এখানে। রবার্ট ওপেনহাইমার যেভাবে চোখে গগলস্ লাগিয়ে অ্যালামোগডো মরুভূমিতে অ্যাটম বোমার ক্ষমতা দেখেছিলেন, সেভাবেই আজ চার্লটন তার জানালা থেকে নিজের কাজের ফসল প্রত্যক্ষ করে। কে জানে, কোনও একদিন হয়তো তার নামও উচ্চারিত হবে ওপেনহাইমারের মত!
সাদার্ন অ্যাসোশিয়েটস্ যে-কাজটা করছে… এখানে, এবং এখানকার মত অন্যান্য সাইটে…
অন্যান্য সাইটে… সেটাকে শুধু রোমহর্ষক বললে কম বলা হয়। তাদের প্রস্তুতি ও আয়োজন রীতিমত ভীতিকর—অ্যান্টেনা, কন্ট্রোলার এবং আরেকটা জিনিস, যার কথা শুনলে লোকে ভয় পেয়ে যায়। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই চার্লটনের, ওটা নিয়ে তার ভেতরেও যথেষ্ট অস্বস্তি আছে। জিনিসটা পুরোপুরি তৈরি বলা চলে, যে- কোনোদিন মাঠে নামানো হবে, আর তখন সেটাকে ফেরাবার কোনও উপায় থাকবে না। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বড় ধরনের সবকিছুই প্রাথমিকভাবে ভয় করে লোকে, তাই বলে পিছিয়ে আসা চলে না। তা হলে আর দুনিয়ায় বড় বড় আবিষ্কারগুলো হতো না। আমরা পড়ে থাকতাম প্রস্তরযুগে।
এসব নিয়েই ভাবছিল চার্লটন, যখন গোলমালটা শুরু হলো। দু’নম্বর ক্লাস্টারের একটা সেকশনে কাজ করছিল মাইকেল শেফার্ড, আচমকা ধড়মড় করে উঠে বসল সে, হৈচৈ শুরু করল অ্যান্টেনা সাইট নিয়ে।
এখন, ত্রিশ সেকেণ্ডের মাথায়, তার পাশে পৌঁছেছে চার্লটন, শান্ত করার চেষ্টা করছে যুবকটিকে। চেহারা উদ্ভ্রান্ত হয়ে আছে মাইকেলের, টান দিয়ে খুলে ফেলেছে সব ইলেকট্রোড, কপাল আর একটা চোখের পাতা মাখামাখি হয়ে গেছে কণ্ডাক্টিভ জেলে।
‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল চার্লটন।
‘জানি না। মনে হলো… মনে হলো কেউ আমার কাছে পৌঁছুবার চেষ্টা করছে।’
‘মানে কী?’
‘মনে হলো, লাইনের ও-মাথায় রয়েছে কেউ… কোল্ড স্প্রিংসে। কানেকশনটা ধরে সে যেন এগিয়ে আসছিল আমার দিকে।’
অর্থহীন কথাবার্তা, মাইকেল নিজেও সেটা বুঝতে পারছে। তারপরেও পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারল না চার্লটন। কিছু একটা তো হয়েছে নিশ্চয়ই, নইলে এমন করবে কেন!
কী হতে পারে? একটু ভাবল চার্লটন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, গত কয়েক মাস ধরে ওপরমহল থেকে একটা কানাঘুষো ভেসে আসছে। কানাঘুষো অবশ্য সবসময়েই শোনা যায়, বিশেষ করে দুটো প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিষ্ঠান যদি একই কাজে নিয়োজিত হয়, নানা ধরনের উড়ো কথা ভেসে বেড়ানোই স্বাভাবিক। তবে সম্প্রতি যেটা শোনা গেছে, সেটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেবার মত নয়। শোনা গেছে, পুরো প্রজেক্টকে হুমকিতে ফেলে দিতে পারে, এমন একটা বিপদ নাকি উদয় হয়েছে হঠাৎ করে। বিভিন্ন সূত্র থেকে যতটুকু জানতে পেরেছে চার্লটন, তাতে বলা হয়েছে, ফোর্ট ডেট্রিকের অরিজিনাল প্রজেক্টের একটা ছেঁড়া সুতো নাকি রয়ে গেছে। বেঁচে যাওয়া এক সাবজেক্ট…. অল্পবয়েসী একটা মেয়ে… তাকে কবজা করেছে ফিল্ডিং-গেলারের লোকেরা… আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, অ্যালেক্স লিয়ারি। মেয়েটা ক্যালিফোর্নিয়ায় আছে বলে শোনা গেছে, কিন্তু তারপরেও তিন অ্যান্টেনা সাইটে যে-ধরনের টেস্টিং চলছে, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মেয়েটি। মোটামুটি এ-রকম একটা সতর্কবাণীই পেয়েছে চার্লটন।
থমথমে মুখে মাইকেলের দিকে তাকাল সে। জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক কী অনুভব করেছ তুমি? খুলে বলো দেখি।’
‘বললাম তো,’ কাঁধ ঝাঁকাল মাইকেল। ‘কেউ একজন ছিল ওখানে… একদম অ্যান্টেনাটার কাছে।
‘সেটা এই প্রথম ঘটছে না,’ গম্ভীর গলায় মনে করিয়ে দিল চার্লটন। ইতিপূর্বে কিছু দুষ্টু ছেলে-ছোকরা উদয় হয়েছিল অ্যান্টেনা সাইটে, নিজেদের মধ্যে বাজি ধরে অ্যান্টেনায় চড়ার চেষ্টা করেছিল ওরা।
‘এবারের অনুভূতিটা অন্যরকম,’ বলল মাইকেল। ‘পার্থক্যটা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না… তবে আমার মনে হলো, ওখানে এমন কেউ দাঁড়িয়ে আছে, যার থাকার কথা নয়।
ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা খতিয়ে দেখল চার্লটন। যে- হুমকির কথা বলা হয়েছিল, এটা সেটাই নয় তো? কীভাবে বুঝবে?
অ্যান্টেনার সঙ্গে কোনও সিকিউরিটি ক্যামেরা নেই। মরুভূমিতে কী ঘটছে, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানার উপায় নেই কোনও। ওয়াশিংটনে এক বন্ধু আছে চার্লটনের, তাকে বললে হয়তো বা স্যাটেলাইট ডেটায় অ্যাকসেস পাওয়া যাবে। তবে তার জন্যে সময় দরকার—এক ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি। লিয়ারির প্রতি ঈর্ষা অনুভব করল চার্লটন, ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিতে লোকটার যোগাযোগ অনেক বেশি। চাইলে এমনকী স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণও নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে। মনে সন্দেহ জাগল, ঘটনাটার পেছনে ফিল্ডিং- গেলারের হাত নেই তো?
কী করা যায়?
মাইকেলকে পেরিয়ে ওঅর্কস্টেশনের মেঝেতে চোখ গেল চার্লটনের। ইলেকট্রোডগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে।
‘ওগুলো মাথায় লাগাও আবার,’ নির্দেশ দিল সে।
.
আবার গাড়িতে চড়েছে রানা আর অ্যালি, টাওয়ারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে উত্তরদিকে। জায়গাটার সঙ্গে যত দূরত্ব বাড়ছে, ততই স্বাভাবিক হয়ে আসছে মেয়েটা। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে ভয় পেয়ে গিয়েছিল রানা, ভেবেছিল টাওয়ারে হাত দিয়ে অ্যালি ইলেকট্রিক শক খেয়েছে।
ইতিমধ্যে নিজের অভিজ্ঞতা খুলে বলেছে অ্যালি। কোল্ড স্প্রিংসের অধিবাসীদের চিন্তা শুনতে পাওয়া, টাওয়ারের কানেকশনের ওপারে আরেকজন মানুষের কণ্ঠ, সবশেষে নিজের মনের গভীরে নিজের স্মৃতিদের বন্দি হয়ে থাকতে দেখা।
‘আমার মনে হয়েছে, টিফানি ক্যানট্রেলের স্মৃতিটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,’ শেষে যোগ করল অ্যালি। ‘ওটা ফিরে পাবার জন্যে যুদ্ধ করছিল আমার মন। যখন পেলাম, তখন মনে পড়ে গেল নামটা। ওটা আমি আগেও শুনেছি।’
‘কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।
‘এল্ সেডেরোয়। ওই যে, যেখানে আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ওখানকার লোকজনের চিন্তায় শুনতে পেয়েছি টিফানি ক্যানট্রেলের নাম। ডা. ক্যানট্রেল–টেক্সাসের অ্যামারিলোয় থাকেন। একজনকে ভাবতে শুনেছিলাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে—আগে হোক, বা পরে। তখন সেটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি, দেয়ার মত অবস্থাও ছিল না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার কেসটার সঙ্গে ভদ্রমহিলার সম্পর্ক আছে।’
অ্যালির কথাটা ভাবিয়ে তোলার মত। দেখা করা মানে নির্দোষ সাক্ষাৎ নয়, রানার জগতে ওটা ভিন্ন অর্থ বহন করে। আর যদি তা-ই হয়, টিফানি ক্যানট্রেলের সামনে বড় ধরনের বিপদ অপেক্ষা করছে।
‘আর কিছু মনে করতে পারছ ডা. ক্যানট্রেলের সম্পর্কে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কী ধরনের ডাক্তার সে? রিসার্চারদের কেউ নয়তো, যারা তোমার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল?’
‘জানি না,’ মাথা নাড়ল অ্যালি। ‘অমন কোনও স্মৃতি নেই। আবছাভাবে শুধু এটুকু মনে পড়ছে যে, মহিলা খুব ভাল। আমার যত্ন নিত খুব। মন থেকে ভালবাসত আমাকে। লোক-দেখানো ভালবাসা নয়, খাঁটি ভালবাসা। ভান করলে বুঝে ফেলতাম… আমার সঙ্গে কেউ ভান করতে পারে না।’
তা ঠিক, মনে মনে স্বীকার করল রানা।
‘লিয়ারির সঙ্গে ভদ্রমহিলা কীভাবে জড়িত, আমি বলতে পারব না,’ এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল অ্যালি। ‘তবে আমাকে চেনেন তিনি। হয়তো আমার ব্যাপারে সবকিছুই জানেন। আর যদি তিনি বিপদে পড়ে থাকেন, আমাদের সাহায্য করা উচিত তাঁকে।’ রানার দিকে তাকাল ও। ‘ডা. ক্যানট্রেলকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? ডাক্তার যখন, অনলাইনে খোঁজ নিলেই তাঁর কন্ট্যাক্ট ইনফরমেশন পাওয়া যাবে।’
দ্বিমত পোষণ করল রানা। বলল, ‘লিয়ারি বা তার লোকেরা যদি ভদ্রমহিলার পেছনে লেগে থাকে, তা হলে তার ফোনে আড়ি পেতে রেখেছে।’
যদি এখনও বেঁচে থাকে আর কী, মনে মনে ভাবল ও।
চিন্তাটা নিজের অজান্তেই চলে এল মাথায়। চোখের কোনায় অ্যালিকে কেঁপে উঠতে দেখল সঙ্গে সঙ্গে।
‘সরি,’ বলল রানা।
‘না, ঠিক আছে। আমিও একই কথা ভাবছিলাম।’
‘তোমার বুদ্ধিটা অবশ্য মন্দ না। ইন্টারনেট থেকে কন্ট্যাক্ট ইনফরমেশন জোগাড় করার কথা বলছি। ঠিকানা নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করা যায়।’
‘ওতে ঝুঁকি আছে না?’
‘আছে। তবে ঝুঁকি এড়ানোরও কায়দা আছে। যতই চোখে চোখে রাখা হোক কাউকে, গোপনে দেখা করা যায়।’ একটু ভেবে নিল রানা। ‘অ্যামারিলোয় থাকে এই ডাক্তার, তাই না? দশ থেকে বারো ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছুনো যাবে ওখানে।’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল অ্যালি। ওর হাতদুটো কোলের ওপর রাখা, নার্ভাস ভঙ্গিতে নখ খুঁটছে।
পরের কয়েক মিনিট কেউ কথা বলল না। তাপতরঙ্গের মাঝ থেকে ধীরে ধীরে উদয় হলো কোল্ড স্প্রিংসের দক্ষিণ অংশ। হাত বাড়িয়ে গাড়ির পেছনের সিট থেকে বেসবল ক্যাপ আর সানগ্লাস নিল রানা। ওগুলো পরতে যাবে, এমন সময় চেঁচিয়ে উঠল অ্যালি।
যেন বাতাস ফুঁড়ে উদয় হলো পিকআপটা—হোণ্ডা অ্যাকর্ডের ত্রিশ ফুট সামনে। এক সেকেণ্ড আগেও ফাঁকা ছিল রাস্তা, কিন্তু এখন… ছোট একটা বালিয়াড়ির পেছন থেকে আচমকা বেরিয়ে এসেছে গাড়িটা, রাস্তার ঢাল বেয়ে উঠে এসেছে দুরন্ত বেগে, ঝাঁপ দিয়েছে শূন্যে। স্থানীয় কোনও বেপরোয়া ড্রাইভার, সন্দেহ হলো রানার-মরুভূমির ওপর দিয়ে শর্টকাট নিতে চাইছে, সেজন্যেই আড়াআড়িভাবে পার হচ্ছে রাস্তা। পলকের জন্যে উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে চালকের যে-চেহারা দেখল, তাতে ধারণাটা পাকা হলো আরও। ময়লা ওভারঅল, দাগঅলা শার্ট আর অবিন্যস্ত চেহারার এক তরুণ—চোখে-মুখে ফুটে আছে গ্রাম্য সারল্য।
একেবারে অ্যাকর্ডের নাকের ডগায় উঠে এসেছে পিকআপটা, কয়েক সেকেণ্ড পরে এলে পাশ থেকে গুঁতো মেরে বসত। তাই বলে বিপদ কাটেনি, এখন ওটার পজিশন অনেকটা রোডব্লকের মত—পিকআপের গায়ে এবার অ্যাকর্ডই গুঁতো মারতে চলেছে। ব্রেক কষল রানা, কর্কশ শব্দ তুলে প্রতিবাদ জানাল ওর গাড়ির টায়ার, ঘষা খাচ্ছে অ্যাসফল্টে। পিছলাতে পিছলাতে হোণ্ডা অ্যাকর্ড ছুটে যাচ্ছে পিকআপের দিকে।
রানা আশা করেছিল, বিপদ দেখে স্পিড বাড়াবে পিকআপের ড্রাইভার, সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোপাশে নেমে যাবার চেষ্টা করবে… কিন্তু তা করল না সে। তার বদলে ব্রেক চাপল, স্টিয়ারিং ঘোরাল বনবন করে—রাস্তার ওপর সিধে করতে চাইছে নিজের গাড়ি। আঁতকে উঠল রানা। ব্যাটা পাগল, নাকি বিপদের মুখে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট বুঝি আর ঠেকানো গেল না!
সত্যিই গেল না। তবে তার শিকার রানা নয়, বেপরোয়া ড্রাইভারই হলো। হিসেবে ভুল করেছে সে। তুমুল বেগে ঢাল বেয়ে উঠে এসেছে গাড়ি, ঠিকমত কাজ করল না ব্রেক। মোমেন্টামের কারণে গাড়িটা নিজ থেকেই এগিয়ে গেল খানিকটা, সামনের দু’চাকা চলে গেল অন্যপাশের ঢালে। সে- অবস্থায় স্টিয়ারিং ঘোরানোয় আরও বড় সর্বনাশ ঘটে গেল। সামনের দু’চাকা ঘুরে যাওয়ায় যেন একটা ধাক্কা খেল পিকআপ, পেছনদিকটা উঠে গেল ভূমি ছেড়ে, শূন্যেই মোচড় খেল পুরো চেসিস। রাস্তার ঢালে কাত হয়ে পড়ল গাড়িটা, গড়িয়ে গেল নিচে। মাত্র দু’ইঞ্চির জন্য মিস করে গেল অ্যাকর্ডকে। রাস্তার ওপর থেকে ছিটকে যেতে থাকা পিকআপের গা ঘেঁষে স্কিড করে গেল রানার গাড়ি, দশ ফুট সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
জানালা দিয়ে হতভম্ব চোখে বাইরে তাকাল রানা আর অ্যালি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানে ঘটে গেছে একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা। গড়ান দিচ্ছে পিকআপটা—ঢাল থেকে নেমেও থামল না, নিচের জমিনে পৌছে আরও কয়েকবার গড়াল, থামল প্রায় সত্তর ফুট দূরে গিয়ে। মরা তেলাপোকার মত উল্টে গেছে। বিশ্রী আওয়াজ তুলে ঘুরছে পেছনের দুই চাকা। সামনে… ক্যাবের ছাতটা প্রায় চ্যাপ্টা হয়ে গেছে, ভেঙেচুরে ছিটকে গেছে একপাশের দরজা। ক্যাবের অভ্যন্তরটা কালো গর্তের মত লাগল দূর থেকে—ড্রাইভারকে দেখা যাচ্ছে না।
‘ওহ্ গড!’ পিকআপের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসাল অ্যালি।
ঠোঁট কামড়াল রানা। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা দরকার, কিন্তু কীভাবে ডাকবে, বুঝতে পারছে না। সেলফোন নেই ওর কাছে, খবরটা দেয়ার জন্যে শহরে যেতে হবে। সেটা বিপজ্জনক। পুলিশ আসার আগেই কেটে পড়তে হবে ওদেরকে। তাই বলে দুর্ঘটনায় পড়া একজন মানুষকে ফেলে চলেও যাওয়া যায় না। আর কিছু না হোক, লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে, তা অন্তত দেখা দরকার। তাকে সাহায্য করা যাবে কি না, সেটা তখন বোঝা যাবে।
‘এখানেই থাকো, অ্যালিকে বলল ও। ‘আমি দেখে আসছি।’
গাড়ি থেকে নামল রানা। ঝুঁকে ড্রাইভারের সিটের তলা থেকে বের করে আনল নিজের সিগ-সাওয়ার। সতর্ক থাকার তাগিদ অনুভব করছে। যেভাবে আচমকা বেরিয়ে এল পিকআপটা, ওটাকে স্বাভাবিক বলা চলে না মোটেই। সন্দেহ হচ্ছে ওর। পিস্তলটা কোমরের পেছনে বেল্টে গুঁজল। এরপর নামতে শুরু করল রাস্তার ঢাল বেয়ে।
.
খুন করো ওদেরকে, অ্যাডাম। বাইরে বেরিয়ে খতম করে দাও ওদেরকে। এখুনি!
ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখছে অ্যাডাম। তীব্র ব্যথা… এতই তীব্র যে, রুক্ষ কণ্ঠের আদেশটা ঠিকমত শুনতেই পাচ্ছে না।
হেলায় সুযোগ নষ্ট করছ তুমি। অপেক্ষা করছ কীসের জন্যে?
শরীর ঘোরাল অ্যাডাম। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধের কাছে কট করে উঠল কী যেন। ফুঁপিয়ে উঠল ও। চিৎকার করার শক্তি নেই। বাঁ হাতটা অকেজো হয়ে গেছে। তবে হতাশ হবার কিছু নেই, ও ডানহাতি। ডান হাত ঠিক থাকলেই এমপি- ফাইভটা ব্যবহার করতে পারবে। অস্ত্রটার খোঁজে চোখ বোলাল। ওই তো, দু’ফুট দূরে পড়ে আছে ওটা—ধুলোয় একাকার।
বাইরে থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘হ্যালো? আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? সাড়া দিন।’
কপাল ভাল তোমার, অ্যাডাম। কাজটা সহজ করে দিচ্ছে ও। অস্ত্রটা তোলো। মিটিয়ে দাও ঝামেলা।
সাবমেশিনগানের দিকে ডান হাত বাড়াল অ্যাডাম। কিন্তু ওটুকু নড়াচড়াতেই অবর্ণনীয় ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল চুরমার হয়ে যাওয়া বাঁ কাঁধ থেকে। কেশে উঠে স্থির হয়ে গেল ও। পড়ে রইল মড়ার মত।
থামলে কেন, অ্যাডাম? শাস্তি পেতে চাইছ তুমি? আমার শাস্তি যে কত ভয়ঙ্কর, তা কি তুমি ভুলে গেছ?
কিছু বলল না অ্যাডাম। অসহ্য যে-ব্যথা সারা দেহে, তার সামনে দুনিয়ার সমস্ত হুমকি অচল। মাথার ভেতর অশরীরী কণ্ঠটা শুনতে পেল—কণ্ঠের মালিক যেন অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছে।
একে দিয়ে কিচ্ছু হবে না— বাতিলের খাতায় চলে গেছে। অ্যাই, সাইট টু-র আশপাশে আর কারও অ্যাসেট আছে? থাকলে জলদি আনার ব্যবস্থা করো।
কাকে বলা হলো কথাটা? কিছুই মাথায় ঢুকছে না অ্যাডামের। অবশ্য, পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে ঘোলাটে। এর সূচনা হয়েছে খানিক আগে—যখন অপ্রত্যাশিতভাবে মাথার ভেতর রুক্ষ কণ্ঠটা শুনতে পেয়েছে। একটা গাড়ির রেডিয়েটর খোলায় দাদুকে তখন গ্যারাজে সাহায্য করছিল ও। এমনটা আগে কখনও ঘটেনি, দাদু আশপাশে থাকলে কখনও কথা বলেনি কণ্ঠের মালিক। কিন্তু আজ বলল।
অ্যাডাম, জরুরি একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।
অবাক হয়েছিল অ্যাডাম। কণ্ঠটা নার্ভাস শোনাচ্ছিল, সেই সঙ্গে মিশে ছিল এক ধরনের তাড়া।
‘কী করতে হবে?’ মনে মনে জিজ্ঞেস করেছে ও।
ম্যাট্রেসের তলা থেকে মেশিনগানটা বের করো। ওটা নিয়ে পিকআপে চড়বে। শহরের দক্ষিণে… পুরনো লেক রোডে যেতে হবে তোমাকে। এক্ষুণি!
অ্যাডামকে থমকে যেতে দেখে দাদু ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছেন। ‘কী হয়েছে?’ জানতে চেয়েছেন তিনি।
কোনোমতে মাথা নেড়েছে অ্যাডাম। ‘না, কিছু না।’ বুড়োটার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট কোরো না। রওনা দাও এখুনি। মুভ!
‘আমি একটু বাথরুমে যাব,’ নিচু গলায় দাদুকে বলেছে অ্যাডাম। এক ছুটে বেরিয়ে এসেছে গ্যারাজ থেকে। মেশিনগান নিয়ে পিকআপে চড়তে লেগেছে পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড। এরপর মরুভূমির মাঝ দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি ছুটিয়েছে লেক রোডের দিকে
কী করতে হবে, সেটা পথিমধ্যে তাকে জানিয়েছে অশরীরী কণ্ঠ। ড্রাই লেকের রেডিয়ো টাওয়ারের পাশে, কিংবা ওখান থেকে ফিরতে থাকা অবস্থায় কাউকে দেখতে পাবে ও। সেই মানুষ বা মানুষগুলো যে-ই হোক না কেন, তাদেরকে থামিয়ে খুন করতে হবে।
দূর থেকেই হোণ্ডা গাড়িটা দেখতে পেয়েছিল অ্যাডাম। একটা বালিয়াড়ির পেছনে ওত পেতেছিল। ভেবেছিল, পাশ, থেকে গাড়িটাকে গুঁতো মেরে অচল করে দেবে। তারপর গুলি চালিয়ে খুন করবে ওটার আরোহীদের। কিন্তু হিসেবে সামান্য গরমিল হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনাটা মাঠে মারা পড়েছে।
সত্যিই কি ব্যর্থ হয়েছে ও? মাথা সামান্য উঁচু করে সাবমেশিনগানটার দিকে আবারও তাকাল অ্যাডাম। শার্টের একটা কোনা তুলে কামড়ে ধরল দাঁত দিয়ে। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করল; ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে শুরু করল অস্ত্রটার দিকে।
.
ত্রিশ গজ দূর থেকে পিকআপের ভেতরে নড়াচড়া দেখতে পেল রানা। এক সেকেণ্ড পরেই বেরিয়ে এল দুটো পা। ধীরে ধীরে, উল্টোদিকে হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে, তরুণ ড্রাইভারের দেহটা বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে।
‘ঠিক আছ তুমি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
কোনও জবাব পাওয়া গেল না।
‘শুনতে পাচ্ছ?’
এবারও তরুণ নিরুত্তর।
এরপর যা ঘটল, তার জন্যে তৈরি ছিল না রানা। ছেলেটার দুর্দশা দেখে করুণা অনুভব করছিল, ঢিল দিয়েছিল সতর্কতায়, আর সে-কারণেই পড়ে গেল বিপদে। ওর চোখের সামনে আস্তে আস্তে পিকআপ থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এল তরুণ ড্রাইভার, বাম হাতটা বেকায়দা ভঙ্গিতে ঝুলছে সামনে, মনে হলো কাঁধটা ভেঙে গেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে খোলা আকাশের নিচে বেরিয়েই দু’হাঁটুতে ভর দিয়ে উঁচু হলো সে, পরমুহূর্তে মোচড় খেল, কাতর এক আর্তনাদ করে ঘুরে গেল রানার দিকে, পিকআপের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। আর তখুনি রানা দেখল, ছেলেটার হাতে একটা সাবমেশিনগান শোভা পাচ্ছে—নলটা তাক করা হয়েছে ওর বুকের দিকে।
পেছন থেকে আঁতকে ওঠার মত একটা আওয়াজ শুনল রানা। ওদিকে না তাকিয়েও বুঝল, ওর নির্দেশ অমান্য করে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে অ্যালি, দেখতে পেয়েছে অস্ত্রটা।
‘এদিকে এসো না, অ্যালি। খবরদার!’ চেঁচিয়ে বলল রানা। ‘গাড়ির আড়ালে চলে যাও, জলদি!’
এবার বাধ্য মেয়ের মত নির্দেশটা পালন করল অ্যালি। এক ছুটে চলে গেল অ্যাকর্ডের উল্টোপাশে।
অস্ত্রধারী তরুণের দিকে নজর ফেরাল রানা। হাতে ধরা আগ্নেয়াস্ত্রটা থরথর করে কাঁপছে—তবে এত বেশি নয় যে, গুলি করলে সেটা মিস হবে। আঙুলের ডগা যেভাবে চেপে বসেছে ট্রিগারে… চাপ আরেকটু বাড়ালেই গুলিবর্ষণ করবে এমপি-ফাইভ। রানা বুঝল, কোমর থেকে নিজের পিস্তলটা বের করার আগেই গুলি খেতে হবে ওকে।
‘কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
কোনও শব্দ বেরুল না তরুণের মুখ দিয়ে। পালা করে রানা আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটাকে দেখছে সে। ছেলেটা আহত, তবে পুরোপুরি অচল হয়ে যায়নি। রানাকে গুলি করার পর উঠে দাঁড়িয়ে অ্যালির কাছে যেতে পারবে। পালাবার চেষ্টা করতে পারে অ্যালি, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না। ওকে ধাওয়া করার প্রয়োজন হবে না কোনও। চারদিকে উন্মুক্ত মরুভূমি, আড়াল নেবার মত কিছুই নেই… দূর থেকেই ওকে সাবমেশিনগান দিয়ে ঘায়েল করতে পারবে ছেলেটা।
‘মাথা গরম কোরো না,’ নরম গলায় তাকে বলল রানা। ‘তুমি একটা ভুল করতে চলেছ।’
চোয়াল শক্ত হলো তরুণ ড্রাইভারের। ট্রিগারের ওপর চাপ আরেকটু বাড়াল সে।
.
গুলি করো, অ্যাডাম। খতম করো ওকে!
সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার ওপর মনোযোগ দিতে চাইছে অ্যাডাম, কিন্তু ওর চোখ বার বার চলে যাচ্ছে রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড আগ পর্যন্ত দৃঢ়প্রত্যয়ে ছিল সে—ভুতুড়ে কণ্ঠের হুকুম তামিল করবে, কণ্ঠটাকে বিদায় করবে মাথা থেকে। কিন্তু এখন…
মেয়েটাকে দেখে একটা ঝাঁকি খেয়েছে অ্যাডাম। কতই বা বয়স হবে? দশ? বারো? রুক্ষ কণ্ঠটা কিনা ওই ফুটফুটে মেয়েটাকে খুন করতে বলছে!
মাথা থেকে ওসব চিন্তা দূর করো, অ্যাডাম! কথা না শুনলে ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে তোমাকে। ক্ষমা করব না কিছুতেই। শায়েস্তা করব তোমাকে… ভয়ঙ্কর শাস্তি দেব!
‘প্লিজ!’ ফিসফিসাল অ্যাডাম।
আদেশ পালন করো। এটা আমার শেষ কথা।
বড় করে শ্বাস নিল অ্যাডাম, তারপর ধীরে ধীরে ছাড়ল। টের পেল, বুকের ধুকপুকানি কমে যাচ্ছে। পরিচিত একটা অনুভূতি—সবকিছু মেনে নেবার অনুভূতি… যা হয় হোক, ওর কিছু যায় আসে না।
.
মরিয়া হয়ে উঠেছে রানা, পিস্তলটা বের করবে বলে ভাবছে। সন্দেহ নেই, কোমরের পেছনে হাত বাড়ানোমাত্র গুলি খেতে হবে ওকে; কিন্তু মরার আগে একটা হলেও গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পাবে ও। অস্ত্রধারী তরুণটিকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে। অ্যালি অন্তত বেঁচে যাবে তাতে।
সত্যিই কি বাঁচবে? বড় একটা খুঁত আছে প্ল্যানটায়। মেশিনগানটা যদি ফুল অটোতে সেট করা থাকে, তা হলে ট্রিগারে চাপ পড়লেই অঝোরে বেরিয়ে আসবে বুলেটের ধারা। ছিন্নভিন্ন করে দেবে ওকে। পিস্তল বের করারই সময় পাওয়া যাবে না।
এমপি-ফাইভের ব্যারেলের দিকে তাকিয়ে আছে রানা, তরুণের কম্পিত হাতে সামান্য নড়ছে ওটা। একটিবারের জন্যেও যদি ওর দিক থেকে সরে যায়… সেটা যত অল্প সময়ের জন্যেই হোক না কেন… একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেতে পারে।
হঠাৎ মুখ খুলল তরুণ। বলল, ‘আমি নিরুপায়। আমার সত্যিই এসবের ইচ্ছে ছিল না।’
তার চোখে করুণার ছায়া দেখতে পেল রানা। খটকা লাগল ওর। অ্যাকসিডেন্টের আগ মুহূর্তে ছেলেটাকে দেখে যে-ধারণাটা হয়েছিল, তা ফিরে এল আবার। নিতান্তই এক গ্রাম্য, সরল ছেলে। পোড়খাওয়া কোনও খুনি নয়। এমন একজন মানুষকে কেন পাঠানো হয়েছে এ-কাজে? কী যেন ঠিক মিলছে না।
তবে ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামানো চলে না। বোকাসোকা হোক, বা না-ই হোক, ছেলেটা যে গুলি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে চেহারা দেখে। এখন একটাই কাজ করা যেতে পারে। ছেলেটার অনভিজ্ঞতাই এখন রানার জন্যে সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
‘…আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো,’ বলল তরুণ। উঁচু করল সাবমেশিনগান।
‘তুমি সেফটি ক্যাচ অফ করোনি,’ ওকে বলল রানা।
থমকে গেল তরুণ, অস্ত্রটা কাত করে দেখতে চাইল, কথাটা সত্যি কি না। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের জন্যে নড়ে গেল ব্যারেল। রানার জন্যে ওটুকুই যথেষ্ট। বিদ্যুতের মত ছোবল দিল ওর ডান হাত, কোমরের পেছন থেকে বের করে আনল সিগ-সাওয়ার। তরুণ ড্রাইভার ওর দিকে ঠিকমত তাকাবার সময় পেল না, তার আগেই টিপে দিল রানা ট্রিগার।
কপালে তৃতীয় নয়ন সৃষ্টি হলো অ্যাডামের। বিস্ফোরিত হলো মাথার পেছনদিক। ভীষণ একটা ঝাঁকি খেয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ল সে। চলে গেল সমস্ত দুঃখকষ্টের ঊর্ধ্বে
পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল রানা। কেন যেন বিবেকের দংশন অনুভব করছে, যদিও তার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। এক মুহূর্ত দেরি করলে ও নিজেই খুন হয়ে যেত। কিন্তু তারপরও…
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রানার বুক চিরে। উল্টো ঘুরে গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল ও।