পঁচিশ
মোলায়েম একটা কণ্ঠ শুনে জেগে উঠল রানা—ধীরে ধীরে। যেন অন্ধকার থেকে একটু একটু করে ফিরে এল আলোয়। মাঝখানে কতটা সময় পেরিয়েছে বলতে পারবে না। আধো- ঘুম, আধো-জাগরণের মাঝে শুনেছে কেবল নানা ধরনের শব্দ—মানুষের গলা, গাড়ির আওয়াজ, জেট ইঞ্জিনের গর্জন, ইত্যাদি। আস্তে আস্তে চোখ মেলল ও। চোখে পড়ল অচেনা একটা ছাত। গায়ের নিচে নরম গদি—কাউচে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে। ঢোক গিলতে কষ্ট হলো। খসখসে হয়ে আছে গলা, যেন কেউ শিরিষ কাগজ ঘষে দিয়েছে জিভের ভেতরদিকে।
‘এটা খাও।’
অ্যালির গলা। মাথা ঘোরাতেই দেখতে পেল মেয়েটাকে—একটা জুসের প্যাকেট বাড়িয়ে ধরেছে ওর দিকে, প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আছে স্ট্র। কোনও কথা না বলে স্ট্র-টা মুখে নিল রানা, চোঁ চোঁ করে খানিকটা জুস চালান করল উদরে। গলা থেকে খসখসে ভাবটা দূর হলো কিছুটা, একই সঙ্গে সাড়া ফিরে পেল শরীরে।
নড়তে গিয়ে টের পেল রানা, ওর হাত থেকে হ্যাণ্ডকাফ খোলা হয়নি এখনও। কামরাটার ওপর নজর দিল। ছোট্ট একটা স্টাডি, দেয়ালগুলো বিবর্ণ। কোনও জানালা নেই। একপাশের দরজা গলে ঢুকছে আলো। কাউচ থেকে দরজার ওপাশটা দেখা যাচ্ছে না।
‘আমরা কোথায়?’ জানতে চাইল রানা। ‘বাড়িতে,’ বলল অ্যালি।
‘কার বাড়ি?’ ভ্রূকুটি করল রানা। ‘তোমার?
মাথা ঝাঁকাল অ্যালি। ‘আমাদের।’ এক ধরনের উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল কণ্ঠে। পরিচয়ের পর এই প্রথম ওকে খুশি হতে দেখছে রানা।
মাথা এখনও দপ দপ করছে রানার, সঙ্গে রয়েছে ঠাণ্ডা স্পর্শের অনুভূতিটা। এখন তা আগের চেয়ে তীব্র… প্রায় তিনগুণ বলা চলে। কারণটা অনুমান করতে কষ্ট হলো না। গলি ধরে পালাবার প্ল্যান মনে মনে ভেবেছিল ও, কাউকে জানায়নি। অথচ তারপরেও ওখানে ওত পেতে অপেক্ষা করছিল অচেনা মেয়েটা।
‘ওরাও মাইণ্ডরিডার?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
আবার মাথা ঝাঁকাল অ্যালি। ‘হ্যাঁ। ফোর্ট ডেট্রিকের ফসল—আমার মত। পাঁচ বছর আগে আমরা তিনজনই নাকি একসঙ্গে পালিয়েছিলাম ওখান থেকে। এরপর গা ঢাকা দিয়েছিলাম। ওদের মুখে অনেক কিছু শুনলাম। আমিও গত কয়েকদিনের ঘটনা জানিয়েছি ওদেরকে। আমার কথা অবিশ্বাস করছে না, তবে তোমার সঙ্গে কথা বলে নিতে চাইছে… নিশ্চিত হতে চাইছে, তোমার ওপর ভরসা করা যায় কি না। তারপর হ্যাণ্ডকাফ খুলে দেবে। তোমার তাতে আপত্তি নেই তো?’
কষ্টে-সৃষ্টে উঠে বসল রানা। বলল, ‘ডাকো ওদেরকে।’
‘এক্ষুণি যাচ্ছি,’ উঠে দাঁড়াল অ্যালি।
‘দাঁড়াও,’ কী যেন মনে পড়েছে রানার, থামাল ওকে। ‘একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও।
‘কী প্রশ্ন?’
‘টিফানি ক্যানট্রেলের ব্যাপারে। শেষ মুহূর্তে ওর চিন্তায় অস্বাভাবিক কিছু একটা শুনতে পেয়েছিলে তুমি, তাই না? মানে… আমরা আক্রান্ত হবার ঠিক আগ মুহূর্তে?’
চেহারায় মেঘ জমল অ্যালির।
‘কী শুনতে পেয়েছিলে?’ জানতে চাইল রানা।
‘একটা ফোন করার কথা ভাবছিল সে। জরুরি একটা ফোন। ফোন করে কী বলবে, তা ঠিক করে নিচ্ছিল মনে মনে। আমি শুধু প্রথম অংশটা শুনেছি।’
‘কী?
‘মি. অ্যালেক্স লিয়ারি কি আছেন? আমি টিফানি ক্যানট্রেল। তাঁর সঙ্গে জরুরি কথা আছে আমার।’
কামরা থেকে বেরিয়ে গেল অ্যালি। রানার কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
একটু পরেই দুই যুবতীকে নিয়ে ফিরে এল অ্যালি। উজ্জ্বল আলোয় এই প্রথম তাদেরকে দেখল রানা। দু’জনেরই বয়স ত্রিশের আশপাশে। মাঝারি গড়ন, মাঝারি উচ্চতা। একজন স্বর্ণকেশী, অন্যজনের চুল কালচে-বাদামি। সাদামাটা চেহারা। লিপস্টিক, আই শ্যাডো, মেকআপ… কিছুই নেই মুখে। সম্ভবত ইচ্ছে করেই কোনও সাজগোজ করেনি, নিজেদের যতটা সম্ভব অনাকর্ষণীয় করে রাখতে চায়, যাতে কেউ মনে না রাখে ওদেরকে।
রানার কাউচের মুখোমুখি আরেকটা কাউচ আছে, সেটায় বসল দুই যুবতী। স্বর্ণকেশী বলল, ‘আমি এলিনা। আর ও হলো ভেরোনিকা।’
গলিতে দেখা বৈরিতা উধাও হয়েছে ওদের হাবভাব থেকে। তবে ওখানকার ঘটনার জন্যে বিব্রত বা দুঃখিত মনে হলো না। রানা কিছু মনে করল না। যখন পরিস্থিতির প্রয়োজনে কঠোর হতে হয় কাউকে, পরে সে-নিয়ে বিব্রত বা দুঃখিত হবার কিছু নেই।
‘ঠিক,’ একমত হলো ভেরোনিকা—রানার মন পড়ছে সে। ‘পরিস্থিতির প্রয়োজনেই অমনটা করতে হয়েছে আমাদেরকে। আমরা তো জানতাম না তুমি কে। টিফানি ক্যানট্রেলের বাড়ির ওপর নজর রাখছিলাম, এমন সময় তোমরা হাজির হলে ওখানে। স্বভাবতই সন্দিহান হয়ে উঠলাম।’
‘ওখানে তো সারাদিনই মানুষ আসা-যাওয়া করে,’ রানা বলল। ‘আমাদের ওপর আলাদা করে নজর পড়ল কেন?’
‘কারণ, দেখলাম নতুন দু’জন মানুষ উদয় হয়েছে, তাদের একজনের চিন্তা পড়তে পারছি না। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছ… আমরা অ্যালির মনের কথা শুনতে পাই না। মাইণ্ডরিডাররা কেউই কারোটা শুনতে পায় না। যা হোক, তোমাদের ওপর মনোযোগ দিলাম আমরা। তোমার চিন্তাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম পরিষ্কার। সেখান থেকেই জানলাম, অ্যালি তোমার সঙ্গে আছে… ওকে নিয়েই সারাক্ষণ ভাবছিলে তুমি। ও যে স্মৃতি হারিয়েছে, তাও তোমার ভাবনা থেকেই জানলাম। তোমার আসল উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছিল না, তা ছাড়া স্মৃতি হারানোয় অ্যালিও আমাদেরকে চিনতে পারবে না… তাই সবদিক ভেবে তোমাদেরকে তুলে আনাই ভাল বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে, যাতে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে ভালমত জেরা করা যায় তোমাকে।
‘বেশি সময় নেব না আমরা,’ বলল এলিনা। ‘আমাদের প্রশ্নগুলোর জবাব দাও, এরপর আমরা তোমার প্রশ্নের জবাব দেব… যতটা পারা যায় আর কী। কী বলো, তুমি রাজি?’
সায় জানাল রানা।
.
পরের আধঘণ্টা রানাকে জেরা করল এলিনা আর ভেরোনিকা। অ্যালির কাছে সব শুনেছে, তারপরও রানার মুখ থেকে আবার শুনল সব—ওর অতীত, বর্তমান, এল সেডেরোয় উপস্থিত হবার কারণ, অ্যালিকে উদ্ধার ও তার পরের ঘটনা, ইত্যাদি। কিছু লুকাল না রানা, সে-চেষ্টা করে লাভ নেই। অকপটে বলল সব।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সন্তুষ্ট দেখাল দুই মাইণ্ডরিডারকে। পকেট থেকে একটা চাবি বের করে রানার হ্যাণ্ডকাফ খুলে দিল এলিনা। দু’হাতের কবজি ডলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিল রানা।
‘তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?’ বলল ভেরোনিকা। ‘চলো, লাঞ্চ করতে করতে আমাদের গল্প শোনাব। টেবিল সাজানোর ফাঁকে অ্যালি তোমাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে।’
কাউচ থেকে উঠে পড়ল রানা। অ্যালির পিছু পিছু বেরিয়ে এল কামরা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়াল। সাধারণ কোনও বাড়ি ভেবেছিল জায়গাটাকে, আদপে তা নয়।
বিশাল এক লিভিং রুম দেখতে পেল রানা, দেয়ালটা কাঁচের তৈরি। শুধু তা-ই নয়, লিভিং রুমটা মাটি থেকে অন্তত সত্তর-আশি তলা ওপরে! কাঁচের ওপারে বিশাল এক নগরী, সবকিছু কেমন যেন খুদে দেখাচ্ছে। সময়টা দুপুর, নীল আকাশের নিচে কড়া রোদে স্নান করছে নগরীর উঁচু-নিচু বিল্ডিং আর রাস্তাঘাট। ভাল করে তাকাতেই একটা আকাশছোঁয়া বিল্ডিং চিনতে পারল—উইলিস টাওয়ার… বাংলাদেশি স্থপতি এফ. আর. খানের তৈরি করা বিশ্ববিখ্যাত ইমারত, আগে যেটা সিয়ার্স টাওয়ার নামে পরিচিত ছিল। এর অর্থ, শিকাগোয় রয়েছে ও।
‘আরও স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে, শিকাগোর হ্যানকক সেন্টারে,’ পেছন থেকে বলল এলিনা। ‘তিরাশি নম্বর ফ্লোরের পুরোটা জুড়ে আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্ট।’
ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল রানা। চোখে বিস্ময়। ‘আর এটা কিনা তোমাদের হাইডআউট?’
হাসল এলিনা। ‘হ্যাঁ। গা-ঢাকা দেবার জন্যে জায়গাটা যে কত ভাল, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ধনী লোকেরা নিজেদের সুবিধের জন্যে আইনে হাজারটা ফাঁকফোকর রেখেছে। চাইলেই এরকম একটা জায়গা বেনামে কেনা যায়… কোনও ধরনের পেপার ট্রেইল ছাড়াই! সাধারণ কোনও বাড়ির বেলায় সেটা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এখানে আমাদেরকে খোঁজার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাববে না।’
‘আরেকটা কারণ আছে এখানে বাস করার,’ বলল ভেরোনিকা। ‘তবে এ-মুহূর্তে সেটা তোমার না জানলেও চলবে। বরং প্রার্থনা করো, জানার মত পরিস্থিতি যেন দেখা না দেয়।’
রানার হাত ধরে টানল অ্যালি, অ্যাপার্টমেন্টটা ঘুরিয়ে দেখাবার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। পা বাড়াতে গেল রানা, কিন্তু পেছন থেকে ডেকে উঠল এলিনা।
‘দাঁড়াও।’
এগিয়ে এল সে। হাতে রানার সিগ-সাওয়ার, ম্যাগাজিনটা গ্রিপে লোড করে দেয়া হয়েছে। বাড়িয়ে ধরল ওটা’।
‘আমরা কৃতজ্ঞ, রানা,’ বলল এলিনা, ‘অ্যালির জন্যে এতকিছু করেছ বলে। প্রতিদান হিসেবে আর কিছু না হোক, অন্তত তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি আমরা।’
মৃদু মাথা ঝোঁকাল রানা। বাড়ানো হাত থেকে নিল পিস্তলটা। সেফটি চেক করে গুঁজে রাখল ওয়েস্টব্যাণ্ডে। এরপর অ্যালির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল।
বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। ফ্লোরটার ঠিক মাঝখানে মস্ত ফাঁকা জায়গা, অনেকটা হলঘরের মত। সেটার চারদিকে তৈরি করা হয়েছে সবগুলো কামরা। লিভিং রুমের পাশে কিচেন আর ডাইনিং রুম। ওটা দক্ষিণ দিক। উত্তরের প্রায় পুরো উইংটাই একটা বিরাট লাইব্রেরির দখলে। পূর্ব আর পশ্চিমের উইংদুটো বসবাসের জন্যে–প্রমাণ সাইজের ছ’টা বেডরুম আছে।
পশ্চিমের একদম কোনার রুমটা অ্যালির, ওখানে রানাকে নিয়ে গেল সে। ভেতরে ঢুকে বিস্মিত হলো রানা—কামরাটা অগোছালো, দেখে মনে হচ্ছে নিয়মিত ব্যবহার হয় ওটা।
‘আসলে তা নয়,’ রানার মনের কথা পড়ে বলল অ্যালি। ‘গত দু’মাস থেকে এভাবে পড়ে আছে কামরাটা, কেউ গোছায়নি। আমি যখন ধরা পড়লাম, এলিনা আর ভেরোনিকা পালিয়ে গিয়েছিল। ওরা ভয় পাচ্ছিল, আমাকে ইন্টারোগেট করে এখানকার ঠিকানা জেনে নিতে পারে লিয়ারি।’
বিছানার দিকে এগিয়ে গেল ও। নীল রঙের একটা তুলতুলে পুতুল—একটা ডায়নোসর—পড়ে আছে বালিশের পাশে। কম্বলে ঢাকা পড়ে আছে খানিকটা। ঝুঁকে পুতুলটা তুলে নিল অ্যালি।
ওদের ধারণা, এসব দেখলে আমার স্মৃতি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে,’ বলল ও।
‘সেটা অস্বাভাবিক নয়। স্মৃতি ফেরানোর জন্যে ডাক্তাররা পরিচিত পরিবেশে থাকার পরামর্শ দেয়।’
পুতুলের গায়ে হাত বোলাল অ্যালি। ‘কাজ বোধহয় কিছুটা হচ্ছে। পুতুলটা চেনা চেনা লাগছে আমার। এটার একটা নামও দিয়েছিলাম আমি। নামটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। ‘
ভুরু কুঁচকে পুতুলটার দিকে তাকিয়ে রইল ও। চেষ্টা করছে নামটা স্মরণ করার। একটু পর হার মানল। পুতুলটা আবার নামিয়ে রাখল বিছানায়।
‘সময় দাও,’ ওকে বলল রানা। ‘অস্থির হয়ো না।’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল অ্যালি, কিন্তু চোখের তারা থেকে অস্বস্তি দূর হলো না।
‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
আস্তে শ্বাস ফেলল অ্যালি। ‘খুব শীঘ্রি দেখতে পাবে।’
.
‘বাইশ বছর বয়সে জেলে যাই আমি,’ বলল এলিনা। ‘কীসের জন্যে, সেটা বলব না।’
ডাইনিং রুমের টেবিলে বসে আছে চারজনে, খেতে খেতে কথা বলছে। বাইরে মেঘ জমেছে। হ্যানকক সেন্টারের চূড়ায় জমাট বেঁধেছে কুয়াশা, ঢাকা পড়ে গেছে কাঁচের ওপারের সবকিছু। নিচের শহর অদৃশ্য হয়ে গেছে দৃষ্টিসীমা থেকে।
‘আগেও ছোটখাট অপরাধ করেছিলাম, কাজেই সেবার ষোলো বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলো,’ বলে চলেছে এলিনা, ‘অন্তত বারো বছর না কাটলে প্যারোলের কোনও সম্ভাবনা নেই। জেলে যাবার পর মাসখানেক কাটল, এরপরেই এক লোক দেখা করতে এল আমার সঙ্গে। না, ভিজিটর’স্ রুমে নয়… একেবারে আমার কামরায়! মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভাঙতেই দেখলাম, সে দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। কারাগারের চিফ অভ গার্ডস্-ও ছিল তার সঙ্গে—বিরক্ত চেহারা নিয়ে, তবে সে কোনও কথা বলছিল না। যা বলার বলল অচেনা লোকটাই। বলল, চাইলে সে-রাতেই কারাগার থেকে ছাড়া পেতে পারি আমি—যদি লোকটার সঙ্গে যেতে রাজি হই আর কী। আমাকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবে সে, ওখানে দু’বছর কাটাতে হবে। আর দু’বছর পর আমি সম্পূর্ণ মুক্তি পাব।
‘বিস্তারিত জানতে চাইলাম। লোকটা তখন ব্যাখ্যা করল, যেখানে আমাকে রাখা হবে, সেটা একটা ডরমিটরির মত… আর্মির ডরমিটরি। মিলিটারির তত্ত্বাবধানে একটা ড্রাগের পরীক্ষা চালানো হবে আমার ওপর। প্রথম দু’সপ্তাহে তিনটে ইঞ্জেকশন দেয়া হবে আমাকে, লোকটার ভাষায় সেটা একটা আর.এন.এ. ইন্টারফ্যারেন্স ড্রাগ। এরপর আর কোনও কাজ নেই। বিশ্রাম নিতে পারব আমি, ইচ্ছেমত সময় কাটাতে পারব… ওরা মাঝে মাঝে ড্রাগের রিঅ্যাকশন চেক করে দেখবে। সবচেয়ে বড় কথা, ইঞ্জেকশনের ফলে কিছু ঘটুক বা না-ঘটুক, দু’বছর ফুরোলে মুক্তি দেয়া হবে আমাকে। পুরনো সব ক্রিমিনাল রেকর্ড মুছে দেয়া হবে, যাতে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারি। আমাকে বোঝাল, প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে চব্বিশ বছর বয়সে আবার সমাজে ফিরে যেতে পারব আমি, জেলে থাকলে চৌত্রিশ বছরের আগে ছাড়া পাবার কোনও সুযোগ নেই। তা ছাড়া তখন জেলখাটা দাগী আসামী হিসেবে বেরোতে হবে, নিষ্কলুষ রেকর্ড নিয়ে নয়। আমাকে ব্যাপারটা ভেবে দেখতে বলল সে।
‘ভাবাভাবির আসলে কিছু ছিল না। এক মাসেই জীবন নরক হয়ে উঠেছিল আমার। দু-দু’বার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছি, ধর্ষিত হয়েছি। ওখানে বারো কিংবা ষোলো বছর তো দূরের কথা, আর একটা দিনও কাটাবার মত শক্তি ছিল না আমার। ভাবছিলাম আত্মহত্যার কথা। সে-অবস্থায় লোকটা যেন দেবদূতের মত হাজির হয়েছিল আমার সামনে। ড্রাগ ট্রায়াল নিয়ে মাথা ঘামালাম না। জেল থেকে বেরুনোটাই হলো আসল কথা! ট্রায়ালে যদি মারাও যাই, কী এসে-যায় তাতে? আমি তো এমনিতেই মরবার কথা ভাবছিলাম।’
‘আমার অভিজ্ঞতাও অনেকটা একই রকম,’ বলল ভেরোনিকা। ‘খুব বাজে একটা জায়গায় আটকা পড়েছিলাম—একটা পতিতালয়ে… সেখান থেকে মুক্তি পাবার উপায় হিসেবে প্রস্তাবটা দেয়া হয়েছিল আমাকে…’
পালা করে নিজেদের কাহিনী বলে চলল দু’জনে। বিপন্ন অবস্থায় অচেনা দুই লোক এসে প্রস্তাব দেয় ওদেরকে, দু’জনেই সেটা গ্রহণ করে। এরপর ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ফোর্ট ডেট্রিকে। সেখানকার একটা ডরমিটরিতে থাকতে দেয়া হয়। টিভিতে বা সিনেমায় যে-সব ডরমিটরি দেখা যায়, ওটাও সে-রকমই ছিল; পার্থক্য হলো, ওখান থেকে বেরুবার অনুমতি ছিল না ওদের। ওরা ছাড়াও আরও আটজন মেয়ে থাকত ওখানে—সবারই বয়স মোটামুটি একই রেঞ্জে; সবাইকেই একই কায়দায় রিক্রুট করা হয়েছে। অল্পদিনেই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল সবার। মিলেমিশে ডরমিটরিতে থাকতে শুরু করেছিল ওরা। পরিবেশ নিয়ে কারও কোনও অভিযোগ ছিল না। অন্তত জেলের মত বাজে পরিবেশ ছিল না ওখানে।
ফোর্ট ডেট্রিকে যেদিন পৌঁছুল, ‘ সেদিনই প্ৰথম ইঞ্জেকশনটা দেয়া হয় ওদের। আলাদা কোনও বিশেষত্ব ছিল না ওটার, মেয়েদের কাছে ইঞ্জেকশনটা নিছক একটা টিটেনাস শটের মত লেগেছে। ইঞ্জেকশনের দায়িত্বে থাকা মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান বলেছিল, জ্বর-টর আসতে পারে, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। পরের দু’সপ্তাহে বাকি দুটো ইঞ্জেকশন দেয়া হলো, তারপরেও কিছু হলো না। ইঞ্জেকশনের কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়ল না কারও ওপর। পরবর্তী দু’মাস কাটল ওভাবেই।
দলের একটি মেয়ে বিজ্ঞানে লেখাপড়া করেছে, সে বলল, ওরা সম্ভবত কন্ট্রোল গ্রুপ। বড় ধরনের যে-কোনও এক্সপেরিমেন্টে দু’ভাগে ভাগ করা হয় ‘টেস্ট সাবজেক্টদের। একদলকে সত্যিকার ওষুধ দেয়া হয়, আরেক দলকে দেয়া হয় সাধারণ স্যালাইন… এই দ্বিতীয় দলটাই কন্ট্রোল গ্রুপ নামে পরিচিত। এরপর দু’দলের মধ্যকার পার্থক্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ওষুধের প্রভাব ও কার্যকারিতা বিচার করা হয়। মেয়েটি ধারণা করল, ওরা সেই কন্ট্রোল গ্রুপে পড়েছে। কথাটা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। ওষুধ-টষুধ ছাড়া ওখানে দু’বছর কাটিয়ে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তার চেয়ে আনন্দের সংবাদ আর কী হতে পারে?
কিন্তু তৃতীয় মাসের মাঝ নাগাদ বদলে গেল সবকিছু। দেখা দিল ওষুধের রিঅ্যাকশন। প্রথমে ছাড়া-ছাড়াভাবে, তখন পাত্তা দেয়নি কেউ; পরে সেটা এমন আকার ধারণ করল যে, অগ্রাহ্য করবার উপায় রইল না। অবশ্য তখনও সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করেনি কেউ, সবাই ভেবেছে ওটা তাদের নিজস্ব সমস্যা। কারণ, ওটা ডরমিটরির অন্যান্যদের ওপর কাজ করে না; কাজ করে কেবল বাইরের লোকের ওপরে। মেডিক্যাল স্টাফরা যখন দেখা করতে আসে, কিংবা ডরমিটরির পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে বা গাড়ি নিয়ে যায়, শুধুমাত্র তখনই ব্যাপারটা অনুভব করে ওরা। ব্যাপারটা প্রায় এক সপ্তাহ নিজেদের ভেতর চেপে রাখল ওরা; ভাবল, কাউকে বলতে গেলে তাকে মানসিক রোগী ভাবা হবে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বের দেয়ালটা ধসে পড়ল আচমকা। সপ্তাহে দু’দিন রুটিন মেডিক্যাল টেস্ট করা হয় মেয়েদের। এমনই একটা দিনে টেস্টের ফাঁকে হঠাৎ এক মেডিক্যাল স্টাফ জানতে চাইল, ওদের কেউ মাথার ভেতর অচেনা কোনও কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে কি না। এমন কিছু কি শুনতে পাচ্ছে, যা তারা নিজেরা ভাবছে না?
যে-মেয়েটিকে প্রশ্নটা করা হলো, সে চমকে উঠল। স্বীকার করল, সত্যিই সেটা ঘটছে; কিন্তু কেন ঘটছে বুঝতে পারছে না। অন্যেরা শুনতে পেল তার কথা, সঙ্গে সঙ্গে দ্বিধা- দ্বন্দ্ব কেটে গেল সবার। এগিয়ে এসে জানাল, এই ব্যাপার ঘটছে তাদেরও। ওদের কথা শুনে পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করল সেই স্টাফ, যোগাযোগ করল কারও সঙ্গে। ব্যস, ওখানেই ইতি ঘটল ওদের ডরমিটরি জীবনের।
পরের এক ঘণ্টার ভেতর মেয়েদের সবাইকে আলাদা করে ফেলা হলো, তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ভিন্ন ভিন্ন বিল্ডিঙে। এবার আর ডরমিটরি নয়, খাঁচার ভেতর স্থান হলো প্রত্যেকের। গরাদেঅলা ছোট ছোট যে-কামরাগুলোয় থাকতে দেয়া হলো ওদের, তার সঙ্গে খাঁচা বা কারাপ্রকোষ্ঠের বিশেষ তফাৎ ছিল না। নতুন একদল মানুষ এরপর উদয় হলো—মাঝবয়েসী, বিজ্ঞানীসুলভ চেহারা; কেউ বা আবার ইউনিফর্ম পরিহিত মিলিটারি অফিসার। মেয়েদের ওপর গবেষণা চালাতে শুরু করল তারা, ঠিক যেভাবে ল্যাবরেটরির ইঁদুরের বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এক হিসেবে ইঁদুরেই পরিণত হলো ওরা, কারণ মানুষ হিসেবে ওদেরকে আর গণ্য করছিল না কেউ। গবেষকরা ওদেরকে নিয়ে আলোচনা করত, কিন্তু ওদের সঙ্গে কোনও কথা বলত না। এমন একটা ভাব দেখাত, যেন ওদের কোনও অস্তিত্ব নেই।
‘লোকগুলোর চিন্তা থেকেই জানতে পেরেছিলাম, আমাদের মুক্তি নেই,’ বলল এলিনা। ‘দু’বছরে তো নয়ই, জীবদ্দশাতেই আমাদের ছেড়ে দেবার কোনও পরিকল্পনা নেই তাদের। সবচেয়ে ভয়ের কথা, ওরা জানত আমরা ওদের মন পড়তে পারি, কিন্তু পরোয়া করত না। যেন আমাদের শোনাবার জন্যে সামনে এসে ভাবত ওসব কথা। ভাব দেখে বুঝতাম, আমরা কী জানছি বা না-জানছি, তাতে কিছুই আসে-যায় না। ওদের জাল থেকে মুক্তি পাব না আমরা কোনোদিনই।’
‘শুরুতে আমাদেরকে আড়ি পাতার কাজে ব্যবহারের কথা ভাবছিল ওরা,’ ভেরোনিকা বলল। ‘গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ভিভিআইপি-রা যখন হোটেলে ওঠে, তখন আমাদেরকে ছদ্মবেশে তাদের পাশের কামরায় রাখবে, যাতে আমরা আড়ি পেতে ওদের মনের সমস্ত খবর জেনে নিতে পারি। সোজা কথায়, এক ধরনের লিসেনিং ডিভাইস বানাতে চাইছিল… মনের লিসেনিং ডিভাইস। বুদ্ধিটা একেবারে মন্দ নয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা করা হলো না।’
‘কেন?’ জানতে চাইল রানা।
‘বিজ্ঞানীরাই বাগড়া দিলেন। বললেন, আমরা এক্সপেরিমেন্টাল ফেজে রয়েছি, সে-অবস্থায় আমাদের ফিল্ডে পাঠানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তারচেয়ে আমাদের দশজনকে পুরোপুরিভাবেই ল্যাব টেস্টে রাখা হোক। ড্রাগটার লং টার্ম এফেক্ট পর্যবেক্ষণ করবেন তাঁরা। মানবশরীরে ড্রাগটা কতদিন কার্যকর থাকে, জানা দরকার তাঁদের। সময়ের সঙ্গে মাইওরিডিঙের ক্ষমতা বাড়ে-কমে কি না, ড্রাগের কারণে শরীরে কোনও মরণব্যাধি—যেমন ধরো ক্যান্সার, নিউরন ডিজিজ, হার্টের সমস্যা, আলযেইমার’স্, ইত্যাদি—দেখা দেয় কি না… এসবের ওপর গবেষণা চলবে।’
ওরা আসলে আমাদের টেস্টের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় প্রজন্মের মাইণ্ডরিডার সৃষ্টি করতে চাইছিল, যাদের ভেতরে কোনও ধরনের সমস্যা থাকবে না, বলল এলিনা। ‘সুস্থ, সবল, ত্রুটিহীন একদল মাইণ্ডরিডার।’
‘বুঝতে পারছি,’ বলল রানা।
‘চরম সত্যটা বুঝতে পেরে আমাদের মনের কী দশা হয়েছিল, আন্দাজ করতে পারো? যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়েও ভয়ঙ্কর একটা শাস্তি পেতে চলেছিলাম আমরা। যতদিন বেঁচে থাকব, ল্যাবরেটরির গিনিপিগ হয়ে থাকতে হবে। বয়স ছাড়া আর কিচ্ছু বদলাবে না আমাদের… যতদিন না কবরে যাচ্ছি! মুষড়ে পড়েছিলাম সবাই। আর তখুনি একটা নতুন ঘটনা ঘটল। অ্যাম্বার মিচেল নামে একটা মেয়ে ছিল আমাদের মাঝে। একটা রুটিন মেডিক্যাল চেকআপের সময় আবিষ্কৃত হলো, সে প্রেগন্যান্ট। ড্রাগ ট্রায়ালে যোগ দেবার ঠিক আগেভাগে মেয়েটা গর্ভধারণ করেছিল, কিন্তু সেটা কেউ জানত না।’
একযোগে অ্যালির দিকে তাকাল এলিনা আর ভেরোনিকা। গল্পের এ-অংশটা ওকে আগেই জানিয়েছে ওরা, কিন্তু তারপরেও অ্যালিকে আবেগাপ্লুত হতে দেখল রানা। চোখ ছল ছল করছে।
‘আমাদের বন্দিজীবনের অষ্টম মাসে জন্ম হয় অ্যালির,’ ভেরোনিকা বলল। ‘মায়ের কাছ থেকে আলাদা করা হয়নি ওকে, অ্যাম্বারকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল সন্তানকে নিজের কাছে… ওই বন্দিশালায় রেখে বড় করে তোলার। না, সেটা মহানুভবতা ছিল না, বরং পরীক্ষা-নিরীক্ষারই আরেকটা ধাপ ছিল। বিজ্ঞানীরা দেখতে চেয়েছিল, জরায়ুর ভ্রূণের ওপর ওদের আর.এন.এ. ইন্টারফ্যারেন্স ড্রাগের কোনও প্রভাব পড়ে কি না। আফটার অল, অ্যালি তার মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতে অ্যাম্বারকে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছিল তো! এ-কথা বলার বোধহয় প্রয়োজন নেই যে, প্রভাব পড়েছে… বেশ ভালমতই পড়েছে। তার কিছু নমুনা তুমি ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই দেখেছ, রানা। যা দেখোনি, তা নিয়েই সব সমস্যা। ড্রাগটা অ্যালির ওপর এমনভাবে কাজ করেছে, যা আমাদের কারও ওপর করেনি। তার ফলে ও হয়ে উঠেছে আমাদের সবার চেয়ে আলাদা।’
‘আলাদা?’ ভুরু কোঁচকাল রানা। ‘কীভাবে?’
শব্দ করে শ্বাস ফেলল অ্যালি। ‘সেটাই ওরা আমাকে বলছে না।’