অন্তর্যামী – ২২

বাইশ

কোল্ড স্প্রিংসে ঢোকা নিরাপদ মনে হলো না রানার কাছে। রাস্তা ছেড়ে মরুভূমিতে নামল ও, এবড়ো-খেবড়ো জমিনের ওপর দিয়ে ছোটাল গাড়ি। কয়েক মাইল যাবার পর একটা কাঁচা রাস্তার দেখা মিলল, সেটা উত্তরে গিয়ে ইউ.এস. ফিফটিতে মিলেছে। সেই রাস্তা ধরে ফ্রিওয়েতে উঠে এল অ্যাকর্ড। এবার গতি বাড়াল রানা।

পিকআপ ফেলে আসার পর থেকে একটা কথাও বলেনি কেউ। অ্যালিকে উসখুস করতে দেখে রানা নীরবতা ভাঙল। বলল, ‘আমাকে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। কী ঘটল ওখানে, তা আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’

আরও ঘণ্টাখানেক না কাটা পর্যন্ত স্বস্তি পেল না ও। শেষে ইন্টারস্টেট সেভেন্টিতে পৌঁছে একটু ঢিল দিল সতর্কতায়। অঙ্গরাজ্যের পূর্ব প্রান্ত ঘেঁষে ছুটছে এখন ওদের অ্যাকর্ড। কিছুক্ষণ পর সামনার নামে একটা ছোট্ট শহরের দেখা পেল। ফ্রিওয়ে থেকে শহরের আকার দেখে মনে হলো, ভেতরে একটা লাইব্রেরি পাওয়া যেতে পারে।

সত্যিই পাওয়া গেল—শহরের স্কুলের পাশে ছোট্ট পাবলিক লাইব্রেরি, পার্কিং লটটা প্রায় ফাঁকা। খুশি হলো রানা, খুব বেশি লোকজনের সঙ্গে দেখা হবে না। সানগ্লাস আর বেসবল ক্যাপ পরে আছে ও, কিন্তু তাতে চেহারা পুরোপুরি ঢাকা পড়ে না।

অ্যালিকে একাই লাইব্রেরিতে পাঠাবার কথা ভাবল রানা, কিন্তু পরক্ষণে সিদ্ধান্ত পাল্টাল। একা থাকা চলবে না ওর। একাকী একজন অপরিচিত লোককে গাড়িতে বসে থাকতে দেখলে শহরবাসীর সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে।

‘আমাকে একা দেখলেও সন্দেহ করতে পারে,’ রানার মনের কথা পড়ে বলল অ্যালি। ‘আমার বয়েসী একটা অচেনা মেয়ে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়।’

‘ঠিক বলেছ,’ একমত হলো রানা। দু’জনে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।

লাইব্রেরির এন্ট্রান্সের মুখে একটা ডেস্কে বসে আছে মাঝবয়েসী এক মহিলা—সে-ই লাইব্রেরিয়ান। রানা আর অ্যালিকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল, উপহার দিল সৌজন্যমূলক হাসি। নড করল রানা, মুখ ঘুরিয়ে নিল আরেকদিকে। ওকে ভাল করে দেখার সুযোগ পেল না মহিলা, উৎসাহী ভঙ্গিতে হাত নেড়ে তাকে সম্ভাষণ জানাল অ্যালি, বাধ্য করল নিজের দিকে তাকাতে।

বুদ্ধিমতী মেয়ে… মনে মনে ওর কৌশলের প্রশংসা করল রানা।

‘থ্যাঙ্কস,’ নিচু গলায় বলল অ্যালি

‘লাইব্রেরিয়ান কী ভাবছে, বুঝতে পেরেছ? আমাকে চিনে ফেলেনি তো?’

মাথা নাড়ল অ্যালি

লাইব্রেরির এক কোণে, একটা কাউন্টারের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে তিনটে কম্পিউটার। আশপাশে কেউ নেই। এখন পর্যন্ত অল্পবয়েসী এক ছেলে ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়েনি ওদের। দূরের একটা টেবিলে বসে নিবিষ্টমনে বই পড়ছে সে, কোনোদিকে খেয়াল নেই। চেয়ার টেনে একটা কম্পিউটারের সামনে বসল রানা, মাউস নেড়ে স্লিপ মোড থেকে জাগিয়ে তুলল ওটাকে। আরেকটা চেয়ার টেনে ওর পাশে বসল অ্যালি।

ইন্টারনেট কানেকশন আছে কি না দেখে নিল রানা, এরপর ব্রাউজার খুলে সার্চবারে টিফানি ক্যানট্রেলের নাম টাইপ করল—ইয়েলো-পেজ-সার্চ চালাল অ্যামারিলো, টেক্সাসে।

ফলাফল, শূন্য।

এক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে আবারও সার্চ করল রানা, এবার প্যারামিটার বদলে পুরো টেক্সাসে দেখছে। ডা. ক্যানট্রেল হয়তো অ্যামারিলোর বাইরে থাকে। কিন্তু আবারও ব্যর্থ হতে হলো।

সার্চ পেজ বন্ধ করে দিয়ে এরপর গুগল ম্যাপ ওপেন করল রানা, অ্যামারিলোর ওপর জুম করে হাসপাতাল খুঁজল। তিনটা বড় হাসপাতাল আছে শহরে, আর আছে বেশ কিছু প্রাইভেট প্র্যাকটিস। প্রাইভেট ডাক্তারদের কারও নাম টিফানি ক্যানট্রেল নয়।

বড় হাসপাতালগুলোর ওয়েবসাইটে এবার ঢুঁ মারল রানা। স্টাফদের তালিকা বের করে পড়তে থাকল সবক’টা নাম। তিন নম্বর হাসপাতালে গিয়ে একটু আশান্বিত হয়ে উঠল। টিফানি প্রাইস নামে একজন ডাক্তার রয়েছে ওখানে, তবে তার পরিচিতির পেজে কোনও ছবি দেয়া হয়নি। ভুলে বাদ পড়ে গেছে, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ছবিটা দেয়া হয়নি, কে জানে। নিশ্চিত হবার জন্যে ফটো গ্যালারির সব ছবি খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। খানিক পরেই পাশ থেকে অস্ফুট শব্দ করে উঠল অ্যালি।

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল রানা।

স্ক্রিনের দিকে আঙুল তুলল অ্যালি, নিচদিকের একটা ছবিকে ইশারা করছে। হাসপাতালের ছাতের ছবি। স্ট্রেচারে করে একজন রোগীকে নিয়ে হেলিপ্যাডে অপেক্ষমাণ হেলিকপ্টারের দিকে যাচ্ছে দু’জন মেডিক্যাল স্টাফ। তবে তাদের দিকে নয়, অ্যালি ইশারা করছে স্টাফদের পেছনে, ছাতে বেরুবার করিডোরে দাঁড়ানো একটি নারীমূর্তির দিকে। ক্যামেরার দিকে পাশ ফিরে রয়েছে মেয়েটি, চেহারা পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না… প্রথম দর্শনে চোখ পড়ে না তার দিকে। রানাও মিস করে গিয়েছিল।

‘ইনিই?’ জিজ্ঞেস করল ও।

কম্পিউটারের স্ক্রিনের কাছে মুখ নিয়ে গেল অ্যালি। ভালমত দেখল ছবিটা। বলল, ‘হ্যাঁ। আমি শিয়োর।’

গম্ভীর চোখে ছবির নারীকে খেয়াল করল রানা। ডাক্তারের অ্যাপ্রন পরে রয়েছে; বয়স খুব বেশি নয়, ত্রিশের আশপাশে। মাথায় সোনালি চুল। সত্যিই কি টিফানি ক্যানট্রেল? হতে পারে, মনে মনে স্বীকার করল রানা। হয়তো নাম ভাঁড়িয়ে কাজ করছে হাসপাতালে। টিফানি ক্যানট্রেলই হয়তো টিফানি প্রাইস—পুরো নাম না বদলে শুধু পদবী পাল্টেছে। এমনটা করে অনেকে, রানা দেখেছে।

নাম বদলানো, এবং কোথাও ছবি না দেয়া… মানেটা কী দাঁড়াল? এই ডাক্তার বিপদের মধ্যে রয়েছে, এবং সেটা সে জানে। সেজন্যেই নাম-ধাম বদলে আত্মগোপন করেছে।

ইয়েলো পেজে ফিরে গেল রানা। টিফানি প্রাইসের নাম টাইপ করে সার্চ বাটন চাপল। একটামাত্র এন্ট্রি বেরুল। সঙ্গে ঠিকানা দেয়া আছে।

গুগল থেকে ঠিকানাটা ম্যাপে দেখে নিল রানা। স্ট্রিট ভিউ অপশন থেকে দেখে নিল বাড়ি ও তার আশপাশের রাস্তা। পুরনো আমলের একটা টাউনহাউস মডেলের বাড়িতে থাকে ডা. ক্যানট্রেল। আশপাশের সব বাড়ি ওই একই ডিজাইনে তৈরি।

‘ডাক্তার যদি এখনও বেঁচে থাকেন, লিয়ারির লোকেরা নিশ্চয়ই তাঁকে চোখে চোখে রাখছে,’ প্রশ্ন নয়, মন্তব্যের সুরে বলল অ্যালি।

‘নিঃসন্দেহে।’ সায় দিল রানা।

‘তা হলে ওঁর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করব কীভাবে? ‘যোগাযোগের আগে ডাক্তারের সম্পর্কে ভাল করে জেনে নিতে হবে আমাদেরকে,’ রানা বলল। ‘তোমার স্মৃতিতে তাকে ভালমানুষ মনে হয়েছে মানে এ-ই না যে, আগুপিছু না ভেবে সরাসরি হাজির হয়ে যাব তার সামনে। সে শত্রুপক্ষের লোকও হতে পারে!’

কম্পিউটারের স্ক্রিনে আবার মনোযোগ দিল ও। স্ট্রিট- ভিউ থেকে ভালমত দেখে নিচ্ছে ডাক্তারের বাড়ি, রাস্তা, আর পুরো পাড়াটা। ওখানে আড়ি পাতা যায় কি না, ভাবল। কার সঙ্গে, কী বিষয়ে কথা বলছে ডাক্তার, সেসব শুনতে পারলে একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে—কারও সঙ্গে সে হাত মিলিয়েছে কি না। সমস্যা হলো, আড়ি পাতার কোনও যন্ত্রপাতি নেই ওদের সঙ্গে। এসব জিনিস সাধারণ কোনও দোকানে পাওয়া যায় না।

রানার চিন্তাধারা অনুসরণ করছিল অ্যালি। এবার ও বলল, ‘আড়ি পাতার আরেকটা কায়দা আছে।’

‘কী কায়দা?’

টিফানির বাড়ির দু’পাশের বাড়িগুলো দেখাল অ্যালি। জিজ্ঞেস করল, ‘এগুলোর কোনোটায় ঢুকতে পারব আমরা? মানে… কিছুটা সময় থাকতে পারব ওগুলোর কোনোটার ভেতরে?’

‘কী জানি,’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘একেবারে অসম্ভব বোধহয় না। ঘরের লোক বাইরে গেছে, এমন বাড়ি নিশ্চয়ই পাব। ভাড়া হয়নি, এরকম খালি অ্যাপার্টমেন্টও থাকতে পারে। কিন্তু কেন?’

‘একেকটা বাড়ি কতটুকু চওড়া?’ জবাব না দিয়ে আরেকটা প্রশ্ন ছুঁড়ল অ্যালি।

‘টাউনহাউস তো, পঁচিশ-ত্রিশ ফুটের বেশি হবে না।’ ঘাড় ফিরিয়ে লাইব্রেরির রিডিং এরিয়ার দিকে তাকাল অ্যালি। লাইব্রেরিতে হাজির হওয়া একমাত্র পাঠকটি একেবারে শেষ টেবিলে বসে বই পড়ছে।

‘ছেলেটা আমাদের থেকে কত দূরে?’ অ্যালির তৃতীয় প্রশ্ন।

‘ষাট ফুট,’ রানা বলল। ‘সামান্য কম-বেশি হতে পারে।’

‘গুড।’ ওদিকে ঘুরে বসল অ্যালি, চোখ মুদল। কপালে ভাঁজ পড়ল ওর, কুঁচকে গেল ভুরু। মনে হলো, দুর্বল কানেকশনের টেলিফোনে কিছু শোনার চেষ্টা করছে বুঝি। খানিক পর বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল:

‘…হি গিভস্ হিজ হারনেস বেলস্ আ শেক
টু আস্ক ইফ দেয়ার ইজ সাম মিস্টেক।
দি ওনলি আদার সাউণ্ড’স্ দ্য সুইপ
অভ ইজি উইণ্ড অ্যাণ্ড ডাউনি ফ্লেক।
দ্য উডস্ আর লাভলি, ডার্ক অ্যাণ্ড ডিপ,
বাট আই হ্যাভ প্রমিজেস টু কিপ,
অ্যাণ্ড মাইলস্ টু গো বিফোর আই স্লিপ…’

চোখ খুলল অ্যালি। রানার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল।

‘রবার্ট ফ্রস্ট,’ বলল রানা।

মৃদু হাসল অ্যালি। দূরে বসা পাঠককে ইশারা করে বলল, ‘ওর প্রিয় কবি। বসে বসে তাঁর কবিতা পড়ছে।’

ওর মতলবটা এবার বুঝতে পারছে রানা। মুখ ঘুরিয়ে কম্পিউটারের ছবি দেখল। ষাট ফুট… তারমানে, ডাক্তারের বাড়ি থেকে দু’বাড়ি দূরে পজিশন নিলেও তার মাইগুরিডিং করতে পারবে অ্যালি। কে জানে, আরও দূর থেকেও হয়তো সম্ভব।

‘ইন্টারেস্টিং,’ মন্তব্য করল ও।

‘আইডিয়াটা পছন্দ হয়েছে?’ জানতে চাইল অ্যালি।

‘খুব,’ বলে কিবোর্ডের বোতাম চাপল রানা, একটা রিয়াল এস্টেটের ওয়েবসাইট ওপেন করল। এক মিনিটের মাথায় টিফানি ক্যানট্রেলের পাড়ার লিস্টিং পেয়ে গেল ও। পছন্দসই রেঞ্জের ভেতর তিনটা অ্যাপার্টমেণ্ট ফাঁকা রয়েছে। সবচেয়ে সুবিধেজনকটা টিফানির দুটো বাড়ি পরে। দোতলায়। টিফানির বাড়ির পুরোটাই অ্যালির নাগালের ভেতর থাকবে।

‘কতক্ষণ লাগবে ওখানে পৌঁছুতে?’ জিজ্ঞেস করল অ্যালি।

ডেস্কটপের কোনায় ঘড়ি দেখে নিল রানা। মনে মনে হিসেব করে বলল, ‘মাঝরাত।’

‘চলো, রওনা হওয়া যাক।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *