অন্তর্যামী – ৩৫

পঁয়ত্রিশ

তিন. মিনিট হলো লিয়ারিকে ফোন করেছে রানা, জবাব পায়নি। নিজের ফোন থেকে টিফানিও চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি। সমস্যাটা ফোনের ভেবে রানার নাম্বারে কল করেছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠেছে ওটা।

এখন এক জানালা থেকে আরেক জানালায় ছুটছে দু’জনে, নজর বোলাচ্ছে চারদিকের প্রান্তরে। ফার্মহাউসের দিকে কেউ এগিয়ে আসছে কি না, দেখতে চাইছে।

‘কোনও মানে হয় না,’ কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে বলল টিফানি। ‘ওদেরকে আমরা যদি দেখতেও পাই, লাভ কী?’

লিভিং রুমের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে রানা। ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে কী করতে চাও?’

‘দু-দুটো গাড়ি আছে গ্যারাজে,’ টিফানি বলল। ‘পালানোর চেষ্টা করলে কেমন হয়? হেডলাইট নিভিয়ে যদি মাঠের ওপর দিয়ে ফুল স্পিডে ছুটি, দু’মিনিটের মধ্যেই অ্যালির লকিং রেঞ্জের বাইরে চলে যেতে পারব।’

‘তার আগেই ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনে আমাদেরকে আবার লক করে ফেলবে ও।’

‘এখানে বসে থাকলে সেটা এমনিতেও করবে,’ কেঁপে উঠল টিফানি।

‘শান্ত হও,’ ওকে বলল রানা। ‘লিয়ারির কী হয়েছে, তা জানি না আমরা। সে যদি মারাও গিয়ে থাকে, তার মানে এই নয় যে, প্ল্যানটার বারোটা বেজেছে। আমরা পালাবার চেষ্টা করলেই বরং ওটায় ব্যাঘাত ঘটবে। একটু ধৈর্য ধরো, এমন সুযোগ বার বার আসবে না।’

পাল্টা কিছু বলতে চাইছিল টিফানি, থমকে গেল জানালায় চোখ পড়ায়। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রানাও বাইরে তাকাল। দুটো ছায়ামূর্তি! মাঠের ওপর দিয়ে লম্বা লম্বা কদম ফেলে এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না, তবে তার প্রয়োজনও নেই। দু’জনের আকার-আকৃতি আর উচ্চতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিচয়।

এগিয়ে এসে রানার হাত ধরল টিফানি। ওর হাতের তালু ঘামছে। মুঠোয় মৃদু চাপ দিয়ে ওকে সাহস জোগাতে চাইল রানা।

থামার কোনও লক্ষণ নেই দুই ছায়ামূর্তির মাঝে, মাঠের অর্ধেকটা পেরিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে। ওদের হাঁটার ভঙ্গিতে কী যেন একটা বৈসাদৃশ্য লক্ষ করল রানা। সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় পেল না ও, তার আগেই শুরু হয়ে গেল নরক গুলজার।

প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে গেল উজ্জ্বল একটা আলোয়। তার পিছু পিছু ভেসে এল প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের আওয়াজ। সেটা এতই তীব্র যে, চুর চুর করে ভেঙে পড়ল দক্ষিণদিকের সমস্ত জানালার কাঁচ।

ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল টিফানি। ওকে জড়িয়ে ধরল রানা—নিজের শরীরকে বর্ম বানিয়ে পিঠ ঘোরাল জানালার দিকে, যাতে ছুটে আসা কাঁচের টুকরোয় আহত না হয় মেয়েটা। আলোর তীব্রতা কমে এলে আড়চোখে তাকাল বাইরে।

আরেকটা বিস্ফোরণ ঘটল। আবারও আলোকিত হলো প্রান্তর। দুই ছায়ামূর্তি ইতিমধ্যে উল্টো ঘুরে গেছে, প্রাণপণে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছে। তৃতীয় বিস্ফোরণ হলো, এরপর চতুর্থটা। নিয়মিত ছন্দে বিস্ফোরণ ঘটছে তাদের চারপাশে, যেন শুরু হয়েছে কোনও আতশবাজির খেলা।

‘হচ্ছেটা কী?’ চেঁচিয়ে উঠল টিফানি।

প্ল্যানের বাস্তবায়ন,’ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল রানা।

শব্দ আর আলোর ফুলঝুরির মাঝ দিয়ে দৌড়ে চলেছে অ্যালি ও ভেরোনিকা—দক্ষিণে, যেদিক থেকে ওরা এসেছে। কিন্তু ষাট ফুট যেতেই পরাস্ত হলো দু’জনে। পুরু সাদা ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে প্রান্তর। দুই পলাতকের চারপাশে… যেখানে যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে… সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে এই ধোঁয়া। ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। একদম মাঝখানে পড়ে গেছে অ্যালি আর ভেরোনিকা। আলোর শেষ ঝলকানিতে ওদেরকে টলে উঠতে দেখল রানা, দু’জনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে।

নেমে এল অন্ধকার। নীরবতা।

কান ঝন ঝন করছে রানার। সেলফোনের রিংটোন প্রথমে শুনতে পেল না, ভাইব্রেশনে টের পেল, ওটা বাজছে। ফোন বের করে দেখল, ডিসপ্লেতে ভেসে উঠেছে লিয়ারির নাম্বার।

‘কোথায় ছিলেন আপনি?’ কল রিসিভ করে ধমকে উঠল ও।

‘সরি,’ সকৌতুকে বলল লিয়ারি। প্রসন্ন কণ্ঠ। ‘ইচ্ছে করেই জবাব দিইনি। ভেবেছিলাম, আপনারা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে অ্যালির সাহস আরও বেড়ে যাবে।’

ব্যাকগ্রাউণ্ডে একটা গুঞ্জন শুনতে পেল রানা। হেলিকপ্টারের টার্বাইন চালু হচ্ছে।

‘লিভিং রুমের কাউচের মাঝখানের কুশনটা তুলে ফেলুন,’ লিয়ারি বলল। ‘তলার খোপে দুটো গ্যাস মাস্ক পাবেন।’

মাস্কদুটো বের করল রানা, একটা তুলে দিল টিফানির হাতে।

‘আমি দশ মাইল দূরে আছি,’ জানাল লিয়ারি। ‘তিন থেকে চার মিনিটের ভেতর ফার্মহাউসে পৌঁছুব। তার আগে অ্যালি বা ভেরোনিকার জ্ঞান ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই, তারপরেও সতর্ক থাকা ভাল। ডা. ক্যানট্রেলকে বলুন, গ্যারাজ থেকে যে-কোনও একটা গাড়ি নিয়ে এখুনি বেরিয়ে পড়তে। যেখানে খুশি চলে যেতে পারেন, কাউকে বলার প্রয়োজন নেই। সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা পরে যোগাযোগ করব তাঁর সঙ্গে।’

‘ঠিক আছে, বলছি। আর আমি?’

‘ওখানেই থাকুন। শীঘ্রি দেখা হচ্ছে আপনার সঙ্গে।’

ভাঙা জানালা দিয়ে ইতিমধ্যে ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করেছে ঘরে। গ্যাস মাস্ক পরে ফেলেছে টিফানি, রানাও পকেটে ফোন রেখে নিজেরটা পরল।

‘কী ব্যবহার করেছে ওরা?’ জিজ্ঞেস করল টিফানি। মাস্কের আড়াল থেকে যান্ত্রিক শোনাচ্ছে ওর কণ্ঠ।

‘গ্যাস মর্টার শেল,’ রানা বলল। ‘লঞ্চারগুলো দূর থেকে অপারেট করা যায়। রেঞ্জ, দশ মাইল।’

বারান্দায় বেরিয়ে এল দু’জনে। আবছা আলোয় মেঘের মত লাগল মাঠের ওপর স্থির হয়ে থাকা গ্যাসটাকে। টিফানিকে লিয়ারির নির্দেশ শোনাল রানা। দ্বিধা দেখা দিল টিফানির মাঝে।

‘আমি থাকছি এখানে,’ ওকে বলল রানা। ‘অ্যালির দিকে খেয়াল রাখব। প্রমিজ।’

‘আমি ভাবছি গ্যাসের কথা, বলল টিফানি। ‘ওতে অ্যালির কোনও ক্ষতি হবে না তো?’

‘আশা করি হবে না। ওকে খুন করতে চায় না লিয়ারি। তুমি এখন যাও। ফিরে আসা নিরাপদ মনে হলে আমি ফোন করব তোমাকে।’

আরও কয়েক সেকেণ্ড দোনোমনো করল টিফানি। এরপর দ্বিধা ঝেড়ে পা বাড়াল গ্যারাজের দিকে। খানিক পর শোনা গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ। গ্যারাজের দরজা খুলে গেল, সেডান নিয়ে বেরিয়ে এল ও। রানার দিকে হাত নাড়ল একটু, চলে গেল ড্রাইভওয়ে ধরে। গাড়ির টেইললাইট অন্ধকারে ‘মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওদিকে চেয়ে রইল রানা।

.

হেলিকপ্টারের সিটে বসে স্ট্র্যাপ আটকাতে আটকাতে নতুন একটা নাম্বারে কল করল লিয়ারি। হেডসেটের সঙ্গে কানেক্ট করে নিল ফোনটা। দ্বিতীয়বার রিংশেষে শোনা গেল একটা ভারী কণ্ঠস্বর।

‘চার্লটন বলছি।’

‘সবকিছু ঠিক,’ তাকে বলল লিয়ারি। অ্যালিকে নিউট্রালাইয করা হয়েছে। রানা আছে ওর সঙ্গে। ডা. ক্যানট্রেলকে আমি ওখান থেকে সরিয়ে নিয়েছি, তবে সময় হলে ওঁকে আবার ডেকে নেয়া যাবে।’

ওরা কিছু আঁচ করেনি তো?’ জিজ্ঞেস করল চার্লটন।

‘না, দু’জনেই অন্ধকারে।’

কল্পনায় চার্লটনকে দেখল লিয়ারি—কানাডিয়ান রকির দুর্গম কম্পাউণ্ডে আরাম করে বসে আছে। আর এদিকে সে কিনা… মুখের ভেতরটা তেতো লাগল তার। কিন্তু কিছু করার নেই, পরিস্থিতি তাকে ওই লোকের সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য করেছে। যেখানে বীজ বপন করা হয়েছে, সেখানেই ফুল ফোটাতে হবে।

‘বুঝতে পেরেছি,’ চার্লটন বলল। ‘আমাদের কন্ট্রোল অ্যাসেট পাঁচ মিনিটের ভেতর আকাশে উড়বে। ত্রিশ মিনিটের মত লাগবে টার্গেট এরিয়ায় পৌঁছুতে। এরপর শুরু হবে আসল কাজ।’

কন্ট্রোল অ্যাসেটের নমুনা লিয়ারি দেখেছে—কালো রঙের পিপের মত একটা যন্ত্র… সেলফোন টাওয়ারের গায়ে আটকানো অবস্থায়। তবে আজ যেটা পাঠানো হচ্ছে, সেটা থাকবে একটা সি-ফাইভ গ্যালাক্সি এয়ারক্র্যাফটের কার্গো হোল্ডে। ওখান থেকেই অপারেট করা হবে ওটা।

‘আবার বলছি,’ হেডসেটে শোনা গেল চার্লটনের কণ্ঠ, ‘বড় সমস্যাটা মিটিয়ে দেব আমরা, কিন্তু তাতে তোমার বিপদ কাটছে না। অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন, আলবার্ট ফুলার, আর ববি মুরল্যাণ্ড… এরা রয়ে যাচ্ছে পেছনে। কীভাবে ঠেকাবে ওদেরকে?’

‘রিল্যাক্স,’ ক্রূর হাসি ফুটল লিয়ারির ঠোঁটে। ‘আজ রাতে সব প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতে চলেছি আমরা। প্রমাণ ছাড়া কিছু করতে পারবে না ওরা। আর যদি বাড়াবাড়ি করেই, ওদের মুখ বন্ধ করার মত প্রচুর কৌশল জানা আছে আমার।’

‘তা আর বলতে!’ চার্লটনও হাসল ওপাশ থেকে।

.

কয়েক মিনিট পর, এক হাজার মাইল দূরে, টেলিফোনের শব্দে কাঁচা ঘুম থেকে জেগে উঠলেন নুমার ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন। রিসিভার কানে ঠেকাতেই শুনতে পেলেন হোমল্যাণ্ড সিকিউরিটির প্রধান আলবার্ট ফুলারের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।

‘একটা দুঃসংবাদ আছে, অ্যাডমিরাল।’

‘কী হয়েছে?’

‘খানিক আগে রানাদের ফার্মহাউসে আক্রমণ করতে গিয়েছিল অ্যালিসন মিচেল…’

‘লিয়ারির প্ল্যান ফেল করেছে?’

‘না, স্যর। প্ল্যান ঠিকমতই এগিয়েছে। সমস্যা অন্যখানে।’

‘কী সমস্যা?’

‘আপনার কথামত লিয়ারির ফোনে আড়ি পেতে রেখেছিলাম আমি। খানিক আগে একটা কল ইন্টারসেপ্ট করেছি। যা শুনলাম, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের সঙ্গে বেঈমানী করতে চলেছে সে। রানা, অ্যালি, ভেরোনিকা, বা টিফানি ক্যানট্রেল… কাউকেই বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে তার নেই।

‘কী!’ ধড়মড় করে উঠে বসলেন অ্যাডমিরাল। ‘থামাও ওকে!’

‘আমাদের হাতে সময় নেই, স্যর। ওরা যে-কোনও মুহূর্তে পৌঁছে যাবে ওখানে। তারপরেও একটা টিম রেডি করছি আমি। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন…’

‘রানাকে সাবধান করে দিতে হবে। তা হলে হয়তো কিছুটা সময় পাব আমরা। ওকে যে-সেলফোনটা দেয়া হয়েছে, সেটার নাম্বার কি আছে তোমার কাছে?’

‘আছে, স্যর। কিন্তু ওটায় নির্ঘাত আড়ি পেতে রেখেছে লিয়ারি। আমরা রানাকে সতর্ক করতে গেলেই টের পেয়ে যাবে।’

ঠোঁট কামড়ালেন অ্যাডমিরাল। কী করা যায়? আচমকা বিদ্যুৎচমকের মত একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়।

‘মুরল্যাণ্ড কোথায়?’ বললেন তিনি। ‘খবর দাও ওকে।’

.

মাঠের ওপর যেন জমাট বেঁধে আছে সাদা ধোঁয়া। তবে মৃদু বায়ুপ্রবাহে ধীরে ধীরে সরতে শুরু করেছে, ভেসে যাচ্ছে পশ্চিমে। হেলিকপ্টার চলে এলে রোটরের ধাক্কায় পুরোপুরি কেটে যাবে। দেরি নেই তার। কপ্টারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে রানা, জোরালো হচ্ছে ক্রমশ। খুব শীঘ্রি দেখা যাবে।

বাড়ি থেকে একশো গজ চলে এসেছে রানা। ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে দেখতে পেল অ্যালি আর ভেরোনিকাকে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। দৌড়াতে শুরু করল ও। গোলমালের আভাস পাচ্ছে। কপালের দু’পাশে শীতল অনুভূতিটা হচ্ছে না ওর, অথচ অ্যালির কাছাকাছি গেলেই সেটা হবার কথা—মেয়েটা জেগে বা ঘুমিয়ে থাকুক। এর মানে কী? খারাপ কিছু হয়ে যায়নি তো ওর?

হেলিকপ্টারের আওয়াজ বেড়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ওটাকে দেখতে পেল রানা—বড়জোর দু’মাইল দূরে। চলে আসবে এক্ষুণি। অ্যালির পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ও। চুল সরিয়ে ঘাড়ের ক্যারোটিড আর্টারি স্পর্শ করল, চেক করল পালস।

বেঁচে আছে মেয়েটা। নাড়িস্পন্দন স্বাভাবিক। তা হলে কপালে কিছু অনুভব করছে না কেন?

আচমকা কেঁপে উঠল রানা। খাড়া হয়ে গেল ঘাড়ের পেছনের খাটো চুলগুলো। মনে পড়ে গেল জানালা দিয়ে দেখা ছায়ামূর্তিদুটো। কী নিয়ে খটকা লেগেছিল, তা বুঝতে পারছে এবার। একসঙ্গে পা ফেলছিল না ওরা। একজন এগোলে অন্যজন থেমে যাচ্ছিল। যেন পালা করে দুটো পুতুলকে হাঁটাচ্ছিল কেউ।

তাড়াতাড়ি অজ্ঞান দেহটাকে চিৎ করল রানা। মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল চুল। যা ভেবেছে তা-ই। অ্যালি নয়, অচেনা একটা চেহারা।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। এক টানে মুখ থেকে খুলে ফেলল মাস্ক, ছুটতে শুরু করেছে একই সঙ্গে। পৌঁছুতে চাইছে পরিষ্কার বাতাসে। হাতে ফোন বেরিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে, দৌড়াতে দৌড়াতেই ডায়াল করল লিয়ারির নাম্বারে। হেলিকপ্টার ততক্ষণে ফার্মহাউসের প্রায় ওপরে চলে এসেছে।

একবার রিং হলো। তারপরেই খুট করে কানেক্ট হলো কলটা।

‘হেলিকপ্টার ঘোরান!’ চেঁচাল রানা। ‘জলদি! আমাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে ও… পাল্টা ফাঁদ পেতেছে। পালান এখান থেকে!’

কথাটা বলতে না বলতে বদলে গেল হেলিকপ্টারের আওয়াজ। খসে পড়তে শুরু করল আকাশ থেকে। ফোনের ইয়ারপিসে শোনা গেল চেঁচামেচি। কন্ট্রোল ছেড়ে দিয়ে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাইলট আর কো-পাইলট। ঘুরপাক খেতে খেতে ফার্মহাউসের ওপর দিয়ে উড়ে গেল কপ্টার—কেউ এখন আর ওটাকে ওড়াচ্ছে না। মাঠের দূর প্রান্তে গিয়ে ভারী পাথরের মত আছড়ে পড়ল মাটিতে। ইস্পাত থেঁতলে যাওয়ার বিশ্রী শব্দ শোনা গেল, তারপরেই বিস্ফোরিত হলো পুরো কাঠামো। আগুনের একটা গোলা যেন লাফিয়ে উঠল ওখানে। দূর থেকেও শকওয়েভ আর তাপের হলকা অনুভব করল রানা।

অপলকে তাকিয়ে রইল ও। ফোন এখনও ধরে রেখেছে কানে, কিন্তু লাইন কেটে গেছে। ধরাধাম ত্যাগ করেছে অ্যালেক্স লিয়ারি। রানা বুঝতে পারছে, কাছেই কোথাও লুকিয়ে আছে অ্যালি, পাইলট আর কো-পাইলটকে লক করে ক্র্যাশ করিয়েছে হেলিকপ্টার। কিন্তু কোথায়? ভাবনাটা বেশিক্ষণ রইল না মাথায়। ধ্বংসস্তূপের লকলকে শিখা যেন মোহগ্রস্ত করে ফেলেছে ওকে।

পাঁচ সেকেণ্ড পেরুল।

রানা জানে না কী করবে। এমন পরিস্থিতিতে করবার আছেই বা কী? আরও কয়েক সেকেণ্ড কাটার পর একটা সিদ্ধান্তে পৌছুল ও। ফোনটা পকেটে রাখল, হাত থেকে ফেলে দিল গ্যাস মাস্ক। ঘুরে দাঁড়াল। তাকাল মাঠ ছাড়িয়ে সামনে। যেখানে রানা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে গ্যাস নেই বললেই চলে, কিন্তু পঞ্চাশ গজ দূরে ভাসছে ঘন কুয়াশার মত। ওখানে ঢুকলেই ঘুমিয়ে পড়বে ও।

চিন্তাটা কেন এল, জানে না রানা, শুধু মনে হলো ওটাই করা উচিত। ওটাই করতে চায় ও।

হাঁটতে শুরু করল রানা। প্রতি পদক্ষেপ ওকে নিয়ে চলেছে গ্যাসের মেঘের গভীর থেকে গভীরে। শ্বাসের সঙ্গে বুভুক্ষের মত টেনে নিচ্ছে বিষাক্ত, ঘুমপাড়ানি বায়ু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *