দশ
ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটা অল্পবয়েসী। গভীর মনোযোগে নগ্ন নারীদেহের ছবি ভরা একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে সে। ম্যাগাজিনটা কাউন্টারের আড়ালে ঢাকা পড়ায় দেখতে পাচ্ছে না অ্যালি, কিন্তু অনায়াসে পড়তে পারছে তরুণ সেলসম্যানের মন। মাঝে মাঝেই মুখ তুলে স্টোরে ঢোকা তরুণী-যুবতীদের দিকে তাকাচ্ছে সে, ম্যাগাজিনের মডেলদের ছেড়ে কল্পনায় দেখতে চেষ্টা করছে তাদের। শয়তান কোথাকার! ‘প্রাণপণ চেষ্টা করছে অ্যালি, যাতে বদমাশটার চোখে না পড়ে। রানার শরীরের আড়াল নিয়ে শপিং কার্ট ঠেলছে। সুযোগ পেলেই চলে যাচ্ছে কোনও একটা র্যাকের আড়ালে।
বেকারফিল্ডে রয়েছে ওরা। সকাল দশটা বেজেছে খানিক আগে। স্টোরের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বিশাল পার্কিং লট, আর ওপারে পুরো শহরটা দেখতে পাচ্ছে অ্যালি। রোদে পুড়ছে সব। পার্কিং লটের একপ্রান্তে রাখা হয়েছে ওদের নতুন গাড়ি—একটা সেকেণ্ড-হ্যাণ্ড টয়োটা জিপ। বেশ সস্তায় গাড়িটা কিনেছে রানা, কণ্ডিশনও ভাল। আগের জিপটা এয়ারপোর্টের লং টার্ম পার্কিঙে রেখে এসেছে। যেখানে- সেখানে ফেলে এলে পুলিশের চোখে পড়ত, ওটা জব্দ করা হতো। কোনও না কোনোভাবে খবরটা হয়তো চলে যেত লিয়ারির কাছে, দু’য়ে দু’য়ে চার মেলাতে শুরু করত সে। সেটা এড়াবার জন্যেই বৈধ পার্কিং বেছে নেয়া। গাড়ির সূত্র ধরে ওদেরকে ট্র্যাক করতে পারবে না কেউ।
টাকার অভাব মিটে গেছে ওদের। বেকারফিল্ডে ঢুকেই ব্যাঙ্কে চলে গিয়েছিল রানা। সেখানকার একটা সেফ ডিপোজিট বক্স খুলেছে। ক্যানভাসের একটা ব্যাগ রাখা ছিল বক্সে। ওটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে আবার। অ্যালিকে ব্যাঙ্কে নেয়নি রানা, ব্যাগও খুলে দেখায়নি; তাই বলে ওতে কী রয়েছে, জানতে অসুবিধে হয়নি ওর। ব্যাগে আছে খামে ভরা দশ হাজার ডলার, একটা সিগ-সাওয়ার পিস্তল, বাড়তি ম্যাগাজিন, আর তিন সেট ভুয়া পরিচয়পত্র। বেশ অবাক হয়েছিল অ্যালি, জানতে চেয়েছিল, ওগুলো ব্যাঙ্কে এল কী করে। জবাবে রানা শুধু সংক্ষেপে জানিয়েছে, ইমার্জেন্সি সামাল দেবার জন্যে এ-রকম বেশ কিছু ব্যাগ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লুকানো আছে ওর। এসব নাকি ওর পেশার অংশ।
রানার পেশাটা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি অ্যালি। তবে এটুকু বুঝেছে, অত্যন্ত যোগ্য একজন সাহায্যকারী পেয়ে গেছে ও। এমন একজন, যে ওর পেছনে লাগা মানুষগুলোর সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে পাল্লা দিতে পারে। বিস্মিতও হচ্ছে, দুনিয়ায় এত লোক থাকতে ও কিনা ঠিক এই মানুষটার কাছেই এসে পড়ল! ব্যাপারটা নিছক কাকতালীয়, নাকি অন্য কিছু? আর কোনোভাবে কি ব্যাখ্যা করা যায় ঘটনাটা? জানে না অ্যালি, ভাবলেই মাথা কেমন যেন করে।
এ-মুহূর্তে ফ্রিজ ড্রায়েড মিলের একটা শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। তাকগুলোয় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন আকারের ফয়েল প্যাকেট—ওপরে হাইকারদের ছবি, সেই সঙ্গে নানা ধরনের নাম: লাসানিয়া উইথ মিট সস, চিকেন টেরিয়াকি উইথ রাইস, ইত্যাদি।
রানা বলল, ‘খেতে ভাল না, তবে প্যাকেটগুলো বেশ হালকা। আমাদের লাগেজ বাড়বে না। কয়েকটা নিয়ে নিই, কী বলো?’
শপিং কার্টে অনেকগুলো প্যাকেট নিল ও। কার্টের বাকি অংশে আছে দু’জনের জন্যে বিভিন্ন ধরনের পোশাক, প্রোপেন স্টোভ, ওয়াটার পিউরিফায়ার, দুটো ব্যাকপ্যাক, দুটো স্লিপিং ব্যাগ আর দু’জোড়া হাইকিং বুট। সোজা কথায়, মোটামুটি এক সপ্তাহ পাহাড়ি অরণ্যে কাটাবার উপযোগী সব সরঞ্জাম। যতদিন অ্যালির স্মৃতি না ফিরছে, গা-ঢাকা দেবে বলে ঠিক করেছে রানা।
পাশ দিয়ে এক মাঝবয়েসী মহিলা হেঁটে গেল। তার চিন্তা পড়তে পারছে অ্যালি—ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করবে, সেজন্যে মশলা খুঁজছে। খানিক দূরে কার্ট ঠেলছে এক যুবক, মনে মনে একটা গানের সুর গুনগুন করছে; মনে ভারি আনন্দ, নতুন চাকরি পেয়েছে সে। কাউন্টারে দাঁড়ানো সেলসম্যানের দিকে তাকাল অ্যালি, এখনও সে তার ম্যাগাজিন নিয়ে ব্যস্ত, মাথায় নোংরা দৃশ্য ঠাসা।
বড় করে শ্বাস ফেলে রানার দিকে ফিরল ও। এই মানুষটা সবার থেকে আলাদা। মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু সবকিছুর মূলে রয়েছে অ্যালি। এক মুহূর্তের জন্যে অন্য কিছু ভাবছে না। ব্যাপারটা অদ্ভুত এক স্বস্তি জাগিয়ে তুলছে অ্যালির মাঝে। মনে হচ্ছে, এই মানুষটার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়…. একে বিশ্বাস করলে ঠকতে হবে না। সারাক্ষণই যেন অদৃশ্য দু’হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে লোকটা, কোনও আঘাত লাগতে দেবে না।
দশ মিনিট পর বিল মিটিয়ে স্টোর থেকে বেরিয়ে এল দু’জনে। জিপের পেছনে সদ্য কেনা সব জিনিস তুলে পথে নামল। শহর পেরিয়ে উত্তরের পাহাড়ি এলাকার দিকে চলেছে। পথে দু’জায়গায় থামবে বলে ঠিক করেছে রানা। প্রথমটা বেকারফিল্ডেই—একটা ইলেকট্রনিকস্ স্টোর থেকে অডিয়ো রেকর্ডার কিনবে। দ্বিতীয় স্টপেজটা ভিসালিয়া শহরের একটা স্পেশালিটি শপ। ওখান থেকে বিশেষ দুটো আইটেম সংগ্রহ করবে ও। ইতিমধ্যে পে-ফোন থেকে কয়েক জায়গায় ফোন করেছে আইটেমদুটোর ব্যাপারে; সেগুলো জরুরি পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হবে ওদের। মনে মনে প্রার্থনা করছে অ্যালি, তেমন পরিস্থিতি যেন দেখা না দেয়।
একটা চৌরাস্তায় পৌঁছে বাঁয়ে মোড় নিল রানা। আধমাইল দূরে বেস্ট বাই-এর বিশাল সুপারস্টোর। ‘ আর তখুনি ঘটল ব্যাপারটা। দম আটকে এল অ্যালির, যেন কেউ কনুই দিয়ে আঘাত হেনেছে ওর বুকে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল গোঙানির আওয়াজ।
ঝট্ করে ওর দিকে তাকাল রানা। চোখে উদ্বেগ। জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, অ্যালি?’
শব্দ করে শ্বাস ছাড়ল আর নিল অ্যালি। বলল, ‘কিছু না। আমি ঠিক আছি।’
আসলে ঠিক নেই ও। বুকের ওপর ভারী কী যেন চেপে বসেছে… সীমাহীন আতঙ্ক যেন ঘিরে ধরেছে ওকে! কিন্তু কেন? আশপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। দৃষ্টি আটকে গেল একটা সেলফোনের টাওয়ারের ওপর। সুপারস্টোরের ওপারে, ব্যস্ত শহরের ইমারতগুলোর মাঝ থেকে উঠে এসেছে ওটা, সগর্বে মাথা তুলে রেখেছে আকাশের বুকে। নিরীহদর্শন একটা কাঠামো, অথচ ওদিকে তাকালেই হিম হয়ে আসছে বুকের ভেতরটা।
রানা বুঝতে পারছে ওর অবস্থা। আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
‘জানি না,’ মাথা নাড়ল অ্যালি। কিছু বলতে চাইছে না, রানা ওকে পাগল ভাবতে পারে। একটা টাওয়ার দেখে কেউ ভয় পায়?
ইণ্ডিকেটর জ্বেলে জিপকে রাস্তার পাশে নিয়ে গেল রানা, থেমে দাঁড়াল। তারপর ঘুরল মেয়েটার দিকে
‘আমার দিকে তাকাও,’ নরম গলায় বলল ও। অ্যালির মনে হলো, অদৃশ্য হাতদুটোর বন্ধন যেন আরও দৃঢ় হয়েছে। জোর করে টাওয়ার থেকে নজর ফেরাল, তাকাল রানার দিকে।
‘ব্যাপারটা যা-ই হোক না কেন,’ রানা বলল, ‘তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় খুলে বলতে পারো।’
আস্তে মাথা ঝাঁকাল অ্যালি। বলল, ‘ওই টাওয়ারটা… ওটার দিকে তাকালেই ভীষণ ভয় করছে। দম আটকে আসছে আমার।
ভ্রূকুটি করে ওদিকে তাকাল রানা। বোঝার চেষ্টা করছে, ওতে সত্যিই কোনও ভীতিকর ব্যাপার আছে কি না।
‘সম্ভবত ড্রাগের কারণে এমনটা হচ্ছে,’ অ্যালি বলল। ‘একটা টাওয়ার দেখে তো ভয়ের কিছু নেই।’
‘আমার তা মনে হয় না,’ রানা বলল। ‘তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এটা একটা কণ্ডিশনাল রেসপন্স।
‘সেটা আবার কী?’
‘মানে হচ্ছে, স্মৃতি হারানোর আগে একটা কিছুকে ভীষণ ভয় পেতে তুমি, এখন সেটারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অবচেতন মনে এখনও রয়ে গেছে সেই আতঙ্ক, শরীর সে অনুসারে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।’
‘কিন্তু সেলফোন টাওয়ার দেখে কেন ভয় পাব আমি?’
‘খুব শীঘ্রি সেটা জানা যাবে,’ গম্ভীর গলায় বলল রানা।