অন্তর্যামী – ২৯

উনত্রিশ

কানের পাশে শোঁ-শোঁ বইছে বাতাস। ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথিবী। ওপরে শোনা যাচ্ছে হেলিকপ্টারের রোটরের গুরুগম্ভীর আওয়াজ। হ্যানকক সেন্টারের গা ঘেঁষে তীরবেগে নিচে পড়ছে দুটো দেহ।

প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গেলে সচেতন হয়ে উঠল রানা। মাথা ঘুরিয়ে টাওয়ারের চূড়ার দিকে তাকাল, বুঝে নিতে চাইল পরিস্থিতি। মোটামুটি দশ তলা নেমে এসেছে ও আর অ্যালি, নিচে রয়েছে আরও অন্তত সত্তর তলা। অ্যালির গা থেকে একটা হাত সরিয়ে প্যারাশুটের রিলিজ টানল, তারপর আবার জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে।

প্যাক থেকে সাঁৎ করে বেরুল পাইলট শুট, ওটার টানে পরক্ষণে বেরিয়ে এল মেইন শুট। একটা ঝাঁকুনি খেল রানা, হারনেস টান খেয়েছে। পতনের গতি কমে গেল নাটকীয়ভাবে, কান থেকে দূর হলো বাতাসের গর্জন। মাথা তুলে ওপরে তাকাল ও। বিশাল এক ব্যাঙের ছাতার মত ফুলে উঠেছে ক্যানোপি, মৃদুমন্দ বেগে ধীরে ধীরে নিচে নামছে ওরা।

তবে স্বস্তিতে থাকা গেল না। বাতাসের প্রবাহে ধীরে ধীরে বিল্ডিঙের দিকে সরছে ওরা, বাড়ি খেতে চলেছে।

ছেড়ে দিলে আমাকে ধরে থাকতে পারবে?’ অ্যালিকে জিজ্ঞেস করল ও।

মৃদু মাথা ঝাঁকাল অ্যালি। রানার কাঁধে মাথা গুঁজে রেখেছে ও, দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আছে ওর গলা।

ওকে ছেড়ে দিল রানা, প্যারাশুটের স্টিয়ারিং লাইনদুটো দু’হাতে ধরল। বামের লাইনটা আস্তে করে টানল ও, সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল ক্যানোপি। ভেসে ভেসে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করল রানা আর অ্যালি, বায়ুপ্রবাহকে ফাঁকি দিয়ে বিল্ডিঙের পাশ থেকে সরে আসছে।

মনে মনে হিসেব কষল রানা। নব্বুই সেকেণ্ড লাগবে নিচে পৌঁছুতে। ততক্ষণে প্যারাশুটটা দেখতে পাবে হেলিকপ্টারের আরোহীরা, গ্রাউণ্ড টিমকে সতর্ক করে দেবে। কয়েক সেকেণ্ড পরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। দক্ষিণে উদয় হলো তিনটে কালো রঙের গাড়ি, মিশিগান অ্যাভিনিউ ধরে ঝড়ের বেগে হ্যানকক সেন্টারের দিকে ছুটে আসছে। এবার আর হিসেব করার প্রয়োজন হলো না, এক নজরেই রানা বুঝল, ওরা মাটিতে পা ঠেকাবার আগেই গাড়িগুলো পৌঁছে যাবে বিল্ডিঙের তলায়।

বিকল্প খুঁজতে শুরু করল রানা। রাস্তার ওপারে সাদা মার্বেলের একটা টাওয়ার দেখা যাচ্ছে—উঠে এসেছে দশ তলা উঁচু, এবং প্রায় এক ব্লক জুড়ে বিস্তৃত একটা বেইস স্ট্রাকচার থেকে। ছাতটা বেশ চওড়া, ল্যাণ্ডিঙের উপযোগী। সবচেয়ে বড় কথা, বিল্ডিংটাই একটা বড় ধরনের কৌশলগত সুবিধে দেবে ওদেরকে। বিশাল ওই বিল্ডিঙে ঢুকতে পারলে সহজে ওদেরকে খুঁজে পাবে না শত্রুরা। চেষ্টাচরিত্র করে যদি বেজমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছুনো যায়, সেখান থেকে ঢুকে পড়া যাবে ভূগর্ভস্থ সার্ভিস টানেলে—স্যাটেলাইটের নজরের বাইরে।

প্যারাশুটের গ্লাইড অ্যাঙ্গেল ইতিমধ্যে ওদেরকে নিয়ে চলেছে ছাতটার দিকে। বড়জোর এক মিনিট লাগবে। গ্রাউণ্ড টিম পৌঁছুবার আগেই ওখানে নেমে যেতে পারবে ওরা। আশাবাদী হয়ে উঠল রানা।

ঠিক তখুনি আলোকিত হয়ে উঠল প্যারাশুটের ক্যানোপি, সেটার ছায়া গিয়ে পড়ল নিচের রাস্তায়। আলোর উৎসের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল রানা। স্পটলাইট! ওদেরকে খুঁজে নিয়েছে একটা হেলিকপ্টার! প্রমাদ গুনল ও। ষাট সেকেণ্ড প্রয়োজন ল্যাণ্ড করার জন্যে, সেটা পাচ্ছে না ওরা। শুধু স্পটলাইট ফেলে ক্ষান্ত হবে না হেলিকপ্টার, ওদেরকে পাশের বিল্ডিঙের ছাতে নামতে দেখলে হামলা চালাবে।

কপ্টারের টারবাইনের আওয়াজ বদলাতে শুরু করেছে, স্পটলাইটও নড়ছে ঘন ঘন। যান্ত্রিক ফড়িংটাকে উচ্চতা কমাতে দেখল রানা, ওদের কাছাকাছি পৌছুবার চেষ্টা করছে। নাগালের ভেতরে পেলে নিশ্চয়ই গুলি করবে।

স্বাভাবিকভাবে আর নামার চেষ্টা করে লাভ নেই, বেইস স্ট্রাকচারের ছাতে আরও দ্রুত পৌঁছুতে হবে ওদেরকে। একটা স্টিয়ারিং লাইন ছেড়ে দিল রানা, মুক্ত হাতটা ওপরে তুলল, মুঠো করে ধরল প্যারাশুটের তিনটে লাইন, নিচের দিকে টান দিল একটা। চোখের পলকে বাতাস হারাল ক্যানোপির একটা অংশ। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল পতনের গতি। স্বাভাবিক ডিসেন্ট রেটের দ্বিগুণ বেগে এখন নিচে পড়ছে ওরা—ঘুরপাক খেতে খেতে।

বিপজ্জনক একটা অবস্থা। এখন আর ভাসছে না রানা আর অ্যালি, গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মত পড়ে যাচ্ছে নিচে দক্ষিণের বদলে বাতাস ওদেরকে ঠেলে নিয়ে চলেছে উত্তর দিকে… আবারও হ্যানকক সেন্টারের গায়ে। চুলচেরা হিসেব করতে হচ্ছে রানাকে—এভাবে কতদূর নামবে, ঠিক কখন আবার বাতাস ভরবে ক্যানোপিতে। কিন্তু হিসেবটা শেষ করার আগেই আচমকা দমকা হাওয়ার একটা ঝাপটা বয়ে গেল। বেসামাল হয়ে গেল রানা। আতঙ্কিত চোখে দেখল, দৃষ্টিসীমায় বড় হয়ে চলেছে হ্যানককের কাঁচের দেয়াল… ওটার গায়ে আছড়ে পড়তে চলেছে ওরা!

মুঠোয় ধরা লাইনগুলো ছেড়ে দিল রানা, অ্যালিকে আঁকড়ে ধরল যত জোরে পারে। ক্যানোপি আবার ফুলে উঠল বাতাসে, বিল্ডিঙের কয়েক গজ দূরে থাকতে থেমে গেল … গোঁত্তা খাওয়া। তারপরেও দেয়ালের দিকে উড়ে চলল ওরা—ঘণ্টায় বিশ মাইল বেগে। সর্বশক্তিতে দৌড়াতে থাকা অবস্থায় দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়লে যা হয়, তেমন কিছুই একটা ঘটতে চলেছে। পাক খেল রানা, পিঠ নিয়ে গেল বিল্ডিঙের দিকে, যাতে অ্যালির গায়ে কোনও আঘাত না লাগে।

এরপরেই বিল্ডিঙের গায়ে আছড়ে পড়ল দু’জনে। পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল প্রচণ্ড ব্যথা, রানার মনে হলো, একটা চলন্ত বাস ধাক্কা দিয়েছে ওকে। ককিয়ে উঠল শরীরের সবগুলো অস্থিসন্ধি। নিজের অজান্তেই অ্যালিকে ছেড়ে দিল ও। ঝাঁকুনিতে অ্যালির হাত-পায়ের বাঁধনও ছুটে গেছে, পড়ে গেল সে। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে সচল হলো রানা, পাগলের মত হাত ছুঁড়ল, নাগালে পেল অ্যালির একটা হাতের কবজি, খপ করে ধরে ফেলল সেটা।

বাড়ি খেয়ে এক সেকেণ্ডের জন্যে স্থির হয়েছিল ওরা, এবার বিল্ডিঙের দেয়াল ঘষটে নিচে নামতে শুরু করল। প্যারাশুট ঠিকমত ওদের ওজন নিতে পারছে না, ঘষা খাচ্ছে দেয়ালে। নিচে তাকাল রানা, আরেক দফা আঁতকে উঠল। মাটি থেকে প্রায় চারশো ফুট ওপরে রয়েছে ওরা, পড়ছে দ্রুত… কিন্তু তারচেয়েও বড় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ত্রিশ ফুট নিচে একটা কার্নিশ দেখা যাচ্ছে। ঠিক কার্নিশ নয়, ওটা আসলে স্টিলের তৈরি

তৈরি মোটা একটা পাত—বিল্ডিঙের এক্সটেরিয়র ডিজাইনের অংশ। মাটির সঙ্গে সমান্তরাল এরকম অনেকগুলো বিম রয়েছে হ্যানকক সেন্টারের গায়ে। প্রায় দেড় ফুট পুরু সেই বিমটাই কার্নিশের মত বেরিয়ে আছে বাইরে, আর সেটার দিকে তুমুল বেগে ছুটে যাচ্ছে ওরা!

দ্রুত কমছে বিম আর ওদের মাঝে দূরত্ব। বিশ ফুট। দশ ফুট। টেনে অ্যালিকে ওপরদিকে তুলল রানা, হাতটা নিয়ে গেল ঘাড়ের কাছে, আগের মত ওর গলা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল অ্যালি। ঠিকমত ধরার আগেই বিম স্পর্শ করল রানার পা-দুটো।

আবারও তীব্র ব্যথা অনুভব করল রানা, মনে হলো কংক্রিটের ওপর লাফ দিয়ে নেমেছে। ঢেউয়ের মত ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ল পা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত। ঝাঁকি খেয়ে আবারও পড়ে যাচ্ছিল অ্যালি, কোনোমতে সেটা ঠেকাল রানা, জাপটে ধরল ওকে। মাথার ওপর পত পত আওয়াজ হলো—প্যারাশুটটা নেতিয়ে গেছে পুরোপুরি, এখন ওটা দলা পাকানো বিশাল এক চাদর, নেমে আসছে নিচে, বিমের ওপর দাঁড়ানো রানা আর অ্যালিকে পেরিয়ে গেল নিমেষে। তাড়াতাড়ি লাইনগুলো ডিটাচ করে দিল রানা, নইলে প্যারাশুটের টানে ওরা ছিটকে পড়বে বিম থেকে। বন্ধনহীন প্যারাশুট এবার খানিকটা বাতাস ধরে ফুলে উঠল, নামতে থাকল ভেসে ভেসে।

রোটরের আওয়াজ বাড়তে শুরু করেছে। ঘাড় ফেরাতেই একটা হেলিকপ্টারটাকে এগোতে দেখল, স্পটলাইট তাক করে রেখেছে ওদের দিকে। ধীরে ধীরে ওদের সামনে এসে স্থির হলো, ঘুরে গেল একপাশে। খোলা দরজায় অস্ত্রধারী দু’জন স্নাইপারকে দেখা গেল এবার, হাতের রাইফেল তাক করে রেখেছে বিমের ওপর আটকা পড়া দুই শিকারের দিকে।

হতাশায় ছেয়ে গেল রানার হৃদয়। সব শেষ। বাঁচার কোনও উপায় নেই। সত্যি বলতে কী, নিচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই ওদের। এখুনি স্নাইপারের গুলিতে সাঙ্গ হবে ওদের জীবন। সাবধানে অ্যালিকে কোল থেকে নামাল ও। পাশ ফিরে হাত রাখল ওর কাঁধে।

‘সরি,’ বলল ও। ‘তোমার জন্যে কিছু করতে পারলাম না।’

ঠোঁট কেঁপে উঠল অ্যালির। রানাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল সে। আর তখুনি প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল চতুর্দিক।

চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকাল রানা। বিশাল এক আগুনের গোলায় পরিণত হয়েছে অ্যাটাক হেলিকপ্টার, খণ্ড- বিখণ্ড হয়ে গেছে। জ্বলন্ত এক উল্কার মত ধ্বংসাবশেষটা খসে পড়ল নিচে।

.

‘হচ্ছেটা কী ওখানে?’ মাইক্রোফোনে চেঁচিয়ে উঠল লিয়ারি।

রেডিয়োতে ভেসে এল স্প্যারো ফোর-টুর পাইলটের আতঙ্কিত কণ্ঠ। কী এক মিসাইল অ্যাটাকের কথা বলছে। মিরাণ্ডা ইমেজে তার হেলিকপ্টারকে ঘুরে যেতে দেখল লিয়ারি-লেজ তুলে পশ্চিমদিকে পালাচ্ছে।

স্প্যারো ফোর-ওয়ান থেকে কোনও রেসপন্স পাওয়া গেল না। পাবার কথাও নয়। বিশাল একটা হিট সিগনেচার দেখা যাচ্ছে ওটার জায়গায়… আগুনের একটা গোলা। লিয়ারির চোখের সামনে মিশিগান অ্যাভিনিউতে আছড়ে পড়ল ওটা।

ভাঙা জানালার পাশে উপুড় হয়ে আছে ভেরোনিকা, শরীরের খানিকটা বের করে রেখেছে বাইরে, কাঁধে ঠেকিয়ে রেখেছে একটা এফ.জি.এম.-১৪৮ লঞ্চার। এটা দ্বিতীয় লঞ্চার, প্রথমটা খালি করা হয়েছে আগেই—ওটা দিয়েই প্রথম হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুঁড়েছিল সে; খালি লঞ্চারটা পড়ে আছে তার পাশে। এখন দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটাকে ভূপাতিত করার চেষ্টা করছে।

লাভ হলো না। দ্বিতীয় কপ্টারের পাইলট যথেষ্ট চালু, প্রথমটাকে বিধ্বস্ত হতে দেখেই পিঠটান দিয়েছে, চোখের পলকে চলে গেছে রেঞ্জের বাইরে। সহজে ফিরবে বলে মনে হয় না। নিচে তাকাল ভেরোনিকা। রানা আর অ্যালিকে বিন্দুর মত দেখাচ্ছে ওপর থেকে।

উঠে দাঁড়াল ভেরোনিকা। পিছিয়ে গেল কয়েক গজ। প্যারাশুটের হারনেস ভাল করে এঁটে নিল গায়ে। তারপর ছুট লাগাল। ভাঙা জানালার সীমানায় পৌছুতেই দক্ষ অ্যাথলিটের মত লং জাম্প দিল—বেরিয়ে গেল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।

.

হেলিকপ্টারের ধ্বংসস্তূপ থেকে চোখ সরাল রানা। মনোযোগ দিল নিজেদের সমস্যার দিকে, এখন সেটাই জরুরি। বিমের ওপর আটকা পড়েছে ওরা, নিচে নামার উপায় নেই। এর বিকল্প হচ্ছে, বিল্ডিঙের ভেতরে ঢোকা। উল্টো ঘুরে কাঁচের ওপর নাক-মুখ ঠেকাল। ওপাশটায় একটা অন্ধকার অফিস, কেউ নেই।

ঠোঁট কামড়াল রানা। বন্দুক-পিস্তল কিছু নেই যে, গুলি করে কাঁচ ভাঙবে। লাথি-ঘুসি মেরেও এই পুরু কাঁচের দেয়াল ভাঙা সম্ভব নয়। সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, এমন সময় ওপর থেকে শোনা গেল কাপড়ের খসখস আর প্যারাশুটের লাইন টানটান হয়ে যাবার টঙ্কার। ঝট্ করে ওদিকে তাকাল ও। ছিপছিপে গড়নের একজন মানুষ … নিঃসন্দেহে ভেরোনিকা… নেমে আসছে দ্বিতীয় একটা প্যারাশুটে ভর করে। টাওয়ার থেকে ষাট ফুট দূরে, এবং রানা-অ্যালির একশো ফুট ওপরে পৌঁছে প্যারাশুট খুলেছে সে। বাতাসের প্রতিকূলে লড়ছে না, বরং বায়ুপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে মোড় নিচ্ছে, দ্রুত এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

কয়েক সেকেণ্ডের ভেতরেই পরিষ্কার হয়ে গেল, প্যারাট্রুপার হিসেবে ভেরোনিকার দক্ষতা তুলনাহীন। রানা নিজেও মন্দ নয়, প্রায় দু’শো প্যারাজাম্প করার অভিজ্ঞতা আছে ওর, কিন্তু তারপরেও ভেরোনিকার তুলনায় তা কিছুই না। মেয়েটার অ্যাক্রোব্যাটসুলভ মুভমেন্টই বলে দিচ্ছে, সে একজন স্পেশালিস্ট—দীর্ঘদিন থেকে একটা নির্দিষ্ট ধরনের প্যারাজাম্পিঙের ওপর ট্রেইনিং নিয়েছে, দক্ষতার চরম সীমায় পৌঁছেছে।

আরেকটা কারণ আছে এখানে বাস করার। প্রার্থনা করো, সেটা জানার মত পরিস্থিতি যেন দেখা না দেয়।

কথাটা ভেরোনিকার। আর এখন সেটার অর্থ অনুধাবন করতে পারছে রানা। প্যারাজাম্পিঙের কথা বলছিল মেয়েটা। বিরূপ পরিস্থিতিতে পালাবার জন্যে সবচেয়ে অভিনব এবং অপ্রত্যাশিত কৌশল। এজন্যেই তিরাশি তলার অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছিল ওরা। বছরের পর বছর ধরে ট্রেইনিং নিয়েছে উঁচু বিল্ডিং থেকে প্যারাজাম্প করার। তার ফলাফল চাক্ষুষ করছে রানা। বাতাসের প্রবাহ বা মাধ্যাকর্ষণকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে ভেরোনিকা। প্যারাশুট তো নয়, যেন নিজের দেহের একটা অঙ্গ পরিচালনা করছে, পাখির মত অনায়াসে ভাসছে বাতাসে। নেমে আসছে রানা আর অ্যালিকে লক্ষ্য করে।

বাজে একটা কিছু ঘটতে চলেছে, বুঝতে পারল রানা। অ্যালির সঙ্গে চোখাচোখি হলো, রানার মনের ভেতর বাজতে থাকা বিপদঘণ্টা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে।

‘আমাকে ছেড়ে দাও,’ অ্যালি বলল। ‘ওকে ঠেকাবার চেষ্টা কোরো না।’

‘অসম্ভব,’ দাঁতে দাঁত পিষল রানা। দ্রুত হাতে পিঠে বাঁধা প্যারাশুটের প্যাকটা খুলল। একটা হারনেসের ক্লিপ আটকাল পেছনের জানালার ফ্রেমে। অন্য হারনেসে ঢোকাল বাম হাত, স্ট্র্যাপটা রইল কনুইয়ের ভাঁজে। ব্যস, এবার আর বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়বে না বিম থেকে।

দশ সেকেণ্ড পর এল আক্রমণ। ওদের খানিক ওপরে পৌছে আচমকা ক্যানোপির বাতাস ছেড়ে দিল ভেরোনিকা ডাইভ দিল বিম লক্ষ্য করে। এক হাতে তাকে ঠেকাতে পারল না রানা, সরাসরি ওর বুকের ওপর গাছের গুঁড়ির মত ধাক্কা দিল মেয়েটার জোড়া-পা। পেছনের কাঁচের ওপর আছড়ে পড়ল ও, বুক থেকে বেরিয়ে গেল সব বাতাস। বিম থেকে পড়ে যাচ্ছিল, বেঁচে গেল স্ট্র্যাপটার কারণে। ওটার টান খেয়ে স্থির হলো দেহ।

মাথা ঝাঁকি দিয়ে সোজা হলো রানা। তাকাল পাশে। বিমের ওপর নেমে এসেছে ভেরোনিকা, অ্যালিকে জাপটে ধরেছে এক হাতে। চোখের কোণে রানাকে সোজা হতে দেখে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল, সঙ্গে সঙ্গে মনের সুখে ওর নাকের ওপর একটা ঘুসি মারল রানা। টের পেল, নাকটা বসে গেল মুঠোর ওপারে, রক্ত বেরিয়ে এল। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ভেরোনিকা, পাগলের মত লাথি মারল একটা। কোনোকিছু দেখে মারেনি, স্রেফ কপালজোরে রানার ঊরুসন্ধিতে তার জুতোর ডগা। জান্তব এক গোঙানি ছেড়ে বসে পড়ল রানা; আবারও প্যারাশুটের স্ট্র্যাপটা ওকে বাঁচিয়ে দিল নিচে পড়ে যাওয়া থেকে।

অ্যালি ধস্তাধস্তি করতে চাইছে, কিন্তু সুবিধে করতে পারল না। ওকে শক্ত করে জাপটে ধরল ভেরোনিকা, তারপর লাফ দিল বিম থেকে। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল অ্যালি। ঝুলন্ত অবস্থায় হাত ছুঁড়ল রানা, ওদেরকে খামচে ধরতে চাইল, কিন্তু নাগালে পেল না। ভেরোনিকার ক্যানোপি আবার ফুলে উঠতে দেখল ও, অ্যালিকে নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে সে।

লিয়ারির টিমের গ্রাউণ্ড ভেহিকেলগুলো মিশিগান অ্যাভিনিউর শেষ ব্লকটা অতিক্রম করছে। হ্যানকক সেন্টারের পাশ ঘুরে দক্ষিণ পাশে পৌঁছুনোর চেষ্টা করল, কিন্তু থমকে গেল রাস্তা জুড়ে পড়ে থাকা হেলিকপ্টারের জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষের কারণে। গাড়ি থেকে নামল না কেউ, ধ্বংসস্তূপে কেউ বেঁচে আছে কি না দেখার চেষ্টা করল না, তার বদলে ওটাকে পাশ কাটিয়ে এগোবার প্রয়াস নিল। তবে আক্ষরিক অর্থেই একটা আগুনের ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে রাস্তায়, সেটা পেরুতে পারল না গাড়িগুলো।

বিশ সেকেণ্ডের মাথায় ভূমি স্পর্শ করল ভেরোনিকা। রাস্তায় পা ঠেকিয়েই বিদ্যুৎবেগে খুলে ফেলল হারনেস, বাতাসের টানে মুক্ত প্যারাশুটটা উড়ে চলে গেল পেছনে—ভূতের মত ভেসে ভেসে। অ্যালিকে সাবধানে মাটিতে নামাল সে, কোমরে গোঁজা একটা ক্রো-বার বের করে হাঁটু গেড়ে বসল। বিস্মিত চোখে ওকে একটা ম্যানহোলের ঢাকনা খুলতে দেখল রানা। অ্যালিকে নামাল ওখান দিয়ে, নিজেও নামল। শেষে টেনে দিল ম্যানহোলের ঢাকনা।

তিক্ততায় ছেয়ে গেল রানার অন্তর। আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল, ওদের এস্কেপ প্ল্যান শুধু প্যারাজাম্পিঙে সীমাবদ্ধ থাকার কথা নয়। সন্দেহ নেই, ম্যানহোলের তলার টানেল নেটওঅর্ক হাতের তালুর মত চেনে ভেরোনিকা… কোথা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে বেরুবে, সব ঠিক করা আছে। একটা গাড়িও নিশ্চয়ই রেখেছে ওখানে।

বিল্ডিঙের উল্টোপাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ম্যানহোলের কাছে পৌছুতে গ্রাউণ্ড ভেহিকেলগুলোর লাগল পুরো দু’মিনিট। ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে অ্যালি আর ভেরোনিকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *