অধ্যায় সাত – প্রথম লিখিত নথিসমূহ
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮০০ ও ২৪০০ সালের মাঝে সুমেরীয় ও মিশরীয়গণ সিলমোহর ও নির্দেশক চিহ্ন ব্যবহার করা শুরু করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে লিখিত ইতিহাস শুরু হয়। সেই সহস্রাব্দের শুরুতে লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি বস্তুই ছিল-বড়ো বড়ো মানুষের কীর্তিকলাপ এবং তাদের মালিকানাধীন গরু, শস্য ও ভেড়ার পরিমাণের হিসাব। সুমেরের শহরগুলোতে মহাকাব্য রচনা শুরু হয়, কেননা সেখানে আমলাতন্ত্র শস্যের হিসাবরক্ষণের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
মানুষের জীবন এখন যেমন, সেই যুগেও অনেকটা সেরকমই ছিল। আমলাতন্ত্র সাহিত্য রচনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। লেখালেখির ইতিহাসে শুরুতে মানবাত্মার উদযাপন নয় বরং ‘এটা আমার, ওটা তোমার’ ইত্যাদির হিসাবনিকাশের পেছনেই বেশি সময় ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু হিসাবরক্ষকদের উদ্ভাবিত কৃত্রিম চিহ্নগুলো গল্পকথকদের জন্য উপহারস্বরূপ ছিল। তারা তাদের বীরদের অমর করে রাখার নতুন একটি পন্থা খুঁজে পেলেন। তাই শুরুর দিকে সাহিত্যের সাথে বাণিজ্যের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।
আদিম মানুষদের গুহার দেওয়ালে ছবি আঁকার সময় থেকে মানুষ বিভিন্ন ধরনের চিহ্নের মাধ্যমে জিনিসপত্র গণনা ও হিসাব রাখার কাজ করে আসছে। এই চিহ্নগুলোই লেখালেখির বীজ বপন করেছিল আদিম যুগে। তবে চিহ্নের একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে–তারা কালের বিবর্তনে মানে হারিয়ে ফেলে। সেসব চিহ্নের কোনো নিজস্ব কণ্ঠ নেই, যদি না তাদের উদ্ভাবক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে যে ‘এই লাইনটি হচ্ছে একটি গরু, এটা একটি হরিণ আর এগুলো আমার সন্তান’।
সুমের চিহ্নের ব্যবহার বেশ অগ্রসর হয়েছিল। একজন সুমেরীয় ব্যক্তি তার কাছে থাকা মূল্যবান দ্রব্যসমূহকে (খাদ্যশস্য, দুধ অথবা তৈল) একটি শস্যের ব্যাগে ভরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত আর বাঁধুনির উপর কাদামাটির গোল্লা লেপে দিত এবং সেটাকে চেপে চেপে একটি সিলগালার মতো তৈরি করত। এই সিলটি দেখতে চারকোনা কিংবা সিলিন্ডারের মতো হতো এবং এর উপর একটি বিশেষ নকশায় খোদাই করে দেওয়া হতো। কাদামাটির গোল্লা শুকিয়ে গেলে সেখানে সে চিহ্নটি ফুটে উঠত যা দেখে এর মালিকের নাম জানা যেত। এই চিহ্ন দ্রব্যসামগ্রীর উপর তাদের মালিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করত। তার অবর্তমানে এই চিহ্ন প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো।
গুহার দেওয়ালে অঙ্কিত চিহ্নগুলোর মতো এই সিলগুলোও বিভাজিত জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল ছিল। যারা এই সিলগুলো দেখত তাদেরকে জানতে হতো প্রতিটি চিহ্ন কোন ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে। সেটা জানলেই কেবল তারা বলতে পারত ‘এটার মালিক ইশু’, কেননা গুহাচিত্রের তুলনায় এই চিহ্নগুলো অনেক বেশি স্বতন্ত্র ছিল।
একটি চিহ্নের মাধ্যমে মহিলা কিংবা ভেড়া, মানুষ কিংবা গরু বোঝানো যেত। কিন্তু একটি সিল শুধু একজন সুমেরীয় মানুষের প্রতিনিধিত্ব করত, যেমন ইণ্ড। ইশুকে নিজে এসে ব্যাপারটা বোঝানো লাগত না।
এভাবেই ‘কাল’-কে জয় করার ক্ষেত্রে একটি বড়ো ধাপ নেওয়া হয়েছিল।
সম্ভবত একই সময়ে আরেক ধরনের চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়। গুহাচিত্রকরদের মতো সুমেরীয়গণ বিভিন্ন চিহ্ন ও টালির মাধ্যমে তাদের মালিকানাধীন গরু কিংবা শস্যের বস্তার সংখ্যা গণনা করতেন। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের আগে দিয়ে, সর্বাধিক ধনবান সুমেরীয়রা (যাদের অনেক বেশি সম্পদ ছিল যা এভাবে গণনা করা দুষ্কর ছিল) তাদের গণনার চিহ্নগুলোকে একটি পাতলা কাদামাটির তৈরি পাতের উপর এঁকে দিয়ে সেই পাতকে ভাঁজ করে সেটার উপর এক ধরনের সিল মেরে দিতেন। যখন কাদামাটি শুকিয়ে যেত তখন তা এক ধরনের খামের মতো বস্তুতে রূপান্তরিত হতো।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই খামটিকে খোলার একমাত্র উপায় ছিল কাদামাটির আস্তরটি ভেঙে ফেলা, যার কারণে তা আর ব্যবহারের উপযোগী থাকত না। সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা ছিল কয়টি গণকচিহ্ন খামের ভেতরে আছে তা বোঝানোর জন্য বাইরে দিয়ে নতুন একটি টালি বানিয়ে রাখা।
খামের বাইরের চিহ্নগুলো আমাদেরকে জানাতে পারত ভেতরে সম্পদের সুনির্দিষ্ট গণনাসূচক কয়টি চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ এখানে দুই ধরনের চিহ্ন কাজ করত। এক ধরনের চিহ্ন দিয়ে ধনসম্পদের পরিমাণ বোঝা যেতো আর অন্য চিহ্ন দিয়ে গরুর সংখ্যা। এ পর্যায়ে এসে বস্তু ও চিহ্নের মধ্যকার সম্পর্কটি আরও বিমূর্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তী ধাপ ছিল এই সহজ চিহ্নপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসা। সুমেরীয় শহরগুলো বড়ো হতে লাগল এবং সম্পদের মালিকানার ব্যাপারটি জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল। একজন মানুষ অনেক ধরনের সম্পদের মালিক হতে লাগল এবং সেসব সম্পদের বিনিময়ও চলতে থাকত অবিরাম। সেই মুহূর্তে হিসাবরক্ষকদের প্রয়োজন ছিল চিহ্নের চেয়েও বেশি কিছুর। সেই সময় তাদের প্রয়োজন ছিল চিত্রলিপির, যা একইসাথে কোন জিনিস গণনা করা হচ্ছে এবং তার পরিমাণ কত উভয়ই প্রকাশ করতে পারবে।
চিত্রলিপির ব্যবহার বেশ সরলীকৃত ছিল। সাধারণত সেগুলো আঁকা হতো কাদামাটির উপর, যেখানে খুব সূক্ষ্ম কারুকাজের সুযোগ ছিল না। আর সেখানে বাস্তবসম্মত গরুর ছবি আঁকার প্রয়োজনীয়তা ছিল না, কেননা যখনই কারও গরুর প্রয়োজন হতো তখন ট্যাবলেটের দিকে তাকিয়ে চতুর্ভুজের উপরে একটি মাথা এবং লেজ আঁকা দেখলেই মানুষ বুঝত যে এটা গরু। ঠিক একইভাবে, ছোটো বাচ্চার আঁকা মায়ের কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং মার্কা ছবি দেখলেও সবাই বুঝতে পারত যে এটাই তার মা এবং সে এখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
তখনও পর্যন্ত এটি চিহ্ননির্ভর ব্যবস্থাই ছিল; একে ‘লিপি’ বলার মতো যোগ্যতা সে অর্জন করেনি তখনও। অপরদিকে চিহ্নভিত্তিক প্রক্রিয়া হিসেবে এটি বেশ জটিল আকার হয়ে গিয়েছিল।
এরপর সিলগালা পুনরায় ফিরে এলো; কিন্তু এবার সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে।
শু এক সময় শুধু শস্য আর তেলের হিসাব রাখার জন্য তার সিলটিকে ব্যবহার করতেন। তিনি এখন একটি ট্যাবলেটের নিচের দিকে সিল মারতে পারতেন, যেখানে চিত্রলিপির মাধ্যমে দুই প্রতিবেশীর মাঝে গরু কেনাবেচার বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা থাকত। যেহেতু সেই দুই প্রতিবেশী একজন আরেকজনকে পুরোপুরি বিশ্বাস করত না, তারা তাকে অকুস্থলে উপস্থিত থেকে বেচাকেনার ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করার অনুরোধ করেছিল এবং পরিশেষে তিনি তার সিল প্রদানের মাধ্যমে নিজেকে এই লেনদেনের একজন চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ট্যাবলেটের নিচের দিকে শু-র নাম থাকা মানে এখন আর এটা না যে ও এখানে ছিল কিংবা ও এসকল সম্পদের মালিক। শু-র সিল এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অর্থ বহন করছে, যার মানে হচ্ছে : ‘শু এখানে উপস্থিত থেকে এই লেনদেনটি পর্যবেক্ষণ করেছে এবং কারও মনে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন থাকলে তার সাথে যোগাযোগ করুন।
এটি শুধু একটি চিহ্ন ছিল না, পাঠকের প্রতি একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তৃতার মতো ছিল।
সেই সময় পর্যন্ত সুমেরীয় ‘লিপি’ মানুষের ভালো স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। তখনও পর্যন্ত সেটি ছিল হাতের আঙুলে সুতা জড়িয়ে রাখার মতো প্রাথমিক একটি প্রক্রিয়া; এটাকে চিহ্নের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা বলা যেত না। কিন্তু বিভিন্ন শহরের মাঝে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়তে লাগল এবং সেসব কাদামাটির ট্যাবলেটে আরও অনেক বেশি তথ্য ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো-পূর্বের মতো পণ্যের নাম এবং সংখ্যার হিসাব রাখা যথেষ্ট ছিল না। কৃষক ও বণিকদের লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল কখন ফসল বোনা হয়েছে এবং কী ধরনের ফসল, কোন ভৃত্যকে কী কাজে পাঠানো হয়েছে ইত্যাদি। এ ছাড়া ঐশ্বরিক কৃপা লাভের আশায় এনলিলের মন্দিরে কয়টি গরু পাঠানো হয়েছে সেই হিসাবটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ মন্দিরের পূজারিরা ভুল গণনা করতে পারে। এরপর ছিল রাজাকে পাঠানো নজরানার বিষয়টি। সেখানে গণনা ভুল হলে রাজার আক্রোশ নেমে আসতে পারে গণনাকারীদের উপর এবং তিনি অতিরিক্ত নজরানা দাবি করতে পারতেন।
চিত্র : সুমেরীয় বর্ণমালা চার্ট
এই ধরনের বিস্তারিত তথ্য পাঠানোর জন্য সুমেরীয়দের প্রয়োজন ছিল সেরকম চিহ্নের যা শব্দের মতো অর্থ বহন করবে, শুধু বস্তুসূচক নয়। তাদের দরকার পড়েছিল ‘গরু’, ‘পাঠানো হয়েছে’, ‘গম’, ‘বপন করা হয়েছে’ কিংবা ‘ধ্বংস হয়েছে’-এধরনের শব্দ বা শব্দাংশ বোঝানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন চিত্রলিপির।
বিভিন্ন ধরনের চিহ্নের প্রয়োজনীয়তা দ্রুত বাড়ছিল আর লিখিত সংকেতের ব্যবহার প্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মাত্র দুটি পথই খোলা ছিল। প্রথমত, চিহ্নের সংখ্যা বাড়ানো, যাতে করে অতিরিক্ত চিহ্নগুলো এই নতুন নতুন জিনিস ও পরিস্থিতিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা যেত। আরেকটি উপায় ছিল চিত্রলিপিকে শব্দভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যমে রূপান্তরিত করা, যাতে যে-কোনো চিহ্নকে নির্দিষ্ট ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করা যেত। পূর্ণাঙ্গ শব্দ নয় বরং প্রতিটি ধ্বনি এক-একটি শব্দাংশকে প্রকাশ করতে পারত আর এই ধ্বনিগুলোর সমন্বয়ে শব্দ ও বাক্য গঠন করা যেত। যখন কোনো সুমেরীয় ব্যক্তি একটি গরু-চিহ্ন দেখতেন, তিনি তখন তার ঠোটের মাধ্যমে সেই শব্দটিই করতেন যাতে বোঝা যেত এটি একটি গরু। এই কারণে চিত্রলিপি ও ধ্বনির সমন্বয় ঘটিয়ে ভাব প্রকাশ করাটা খুব একটা দুরূহ ব্যাপার ছিল বলে বোধ হয়নি কখনোই।
পরবর্তী ছয়শ বছরে সুমেরীয় চিত্রলিপি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধ্বনিভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়। ভেজা কাদামাটির উপর কীলকসদৃশ যন্ত্রের মাধ্যমে খোদাই করা এসব চিহ্নের সুনির্দিষ্ট আকৃতি ছিল, যা উপরের দিকে প্রশস্ত ও নিচের দিকে সরু ছিল।
এই লিপিকে সুমেরীয়রা কী বলতেন তা আমরা কখনোই আর জানতে পারব না। একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারকে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন কাজ; আর সুমেরীয়রা তাদের এই উদ্ভাবনকে নিয়ে কোনো মন্তব্যই রেখে যায়নি আমাদের জন্য। তবে ১৭০০ সালে থমাস হাইড নামের একজন বর্ষীয়ান পার্সি বিদ্বান এই লিপির নাম দেন ‘কুনেইফর্ম’, যে নামটি আমরা এখনও ব্যবহার করি। এই নামটি এই লিপির গুরুত্বকে বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়; এটি এসেছে ল্যাটিন ভাষার একটি শব্দ থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘তিনকোনা ত্রিভূজ আকৃতি’ বা ইংরেজিতে ‘ওয়েজ (wedge) শেপ।
হাইড ভেবেছিলেন যে কাদামাটির উপর খোদাই করা চিহ্নগুলো কোনো এক ধরনের সুসজ্জিত সীমানা।
সুমেরের অল্প কিছুদিন পরে মিশরে চিত্রলিপির ব্যবহার শুরু হয়।
মিশর দেশটি একটি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হতে হতে সেখানে চিত্রলিপির বহুল ব্যবহার শুরু হয়। নার্মার প্যালেটের উপর, রাজা নার্মারের মাথার ঠিক ডানপাশে মাগুর মাছের চিত্রলিপি আঁকা আছে এবং পোর্টেটের উপর তার নাম ‘নার্মার’ লেখা আছে।
মিশরীয় চিত্রলিপি, যাকে আমরা হায়েরোগ্লিফিক্স বলে থাকি, সেটি গণনাপদ্ধতি থেকে আসেনি। খুব সম্ভব মিশরীয়রা চিত্রলিপির প্রক্রিয়াটি শিখেছিল তাদের উত্তর-পূর্বদিকের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। সুমেরীয় কুনেইগ্রাম লিপি তার মূল উৎস চিত্রলিপি থেকে অনেক বেশি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু হায়েরোগ্লিফিক্স অনেকটাই তার প্রাথমিক রূপ ধরে রাখতে পেরেছিল—দীর্ঘদিন ধরে। হায়েরোগ্লিফিক্স পরবর্তীকালে ধ্বনিমূলক চিহ্নে রূপান্তরিত হওয়ার পরও তাকে বিভিন্ন বস্তুর সাথে মেলানো যেত; যেমন হাত উঠিয়ে রাখা একজন মানুষ, মেষপালকের লাঠি, মুকুট, বাজপাখি ইত্যাদি।
হায়েরোগ্লিফিক্স ছিল ভালোমন্দ মেশানো একটি ভাষা। কিছু চিহ্ন চিত্রলিপির মতো ছিল আর কিছু ছিল ধ্বনি-সংকেত। কখনও কখনও একটি বাজপাখি-চিহ্ন দিয়ে একটি শব্দকে বোঝানো হতো, আবার কখনও কখনও এটি ছিল শুধুই একটি বাজপাখি। এই কারণে মিশরীয়রা এক ধরনের ‘নির্ণায়ক’ উদ্ভাবন করেন যাকে হায়েরোগ্লিফিক্সের পাশে বসিয়ে বোঝানো হতো সেটি ধ্বনি-সংকেত নাকি চিত্রলিপি।
কিন্তু হায়েরোগ্লিফিক্স কিংবা কুনেইফর্ম কোনোটাই একটি পূর্ণাঙ্গ বর্ণমালায় রূপান্তরিত হতে পারেনি।
সুমেরীয়রা এই সুযোগটি পায়নি। সুমেরীয় ভাষার সম্পূর্ণ বিবর্তন সম্পন্ন হওয়ার আগেই সেটি আক্কাদিয়ান দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে গিয়েছিল, যেটি ছিল সুমেরকে দখল করে নেওয়া শাসকদের কথ্যভাষা।
অপরদিকে হায়েরোগ্লিফিক্স হাজার হাজার বছর ধরে টিকে ছিল—চিত্রলিপি হিসেবে তার পরিচয়কে অক্ষুণ্ণ রেখে। এর সাথে মিশরীয়দের লেখালেখির প্রতি মনোভাবের একটি যোগসূত্র ছিল। একজন মিশরীয় মনে করতেন লিপির মাধ্যমে তিনি অমরত্ব লাভ করতে পারেন। এটি এক ধরনের জাদুবিদ্যা ছিল যার মাধ্যমে ছোটো ছোটো সারির মধ্যে জীবন ও শক্তিমত্তা লুকিয়ে থাকে। মিশরীয়দের মতে কিছু হায়েরোগ্লিফিক্স এতই শক্তিশালী ছিল যে তা জাদুবিদ্যায় ভরপুর এলাকায় লেখাই যেত না; সেগুলো শুধু কম জাদুকরি এলাকায় বসে লেখা যেত, যাতে কোনো অশুভ শক্তির আগমন না ঘটতে পারে। একটি মিনার কিংবা মূর্তির উপর হায়েরোগ্লিফিক্সের মাধ্যমে একজন রাজার নাম খোদাই করে রাখার মানে ছিল তাদেরকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা—ইহকালের মায়া ত্যাগ করার পরেও। একজন রাজার খোদাই করা নামকে বিকৃত করার মানে ছিল তাকে মেরে ফেলা-চিরকালের জন্য।
সুমেরীয়রা ছিল অধিক বাস্তববাদী; তাদের লেখায় এই ধরনের কোনো উদ্দেশ্য থাকত না।
মিশরীয়দের মতো সুমেরীয়দেরও একজন লেখালেখির দেবী ছিলেন, যার নাম নিসাবা। প্রাপ্ত জ্ঞান অনুযায়ী তিনি খাদ্যশস্যেরও দেবী ছিলেন।
কিন্তু মিশরীয়দের ধারণা ছিল যে লিপির উদ্ভাবন ঘটেছিল একজন দেবতার হাত ধরে, যার নাম ছিল তথ-পবিত্র লেখক, যিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন তার নিজেরই শব্দের শক্তিতে। তথ ছিলেন লিপির দেবতা এবং একইসাথে প্রজ্ঞা ও জাদুবিদ্যার দেবতা। তিনি পৃথিবীর পরিমাপ করেছিলেন, তারার সংখ্যা গণনা করেছিলেন এবং মানুষের প্রতিটি কার্যকলাপের নথি সংরক্ষণ করেছিলেন, যাতে তা মৃত্যুর হলঘরে নিয়ে এসে তাদের বিচার করা যায়। তিনি শস্যের বস্তা গণনা করার মতো অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করতেন না।
লিখিত বক্তব্যের প্রতি এই মনোভাবটির কারণেই হায়েরোগ্লিফিক্সের চিত্রলিপি আকারটি টিকে ছিল দীর্ঘদিন। মিশরীয়রা এই ছবিগুলোকেই শক্তির উৎস ভাবতেন। এমনকি এই চিত্রলিপিগুলোর মানেও সবার জানার কথা ছিল না, যদি না কাউকে সেই জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করা হতো। মিশরীয় পূজারিগণের কাছে এই গোপন তথ্যগুলো সংরক্ষিত থাকত আর তারা এই জ্ঞান নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতেন দীর্ঘদিন ধরে।
তখন থেকেই লিখতে ও পড়তে পারাকে এক ধরনের শক্তির উৎস হিসেবে ধরে নেওয়া হতো।
এমনকি হায়েরোগ্লিফিক্স এতটাই দুর্বোধ্য ছিল যে এর অর্থ খুঁজে বের করার সক্ষমতা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছিল; যদিও তখনও সগৌরবে মিশর রাজ্যের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে।
আমরা খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সালে গ্রিকভাষী মিশরীয়দের খুঁজে পাই যারা বিভিন্ন চিহ্নের মানে এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ব্যাখামূলক লেখা লিখে রেখে গিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, হোরাপল্লো তার হায়েরোগ্লিফিকা বইতে হায়েরোগ্লিফিক্সের মাধ্যমে লেখা—আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে ‘আঁকা’—শকুনের ছবির বিভিন্ন ধরনের অর্থকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছেন একই চিহ্নের বিভিন্ন অর্থের ব্যাখ্যা প্রদান করতে; কিন্তু তার ব্যাখ্যা অনেকাংশেই ভুল ছিল।
‘তারা যখন একজন মাতা, চোখের দৃষ্টি, সীমানা অথবা জ্ঞানের কথা বলেন তখন একটি শকুন আঁকেন’, হোরাপল্লো লিখেছেন। ‘মা, কেননা শকুন প্রজাতিতে কোনো পুরুষ নেই; দৃষ্টিশক্তি, কেননা অন্য যে-কোনো প্রাণীর তুলনায় শকুনের দৃষ্টিশক্তি অধিকতর প্রখর; সীমানা, কেননা যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন সেই যুদ্ধক্ষেত্রের সীমানা ঠিক করে দেয় সেই জায়গাটুকুর উপর দিয়ে সাতদিন ধরে উড়ে উড়ে এবং সর্বশেষে জ্ঞান, কেননা সে সানন্দে প্রত্যাশা করে যুদ্ধের ফল হিসেবে আসন্ন লাশের পরিমাণকে যা তার দীর্ঘদিনের খাবারকে সুনিশ্চিত করবে।’
হায়েরোগ্লিফিক্সের জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই মিশরীয় লিপির কথা অজ্ঞাত ছিল। সম্রাট নেপোলিয়নের সৈন্যরা নীল নদের তীর থেকে একটি পুরানো দুর্গের ছাঁচ খুঁড়ে তোলেন। সেখানে তিনি নিজেই একটি দুর্গ বানানোর পরিকল্পনা করছিলেন। সেই খুঁড়ে তোলা সাতশ পাউন্ড ব্যাসাল্টের চাঁই- এর গায়ে হায়েরোগ্লিফিক্স খোদাই করা ছিল; আর একইসাথে ছিল আরও অনেক পরে আবিষ্কৃত মিশরীয় লিপি এবং গ্রিক লিপিতে লেখা অনুবাদ। এই পাথরটি—পরবর্তীতে যার নাম দেওয়া হয় ‘রোসেটা স্টোন’—ছিল ভাষাবিদদের জন্য একটি সোনার খনি। এখান থেকেই হায়েরোগ্লিফিক্সের মর্মোদ্ধারের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। এই সামরিক অভিযানের ফলে আমরা বহু বছরের সাহিত্যিক অভিযানের রসদ পেয়ে যাই। এর মাধ্যমে প্রাচীন কাব্য ও মহাকাব্যের মানে খুঁজে বের করার সুবর্ণ সুযোগ আমাদের হাতে আসে। এ থেকে আরেকবার প্রমাণিত হয় যে সাহিত্য কখনোই যুদ্ধবিগ্রহের গ্রাস থেকে পুরোপুরি স্বাধীন ছিল না এবং একইভাবে সাহিত্য সর্বদা ব্যাবসাবাণিজ্যের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।
হায়েরোগ্লিফিক্সের যাদুকরি ও রহস্যময় প্রকৃতিটি টিকে ছিল, কেননা মিশরীয়রা দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য নতুন এবং সহজ এক ধরনের লিপি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।
হায়রাটিক লিপি ছিল হায়েরোগ্লিফিক্সের একটি সহজতর সংস্করণ, যেখানে ছবির মতো চিহ্নগুলোকে বাঁকা বাঁকা রেখা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। ডব্লিউ ভি ডেভিসের বর্ণনায়, এটি ছিল হায়েরোগ্লিফিক্সের ‘কার্সিভ’ (জড়ানো) রূপ। ব্যাবসায়িক বিষয়াদি, আমলা ও প্রশাসকদের বিভিন্ন কাজের বর্ণনা লেখার ক্ষেত্রে হায়োটিক হয়ে ওঠে পছন্দসই লিপি। এটির অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল আরেকটি মিশরীয় উদ্ভাবনের উপর কাগজ। রেখাগুলো যতই সহজ হোক না কেন, সেগুলোকে কাদামাটির উপর খোদাই করা সহজ ছিল না।
শত শত বছর ধরে কাদামাটি ছিল সুমেরীয় ও মিশরীয়দের পছন্দের লেখার মাধ্যম। এটি সহজলভ্য এবং বারবার ব্যবহারযোগ্য ছিল। একটি সমতল কাদামাটির ট্যাবলেটের উপর খোদাই করে সেটাকে রোদে পুড়িয়ে শুকিয়ে নিলে তা অনেক বছর ধরে টিকে থাকত। কিন্তু একইসাথে ট্যাবলেটের পৃষ্ঠতল একটু আর্দ্র করে নিলেই খুব সহজে লেখাগুলোকে আরও পরিষ্কার করা যেত কিংবা পরিবর্তন করে নেওয়া যেত–কোনো নথিকে হালনাগাদ কিংবা সঠিক করার জন্য। যে নথিকে অবিকৃত রাখার প্রয়োজন হতো তা রোদে সেঁকা হতো, যাতে চিহ্নগুলো ট্যাবলেটের উপর পাকাপাকিভাবে বসে যায় এবং সেগুলোকে কোনোভাবেই পরিবর্তন করা না যায়।
কাদামাটির ট্যাবলেটগুলো ভারী ছিল; সেগুলোকে সংরক্ষণ করা এবং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া ঝামেলাপ্রদ ছিল এবং এক-একটি ট্যাবলেটে খুব সীমিত পরিমাণ জায়গা থাকত লেখার জন্য। ব্যাপারটি হালের ওয়ার্ড প্রসেসরের পুরোই বিপরীতমুখী একটি ব্যাপার ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের আশেপাশে একজন মিশরীয় লিপিকার অনুধাবন করেন যে ঘরবাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহৃত প্যাপিরাসকেও লেখনীপৃষ্ঠ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্যাপিরাস ছিল মূলত নলখাগড়া। নরম করে গোল্লা খেলার কাঁটার মতো করে বিছিয়ে সেগুলোকে ভর্তা করা হতো, যা থেকে মণ্ড তৈরি হতো। এরপর এই মণ্ডকে কাগজের মতো করে বিছিয়ে শুকানো হতো।
তুলি ও কালির সাহায্যে খুব সহজে এবং দ্রুততার সাথে প্যাপিরাসের উপর হায়রাটিক লিপি বসানো যেত।
সুমেরে এই ধরনের কোনো বস্তুর কাঁচামাল পাওয়া যেত না, যে কারণে সেখানে আরও শত শত বছর ধরে কাদামাটির ট্যাবলেট ব্যবহৃত হতে লাগল। প্রায় ১ হাজার ৫০০ বছর পরে, মোসেস যখন যাযাবর আব্রাহামের সেমিটিক বংশধরদেরকে মিশর থেকে প্রাচ্যের শুষ্ক আবর্জনা-ভূমিতে নিয়ে আসলেন, তখন সৃষ্টিকর্তা তাদের উদ্দেশ্যে যে নির্দেশাবলি প্রেরণ করেছিলেন তা পাথরের ট্যাবলেটে খোদাই করা ছিল, কাগজে নয়। এই পাথরের ট্যাবলেট সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের বাক্স বানাতে হয়েছিল, কেননা সেগুলোকে পরিবহণ করা কষ্টসাধ্য ছিল।
অপরদিকে কাগজ পরিবহণ করা তুলনামূলক অনেক সহজ ছিল। বার্তাগুলোকে সহজেই ভাঁজ করে নেওয়া যেত এবং কোটের নিচে কিংবা পকেটে ভরে বহণ করা যেত। দূরে দূরে থাকা নীল নদের আমলাদের জন্য রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মাঝে বার্তার আদানপ্রদান করার জন্য এরকম সহজ একটি মাধ্যমের প্রয়োজন ছিল। ৪০ পাউন্ড ওজনের কাদামাটির ট্যাবলেট বহনকারী বার্তাবাহকের কাজটা কখনোই সহজ ছিল না।
মিশরীয়রা দুহাত প্রসারিত করে এই নতুন ও কার্যকর প্রযুক্তিকে লুফে নিয়েছিল। পাথরের দেওয়ালে, সমাধিতে, স্মৃতিস্তম্ভে ও মূর্তির গায়ে হায়েরোগ্লিফিক্স খোদিত হতে থাকল কিন্তু চিঠিপত্র, স্মারকলিপি, নির্দেশাবলি ও সতর্কবাণী লেখা হতো প্যাপিরাসে, যেটি আর্দ্র হলে গলে যেত, পুরানো হয়ে গেলে ফেটে যেত এবং কিছুদিন পর ধ্বংস হয়ে ধুলোয় মিশে যেত।
আমরা সুমেরীয় রাজা জিমরি লিমের বিবিধ পারিবারিক সমস্যার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পেরেছি সেসব কাদামাটির ট্যাবলেট থেকে, যেগুলো মেসোপটেমিয়ার রোদে সেঁকা বিভিন্ন শহরের মাঝে ঘোরাফেরা করেছিল আজ হতে অনেক অনেক বছর আগে। কিন্তু সেই তুলনায় প্যাপিরাস আবিষ্কারের পরবর্তী সময়ে আমরা ফেরাউনদের দৈনন্দিন জীবন এবং তাদের প্রশাসনিক কার্যকলাপের ব্যাপারে খুব কমই জানতে পেরেছি।
তাদের দুঃখ-দুর্দশার বয়ান এবং জরুরি বার্তাগুলো হারিয়ে গিয়েছে; অতীব সতর্কতার সাথে লিপিকারদের লেখা ইতিহাস উধাও হয়ে গিয়েছে ডিলিট হয়ে যাওয়া ইমেইলের মতো করে। অর্থাৎ পাঁচ হাজার বছর আগে আমরা শুধু প্রথম লেখনী পাইনি বরং সাথে এমন একটি প্রযুক্তিও খুঁজে পেয়েছিলাম যা পরবর্তীতে শাঁখের করাতের মতো হয়ে দাঁড়ায়।
ততদিনে সুমেরীয় কুনেইফর্মের মৃত্যু ঘটেছে এবং তাকে কবরও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হায়েরোগ্লিফিক্সের রেখাগুলো আজও বেঁচে রয়েছে বহাল তবিয়তে আরও কিছুদিন পরে ‘প্রটোসিনাইটিক’ নামে আরেক ধরনের লিপির খোঁজ পাওয়া যায় সিনাই উপদ্বীপের আশেপাশের কিছু জায়গায়, যেটির অর্ধেকের বেশি অক্ষর ছিল মিশরীয় হায়েরোগ্লিফ থেকে ধার নেওয়া।
পরবর্তীতে, ফিনিশীয়রা তাদের বর্ণমালায় প্রটোসিনাইটিক থেকে কিছু অক্ষর ধার নিয়েছিল। আর গ্রিকরা ফিনিশীয় বর্ণমালাকে ধার করে এনে তাকে উলটে পালটে আবার সেটিকে রোমানদের কাছে প্রেরণ করে, যা অবশেষে আধুনিক মানুষের কাছে এসে পৌঁছায়। সুতরাং এক অর্থে বলা যায়, মিশরীয়দের জাদুকরি চিহ্নগুলো প্রকৃতপক্ষেই অমরত্ব লাভ করেছে।