অধ্যায় পঁচিশ – হরপ্পানদের ছড়িয়ে পড়া
ভারতে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ থেকে ১৫৭৫ সালের মধ্যে হরপ্পান শহরগুলো ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং ধ্বংসস্তূপে যাযাবররা ঘাঁটি গেড়ে বসে।
ভূমধ্যসাগরের একেবারে পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হরপ্পা শহরগুলো এক ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় মহেঞ্জোদারোর জনগোষ্ঠী তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করল। তবে সবাই পালাতে পারেনি। মাটি খুঁড়ে রাস্তার উপর কবর দেওয়া হয়নি এরকম কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া গেছে। এ ছাড়া একটি পুরো পরিবার তাদের ঘরের মধ্যে আটকানো অবস্থায় মারা গেছে। একটি বাড়িতে আগুন লেগে ধসে পড়েছে। পলায়নপর বাসিন্দারা তাদের দামি জিনিসপত্র পেছনে ফেলে গেছে; যেমন গয়না, রুপা ইত্যাদি। হরপ্পার উত্তরেও একইরকম দৃশ্য দেখা গেছে। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, সমগ্র হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছিল।
তবে এটুকু নিশ্চিত যে হরপ্পারা কোনো সশস্ত্র হামলার শিকার হয়নি। পুরানো ধ্বংসাবশেষে কোনো ধরনের অস্ত্র, বর্ম পরিহিত মরদেহ কিংবা দালানের নিয়মতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ অথবা নগরকেন্দ্রে কোনো সংঘর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন দালানের ধসে পড়া এবং অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে ভূমিকম্প কিংবা বন্যাকে দায়ী করা যেতে পারে। যদি বন্যা হয়ে থাকে তা হলে তা ছিল আকস্মিক, অস্বাভাবিক ও তীব্র। পলিমাটির স্তর থেকে দেখা যায় যে সিন্ধু নদে নিয়মিত বন্যা হতো। নগরকেন্দ্রের পোড়ানো ইট শহরকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করত। তবে হরপ্পা শহরে দেখা ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে অনেক উঁচু পানির স্রোত দায়ী হতে পারে।
হাইড্রোলজিস্ট আর এলো রাইকেস দাবি করেন, হরপ্পার কাছাকাছি সিন্ধু নদ থেকে বয়ে আনা পলিমাটি জমে একটি প্রাকৃতিক বাঁধ সৃষ্টি হয়েছিল, যেটি কিছু সময়ের জন্য বন্যা বন্ধ রেখেছিল। তবে নতুন করে আর কোনো পানি এবং সঙ্গে পলিমাটি না আসায় সেই অঞ্চলের ভূমি তার উর্বরতা হারিয়েছিল এবং একটি মাঝারি মানের দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তারপর জমতে থাকা পানির চাপে এক সময় সেই প্রাকৃতিক বাঁধ ভেঙে যায় এবং একইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ পানি এসে শহরগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ১৮১৮ সালে একই ধরনের এক ঘটনায় পলিমাটির বাঁধ প্রায় ২ বছর ধরে সিন্ধু নদের প্রবাহকে আটকে রেখেছিল। তবে এত কিছুর পরও হরপ্পার দুটি বৃহত্তম শহরে বন্যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর বন্যায় দালান ধ্বংস হলেও সেগুলোকে পুনর্নির্মাণ কেন করা হয়নি?
আমাদেরকে ধরে নিতে হবে যে ইতোমধ্যে রোগশোকে ভুগতে থাকা একটি সভ্যতার উপর কোনো এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছিল। কঙ্কালের পরীক্ষায় দেখা গেছে হরপ্পার জনগোষ্ঠী রক্তশূন্যতাসহ আরও বিভিন্ন ধরনের অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছিল। সিন্ধু নদের তীরে লবণাক্ততার সমস্যা খুব একটা ছিল না, তবে কোনো ভূমিই আজীবন উর্বর থাকে না। বর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যশস্যের চাহিদা নিরন্তর বাড়ছিল। শহর বড়ো হচ্ছিল আর বেশি করে গাছ কাটা হচ্ছিল। সবদিক দিয়ে হরপ্পার মানুষদের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ কমে আসছিল এবং এই পর্যায়ে একটি বন্যা তাদেরকে কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।
তবে এই প্রলয়ের পরেও শহরগুলো পুরোপুরি জনশূন্য হয়ে পড়েনি। কিছু মানুষ থেকে যায় এবং আরও কিছু মানুষ ফিরে আসে। তবে হরপ্পায় আর আগের মতো সুসংহত জীবন ফিরে আসেনি। আগের সেই জটিল ড্রেন ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে কেউ আর মেরামত করতে পারেনি। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই হরপ্পাপরবর্তী সভ্যতাকে ঝুকার সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করেন। ঝুকার সম্প্রদায় বলতে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তাদের রেখে যাওয়া শহরে ধ্বংসাবশেষে বসবাসকারী কিছু মানুষ বোঝায়।
প্রাচীন ভারতে উত্তরদিক থেকে হামলাকারীরা এসেছিলেন, তবে তারা ১৫৭৫ থেকে ১৫০০ সালের আগে আসেনি। তারা পূর্বের এলাম ও উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল থেকে ভারতের পশ্চিম প্রান্তে (বর্তমানে হিন্দুকুশ পর্বতমালা নামে পরিচিত) চলে আসে। তারা ছিলেন যাযাবর যোদ্ধা। এই যাযাবরদের লেখায় ভারতকে ‘সাত নদীর ভূমি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যার অর্থ হচ্ছে তারা প্রথমে পাঞ্জাবে বসবাস করতে থাকেন। সিন্ধু নদের উপরের দিকে নদীটি ছয়টি উপনদীতে বিভাজিত হয়ে একটি মূল নদীর সঙ্গে মিশে গেছে, যার কারণে এরকম নামকরণ।
এই যাযাবরদের সভ্য বলারই তেমন কোনো উপায় ছিল না। তারা ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে যোদ্ধা-রাজদের অধীনে থাকতেন। তারা কিছু নির্মাণও করতেন না; লেখালেখির ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। তাদের কোনো চিত্রকলারও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কিন্তু তারা যুদ্ধ করতে জানতেন। তাদের ছিল ঘোড়া, ঘোড়ায় টানা গাড়ি চ্যারিওট এবং স্পোকযুক্ত চাকা, ব্রোঞ্জের কুঠার এবং অনেক দূর থেকে নিশানায় লক্ষ্যভেদে সক্ষম তির-ধনুক। তাদের অস্ত্রের মতো কোনো কিছু হরপ্পার লোকজন স্বপ্নেও দেখেনি, ব্যবহারের তো প্রশ্নই উঠে না। মিশরের হিকসোসদের মতো এই জাতিও মরুভূমি থেকে এসেছিল। তাদের যুদ্ধবিগ্রহের অভিনব কৌশল তাদেরকে যে-কোনো শত্রু বিনাশে সহায়তা করেছিল।
তবে তারা ভারতে এসেই দখলদারি শুরু করেনি। তারা সাত নদীর আনাচেকানাচে প্রায় ১০০ বছর থেকে তারপর আরও দক্ষিণ ও পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যতদিনে তারা হরপ্পার শহরগুলোতে পৌঁছায় ততদিনে সেই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং কোনোমতে তার কিছু নিশানা টিকে ছিল।
তারা কিছু ভবঘুরে লোককে তাড়িয়ে দিলেও প্রকৃতপক্ষে জবরদখলের মতো কিছু তারা করেনি। কিছু পরিত্যক্ত দালানকে তারা ব্যবহার করতে শুরু করে। এভাবেই পরিশীলিত হরপ্পা সভ্যতাকে প্রতিস্থাপন করে একটি যাযাবর জাতি, যাদের ছিল না তেমন কোনো সংস্কৃতি, প্রযুক্তি বা শহর পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা। তবে বৈরী পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলেন।
পরবর্তীতে এই যাযাবরদের বংশধররা নিজেদেরকে ‘আরিয়া’ বলে অভিহিত করতে শুরু করেন, যার কমপক্ষে ৭টি ভিন্ন ভিন্ন ভাবানুবাদ রয়েছে ইংরেজি ভাষায়। এর মধ্যে ‘সম্মানের যোগ’ থেকে শুরু করে ‘খাঁটি’ পর্যন্ত সবই রয়েছে।
আরিয়ান বা আর্য সভ্যতার শুরুতে কোনো কিছুই খাঁটি ছিল না। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ অংশ আগেই হারিয়ে গেছে; কিন্তু বাকি যারা ছিলেন তারা যুদ্ধবাজ আর্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেলেন এবং তাদেরকে চাষবাস শেখালেন।
এভাবেই নতুন এক সভ্যতার সূর্যোদয় ঘটে উত্তর ভারতে।