অধ্যায় তেরো – প্রথম সামরিক শাসক

অধ্যায় তেরো – প্রথম সামরিক শাসক 

সুমেরে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৩৪ থেকে ২২৭৯ সালের মাঝে, রাজকীয় মদ্য পরিবেশক বা ‘কাপবাহক’ সার্জন একটি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। কিশ শহরে সার্গন নামের একজন কাপবাহক সাম্রাজ্য বিস্তারের নিজস্ব পরিকল্পনা আঁটছিলেন। 

সার্গন ছিলেন একজন রহস্যময় ব্যক্তি। তার জন্মকে ঘিরে একটি শিলালিপি রয়েছে যেখানে তার নিজ ভাষায় বর্ণনাটি এরকম- 

‘আমার মা ছিলেন সদা পরিবর্তনশীল 
আমার বাবাকে কখনও চেনা হয়নি
আমার বাবার ভাই পাহাড় ভালোবাসতেন 
আমাদের বাড়ি ছিল উঁচু ভূমিতে 
যেখানে ভেষজ উদ্ভিদের জন্ম হতো 
আমার মা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন গোপনে 
এবং তিনি আমাকে গোপনেই প্রসব করেছিলেন 
তিনি আমাকে একটি বেতের ঝুড়িতে বসিয়েছিলেন
তার মুখটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন আলকাতরা দিয়ে
তিনি আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন 
কিন্তু নদী আমাকে ডুবায়নি 
পানিতে ভেসে আমি আক্কির কাছে চলে এলাম 
যে ছিল পানি সংগ্রাহক 
সে তার কুঁজোটি পানিতে চুবিয়ে আমাকে খুঁজে পায় 
আর তুলে আনে 
সে আমাকে নিজ পুত্রের মতো লালন করে 
সে আমাকে তার মালী বানায়।’ 

কবিতার ধাঁচে লেখা এই গল্প থেকে আমরা সার্গনের জন্মরহস্যের কোনো কিনারা করতে পারি না। আমরা তার প্রকৃত নাম কিংবা তার জাত সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না। ‘সার্গন’ নামটিও আমাদের কোনোভাবে সাহায্য করে না, কারণ এটি তার নিজেরই রাখা। মূল শব্দটি হচ্ছে ‘শাররুম কিন’, যার মানে হচ্ছে ‘বৈধ রাজা’; কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে সিংহাসনের উপর তার কোনো ধরনের বৈধ দাবিই ছিল না। 

তার আদি নিবাস যদি পাহাড়ি এলাকাই হয়ে থাকে তা হলে খুব সম্ভব তিনি সেমাইট ছিলেন, সুমেরীয় ছিলেন না। এই বিষয়ে আমরা আগেই আলোকপাত করেছি। পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে আগত সেমাইটরা মেসোপটেমীয় সমতলভূমিতে সুমেরীয়দের সাথে মেলামেশা করেছে উপনিবেশগুলোর গোড়াপত্তনের সময় থেকেই। এ ছাড়া সুমেরীয়দের লেখায় ডজন ডজন ধার করা সেমাইট শব্দ পাওয়া যায় এমনকি কিশের প্রথমদিকের রাজাদের নামও সেমিটিক ছিল। 

এত কিছুর পরও দক্ষিণের সুমেরীয় এবং উত্তরের সেমাইটদের মাঝে পার্থক্য ছিল দিনের আলোর মতো। এই দুটি জাতির পূর্বপুরুষ ছিল ভিন্ন দুটি যাযাবর গোত্র যারা পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে এসে মেসোপটেমিয়াতে থিতু হয়েছিল বহুকাল আগে। উত্তরে একটি সেমাইট ভাষায় কথা বলত লোকজন যা পরবর্তীতে ইসরাইল, ব্যাবিলন ও এসিরিয়া অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায় রূপান্তরিত হয়। অপরদিকে, দক্ষিণের সুমেরীয় শহরগুলোতে সুমেরীয় ভাষা প্রচলিত ছিল যে ভাষার সাথে অন্য কোনো ভাষার কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। 

যেসব এলাকায় সুমেরীয় ও আক্কাদীয়দের মধ্যে মেলামেশা হতো সেখানেও তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল এক ধরনের জাতিগত বিদ্বেষ। আরও প্রায় দেড়শ বছর পরে, যখন আদাবের রাজা লুগুলান্নেমুন্ডু এলামাইটদের বিদায় করে দিয়ে নিজেকে সুমেরের ‘চার-চতুর্থাংশের’ অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করলেন, তখন তার বিরুদ্ধে জোট বাঁধা তেরোটি শহরের তেরোজন শাসকের প্রত্যেকেরই ছিল সেমাইট নাম। 

কিন্তু সার্গনের গল্পে কোথাও তার পূর্বপুরুষদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না, কারণ তিনি সযত্নে এই বিবরণগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি তার পিতার পরিচয় জানতেন না এবং এই কারণেই তাকে কোনো নিম্ন গোত্র কিংবা বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ণ বংশের সাথে সংযুক্ত করা যায়নি। তার সেই ‘পরিবর্তনশীল’ মাতার পরিচয়ও কুয়াশায় ঢাকা 

খুব সম্ভব তিনি তার নিজ পরিচয়ও বদলে ফেলেছিলেন কোনো এক সময়। তিনি হয়তো তার সাধারণ জীবনকে পরিত্যাগ করে ধর্মীয় জীবনযাপন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন (কিছু অনুবাদক ‘পূজারি’ শব্দটি প্রয়োগ করেন তার নামের সাথে) কিংবা হয়তো তিনি নিম্ন গোত্র থেকে উচ্চ বংশে উন্নীত হতে পেরেছিলেন অথবা অন্য কোনো গোত্রের মানুষের সাথে থিতু হয়েছিলেন। 

তার জীবনটা যেমনই হোক সেই পরিবর্তনশীল মাতার জীবনে তার পুত্রের কোনো স্থান ছিল না। তাকে নদীতে বিসর্জন দিয়ে তিনি চিরতরে পুত্রের পরিচয়কে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেন। তাকে পানি থেকে টেনে তোলার ঘটনাটির প্রভাব একইরকম ছিল যেরকমটি আমরা দেখতে পাই পরবর্তীকালে হিব্রু ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের লেখা বিভিন্ন রচনায়। সুমেরীয়রা ভাবতেন যে নদী ইহকাল ও পরকালের মাঝের সেতুর মতো কাজ করে এবং পানির মধ্য দিয়ে পারাপারের মাধ্যমেই তাদের জীবনে কোনো বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। পানি থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর সার্জন তার পালক বাবা-মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হন। যে মানুষটি তাকে উদ্ধার করেছিলেন তার নাম ছিল আক্কি, যার নামটি সেমাইটদের মতো। আক্কিও সেমাইট হয়ে গিয়েছিলেন। 

মানচিত্র-১০ : সার্গনের রাজত্ব 
মানচিত্র-১০ : সার্গনের রাজত্ব 

আক্কি কিশের রাজার প্রাসাদে চাকরিরত ছিলেন; তিনি তার পালক পুত্রকে রাজার বাগানের মালি হওয়ার জন্য তালিম দিয়েছিলেন। 

তবে সার্গন বড়ো হতে হতে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলেন। 

সুমেরীয় রাজাদের তালিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সার্জন কিশের সুমেরীয় রাজা উর-জাবাবার কাপবাহক হতে পেরেছিলেন। 

মদ্য পরিবেশন করাই প্রাচীন কাপবাহকদের একমাত্র কাজ ছিল না। সুমেরীয় শিলালিপিগুলোতে কাপবাহকদের দায়িত্বের ফিরিস্তি না থাকলেও এর অল্প কিছুদিন পরে খোদাই করা এসিরীয় লিপি থেকে জানা যায় যে ক্ষমতার দিক দিয়ে রাজার পরেই তাদের স্থান ছিল। জেনোফোনের বর্ণনা অনুসারে, কাপবাহক শুধু রাজার সব খাবার নিজে আগে চেখে দেখতেন না, তাদের কাছে রাজার সিলমোহরও থাকত যার মাধ্যমে তারা ‘রাজকীয় অনুমোদন’ দিতে পারতেন। তিনি ঠিক করতেন কে কে রাজার সাথে দেখা করতে পারবেন এবং কখন। দ্য এজুকেশন অব সাইরাস নামক বইতে জেনোফোন লিখেন : ‘পারস্য রাজের কাপবাহকের দায়িত্বে ছিল ভূমিকা অধিদপ্তর। তিনি এই দপ্তরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন কারা রাজার সাথে দেখা করার যোগ্য।” 

কাপবাহকের হাতে এত বেশি ক্ষমতা ছিল যে তাকে রাজার সব খাবার ও পানীয় পরখ করে দেখতে হতো, রাজাকে বিষ প্রয়োগের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নয় (মানব-ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তিনি অনেক বেশি মূল্যবান একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন) বরং তিনি নিজে যাতে কখনও তার প্রভুকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে নিজের ক্ষমতা বাড়াতে প্রলুব্ধ না হন। 

সার্জন যখন কিশ শহরে উর-জাবাবার সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন তখন লুগালজাজ্ঞেসি একের পর এক অভিযান চালাচ্ছেন সুমেরে এবং ধীরে ধীরে নিজ রাজত্বের সীমানা বর্ধন করে যাচ্ছেন। সার্গন রাজার কাপ বহন করতে করতে লুগালজাজ্ঞেসি লাগাশ আক্রমণ করেন এবং উরুকাগিনাকে উৎখাত করেন; এবং পরবর্তীতে গিলগামেশের পুরানো আবাসস্থল উরুকও দখল করে নেন। এরপর তার পূর্ববর্তী সকল সুমেরীয় রাজার মতো তিনিও সমতলভূমির হিরক শহর কিশের দিকে তার নজর ফেরান। 

পুরানো একটি লেখার অংশবিশেষ থেকে আমরা পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। ‘দেবতা এনলিল রাজপ্রাসাদ থেকে তার সুনজর প্রত্যাহার করে নিলেন’, অর্থাৎ লুগালজাজ্ঞেসি ছিলেন আক্রমণকারী এবং তার নেপথ্যে ছিল এনলিলের আশির্বাদ। 

শহর আক্রমণ করতে প্রতিপক্ষের বাহিনী এগিয়ে আসছে, কথাটি শুনে উর- জাবাবা যারপরনাই ভীত হলেন এবং তিনি পা মচকে ফেললেন। আসন্ন যুদ্ধের মুখে দাঁড়ানো ভীত ও সন্ত্রস্ত উর-জাবাবাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি ‘লোনা জলে মিঠা পানির মাছের মতো খাবি খাচ্ছেন’। 

তার এই লক্ষ্যহীন আচরণের পেছনে কাপবাহকের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সন্দেহ একটি বড়ো কারণ ছিল। সার্গনের আচরণ তাকে সন্দিহান করে তুলেছিল (এবং যৌক্তিক কারণেই) এবং তিনি তার প্রকৃত আনুগত্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। তাই তিনি সার্জনকে লুগালজাজ্ঞেসির কাছে পাঠালেন কাদামাটির ট্যাবলেট সহকারে, যেটিকে সন্ধি চুক্তি হিসেবে তার কাছে দেওয়া হয়েছিল। আদতে সেই ট্যাবলেটে লুগালজাজ্ঞেসির কাছে তিনি গোপনে অনুরোধ করেছিলেন সেই বার্তার বাহককে হত্যা করতে। লুগালজাজ্ঞেসি তার সেই অনুরোধকে অবজ্ঞা করে কিশ অভিমুখে তার যাত্রা চালিয়ে যেতে থাকলেন। 

গল্পের পরবর্তী অংশটি অনুমাননির্ভর। পরবর্তীকালের এসিরীয় রাজারা সার্জনকে তাদের মহান পূর্বসূরি হিসেবে দাবি করেন এবং অবশ্যই গল্পে নির্দিষ্ট একটি অংশ অতিরঞ্জিত, যেখানে লুগালজাজ্ঞেসির স্ত্রী সার্জনকে স্বাগত জানান তার নারীত্ব দিয়ে। এটি সম্ভবত মহান দিগ্‌বিজয়ীদের দুর্নিবার যৌন আবেদনসম্পন্ন হিসেবে চিত্রিত করার প্রতিষ্ঠিত রীতির সাথে মিলিয়ে বানানো গল্প। 

তবে কিশের উপর আসা আক্রমণ থেকেই বোঝা যায় যে সার্গন সম্পূর্ণরূপে তার রাজার সমর্থনে ছিলেন না। লুগালজাজ্ঞেসি প্রবল বেগে বিজয়ীর বেশে কিশ শহরে অনুপ্রবেশ করলেন আর উর-জাবাবা প্রাণভয়ে পলায়ন করলেন; কিন্তু তার ‘ডান হাত’ সাৰ্গনকে দৃশ্যপটে দেখাই গেল না। 

যখন লুগালজাজ্ঞেসি সহজ জয়ের আনন্দে উদ্বেল হয়ে তখন সার্গন তার নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গঠন করছিলেন (যার কিয়দংশ উর-জাবাবার বাহিনী থেকে তিনি নিজ হাতে নির্বাচন করেছিলেন সতর্কতার সাথে, বহু বছর ধরে)। তিনি উরুকের দিকে সেই বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেন এবং খুব সহজেই শহরটি দখল করে নেন। আমরা এই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি, কারণ যুদ্ধের বর্ণনায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে প্রথম যখন হামলাকারী বাহিনীর অগ্রভাগে সার্জনকে দেখা গেল তখন যুদ্ধক্ষেত্রে লুগালজাজ্ঞেসি অনুপস্থিত ছিলেন এবং অতর্কিত হামলায় শহরের রক্ষীবাহিনী সহজেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। সার্গনের বিজয়গাথা প্রকাশক শিলালিপিতে লেখা ছিল : ‘তিনি উরুক শহরকে গুঁড়িয়ে দেন। তিনি সকল প্রাচীর ধ্বংস করেন এবং উরুকের বাহিনীকে পরাস্ত করে শহরের দখল নেন।’ 

এই আক্রমণের সংবাদ পেয়ে লুগালজাজ্ঞেসি কিশ ত্যাগ করে নিজ দেশ অভিমুখে যাত্রা করেন দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ততদিনে সার্গন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে লুগালজাজ্ঞেসির মুখোমুখি হয়ে তাকে পরাজিত করেন এবং তাকে বন্দি করে তার গলার চারপাশে একটি জোয়াল বেঁধে দেন এবং তাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে পবিত্র শহর নিপ্পুরে নিয়ে যান। সেখানে বন্দি ও পরাজিত রাজাকে দেবতা এনলিলের উদ্দেশ্যে নিবেদিত গেইটের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মাধ্যমে সার্গন দেবতা এনলিলের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তাকে বিজয়ী বানানোর জন্য। এনলিলই ছিলেন সেই দেবতা যিনি সার্জনকে সমগ্র ভূখণ্ডের অধিপতি হওয়ার আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। সমগ্র ব্যাপারটি ছিল এক ধরনের নির্মম রসিকতা। অবশেষে যেন উরুকাগিনার অভিশাপ দূরীভূত হলো। 

সাথে সাথেই সার্গন কিশের রাজা’ পদবি ধারণ করলেন। সেই একই শিলালিপিতে বর্ণিত আছে যে তিনি দক্ষিণের দিকে যাত্রা করে উর শহর দখল করেন, উম্মাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন এবং বাকি সকল সুমেরীয় শহরেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে একেবারে পারস্য উপসাগরের তীর পর্যন্ত সমগ্ৰ ভূখণ্ড নিজের দখলে নিয়ে নেন। সেখানে তিনি ‘সমুদ্রে অস্ত্রশস্ত্র ধুয়ে নেন’ যা তার জয়রথের এক রহস্যময় প্রতীক হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। 

সার্গনের তুলনামূলকভাবে দ্রুত এবং আক্রমণাত্মকভাবে সমগ্র মেসোপটেমীয় সমতলভূমি দখল করে নেওয়ার ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক, কেননা এর আগে কোনো সুমেরীয় রাজা দু-তিনটি শহরের চেয়ে বেশি এলাকা নিজ দখলে রাখতে পারেননি বেশিদিনের জন্য। তার নিজের ক্ষমতা এবং সুমেরীয়দের দুর্বলতার সমন্বয়ে তিনি এই অবিশ্বাস্য কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। তার সৈন্যবাহিনী সুমেরীয় রক্ষীবাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী ছিল, কারণ তারা তীর ও ধনুক ব্যবহার করতে জানত। 

কাঠের অভাবের কারণে সুমেরে তীর-ধনুক বেশ অপরিচিত এবং দুর্লভ অস্ত্র ছিল। সার্গনের কাছে ইউ কাঠের উৎস ছিল; ধারণা করা হয় যে যুদ্ধযাত্রার প্রারম্ভিককালে তিনি উপসাগরের পূর্বে অবস্থিত জার্গোস পর্বতমালার দখল নিয়ে নিয়েছিলেন। তার সৈন্যবিন্যাসও ভিন্ন ধরনের ছিল। শকুনের স্টেলে এবং স্ট্যান্ডার্ড অব উর নামক স্টেলে থেকে আমরা সশস্ত্র সেনাদের দেখি একসাথে গায়ে গায়ে লেগে থেকে পরবর্তীকালের গ্রিক ফ্যালাংক্স বিন্যাসের মতো করে এগোতে। কিন্তু সার্গনের সৈন্যদের দেখা যায় হালকা অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্রে খুব দ্রুততার সাথে এক জায়গায় আক্রমণ করে প্রতিপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে পুনরায় আবার একত্রিত হয়ে আরেক পার্শ্বে আক্রমণ চালাতে সক্ষম ছিল। 

এ ছাড়া সুমেরীয়রা তাদের অভ্যন্তরীণ ঝামেলার কারণে দুর্বল ছিল আগে থেকেই। সার্গনের অভিযানের পূর্বে প্রতিটি শহরেই ধনী ও গরিবের মাঝে পর্বতপ্রমাণ দূরত্ব সমাজের অস্থিরতা বাড়াচ্ছিল। উরুকাগিনা এসব অন্যায় ও অবিচার দূর করতে চেয়েছিলেন, যার জন্য দায়ী ছিল শহরের ধনী সম্প্রদায় ও পূজারি সমাজের জোট। তারা তাদের ধর্মীয় ও ধনসম্পত্তির প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সকল শহরের তিন-চতুর্থাংশ ভূমি নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছিল। সার্গন তার অনভিজাত পূর্বসূরি, উন্নত যুদ্ধকৌশল ও ব্যক্তিগত কারিশমাকে কাজে লাগিয়ে সুমেরীয় সমাজের গরিব ও নিষ্পেষিত নাগরিকদের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তারা তার পক্ষে চলে এসেছিল খুব সহজেই। 

ফলে সার্গন এমন এক কীর্তি দেখালেন যা এর আগে অন্য কোনো সুমেরীয় রাজা করে দেখাতে পারেননি—তিনি সাফল্যের সাথে অসংখ্য শহরের একটি দুর্বল জোটকে এক অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করলেন। 

দখল করার পর নতুন এই এলাকাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন দেখা দিলো। দূরে অবস্থিত শহরগুলোকে শাসন করার জন্য সার্জন এক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করলেন—তিনি ‘আগাদে’ নামক নতুন এক রাজধানী তৈরি করলেন। এই শহরের হিব্রু নাম ছিল আক্কাদ, যেখান থেকে তার সাম্রাজ্যের নামটি এসেছে। আগাদের ধ্বংসাবশেষ কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবে সম্ভবত তা দাঁড়িয়ে ছিল উত্তরের সুমেরীয় সমতলভূমিতে যেখানে বর্তমানের বাগদাদ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

কিশের সামান্য উত্তরে এই অবস্থানে বসে সার্জন সমগ্র নদীনালার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন এবং তার সাম্রাজ্যের উভয় প্রান্তের উপর চোখ রাখতে পারতেন। 

নতুন এই সাম্রাজ্যে সুমেরীয়রা নিজেদেরকে বহিরাগত হিসেবে আবিষ্কার করতে লাগল। সার্গনের লোকজন ছিল সেমাইট; তারা উত্তরের সমতলভূমি থেকে আগত। তাদের উচ্চারণভঙ্গি ছিল সেমাইটদের মতো এবং তা আক্কাদীয় নামে পরিচিত হয়। তাদের আচার আচরণ, রীতিনীতি এবং মুখের কথা দক্ষিণের সুমেরীয়দের মতো ছিল না। যখনই সার্গন একটি শহর দখল করতেন তখনই তা একটি আক্কাদীয় দুর্গে রূপান্তরিত হতো এবং তার পরিচালনায় নিয়োজিত হতেন আক্কাদীয় কর্মচারীরা এবং সেখানে থাকতেন আক্কাদীয় সৈন্যরা। 

সার্গন তার পূর্বসূরিদের মতো স্থানীয়দের ব্যাপারে অতটা নমনীয় ছিলেন না। যখন লুগালজাজ্ঞেসি কিশ শহরকে দখল করে সেখানে তার আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, তিনি সুমেরীয় রাজকর্মচারীদের অর্থাৎ ‘লুগালদের’ পরিবর্তন করেননি। যেহেতু তারা সুমেরের নাগরিক ছিল এবং আগের রাজার আনুগত্য ত্যাগ করতেও রাজি ছিল, তিনি তাদের পদমর্যাদা পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। তবে সার্গনের মাঝে এই ধরনের কোনো বদান্যতা দেখা যায়নি। তিনি যখন কোনো শহর দখল করেছিলেন, সাথে সাথে তিনি সেই শহরের সকল প্রশাসনিক কর্মচারীকে পরিবর্তন করে সেখানে নিজের লোক বসিয়েছিলেন। শিলালিপিতে উল্লেখ আছে : ‘সমুদ্রের উপরে এবং নিচে, সকল ধরনের নেতৃত্ব আক্কাদের সন্তানদের হাতে ছিল।’ দীর্ঘদিন ধরে সুমেরীয়দের সাথে মেলামেশা করার পর অবশেষে সেমাইট গোত্রীয় আক্কাদীয়দের হাতে সর্বময় ক্ষমতা এসেছিল। 

শুধু আগাদে শহরের দুর্গতেই প্রায় চুয়ান্ন হাজার সৈন্য মওজুদ ছিল যারা প্রতিদিন ‘রাজার সম্মুখে রুটি ভক্ষণ’ করত। আরও হাজার হাজার সৈন্য সমগ্র মেসোপটেমিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। 

মেসোপটেমীয় সমতলভূমির দখল নেওয়ার পর সার্জন তার সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করেন। তিনি তার সেনাদলকে একের পর এক অভিযানে পাঠাতে থাকেন। একটি ট্যাবলেটে বর্ণিত আছে, ‘সার্গন, কিশের রাজা, সর্বমোট চৌত্রিশটি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন।’ তিনি টাইগ্রিস নদী পেরিয়ে এলামাইটদের কাছ থেকে ভূমি দখল করে নিয়েছিলেন, যার ফলে তারা তাদের রাজধানী আওয়ান থেকে সরিয়ে কিছুটা দূরে অবস্থিত সুসা শহরে নিয়ে যায়। নতুন অবস্থানে এলামাইটদের রাজধানী নিরাপদ ও অটুট থাকে। এ ছাড়া তিনি যুদ্ধ করতে করতে উত্তরের মারি শহরে এসে পৌঁছান এবং তা দখল করে নেন। তারপর তিনি আরও দূরে কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিমে গিয়ে আরেকটি যাযাবর সেমাইট গোত্রের ভূমি দখল করে নেন, যারা এমোরাইট নামে পরিচিত ছিলেন। 

টাইগ্রিসের তীর ধরে অভিযান চালাতে চালাতে তার বাহিনী এক সময় উত্তরের আসুর শহরে পৌঁছে যায়, যে শহরকে কেন্দ্র করে দেবতা ইশতারের পূজা করা হতো। এই শহরটি সার্গনের জন্মের প্রায় তিনশ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এরপর তিনি আরও উত্তরে অগ্রসর হন এবং নিনেভেহ নামক ক্ষুদ্র শহরটিকেও নিজ দখলে নিয়ে নেন। নিনেভেহ ছিল উত্তরের সর্বশেষ সেনাঘাঁটি; সেখানে থেকে সার্গনের সন্তানরা সমগ্র উত্তরাঞ্চলের অভিযানগুলোর নেতৃত্ব দিতেন আর ওদিকে তিনি নিজে আগাদে শহরে থেকে দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন। 

সার্জন সম্ভবত এশিয়া মাইনরেও আক্রমণ চালিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রচিত একটি গল্প ‘সার্গন, যুদ্ধের রাজা’-তে বর্ণিত হয়েছে তার পুরুশখান্দা নামক শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রার কথা। সেই শহরের বাসিন্দারা তার কাছে বার্তা পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন, অত্যাচারী স্থানীয় রাজা নুর-দাজ্ঞালকে উৎখাত করার জন্য। খুঁজে পাওয়া পঙ্ক্তিগুলোতে নুর-দাজ্ঞাল তার শহরে সার্গনের সম্ভাব্য আগমনকে নিয়ে পরিহাসের সুরে বলেন- 

‘সে এতদূর আসবে না 
নদীর পাড় এবং উঁচু পানির স্রোত তাকে বাধা দেবে 
সুবিশাল পর্বতমালা তার উপর চেপে আসবে 
এবং তার পথ বন্ধ করে দেবে’ 

এই কথাগুলো তার মুখ থেকে বের হতে না হতেই সার্গন তার শহরে অনুপ্রবেশ করেন, মূল দ্বার ভেঙে। 

‘নুর-দাজ্ঞাল নির্বাক হলেন 
যখন সার্গন পুরো শহরকে ঘিরে ফেললেন 
এবং প্রবেশদ্বারকে দুই একর প্রশস্ত করে ফেল্লেন’ 

সার্গন সত্যি সত্যি পুরুশখান্দা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন কি না সেটা নিশ্চিত নয়, তবে এই গল্প অন্য একটি সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। সেই যুগে সার্জনকে একজন অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবেই বিবেচনা করা হতো এবং ধারণা করা হতো যে তিনি ভোজবাজির মতো পৃথিবীর যে-কোনো কোণে যে-কোনো মুহূর্তে উপস্থিত হতে পারেন। সার্গনের নিজ দাবি অনুযায়ী, তার সৈন্যবাহিনী একেবারে সুদূর পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল এবং তার দখলে ছিল মেলুহহা (ইন্দাস) থেকে আগত জাহাজসমূহ, মাগান রাজ্য (দক্ষিণ- পূর্ব আরব) ও দিলমুন (আরব উপসাগরের দক্ষিণ প্রান্ত)। 

এত বড়ো ভূখণ্ডকে নিজের দখলে রাখার জন্য প্রয়োজন একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী; সার্গনের নিয়মিত ‘রুটি খাওয়া বাহিনী’ই সম্ভবত মানব ইতিহাসের প্রথম পেশাদার যোদ্ধার দল। বিভিন্ন পেশার লোকদের নিজ শাসনে রাখার জন্য তার প্রয়োজন ছিল ধর্মীয় প্রভাব, যা তিনি সূক্ষ্মভাবে আদায় করে নিয়েছিলেন। তিনি মোটামুটি সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে উপঢৌকন প্রদান করেছিলেন এবং একজন আদর্শ সুমেরীয় রাজার মতো নিষ্ঠুরে বিবিধ মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং পরিশেষে নিজ কন্যাকে চন্দ্রদেবতা উর-এর প্রধান পূজারি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। 

সার্গনের রাজসভার নথি থেকে জানা যায় যে তার সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা খুবই উন্নত এবং সুমেরীয় পরিপ্রেক্ষিতে নজিরবিহীন ছিল। তিনি ওজন ও মাপজোখের একককে প্রমিতকরণের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন এবং তিনি মিশরীয়দের মতো সরকার নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন সরকারি ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে। 

এ ছাড়া রাজ্য পরিচালনাকে সহজতর করার জন্য তিনি আরও বিবিধ রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তার সভায় পুরানো শাসকদের পরিবার থেকে প্রতিনিধি রাখা হতো, যে রীতি এর পরে আরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত অন্যান্য রাজসভার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে পড়েছিল। প্রকারান্তরে এই প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করতেন যে তাদের অধীনে থাকা শহরগুলো বিদ্রোহ করবে না এবং তাদের ঐতিহ্যগত প্রভাবের কল্যাণে সার্গনের বাধ্য থাকবে। 

এই কৌশলের নেপথ্যে রয়েছে তার সুবিশাল রাজ্যকে দেখভাল করার জটিলতার প্রকৃত রূপ। এই সুদূর বিস্তৃত রাজত্বের কোনো না কোনো অংশে সর্বক্ষণই বিদ্রোহের ঝুঁকি থাকত। 

সুমেরীয় রাজাদের তালিকা অনুযায়ী সার্জন ছাপ্পান্নো বছর ধরে রাজত্ব করতে পারার সুযোগ পেয়েছিলেন। 

তার বয়স সত্তরোর্ধ হওয়ার পর এবং রাজত্বের শেষের দিকে একটি বড়ো ধরনের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। পুরানো ব্যাবিলনীয় শিলালিপির নথি অনুযায়ী জানা যায় যে প্রাচীন ও ক্ষমতাচ্যুত পরিবারের অগ্রজরা একত্রিত হয়ে কিশ শহরে ইনান্নার মন্দিরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিলেন। 

স্বভাবতই সার্গন দাবি করেন যে তিনি শক্ত হাতে সেই বিদ্রোহটি দমন করেছিলেন; কিন্তু পুরানো ব্যাবিলনীয় নথি অনুযায়ী, সেই বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানগুলোর মধ্যে অন্তত একটি যুদ্ধ সার্গনের পক্ষে যায়নি। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছিল যে সার্জনকে বৃদ্ধ বয়সে এসে একটি নালার মধ্যে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল—পদযাত্রারত বিদ্রোহীদের হাত থেকে পালানোর জন্য। তবে এই ব্যাবিলনীয় নথিগুলো অনেক পরে লিখিত এবং সেগুলো সার্গনবিরোধী কথা ও কাহিনি দিয়ে ভরা। 

তবে এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত বা সন্দেহের অবকাশ নেই যে সার্গনের মৃত্যুর প্রায় সাথে সাথেই তার পুত্র রিমুশ পাঁচ শহরের (উর, লাগাশ, উম্মা এবং আরও দুটি শহর) সমন্বয়ে গঠিত বিদ্রোহী জোটের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। রিমুশ দশ বছরেরও কম সময় ধরে রাজত্ব করতে পেরেছিলেন এবং তিনি সহসাই মৃত্যুমুখে পতিত হন। পরবর্তীকালে রচিত একটি শিলালিপিতে বর্ণিত আছে যে তার নিজের চাকররাই আততায়ীর ভূমিকা পালন করে তাকে মেরে ফেলেছিল। 

সার্গনের মৃত্যুর সময় একটি ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পরিবেশ পেরোতে হলেও তার বংশধররা প্রায় একশ বছর ধরে আগাদের সিংহাসনের দখল রাখতে সমর্থ হয়েছিল, যা যে কোনো সুমেরীয় রাজবংশের চেয়ে দীর্ঘ। এই আক্কাদীয় সাম্রাজ্যটি শুধু রাজাদের ব্যক্তিগত কারিশমা দিয়েই পরিচালিত হয়নি, এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অন্য কিছু। 

অনেকটাই মিশরের মতো, সার্গনের শাসনতন্ত্র এবং প্রশাসনিক দৃঢ়তাই পরিশেষে মেসোপটেমিয়াকে এমন এক ধরনের শক্ত ভিত্তি দিয়েছিল যার উপর এই সুবিশাল সাম্রাজ্যটি টিকে ছিল বছরের পর বছর এমনকি শক্তিমান পিতার কাছ থেকে দুর্বল সন্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকালেও কোনো সমস্যা আসেনি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *