অধ্যায় এগারো – মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়

অধ্যায় এগারো – মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রথম বিজয় 

মিশরে খ্রিষ্টাব্দ ২৬৮৬ সাল থেকে ২৫৬৬ সাল পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রাজবংশের ফারাওরা মৃতদের জন্য গৃহ নির্মাণ করতেন। 

মিশরে তৃতীয় রাজবংশের ফারাওরা মৃত্যুকে জয় করার জন্য গিলগামেশের অভিযানের আদলে নিজেদের মহাকাব্যিক অভিযান শুরু করেন। 

তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ একটি অভিযানের মাধ্যমে তৃতীয় রাজবংশের প্রারম্ভিক কালের ফারাও রাজা দোসার সিনাইয়ের তামা ও ফিরোজা পাথরের খনিগুলো দখল করে নেন। এই সময় মিশরীয় রাজতন্ত্র একটি সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করতে শুরু করে। মিশরকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন গভর্নরের হাতে, যিনি সরাসরি রাজকীয় পরিবারের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতেন। দোসারও তার নিজস্ব পদ্ধতিতে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তিনি মিশরের দক্ষিণ সীমান্তকে প্রথম জলপ্রপাত পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। আসওয়ানের একটি শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে তিনি দখল করা কিছু জায়গাকে সেখানকার স্থানীয় উপাস্য ‘নাম’-কে উৎসর্গ করেছিলেন, যিনি সাত বছরব্যাপী একটি দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটিয়েছিলেন বলে সেখানকার বাসিন্দারা বিশ্বাস করত। ‘সাত’-কে প্রাচীন যুগের ‘দীর্ঘ সময়’ বোঝানোর একক হিসেবে ধরা যায়। সাত মানেই সাত বছর নাও হতে পারে। 

কিন্তু যেটাই বিবেচিত হোক না কেন, এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত মতবাদকে সমর্থন করে, যেখানে বলা হয়েছিল যে নীল নদে বন্যার সংখ্যা ও পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে ফারাওদের স্বর্গীয় ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল নিরন্তর। 

দোসারের আমল আসতে আসতে ফারাওরা ‘পরিবর্তন নিরোধক’ হিসেবে কাজ করা শুরু করেছিলেন এবং তাদের এই ভূমিকাটিতে ধর্মীয় আচার পালন একটি বড়ো অংশ ছিল। একটি মিশরীয় দেওয়াললিপিতে দেখা যায় যে দোসার হেব-সেড জয়ন্তী উৎসবে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। সবার প্রত্যাশা ছিল যে তিনি অবশ্যই এই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করবেন। এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে রাজার শারীরিক সক্ষমতার সাথে দেশের উন্নতি ও মঙ্গলের সরাসরি সংযোগ আছে—এই কথাটি প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন। হেব-সেড দৌড়ে জয়লাভ করে দোসার দেশবাসীকে আশ্বস্ত করলেন। তার জয়ে ফারাওদের মিশরকে রক্ষা করা এবং পানির নিয়মিত ওঠানামাকে অব্যাহত রাখার ক্ষমতা অটুট থাকল। 

এই ধরনের পুনর্জীবিতকরণ উৎসবের মাধ্যমে আরও বোঝা যায় যে মিশরীয়রা নিশ্চিত ছিলেন যে নিয়মিতভাবে এই ধরনের উৎসবের আয়োজন না করলে ফারাওদের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফারাওদের সাথে তখনও এক ধরনের স্বর্গীয় ক্ষমতার তুলনা করা হতো। কিন্তু প্রথম দুই রাজবংশের সংগ্রামের ইতিহাস তাদের মানবসত্তাকে সবার সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছিল। যখন কোনো একটি চিন্তাধারা তার মূল–হৃদয় নিংড়ানো ভাব থেকে দূরে সরে আসে তখন তাকে বিভিন্ন রীতিনীতি ও আচারব্যবহারের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে হয়; তখন সেই মতবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি সহায়ক ব্যবস্থা তৈরি করতে হয় যা এর আগে প্রয়োজন ছিল না। এই বিশেষ ক্ষেত্রে ফারাওদের নেতৃত্বের কারিশমা কমে গিয়ে সেখানে শাসনতন্ত্র এবং উত্তরাধিকারের মূল্য বেড়ে গিয়েছিল। 

ক্রমশ ক্ষমতার সহজাত প্রদর্শনীগুলো উৎসব আয়োজনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। ফারাওদের মরণশীল সত্তাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এসব অনুষ্ঠানকে জাতিগত ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে দেখানো হয়। 

অবশেষে, দোসার যখন মারা গেলেন তখন তাকে প্রথাগতভাবে এবিদোসের কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হলো না। তিনি মারা যাওয়ার আগেই নিজের জন্য সমাধি তৈরি করে রেখেছিলেন মিশরের একেবারে উত্তর প্রান্তে, সাক্কারা নামক স্থানে। জায়গা পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি নির্মাণসামগ্রীও পরিবর্তন করেছিলেন। দ্বিতীয় রাজবংশের ব্যবহার করা কাদামাটির ইটের পরিবর্তে তার সমাধিটি তৈরি হয়েছিল পাথর দিয়ে এবং তা চিরস্থায়ী হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন। এটি ইহজগৎ থেকে পরজগতের উদ্দেশ্যে যাত্রাকে মসৃণ করার জন্য তৈরি করা হয়নি বরং এটি তৈরি করা হয়েছিল এমনভাবে যাতে মৃত্যুর পরেও ফারাও সেখানে আরাম আয়েশের সাথে জীবনযাপন করতে পারেন। 

দোসারের আত্মার শান্তির জন্য তার সমাধির চারপাশে পুরো একটি শহর বানানো হয়েছিল। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে হেব-সেড দৌড়ের জন্য একটি রেসকোর্স বানানো হয়েছিল, যাতে রাজা নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই পুনর্জীবনী দৌড়টি দৌড়ে যেতে পারেন। সমাধি কমপ্লেক্সের চারপাশে চিরাচরিত মিশরীয় দালানের আদলে বড়ো বড়ো প্রস্তর-নির্মিত ঘর তোলা হয়েছিল। এ ছাড়া পাথর দিয়ে প্রাচীর বানানো হয়েছিল এবং সেগুলোকে খোদাই করে নলখাগড়ার আচ্ছাদনের মতো আকার দেওয়া হয়েছিল। পাথরের কলামকে নলখাগড়ার বান্ডিলের মতো আকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং একটি কাঠের দরজাসমৃদ্ধ গেইটের প্রতিকৃতিও বানানো হয়েছিল সেখানে। নলখাগড়া ও কাঠ কখনও নষ্ট হবে না এবং একইভাবে ফারাওর আত্মাও টিকে থাকবে চিরদিন। 

সেরদাব নামের একটি ছোটো প্রকোষ্ঠে দোসারের একটি মূর্তি আছে যেটি দেখতে অবিকল তিনি জীবিত অবস্থায় যেরকম ছিলেন সেরকম। মূর্তিটির গায়ে একটি চুনাপাথরের আলখাল্লা পরানো ছিল এবং সেটি পূর্বদিকে ফেরানো ছিল। 

সেরদাবের দেওয়ালে ড্রিল করা দুটি ফুটো ছিল যার মাধ্যমে মূর্তিটি বাইরে তাকিয়ে উদীয়মান সূর্য দেখতে পেত। সেই ফুটো দুটির নিচে ছিল একটি বেদি, যেখানে পূজারিরা প্রসাদ হিসেবে খাদ্য প্রদান করতেন এবং দোসারের আত্মা সেসব খাদ্যের সুঘ্রাণ উপভোগ করতেন। 

মানচিত্র-৮ : পুরোনো রাজত্বের পিরামিড 
মানচিত্র-৮ : পুরোনো রাজত্বের পিরামিড 

ওসাইরিসের মৃত্যুপুরী থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে, কোনো বলিদানকৃত সঙ্গীসাথি না রেখেও, ফারাওর আত্মা উপস্থিত ছিল সেই দালানে। তিনি তার জন্য প্রসাদ হিসেবে উৎসর্গ করা খাবার খেতেন এবং পুনরুজ্জীবিত করতেন নিজেকে এবং মিশরকে—সেই হেব-সেড দৌড়ের মাধ্যমে। তার আরাম আয়েশের জন্য অন্য কারও জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। জীবিতরাই তার সকল প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারতেন তার নিজের হাতে তৈরি মৃত্যুর শহরে। 

মৃত্যুর শহরের একেবারে কেন্দ্রে, সেই সমাধির উপরে দাঁড়িয়ে ছিল প্রথম মিশরীয় পিরামিড, যা ইংরেজিতে স্টেপ পিরামিড নামে পরিচিত। সেখানে ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে পাথরের বড়ো বড়ো চাঁই দিয়ে তৈরি ছয়টি স্তর, যার উচ্চতা প্রায় দুইশ ফুট। সেটির নিচে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ চলে গিয়েছে রাজকীয় পরিবারের সমাধি পর্যন্ত, যা সবচেয়ে নিচের স্তর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছে। 

সম্ভবত দোসারের উজির ইমহোটেপ এই অভিনব নকশার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে সেই দালানের নির্মাণকাজও তিনি নিজেই পরিচালনা করেছিলেন। ইতিহাসবিদ মানেথো আমাদের জানান যে ইমহোটেপ ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি কাটা পাথরের তৈরি দালান নির্মাণ করিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি সরাসরি পাথরের এবড়োথেবড়ো টুকরো ব্যবহার না করে সেগুলোকে সুন্দর করে সমান আকারে কেটে নিয়ে তারপর নির্মাণকাজে ব্যবহার করেছিলেন। 

আমরা সঠিকভাবে জানি না কীসের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে ইমহোটেপ এই ধরনের অভিনব সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন যে স্টেপ পিরামিডের আকৃতিটি একটি প্রাচীন মিশরীয় আকৃতির পরিবর্ধিত রূপ মাত্র। এবিদোসের কবরগুলোর উপর ছাদ হিসেবে পাথরের প্রাচীরের তৈরি চতুষ্কোণ আচ্ছাদন অথবা দালান বসানো হতো, যেগুলো মাসতাবা নামে পরিচিত ছিল। 

অর্থাৎ স্টেপ পিরামিড হচ্ছে একটি বড়ো আকারের মাসতাবা, যেখানে পাঁচটি ছোটো ছোটো মাসতাবাকে স্তূপ করে রাখা হয়েছে—একটির উপর আরেকটি বসিয়ে। সম্ভবত ইমহোটেপ দোসারের কমপ্লেক্সের কেন্দ্রে একটি বড়ো মাসতাবা বানিয়েছিলেন প্রথমে এবং তারপর ধীরে ধীরে সেটির উপর আরও বেশ কিছু মাসতাবা বসানো হয়েছিল। 

তবে এভাবে মাসতাবার স্তূপ বানানোর ব্যাপারটি আবশ্যক ছিল না। খুব সম্ভব ইমহোটেপ স্টেপ পিরামিডের নকশাটি সুমেরীয়দের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন, যারা উপাসনার জন্য সিঁড়িযুক্ত মন্দির ‘জিগুরাট’ তৈরি করেছিলেন। ধরে নেওয়া যায় যে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যপথের বিস্তারের সাথে সাথে মিশরীয়রা এক সময় সুমেরে এসে পৌঁছেছিলেন এবং সেখানকার আকাশচুম্বী মন্দিরগুলো দেখে পুলকিত হয়েছিলেন। 

সুমেরীয় জিগুরাটের উপযোগিতার ব্যাপারটি পরিষ্কার ছিল না। সেগুলোকে হয়তো কাকতালীয়ভাবেই তৈরি করা হয়েছিল। সুমেরের সর্বাধিক পবিত্র ভূমিগুলোতে যেসব মন্দির পুরানো হয়ে যেত সেগুলো ভেঙে ফেলা হতো এবং একটি উৎসবের মাধ্যমে কাদা ও মাটি দিয়ে শক্ত করে তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হতো। প্রাচীন শহর এরিদুতেও একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হতো। 

তারপর সেই বন্ধ করে দেওয়া জায়গার উপর নতুন একটি মন্দির তৈরি করা হতো। এভাবে একাধিকবার মন্দির নির্মাণের পর ধাপে ধাপে উঁচু হওয়া পুনর্নির্মিত মন্দিরগুলো একটি স্বকীয়তা অর্জন করত। এই কাঠামোগুলো বেশ উপকারী ছিল, কেননা আকাশচুম্বী জিগুরাটের ছাদে সুমেরীয় পূজারিরা বিভিন্ন ধরনের অজ্ঞাত ধর্মীয় আচার পালন করতে পারতেন। জিগুরাটের ছাদগুলোকে দেবতাদের পাদানি হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং ধারণা করা হতো যে দেবতারা পৃথিবীতে আসলে সেখানে পা রেখে দাঁড়াতেন। 

আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে স্টেপ পিরামিডের ভেতরে অবস্থান নিয়ে দোসারের আত্মা কী অর্জন করতে চেয়েছিল; কিন্তু দৈবক্রমে এবং এই অভিনব নকশার কল্যাণে ইমহোটেপ বিশেষ সম্মানপ্রাপ্ত হন। 

দোসারের রাজত্বের সময়ে বানানো ইমহোটেপের একটি মূর্তির পায়ের কাছে তার খেতাবসমূহের একটি তালিকা পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন একইসাথে নিম্ন মিশরের রাজার কোষাধ্যক্ষ, উচ্চ মিশরের রাজার ‘প্রথম’, রাজপ্রাসাদের প্রশাসক এবং হেলিয়োপোলিসের অন্যতম প্রধান পূজারি, যারা সূর্যদেবতার ভৃত্য ছিলেন। 

মৃত্যুর পর তাকে মিশরের সর্বকালের সর্বসেরা পূজারি এবং বিজ্ঞতম ব্যক্তি হিসেবে সম্মানিত করা হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাকে দেবত্ব প্রদান করা হয়। তিনি হয়ে যান চিকিৎসাশাস্ত্রের দেবতা—যা ছিল মৃত্যুকে দূরে সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তৈরি আরেকটি পন্থা। 

মিশরের সকল অসাধারণ পিরামিডের মাঝে স্টেপ পিরামিডটিকেই প্রথম নির্মাণ করা হয়। এর মাধ্যমে মৃত্যুকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার একটি প্রয়াস আমরা দেখতে পাই; যেখানে বর্ণিত হয় শরীর ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরও আত্মার টিকে থাকার ব্যাপারটি। এই সময়টি ছিল শান্তিপূর্ণ ও অবিভক্ত মিশরের সূচনালগ্ন, যার প্রথম ধাপ ছিল একটি সুষ্ঠু প্রশাসনিক গঠন। 

দোসার মাত্র উনিশ বছর রাজত্ব করেছিল, যা এত বড়ো একটি দালান প্রকল্প শেষ করার জন্য যথেষ্ট সময় নয়। পিরামিডের জন্য উনিশ বছর ধরে তামার তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বহুদূর থেকে বড়ো বড়ো প্রস্তরখণ্ড টেনে টেনে আনতে হয়েছিল। হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুযায়ী, পিরামিডের পাথরগুলোকে মিশরের পূর্বে অবস্থিত পর্বতমালা এবং লাল সমুদ্রের পশ্চিমদিক থেকে আনতে হতো। পিরামিড নির্মাণের জন্য একটি সুসংহত কর্মীবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল এবং এর সদস্যরা সবাই ছিলেন শক্তিশালী ও কর্মঠ মানুষ, যাদেরকে কৃষিকাজ কিংবা সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাহার করে আনা হয়েছিল। 

পিরামিড নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল উন্নয়নশীলতা, শান্তি এবং কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ। ইমহোটেপের খেতাব ‘কোষাধ্যক্ষ’ কিংবা ‘আচার্য’ আমাদের জানায় যে কর ও খাজনা আদায়ের পুরো ব্যাপারটির দায়িত্ব তার উপরেই অর্পিত ছিল। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মিশরের ছিল একটি আনুষ্ঠানিক, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা। 

শুধু একটি শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব কর্মীদেরকে পাথরের খনিতে কাজ করতে পাঠানো এবং তাদের ভরণপোষণের ভার নেওয়ার। সেই সময় মিশর ছিল প্রগতিশীলতা ও সুশাসনের উদাহরণ; তারা একটি নতুন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল। এই কারণেই পিরামিডের নির্মাণের সাথে সাথে মিশরের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল, যার নাম ছিল ‘মিশরের পুরানো রাজত্ব’ 

পুরানো রাজত্বের প্রথম দুই রাজবংশের সময়পর্বে সর্বমোট নয়টি পিরামিড নির্মাণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, যার মাঝে কিছু সফল হয় এবং কিছু কম পরিমাণে সাফল্যের মুখ দেখে; তবে সবগুলোই ছিল মানুষ এবং তার নির্মাণকাজের দক্ষতার সুনিপুণ নিদর্শন 

দোসারের পরের রাজা সেখেমখেতও একই কীর্তির পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা চালান। সেখেমখেতের ব্যাপারে আমরা তেমন কিছু জানি না, তবে এটুকু জানা যায় যে তার মাঝে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল এবং তিনি চিরাচরিত নিজেকে অন্যের চেয়ে বড়ো করে দেখানোর অভিপ্রায়ে সাত ধাপের পিরামিড বানানোর চেষ্টা করেন যা ইমহোটেপের পিরামিডের চেয়ে এক ধাপ বেশি ছিল। কিন্তু সেখেমখেতের পিরামিডটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি রাজত্ব শুরু করার ছয় বছরের মাথায় মারা যান এবং তার নির্মাণাধীন পিরামিডটির মাত্র এক ধাপ তৈরি হতেই সেই কাজ থেমে যায়। 

তৃতীয় রাজবংশের চতুর্থ রাজার নাম ছিল ‘খাবা’। তিনিও একটি পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন। 

খাবা-র স্তরে স্তরে বিভক্ত পিরামিডটি সাক্কারাতে নির্মিত হয়নি বরং সেই জায়গা থেকে আরও কয়েক মাইল উত্তরে নিম্ন রাজত্বের কাছাকাছি তৈরি হয়েছিল। ততদিনে উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে বিভেদ কমে এসেছিল। এই পিরামিডটিরও সাতটি ধাপ থাকার কথা ছিল, যেটি দোসারের পিরামিডের চেয়ে উচ্চ স্থানে সেটিকে নিয়ে যেত। তবে খাবা-র অবস্থা হয়েছিল ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। যথারীতি এই পিরামিডটিরও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। 

তৃতীয় রাজবংশের সর্বশেষ প্রয়াস ‘মেইদুম পিরামিড’-এর কাজও অসমাপ্ত থেকে যায়। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল রাজা হুনির হাতে এবং এতে আটটি ধাপ থাকার কথা ছিল। 

তবে এর আগের দুটি পিরামিডের মতো মন্দ ভাগ্য বরণ করতে হয়নি এটিকে-পরবর্তী রাজবংশের প্রথম রাজা এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। আমাদের দৃষ্টিতে, চতুর্থ রাজবংশকে এর পূর্ববর্তী তৃতীয় রাজবংশ থেকে সহজেই আলাদা করা যায়, কেননা এই রাজবংশই প্রথমবারের মতো সুউচ্চ পিরামিড নির্মাণের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে। 

রাজা সেফরুর রাজত্ব শুরু হয়েছিল বিস্ময়করভাবে। প্রথমে তিনি মেইদুম পিরামিডের নির্মাণকাজ শেষ করেন এবং তার নকশায় কিছু অভিনবত্ত্বও যোগ করেন। মেইদুম পিরামিডের কবর প্রকোষ্ঠটি ছিল পিরামিডের ভেতরেই; ভূগর্ভ কিংবা পার্শ্ববর্তী কোনো জায়গায় নয়। এর আগের কোনো পিরামিডেই এরকম কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তিনি মেইদুম পিরামিডের সাথে সরাসরি যুক্ত একটি লম্বা রাস্তাও তৈরি করেন যার মাধ্যমে সেখান থেকে পূর্বদিকের একটি মন্দিরে যাওয়া যেত। এই মন্দিরটি উদীয়মান সূর্যের দিকে ফেরানো ছিল এবং সেখানে মৃতদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য প্রদান করা যেত। এই দুটি অভিনব ব্যাপার পরবর্তীকালে পিরামিডের জন্য সাধারণ মানদণ্ডে পরিণত হয়। 

সেফরু মেইদুম পিরামিডের উপর এক ধরনের ধাতব আস্তরণ প্রদান করার চেষ্টা করেন; যা ছিল খুবই আগ্রহোদ্দীপক একটি ঘটনা। প্রথম চারটি পিরামিডের প্রতিটিই ছিল ধাপে ধাপে তৈরি করা এবং সেগুলোতে ছিল জিগুরাটের মতো প্যাচানো সিঁড়ি। কিন্তু মেইদুম পিরামিডের চারপাশে ছড়ানো ধ্বংসস্তূপ দেখে বোঝা যায় যে নির্মাণকর্মীগণ সিঁড়িগুলোর উপর মসৃণ পাথুরে আস্তরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। 

এটা যদি ঠিকমতো কাজ করত তা হলে মেইদুন পিরামিডই হতো প্রথম মসৃণ খাঁজযুক্ত পিরামিড—যেরকমটা আমরা দেখে অভ্যস্ত। তবে দুঃখজনকভাবে সেফরুর স্থপতির (যাকে দেবত্ব প্রদান করা হয়নি) সেই ধরনের দক্ষতা ছিল না। 

অল্পদিনের মাঝেই পিরামিডটি ধসে পড়েছিল। মেইদুম পিরামিডের ধ্বংসস্তূপের মূল কাঠামোটি একটি অর্ধেক খাওয়া বিয়ের কেকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে আজও এবং তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ভগ্ন পাথরের স্তূপ। 

এই ব্যর্থ পিরামিডে কাউকে কখনোই সমাধিস্থ করা হয়নি এবং এর সাথে লম্বা রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত জানালাবিহীন মন্দিরটিও বিশেষ কোনো স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারেনি। কয়েক শতাব্দী পরে কিছু রসিক মিশরীয় সেই বিরক্তিকর ছোটো দালানের গায়ে বিদ্রুপ করে লিখে রেখে গিয়েছিলেন : ‘রাজা সেফরুর চমকপ্রদ মন্দির’। এই ঘটনাকে আমরা মানব ইতিহাসের প্রথম বিদ্রুপাত্মক গ্রাফিতি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। 

তবে সেফরু হাল ছেড়ে দেননি। চতুর্থ রাজবংশের প্রথম এই ফারাও রাজা সম্পর্কে আমাদের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। তবে সিনাইয়ের খনি এবং লেবাননের বাণিজ্যিক বন্দরগুলোর দিকে তিনি অভিযান চালিয়েছিলেন, যার প্রমাণস্বরূপ কিছু নথিপত্র রয়েছে। ওয়েস্টকার প্যাপিরাসে আরেকটি অদ্ভুত গল্প আছে যেখানে সেফরুর জীবনের একটি দিনের কথা বলা হয়েছে। সেদিন বিরক্ত সেফরুর আদেশে তার হারেমের সবচেয়ে সুন্দরী বিশজন নারী তার সাথে নৌকাভ্রমণে বের হন। তারা প্রাসাদের সাথে সংযুক্ত হ্রদে নৌকা বেয়ে তাকে ঘুরিয়ে আনেন; আর সেই সময় তাদের পরনে মাছের জালের মতো এক ধরনের পোশাক ব্যতীত কিছুই ছিল না। 

তবে আর কিছু না হলেও তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা প্রকৃতির। মেইদুম পিরামিড প্রকল্পটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে তিনি নতুন একটি পিরামিডের কাজ শুরু করেন। এবার তিনি নতুন একটি জায়গা খুঁজে বের করেন যার নাম ছিল দাহশুর। এটি সাক্কারা থেকে সামান্য দূরে, দক্ষিণদিকে অবস্থিত ছিল। 

শুরু থেকেই এই পিরামিডটিতে একটি ভিন্নতার ছোঁয়া ছিল। এই পিরামিডটির নকশাটি এমনভাবে বানানো হয়েছিল যাতে সেটি একপাশে ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে আসতে থাকে এবং তার সম্মুখে চুনাপাথরের মসৃণ আস্তরণ থাকে। এই আস্তরণের কারণে পিরামিডটি সূর্যের আলোতে জ্বলজ্বল করত। 

পিরামিডকে ঘিরে রয়েছে অনেক ধরনের জল্পনাকল্পনা। কিন্তু এর মাঝে সবচেয়ে শিহরণ জাগানিয়া অমীমাংসিত রহস্যটি ফেরুকে ঘিরে—কেন তিনি খাঁজ কাটা, ধাপে ধাপে বানানো পিরামিডের নকশা পরিবর্তন করে মসৃণ পাথরের খাড়া পিরামিড নির্মাণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন? মজার ব্যাপার হচ্ছে, একজন চৌকশ স্থপতি হওয়া সত্ত্বেও সেফরু কখনোই সেভাবে পরিচিতি পাননি ইতিহাসের পাতায়। 

চিত্র-৩ : বক্র পিরামিড 
চিত্র-৩ : বক্র পিরামিড 

এই নকশার পেছনে কি কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল? এটি কি পিরামিডের ব্যাপারে আমাদের নতুন কোনো চিন্তার খোরাক দেয়? এগুলো কি আসলে জমির সীমানা নির্ধারক চিহ্নবিশেষ—মৃত ব্যক্তিদের আত্মাকে ধারণ করার সমাধির পরিবর্তে? 

এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে দুঃখজনকভাবে সেফরুর নতুন মসৃণ পার্শ্বযুক্ত পিরামিডটি বক্র পিরামিড’ নামে পরিচিত হয়, কারণ তিনি তখনও পিরামিডটির কোনাগুলোকে সঠিকভাবে মাপতে পারেননি। পিরামিডটির পার্শ্বগুলো মসৃণ ও ঢালু হওয়ার কথা ছিল কিন্তু নির্মাণকাজের অর্ধেক শেষ হওয়ার পর সেফর এবং প্রকল্প প্রধান টের পান যে তাদের মাপজোকে ভুল আছে। একই মাপে কাজ আগাতে থাকলে পিরামিডটি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র ভিত্তির উপর বসানো বড়ো বড়ো পাথরের ভারে ভেঙে পড়ত। তারা তখন খুব দ্রুততার সাথে কোণের পরিমাপ পরিবর্তন করলেন; এবং তার ফলে পিরামিডটি হয়ে দাঁড়াল কুঁজযুক্ত পিঠের মতো, যার একটি পার্শ্ব ডানদিকে ঘোরানো ছিল। 

পিরামিডের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছিল কিন্তু সেটি কখনও ব্যবহৃত হয়নি। সেফরু তখনও সমর্থ হননি একটি মনের মতো সমাধিস্থান তৈরি করতে। তার রাজত্বের শেষের দিকে তিনি তৃতীয় পিরামিডটির কাজ শুরু করেন। 

উত্তরের পিরামিডটি বক্র পিরামিডের প্রায় মাইলখানেক দূরে নির্মিত হয়েছিল। এটি ছিল আরও প্রশস্ত ও বিস্তৃত কিন্তু এর আগে নির্মিত পিরামিডগুলোর তুলনায় খর্বাকৃতির। বক্র পিরামিডটি তার খাড়া পার্শ্বে ৫২ ডিগ্রি থেকে সংকুচিত হয়ে ৪৩ ডিগ্রিতে নেমে এসেছিল এবং উত্তরের পিরামিডটির পরিকল্পিত নকশাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে প্রতিটি পার্শ্ব ৪৩ ডিগ্রি কোণে হেলে পড়ে। তার সর্বশেষ প্রয়াসটি এতটাই সুপরিকল্পিত ছিল যে প্রায় চার হাজার বছর পরেও পিরামিডটির দেওয়ালে কিংবা ছাদে কোনো ফাটল ধরেনি, যা প্রায় দুই মিলিয়ন টন ওজনের পাথরের নিচে অবস্থিত। 

উত্তরের পিরামিডটিকে ‘লাল পিরামিড’ নামেও ডাকা হয়, কারণ সেটির উপরের দিকের চুনাপাথরের স্তর ক্ষয়ে গিয়ে নিচের লাল বেলেপাথরের স্তর উন্মোচিত হয়ে গেছিল এবং তাতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে একটি লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাত। এখানেই সম্ভবত ফেরু সমাধিস্থ হয়েছিলেন। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মাটি খুঁড়ে একটি মরদেহ পেয়েছিলেন এবং সেটিকে তারা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পাঠিয়েছিলেন পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য। তবে দুঃখজনকভাবে যাত্রাপথে লাশটি হারিয়ে যায় এবং সেটিকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

সেফরুর মৃতদেহ হারিয়ে গেলেও তার তিনটি নির্মাণ প্রকল্প থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে মিশরীয়রা তখনও বিশ্বাস করত যে ফারাওরা মৃত্যুর পরও উপস্থিত থাকতেন পৃথিবীতে; এবং তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ত। স্নেফরু দৃঢ়চিত্ত ছিলেন তার নিজের জন্য একটি শেষ বিশ্রামের জায়গা তৈরি করার জন্য, যেটি একইসাথে অন্য সকল ফারাওর অনুরূপ বিশ্রামের স্থানের চেয়ে উন্নত হবে। ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে মিশরীয়দের ধারণা ছিল যে তারা মৃত্যুকে কিছু পরিমাণে বশে আনতে পেরেছে। ফারাওদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মৃত্যুর পরও তারা তাদের প্রজাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাই তারা তখন অন্য চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন—তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হলো পূর্বসূরিদের কীর্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। 

সেফরু একটি পিরামিডের কাজ সমাপ্ত করতে পেরেছিলেন এবং আরও দুটিকে অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন। এ থেকে আমরা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে আগের চেয়ে মিশর তখন আরও বেশি ঐশ্বর্যশালী ও শান্তি পূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং সেখানে ফারাও রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। 

সেফরুর ছেলে খুফু উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন এবং তিনি তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। তিনি মিশরীয় রাজাদের জন্য ডালভাতে পরিণত হওয়া সামরিক অভিযানগুলোতে নেতৃত্ব দেন এবং সিনাই থেকে নিজের জন্য মূল্যবান পাথর নিয়ে আসেন। তিনি তার নিজের পিরামিড নির্মাণের পরিকল্পনাও করেছিলেন। 

হেরোডোটাসের মতে, খুফু প্রায় পঞ্চাশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তবে এর সাথে মিশর-বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করে বলেন, আসলে তার রাজত্বের দৈর্ঘ্য এর অর্ধেক সময়জুড়ে ছিল এবং ইতিহাসের বৃহত্তম নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার জন্য পঁচিশ বছর সময়টা খুব কম ছিল না। তার সুবিশাল পিরামিডটির সাথে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কমপ্লেক্স ছিল আর পুরো নকশাটি করা হয়েছিল সেফরুর নিখুঁত নকশার আদলে। পিরামিডের সাথে লম্বা রাস্তার মাধ্যমে পূর্বদিকে একটি মন্দির সংযুক্ত ছিল যেখানে ভক্তরা প্রসাদ নিবেদন করতে পারতেন। এ ছাড়া সেটি আরও ছোটো ছোটো তিনটি পিরামিডের সাথে যুক্ত ছিল যেগুলো সম্ভবত খুফুর রানিদের জন্য বানানো হয়েছিল। 

এই পিরামিডটি নির্মিত হয়েছিল নতুন একটি স্থানে-গিজার সমতলভূমিতে। এর উচ্চতা ছিল ৪৮১ ফুট এবং এটির ধারগুলো ৫১ থেকে ৫২ ডিগ্রি কোণে ঢালু করে বানানো হয়েছিল; যা ছিল সেফরুর সফল উত্তরের পিরামিডের চেয়ে বেশি ধারাল কিন্তু ব্যর্থতায় পর্যবসিত বক্র পিরামিডের মতো অতটা নয়। সেফরুর নির্মাতাদলের প্রধান তার পূর্বসূরিদের কাজের উদাহরণ থেকে উপকৃত হয়েছিলেন। বড়ো পিরামিডের ধারগুলো চমকপ্রদভাবে সম আকৃতির–প্রতিটি প্রায় ৭৫৫ ফুট লম্বা এবং কোনো দুটি ধারের মাঝে ৮ ইঞ্চির বেশি দূরত্ব নেই। উত্তরদিকে একটি খাদের মতো বানানো হয়েছিল যার মাধ্যমে রাজার শয়নকক্ষে প্রবেশ করা যেত। এই খাদসদৃশ জায়গা দিয়ে তাকালে নক্ষত্রমালা দৃশ্যমান হতো। 

যদিও আমরা খুফুর জীবনের ব্যাপারে খুব কমই জানি তবু তার রাজত্বের বিভিন্ন গল্প ইতিহাসের হাত ধরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। এরকমই একটি গল্পে বর্ণিত আছে যে পিরামিড নির্মাণে ব্যস্ত হাজার হাজার শ্রমিকের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার নিমিত্তে তিনি পৃথিবীর প্রথম বাঁধটি নির্মাণ করিয়েছিলেন, যার নাম ছিল সাদ আল কাফারা; এবং এটি কায়রো শহরের বিশ মাইল দক্ষিণে ছিল। এই বাঁধের মাধ্যমে তৈরি হ্রদটি ছিল প্রায় আশি ফুট গভীর এবং এটিই ছিল প্রথম মানব-নির্মিত প্রাকৃতিক পানির আধার। আরেকটি গল্পে বলা হয়েছে যে বড়ো পিরামিডটির নির্মাতা দেবতাদের উপর বীতশ্রদ্ধ ছিলেন এবং বহু বছর পার করেছেন তাদের প্রতি ভেংচি কেটে। তবে এক পর্যায়ে তিনি অনুতপ্ত হন এবং বেশ কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেন। 

হেরোডোটাস লিখেছেন, ‘বড়ো পিরামিডটি তৈরি করতে গিয়ে খুফু মিশরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান এবং তিনি সকল মিশরীয়কে তার জন্য কাজ করার আদেশ দেন।’ তিনি আরও বলেন, “তিনি ছিলেন খুবই খারাপ একজন মানুষ।’ হেরোডোটাসের বর্ণনায় ফারাওদের ক্রমে প্রচুর ভুলত্রুটি রয়েছে এবং এই বিষয়ে তার বক্তব্যকে কোনোভাবেই নির্ভুল হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। 

অনুতাপ থেকে লিখিত সেই ধর্মগ্রন্থগুলোরও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি; সম্ভবত সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই ছিল না কখনও। কিন্তু খুফুর অশুভ সত্তার গল্পটি বেশ আগ্রহোদ্দীপক এবং এটি একাধিক সূত্র থেকে বর্ণিত। তার সেই সমাধিক্ষেত্র বানানোর জন্য তিনি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ একটি কর্মীবাহিনী জড়ো করেছিলেন, কেননা সেই প্রস্তর-নির্মিত কাঠামোটিতে লেগেছিল পঁচিশ লাখ পাথরের টুকরো। প্রতিটি পাথরের ওজন ছিল গড়ে দুই থেকে আড়াই টনের মতো। কর্মীদের দাসত্ব বরণ করতে না হলেও এটুকু পরিষ্কার যে খুফুর হাতে ছিল অপরিসীম ক্ষমতা যার অপব্যবহার করেই তিনি এত বড়ো একটি কর্মীবাহিনীকে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন। পিরামিডগুলো ছিল সেই ক্ষমতার এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ। 

খুফুর নির্মমতার গল্পগুলো থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে তিনি তার নিজের প্রয়োজনে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পিছপা হতেন না; তাতে তার প্রজাদের কষ্ট বেড়ে গেলেও তিনি সেটিকে ধর্তব্যে নিতেন না। তার চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটি সবাই ভালোভাবে নেননি। তার উচ্চাভিলাষের কারণে তিনি ধর্মকর্মেও আগ্রহ হারান এবং সবাইকে নির্দেশ দেন মন্দিরগুলো বন্ধ করে দিতে এবং সেখানে অর্ঘ্য প্রদানের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। 

হেরোডোটাসের বর্ণনায় একটি কাহিনির কথা বলা আছে যেখানে খুফু তার কমতে থাকা তহবিল পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে নিজের মেয়েকে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করেন। তিনি কন্যাকে একটি ঘরে আটকে রেখে তার সাথে সময় কাটাতে আসা প্রত্যেকটি পুরুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন। তার মেয়ে পিতার কথার অবাধ্য হননি এবং প্রতিটি বহির্গামী পুরুষকে তিনি বলে দেন এক টুকরো করে পাথর রেখে যেতে, পিরামিডের নির্মাণস্থানে। এর ফলাফল হিসেবে মধ্যম রানির পিরামিডটি তৈরির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পাথরের যোগান হয়েছিল। এই পিরামিডটি বড়ো পিরামিডটির কাছেই অবস্থিত; এবং সম্ভবত এটি কোনো এক ধরনের বিশ্বরেকর্ডের পরিচায়ক হিসেবে দণ্ডায়মান। 

খুফুর আমল আসতে আসতে ইমহোটেপের বানানো নেক্রোপলিসের মূল উদ্দেশ্যটি হারিয়ে গিয়েছিল। বড়ো পিরামিডটি এবং তার পরবর্তীতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভগুলোই হচ্ছে এই ধরনের স্থাপত্যকলার প্রাচীনতম নিদর্শন। এই দালানগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বড়ো আকারের। প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্রুস ট্রিগারের ভাষায়, ‘এগুলো হচ্ছে শক্তিমত্তা প্রদর্শনীর আদিমতম এবং সহজবোধ্য নিদর্শন; এই দালানগুলোর রয়েছে শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটানোর এক অনন্য ক্ষমতা, যার উৎস মানুষের শ্রম; এবং তা কোনো জনহিতকর পন্থায় আদায় করা হয়নি।’ 

পিরামিডের উপযোগিতা যত কম ছিল, সেটি তত বেশি করে তাদের নির্মাতার ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে কাজ করত। আত্মার সুরক্ষার জন্য বানানো ঘরগুলো এক পর্যায়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। 

খুফুকে নিয়ে আমাদের হাতে যা তথ্য আছে তার পুরোটাই পিরামিডকে ঘিরে। তার যদি অন্য কোনো কৃতিত্ব থেকেও থাকে তার বিস্তারিত বর্ণনা হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে, চিরতরে। মানব ইতিহাসে সম্ভবত স্টোনহেঞ্জ ছাড়া আর কোনো স্থাপত্যের নিদর্শনকে ঘিরে এত ভিন্ন ধরনের মতবাদ প্রদান করা হয়নি। পিরামিডকে নিয়ে তৈরি মতগুলোর মাঝে ‘বাস্তবসম্মত কিন্তু প্রমাণ করা দুষ্কর’ থেকে শুরু করে একেবারে অলীক কল্পনাও রয়েছে। 

একটি মতবাদে বলা হয়েছে যে গিজার পিরামিডের নকশাটি অরিওন নক্ষত্রপুঞ্জের প্রতিলিপি (এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ অনেকগুলো তারাকেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি); পিরামিডটি পৃথিবীর ভৌগোলিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত (এটা শুধু ম্যাপ দেখার একটি বিশেষ কৌশল, মেরকাটোর প্রক্ষেপণ ব্যবহার করলেই এরকম মনে হয়; কিন্তু প্রাচীন মিশরীয়রা এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত ছিল—এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই); মিশরীয়রা কাদুসিউস কয়েল নামের এক ধরনের শক্তি উৎপাদনকারী কয়েল ব্যবহার করত যার মাধ্যমে তারা পুরো গ্রহের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাথরের ব্লকগুলোকে উড়িয়ে এনে জায়গামতো বসিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো যে এই শক্তির গ্রিডের মূল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা হিসেবে ‘আর্ক অব দ্য কভেনান্ট’-এর কথা বলা হয়েছে, যেটি সময়ক্রমের সাথে সাংঘর্ষিক। এটি বাইবেলের দ্বিতীয় বইতে বর্ণিত এক ধরনের সিন্দুক যার মাঝে কিছু অলৌকিক বস্তুকে রাখা হয়েছিল। 

অনেকে বলেন যে গিজার পিরামিডটি তৈরি করেছিল পানির নিচের শহর আটলান্টিসের বাসিন্দারা। তারা তাদের পৌরাণিক মহাদেশ থেকে পৌরাণিক নৌকায় চড়ে মিশরে এসে তেমন কোনো কারণ ছাড়াই পিরামিডটি বানিয়েছিলেন। তারপর আবার তারা সেটিকে পরিত্যাগ করে চলেও যান। কিছু তাত্ত্বিক দাবি করেন যে এই পিরামিডটি প্রকৃতপক্ষে ভূ-গোলার্ধের একটি প্রতিরূপ এবং যারা এটিকে নির্মাণ করেছিল তারা ‘পৃথিবীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাপজোক জানতেন; তারা পৃথিবীর ব্যাসার্ধ এবং বছরের দৈর্ঘ্য জানতেন- দশমিকের পরের বেশ কয়েক ঘর পর্যন্ত।’ 

তবে পিরামিডসংক্রান্ত এই ধরনের বিচিত্র মতবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ওস্তাদ ছিলেন এরিক ফন দানিকেন- একজন সুইস হোটেল ম্যানেজার। তিনি ১৯৬০ সালের দিকে চ্যারিওটস অব দ্য গডস নামের একটি বই প্রকাশ করেন। দানিকেন জোর দাবি করেন যে পিরামিডগুলো মিশরীয়দের দ্বারা নির্মিত হতেই পারে না, কেননা তাদের সেই ধরনের উপযুক্ত প্রযুক্তি ছিল না। তার মতে, যেহেতু পিরামিডগুলো হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছিল, নিশ্চয়ই সেগুলো ভিনগ্রহের প্রাণীরা তৈরি করে দিয়েছিল। 

এটি সত্য যে মিশরীয়রা অতটা গণিতমনস্ক ছিলেন না। তবে পিরামিডের ভিত্তির সরলরেখাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা তেমন কোনো জটিল কাজ ছিল না; এতে শুধুই নির্ভুল হিসাবের প্রয়োজন পড়ত—এটুকু বোঝার জন্য উচ্চতর গণিত শিক্ষার দরকার পড়ত না। একইভাবে, বড়ো বড়ো পাথরগুলো সরানোর কাজটি অনেক পরিশ্রমের ছিল কিন্তু এটি শুধুই ছিল একটি কারিগরি সমস্যা। 

হেরোডোটাস বলেন যে পাথরের টুকরোগুলোকে টেনে টেনে উপরে উঠানো হয়েছিল মাটির তৈরি র‍্যাম্পের মাধ্যমে। এই ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব কিছু নয়; পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে একশজন কর্মী আড়াই টন ওজনের পাথরকে সহজেই প্যাপিরাসের তৈরি দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে তুলতে পারে। কাজটা আরও সহজ হয়ে যায় যদি পাথরের তলায় ডলোমাইট নামক এক ধরনের খনিজের শক্ত বল ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। 

আটলান্টিসের অধিবাসী এবং ভিনগ্রহের প্রাণীদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে পিরামিড তৈরির ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল না—এই ব্যাপারটি দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। কারণ হঠাৎ করেই নিখুঁত পিরামিড নেমে আসেনি পৃথিবীর বুকে; খুফুর অসামান্য কীর্তির আগে রয়েছে অসংখ্য ব্যর্থ এবং অসমাপ্ত পিরামিডের ইতিহাস। বস্তুত পিরামিডের নির্মাণকাজ একটি সরলরৈখিক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছে; দোসারের ‘আত্মার শহর’ থেকে শুরু করে খুফুর পর্বতপ্রমাণ শেষ বিশ্রামের স্থল পর্যন্ত এসে তা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল। এই স্থাপনাগুলো ভিনগ্রহের প্রাণীদের আগমনের পরিচায়ক হিসেবে নয় বরং প্রাচীন মিশরীয়দের মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও জাগতিক ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করতে না পারার তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতীকস্বরূপ। 

গিলগামেশ পাহাড়ে গিয়েছিলেন অমরত্ব লাভের আশায় কিন্তু তিনি ফিরে আসতে পারেননি। তবে মিশরীয়দের জন্য ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। তারা সর্বদাই রাজার বিদেহী আত্মার জন্য বানানো ঘরকে দেখতে পেত চোখের সামনে এবং তাদের কাছে ফারাওর ক্ষমতা কখনোই কমে যেত না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *