অধ্যায় বাইশ – হাম্মুরাবির সাম্রাজ্য

অধ্যায় বাইশ – হাম্মুরাবির সাম্রাজ্য 

খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৮১ থেকে ১৭১২ সালের মাঝে আসসুরের রাজা এবং তার সকল মিত্র একে একে ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবির কাছে পরাস্ত হলেন। তারপর তিনি তার সাম্রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু আইন তৈরি করলেন। 

বহু বছর চুপচাপ অপেক্ষা করার পর সুযোগসন্ধানী হাম্মুরাবি উত্তরের রাজ্যগুলোতে ভাঙনের সুর দেখতে পেলেন। 

বার্ধক্যজনিত কারণে ১৭৮১ সালে শামসি আদাদ মৃত্যুবরণ করার পর আসসুরের শাসনভার তার ছেলে ইশমে দাগানের কাছে এলো। তিনি তার পিতার সহ-শাসক হিসেবে একাল্লাতুম ও তার উত্তরের অঞ্চলগুলোর দায়িত্বে ছিলেন। ইশমে দাগানের হাতে হঠাৎ সমগ্র সাম্রাজ্যের শাসনভার চলে এলো, যার মাঝে ছিল মারি শহরও। সেখানে ছোটো ভাই ইয়াসমাহ আদাদ তার সহকারী হিসেবে রাজত্ব করছিলেন। 

ইশমে দাগান ও ইয়াসমাহ আদাদ কখনোই ভালো বন্ধু ছিলেন না। বড়ো পুত্ৰ ছিলেন শামসি আদাদের গর্ব। কিন্তু ছোটো পুত্ৰ ইয়াসমাহ আদাদ মারির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পিতার রুদ্র রোষের শিকার হয়েছেন। তাকে লেখা বেশির ভাগ চিঠিতেই শামসি আদাদ দুই ভাইয়ের মধ্যে তুলনা করতেন এবং সব সময় তা ইয়াসমাহ আদাদের বিরুদ্ধে যেত। 

উদাহরণস্বরূপ, ‘তোমার ভাই পূর্বে একটা বড়ো যুদ্ধে জয়লাভ করেছে কিন্তু তুমি মারিতে মহিলাদের মাঝে বসে আছ। তুমি কি পুরুষের মতো আচরণ করতে পারো না? তোমার ভাই বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে; তোমারও সেই প্রচেষ্টা করা উচিত।’ 

ইয়াসমাহ আদাদ খুব কম সময়ই তার পিতাকে খুশি করতে পারতেন। তার চিঠিগুলোতে তিনি পুত্রের সব কাজের খুঁত ধরতেন। সেখানে থাকত গৃহস্থালির বিষয় নিয়ে বিষোদ্‌গার থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যাপার নিয়ে সমালোচনা। প্রত্যুত্তরে ইয়াসমাহ আদাদের চিঠিগুলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার মনের দ্বিধা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব। 

তিনি একবার পিতাকে লিখলেন, ‘আপনি আমাকে বলেছেন সিন-ইদ্দিনামকে আপনার কাছে পাঠাতে যাতে সে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। আমি আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করব। কিন্তু সেক্ষেত্রে তার জায়গায় কে এখানে প্রশাসনিক কাজগুলো করবেন? আমি আমার পিতাকে সম্মান করি এবং আমি খুশি মনেই তাকে আপনার কাছে পাঠাতে চাই কিন্তু এরপর যদি আপনি এখানে এসে এই ব্যাপারে আমাকে জবাবদিহি করতে শুরু করেন তা হলে আমি কী উত্তর দেবো? এসব কারণে আমি সকল বৃত্তান্ত আপনাকে জানালাম। এখন আপনি নির্ধারণ করেন কী করতে চান।’ 

মানচিত্র-১৫ : হাম্মুরাবির সাম্রাজ্য 
মানচিত্র-১৫ : হাম্মুরাবির সাম্রাজ্য 

ইতোমধ্যে ইশমে দাগান তার ছোটো ভাইয়ের কাঁটা ঘায়ে লবণের ছিটা দেওয়ার জন্য তার বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের ফিরিস্তি লিখে তাকে চিঠি পাঠাতেন। I কবিতার ভাষায় লেখা একটি চিঠি ছিল এরকম—

মাত্র আটদিনে আমি কিরহাদাত শহরের প্রভু হয়ে গেলাম এবং
তার চারপাশের শহরগুলোকেও দখল করে নিলাম।
জয়ধ্বনি করো! 
আমি হাতকার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলাম আর মাত্র একদিনে আমি
পুরো শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলাম এবং নিজেকে সেই
শহরের প্রভু বানিয়ে ফেললাম। 
জয়ধ্বনি করো! 
আমি সিজ-টাওয়ার আর ব্যাটারিং র‍্যাম ব্যবহার করলাম হুরারা
শহরের বিরুদ্ধে এবং সেটিকে সাতদিনে দখল করে নিলাম। 
জয়ধ্বনি করো! 

স্বভাবতই ইয়াসমাহ আদাদ তার ভাইকে ঘৃণা করতেন। 

শামসি আদাদ মৃত্যুবরণ করার পর ইশমে দাগান তার ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখলেন তাদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন করার উদ্দেশ্যে। তবে দুঃখজনকভাবে তার লেখার ভঙ্গিটিও তার পিতার মতোই বিরক্তিকর ছিল : ‘আমি আমার পিতার ঘরে—তার সিংহাসনে বসেছি। আমি খুবই ব্যস্ত থাকার কারণে আরও আগে তোমাকে সংবাদটি জানাতে পারিনি। তুমি ছাড়া আমার আর কোনো ভাই নেই। তুমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আমি যতদিন বেঁচে আছি তুমি নিশ্চিন্তে তোমার নিজ শহর শাসন করতে থাকবে। এসো আমরা একজন আরেকজনের দিকে ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিই। ওহ, অবশ্যই মনে করে আমাকে তোমার সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি পাঠাতে ভুলবে না।’ 

এটা বোঝা মুশকিল যে এই বন্ধুত্বের আহ্বানটি কতটুকু খাঁটি ছিল। দ্বিধান্বিত ইয়াসমাহ আদাদের দরজায় যুদ্ধের দামামা বাজছিল। মারির নির্বাসিত রাজা জিমরি লিম তার শ্বশুরের সহায়তায় আবার নিজের শহর দখল করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। জিমরি লিম তার শ্বশুর আলেপ্পোর রাজার কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সৈন্যসামন্ত পেলেন এবং শামসি আদাদের মৃত্যুর ঠিক ছয় বছর পর ইয়াসমাহ আদাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করলেন। 

আসসুর থেকে কোনো সাহায্যকারী সৈন্যদল এসে পৌঁছাল না। ইয়াসমাহ আদাদ তার যৎসামান্য বাহিনী নিয়ে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই বীরের মতো মৃত্যুবরণ করলেন। 

জিমরি লিম আবারও মারির রাজা হয়ে গেলেন। জিমরি লিম দেখলেন যে তার রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে তিনটি সুবিশাল এবং লোভী সাম্রাজ্য। ইশমে দাগানের আসসুর, হাম্মুরাবির ব্যাবিলন এবং রিম-সিনের দক্ষিণাঞ্চল। জিমরি লিম বুঝতে পারলেন যে এদের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজত্বটির সাথে তাকে মৈত্রী চুক্তি করতে হবে; তা না করলে এই অঞ্চলে টিকে থাকা দুষ্কর হবে। 

কিন্তু কোন সাম্রাজ্যটি সবচেয়ে শক্তিমান—এই প্রশ্নের কোনো সহজসরল উত্তর ছিল না। জিমরি লিমের নিজের লেখা একটি চিঠিতে বিষয়টি বোঝা যায় : ‘এমন কোনো রাজা নেই যে নিজের শক্তিতে সর্বশক্তিমান। ব্যাবিলনের হাম্মুরাবিকে ১০-১৫ জন রাজা অনুসরণ করেন এবং লাসার রিম-সিন আর এশনুন্নার রাজাকেও সমপরিমাণ রাজারা অনুসরণ করেন।’ 

তবে পুরো অঞ্চলটিকে ভালো করে জরিপ করে তিনি এই ধারণায় উপনীত হলেন যে হাম্মুরাবির উপর ভরসা রাখাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। 

হাম্মুরাবি জিমরি লিমের মিত্র হতে রাজি হলেন। নিঃসন্দেহে তার বিরুদ্ধে একজোট হতে থাকা শত্রুবাহিনীর ব্যাপারে তিনি অবগত ছিলেন। ইশমে দাগান সমর্থ হয়েছিলেন এশনুন্নার রাজার সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করতে। অপরদিকে এলাম রাজ্যের সাথেও তিনি মিত্রতা তৈরি করেছিলেন। তিন রাজ্যের এই যৌথবাহিনীটি বেশ শক্তিশালী ছিল। উর শহরের পতনের পর থেকে এলাম একটি ঐক্যবদ্ধ রাজ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। দক্ষিণের অঞ্চলগুলো মাঝে মাঝে বিভিন্ন মেসোপটেমীয় রাজার দখলে চলে গেলেও উত্তরের ভূখণ্ডটি সব সময়ই এলামাইটদের দখলে ছিল। তখন উত্তর ও দক্ষিণ সমগ্র অঞ্চলের দখল নিয়েছে এপার্টি নামের নতুন রাজবংশ, যারা ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে খুবই আগ্রহী ছিল। 

মেসোপটেমিয়ার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে বসে রিম-সিন আসসুর, এশনুন্না ও এলামের ত্রিমুখী হাম্মুরাবিবিরোধী বাহিনীর সাথে হাত মেলাতে রাজি হলেন না। তিনি ভেবেছিলেন যে হাম্মুরাবিকে হারানো সম্ভব নয়। তবে এটাও হতে পারে যে বার্ধক্যজনিত ক্লান্তির কারণে তিনি এত দূরে, উত্তরে গিয়ে, কোনো যুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী হননি। তিনি প্রায় ষাট বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন—অন্য যে-কোনো মেসোপটেমীয় রাজার চেয়ে বেশি সময় ধরে। 

ইশমে দাগান, এশনুন্না ও এলামের রাজা, তাকে ছাড়াই এগিয়ে গেলেন। জিমরি লিম মারির ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রায় নয় বছর পরে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৬৪ সালে যৌথবাহিনী হাম্মুরাবির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করল। 

হাম্মুরাবির নেতৃত্বাধীন ব্যাবিলনীয় সৈন্যবাহিনী এবং মিত্র জিমরি লিমের সম্পূরক বাহিনী এই যৌথবাহিনীর সাথে মোটামুটি চোখ বন্ধ রেখেই জয়লাভ করলেন। হাম্মুরাবি ছেলেখেলার মতো এশনুন্নাকে দখল করে নিলেন। তবে তিনি আরও পূর্বদিকে—এলামাইটদের পার্বত্য এলাকার দিকে অভিযান না চালালেও—সুসা শহরকে ঠিকই দখল করে নিলেন এবং সেখানে নির্বিচারে লুটপাট চালালেন। তিনি এলামাইট দেবীদের মূর্তিগুলো ধ্বংস না করে নিজ শহরে নিয়ে এলেন। সাথে নিয়ে এলেন দেবীমূর্তির পূজায় নিয়োজিত পূজারিণীদেরও। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি সেই মূর্তিগুলো ব্যাবিলনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। 

এটি ছিল শত্রুদের স্ত্রীদেরকে জোরপূর্বক উঠিয়ে এনে তাদের উপর অত্যাচার করার একটি প্রতীকী রূপ। 

পরের বছরই তিনি রিম-সিনের বিরুদ্ধে চলে গেলেন—নিরপেক্ষ থেকেও তার কোনো লাভ হলো না। এই নিরপেক্ষতাকেই হাম্মুরাবি অপ্রয়োজনীয় ধরে নিয়ে তাকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলেন। কেন রিম-সিন উত্তরের হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাকে সহায়তা করলেন না—এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেননি রিম-সিন। শাস্তি হিসেবে একটি নদীর প্রবাহকে বদলে দিয়ে হাম্মুরাবি রিম-সিনের রাজত্বের একটি জনবসতিপূর্ণ এলাকাকে পানির নিচে ডুবিয়ে দিলেন। রিম-সিন যুদ্ধের দিকে না গিয়ে হাম্মুরাবিকে নজরানা দিয়ে প্রাণে বাঁচলেন এবং বন্যাদুর্গত জনগোষ্ঠীকে অন্যত্র সরিয়ে নিলেন। 

হাম্মুরাবি এরপর নিজের মিত্রের বিরুদ্ধে চলে গেলেন। 

খুব সম্ভব জিমরি লিম ছিলেন একজন শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তার ছিল প্রবল ব্যক্তিত্ব। এই ব্যাপারগুলো হাম্মুরাবিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। তিনি তার সাবেক অংশীদারকে সরাসরি আক্রমণ করলেন না; তার পরিবর্তে তিনি দাবি করলেন যে জিমরি লিম অন্যান্য দেশের সাথে যে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান করবেন তা পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করার নিঃশর্ত অধিকার তার থাকবে। এই ধরনের আধিপত্য—অন্য একটি দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি—আমরা পরবর্তী শতাব্দীতে আরও বড়ো কলেবরে ঘটতে দেখব। এই ব্যাপারগুলো বস্তুত স্বাধীনতা হরণের মতোই; এবং জিমরি লিম ব্যাপারটি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। 

সংকল্পবদ্ধ জিমরি লিম এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। হাম্মুরাবি আক্রমণের হুমকি দিলেন কিন্তু জিমরি লিম তাকে পাত্তা দিলেন না। রাগান্বিত হাম্মুরাবি তার বাহিনী নিয়ে মারি অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং শহরের প্রাচীরের বাইরে থাকা লোকজনকে বন্দি করে এনে হত্যা করতে শুরু করলেন। তবুও প্রাচীরের দরজাগুলো বন্ধই থেকে গেল। তখন হাম্মুরাবি প্রাচীর ভেঙে শহরে প্রবেশ করলেন এবং শহরের জনগোষ্ঠীকে ধরে এনে দাসদাসী বানালেন। তারপর তিনি পুরো শহরে আগুন ধরিয়ে দিলেন। 

ইতিহাসের পাতায় জিমরি লিম, তার রানি শিপটু অথবা তার ছেলেমেয়েদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তার কোনো বিবরণ স্থান পায়নি। মারি কিংবা ব্যাবিলনের গল্পে তাদের ব্যাপারে আর কোনো উল্লেখ নেই। 

ঠিক এক বছর পর হাম্মুরাবি লারসা অভিমুখে যাত্রা করলেন। আমরা ধরে নিতে পারি যে রিম-সিন আগের বার নজরানা দিয়ে যুদ্ধের হাত থেকে বেঁচে গেলেও এযাত্রা তিনি আর বসে থাকেননি, প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ছয় মাসের অবিরাম আক্রমণ পালটা আক্রমণের পর লারসার পতন হলো। 

এবার হাম্মুরাবি রিম-সিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাকে বন্দি করে রাখলেন এবং এর সাথে তার ষাট বছরের শাসনের অবসান হলো। সেই মুহূর্তে সকল প্রাচীন সুমেরীয় শহর এবং একইসাথে পশ্চিম ও উত্তরের বেশ কিছু অঞ্চল একটি ব্যাবিলনকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে গেল। হাম্মুরাবির সভালেখকরা লিখেছেন : ‘সকল মানুষ আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কুর্নিশ করুক। তারা আপনার বিজয়গাথাকে উদযাপন করুক এবং আপনার অসামান্য আধিপত্যকে নিঃশর্তে মেনে নিক।’ 

এটি কোনো এলোমেলো সাম্রাজ্য ছিল না, এখানে ছিল আইনের শাসন। হাম্মুরাবি তার দখলে থাকা সব জায়গায় একই আইনকানুনের প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তার সেই লিপিবদ্ধ ‘কোড’ বা রাজ্য শাসনের জন্য নির্ধারিত নির্দেশিকার একমাত্র প্রতিলিপিটি আরও কয়েক শতাব্দী পরে সুসা শহরে খুঁজে পাওয়া যায়—তা একটি কালো রঙের স্টেলের গায়ে খোদাই করা ছিল। নিশ্চিতভাবেই এই আইনগুলোর উদ্দেশ্য ছিল একটি সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থার প্রচলন করা। স্টেলের উপরে দেখা যায় ন্যায়বিচারের দেবতা হাম্মুরাবিকে তার প্রতিনিধি হিসেবে আশীর্বাদ দিচ্ছেন। 

সেই স্টেলের বক্তব্য অনুযায়ী, হাম্মুরাবির আইনগুলো নিপ্পুর, এরিদু, উর, লারসা, ইসিন, কিশ, মারি এবং অন্যান্য শহরে নিষ্ঠার সাথে পালিত হতো। 

হাম্মুরাবি প্রথম আইন প্রণেতা ছিলেন না, তার আগেই উর-নাম্মু এই কাজটি করে গিয়েছেন। কিন্তু তার আইনগুলো প্রাচীন যুগে সুন্দরভাবে জীবনযাপনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল এবং এর ছিল অসাধারণ ব্যাপ্তি ও গভীরতা। 

ডাকাতি, একজন দাসকে পলায়নে সহায়তা করা, কাউকে অপহরণ করা, এমন একটি বাড়ি নির্মাণ করা যা কারও মাথার উপর ভেঙে পড়েছে এবং রাজার প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ফলাফল না দেখাতে পারা—এসব অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। 

এই ধরনের দণ্ডবিধি ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজনীয় আইনের মাঝে ছিল বিয়ে করার জন্য চুক্তিনামার প্রয়োজনীয়তা এবং বিবাহবিচ্ছেদের জন্য বিচারকের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা; যা উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে স্বামী বা স্ত্রী উভয়েই নিতে পারতেন। 

একজন মানুষ আরেকজনের চোখ উপড়ে নিলে আইন অনুযায়ী অপরাধীরও একটি চোখ উপড়ে নেওয়া হতো। তবে সেটি যদি কোনো দাস বা দাসীর চোখ হয়ে থাকে তা হলে সেই ব্যক্তি মাত্র একটি রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যেতেন। বিধবারা তাদের স্বামীর রেখে যাওয়া জমির মালিক হতে পারতেন কিন্তু সেগুলো বিক্রি করার অনুমতি তাদের ছিল না। সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাদের ছেলে-সন্তানদের কাছে থাকত। 

আরেকটি মজার আইনে বলা হয়েছিল যে কোনো ব্যক্তি যদি তার প্রতিবেশীর বাসার আগুন নেভাতে গিয়ে সেখান থেকে কিছু চুরি করেন তা হলে সেই চোরকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। 

হাম্মুরাবির এসকল আইনকানুন ও নীতিমালা তার রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তা ব্যাবিলন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। যে-কোনো দখলকৃত ভূমিতে এই আইনকানুনের প্রচলন ঘটিয়ে ব্যাবিলনকে একটি ন্যায়বিচারসমৃদ্ধ উন্নত সাম্রাজ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। তবে প্রকৃতপক্ষে এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল প্রজাদের উপর নিরবচ্ছিন্ন আধিপত্য বিস্তার করা। 

সমগ্র রাজত্বের সাথে হাম্মুরাবির সম্পর্কটি ছিল ঘোড়া ও তার রাশের মতো। রাজ্য যদি একটি ঘোড়া হয়ে থাকে তা হলে ঘোড়সওয়ার হাম্মুরাবি একটি বজ্রকঠিন রাশের মাধ্যমে সেই রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিস্তৃত যুদ্ধযাত্রার কল্যাণে সাম্রাজ্যের উত্তর প্রান্ত থেকে একেবারে দক্ষিণ পর্যন্ত সকল নদীপথ তার দখলে ছিল। সিডার গাছ, লাপিস লাজুলি, মূল্যবান পাথর, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি পণ্য তার নিয়ন্ত্রণে থাকা চৌকির মাধ্যমে প্রবাহিত হতো। শুধু সেসব জাহাজকেই যেতে দেওয়া হতো যাদের ছিল রাজকীয় অনুমতি। এই ব্যবস্থার কল্যাণে শুধু এটাই নিশ্চিত হতো না যে সকল বণিক সঠিক পরিমাণে খাজনা আর কর দিচ্ছেন, সাথে দক্ষিণের গোলযোগপূর্ণ এলাকাগুলোতে কী কী পণ্য যাচ্ছে তার উপর কড়া নজরও রাখা যেত। হাম্মুরাবির সাম্রাজ্যের কোনো শহর চাইলেও গোপনে অস্ত্রসজ্জিত হতে পারত না। 

হাম্মুরাবি নিজেকে তার দেশবাসীর পালনকর্তা হিসেবে অভিহিত করতে ভালোবাসতেন। তিনি নিজেকে ভাবতেন মেষপালক আর প্রজাদের মেষের মতো স্নেহ করতেন। 

তবে মেষপালক হিসেবে তিনি তার মেষদের ভালোমন্দের ব্যাপারে না বরং দুশ্চিন্তা করতেন এটি ভেবে যে তার পালিত মেষগুলোর মুখে নেকড়ের মতো দাঁত গজাতে পারে এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে পারে বা একতাবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। বাইরে থেকে নেকড়ে এসে মেষদের আক্রমণ করতে পারে—এই ব্যাপারটি নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্রও চিন্তিত ছিলেন না। 

তিনি একটা ব্যাপারে খুব ভালো করে জানতেন যে যতদিন পর্যন্ত তিনি তার সুবিশাল সাম্রাজ্যটিকে অবিকৃত অবস্থায় রাখতে পারবেন ততদিন তিনি একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক হিসেবে নিজেকে চিত্রায়িত করতে পারবেন। পরপর কয়েকটি যুদ্ধে পরাজয়ের স্বাদ পাওয়ার পর তিনি জোরপূর্বক উঠিয়ে আনা এলামাইট দেবীদের মূর্তিগুলোকে নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন। এই ব্যাপারে তিনি তার এক সেনাপতির সাথে চিঠির মাধ্যমে শলাপরামর্শ করেন। তিনি ভেবেছিলেন মূর্তিগুলোকে তাদের নিজ ভূমিতে পুনঃস্থাপিত করলে তিনি দেবীদের আশীর্বাদ পাবেন। তবে তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে এই কাজটি কীভাবে সম্পাদন করবেন। তিনি মূর্তি- কাঁধে যুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না, আবার বিনা বাক্য ব্যয়ে এলামাইটদের কাছে মূর্তি ফিরিয়ে দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না; কারণ সেক্ষেত্রে তারা এটিকে তার দুর্বলতার প্রকাশ হিসেবে ধরে নেবে। 

উত্তর ও পূর্বে হাম্মুরাবির শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি শোষণ ও নিপীড়নের উপর নির্ভরশীল ছিল। এশনুন্না দখল করে নেওয়ার দশ বছরেরও কম সময় পরে তিনি আবারও শহরটিতে আক্রমণ চালান। এবারের যুদ্ধটি দুই বছর ধরে চলে এবং এবার ব্যাবিলনের সৈন্যরা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে শহরটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। তিনি পূর্বের সীমান্তে, নিনেভেহের কাছে, কিছু বিদ্রোহীকে দমন করার জন্য যুদ্ধ করেন। তিনি তার কষ্টার্জিত সাম্রাজ্যকে অবিকৃত রাখার জন্য প্রায় পুরো শাসনামলজুড়েই যুদ্ধবিগ্রহে ব্যস্ত থেকেছেন। ১৭৪০ সালের শেষের দিকে তিনি নিজেকে আহত, অসুস্থ ও বৃদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করেন। বছরের পর বছর কষ্টকর যাত্রা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল, যার কোনোটিই পুরোপুরি সারেনি। 

এশনুন্না ধ্বংস হওয়ার ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় হাম্মুরাবির মৃত্যু হয়। তিনি তার পুত্র সামসুইলুনার জন্য একটি বড়ো ধরনের ঝামেলা রেখে পরলোকগমন করেন। 

বেশ কয়েক বছর ধরে কাসাইট নামের কিছু ছোটো ছোটো যাযাবর দল জাগ্রোস পর্বতমালার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। ঘুরতে ঘুরতে তারা টাইগ্রিস নদী পেরিয়ে মেসোপটেমিয়ার একেবারে মধ্যাঞ্চলে চলে এসেছিল। ব্যাবিলনীয় নথিপত্রে তাদেরকে কখনও কখনও যাযাবর কর্মী কিংবা সহজলভ্য অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বিভিন্ন কাজের জন্য তাদেরকে সহজে এবং কম খরচে ভাড়া করা যেত। 

সামসুইলুনার রাজত্বের নবম বছরটি ‘কাসাইট সৈন্যবাহিনীর আগমনের বছর’ হিসেবে পরিচিত। যাযাবর শ্রমিকরা নিজেদেরকে অস্ত্রসজ্জিত করেছিল এবং তারা উত্তর-পূর্ব সীমানায় আক্রমণ চালাচ্ছিল। এতদিন পর্যন্ত এশনুন্না এই যাযাবর বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু শহরটি ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে যাযাবররা খুব সহজেই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যায়; এবং তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। 

একই সময়ে সামসুইলুনা ব্যস্ত ছিলেন পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে বিদ্রোহ দমনের কাজে। এই কাজটি তার পিতা সারা জীবন নিষ্ঠার সাথে পালন করে গিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে উরুক, ইসিন, লারসা ও উর বিদ্রোহ ঘোষণা করে; এবং তিনি বাধ্য হন ব্যাবিলনীয় সেনাবাহিনীকে সেসব শহরে পাঠিয়ে বিদ্রোহের আগুনকে স্তিমিত করতে। ফলস্বরূপ উর এত ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল যে এর পরের কয়েকশ বছর সেখানে আর কোনো জনবসতি গড়ে উঠেনি। কিছুদিন পর নিপ্পুরের ভাগ্যেও একই পরিণতি দেখা দেয়। 

একইসাথে একাধিক অঞ্চলে যুদ্ধ করতে করতে সামসুইলুনা হঠাৎ পূর্ব প্রান্তে এক নতুন হুমকির মুখোমুখি হন। এলামাইটরা তখন যুদ্ধংদেহি নতুন এক রাজা পেয়েছে। রাজা কুটির নাহহুনতে ১ কাসাইট আক্রমণের ঠিক দশ বছর পরে তার বাহিনী নিয়ে টাইগ্রিস নদী পেরোলেন। এলামাইটদের অঞ্চলে থাকা অল্প কিছু ব্যাবিলনীয় সৈন্যবাহিনী খুব সহজেই পরাজিত হলো এবং জীবিত সৈন্যরা পিছু হটে ব্যাবিলনের পথে পালিয়ে গেল। ব্যাবিলনীয় সৈন্যবাহিনীর এই পরাজয়টি এতটাই একতরফা ছিল যে প্রায় এক হাজার বছর পরেও ব্যাবিলনের শত্রু এসিরিয়া তাদেরকে এই ব্যাপারটি নিয়ে বিদ্রুপ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেনি। 

সামসুইলুনা তার পিতার মতো করে তার সমগ্র সাম্রাজ্যকে অবিকৃত রাখতে পারেননি। ১৭১২ সালে তার রাজত্বের অবসান হয়। ততদিনে তিনি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের দখল হারিয়ে ফেলেছেন। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে জানা যায় যে লড়াই পরিচালনা করার মতো কোনো বীর সেনাপতি তার কাছে ছিল না। 

হাম্মুরাবির রেখে যাওয়া আইন তার সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *