অধ্যায় বিশ – মেসোপটেমীয় ব্লেন্ডার

অধ্যায় বিশ – মেসোপটেমীয় ব্লেন্ডার 

খ্রিষ্টপূর্ব ২০০৪ থেকে ১৭৫০ সালের মাঝে লারসা ও আসসুরের রাজারা যথাক্রমে দক্ষিণ ও উত্তরে তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্য গঠন করে ফেলেছিলেন এবং ব্যাবিলনের হাম্মুরাবি সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে বসে ছিলেন। একদিকে মিশর তার হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে মেসোপটেমীয় সমতলভূমিতে চলছে এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। 

এলামাইটরা উর শহরে লুটপাট চালালেন, ইব্বি-সিনকে বিতাড়ন করলেন এবং সুসা শহর দখল করে নিলেন। তারা শহরের প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত প্রাচীরগুলোকে আরও মজবুত করে এটিকে তাদের ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নির্বাচন করলেন। তবে তারা বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি ইশবি এররার কথা ভুলে গিয়েছিলেন যার হাতে তখনও উত্তরের ইসিন শহরের দখল ছিল। নতুন একটি সুমেরীয় রাজত্ব তৈরি করার জন্য ইশবি এররার প্রয়োজন ছিল উর শহরকে নিজের দখলে রাখা। 

এই কাজে তিনি খুব একটা বাধার শিকার হলেন না। উর শহর লুণ্ঠিত হওয়ার পর আর কোনো শহরই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তৃতীয় রাজবংশের শাসনাধীন থাকা শহরগুলোর মাঝে শুধু দুটি প্রাচীন শহর এবং এলামাইটরা ছিলেন ইশবি এররার জন্য পথের কাঁটার মতো। 

মেসোপটেমিয়ার একেবারে উত্তর প্রান্তে টাইগ্রিস নদীর ডানদিকের বাঁকের পাশে এশনুন্না শহরটি অবস্থিত ছিল। ইব্বি-সিন বিভিন্ন ধরনের ঝামেলায় পড়লেন আর রাজধানী শহরের সাথে দূরত্বের সুযোগ নিয়ে এশনুন্না বিদ্রোহ করে বসল। এই শহরটি ইশবি এররার ক্ষমতার বিপক্ষে হুমকিস্বরূপ ছিল কিন্তু এটি ইসিন থেকে অনেক দূরে ছিল এবং এই দুই শহরের মাঝে ছিল এমোরাইটদের আনাগোনা। অপরদিকে লারসা শহরটি ছিল দক্ষিণের সমতলভূমিতে যা ইশবি এরার জন্য খুবই সুবিধাজনক একটি জায়গা ছিল। এই শহরটি ইব্বি-সিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি; একজন এমোরাইট শহরটি দখল করে নিয়েছিলেন। 

লারসার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে নিজের শক্তি ক্ষয় করেননি ইশবি এররা। বরং তিনি তার নিজের শহর ইসিনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের কাজে হাত দেন এবং সুমেরীয় রাজত্বের সবচেয়ে আরাধ্য শহর উর-এর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য তৈরি করেন একটি সুপ্রশিক্ষিত বিশাল সৈন্যদল। 

তিনি প্রস্তুতির জন্য প্রচুর সময় নিলেন। তার রাজত্বের প্রায় শেষের দিকে, খুব সম্ভব এলামাইটদের উর দখল করে নেওয়ার প্রায় দশ বছর পরে, উত্তর প্রান্ত থেকে তিনি এলামাইট দখলদারদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু করেন। তার সৈন্যদল লারসার পাশ দিয়ে গেলেও সেই শহরকে আক্রমণ করেনি। তার এই 

আক্রমণ কাব্যের ভাষায় অমরত্ব পেয়েছে—
ইশবি এররা তার শত্রুদের দিকে ধেয়ে গেলেন 
তারা তার রুদ্র রোষের হাত থেকে বাঁচতে পারল না
সেই উরিমের সমতলভূমিতে। 
তিনি এলেন ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে 
তার জয়রথ শহরে প্রবেশ করল 
তিনি শহরের সব ধনসম্পদ লুণ্ঠন করলেন 
এবং এই দুঃসংবাদটি এলামের রাজার কানে এলো। 

ইশবি এররা উরকেই তার সাম্রাজ্যের মুকুট হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য হলেন। তিনি লারসা কিংবা এশনুন্নাকে আক্রমণ করার সুযোগ পেলেন না; অল্পদিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। তবে মারা যাওয়ার আগে নিজ পুত্রকে তিনি তার দখলে থাকা চার শহরের শাসনভার দিয়ে গেলেন। 

পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরে ইশবি এররার বংশধররা এবং লারসার এমোরাইট রাজারা একে অপরের বিরুদ্ধে দক্ষিণের সমতলভূমিতে যুদ্ধবিগ্রহ চালিয়ে গেলেন; কিন্তু কেউই জয়ী হতে পারলেন না। 

ইতোমধ্যে উত্তরের যেসব শহর তৃতীয় রাজবংশের অধীনে ছিল তারা একে একে স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। আসসুর শহরটি প্রথমে সার্গনের মাধ্যমে আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে শুলগি একে উর- এর অধীনে নিয়ে আসেন। শহরবাসীরা তাদের প্রাচীরগুলো পুনর্নির্মাণ করলেন এবং পশ্চিমা সেমাইটদের সাথে ভূমধ্যসাগরের তীরে বাণিজ্য শুরু করলেন। এমনকি আসসুরের বণিকরা এশিয়া মাইনরের পূর্বপাশে উপনিবেশও স্থাপন করেছিলেন বাণিজ্যের সুবিধার জন্য। ইউফ্রেটিস নদের তীরে অবস্থিত উত্তরের শহর মারিতেও একই ধরনের কর্মকাণ্ড চলেছিল। আসসুর ও মারির মাঝে, অর্থাৎ মিশরের দুই বৃহৎ নদীর মধ্যস্থলে বেশ কিছু ছোটোখাটো এমোরাইট সর্দার ছিলেন যারা তাদের ছোটো ছোটো আবাদি জমি দখল করে বসে ছিলেন। তাদের একমাত্র কাজ ছিল অন্যের এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করা, কলহ ও বিবাদে অংশ নেওয়া এবং বারবার নিজ নিজ এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা। 

খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৩০ সালের দিকে দক্ষিণের ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে লাগল। 

লারসার পঞ্চম রাজা ছিলেন গানগানাম নামের একজন এমোরাইট। তিনি তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর সিংহাসন দখল করে নিয়ে নিজের মতো করে রাজত্ব করতে শুরু করলেন। তিনি সুসা শহর দখল করলেন এবং সেখানে নিজের নামসংবলিত একটি শিলালিপি রেখে এলেন। এরপর তিনি ইসিনের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিপ্পুরকে মুক্ত করলেন এবং উর শহরকে আক্রমণ করলেন। 

এই যুদ্ধের সময়ের বেশ কিছু চিঠি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। চিঠিগুলো মূলত আদানপ্রদান হয়েছিল ইসিনের রাজা লিপিট ইশতার (ইশবি এররার প্রপৌত্র) এবং তার সেনাপতির মাঝে, যার মূল বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধকৌশল। সেনাপতি লিখেছিলেন : ‘গানগানামের ছয়শ সৈন্য এসেছে; হে প্রভু, আপনি যদি অতিরিক্ত সৈন্য না পাঠান তা হলে তারা এখানে ইটের তৈরি দুর্গ তৈরি করে ফেলবে। তখন আর তাদের পরাজিত করা যাবে না। আর দেরি করবেন না, প্ৰভু।’ 

লিপিট ইশতারের উত্তর আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় প্রায় আশি বছর আগে ইব্বি-সিনের মরিয়া অবস্থার কথা, যখন ইশবি এররা এগিয়ে আসছিলেন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে। তিনি লিখলেন : ‘আমার অন্য সেনাপতিরা তোমার চেয়ে তাদের প্রভুর সেবায় অধিক পারদর্শী; কেন তুমি আমাকে আগে জানাওনি এই পরিস্থিতির কথা? আমি তোমাকে দুই হাজার বল্লমধারী সৈনিক, দুই হাজার তিরন্দাজ এবং এক হাজার কুঠার-যোদ্ধা পাঠিয়েছি। শত্রুবাহিনীকে তাদের শিবির থেকে তাড়িয়ে দাও এবং শহর প্রতিরক্ষায় আন্তরিক হও। এটাকে একটি জরুরি বার্তা হিসেবে বিবেচনা করো।’ 

বাড়তি সৈন্যবাহিনী আসতে দেরি হয়েছিল কিংবা তারা সংখ্যায় ছিল অপ্রতুল; কারণ যেটিই হোক না কেন, লারসার শত্রুবাহিনী উর শহর দখল করে নিলেন অনায়াসেই। শীঘ্রই গানগানাম নিজেকে উর শহরের স্বর্গীয় রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নামলেন। তিনি কবিদের নির্দেশ দিলেন তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে। সেসব কাব্যে তার এমোরাইট উত্তরাধিকারকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করা হয়েছে। একটি কবিতায় চন্দ্রদেবতার কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো যে তিনি প্রাচীন আচারগুলোকে আবারও প্রতিষ্ঠিত করবেন: ‘হে নান্না, তুমি আমাদের রাজা গানগানামের প্রিয়তম।’ 

আরেকটিতে বলা হলো, ‘তিনি আপনার শহরকে আপনার জন্য নতুন করে তৈরি করবেন। তিনি সুমের ও আক্কাদের ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে আবার একত্র করবেন আপনার উর শহরে। যে শহরটি প্রাচীন, যে শহরের রয়েছে মহান ঐশ্বরিক ক্ষমতা, সেখানে এমন একটি বাড়িতে বসবাস করে গানগানাম দীর্ঘজীবী হোক, যা কখনোই ধ্বংস হবে না।’ 

এভাবে অন্যদের উত্তরাধিকারকে নিজের বলে দাবি করার কৌশলটি পরবর্তীতে আরও অনেক শাসকই অনুসরণ করেছেন। 

গানগানামের উত্তরসূরি লারসা ও উর শহরের শাসনভার পেলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি নিপ্পুরকেও দখল করে নেবেন। কিন্তু ব্যাপারটিতে ইসিনের তৎকালীন রাজা (একজন উৎখাতকারী; ইশবি এররার বংশধররা উর শহরের দখল হারানোর সাথে সাথে সিংহাসন থেকেও বিতাড়িত হয়েছিলেন তার দ্বারা) বাগড়া দিলেন এবং দুটি শহরের মাঝে তাদের প্রাচীন সংগ্রামটি আবারও নতুন করে শুরু হলো। আবারও লারসা ও ইসিনের মাঝে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের সূত্রপাত হলো। এবারের লক্ষ্যবস্তু ছিল নিপ্পুর শহর, যার দখল অন্তত আটবার হাতবদল হয়েছে বিভিন্ন যুদ্ধের ফলস্বরূপ। 

ইতোমধ্যে সমতলভূমির অন্য শহরগুলো যেমন উরুক, এশনুন্না, আসসুর, মারি প্রভৃতি বেশ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছিল। যদিও প্রতিটি শহরই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছিল তারপরও তাদের মাঝে বজায় ছিল অস্ত্রের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এক ধরনের নিরপেক্ষতা। 

ইতোমধ্যে একজন এমোরাইট সেনাপতি নদীর তীরঘেঁষা গ্রাম ব্যাবিলনে বসতি স্থাপন করে সেটিকে তার সদর দপ্তর হিসেবে নির্বাচন করলেন। এভাবে নতুন একটি শহরের উত্থান হলো, যা ভবিষ্যতে একটি আলাদা সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে ওঠে। 

সেনাপতি সুমু আবুম গ্রামটির চতুর্দিকে প্রাচীর তুলে সেটিকে শহরে রূপান্ত রিত করলেন এবং নিজেকে রাজা হিসেবে এবং তার পুত্রদের তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করলেন। শিলালিপিতে তাকে গিলগামেশের মতো ‘এই শহরের মহান স্থপতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো। সেখানে আরও বর্ণিত আছে যে তার শাসনামলের দ্বিতীয় বছরে প্রাচীর এবং পঞ্চম বছরে নান্নার মন্দির তৈরি করা হয়েছিল সেখানে। 

সেই যুগে সুমু আবুম ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন না। একের পর এক অযোগ্য রাজা শহরগুলোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন; কেউই মনে রাখার মতো কিছু করে যেতে পারেননি। ইসিন শহরে অভিনব পন্থায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এক ভবিষ্যদ্‌বক্তা সেখানকার নবম রাজা এররা ইমিত্তিকে জানান যে তিনি শীঘ্রই চরম দুর্ভাগ্যের শিকার হতে চলেছেন। সেই দুর্ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি এসিরীয়দের মধ্যে প্রচলিত একটি রীতি পালন করেন। তিনি বলির পাঁঠা হিসেবে একজন অস্থায়ী রাজা খুঁজে বের করেন : একদিনের জন্য প্রাসাদের মালীকে রাজা বানিয়ে দিন। পরিকল্পনা ফেঁদেছিলেন যে একদিন রাজত্ব করার পর নকল রাজাকে ফাঁসি দেওয়া হবে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। যেহেতু ‘রাজা’র উপর দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে, তাই আসল রাজা থাকবেন সুরক্ষিত। 

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাগানের মালীকে অভিষিক্ত করার পর এররা ইমিত্তি এক বাটি সুপ খেতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সুপ গলায় আটকে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে; তাই আমরা ধরে নিতে পারি যে তার মৃত্যুর পেছনে প্রাসাদের বিষ বিশারদের অবদান ছিল। রাজা মারা যাওয়ার পর মালী আর সিংহাসন ত্যাগ করতে রাজি হলেন না এবং তিনি প্রায় চব্বিশ বছর ধরে রাজত্ব করলেন। 

এই পুরো সময়জুড়ে লারসার সাথে যুদ্ধ চলছিল। সর্বক্ষণ যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার কারণে লারসা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল আর সেই সুযোগটি লুফে নেয় এলামাইটরা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৩৪ সালের দিকে একজন এলামাইট বীর যোদ্ধা লারসা, উর ও নিপ্পুর দখল করে নেন একে একে। তিনি লারসার শাসনভার দিয়ে দেন পুত্র রিম-সিনের হাতে। 

রিম-সিনের লারসার অবস্থা ছিল খুবই করুণ; বহু বছরের যুদ্ধের কারণে শহরের বাসিন্দারাও ছিলেন অসুখী। তিনি চেষ্টা করলেন লারসাকে তার পুরানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে। প্রায় ১৮ বছরের প্রচেষ্টায় লারসা বেশ সম্মানজনক একটি অবস্থায় চলে এলো। কিন্তু লারসার এই উন্নতিতে অন্য তিনটি শহর এতটাই উদ্‌বিগ্ন হয়ে উঠল যে তারা তাদের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে একজোট হলো। ইসিনের রাজা, উরুকের এমোরাইট শাসক এবং ব্যাবিলনের এমোরাইট সেনাপ্রধান একটি যৌথবাহিনী তৈরি করলেন লারসাকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে। 

রিম-সিন খুব সহজেই সেই যৌথবাহিনীকে নির্মূল করলেন এবং উরুক শহরকে দখল করে নিলেন প্রতিশোধ হিসেবে। ব্যাবিলন ও ইসিনের রাজারা নিজেদের শহরে পালিয়ে গেলেন বাকি সৈন্যসামন্ত নিয়ে এবং কীভাবে রিম- সিনকে পরাজিত করবেন সেই ব্যাপারে পরিকল্পনা করতে লাগলেন। 

এই পর্যায়ে এশনুন্নার রাজা ঠিক করলেন যে তিনি দক্ষিণের গোলযোগের সুযোগে নিজের রাজত্বকে উত্তরে বিস্তৃত করবেন। তিনি টাইগ্রিসের পথে যাত্রা করলেন এবং আসসুরের এমোরাইট রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করে নিলেন। তিনি সেই শহরের দেখভালের দায়িত্ব দিলেন নিজ পুত্রকে। তবে তিনি আরও সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে আসসুরের ভঙ্গুর প্রাচীরের সামনে নতুন এক শত্রুর আবির্ভাব হলো। 

শামসি আদাদ নামক এই যোদ্ধাটি সম্ভবত এমোরাইট গোত্রভুক্ত ছিলেন এবং সেই সময়ের অন্য অনেক যুদ্ধবাজ নেতার মতো সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। এসিরীয় রাজাদের তালিকায় আমরা শামসি আদাদকে খুঁজে পাই। সেখানে বর্ণিত আছে যে তিনি কয়েক বছর ব্যাবিলনে ছিলেন এবং তারপর সেখান থেকে তার উত্থান ঘটে—যখন তিনি একাল্লাতুম নামের একটি সামরিক দুর্গ দখল করে নেন। দুর্গটি টাইগ্রিসের অপর পারে আসসুরের উত্তরে অবস্থিত ছিল। 

সেখানে তিনি তিন বছর বসে থেকে যুদ্ধের পরিকল্পনা আঁটলেন। তারপর তিনি আসসুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন এবং খুব শীঘ্রই এশনুন্নার শাসককে উৎখাত করে সিংহাসন দখল করলেন। 

তারপর তিনি রিম-সিনের রাজত্বের মতো আরেকটি গৌরবান্বিত রাজত্ব তৈরি করার জন্য কাজ করতে শুরু করলেন। শামসি আদাদ তার বড়ো ছেলে ইশমে দাগানকে একাল্লাতুম ও আসসুরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের শাসনভার দিলেন এবং নিজে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী ভূমিটি দখল করে নিলেন। তারপর তিনি আরও পশ্চিমে মারি শহরের দিকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে রওনা দিলেন এবং খুব সহজেই মারির রাজার শিরোচ্ছেদ করে শহরটিকে দখল করে নিলেন। এই সময় শামসি আদাদের একজন কর্মচারী তার কাছে চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, মৃত রাজার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য কতটুকু খরচ করা উচিত হবে। 

মারির রাজার ছেলেদেরকেও মেরে ফেলা হলো। শুধু তরুণ রাজপুত্র জিমরি লিম পালিয়ে যেতে পারলেন। তিনি কানানের উত্তরে অবস্থিত সেমাইটিক শহর আলেপ্পোতে পালিয়ে গিয়ে তার শ্বশুরের কাছে আশ্রয় নিলেন। শামসি আদাদ আক্রমণ করার অল্প কিছুদিন আগেই জিমরি লিম আলেপ্পোর রাজার মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। শামসি আদাদ তার ছোটো ছেলে ইয়াসমাহ আদাদকে মারির সিংহাসনে বসালেন, যাতে তিনি একইসাথে রাজা ও গভর্নরের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। 

অন্য অনেক রাজার মতো শামসি আদাদ শুধু শিলালিপিতেই তার বিজয়গাথা লিখে রেখে যাননি, মারির ধ্বংসস্তূপ থেকে আবিষ্কৃত হয় তার সাথে তার দুই পুত্রের অসংখ্য চিঠি। এসব চিঠি থেকে জানা যায় যে শামসি আদাদ শুধু পশ্চিমের সমতলভূমিই নয় বরং টাইগ্রিসের পূর্বদিকের কিছু এলাকা এমনকি জাগ্রোস পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন। 

শামসি আদাদ প্রথমবারের মতো ত্রিভুজাকৃতির ভূখণ্ডের শাসক হলেন। টাইগ্রিসের একেবারে উত্তরের প্রান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণের জাব নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এলাকাটি এবং এর তিন মাথায় আসসুর, আরবেলা ও নিনেভেহ শহর মিলে ‘এসিরিয়া’ তৈরি হলো। 

মিশরের বাইরে এটাই ছিল একক কোনো রাজার দখলে থাকা সবচেয়ে বড়ো রাজত্ব; এবং শামসি আদাদ ব্যাপারটি নিয়ে বড়াই করার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করেননি। একটি শিলালিপিতে তিনি লিখলেন, ‘আমি শামসি আদাদ, মহাবিশ্বের অধিপতি’ এবং আরেকটি নতুন মন্দিরের ফলকে নিজের ব্যাপারে লিখলেন, ‘তিনি আসসুরের মন্দিরের নির্মাতা। তিনি তার সকল শক্তি উৎসর্গ করেছেন টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী ভূমি রক্ষার কাজে। তিনি মন্দিরের ছাদ আর দরজাগুলো বানালেন সিডার গাছের কাঠ দিয়ে এবং সেগুলোকে রুপা ও সোনা দিয়ে সাজালেন। তিনি মন্দিরের দেওয়ালে সোনা, রুপা, বিভিন্ন দামি মণি-মুক্তা, মধু, সিডারের তেল এবং মাখনের প্রলেপ দিলেন।’ 

শামসি আদাদের সাম্রাজ্যের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল তার বজ্রকঠিন শাসন যা প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও প্রজা উভয়কেই প্রভাবিত করেছিল সমান তালে। তিনি নিজের রাজত্বের ব্যাপারে বলেন, ‘আমি সর্বত্র প্রশাসক বসিয়েছিলাম এবং বিভিন্ন জায়গায় সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে রেখেছিলাম।’ 

একদিকে ছিল নিজ প্রজাদের বিদ্রোহ করে বসার ভীতি আর আরেকদিকে ছিল এলামাইটদের হুমকি। দেশের পূর্ব প্রান্তে এলামাইটরা সৈন্য জড়ো করছিল আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে। শামসি আদাদের পূর্ব প্রান্তের গভর্নর বেশ কয়েকবার রাজাকে সতর্ক করে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল এলামের রাজার বারো হাজার যুদ্ধ-প্রস্তুত সৈন্য। কিন্তু ততদিনে শামসি আদাদ তার প্রজাদের মধ্য থেকে যথেষ্ট পরিমাণ মানুষকে নিজের সৈন্যবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছেন এবং তারা একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এলামাইটদের আক্রমণ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। 

দক্ষিণে রিম-সিন অবশেষে সমর্থ হয়েছিলেন ইসিনকে দখল করে নিতে এবং এর মাধ্যমে অবসান ঘটে লারসার সাথে দুইশ বছরব্যাপী যুদ্ধের। 

ইসিনের রাজবংশের পরাজয়ের সাথে সাথে রিম-সিন হয়ে গেলেন দক্ষিণের অবিসংবাদিত শাসক এবং উত্তরের একমাত্র শাসক হিসেবে অবশিষ্ট থাকলেন শামসি আদাদ। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯৪ সাল নাগাদ এই দুজন মিলে প্রায় সমগ্ৰ মেসোপটেমীয় সমতলভূমিকে নিজেদের দখলেই রাখলেন। 

খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯২ সালে এমোরাইটদের ব্যাবিলনীয় শাসক মারা গেলেন এবং তার ছেলে হাম্মুরাবি সিংহাসনে বসলেন। 

ব্যাবিলনীয় রাজার তালিকা অনুসারে হাম্মুরাবি ছিলেন সুমু আবুম-এর বংশধর, যিনি প্রথম এমোরাইট হিসেবে ব্যাবিলনের চারপাশে প্রাচীর তুলছিলেন। হয়তো তিনি শামসি আদাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন, কারণ ব্যাবিলনীয় রাজার তালিকার প্রাচীনতম সদস্যদের মধ্যে বারোজনের নাম শামসি আদাদের তালিকাতেও ‘তাঁবুতে বসবাসকারী রাজা’ হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় যে এমোরাইট যাযাবরদের মাঝেই জন্ম নিয়েছিলেন এই দুই রাজার পূর্বপুরুষরা। 

হাম্মুরাবির ব্যাবিলন শহরের চারপাশ ঘিরে ছিল রিম-সিন ও শামসি আদাদের বিশাল সাম্রাজ্য। তবে শহর হিসেবে ব্যাবিলনের কেন্দ্রীয় অবস্থানটি কৌশলগত দিক দিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শহরটি আসসুর থেকে বেশ দূরে থাকায় সেটিকে নিয়ে শামসি আদাদ বিন্দুমাত্রও চিন্তিত ছিলেন না। আবার একইভাবে এটি উত্তরের লারসা থেকেও এতটাই দূরে ছিল যে রিম-সিনও ব্যাবিলনকে কোনো ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছিলেন না। এই অবস্থায় হাম্মুরাবি বেশ সতর্কতার সাথে তার সাম্রাজ্য বাড়ানোর কাজে হাত দেন। তিনি মেসোপটেমিয়ার মধ্যাঞ্চলের সব শহর একে একে দখল করে নেন। সিংহাসনে বসার অল্পদিনের মাঝেই তিনি পুরানো সুমেরীয় শহর কিশ এবং ইউফ্রেটিসের দক্ষিণের বরসিপ্পাকে নিজের পতাকার নিচে নিয়ে আসেন। 

হাম্বুরাবি এক পর্যায়ে বুঝতে পারলেন যে তার সাম্রাজ্যকে আরও বড়ো করার জন্য উত্তরে বা দক্ষিণের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি দক্ষিণের পথে রওনা হলেন। রিম-সিন ইসিন আক্রমণ করার পর থেকে শহরটির প্রতিরক্ষা খুবই দুর্বল ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৮৭ সালে, ব্যাবিলনের সিংহাসনে বসার ঠিক পাঁচ বছর পরে, হাম্মুরাবি ইসিন আক্রমণ করলেন এবং সেখানে মোতায়েন করা লারসান সৈন্যবাহিনীকে বিতাড়ন করে শহরের দখল নিলেন। এরপর তিনি এলামাইট সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত শহর ম্যালজিয়ামকেও দখল করে নেন। 

তবে তিনি তখনও রিম-সিনের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। নয় বছর রাজত্ব করার পর তিনি শামসি আদাদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন। একটি ব্যাবিলনীয় ট্যাবলেটে সেই ব্যাপারে বিস্তারিত বলা আছে। চুক্তির ভাষায় এটুকু পরিষ্কার যে হাম্মুরাবি শামসি আদাদকে তার চেয়ে শক্তিমান হিসেবে মেনে নিয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই এটি একটি যুদ্ধকৌশল ছিল; হাম্মুরাবি জানতেন যে শামসি আদাদকে পরাজিত করার মতো শক্তিমত্তা তখনও তিনি অর্জন করেননি। ঘটনাচক্রে এই চুক্তি হওয়ার দুই বছর পর শামসি আদাদ মারা যান বার্ধক্যজনিত কারণে। যদিও তার জন্মের মতো মৃত্যুর ঘটনাটিও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। 

শামসি আদাদের মৃত্যুর পরও হাম্মুরাবি তাড়াহুড়ো করেননি। তিনি সময় নিয়ে খাল খনন করেন, মন্দির বানান, নিজ শহরগুলোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নত করেন এবং একটি শক্তিশালী ও সুপ্রশিক্ষিত সৈন্যদল তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। কোনো ধরনের ঝামেলা না করে তিনি শামসি আদাদের ছেলে মারির রাজা ইয়াসমাহ আবাদ এবং এশনুন্নার রাজার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাদের সাথে হাম্মুরাবির এতটাই ভালো সম্পর্ক ছিল যে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন উভয় রাজ্যেই দূতের ছদ্মবেশে গুপ্তচর পাঠাতে। তিনি আলেপ্পোর সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন যেখানে মারির সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী লুকিয়ে ছিলেন। তিনি তার রাজসভায় আলেপ্পোর একজন রাজদূতকে স্থান দিয়েছিলেন। 

রিম-সিন ততদিনে মেসোপটেমিয়ার মধ্যম অঞ্চলে বাড়তে থাকা ব্যাবিলনীয় হুমকির ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে গিয়েছেন। হাম্মুরাবি চুপচাপ ছিলেন কিন্তু তিনি যে বিপজ্জনক সেই ব্যাপারে কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। রিম-সিন কালবিলম্ব না করে এলামাইটদের সাথে মিত্রতা তৈরি করতে থাকলেন। তিনি পূর্বের ম্যালজিয়ামের রাজা এবং উত্তরের এশনুন্নার রাজা এমনকি গুতিয়ানদের সাথেও মিত্রতা তৈরি করলেন। 

তিনি ভেবেছিলেন চারদিক থেকে মিত্রদের সহায়তায় হাম্মুরাবিকে চেপে ধরবেন। কিন্তু হাম্মুরাবি শান্তিপূর্ণভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন এবং মেসোপটেমিয়ার একেবারে মাঝখানে বসে থেকে সামরিক শক্তি বাড়াতে লাগলেন নিজের। 

বিভিন্ন ধরনের রাজা, রাজ্য ও কৃষ্টির সন্নিবেশে মেসোপটেমিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক ব্লেন্ডার মেশিনের মতো যন্ত্রে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *