অধ্যায় দুই – প্রাচীনতম গল্প

অধ্যায় দুই – প্রাচীনতম গল্প 

অল্পদিনের মাঝেই সুমের রাজ্যে একটি ভয়াবহ বন্যার আগ্রাসন দেখা দেয়। 

মাসের পর মাস কোনো বৃষ্টি হয়নি। উপসাগরের লবণাক্ত উপকূলে একজন মহিলা শুষ্ক ও রুক্ষ গমের উপরের অংশগুলো কেটে নিচ্ছিল খেত থেকে। তার পেছনে শহরের উঁচু দেওয়ালগুলো সিসা রঙা আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সগৌরবে। মহিলাটির পায়ের নিচে পাথুরে ভূমি। পানি ধরে রাখার আধারগুলোতে প্রতি বছর জমা হওয়া বন্যার পানির পরিবর্তে মাত্র এক ইঞ্চি উঁচু আর্দ্র কাদা দেখা যাচ্ছে। সেচব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো। 

হঠাৎ এক ফোঁটা পানি ধুলোয় ধূসরিত হাতে আঁচড় এঁকে দেয়। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় যে দিগন্তের কাছ থেকে কিছু মেঘ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। সে চিৎকার দিয়ে প্রাচীরের দিকে ছুটে যায়; ততক্ষণে পুরো রাস্তা ভরে গিয়েছে মানুষে। সবার হাতে হাতে খালি বাসনকোসন এবং ফাঁপা ঝিনুকের খোলস—কোথাও তিল ধারণের জায়গাটাও নেই। 

এরকম ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে মুহূর্তের মধ্যেই বৃষ্টি ও জোরালো বাতাস স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু এবার সেরকম হলো না। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে থাকল। সবাই তাদের সাথে বয়ে আনা বিভিন্ন ধরনের আধারে পানি জমা করতে থাকলেন। একটু দূর থেকে একটি জোরালো কিন্তু অপরিচিত গর্জনের মতো শব্দ শোনা যেতে লাগল, যার তীব্রতায় মাটি কাঁপতে লাগল। 

প্রাচীন মানুষদের গভীর কূপ, বাঁধ কিংবা কেন্দ্রীয় পানি সরবরাহব্যবস্থা ছিল না। তাই তারা তাদের জীবনের একটি বড়ো অংশ ব্যয় করত পানি আহরণ ও সংরক্ষণের কাজে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পানি আনা নেওয়া করা, তা সংরক্ষণ করে রাখা এবং সংরক্ষিত পানির সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের হিসাব করা প্রভৃতি কাজে অনেক সময় চলে যেত তাদের। তারা প্রায় সর্বক্ষণই প্রাণপণে প্রার্থনা করত যাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে কিংবা কূপগুলো ভরে ওঠে সুপেয় পানিতে। 

মেসোপটেমিয়া রাজ্যে পানিসংক্রান্ত একটি ভীতি কাজ করত মানুষের মনে, এর এত উপকারী বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও। তারা ভাবত যে গভীর পানিতে অশুভ শক্তিসমূহ লুকিয়ে থাকে। পানির অপর নাম জীবন হলেও সেই নামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের নামও। 

মানচিত্র-২ : মহাপ্লাবনের আগে 
মানচিত্র-২ : মহাপ্লাবনের আগে 

ভূবিজ্ঞানীদের ভাষ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ইতিহাসে উল্লিখিত বড়ো বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে যুগ যুগ ধরে অনেক প্রাণ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। একটি মহাবিপর্যয়ের কথা বিভিন্ন গল্প ও কথামালার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। আমরা এমন কোনো গল্প শুনিনি যা শুরু হয়েছে এভাবে : ‘এবং তারপর থেকে আবহাওয়া হতে লাগল অনেক অনেক ঠান্ডা।’ কিন্তু বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে রয়েছে এমন একটি সময়ের কথা যে সময়ে অসীম জলরাশি তাদের গড়ে তোলা ভঙ্গুর সভ্যতার জন্য বড়ো ধরনের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ইতিহাসবিদগণ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ‘মহাপ্লাবন’-কে অস্বীকার করতে পারেন না; সম্ভবত এটিই হচ্ছে মানবজাতির একমাত্র সর্বজনবিদিত উপাখ্যান যা মোটামুটি সকল জাতি ও গোত্রের জন্য একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। 

রাজাদের তালিকায় নামমাত্র উল্লেখ ছাড়া সুমেরীয়দের ইতিহাসের কোথাও বন্যার গল্প সরাসরি আসেনি। এই ঘটনা ঘটার প্রায় এক হাজার বছর পরে এসিরীয় লাইব্রেরিতে আক্কাদিয়ান ভাষায় (মেসোপটেমিয়াতে প্রচলিত একটি সেমিটিক ভাষা) রচিত একটি বইতে এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। দেবতাদের রাজা এনলিল বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন মানবজাতির উপর, কারণ তারা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বুকে জোরালো শব্দের জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল, যার তীব্রতায় তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছিল। তিনি অন্যান্য দেবতাকেও রাজি করে ফেললেন এই বিরক্তিকর প্রাণের বিনাশ ঘটানোর ব্যাপারে। তবে ‘ইয়া’ নামক একজন দেবতা শপথ নিয়েছিলেন যে তিনি মানবজাতির স্বার্থ রক্ষা করবেন সর্বদা। তিনি অন্য 

দেবতাদের এই চক্রান্তের কথা উতনাপিশটিম নামক একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দেন আগেভাগে। —

‘অতঃপর নরকের দেবতারা জেগে উঠলেন 
জলরাশিকে আটকে রাখা সকল বাঁধ ভেঙে দেওয়া হলো
 নরকের সপ্ত-বিচারকগণ ভূমিতে আগুন ধরিয়ে দিলেন মশাল দিয়ে
দিনের আলো আঁধারে রূপান্তরিত হলো 
সকল ভূমিকে চুরমার করে ভেঙে ফেলা হলো’ 

যুদ্ধক্ষেত্রের মতো জলরাশি এসে মানবজাতিকে ছত্রভঙ্গ করে দিলো আগেই দুঃসংবাদটি পেয়ে যাওয়া উতনাপিশটিম পালিয়ে গেলেন নৌকায় করে; 

‘সাথে নিলেন তার পরিবার, কিছু প্রাণী 
এবং আরও যাদেরকে বাঁচাতে সক্ষম হলেন।’

এই কবিতাটির ব্যাবিলনীয় রূপান্তরের নাম ‘আত্রাহাসিসের কাব্য’ (আত্রাহাসিস শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ ‘বিজ্ঞজনরা’)। 

প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান রাজা আত্রাহাসিসকে সতর্ক করা হয়েছিল আসন্ন বিপর্যয়ের ব্যাপারে। তিনি একটি বড়ো জাহাজ নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু সঙ্গে এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে এর মাধ্যমে শুধু অল্প কিছু প্রাণকেই তিনি বাঁচাতে পারবেন। তিনি একটি জাঁকজমকপূর্ণ ভোজসভার আয়োজন করে সকল প্রজাকে দাওয়াত দিলেন যাতে তারা সবাই অন্তিম সময়ে অন্তত একটি দিন আমোদফুর্তির মাধ্যমে কাটাতে পারে। প্রজারা মন ভরে খেলো আর পান করল আর সবাই তাকে তার বদান্যতার জন্য ধন্যবাদ জানাতে থাকল। কিন্তু আত্রাহাসিস জানতেন যে এটি ছিল ফাঁসির আসামির জন্য আয়োজিত শেষ আহারের মতো একটি আয়োজন এবং এই কারণে তিনি শুধু রাজপ্রাসাদের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পায়চারি করতে লাগলেন গভীর দুঃখ ও গ্লানি সহকারে। 

‘তারা তার প্রাচুর্যের একাংশ থেকে ভক্ষণ করল 
এবং প্রাণ ভরে পান করল 
কিন্তু তিনি শুধু আসা যাওয়া করলেন 
কক্ষে প্রবেশ করেন আর বেরিয়ে আসেন 
একদণ্ডও বিশ্রাম নেন না 
এতটাই চিন্তাগ্রস্ত এবং মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন তিনি’ 

অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের মুখে এমনকি সবচাইতে জ্ঞানী রাজাটিও সব সময় তার প্রজাদের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারেন না। 

বাইবেলের ‘জেনেসিস’ অধ্যায়ে বর্ণিত বন্যার গল্পটিই সবচেয়ে সুপরিচিত। সেই বর্ণনা অনুযায়ী, সৃষ্টিকর্তা ঠিক করলেন যে তিনি তার সৃষ্টিসমূহকে কলুষমুক্ত করবেন, আর তাই তিনি একমাত্র নিষ্পাপ মানব নোয়াহ-কে বললেন একটি জাহাজ তৈরি করতে যা তাকে এবং তার পরিবারকে ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা করবে। বৃষ্টি পড়তে লাগল এবং ‘গভীর ঝরনাধারা ফুলে ফেঁপে উঠল; আর সাথে স্বর্গ থেকে বন্যাধারার দ্বার অবারিত হলো’ এবং সমগ্র পৃথিবী নিমজ্জিত হলো পানিতে। 

তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গল্প কিন্তু তাদের মাঝে অনেক বেশি মিল। এই কারণেই সম্পূর্ণ ঘটনাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 

উনিশ শতকের ভূতত্ত্ববিদগণ জেনেসিসের বর্ণনাকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে সেই মহাপ্লাবনের প্রমাণ সন্ধানে রত হন। কিছু প্রমাণ খুঁজেও পাওয়া যায়, যেমন অবিন্যস্ত ভূতাত্ত্বিক স্তর, পাহাড়ের চূড়ায় ঝিনুকের অবশেষ ইত্যাদি। তবে লুইস আগাসিজ ১৮৪০ সালে মতামত প্রকাশ করেন যে বন্যা নয় বরং বরফখণ্ডের শ্লথগতির নড়াচড়ার কারণেই এসব ঘটেছে। তিনি পূর্বে অনুমিত ‘বন্যার ফলে’ তৈরি বেশির ভাগ ভূতাত্ত্বিক প্রভাবের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা থেকে মনে হয় এগুলো কোনো মহাপ্লাবনের ফল নয় বরং সাধারণ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

কিন্তু তারপরও যুগ যুগ ধরে মহাপ্লাবনের গল্পগুলো প্রচলিত থেকে গিয়েছে। মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস নিয়ে অধ্যয়নরত ছাত্ররা একটি প্রকৃত বন্যার কথা জোর গলায় বলতে থাকেন কিন্তু সেটি আর আগের মতো সর্বজনবিদিত কোনো বন্যা ছিল না; ততদিনে সেটি সম্মান হারিয়েছে অনেকটাই। তবে এটুকু সবাই স্বীকার করে নেয় যে খুব সম্ভব মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে এমন একটি সর্বগ্রাসী বন্যার প্রকোপ দেখা দিয়েছিল যার কথা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ মনে রেখেছে। 

উর শহরের ধ্বংসাবশেষ খনন করে খ্যাতি লাভ করা প্রত্নতত্ত্ববিদ লেনার্ড উলি লিখেছেন, ‘মহাপ্লাবনে সম্পূর্ণ মানবজাতির ধ্বংস হওয়ার প্রশ্ন‍ই ওঠে না এমনকি বদ্বীপের বাসিন্দারাও মারা যায়নি সেই বন্যায়। তবে বন্যাটি ইতিহাসের পাতায় মাইলফলক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে তার ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতায় এবং এর মাধ্যমে একটি যুগের অবসান ঘটেছিল।’ 

বন্যার প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে উলি ব্যর্থ হননি, তিনি পলিমাটির একটি ১০ ফুট উঁচু স্তর আবিষ্কার করেন যা মেসোপটেমিয়াকে আলাদা করে রেখেছিল অন্যান্য জনবসতি থেকে। 

প্রায় সত্তর বছর পরে ভূতাত্ত্বিক উইলিয়াম রায়ান ও ওয়াল্টার পিটম্যান প্রস্ত বিনা করেন যে বন্যার গল্পগুলো মেসোপটেমিয়ার ধ্বংসাত্মক বন্যাকে চিত্রিত করে না বরং এটি একটি চিরস্থায়ী জলাবদ্ধতার গল্প বলে। তাদের ভাষায়, ‘এটি এমন একটি বন্যা যা কখনও প্রশমিত হয়নি এবং মানুষকে তার প্রাক্তন বাসস্থান ছেড়ে নতুন আবাসের খোঁজে বের হতে বাধ্য করেছিল।’ বরফ গলতে থাকায় ভূমধ্যসাগরের উচ্চতা বাড়তে থাকে এবং বসফরাস প্রণালিও ভেসে যায়, যা এককালে বিস্তীর্ণ ভূমি ছিল। 

ব্ল্যাক সি-র তীরবর্তী গ্রামগুলো পানিতে ভেসে যায়। যারা পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল তারা দক্ষিণের দিকে চলে যায় আর সাথে করে নিয়ে যায় সেই বিপর্যয়ের স্মৃতি। 

পূর্বে আলোচিত ব্যাখ্যার পাশাপাশি আরও কম চিত্তাকর্ষক ব্যাখ্যাও প্রস্তাবিত হয়েছে মহাপ্লাবনকে ঘিরে। অনেকে বলেছেন যে এই গল্পটি সম্ভবত বন্যাসংক্রান্ত সাধারণ উৎকণ্ঠাকেই প্রকাশ করে যা মেসোপটেমিয়ার উপকূলের বাসিন্দাদের জন্য খুবই নিয়মিত ঘটনা ছিল। 

প্রতিটি ব্যাখ্যারই রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। লেনার্ড উলির আবিষ্কার করা পলিমাটির স্তরের আরও গভীরে খনন করার পর দেখা গেল যে এটি আসলে কোনো মাইলফলক কিংবা ইতিহাস বদলে দেওয়ার মতো বড়ো কোনো প্ৰমাণ নয়। জানা গেল যে এই স্তরটি তৈরি হয়েছিল ২৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে যা সুমেরীয় সভ্যতার মাঝামাঝি সময়ে। এটি প্রমাণ করা খুবই ঝামেলার হয়ে দাঁড়ায় যে পৃথিবীর বুকে শত শত বছর ধরে আঘাত হানা বন্যাগুলোর যে-কোনো একটি কোনোক্রমে মহাপ্লাবনে রূপান্তরিত হয়ে তেমনই একটি মহাবিপর্যয় ঘটিয়ে ছিল যা পৃথিবীর চেহারা পালটে দিয়েছিল চিরতরে। আমরা ধরে নিতে পারি যে উপসাগরের পানি বেড়ে যাওয়াতে তীরবর্তী গ্রামগুলো আর্দ্র হয়েছিল কিন্তু পানি বাড়ার হার ছিল ‘প্রতি দশ বছরে এক ফুট’, যা কোনোভাবেই ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মহাপ্লাবনের সাথে তুলনীয় নয়। 

কালো সাগরের তলদেশ থেকে সংগৃহীত নমুনার উপর ভিত্তি করে দেওয়া পিটম্যান ও রায়ানের তত্ত্বটি অন্যান্য ব্যাখ্যার তুলনায় অধিকতর আকর্ষণীয়। কিন্তু তারা যে বন্যাটিকে চিহ্নিত করেছেন তার সময়পর্ব ৭০০০ খ্রিষ্টাব্দ, যার কারণে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে : ‘কীভাবে এরকম এককটি সর্বজনবিদিত বন্যার গল্প মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল যাদের অনেকেই খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ সালে মেসোপটেমিয়া থেকে যোজন যোজন দূরত্বে বসবাস করতেন? 

সুমেরীয়গণ যখন তাদের শহর গড়ে তুলছিলেন তখন চীনদেশে দুটি পুরোপুরি স্বতন্ত্র চাষাবাদভিত্তিক কৃষ্টি তৈরি হয়েছিল, যাদের নাম ছিল ইয়াং শাও এবং লংশান। তাদের বর্ণনায়, একজন বিশ্বাসঘাতক ও যুদ্ধবাজ নেতা আকাশের বুক চিরে ফেলাতে শাস্তিস্বরূপ পুরো পৃথিবীকে বৃষ্টির পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল; বেঁচে গিয়েছিলেন শুধু একজন মহীয়সী রানি এবং তার অল্প কিছু সহযোদ্ধা। তারা সকলে একটি পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভারতে, বিজ্ঞ রাজা মানুকে একটি মাছ সতর্ক করে দিয়েছিল এটা বলে যে একটি বিশাল আকারের বন্যা আসছে এবং যখনই পানির উচ্চতা বাড়তে থাকবে তখনই তার উচিত হবে একটি বড়ো জাহাজ তৈরি করে তাতে চড়ে বসা। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ থেকে আমরা জানতে পারি যে ‘ত্রিস্বর্গ তলিয়ে গিয়েছিল পানির নিচে, আর শুধু মানু একাই বেঁচে গিয়েছিলেন।’ 

আমেরিকার বন্যার গল্পগুলো আরও কৌতূহলোদ্দীপক, যার কোনো কোনোটার সাথে মেসোপটেমিয়ার গল্পগুলোর আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায় (এবং খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী যাজকদের সঙ্গে করে আনা বাইবেলেরও আগে থেকে সেগুলো প্রচলিত ছিল—যদিও এটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয়)। মায়াদের সংস্করণে ‘চারশো পুত্রসন্তান’ বন্যার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল মাছে রূপান্তরিত হয়ে। পরবর্তীতে তারা মাতাল হয়ে তাদের পুনর্জীবন প্রাপ্তির আনন্দকে উদ্‌যাপন করছিল এবং এক পর্যায়ে তারা স্বর্গে আরোহণ করে পিয়োডেস (সাত বোন) নক্ষত্রপুঞ্জে পরিণত হয় (সতর্ক পাঠকগণ লক্ষ করবেন যে এই কাহিনি বাইবেলের নোয়াহ-র গল্পের সাথে কিছুটা মিলে যায়, সেখানেও আকাশে কিছু চিহ্নের আবির্ভাব হয়েছিল এবং সেটাতেও শুষ্ক ভূমি খুঁজে পাওয়ার দিনে নোয়াহ মাতাল হয়ে গেছিলেন অপরিণামদর্শীর মতো)। 

পেরুতে হঠাৎ একদিন একটি লামা তার জন্য নিয়মিত বরাদ্দের খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানায়। তার এই আচরণে অবাক হয়ে তার মালিক তাকে জিজ্ঞেস করেন কেন সে এরকম করছে। তখন সেই লামা তাকে সতর্ক করে দেয় এই মর্মে যে আর পাঁচদিনের মাথায় জলরাশি জেগে উঠবে যা সমগ্র পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবে। মানুষটি তখন পাহাড়ের উচ্চতম চূড়ায় আরোহণ করেন এবং নিজের প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হন। পরে তিনি পৃথিবীকে পুনরায় জনমানবপূর্ণ করে তোলেন। তবে তার সাথে কোনো মহিলা পাহাড়ে উঠেননি, যা গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে—কিছুটা কৌতুকীভাবেই। 

যদি আমেরিকানদের বর্ণিত বন্যার গল্পগুলোর সাথে মেসোপটেমিয়ার গল্পগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলে বন্যাটি খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ সালে সংগঠিত হতে পারে না। এক্ষেত্রে ইতিহাসবিদ জন ব্রাইট ধারণা করেন যে এই সর্বজনবিদিত দুর্যোগটি নিশ্চিতভাবেই খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০০ সালের আগেই ঘটেছিল, যখন শিকারিরা বেইরিং প্রণালির অপর পারে অভিযোজন করেছিলেন 

তা হলে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল? 

এটুকু নিশ্চিত যে মানববসতিপূর্ণ পৃথিবী বন্যায় ভেসে গিয়েছিল এবং কেউ একজন আগে থেকেই খবর পেয়েছিলেন কিংবা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে মহাদুর্যোগ আসন্ন। 

মহাপ্লাবনের প্রকোপ স্তিমিত হওয়ার পর এক সময় পৃথিবী শুকিয়ে যায়। মানুষ আবার নতুন করে জীবন শুরু করে একটি ভিন্ন ধরনের (লাল রঙে রাঙানো) পৃথিবীতে। বন্যার কারণে মানবজীবন পরিবর্তিত হলো চিরতরে। জেনেসিসের বর্ণনামতে, নোয়াহকে বলা হয়েছিল, ‘এখন থেকে মাংসের জন্য পশু হত্যা করা গ্রহণযোগ্য বলে ঘোষিত হলো।’ 

একইভাবে, সুমেরীয়দের বন্যার গল্পে দেবতারা পৃথিবী ধ্বংস নিয়ে আহাজারি করেন- 

‘যদি দুর্ভিক্ষে পৃথিবী ধ্বংস হতো 
বন্যার পরিবর্তে, 
তবে কি সেই মহামারিতেই মানবজাতির ক্ষয় হতো?
বন্যার পরিবর্তে?’ 

নিশ্চিতভাবেই এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে এতগুলো দেশের সৃষ্টি- রহস্যের গল্প শুরু হয়েছে বিক্ষুদ্ধ জলরাশির উদাহরণ দিয়ে যে মহাপ্রলয়ের কারণে মানুষকে নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য শুষ্ক ডাঙার খোঁজ করতে হয়েছিল। আক্কাদিয়ান গল্পটি গিলগামেশের মহাকাব্যের সাথে খুঁজে পাওয়া কিছু অবিন্যস্ত ট্যাবলেটে লিপিবদ্ধ করা ছিল। গল্পটি শুরু হয় এভাবে- 

‘যখন মাথার উপর স্বর্গের অস্তিত্ব ছিল না 
আর নিচে, পৃথিবীতে, একটি গাছও বড়ো হয়নি
অতল গহ্বর পারেনি আর সীমানা ভাংতে 
বিক্ষুব্ধ তিয়ামাত ছিল তাদের সবার মাতা’ 

পৃথিবী সৃষ্টির সময় সমুদ্রের প্রাণী তিয়ামাতকে হত্যা করা হয় এবং তার মৃতদেহের অর্ধেক স্বর্গে নিক্ষেপ করা হয়। এটা করা হয়েছিল যাতে তার শরীরে লেগে থাকা মৃত্যু সঞ্চারক লবণাক্ত পানিতে সদ্য শুষ্ক হওয়া ভূমির কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয়। 

মিক্সটেক জাতির সৃষ্টি-রহস্যের পুরাণে বর্ণিত : ‘সেটি ছিল মেঘের বছরের মেঘের দিন। সেদিন সবকিছু অন্ধকারে ডুবে ছিল। সকল বস্তু অবিন্যস্ত অবস্থায় ছিল এবং পানিতে নিমজ্জিত ছিল একটি ময়লা ও আবর্জনার আস্তরণ, যা পৃথিবী নামে পরিচিত ছিল।’ একইভাবে, ভারতীয় শতপথ ব্রহ্মা আমাদেরকে জানায় : ‘শুরুতে ছিল শুধু পানি; শুধু পানির সমুদ্র।’ বান্টুদের গল্পেও একই কথা : ‘শুরুতে, সবকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল এবং গভীর অন্ধকার ও পানি ছাড়া কিছুই ছিল না। 

এবং যারা খ্রিষ্টান কিংবা ইহুদি ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম নিয়েছেন তাদের জানা আছে সেই বহুল পরিচিত জেনেসিসের বাণী : ‘শুরুতে পৃথিবীর ছিল না কোনো আকার ও আকৃতি এবং অন্ধকারে ঢাকা ছিল পানির উৎসগুলো। সৃষ্টিকর্তার অবয়ব অনুভূত হতো অতলে। 

জলরাশি দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তার সঠিক কোনো হিসেব নেই। কিন্তু অন্য অনেক মানবগোষ্ঠীর মতো সুমেরীয়দেরও একটি ‘হারিয়ে যাওয়া’ স্বর্গের উপাখ্যান রয়েছে। 

সুপ্রাচীন সুমেরীয় কবিতা ‘এনকি অ্যান্ড নিনহুসাগ’-এ সেই স্বর্গের বর্ণনা দেওয়া আছে এভাবে- 

‘এটি এমন একটি জায়গা 
যেখানে সিংহ কাউকে হত্যা করে না 
নেকড়েরা ভেড়াকে আক্রমণ করে না 
শিশুহন্তারক বুনো কুকুরের নামও কেউ শুনেনি সেখানে 
সেখানে কারও চোখ বা মাথা-ব্যথা করলেও সে তা বলে না
কিন্তু এই স্বপ্নের শহরটি হারিয়ে গিয়েছে 
যা ছিল ফলগাছে ভরা এবং সুপেয় পানির ধারায় সিক্ত।’ 

আমরা এখন শিহরিত হই পানির কথা শুনলে এবং তার মাধ্যমে শুষ্ক জায়গা এবং আমাদের পরিকল্পিত আবাসস্থলের প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবে। এখানে টাইটানিক জাহাজের ডুবে যাওয়ার কাহিনি নিয়ে আমাদের মাতামাতি খুবই প্রাসঙ্গিক। 

জাহাজটির ডেক বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল এবং পানি উপরে উঠে যাচ্ছিল এবং অনেক অফিসার বিপদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারলেও সেই ব্যাপারে কিছুই করতে পারেননি। অতল গভীর জলরাশিসংক্রান্ত গল্পগুলো আমাদেরকে একইসাথে উত্তেজিত ও ভীত করে। দার্শনিক রিচার্ড মাউ-এর মতে, ‘রাগান্বিত ও গভীর জলসংক্রান্ত ছবিগুলো আমাদের কল্পনায় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে, যদিও ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ধরনের কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই। ‘ 

কিন্তু এটি ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিকদের বিচরণক্ষেত্র। একজন ইতিহাসবিদ শুধু এটাই বর্ণনা করতে পারেন যে মদ চোলাইকরণ ও কৃষিকাজ মোটামুটি একসাথেই শুরু হয়েছিল এবং পৃথিবীর প্রাচীনতম ওয়াইনের (যা বর্তমান ইরানের একটি গ্রামে পাওয়া গিয়েছিল) বয়স ছয় হাজার বছরেরও বেশি। সুতরাং এটা ধরে নেওয়া যায় যে যতদিন থেকে মানুষ শস্য ফলাচ্ছে ঠিক ততদিন ধরেই তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে মহাপ্লাবনে হারিয়ে যাওয়া রঙিন দুনিয়াকে খুঁজে পেতে—হোক না তা স্বল্প সময়ের জন্য। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *