অধ্যায় ষোলো – বর্বরদের প্রথম আক্রমণ
খ্রিষ্টপূর্ব ২২৭৮ ও ২১৫৪ সালের মাঝে গুতিয়ানদের সৈন্যদল আক্কাদীয় ভূমিতে আক্রমণ চালায় এবং তৃতীয় রাজবংশের রাজা উর তাদেরকে বিতাড়িত করেন।
সার্গনের পুত্র মানিশটুণ্ড তার শাসনাধীন আক্কাদীয় সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করার চেষ্টায় ছিলেন তখন। মিশরের মতো অভ্যন্তরীণ শত্রু নয় বরং আগাদে শহরের অধিপতি আবিষ্কার করলেন যে তার প্রধান শত্রুগণ তার দেশের সীমানার বাইরেই অবস্থান করছেন।
মানিশটুশুর আমলের শিলালিপিগুলোতে বর্ণিত আছে যে তিনিও তার পিতার মতোই যুদ্ধংদেহি ছিলেন। তিনি দাবি করেন যে তিনি তার পিতার চেয়েও অনেক বেশি এলাকা দখল করেছিলেন; সাম্রাজ্য বিস্তার করার উদ্দেশ্যে জাহাজযোগে পারস্য উপসাগরের তিরে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যেখানে ‘৩২ জন রাজা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য জমায়েত হয়েছিলেন’ এবং ‘তিনি তাদেরকে পরাজিত করে তাদের শহরগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন।’ তবে এই বর্ণনাগুলো অতিরঞ্জিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি যেসব এলাকা থেকে নজরানা পাচ্ছিলেন সেগুলো তার আগেই রিমুশের আমলে দখলকৃত। তারপরও একটি বিজয়ের ঘোষণা দেওয়া শিলালিপিতে লেখা ছিল : ‘এসব মিথ্যা নয়, পুরোপুরি সত্য।’ এই ধরনের জোরগলার দাবি থেকেই মূলত সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে উৎখাতকারী ব্যক্তির নামের আগে বৈধ রাজা’ খেতাব জুড়ে দেওয়ার মতো তার সাম্রাজ্য বিস্তারের গল্পগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ।
মানিশটুশুর চৌদ্দ বছরব্যাপী রাজত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তার পুত্র নারাম সিন দ্য গ্রেট-এর জন্মগ্রহণের ঘটনাটি। তিনি ছিলেন মহান সার্গনের পৌত্র, যিনি আক্কাদীয় সাম্রাজ্যকে চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার দাদার মতোই নারাম সিনকেও সর্বক্ষণ যুদ্ধ করতে হয়েছিল। একটি স্টেলেতে একই বছরে নয়টি যুদ্ধে জয়লাভের কথা লেখা আছে। আরেকটি সাদামাটা বিজয় স্টেলে’-তে বর্ণিত আছে আরেকটি পশ্চিমের এলামাইট প্রদেশের একটি উপজাতি গোত্রের সাথে বিজয়গাথা। সেই সময়ে আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়ে এলামের দুটি রাজধানীর একটি, সুসা-কে গ্রাস করে নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ান শহর মুক্ত থেকে যায়। এলামাইটরা প্রবল পরাক্রমে পশ্চিম থেকে আসা আক্রমণগুলো প্রতিহত করে যাচ্ছিল।
এলামাইট রাজার সার্বভৌমত্বকে অবজ্ঞা করে নারাম সিন নিজেকে ‘পৃথিবীর চার-চতুর্থাংশের রাজা’ ও ‘মহাবিশ্বের রাজা’ খেতাব প্রদান করেন, যা ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার রাজাদের চেয়েও বেশি বাগাড়ম্বরপূর্ণ একটি কাজ। কুনেইফর্মে লেখা তার নামের পাশে এমন একটি চিহ্ন দেওয়া আছে যা দিয়ে ঈশ্বরকে বোঝানো হতো এবং তাকে নিয়ে নির্মিত শিলালিপিতে দেখা যায় তার মিনারের মতো লম্বা অবয়ব; অনেক উঁচুতে বসে তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে জয়ী হতে দেখছেন। পূর্বের শিলালিপিগুলোতে একই ধরনের অবস্থানে দেবতাদের চিত্রিত করা হতো। নারাম সিন যুদ্ধে জয়লাভের উদ্দেশ্যে কোনো দেবতার আশির্বাদের তোয়াক্কা করেননি; তিনি নিজেই যথেষ্ট ছিলেন। আমাদের জানামতে নারাম সিনই ছিলেন প্রথম মেসোপটেমীয় রাজা যিনি ঐশ্বরিক ক্ষমতালাভের দাবি করেছিলেন তার জীবদ্দশায়। তার এই দাবির মাধ্যমে সিংহাসনের ক্ষমতা আরও অধিক পরিপক্কতা লাভ করে।
নারাম সিনের আমল আসতে আসতে আক্কাদীয়রাও জাতি হিসেবে অনেক পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। সার্গন মেসোপটেমিয়ার সকল যুদ্ধরত শহরকে জড়ো করে একটি সুসংহত সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন কিন্তু আক্কাদীয় কৃষ্টি কখনোই তাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত ছিল না। আপনি চাইলে আক্কাদীয় সাম্রাজ্যে একজন আক্কাদীয় রাজার শাসনে থেকেও সুমেরীয় হিসেবে জীবন ধারণ করতে পারতেন সহজেই। সার্গনের পুত্র ও পৌত্ররা তাদের বিজয়গাথা বর্ণনা করেছিলেন সুমেরীয় কুনেইফর্ম (পরাজিতদের সুবিধার্থে) এবং আক্কাদীয় লিপিতে (তাদের নিজের জন্য)। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সৈন্যবাহিনী সুমেরের শহরগুলোতে থাকতেন কিন্তু তারা একইসাথে অবগত ছিলেন যে তাদের কৃষ্টি অনেকটাই ভিন্ন ছিল তাদের তখনকার আবাসস্থল থেকে।
নিজস্ব কৃষ্টিকে ভিত্তি করে তৈরি নিজস্ব ও স্বতন্ত্র পরিচয়ের ব্যাপারটি আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিপদসংকুল সময়ে সগৌরবে প্রদর্শিত হয়েছিল। জাগ্রোস পর্বতমালা থেকে নেমে এসে টাইগ্রিস নদীর পূর্বদিক থেকে সেনাবাহিনী ধেয়ে এসে গুতিয়ান উপজাতিদের নির্মূল করে দেয় এবং নারাম সিনের রাজত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়।
তবে একটি প্রতিষ্ঠিত রাজত্বের বিরুদ্ধে এই ধরনের হুমকি খুব একটা নতুন কিছু ছিল না।
চৈনিক ঐতিহ্যবাহী নথিগুলো থেকে আমরা জানতে পারি অভ্যন্তরীণ গোলযোগের বিরুদ্ধে শাসকদের সংগ্রামের কথা এবং সাথে নিপীড়ন ও শোষণমূলক, নির্দয় শাসনব্যবস্থার প্রতি পক্ষপাতের কথা। মিশরীয়রা ভাইদের মাঝে যুদ্ধের গল্প করে, যে যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে নীল নদের তীরবর্তী রাজত্বগুলো ভেঙে চুরে ভিন্ন ভিন্ন রাজত্বে রূপান্তরিত হয়। গিলগামেশ বর্বরদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু সেই শত্রুগুলো তার নিজের ছায়ার মতোই ছিল।
কিন্তু নারাম সিনকে ভিন্ন ধরনের শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়েছিল-তার রাজ্যে বর্বররা আক্রমণ করেছিল বাইরে থেকে, যাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ধ্বংসযজ্ঞ চালানো। আক্কাদীয়রা হিংস্রভাবে এবং জোরপূর্বক সুমেরের দখল নিয়েছিল; কিন্তু সার্গনের মানুষদের ছিল নিজস্ব ভাষা ও লিপি। নারাম সিনের রাজত্ব শুরু হতে হতে আক্কাদীয় সাম্রাজ্য অনেকটাই দেশের মতো হয়ে গিয়েছিল। তারা আর আগের মতো ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা যাযাবর রক্ষীবাহিনীর মতো আচরণ করত না। যেহেতু তাদের একটি নিজস্ব ইতিহাস ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের একজন অবিসংবাদিত নেতাও ছিল, তারা তখন বহিঃশত্রুদের নির্দ্বিধায় বর্বর নামে অভিহিত করতে পেরেছিল।
ইতিহাসবিদ ডেভিড ম্যাককালো মন্তব্য করেন : ‘কোনো জাতি নিজেদেরকে বর্বর নামে অভিহিত করে না। এটা হচ্ছে শত্রুদের দেওয়া নাম।’ আক্কাদীয়দের কৃষ্টি এলোমেলো গুতিয়ানদের চেয়ে অনেকটাই উৎকৃষ্ট ছিল। আক্কাদীয় ও গুতিয়ানদের ভাষা একই ছিল কিন্তু তাদের ছিল না নিজস্ব কোনো শিলালিপি, রীতিনীতি এবং তাদের ব্যাপারে তেমন কোনো ইতিহাসও আমাদের জানা নেই।
কোনো আক্কাদীয় শিলালিপিতে ‘বর্বর’ শব্দটির উল্লেখ নেই; এই শব্দটি আরও অনেক পরে গ্রিকরা ব্যবহার করা শুরু করে। তবে গুতিয়ানদের মাঝে আক্কাদীয়রা আবিষ্কার করে কিছু যুদ্ধংদেহি গোত্র, একটি বহিঃশক্তি, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ধ্বংস করা- নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন করা কিংবা তাদের কৃষ্টিকে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় তাদের ছিল না। এসিরীয় বিশেষজ্ঞ লিও ওপেনহেইম অভিমত দেন যে আক্কাদীয়দের লেখনীতে গুতিয়ানদের আক্রমণকে এমনই ঘৃণার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এটিকে একমাত্র ২০০ বছর পরে সংঘটিত আরেকটি ঘটনার সাথে তুলনা করা যায়, যখন প্রথমবারের মতো মিশর আক্রান্ত হয়েছিল বাইরে থেকে আসা ধ্বংসাত্মক যাযাবরদের দ্বারা।
সুমেরীয়রা গুতিয়ানদেরকে সাপ ও কাঁকড়া-বিছা বলে অভিহিত করেন এবং তারা তাদেরকে মানুষ বলেও গণ্য করতেন না। কাব্যের ভাষায় তাদের বর্ণনাটি ছিল এরকম-
‘তারা এই ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত নয়
তারা গুতিয়ান, যাদের নেই কোনো লাগাম
তাদের চিন্তাধারা মানবের মতো কিন্তু অনুভূতি কুকুরের ন্যায়
তারা দেখতে একেবারেই বাঁদরের মতো।
ছোটো ছোটো পাখির মতো তারা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে এসেছিল মাটিতে
তাদের নখের আঁচড় থেকে কেউ বাঁচেনি
কেউ পালাতে পারেনি তাদের বজ্র আঁটুনি থেকে।’
নারাম সিনের সৈন্যবাহিনী গুতিয়ান বাহিনীকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছিল—তারা শহরের পর শহর দখল করে নিয়েছিল। গুতিয়ানদের এই দখলীকরণের কারণে আক্কাদীয় শহরের সকল শৃঙ্খলা উলটপালট হয়ে যায়।
‘বার্তাবাহক আর মহাসড়ক দিয়ে যাত্রা করতে পারছিল না
দূতদের নৌকাগুলো আর নদীপথে চলতে পারছিল না
কয়েদিরা প্রহরায় নিযুক্ত হলো, ডাকাতদের কুক্ষিগত হলো সড়কগুলো
তারা তাদের নিজেদের জন্য শহরের ভেতর বাগান বানাল
সাধারণত যেসব বাগান বাইরের অবারিত মাঠে বানানো হতো
জমিতে কোনো শস্য ফলেনি আর নদীতে থাকেনি কোনো মাছ
ফলের বাগান থেকে আসেনি কোনো রস কিংবা মদ
মেঘ থেকে হয়নি কোনো বৃষ্টি
সৎ মানুষদের দেশদ্রোহী হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছিল
বীরদের মৃতদেহ জমে স্তূপ হয়ে যাচ্ছিল
এবং দেশদ্রোহীদের রক্ত সৎ মানুষদের রক্তের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।’ বর্বরদের পরিচালিত ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে কিছুদিন পরে একটি লম্বা উপাখ্যান লেখা হয়েছিল, কারণ ব্যাপারটিতে অনেকেই বিচলিত হয়েছিলেন। বর্বরদের প্রথম এই আক্রমণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল, ‘দেবতারা রেগে গিয়েছেন’; কিন্তু এই ব্যাখ্যা এর পরেও আরও অনেকবার অনুরূপ অবস্থার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
আগাদের অভিশাপ বইতে বর্ণিত আছে যে নারাম সিন রাজধানীতে অবস্থিত এনলিলের মূল মন্দিরটি ধ্বংস করে সেখান থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র লুট করেছিলেন। মন্দিরের পবিত্রতা বিনষ্ট করার কারণে তার দেশ দেবতাদের রোষানলে পড়ে এবং যখন তিনি ‘জাহাজভর্তি ধনসম্পদ নিয়ে’ বন্দর ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন তখন শহরটি তার সকল ধরনের উৎকর্ষ হারিয়ে ফেলছিল।
শহরটি তার নিজস্ব সত্তাকে হারিয়ে ফেলেছিল; তার সুনির্দিষ্ট সভ্য ও মানবিক চরিত্র বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এনলিল সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিশোধ নেবেন এবং তিনি গুতিয়ান বাহিনীকে লেলিয়ে দিলেন আগাদের বিরুদ্ধে; এবং তারা ছিল ‘গর্জনশীল ঝড়ের মতো যা পুরো ভূখণ্ডকে নতজানু করে দিতে পারে এবং এমন একটি প্রাকৃতিক শক্তি যার সাথে যুদ্ধ করে জেতা যায় না।’ অতিমানবীয় গুতিয়ানরা ছিল দেবতাদের আক্রোশের ব্যাবহারিক প্রয়োগের হাতিয়ার। গল্প শেষ হয় এভাবে : ‘খালের তীরে, যেখানে জাহাজগুলো বেঁধে রাখা হতো, লম্বা লম্বা ঘাসের জন্ম নিয়েছিল; আর মহাসড়কে জন্মেছিল অনুতাপের ঘাস।’
এই কথার মর্মার্থ হচ্ছে, সভ্যতা গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় খালি জায়গাগুলো ঘাসে ঢেকে যাচ্ছিল।
রাজার তালিকা থেকে আমরা জানতে পারি যে গুতিয়ান যোদ্ধারা গিলগামেশের আদি নিবাস উরুকের দখল নিয়েছিল। যেহেতু তারা একেবারে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল, তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে তারা দক্ষিণ সুমেরকে আক্কাদীয়দের দখল থেকে মুক্ত করতে পেরেছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ২২১৮ সালে নারাম সিন যখন মৃত্যুবরণ করেন, ততদিনে গুতিয়ানরা তার রাজত্বের অর্ধেকেরও বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছে। নারাম সিন তার সকল ঝুটঝামেলা তার পুত্র শার-কালি-শাররির কাছে রেখে যান এবং তিনি বাধ্য হন বর্বরদেরকে ঝেটিয়ে বিদায় করার দুরূহ প্রচেষ্টায় রত হতে। তিনি সফল হননি; তার শহর লাগাশও গুতিয়ানদের হাতে চলে যায় এবং তার রাজত্বের শেষের দিকে এসে দক্ষিণ সুমের পাকাপাকিভাবে শত্রুর কবজায় চলে যায়। গুতিয়ানরা দক্ষিণের আরও কিছু শহর দখল করে নেয় কিন্তু এলামসহ অন্য শহরগুলো শার-কালি-শাররির ব্যস্ততার সুযোগে নিজেদেরকে আক্কাদীয় সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে ফেলেন। এই শহরগুলো নামেই কেবল আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল; এরপর সেই পোশাকি আধিপত্যও আর থাকেনি।
একই ধারায় আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের সকল এলাকায় নেমে আসে অরাজকতা; বিশেষ করে খ্রিষ্টপূর্ব ২১৯০ সালে শার-কালি-শাররি মৃত্যুবরণ করার পর সমগ্র শাসনব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। যৌক্তিকভাবেই সুমেরীয় রাজার তালিকায় আসে প্রশ্নবোধক চিহ্ন—’রাজা কে?’
এক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশ্নটি হওয়া উচিত ছিল—’কে রাজা নন’; যা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সেই সময় কেউই দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। অবশেষে সার্গনের সাথে কোনোরকম আত্মীয়তা না থাকা একজন যোদ্ধা সিংহাসনে বসেন এবং তিনি প্রায় একুশ বছর ধরে রাজত্ব করতে সমর্থ হন।
অ-সার্গনীয় রাজবংশের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। শুধু জানি যে এটি অভিশপ্ত ছিল। শিলালিপিগুলোতে আগাদের পতন নিয়ে বিলাপ রয়েছে এবং সেখানে বলা হয়েছে যে খ্রিষ্টপূর্ব ২১৫০ সালের আশেপাশে গুতিয়ান দস্যুরা শহরটির প্রাচীর ভেদ করতে সমর্থ হয়েছিল। যেহেতু সেই শহরের কোনো ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পাওয়া যায়নি, আমরা নিশ্চিত নই শহরটির পরিণতি কী ছিল।
কোনো ধরনের ধ্বংসস্তূপের অনুপস্থিতি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে শহরটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু মাটির উপর শহরটির কোনো ধরনের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি, আমরা এটাও নিশ্চিত করতে পারি যে সেই শহরটিতে পুনরায় জনবসতি হয়নি। প্রাচ্যের প্রাচীন শহরগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একাধিকবার জনবসতি স্থাপিত হয়েছে, স্তরে স্তরে। পুরানো শহরের উপর নতুন করে শহর বানানো হয়েছে। তবে কিছু অভিশপ্ত শহর শত শত বছর ধরে জনমানবহীন থেকে গিয়েছে।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে গুতিয়ান ‘বর্বর’-রা সমগ্র মেসোপটেমীয় সমতলভূমিজুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তাদের নিজস্ব কৃষ্টির কোনো চিহ্ন তারা রেখে যায়নি কোথাও-না ছিল কোনো নতুন লিপি, না ছিল কোনো মূর্তি, শিলালিপি কিংবা অন্য কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের প্রমাণ। গুতিয়ানদের আক্রমণে পুরানো একটি কৃষ্টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল কিন্তু সেই জায়গায় নতুন কোনো কৃষ্টি তৈরি হয়নি।
রাজাদের তালিকায় আক্কাদীয় রাজা এবং গুতিয়ান ‘রাজা’-দের মাঝে একটি পরিষ্কার বিভাজক রেখা টেনে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, গুতিয়ানরা সিংহাসন দখল এবং সেটির উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুবই অপটু ছিলেন। মানিশটুশু ১৫ বছর, নারাম সিন ৫৬ বছর এমনকি নারাম সিনের বিপদগ্রস্ত সন্তানও ২৫ বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু আগাদে এবং নিকটবর্তী শহরসমূহের দখল নেওয়া গুতিয়ানদের রাজত্বকাল ছিল এলোমেলো এবং বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। তাদের বেনামি প্রথম রাজার পর আরও ২১ জন রাজার কথা শোনা যাদের মধ্যে শুধু একজনই সমর্থ হয়েছিলেন ৭ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে রাজত্ব করত। বেশির ভাগ শাসকই ১ বা ২ বছরের বেশি টিকতে পারেননি এবং শেষজনের রাজত্ব টিকে ছিল মাত্র ৪০টি দিন।
পুরানো এবং সমৃদ্ধ সুমেরীয় শহরগুলো ততদিনে সুমেরীয়, আক্কাদীয় ও গুতিয়ানদের মিশ্র শাসনের অধীনে চলে গিয়েছিল। তবে বর্বরদের শাসন খুব বেশিদিন সহ্য করেনি তারা।
এলামাইটদের সবচেয়ে কাছের শহর লাগাশ থেকে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। লাগাশের বীর যোদ্ধা গাদেয়া তার নিজ শহর থেকে গুতিয়ানদের বিদায় করে নিজে মসনদে বসেছিলেন। শাসনভার দখল করার পর তিনি সুমেরীয় যুগের মন্দিরগুলোকে অশুভ ছায়া থেকে বের করে এনে পুনর্নির্মাণ করেন। এই মন্দিরগুলো সম্ভবত আক্কাদীয় কিংবা গুতিয়ানদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
গাদেয়ার নামটি রাজাদের তালিকায় স্থান পায়নি, যার একটাই মানে থাকতে পারে—তার শাসন তার নিজ শহরের বাইরে বিস্তৃত হয়নি। তবে এতে তিনি দমে যাননি; তিনি নিজেকে ‘প্রকৃত মেষপালক’ খেতাব দিয়েছিলেন তার নিজের বিজয়ে মুগ্ধ হয়ে। তিনি বিজয়গাথায় আরও দাবি করেন যে তিনি নতুন করে এলামাইটদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন—তিনি তাদেরকে পর্বতমালার মধ্য দিয়ে তামা পাঠাতেন, ভারত থেকে ‘লাল পাথর’ আমদানি করতেন এমনকি তিনি মেসোপটেমিয়ার উত্তর অংশের সাথেও বাণিজ্যে রত ছিলেন। তার আরেকটি দাবি ছিল যে তিনি সিডার পর্বত পর্যন্ত একটি পথ তৈরি করেছিলেন যার মাধ্যমে বড়ো বড়ো কুড়াল দিয়ে সিডারকাঠ কেটে নিয়ে আসা হতো। সিডার পর্বত থেকে সিডার গাছের ডালগুলো এবং পাইন বন থেকে পাইনকাঠ বড়ো বড়ো সাপের মতো ভেসে আসত নদীপথে
যদি দাবিগুলো সত্য হয়ে থাকে তা হলে আমরা বলতে পারি যে গুতিয়ানরা নদীপথকে দখলে রাখতে পারেনি; বাণিজ্যের জন্য নদীপথ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ছিল।
এ ছাড়া গাদেয়া মাগান (ওমান) থেকে পাথর আনিয়েছিলেন নিজের মূর্তি বানানোর উদ্দেশ্যে। এই মূর্তিগুলোতে আমরা রাজা গাদেয়াকে দেখতে পাই একজন ধর্মভীরু মানুষ হিসেবে; তিনি উৎসবের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দুই হাত জোড় করে দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনারত। এটি ছিল অহংকারী নারাম সিনের একেবারেই বিপরীতধর্মী আচরণ। বুদ্ধিমান গাদেয়া কোনোভাবেই দেবতাদের রুদ্র রোষের কবলে পড়তে চাননি। এই কারণেই তিনি তার পূর্বসূরির ভুলগুলো এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
লাগাশের স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পরেই গিলগামেশের শহর উরুকও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হয় রাজা উতুহেগালের হাত ধরে। তবে নিজ শহরকে শত্রুমুক্ত করেই তিনি থেমে থাকেননি, তিনি গুতিয়ানদের উরুক থেকে বিদায় করে তার বিশেষ অনুগত সৈন্যদলকে নিয়ে চক্রাকারে অগ্রসর হতে থাকেন অন্যান্য শহরের দিকে। তার সৈন্যদল এতটাই অনুগত ছিল যে তারা তাকে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্ত পর্যন্ত অনুসরণ করতে রাজি ছিল। একে একে উর, এরিদু এবং সুদূর উত্তরের প্রাচীন ও পবিত্র শহর নিপ্পুর পর্যন্ত তিনি অগ্রসর হতে পেরেছিলেন।
নিপ্পুরকে গুতিয়ানদের হাত থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে সমতলভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের শেষ ধাপটি সম্পূর্ণ হয়। গুতিয়ানদের এলোমেলো শাসনকে রদ করে উতুহেগাল প্রতিটি শহরে সৈন্যবাহিনী নিযুক্ত করেন এবং বিভিন্ন শিলালিপিতে তিনি নিজেকে ‘চার-চতুর্থাংশের রাজা’ হিসেবে অভিহিত করা শুরু করেন যে খেতাবটি বহু বছর কেউ ব্যবহার করেনি। সম্ভবত সার্গনের চার পুত্রের পরে তিনিই প্রথম এই খেতাবের দাবিদার হয়েছিলেন।
তিনি নিজের ব্যাপারে বলতে গিয়ে লিখেছেন : ‘যে রাজার আদেশসমূহকে খণ্ডানো যায় না।’ তিনি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী গুতিয়ান নেতাকে আটক করেছিলেন, যাকে ‘পর্বতমালা থেকে আগত সাপ’ নামে ডাকা হতো। তাকে হাতকড়া পরিয়ে রাজসভায় নিয়ে আসা হয়েছিল এবং রাজা উতুহেগাল তার গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তবে উতুহেগাল বর্বরদের পরাস্ত করতে পারলেও খুব বেশিদিন মসনদের সুখ উপভোগ করতে পারেননি। প্রকৃত বিশ্বাসঘাতক সর্প হিসেবে আবির্ভূত হন তারই ডান হাত, সেনাপতি উর-নাম্মু, যিনি একইসাথে তার মেয়ের জামাইও ছিলেন।
গুতিয়ানদের উর থেকে তিরোহিত করার পর উতুহেগাল উর-নাম্মুকে সেই শহরের দায়িত্ব দেন আর সাথে সৈন্যসামন্তও প্রদান করেন। কিছুদিন পরে উর- নাম্মু তার নিজ রাজার বিরুদ্ধে সেই সৈন্যদল নিয়ে আক্রমণ চালান। রাজাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ আছে যে উতুহেগাল তার সদ্য দখলকৃত রাজত্বটিকে শাসন করতে পেরেছিলেন মাত্র ৭ বছর ৬ মাস ১৫ দিন। এটিই হচ্ছে রাজাদের তালিকায় বর্ণিত সবচেয়ে বিস্তারিত নথি; আর সকল রাজার ক্ষেত্রে শুধু বছর উল্লেখ করা আছে, মাস ও দিন নেই। এই নিখুঁত হিসাব থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে অপ্রত্যাশিতভাবে উতুহেগালের শাসনামলের অবসান ঘটেছিল; খুব সম্ভব যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন তারই জামাতার হাতে।
রক্তপাতের মাধ্যমে রাজত্ব শুরু হলেও উর-নাম্মু যখন উরুক ও উর শহরের শাসনভার গ্রহণ করলেন তখন তার আচরণ একজন যুদ্ধবাজ নেতার মতো ছিল না বরং তিনি একজন প্রকৃত রাজার মতোই কাজ করেছিলেন। তিনি বিচ্ছিন্নভাবে গুতিয়ানদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন; কিন্তু বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং অন্য রাজ্যগুলোর সাথে শান্তিচুক্তির রয়ে যাওয়া নথি থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে উর-নাম্মুর সাম্রাজ্য বিস্তারের পেছনে যুদ্ধবিগ্রহের পরিবর্তে কূটনৈতিক আলাপ আলোচনার ভূমিকাই মুখ্য ছিল। বলা বাহুল্য, হাসিতে উদ্ভাসিত কূটনীতিবিদের পেছনে দাঁড়ানো বিশাল সৈন্যবাহিনীর ভূমিকাকে ছোটো করে দেখারও কোনো অবকাশ নেই।
উর-নাম্মু যে ভূখণ্ডে জোরদখল করেননি সেখানে তিনি বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন। তিনি মারি শহরের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন; কিন্তু এই ব্যাপারে তার প্রথম স্ত্রীর (যিনি ছিলেন প্রয়াত উতুহেগালের মেয়ে) প্রতিক্রিয়া কী ছিল সেই ব্যাপারে ইতিহাস আমাদেরকে কিছু জানায় না।
তিনি তার দখলে থাকা সকল শহরজুড়ে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যার মাঝে ছিল মহান দেবতা এনলিলের উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি নতুন মন্দির। এমনকি সুসা শহরও তার আধিপত্যকে মেনে নিয়েছিল; যদিও আওয়ান শহর তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সচেষ্ট থেকে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
উর-নাম্মুর রাজত্বকালেই সুমেরীয়রা তাদের শেষ রেনেসাঁ উপভোগ করতে পেরেছিল। উর-নাম্মু এবং তার পরে আসা কিছু রাজার শাসনামলকে ‘উর-এর তৃতীয় রাজবংশের রাজত্ব’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। উর-নাম্মু সমতলভূমিগুলো শুধু দখলই করেননি, তিনি একইসাথে সেখানে মানবসভ্যতার পুনঃস্থাপনও ঘটিয়েছিলেন। তিনি রাস্তাঘাট ও প্রাচীরগুলো মেরামত করেছিলেন; বড়ো বড়ো খাল খনন করেছিলেন, যাতে শহরগুলোতে সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত হয়, কালো ময়লা পানির পরিবর্তে। তিনি দাবি করেছিলেন : ‘শহরগুলোতে মাছের প্রাচুর্য ছিল এবং আকাশজুড়ে ছিল পাখিদের কলতান। আমার শহরগুলো মাধবীলতার ছায়ায় ঘেরা।’
উর-নাম্মুর প্রশংসা করে লেখা কবিতাগুলোতে শুধু তার পুনর্নির্মাণের প্রকল্পগুলো নয় বরং আইনের শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়েও বলা হয়েছে—
‘আমি উর-নাম্মু
আমি আমার শহরের রক্ষাকর্তা
আমি অপরাধীদের আঘাত করি আর আমার ভয়ে তারা কাঁপতে থাকে
আমার ন্যায়বিচারের কারণে সুমের ও আক্কাদ একই পথে চলে
আমি তস্কর ও অপরাধীদের গলায় পা দিয়ে রাখি
আমি অশুভ কাজ করা লোকদের শাস্তি দিই
আমি ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠাতা, আমি দুষ্টের দমনকারী
মরুভূমির রাস্তাগুলো উৎসবের সাজে সজ্জিত
পথগুলো সুগম হয়েছে আমার কল্যাণে
আমিই সেই মেষপালক যার কারণে মেষের সংখ্যা বেড়েছে অগুনতি।’
সব ধরনের গোলযোগের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল সাময়িকভাবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ কিছুদিনের জন্য সুমেরীয় সমতলভূমি নিরাপত্তার বেষ্টনীতে থাকতে পেরেছিল।