অধ্যায় উনিশ – একীভূতকরণের জন্য যুদ্ধ
খ্রিষ্টপূর্ব ২১৮১ থেকে ১৭৮২ সালের মাঝে মেন্টহোটেপ প্রথম ভগ্নদশায় থাকা মিশরকে একীভূত করেন এবং মধ্য রাজবংশের গোড়াপত্তন হয়।
প্রায় দেড়শ বছর ধরে মিশরে কোনো প্রতাপশালী ফারাও ছিলেন না। আব্রাহামের আগমন ঘটেছিল নবম কিংবা দশম রাজবংশের সময়পর্বে।
মানেথোর বর্ণনা অনুযায়ী নবম রাজবংশের শুরু হয়েছিল আখখোস নামক একজন রাজার হাত ধরে। তিনি দক্ষিণের হেরাক্লিওপোলিস শহরে বসে সমগ্র মিশর শাসন করতেন। তার ভাষায় : ‘আখথোস ছিলেন মিশরের সর্বকালের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাসক। তিনি সমগ্র মিশরজুড়ে লোকজনের উপর জুলুম চালিয়েছেন।’
বিভিন্ন শিলালিপিতে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ‘আখতয় প্রথম’ হিসেবে। তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন হেরাক্লিওপলিস ও তার চারপাশের এলাকাগুলোর গভর্নর। তার নিষ্ঠুরতার গল্পগুলো সম্ভবত প্রচলিত হয়েছিল তিনি সমগ্র মিশর দখল করে নিতে উদ্যত হওয়ার পর থেকে।
আখতয় মৃত্যুবরণ করার পরপরই (মানেথোর বর্ণনামতে, তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন এবং দৈব প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কুমিরের পেটে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন) আরেকজন ব্যক্তি নিজেকে ‘ফারাও’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বসেন। আরও দক্ষিণে অবস্থিত থেবেস শহরে বসে সমগ্র মিশরের উপর আধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টায় রত সর্বশেষ ব্যক্তিটির নাম ছিল ইনটেফ।
মানেথো দাবি করেন যে আখতয়ের নবম রাজবংশের পর দশম ও একাদশ রাজবংশ রাজত্ব করেছিল। কিন্তু আদতে এরকম কিছুই হয়নি। তিনটি রাজবংশই একইসাথে ‘রাজত্ব’ করেছিল। এখানে ‘রাজত্ব করা’ শব্দটি বলা হলেও সেই সময় বিভিন্ন এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন যুদ্ধবাজ নেতা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন এই পুরো সময়টা জুড়ে—মিশরের বিভিন্ন ছোটো ছোটো এলাকার দখল নেওয়ার উদ্দেশ্যে। অপরদিকে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নররা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলতেন; কে ফারাও ‘আর তার নির্দেশ কী ফদ্ভ এক্সসেটা নিয়ে বিন্দুমাত্রও ভাবতেন না। এই প্রাদেশিক গভর্নররা নোমার্ক নামেও পরিচিত ছিলেন এবং তাদের দ্বারা শাসিত এলাকাসমূহকে ‘নোম’ বলা হতো। এরকম একজন নোমার্কের বাণীসংবলিত শিলালিপি থেকে জানা যায় তাদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা : ‘আমি পূজারিদের অধিকর্তা, সকল মরু-রাজ্যের অধিকর্তা এবং একইসাথে সকল ভাড়াটে সৈনিক ও সকল নোমেরও অধিকর্তা।’ আংখটিফি আরও গর্ব করেন, ‘আমিই মানবজাতির শুরু এবং শেষ। আমি আমার সকল পূর্বসূরি থেকে এগিয়ে গিয়েছি। উচ্চ মিশরে মানুষজন ক্ষুধায় মারা যাচ্ছিলেন এবং তারা তাদের সন্তানদের ভক্ষণ করছিলেন; আমি আমার শাসনামলে তাদেরকে এক নোম থেকে আরেক নোমেও যাওয়ার জন্য কোনো কারণ দিইনি। আমি সকল বীরের সেরা বীর, আমার কোনো তুলনা হয় না।’ অন্ত ত নিজের চোখে আঙ্খতিফি ছিলেন যে-কোনো ফারাওর সমকক্ষ।
মানেথোর নিখুঁত হিসেবের পেছনে রয়েছে তার নিজস্ব চিন্তাধারার প্রতিফলন; তিনি সকল এলোমেলো বিষয়কে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করতে পছন্দ করতেন। এ ছাড়া তিনি প্রাচীন চিন্তাধারাগুলোকে সহজে পরিত্যাগ করতেও রাজি ছিলেন না। প্রায় পনেরোশ বছর পরও তিনি স্বীকার করতে চাননি যে পৃথিবী থেকে ‘হোরাস’-এর প্রভাব সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ধরনের মতাবলম্বী মানুষ তিনি একাই নন। সেই সময়ের বেশির ভাগ লেখনীতেই দেখা গিয়েছে যে লিখিয়েগণ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মিশরের ভাংচুরের ব্যাপারটাকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। তাদের লেখায় ফুটে উঠেছে সুশৃঙ্খল নবম-দশম-একাদশ রাজবংশের কথা; আবার কেউ কেউ নবম ও দশমের কথা পুরোপুরি বাদ দিয়ে সরাসরি চলে গিয়েছেন একাদশ রাজবংশের গল্পে। বাকিরা পুরো ব্যাপারটিকে হালকা করে দিয়ে লিখেছেন যে উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে এরকম কোন্দল সর্বদাই বিরাজমান ছিল, এটি কোনো নতুন অবস্থা নয়। এই কোন্দল সাময়িক এবং শীঘ্রই আরেকজন প্রতাপশালী ফারাও এসে সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন।
প্রথম ইনটেফ নিজেকে উচ্চ ও নিম্ন মিশরের রাজা’ হিসেবে দাবি করেছিলেন, যার প্রমাণ রয়েছে বিভিন্ন শিলালিপিতে। এই দাবি অবশ্যই অতিরঞ্জিত ছিল, কারণ নিম্ন মিশরে তার কোনো প্রভাবই ছিল না এবং উচ্চ মিশরেও তিনি খুব বড়ো এলাকার শাসক ছিলেন না। কিন্তু তারপরও এই দাবির মাধ্যমে তিনি নিজেকে পূর্বের শক্তিমান উচ্চ মিশরের ফারাওদের কাতারে নিয়ে আসলেন যারা প্রায় সব সময়ই সমর্থ হয়েছিলেন উত্তরের বিদ্রোহীদের দমন করতে। হেরাক্লিওপোলিস থেকে আগত সৈন্যদের নিয়ে ইনটেফ যুদ্ধ করলেন একাধিকবার এবং ঐতিহাসিক উত্তর বনাম দক্ষিণের মধ্যকার যুদ্ধগুলো যেন আবার ফিরে এলো মিশরে। ইতোমধ্যে প্রতিপক্ষ নোমার্করা নিজেদের মাঝে যুদ্ধ করতে থাকলেন এবং পশ্চিমা সেমাইটরা সুযোগ বুঝে মিশরীয় বদ্বীপে অনুপ্রবেশ করতে লাগলেন। এক সৈন্যদল আরেক সৈন্যদলের বিরুদ্ধে লড়ছে’—এই ব্যাপারটিই তখন মিশরের সব এলাকার ক্ষেত্রে এক ধ্রুব সত্যে পরিণত হলো। আরেকটি বর্ণনায় বলা হয় : ‘মিশরে যুদ্ধ হচ্ছে কবরস্থানে; এক দল আরেক দলের মৃতদের কবরগুলো ধ্বংস করছে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে।’
তারপর একাদশ রাজবংশের অর্ধপথ পার হওয়ার পর থেবেস-এর সিংহাসনে বসেন প্রথম মেন্টুহোটেপ। তার নামকরণ হয়েছিল থেবেনদের যুদ্ধের দেবতার নামানুসারে। তিনি তার শাসনামলের প্রথম বিশটি বছর কাটিয়েছিলেন উত্তর থেকে যুদ্ধ করতে করতে নিম্ন মিশর পর্যন্ত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। নার্মার আর খাসেখেমউই-এর মতো তার জীবনটা এত সহজ ছিল না; তাকে শুধু উত্তরের রাজার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে হয়নি, সাথে জুটেছিল নোমার্কদের বাহিনীও। তার প্রথম বড়ো বিজয় ছিল এবিডোসের গভর্নরের বিরুদ্ধে। তার সেই বিজয়কে অমর করে রাখার জন্য একটি গণকবর তৈরি করা হয়। কবরের পাশে নির্মিত স্মৃতিসৌধে ষাটজন সৈন্যের মৃতদেহ রাখা হয়েছিল যারা সবাই সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
তিনি যুদ্ধ করতে করতে উত্তরে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং হেরাক্লিওপোলিসের যোদ্ধারা পিছু হটতে লাগল। মেন্টহোটেপ সেখানে পৌঁছানোর ঠিক আগে দিয়ে দশম রাজবংশের শাসক-রাজা সহসা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। তার উত্তরাধিকারী কে হবে এটা নিয়ে যখন তার বংশধররা বচসায় লিপ্ত তখন শহরের রক্ষণের দায়িত্বে থাকা সৈন্যরাও এলোমেলো হয়ে গেল। খুব সহজেই মেন্টহোটেপ তার বাহিনী নিয়ে শহরের ঢুকে পড়লেন।
এই সহজ জয়ের মাধ্যমে তার হাতে থেবেস ও হেরাক্লিওপোলিসের দখল চলে এলো; কিন্তু অবিভক্ত মিশর হাতে পেতে তখনও আরও অনেক দেরি নোমার্করা তাদের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিতে একেবারেই ইচ্ছুক ছিলেন না; তাদের সাথে অনেক বছর ধরে যুদ্ধ চলতে লাগল। সেই সময়কার সকল সরকারি কর্মকর্তার আঁকা ছবিতে তাদের সাথে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র দেখা যেত—প্যাপিরাস কিংবা অন্য কোনো দাপ্তরিক যন্ত্রপাতির পরিবর্তে; যা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে সেকালে অফিস করার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই বেশি সময় কেটেছে আমলাদের।
কিন্তু তার রাজত্বের ৩৯ বছর হতে হতে মেন্টহোটেপ তার নামের বানান পরিবর্তন করে একটি ‘হোরাস’ নাম নিলেন, যার মানে হলো ‘দুই ভূমির যোগসূত্র স্থাপনকারী’। হোরাস নাম নেওয়ার ব্যাপারটি প্রত্যাশিত হলেও তার ৪২ বছরের শক্তির লড়াইয়ের কোথাও উত্তর ও দক্ষিণের মাঝের সংঘর্ষের ব্যাপারটির কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা সেই গৃহযুদ্ধের সমাধানকারী হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে তিনি মিশরের রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
তার বোনা মিথ্যার জাল কাজে এসেছিল। অল্পদিনের মাঝেই বিভিন্ন লেখনীতে তার নাম স্বনামধন্য নার্মারের পাশাপাশি উচ্চারিত হতে শুরু করে। তাকে অনেকেই দ্বিতীয় নার্মার হিসেবে অভিহিত করেন, যিনি ছিলেন একজন কালজয়ী রাজা। তার অসামান্য কীর্তি ছিল উচ্চ ও নিম্ন মিশরকে একীভূতকরণ।
মেন্টুহোটেপের রাজত্বের শেষভাগে অন্তর্বর্তীকালীন যুগের সমাপ্তি হয়ে শুরু হয় মধ্যবর্তী যুগ। এই সময় মিশর আবার ফিরে যায় তার গৌরবময় সময়ে—মধ্যম রাজত্বের উদ্ভব হয়। মানেথোর মতে, তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর রাজত্ব করতে পেরেছিলেন।
কবর পর্যবেক্ষণ করে জানা যায় যে তার অনধিক পাঁচজন স্ত্রী ছিলেন কিন্তু তার কোনো পুত্রসন্তানের ব্যাপারে কোথাও কোনো উল্লেখ নেই। পরবর্তী দুজন রাজার সাথে মেন্টহোটেপের কোনো রক্তীয় সম্পর্ক ছিল না এবং তারাও একে অপরের আত্মীয় ছিলেন না। তৃতীয় রাজা ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিক। তার নাম ছিল আমেনেমহেত। তিনি তৃতীয় মেন্টহোটেপের উজির ছিলেন। এসব ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করে আমরা বলতে পারি যে স্বর্গীয় ও রাজকীয় রক্তকে দেশ শাসনের অত্যাবশ্যক গুণ হিসেবে আর বিবেচনা করা হচ্ছিল না।
দ্বাদশ রাজবংশের প্রথম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হলে প্রথম আমেনেমহেত। জন্মগতভাবে একজন দক্ষিণ মিশরীয় (শিলালিপির লেখনী থেকে জানা যায় যে তার মায়ের জন্মস্থান ছিল উচ্চ মিশরের এলিফেন্টাইন) আমেনেমহেত প্রথমেই নিজেকে নার্মারের মতো ‘একীভূতকারী’ শাসকদের কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। তিনি তার নবপ্রাপ্ত শাসনভারকে উদযাপন করার জন্য একটি নতুন রাজধানী শহর তৈরি করলেন। তিনি মেমফিসের বিশ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত এই শহরের নাম দিলেন ‘ইতিজ তাওয়ায়’ বা ‘দুই দেশের দখলকারী’।
শহরটি এমন জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল যাতে একইসাথে তা দেশের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের মাঝে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। আগে মেমফিস ছিল মিশরীয় দেবতাদের উপাসনার প্রধান জায়গা; দেশের পবিত্রতম মন্দিরগুলো সেখানেই ছিল। কিন্তু নতুন এই শহর আসার পরে আর তা ফারাওদের বাসস্থান হিসেবে বলবৎ রইল না।
যে-কোনো বুদ্ধিমান রাজার মতোই আমেনেমহেতও তার রাজ-লিখিয়েদের নির্দেশ দিলেন তার ব্যাপারে একটি ‘প্রফেসি’ বা ভবিষ্যদ্বাণী রচনা করতে। এই লেখাটি তার রাজত্বের শুরুর দিকে সমগ্র দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ‘নারফার্তির ভবিষ্যদ্বাণী’ নামের এই লেখাটি ‘সম্ভবত’ আরও পাঁচশো বছর আগে রাজা সেফরুর আমল থেকে এসেছে। রাজা সেফরু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলছেন যে মিশর পূর্ব থেকে আগত এশীয় দুর্বৃত্তদের দখলে চলে যাবে। এখানে নিশ্চিতভাবেই আরও অনেক পরের একটি প্রকৃত ঘটনাকে ‘সেফরুর দুশ্চিন্তা’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে; কেননা ৫০০ বছর আগে ফেরুর পক্ষে এই ঘটনার ব্যাপারে চিন্তা করার কোনো উপায় ছিল না। তবে সৌভাগ্যজনকভাবে সেফরুর ভবিষ্যদ্বাণীটি বেশ ইতিবাচক ছিল—
দক্ষিণ থেকে এক রাজার আগমন হবে
তিনি শ্বেত মুকুট ধারণ করবেন
তিনি লাল মুকুটটি মাথায় পরবেন
এশিয়াটিকরা তার তলোয়ারের নিচে মারা পরবে
বিদ্রোহীরা তার রুদ্র রোষের শিকার হবে
আর বিশ্বাসঘাতকরা তার শক্তিমত্তা অনুভব করবে
তিনি শাসকের প্রাচীর নির্মাণ করবেন
যা এশিয়াটিকদের ঠেকাবে, মিশরে প্রবেশ করা থেকে।
মনের মতো ভবিষ্যদ্বাণী তৈরি হওয়ার পর আমেনেমহেত সেটিকে কাজে রূপান্তরের প্রচেষ্টায় নামলেন। তার পুত্র সেনুস্রেতের সহায়তায় তিনি মিশরীয় বদ্বীপে হামলা চালানো ‘বালুতে বসবাসকারী’ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় গেলেন। তিনি বদ্বীপের পূর্বে একটি দুর্গ তৈরি করলেন যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের হামলা সহজে প্রতিহত করা যায়। বলা বাহুল্য, তিনি এই দুর্গের নাম দিলেন “শাসকের প্রাচীর’।
তার রাজত্বের প্রায় শেষের দিকে আমেনেমহেত যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি সঞ্চয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি তার নতুন রাজধানী ইতিজ-তাওয়াইতে নিজের জন্য একটি ছোটো পিরামিড নির্মাণ করালেন। এটি খুবই ছোটো আকারের পিরামিড ছিল কিন্তু তা প্রাচীনকালের নিয়মকানুনের দিকে ফিরে যাওয়ার চিহ্নস্বরূপ সগৌরবে দণ্ডায়মান ছিল।
আমেনেমহেত সম্ভবত হাওয়ায় ভাসছিলেন, এই ভেবে যে তিনি তার মহান পূর্বসূরি নার্মার, খুফু ও খাফরের কাতারে পৌঁছে গিয়েছেন। আবারও ফারাওদের স্বর্গীয় ক্ষমতা ফিরে এসেছিল তার মাধ্যমে। এরকম অবস্থায় হঠাৎ করেই আমেনেমহেতকে হত্যা করা হলো।
কিছুদিনের মাঝেই পুত্র সেনুতে লিখলেন কীভাবে তার পিতা আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। তার পিতার নিজের কণ্ঠেই সে ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি : ‘আক্রমণের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি টের পেলাম যে আমি আমার নিজের দেহরক্ষী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। আমি যদি দ্রুত নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পারতাম তা হলে আমি সেই দুষ্কৃতিকারীদের তাড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু রাতের বেলায় কেউ বলশালী থাকে না, কেউ একা একা যুদ্ধ করতে পারে না। আমার উপর যখন আঘাতের পর আঘাত নেমে আসছিল তখন তুমি আমার পাশে ছিলে না, হে পুত্র!’
‘সিনুহের উপাখ্যান’ নামক গল্পটি এই ঘটনার আরও কিছুদিন পরে লেখা হয়েছিল। সেখানে রয়েছে আরও বিস্তারিত বর্ণনা। সেনুস্রেত দক্ষিণে অবস্থিত ‘লিবিয়ানদের ভূমি’তে যুদ্ধ করছিলেন। নীল নদের পশ্চিমে অবস্থিত মরুভূমিতে কিছু মরু-যোদ্ধা দীর্ঘদীন ধরে মিশরের সীমানায় গোলযোগ সৃষ্টি করে আসছিল। তার পিতার হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে সেনুস্রেত তার সৈন্যবাহিনীকে পেছনে ফেলে বাজপাখির মতো উত্তরদিকে উড়ে গিয়ে ইতিজ-তাওয়ায় শহরে চলে আসলেন, যা ছিল একটি দীর্ঘ ও বিপদসংকুল অভিযান। রাজপুত্রের আগমনের খবর পেয়ে সভাসদ সিনুহে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এশিয়াটিকদের ভূমিতে পালিয়ে গেলেন, কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে হত্যাকাণ্ডের সাথে তার নামটি জড়ানো হবে।
মরিয়া না হলে কোনো মিশরীয় কখনও কানান শহরে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেন না।
সিনুহের যাত্রাটি খুবই ঝামেলাপ্রদ ছিল। তাকে শাসকের প্রাচীর দুর্গের পাশ দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে যেতে হলো। তার ভাষায় : ‘সৈন্যদের চোখে না পড়ার জন্য আমি মাথা নিচু করে ঝোপের মাঝে লুকিয়ে রইলাম।’ তাকে প্রায় ত্রিশদিন ধরে মরুভূমির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। অবশেষে তিনি মধু আর দুগ্ধজাত পণ্যসমৃদ্ধ কানান শহরে পৌঁছান। তিনি কানানকে ‘ইয়া’ নামে সম্বোধন করেছিলেন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। তিনি বলেন : ‘সেখানে যবের খেত ছিল। আর প্রচুর পরিমাণে আঙুরের খেত। সেখানে সুপেয় পানির চেয়ে মদ বেশি সহজলভ্য ছিল এবং সাথে ছিল প্রচুর পরিমাণে মধু ও তেল।’
আরও বেশ কিছুদিন পরে তিনি তার নিজ ভূমিতে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। সেনুস্রেত তার পিতার সিংহাসনে বসার পর তাকে সাধারণ ক্ষমা প্রদান করেছিলেন। সিনুহে নিশ্চিত করেছেন যে কানান শহরের বাসিন্দাদের মাঝে বসবাস করার ব্যাপারটি মোটেও সুখকর ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে এশিয়াটিকদের সাথে বসবাস করার কারণে তার সারা শরীর কেশাচ্ছাদিত হয়ে গিয়েছিল। সারা শরীরের সব চুল ছেঁটে ফেলার পরেই কেবল তাকে পশ্চিমা সেমাইটদের সমাজে পুনঃপ্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
সেনুস্রেত তার বাবার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন সেই দেহরক্ষীকে ফাঁসি দিয়ে। তার রাজত্ব ছিল সমৃদ্ধ। মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে তিনি তার পুত্রকে সহ-শাসকের পদে বসিয়েছিলেন—পূর্বের দ্বাদশ রাজবংশের ফারাওদের মতো। সহ-শাসকদের কাজ ছিল এক ফারাও থেকে আরেক ফারাওর কাছে ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটিকে সহজতর এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমাধা করা। তবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ফারাওদের আরেকটি প্রাচীন রীতির প্রতি অবহেলা প্রকাশ করা হয়েছিল। পূর্বে ধারণা করা হতো যে ফারাও রাজার মৃত্যুর পর সে তার পুত্রের মাঝে পুনরায় জন্মলাভ করে। কিন্তু ততদিনে ফারাওদেরকে দেবতা বা সৃষ্টিকর্তার সমতুল্য ভাবার দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। এই পরিবর্তিত ভাবমূর্তিটি প্রকাশ পেয়েছে দ্বাদশ রাজবংশের রাজাদের বিভিন্ন মূর্তির মাঝে। সকল আত্মপ্রতিকৃতিগুলোতে মানুষের চেহারায় দেখানো হয়েছে। চতুর্থ রাজবংশের রাজাদের মতো দেবতাসুলভ পৌরাণিক চেহারা সেখানে একটিও দেখা যায়নি।
এভাবে একের পর এক শাসক আসতে থাকেন। মিশর তার হারানো গৌরব কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছিল এবং সর্বত্র বিরাজ করছিল শান্তি। সেনুস্রেতের পুত্রের পর তার নাতি এবং তারপর তার নাতির ছেলে তৃতীয় সেনুস্রেত ক্ষমতায় এসেছিলেন। তৃতীয় সেনুস্রেতকে মনে রাখার পেছনে তার বিশাল আকার (সম্ভবত তিনি সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ছিলেন) এবং বিশেষভাবে নির্মিত মূর্তিগুলো বড়ো ভূমিকা রেখেছে। তার মূর্তিগুলোতে দেখা যায় ভাবলেশহীন চেহারা, বড়ো পাপড়িযুক্ত বিস্ফারিত চোখ এবং লম্বা কান। তার কান দুটো এতই বড়ো ছিল যে তা শিরস্ত্রাণের পেছনদিক পর্যন্ত চলে যেত।
দুর্গগুলো পুরানো আমলের রাজপ্রাসাদের মতো সুবিশাল ছিল এবং এতে টাওয়ার, র্যাম্পার্ট ও মোট—সবকিছুই ছিল। দ্বিতীয় ক্যাটারাক্ট বা খাঁজের কাছাকাছি অবস্থিত বুহেনের দুর্গে ছিল ১৩ ফুট প্রস্থের কাদামাটির ইটের তৈরি প্রাচীর, পাঁচটি উঁচু মিনার এবং দ্বৈত দরজা ও উত্তোলনযোগ্য সেতু। দুর্গের ভেতরে একটি গোটা শহর, রাস্তাঘাট ও মন্দিরের সমপরিমাণ জায়গা ছিল।
বুহেনে বসবাসরত মিশরীয়রা এসব প্রাচীরের বাইরে ঘুমাতেন না, যেখানে নুবিয়ানরা তাদেরকে খুঁজে পেতে পারত। সেনুস্রেতের নির্দয় আক্রমণের সময় মিশরীয়রা নুবিয়ান পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল আর মহিলা ও শিশুদের দাসদাসী হিসেবে ধরে নিয়ে এসেছিল। তারা সব ফসলি জমিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এবং নগর রক্ষাকারী প্রাচীরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল।
এই বর্বর হত্যাকাণ্ড ও নারকীয় আচরণের মাধ্যে মিশরের সবচেয়ে গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে সাময়িকভাবে বিপ্লবীদের দমন করা গিয়েছিল। তৃতীয় সেনুতে মারা যাওয়ার সময় তার ছেলের কাছে দেশের ভার দিয়ে গেলেন এবং মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি বিরাজ করতে লাগল। বহু বছর পর মিশর পুনরায় বিরোস শহরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করল সিডার প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে। সিনাই-এর খনিগুলোকে পূর্ণাঙ্গভাবে খনন করা হলো এবং নীল নদের বন্যাগুলোও ফিরে এলো আগের মতো করেই।
মধ্যম সাম্রাজ্য ছিল উৎকর্ষের শীর্ষে, যদিও কোনো দেবতা নয় বরং ক্ষমতায় আসীন ছিলেন একজন মানুষ।