অধ্যায় এক – রাজত্বের সূর্যোদয়

অধ্যায় এক – রাজত্বের সূর্যোদয় 

সুদূর অতীতে, পারস্য উপসাগরের ঠিক উত্তরে, সুমেরীয়রা উপলব্ধি করলেন এক চরম সত্য : শহর পরিচালনার জন্য শাসকের প্রয়োজন। 

হাজার হাজার বছর আগে সুমেরীয় রাজা আলুলিম এরিদু নামক একটি নদীর তীর ঘেঁষে তৈরি করা, প্রাচীর ঘেরা, সুরক্ষিত শহর শাসন করতেন। পরবর্তীকালে রোমের বাসিন্দারা এই জায়গাটির নাম দেন মেসোপটেমিয়া। আলুলিম শক্তির শিখরে আরোহণ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মানবসভ্যতার সূর্যোদয় ঘটে এবং তিনি প্রায় ত্রিশ হাজার বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। 

সুমেরীয়দের কাছে কল্পনা ও বাস্তব জগতের মধ্যে তেমন কোনো বিভেদ ছিল না এবং এই কারণেই শক্তিমান রাজার ত্রিশ হাজার বছরব্যাপী শাসনামল তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। অপরদিকে, আলুলিমের শাসনামল থেকেই ‘সভ্যতার শুরু’—কথাটি হজম করাও তাদের জন্য বেশ কঠিন ছিল, কেননা তারা মনে করত যে সুমেরীয়রা সব সময় সভ্যই ছিল। সুমেরীয় রাজাদের তালিকায় (সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম ঐতিহাসিক দলিল) আলুলিমের শাসনামলকে বর্ণনা করা হয়েছে নিখুঁত, স্বর্গীয় সময় হিসেবে। 

কিন্তু পেছন ফিরে তাকালে আমরা একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রথম রাজার শাসনামলকে পর্যালোচনা করতে পারি। রাজা ও রাজত্বের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির ভাগ্যের চাকা নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। এই সময় থেকেই শুরু হয় মানুষ, তাদের মালিকানাধীন জমিজমা এবং শাসকদের মাঝে একটি জটিল সম্পর্ক। 

আমরা আলুলিমের রাজত্বের সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ উদ্‌ঘাটন করতে ব্যর্থ হয়েছি, কেননা সুমেরীয় রাজাদের তালিকা ছাড়া এই রাজত্বের ব্যাপারে আর কোথাও কোনো উল্লেখ নেই। এই লিস্টটি কাদামাটির ট্যাবলেটে খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ সালের আশেপাশে কোনো এক সময় খোদাই করা হয়েছিল কিন্তু লিপিবদ্ধ বার্তাটির সময়পর্ব আরও অনেকদিন আগের। সুমেরীয় রাজাদের তালিকায় দেওয়া ক্রমপঞ্জি আর আমাদের জানা অতীতের মাঝে আকাশপাতাল ফারাক। সেখানে বলা হয়েছে আলুলিম ২৮ হাজার বছর এবং তার উত্তরসূরি আলালগার ৩৬ হাজার বছর ধরে রাজত্ব করেন। 

তাদের রাজত্বের বর্ণিত দৈর্ঘ্য থেকে অনুমান করা যায় যে দুজন রাজাই প্রকৃতপক্ষে উপদেবতা ছিলেন; তাদেরকে ইতিহাস নয় বরং পুরাণের পাতা থেকেই নেওয়া হয়েছে। হয়তো আলুলিম এবং তার উত্তরাধিকারী দীর্ঘদিন ধরে রাজত্ব করেছিলেন, যেটাকে দেবতাদের রাজত্বের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুমেরীয় নথি থেকে আরও জানা যায় যে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগটি সংগঠিত হওয়ার আগে আটজন রাজা রাজত্ব করেছিলেন। সেই সর্বগ্রাসী বন্যায় তাদের পুরো ভূমিখণ্ড ভেসে যাওয়ার আগে আটজন রাজার প্রত্যেকে তিন হাজার ছয়শ বছরের যে-কোনো একটি গুণিতক পরিমাণ বছর রাজত্ব করেছিলেন, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে তালিকায় বর্ণিত বছরের হিসাব আমাদের বোধশক্তির বাইরের। আমরা সর্বোচ্চ যেটি করতে পারি তা হচ্ছে প্রথম সুমেরীয় রাজাকে দূরবর্তী অতীতের রাজা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। 

মানচিত্র-১ : অতি প্রাচীন মেসোপটেমিয়া 
মানচিত্র-১ : অতি প্রাচীন মেসোপটেমিয়া 

রাজা আলুলিমের রাজত্বের মেয়াদ যা-ই হোক না কেন, তার সময়কার মেসোপটেমিয়া আমাদের জানা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীবেষ্টিত পারস্য উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত উর্বর ভূখণ্ডের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন ছিল। ভূতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মানব ইতিহাসের সূচনালগ্নে (খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০০ সালকে আমরা তথ্যসূত্র হিসেবে নিতে পারি) মেরু অঞ্চল থেকে বরফ ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণে এবং তা প্রায় ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত চলে এসেছিল। বরফের মধ্যেই বেশির ভাগ পানি আটকে ছিল এবং এই কারণে সাগর ও মহাসাগরগুলোর উচ্চতা অনেক কম ছিল। পারস্য উপসাগরের উত্তরের অংশটি তখন ছিল একটি সমতলভূমি যার মাঝ দিয়ে ছোটো ছোটো খালবিল প্রবাহিত হতো। আধুনিক কাতারের সাথে সংযুক্ত সমতলভূমিটিই ছিল তখনকার সমুদ্রতট এবং নিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে সেই ভূখণ্ড সর্বদাই আর্দ্র থাকত। 

কিছুদিনের মাঝেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে বরফখণ্ডগুলো গলতে শুরু করল। ভূতত্ত্ববিদদের হিসেব অনুযায়ী এই প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০০ থেকে ৬০০০—এই পাঁচ হাজার বছর ধরে। এর ফলে সাগরে পানির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সেটি কাতার পেরিয়ে বাহরাইন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ক্রমবর্ধনশীল পানির নিচে অনেক জনবসতি তলিয়ে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ সাল নাগাদ ব্রিটেন ইউরোপের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং পারস্য উপসাগরের ব্যাপ্তি কুয়েতের দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। কুয়েতের উত্তরে অবস্থিত সমতলভূমিটি শুধু একটি বা দুটি নদী দিয়ে নয় বরং ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বেশ কিছু নদীপথের সন্নিবেশে আর্দ্র ও উর্বর ভূমি হয়েছিল। স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ছবিতে এখনও সেসব নদীর গতিপথের চিহ্ন দেখা যায়। বুক অব জেনেসিস (বাইবেল)-এ বর্ণিত আছে এই সমতলভূমি দিয়ে বয়ে যাওয়া চার মাথাওয়ালা একটি নদীর কথা। 

যদিও এই ভূমিটি নদনদীর বিনুনি থেকে পানি পাচ্ছিল, তারপরও তা আস্তে আস্তে শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হয়ে যাচ্ছিল। বরফ তিরোহিত হওয়াতে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল। উপসাগরের উত্তরদিকে বৃষ্টির পরিমাণ কমে গিয়েছিল এবং শুধু শীতকালে অনিয়মিত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতো সেখানে। গ্রীষ্মকালে অবারিত ভূমির উপর দিয়ে লু হাওয়া বয়ে যেত। প্রতি বছর জলস্রোত নদীর তীরবর্তী ভূমিগুলোকে ভাসিয়ে দিত আর চলে যাওয়ার সময় পলিমাটি রেখে যেত। একাধিক পানির উৎস থেকে আসা পলিমাটি জমে জমে উৎসগুলোকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল আর উপসাগর ধীরে ধীরে উত্তরদিকে বিস্তৃত হচ্ছিল। 

দক্ষিণের সমতলভূমির বাসিন্দারা, যারা উপসাগরের একদম কাছে থাকত তাদেরকে বেঁচে থাকার জন্য একটি অনিশ্চয়তায় ভরা ভূ-বৈচিত্র্যের সাথে সংগ্রাম করতে হতো। বছরে একবার তাদের আবাদি জমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে যেত। আবার বন্যার প্রকোপ কমে গেলে মাটি শুকিয়ে শক্ত হয়ে যেত। তাদের ছিল না কোনো পাথর, ছিল না কাঠের উৎস হিসেবে কোনো বন কিংবা গবাদি পশুকে খাওয়ানোর জন্য কোনো প্রশস্ত তৃণভূমি। তাদের হাতের কাছে ছিল শুধু প্রচুর পরিমাণ নলখাগড়া যা নদীর তীরজুড়ে জন্মাত আর ছিল প্রচুর পরিমাণ কাদামাটি। ঢালাই করা শুষ্ক কাদার সাথে নলখাগড়া মিশিয়ে সেটাকে উচ্চ তাপে সেঁকে তৈরি করা হতো বাড়িঘর বানানোর মূল উপাদান—ইট। এই প্রক্রিয়ায় বানানো ইট দিয়েই তৈরি হতো শহরের উচ্চ প্রাচীর, ঘটিবাটি ও বাসনকোসন। তারা প্রকৃতপক্ষেই ‘মাটির মানুষ’ ছিলেন। 

সুমেরীয় ভাষার সাথে অন্য কোনো ভাষার কোনো সম্পর্ক ছিল না। যতদিনে সুমেরীয়রা লিখতে শিখেছিলেন, তাদের ভাষা ততদিনে অন্য ভাষার শব্দ দিয়ে অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সুমেরীয় শব্দগুলোর মূল এসেছে এক ধরনের ধ্বনি থেকে কিন্তু পুরানো লেখায় ডজন ডজন অচেনা ও ভিন্ন ধরনের দ্বৈত ধ্বনির শব্দ পাওয়া যায়। (সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি নদীর নাম, যেগুলো সমতলভূমির মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছিল—চাষি, জেলে, কাঠমিস্ত্রি, তাঁতি এবং আরও অনেক পেশার মানুষদের নামে। এমনকি এরিদু শহরের নামটিও এক ধ্বনির নয়।) 

এই শব্দগুলো সেমিটিক; আর এতে প্রমাণ হয় যে উত্তরের সমতলভূমিতে শুধু সুমেরীয়রাই থাকেনি। সেমিটিক শব্দগুলো দক্ষিণ ও পশ্চিমের মেসোপটেমীয় সমতলভূমির বাসিন্দাদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

মেসোপটেমিয়ার উত্তর ও পূর্বদিকে অবস্থিত পর্বতমালা যাযাবরদের নিরুৎসাহিত করত কিন্তু আরব উপদ্বীপ কিংবা উত্তর আফ্রিকা থেকে ভ্রমণ করে আসা অনেক সহজতর ব্যাপার ছিল। সেমাইটরা এই কাজটিই করেছিল; তারা সুমেরীয়দের সাথে থিতু হয়েছিল এবং তাদেরকে তাদের ভাষার শব্দাবলি ধার দিয়েছিল। আর শুধু ভাষাই নয়, সেমাইটরা চাষাবাদের বিভিন্ন প্রক্রিয়া, ঝুড়ি বানানো, চামড়া ও কাঠের কাজ ইত্যাদি পেশা ও তৎসংক্রান্ত দক্ষতা নিয়ে এসেছিল মেসোপটেমিয়াতে। 

তা হলে সেমাইটরা চাষ করা শিখল কাদের কাছ থেকে? সম্ভবত তারা ধাপে ধাপে এটি শিখেছে, যেমনটা শিখেছিল ইউরোপের এবং আরও উত্তরে থাকা মানুষরা। সম্ভবত বরফখণ্ডগুলো গলে যাওয়ার পর মাংসের উৎস হিসেবে সহজলভ্য প্রাণীগুলো উত্তরের দিকে চলে গিয়েছিল এবং সংখ্যায়ও অনেক কমে গিয়েছিল। এই পশুর পালকে অনুসরণ করা শিকারির দল হতোদ্যম হয়ে মাংসের সাধনা বাদ দিয়ে উষ্ণ ভূমিতে বন্য শস্য কেটে নেওয়ার কাজে মন দেয় এবং তারা কেবল তখনই তাদের বাসস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হতো যখন আবহাওয়া বৈরী ভাব প্রকাশ করত (যেমনটা স্থানীয় উত্তর আমেরিকানরা করছিল, জ্যাকুয়েস কার্টার সেখানে হাজির হওয়ার আগ পর্যন্ত)। 

এরপর সম্ভবত এসব ‘সাবেক যাযাবর’ শিকারিরা বন্য শস্য কাটা থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়ে সেগুলোর সুষ্ঠু চাষাবাদের দিকে নজর দেয় এবং অবশেষে তারা পূর্ণাঙ্গ গ্রাম্য জীবনের লোভে ভ্রমণ থেকে ইস্তফা দেয়। কথিত আছে যে নারী ও পুরুষের পেট ভরা থাকলে তারা অধিক বাচ্চাকাচ্চার জন্ম দেয়। আধুনিক তুরস্ক থেকে শুরু করে নীল নদের উপত্যকা পর্যন্ত বিশাল এলাকায় খুঁজে পাওয়া কাস্তে ও শানপাথর দেখে বোঝা যায় যে সেই বাচ্চাগুলো বড়ো হওয়ার পর জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল আর সাথে নিয়ে গিয়েছিল তাদের পিতামাতার কাছ থেকে শেখা চাষবাসের দক্ষতা। নতুন জায়গায় গিয়ে তারা তাদের সেই সক্ষমতাকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিল। 

প্রাচীন গল্পগুলো আরেকটি বস্তুর অবতারণা ঘটায় মানবজীবনে : সেমাইটদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুমেরীয়রা তাদের গ্রামের চারপাশে বিভিন্ন ফসলের বীজ বপন করে তাদের জীবনকে এতটাই জটিল করে তুলেছিল যে তাদের একজন রাজার প্রয়োজন হয় সকল সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার জন্য। এভাবেই চিত্রপটে আবির্ভাব ঘটে এরিদুর রাজা আলুলিমের আর উন্মোচিত হয় মানবসভ্যতার দ্বার। যে যা-ই বলুক না কেন, সভ্যতাই আমাদেরকে বিশৃঙ্খলামুক্ত রাখে। সভ্য শহরে উঁচু প্রাচীর থাকে যা তার ভেতরের নিয়মতান্ত্রিক রাস্তাগুলোকে বাইরের দুনিয়ার বন্য আবর্জনা থেকে বাঁচিয়ে রাখে। 

প্রত্নতত্ত্ববিদ স্টুয়ার্ট পিগট প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার উপর লেখা ম্যাক্স ম্যালোয়ানের ধ্রুপদি গবেষণাপত্রের ভূমিকায় লিখেছিলেন : ‘হঠাৎ হঠাৎ কিছু জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয় যারা পুরানো ঐতিহ্যের সাথে তাল মেলানোর চেয়ে নতুনত্ব ও পরিবর্তনের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। এসব উদ্ভাবনী শক্তিসমৃদ্ধ সমাজগুলোকেই আমরা সভ্যতার গোড়াপত্তনকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।’ 

প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে আরও প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা থেকেই সভ্যতার উৎপত্তি ঘটে; যেমন কেউ যাতে খুব বেশি খাদ্য কিংবা পানীয়র দখল না পায় সেটাকে নিশ্চিত করার জন্য। সভ্যতার সূর্যোদয় ঘটেছিল উর্বর ক্রিসেন্টে কিন্তু তার পেছনের কারণ এটা না যে সেই জায়গাটি স্বর্গের বাগানের মতো, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরপুর ছিল। বরং সেটি এতটাই বৈরী এলাকা ছিল যে সেখানে অবস্থিত যে-কোনো আকারের গ্রামকে খুব সাবধানে, সতর্ক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টিকে থাকতে হতো। কৃষকদের মিলেমিশে খালবিল খনন করতে হতো আর জলাধারে বন্যার পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হতো। কোনো একজন ব্যক্তিকে এই মিলেমিশে কাজ করার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হতো আর সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হতো যাতে পানির সুষ্ঠু বণ্টন হয়। সেই ‘একজন’-কে এটাও নিশ্চিত করতে হতো যে কৃষকদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত শস্য যেন তারা অ-কৃষকদের (ঝুড়ি নির্মাতা, চর্মকার ও কাঠমিস্ত্রি) কাছে বিক্রি করে, যারা নিজেরা কোনো খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম নয়। শুধু বৈরী ও জংলি জায়গায় এরকম আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়, যা সভ্যতার প্রকৃত মাপকাঠি। উর্বর ভূমিতে, যেখানে খাদ্যশস্য, পানীয় আর শিকার করার জন্য প্রাণী, বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য ও কাঠের প্রাচুর্য রয়েছে, সেখানে এসব নিয়ে কারও মাথাব্যথাই থাকত না। 

উর্বর ক্রিসেন্টে গ্রামগুলো শহরে পরিণত হতে থাকে আর সমপরিমাণ শুষ্ক ভূমিতে আরও বেশি মানুষ বসবাস করা শিখতে থাকে সাথে সাথে। এই পর্যায়ে শক্ত নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। মানবপ্রকৃতি যেমন, তাতে শহরের শাসকদের কিছু পরিমাণে জোরজবরদস্তি প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং এভাবেই আসে সশস্ত্র পুলিশের ধারণাটি। দরকার হয় এক দল মানুষের যারা তাদের জারি করা আইনকানুন রক্ষা করবে। 

হঠাৎ করেই নেতারা রাজায় রূপান্তরিত হয়ে যান। সুমেরীয়দের জন্য রাজা ও রাজত্বের ধারণাটি ছিল সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আসা উপহারের মতো, কারণ তারা তাদের সমগ্র জীবন একটি বৈরী পরিবেশে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। তাদের শস্য বন্যার পানিতে ভেসে যেত অথবা পানি একেবারেই তিরোহিত হয়ে শস্যগুলোকে রোদে সেঁকার জন্য রেখে যেত। সুমেরীয়দের জন্য ছিল না কোনো আদিম বাগান; তাদের শহরকে রক্ষা করত মোটা কাদামাটির দেওয়াল, যা ছিল আগ্রাসী সাগর আর ক্ষুধার্ত দস্যুদের আক্রমণ থেকে বাঁচার প্রাথমিক ও সেরা পন্থা। 

এরিদু শহরে প্রথম রাজত্ব নেমে এসেছিল স্বর্গ থেকে, যার কথা আবারো শোনা যায় ব্যাবিলনীয়দের পৌরাণিক কাহিনিতে, যেখানে তাকে বর্ণনা করা হয়েছে ঈশ্বররাজ মারদুক-এর বানানো সুমেরীয় ইডেন নামে। – 

‘সকল ভূমি সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল 
যখন এরিদু নির্মিত হয়েছিল 
মারদুক নির্মাণ করেছিলেন একটি নলখাগড়ার ভিত্তি 
পানিকে প্রতিহত করার জন্য 
তিনি বানিয়েছিলেন কাদা 
এবং তা ঢেলে দিয়েছিলেন সেই নলখাগড়ার ভিত্তির উপর 
তিনি মানবজাতিকে তৈরি করেছিলেন’ 

বাইবেলের জেনেসিসে বর্ণিত ইডেনের মতো এরিদু কখনও হারিয়ে যায়নি। এই পবিত্র শহর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল শিকারি ও আহরণকারীদের পুরানো পৃথিবী ও সভ্যতার নতুন পৃথিবীর মাঝে বিভাজক হিসেবে। কিন্তু শিকারি ও আহরণকারীগণ পুরোপুরি চলে যাননি। রাজত্বের সূচনালগ্ন এবং প্রথম শহরের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই থিতু কৃষকদের সাথে যাযাবর পশুপালকরা ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হয়ে এসেছে। 

সুমেরীয় লিস্টের পঞ্চম রাজা হচ্ছেন দুমুজি—আশ্চর্যজনকভাবে যিনি ছিলেন একজন মেষপালক। একজন মেষপালকের রাজা হওয়ার ব্যাপারটি হচ্ছে বিপরীতধর্মী সত্তাদের মিলিত হওয়ার কাহিনি, যা আরও স্পষ্ট হয়েছে উইং অব ইনান্না নামের গল্পে, যার মূল চরিত্র দুমুজি ও দেবী ইনান্না। 

এই গল্পে দুমুজি শুধু একজন মামুলি মেষপালক নন বরং তার গায়ে ছিল দেবতাদের রক্ত। কিন্তু তারপরও, তার ঐশ্বরিক সংযোগ থাকা সত্ত্বেও, ইনান্না দুমুজিকে তার যোগ্য মনে করেননি। সূর্যদেবতা উঁচু উঁচু স্বরে ইনান্নাকে বলেন ‘মেষপালক তোমার সাথে বিছানায় যাবে।’ কিন্তু ইনান্না (যে সাধারণত সূর্যদেবের সকল উপহারকে কোনো দ্বিধা ছাড়াই গ্রহণ করেন) অস্বীকৃতি জানান এভাবে- 

‘সে এক মেষপালক! আমি মেষপালকটিকে বিয়ে করব না
তার কাপড়চোপড় অমার্জিত; তার পশম রুক্ষ 
আমি চাষিকে বিয়ে করব 
চাষি আমার পোশাকের জন্য শণ উৎপাদন করে 
চাষি আমার খাবার টেবিলের জন্য যব উৎপাদন করে’ 

দুমুজি হাল ছাড়েন না। কার পরিবার বেশি ভালো সেটা নিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তর্কবিতর্কের পর উপঢৌকন হিসেবে টাটকা দুধ ও ননি প্রদানপূর্বক তিনি ইনান্নার শয়নকক্ষের প্রবেশাধিকার পান। কিন্তু এত কিছুর পরেও তার প্রথম অনুরোধ হয় ‘আমার রুক্ষ জমিতে লাঙল ফলাও।’ 

ইনান্নার কৃষকপ্রীতি সেই যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার পরিচায়ক। দক্ষিণের সমতলভূমিগুলো শুষ্ক হয়ে যেতে থাকে আর শহরগুলো নদীর তীরবর্তী ভূমিগুলোতে সন্নিবিষ্ট হতে থাকে। কিন্তু শহর পেরিয়ে আরও গভীরের দিকে গেলে মরুভূমিগুলো খুঁজে পাওয়া যেত, যেখানে যাযাবররা পুরানো দিনের জীবনধারা বজায় রেখে ভেড়া ও ছাগল চরাত এবং তাদের সাময়িক আবাসস্থল রচনা করত। 

পশুপালক ও কৃষকরা একজন আরেকজনের উপর নির্ভরশীল ছিল- পশুপালকরা কৃষকদেরকে মাংস, বিশুদ্ধ দুগ্ধ ও পশম দিত, যার বিনিময়ে তারা পেত জীবন বাঁচানোর জন্য শস্য। কিন্তু এই নির্ভরতা থাকা সত্ত্বেও তা পারস্পরিক শ্রদ্ধার জন্ম দেয়নি। একদিকে শহরের বাসিন্দারা অসভ্য ও অশুচি মেষপালকদের দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাত আর অপরদিকে তারাও অভিজাত ও অপচয়কারী কৃষকদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করত সমানে। 

শহর, রাজা, কৃষক ও যাযাবরদের এই দেশে পরপর আটজন রাজা রাজত্ব করেছিলেন মহাদুর্যোগ আঘাত হানার আগ পর্যন্ত। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *