অধ্যায় দশ – প্রথম মহাকাব্যিক নায়ক
সুমেরে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ সাল আসতে আসতে গিলগামেশ একজন কালজয়ী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন।
সুমেরীয় রাজা গিলগামেশ তার মৃত্যুর প্রায় হাজারখানেক বছর পরে একজন কালজয়ী যোদ্ধা হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। একই সময়ে মিশরীয়রা সংগ্রাম করছিল একজন ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক খুঁজে পাওয়ার জন্য। গিলগামেশ দানবদের হত্যা করেছিলেন, স্বর্গের মহিষকে পরাস্ত করেছিলেন, দেবী ইনান্নার প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং দেবতাদের বাগানে অনুপ্রবেশ করেছিলেন, যেখানে তার মরণশীল শরীরের উগ্র গন্ধ স্বয়ং সূর্যদেবতাকে ব্ৰিত করেছিল। গিলগামেশের এসকল মহাকাব্যিক কাজের (পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে পুরানো মহাকাব্য) কারণে তার নামও আমরা আজও শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করে থাকি—তার মৃত্যুর পাঁচ হাজার বছর পরও।
বাস্তবের গিলগামেশ এবং ঐতিহাসিক গিলগামেশের মাঝে যে সম্পর্ক তার তুলনা করা যায় শেক্সপিয়ারের বর্ণিত ম্যাকবেথ এবং ১০৫৬ সালে রাজা ও তার সভাসদদের হত্যা করার জন্য চরম মূল্য দিতে বাধ্য হওয়া স্কটিশ উপকথার নায়ক মাওরমর ম্যাকবেদার মাঝে থাকা সম্পর্কের সাথে।
তবে শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের অতিরঞ্জিত কাহিনিকে খুব সহজেই প্রকৃত ইতিহাস হতে আলাদা করে ফেলা যায়।
এর মূল কারণ হচ্ছে যে মাওরমার ম্যাকবেদার জীবনের আসল কাহিনি জানার জন্য অন্যান্য গ্রহণযোগ্য উৎস রয়েছে। কিন্তু সেই এক মহাকাব্যের বাইরে গিলগামেশের জীবন সম্পর্কে জানার জন্য উৎস হিসেবে আমাদের হাতে রয়েছে কেবল কিছু শিলালিপি, সুমেরীয় রাজাদের তালিকাটি এবং একটি বা দুইটি কবিতা। এরকম একটি কবিতায় বলা আছে এই বইয়ের পূর্বের অধ্যায়ে উল্লেখিত গিলগামেশের প্রতি আজ্ঞার শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানোর কথা। কবিতাটি সুমেরীয় ভাষায় লিখিত এবং তা মুখে মুখে বর্ণিত হয়েছে কয়েক যুগ কিংবা কয়েক শত বছর ধরে; কাদামাটির ট্যাবলেটে লিপিবদ্ধ হওয়ার আগে। আমাদের হাতে যে কপিগুলো রয়েছে তা খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ সালে লেখা হয়েছিল, যখন উর-এর রাজা একজন লিপিকারকে দায়িত্ব দেন গিলগামেশের কাহিনি লেখার জন্য। শুলগি নামক ভদ্রলোকটি রাজা হওয়ার পর মহান গিলগামেশের জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা নথিভুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কারণ তিনি নিজেকে গিলগামেশের বংশধর বলে দাবি করেছিলেন। তার এই কার্যক্রম থেকে সন্দেহ করা যায় যে আসলে তিনিও একজন দখলদার রাজা ছিলেন; সম্ভবত গিলগামেশের সাথে তার কোনো আত্মীয়তা ছিল না।
এই কবিতাগুলো রচনার সময়পর্ব আর গিলগামেশের তিরোধানের সময়পর্ব খুবই কাছাকাছি; তাই আমরা ধরে নিতে পারি যে এগুলোতে কিছুটা হলেও এই ঐতিহাসিক রাজার জীবনের প্রতিফলন পাওয়া যায়।
মহাকাব্যটিতেও একইরকম তথ্য পাওয়া যায়; কিন্তু এসকল তথ্য-উৎসকে সুচারুভাবে বিন্যস্ত করা হচ্ছে সবচেয়ে জটিল কাজ।
আপনার লোকালয়ের বইয়ের দোকানে গিয়ে গিলগামেশের মহাকাব্যের একটি কপি হাতে নিয়ে দেখুন; দেখতে পাবেন এতে রয়েছে ছয়টি সংযুক্ত উপাখ্যান, যেগুলো অনেকটা ছোটোগল্পের মতো, যেগুলো যুক্ত হয়ে একটি উপন্যাস তৈরি করেছে। প্রথমে আসে ‘এনকিদুর উপাখ্যান’, যেখানে গিলগামেশ দেবতাদের কাছ থেকে পাঠানো একটি দানবের সাথে বন্ধুত্ব করেন এবং তাকে বশ মানিয়ে ফেলেন। দ্বিতীয় গল্পটির নাম ‘সিডার বনের অভিমুখে যাত্রা, যোখানে তিনি হুমবাবা-কে পরাজিত করেন। এরপর আসে ‘স্বর্গের মহিষ’, যেখানে গিলগামেশ দেবী ইনান্নাকে উত্যক্ত করেন এবং যার ফলে এনকিদুর উপর অত্যাচার নেমে আসে। চতুর্থ গল্প ‘গিলগামেশের অভিযান’, যেখানে তিনি অমর উতনাপিশটিমের দেশে পৌঁছে যান, যে ছিল সুমেরীয়দের নোয়াহ। উতনাপিশটিম মহাপ্লাবনের পর থেকে সেখানেই থাকছিলেন। পঞ্চম গল্পটি হচ্ছে ‘বন্যার গল্প’, যে গল্পটি গিলগামেশ সুমেরীয় নোয়াহর কাছ থেকে শুনেন। সব শেষে আসে ‘গিলগামেশের অভীষ্ট লক্ষ্য’, যেখানে গিলগামেশ অমরত্ব কিংবা আমৃত্যু যৌবন লাভের চেষ্টা করেন কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর একটি ছোটো উপসংহারে গিলগামেশের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।
এই ঝকঝকে ছয় অধ্যায়ের মাধ্যমে চিত্রায়িত গিলগামেশের জীবনকাহিনিতে কিছু পরিমাণ রং চড়ানো হয়েছে। এই উপাখ্যানটি বহুবার কাদামাটির ভঙ্গুর ট্যাবলেটে লেখা হয়েছে এবং স্বভাবতই সেই ট্যাবলেটগুলো অনেকবারই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। সেই ভাঙা টুকরোগুলি মিশরের পূর্বদিকের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং সেগুলো লেখা হয়েছিল বিভিন্ন ভাষায়—এসিরীয় থেকে শুরু করে সুমেরীয় পর্যন্ত; এবং তা খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ থেকে ৬১২ সালের মাঝে। সবচেয়ে পুরানো সুমেরীয় প্রতিলিপিগুলো লেখা হয়েছিল শুলগির লিপিকারদের হাত ধরে আর এগুলোতে ছিল শুধু প্রথম দুই অধ্যায় এবং শেষের উপসংহার।
এটা এখন আর জানা সম্ভব নয় যে পরবর্তী চারটি অধ্যায় কি পরে সংযুক্ত করা হয়েছিল নাকি শুরু থেকেই ছিল। তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায় অর্থাৎ ‘স্বর্গের মহিষ’ ও ‘গিলগামেশের অভিযান’ এবং সাথে প্রথম দুটি অধ্যায়কেও আমরা খুঁজে পাই আক্কাদিয়ান ভাষায় অনূদিত অবস্থায়—খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ সালের মাঝে। আক্কাদিয়ান ভাষার আবির্ভাব হয়েছিল সুমেরীয় ভাষার পরে, যে ভাষার আবির্ভাব ঘটেছিল সুমেরীয় শহরগুলোর শক্তিমত্তা খর্ব হওয়ার পর; এবং নদীর তীর দখল করা মানুষদের মুখের ভাষা হিসেবে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালের আশেপাশে, গল্পের চারটি অধ্যায় আবির্ভূত হয় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে এবং এশিয়া মাইনরে। মহাপ্লাবনের গল্পটির বিভিন্ন চিত্রায়ণ খুঁজে পাই আমরা খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালের আগে থেকেই। খুব সম্ভব এই গল্পটি গিলগামেশের উপাখ্যানের সাথে জোর করে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল এর পঞ্চম অধ্যায় হিসেবে; সম্ভবত গিলগামেশের মৃত্যুরও এক হাজার বছর পরে এই কাজ করা হয়েছিল। ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায় বাকি অধ্যায়গুলোর সাথে এটির কোনো সম্পর্কই নেই।
‘বসো এবং এই গল্পটি শুনো’, উতনাপিশটিম গিলগামেশকে আদেশ করেন এবং সরাসরি গল্পে চলে যান। শুনে মনে হবে যেন নৌকা থেকে নামার পর থেকে তিনি কাউকে এই গল্পটি শোনানোর অপেক্ষাতেই ছিলেন। আর ‘গিলগামেশের অভীষ্ট লক্ষ্য’ নামের গল্পটি (যেখানে তিনি পুনরুজ্জীবনী উদ্ভিদ খুঁজে পেয়েও তা হারিয়ে ফেলেন) বাকি পাঁচটি অধ্যায়ের সাথে যুক্ত হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৬ সালে।
সেই বছরেই খুঁজে পাওয়া যায় ছয় অধ্যায়সংবলিত এই উপাখ্যানটির প্রাচীনতম প্রতিলিপি। এটি খুঁজে পাওয়া যায় আশুরবানিপালের লাইব্রেরি থেকে, তিনি ছিলেন একজন এসিরীয় রাজা, যার ছিল একজন গ্রন্থাগারিকের আত্মা। আশুরবানিপাল খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৮ সালে রাজত্ব লাভ করেন। তার প্রায় ত্রিশ বছরের শাসনামলে তিনি ব্যাবিলন ধ্বংস করেন; তার নিজের ভাইকে হত্যা করেন (যিনি ব্যাবিলনের রাজা হয়েছিলেন) এবং জোনাহ নামের একজন হিব্রু ধর্মপ্রচারকের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। জোনাহ মতামত দিয়েছিলেন যে আশুরবানিপালের রাজধানী নিনেভেহ একটি অভিশপ্ত শহর ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৬ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত আশুরবানিপাল বাইশ হাজার কাদামাটির ট্যাবলেট সংগ্রহ করেন, পৃথিবীর প্রথম প্রকৃত লাইব্রেরির জন্য। এর মধ্যে ১২টি ট্যাবলেটে গিলগামেশের কাহিনিটি লিপিবদ্ধ ছিল এবং সেই একই লেখনী এখনও অবিকৃতভাবেই পুনঃপ্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
সবদিক বিবেচনা করে বলা যায় যে শুধু প্রথম দুইটি উপাখ্যানই গিলগামেশের জীবদ্দশার নিকটবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল। গিলগামেশের অপরিসীম শক্তিমত্তা যেভাবে তার প্রজাদের জীবনে দুঃখ-দুর্দশার কারণ হয়েছিল এবং উত্তরের সিডার বনে যাত্রা এবং সবশেষে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনা- এগুলোকে বলা যেতে পারে খানিকটা অতিরঞ্জিত এবং বিকৃত ঐতিহাসিক সত্য।
সর্বোপরি এই কাহিনিগুলো পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে, যেখানে দেখানো হয়েছে মৃত্যু একইসাথে ধ্বংস এবং মুক্তির রূপ নিয়ে আসতে পারে।
প্রথম গল্প ‘এনকিদুর উপাখ্যান’-এ রাজা উরুক তার প্রজাদেরকে বিভিন্নভাবে শোষণ করতে থাকলে তারা বলা শুরু করে–
‘গিলগামেশ তার নিজের আমোদের জন্য যুদ্ধের দামামা বাজায়
তার ঔদ্ধত্যের কোনো সীমা নেই
দিন হোক বা রাত্রি, সে পিতাদের কাছ থেকে পুত্রদের ছিনিয়ে নেয় য
দিও একজন রাজার হওয়া উচিত জনগণের মেষপালক।’
এ থেকে বোঝা যেত যে সুমেরীয় রাজাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতায় প্রাপ্ত রাজা হওয়ার অধিকার, যার দৃঢ় কর্তৃত্বের কারণে শহরগুলো বেঁচে থাকতে পেরেছিল এতদিন, তা দুঃখজনকভাবে স্বৈরশাসনে রূপান্তরিত হয়েছে। উরুকের নাগরিকরা ঈশ্বরের কাছে ফরিয়াদ জানায় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের আশায়। এর ফলে দেবতারা এনকিদু নামের একটি কাদামাটির প্রাণী তৈরি করেন এবং সেটিকে সুমেরের পতিত ভূমিতে ছেড়ে দেন।
এনকিদু চাষের জমির ব্যাপারে কিছুই জানত না। সে জানত না সভ্য মানুষ কিংবা তাদের জীবন ধারণের পন্থা সম্পর্কে এবং সে সেসব প্রাচীরঘেরা শহর সম্পর্কেও অবগত ছিল না যেগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সুমেরীয় সভ্যতা। তাকে দেখে একজন ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ বলে ভ্রম হয় কিন্তু তার আচার আচরণ ছিল পশুর মতো। সে সমতলভূমিতে ঘুরে বেড়াত আর ঘাস খেয়ে অন্যান্য পশুদের সাথে জীবন ধারণ করত। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল যাযাবরদের আদলে তৈরি একটি প্রাণী যারা সব সময় শহরবাসীদের সাথে কলহে লিপ্ত ছিল।
গিলগামেশ যখন এই নবাগতের ব্যাপারে খবর পেলেন তখন তিনি জঙ্গলে একজন পতিতাকে পাঠালেন তাকে ছলাকলায় ভুলিয়ে বশীভূত করার জন্য (কাব্য থেকে আমরা জানতে পারি ‘সে নিজেকে নগ্ন করে ফেলেছিল’)। মোটামুটি সরল এই কৌশলে পরাভূত হয়ে এনকিদু ছয় দিন ও সাত রাত্রি ইন্দ্রিয় সুখে নিমজ্জিত ছিল। অবশেষে যখন সে উঠে দাঁড়াল এবং পশুদের সাথে তার পূর্ববর্তী জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করল তখন তারা তার কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেল—সে ততক্ষণে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে।
‘এনকিদু ক্ষয়িষ্ণু এবং দুর্বল হয়ে গিয়েছিল
এবং বন্য জন্তুরা তার থেকে পালিয়ে গিয়েছিল
কিন্তু তার পরিবৃদ্ধিও ঘটেছিল
কারণ তখন তার কাছে প্রজ্ঞা এসেছিল
এবং তখন তার কাছে আছে মানব-চিন্তাধারা।’
মানুষের মতো চিন্তা করতে শুরু করার পর এনকিদুর জন্য শহরে গিয়ে বসবাস করাটাই হয়ে দাঁড়াল স্বাভাবিক ব্যাপার। সেই পতিতাটি তাকে প্রস্তাব দিলো ‘শক্ত প্রাচীরে ঘেরা উরুকে যাওয়ার জন্য, যে শহরকে বন্য মোষের মতো দৃঢ়তার সাথে গিলগামেশ শাসন করছেন’।
যখন তারা উরুকে আগমন করল তখন গিলগামেশ একটি বিয়ের অনুষ্ঠানকে বাধাগ্রস্ত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন সেই যুগে প্রচলিত ‘ড্রয়েট দু সিগনেউর’ বা ‘অধিকর্তার অধিকার’ নামক দাবির মাধ্যমে, যা তিনি অনেক বছর ধরেই বিলাসিতার সাথে প্রয়োগ করে আসছিলেন। মহাকাব্যে বর্ণিত আছে, ‘উরুকের রাজা নববধূর সাথে প্রথম পুরুষ হিসেবে সহবাস করার দাবি জানালেন’ এবং এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি নিজের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অধিকারের কথা উল্লেখ করেন। গিলগামেশের রাজকীয় ক্ষমতার অপব্যবহারে ক্ষুদ্ধ হয়ে এনকিদু সেই বধূর বাসরঘরের দরজার সামনের রাস্তাটি বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যান। তখন দুজনের মধ্যে মল্লযুদ্ধ হয় এবং অল্পের জন্য গিলগামেশ পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পান। এর আগে গিলগামেশ কখনও এত কঠিন কোনো প্রতিপক্ষের সামনে পড়েননি। হেরে গিয়েও তিনি এনকিদুর শক্তি ও সামর্থ্যে মুগ্ধ হন এবং দুজনে দুজনের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন। এই যুদ্ধের ফলে গিলগামেশের স্বৈরাচারী সত্তায় পরিবর্তন আসে। উরুকের বাসিন্দারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন এবং পথে-প্রান্তরে শান্তির ছায়া নেমে আসে।
এই কুস্তিযুদ্ধ অবশ্যই সামান্য কোনো কুস্তি ছিল না।
এই গল্পের মাঝে লুক্কায়িত আছে সুমেরীয় রাজাদের অধিকারসংক্রান্ত দ্বৈত ভাবটি। রাজত্ব করার ক্ষমতাটি ছিল দেবতাদের কাছ থেকে মানুষের জন্য উপহারস্বরূপ, যাতে তারা ভালোভাবে জীবন ধারণ করতে পারে। রাজাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, দুর্বলদেরকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার হাত থেকে রক্ষা করা। বলা বাহুল্য, একজন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী রাজার ইচ্ছাশক্তি অনেক দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু একইসাথে এই ক্ষমতা ছিল বিপজ্জনক, যা শোষণের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। আর যখন তা হতো তখন সুমেরীয় শহরগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকত। উরুকে রাজাই ছিলেন আইন; আর যদি রাজা নিজে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে যেতেন তা হলে সেই আইনের মূল ভিত্তিটাই নষ্ট হয়ে যেত।
এই ব্যাপারটি এতটাই ভীতিকর ছিল যে সেটাকে শুধু তীর্যকভাবে পর্যালোচনা করা যেত।
গিলগামেশ যুদ্ধ করছেন, নিজের সাথে নয় বরং একটি প্রাণীর সাথে, যে প্রাচীরের বাইরে থেকে এসেছে। সেই বধূটির বাসরঘরের বাইরে অনুষ্ঠিত কুস্তি যুদ্ধটি তিনি লড়েছিলেন তারই অসভ্য প্রতিফলনের সাথে। এনকিদুকে তার মতো করেই তৈরি করা হয়েছে এবং তারও রয়েছে গিলগামেশের মতো একটি ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ হৃদয়। কাব্যের ভাষায়-
‘তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করুক
এবং শহরবাসীকে শান্তিতে থাকতে দিক।’
গিলগামেশের সিডার বনে যাত্রার কাহিনিটিও খুব বেশি ভিন্ন নয়। সেখানেও আমরা গিলগামেশকে দেখতে পাই নিজ ইন্দ্রিয়সুখের কাছে পরাভূত হয়ে গোঁয়ারের মতো আচরণ করতে।
‘আমি দানবদের পরাভূত করব
আমি চিরদিনের মতো নিজের সুনামকে প্রতিষ্ঠিত করব’
এই কথাগুলো উরুকের জ্যেষ্ঠদের সভায় উচ্চারণ করেন গিলগামেশ। তারা গিলগামেশকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন-
‘তুমি নবীন ও অনভিজ্ঞ, গিলগামেশ
তোমার হৃদয় তোমাকে ভুল পথে পরিচালিত করছে
দানবরা মানুষের মতো মরণশীল নয়।’
কিন্তু তার জেদের কাছে জ্যেষ্ঠরা হার মানতে বাধ্য হন। গিলগামেশ আর এনকিদু দানবটির সাথে যুদ্ধ করার জন্য রওনা দেন। এনকিদুর উপর জ্যেষ্ঠরা বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে গিলগামেশকে নিরাপদ রাখার ভারটি চাপিয়ে দেন।
গিলগামেশের উত্তরাভিমূখী যাত্রার মূলে ছিল খ্যাতি লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। একই আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে তিনি তার প্রজাদেরও যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। তবে আরও একবার, বাইরের শক্তিগুলোকে উরুকের শান্তির প্রতি হুমকি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে অশুভ চিন্তাগুলো রাজার আত্মায় নয় বরং উত্তরের, দূরবর্তী জঙ্গল থেকে এসেছে।
এবার আরেকটি ভিন্ন ধরনের বিপদের আনাগোনাও টের পেলেন গিলগামেশ। তাকে নিয়ে লেখা প্রাচীনতম গল্পেও তিনি মৃত্যু নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। রওনা দেওয়ার আগেই তিনি নিজের মরণশীলতা নিয়ে ভাবতে থাকেন। এই কথাগুলো শুনে মনে হয় তিনি অবশ্যম্ভাবী সত্যকে মেনে নিয়েছেন-
‘কে-ই বা যেতে পারে স্বর্গে?
শুধু দেবতারাই আজীবন বেঁচে থাকেন
মানুষের জীবনের দিনগুলো এক সময় ফুরিয়ে যায়
কিন্তু আমার যদি মৃত্যুও ঘটে তবু আমি খ্যাতিমান হবো
আর সেই খ্যাতি চিরস্থায়ী’
এবং তিনি যে সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন সেই চিন্তা তার মনে ভালো করেই জায়গা করে নিয়েছিল। দানব হুমবাবার সাথে লড়াই করতে যাওয়ার পথে তিনি তিনবার স্বপ্ন দেখেন এবং প্রতিবারই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন এই বলে, ‘দেবতার মৃত্যু ঘটেছে; আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে গিয়েছে।’ তৃতীয় স্বপ্নটি সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল—
‘দিনের আলো নিশ্চুপ হয়ে গেছিল এবং অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছিল
বজ্রপাত হলো এবং চারপাশে আগুন ধরে গেল
বৃষ্টির মতো মৃত্যু নেমে এলো।’
তিনি এতটাই ভয় পেয়েছিলেন যে ফিরে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু এনকিদু তাকে নিবৃত্ত করে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। তারপর, হুমবাবার সাথে লড়াই শুরু হওয়ার ঠিক আগে আগে তিনি এক গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েন এবং এনকিদুর প্রয়াসে কোনোমতে সেই ঘুম ভাঙে এবং তিনি সময়মতোই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন। অশুভ লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও তারা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান।
এই গল্পটির শেষভাগে আমরা দেখতে পাই যে উরুক নিরাপদে রয়েছে এবং দানবটির মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু এই অভিযান থেকে গিলগামেশ উপলব্ধি করতে পারেন যে তার দিন ফুরিয়ে আসছে এবং তাকে মৃত্যুভয় আচ্ছন্ন করে—সম্ভবত প্রথমবারের মতো। এই ভাবনাগুলোকে ভিত্তি করেই পরবর্তী গল্পগুলো কেন্দ্ৰীভূত হয়েছে; এবং প্রতিটিতেই আমরা দেখি গিলগামেশের মৃত্যুকে নিয়ে দুর্ভাবনা এবং তাকে জয় করার তীব্র অভিলাষ।
গিলগামেশ স্বর্গের বাগানের পথে যাত্রা করেন, এই আশায় যে তিনি কোনো উপায়ে নিহত এনকিদুকে মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। তিনি অমরত্বের রহস্য ভেদ করতে গিয়ে মহাপ্লাবনের গল্প শুনলেন; এবং অনেক চেষ্টার পর তিনি চিরযৌবনের উদ্ভিদ খুঁজে পেলেন, যা মৃত্যুকে পরাজিত করতে না পারলেও বিলম্বিত করতে পারে। কিন্তু তিনি সেই উদ্ভিদটি নিজের করে নিতে পারলেন না; একটি জলস্বপ সেটিকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল তার চোখের সামনে দিয়ে। মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার এই যুদ্ধে তিনি অনেক কূটকৌশল অবলম্বন করেন; বহুদূরে যাত্রা করেন, ভিক্ষা করেন, খোঁজাখুঁজি করেন কিন্তু তিনি কখনোই সাফল্যের মুখ দেখেন না।
সুমেরীয়দের জন্য ব্যাপারটি বেশ লাভজনক ছিল। মহাকাব্যের শেষভাগে লিপিবদ্ধ গিলগামেশের শেষকৃত্য ও তার মাতমের বর্ণনাটি আশুবানিপালের কপিতে ছিল না; এর উৎস আরও প্রাচীন। সম্ভবত এসিরীয়রা এর শেষের অংশটিকে বেশ অপ্রাসঙ্গিক ভাবত বিশেষ করে এর পূর্বের প্রতিটি অধ্যায়ে গিলগামেশের অমরত্ব লাভের অভিযানের সাথে তুলনা করতে গিয়ে। কিন্তু এই ‘মাতম’টি কয়েকটি বাক্যে সুমেরীয়দের রাজত্বসংক্রান্ত দুর্ভাবনাকে সরাসরি প্রকাশ করে। কাব্যের ভাষায়-
‘আপনাকে রাজত্ব করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল
অমরত্ব ছিল না আপনার শেষ গন্তব্য।
আপনার হাতে ক্ষমতা ছিল ভাঙা এবং গড়ার
মানুষের উপর আধিপত্য স্থাপনের ক্ষমতা
এবং যুদ্ধে বিজয়ের স্বাদ।
কিন্তু এই ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না।
আপনার প্রাসাদের ভৃত্যদের সাথে ন্যায়পরায়ণ ব্যবহার করবেন
রাজা নিজেকে নিচে নামিয়েছে
সে পাহাড়ে গিয়েছে
আর সে কখনও ফিরবে না
সেই শত্রু যার নেই হাত কিংবা পা
যে পান করে না পানি কিংবা খায় না মাংস
সেই শত্রুর ভার তার উপর চেপে বসেছে।’
সুমেরে গিলগামেশকে তার জীবদ্দশাতেই দেবতা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল। তার এই অবস্থান তিনি অর্জন করেছিলেন শহর রক্ষক ও শাসক হিসেবে তার অপরিসীম পরিশ্রমের কল্যাণে। কিন্তু মৃত্যু তার এই দেবত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেয়। গিলগামেশ আরও অনেক পরে আসা নর্স পুরাণে বর্ণিত বালডার-এর মতো ছিলেন, যিনি অমর না হলেও স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সর্বোপরি গিলগামেশের অচিন্তনীয় শক্তিমত্তা তার মৃত্যুকে আরও গুরুত্বপূর্ণ বানায়। তিনি যদি অশুভ হতেন তবুও কোনো এক সময় তার শক্তিমত্তার অবসান ঘটত। সুমেরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজাও মৃত্যুবরণ করেন। হাত ও পা-বিহীন সেই শত্রু সেই ভীতিকর ক্ষমতাকে প্রশমিত করে যা জনগণের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কাজ করতে পারে। পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্যিক উপাখ্যানে, সুমেরের মতোই, গিলগামেশ সব ধরনের প্রতিপক্ষের সাথে জয়ী হয়েছেন–কাউকে যুদ্ধে হারিয়েছেন, কাউকে অপেক্ষমাণ রেখে নিঃস্ব বানিয়েছেন কিংবা শুধু বাগাড়ম্বরে কারও মনোভাব বদলে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি পরাজিত হয়েছেন শুধু সেই শেষ শত্রুটির কাছে।