অধ্যায় নয় – প্ৰথম গৃহযুদ্ধ
খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ থেকে ২৬৮৬ সালের মাঝে ফারাওদের প্রথম রাজবংশ দেবতায় রূপান্তরিত হন, দ্বিতীয় রাজবংশ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং তৃতীয় রাজবংশ একটি পুনর্গঠিত মিশরের উপর রাজত্ব করার সুযোগ পান।
মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধরত শহরগুলোর কোনো জাতীয় পরিচয় ছিল না, প্রত্যেকে তাদের ছোটো ছোটো রাজত্ব নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে গোটা পৃথিবীতে একটাই সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল যেটি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূল থেকে শুরু করে হিয়েরাকনপলিস শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
রাজত্ব হিসেবে মিশর ছিল একটি কুণ্ডলী পাকানো সুতার বলের মতো, যা ছিল প্রায় চারশো মাইল দীর্ঘ এবং কিছু কিছু জায়গায় এতটাই অপ্রশস্ত যে একজন মিশরীয় ব্যক্তি মরুভূমির মাঝে—দেশটির পূর্ব সীমানায় দাঁড়াতে পারতেন আর ঠিক ডানদিকে তাকিয়ে নীল নদের পশ্চিমপাশে অবস্থিত আবর্জনায় ভরা ভূমিও দেখতে পেতেন।
দেশটির রাজধানী ছিল ‘সাদা শহর’ মেমফিস, যা বদ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। শহরটি প্রাচীন মিশরের নিম্ন ও উচ্চ রাজত্বের সীমারেখার উপর তৈরি করা হয়েছিল। এই সীমানা ছাড়া রাজধানীর গোড়াপত্তনের জন্য সেই জায়গাটির অন্য কোনো যোগ্যতা ছিল না বললেই চলে। সমতলভূমিটি এতটাই আর্দ্র ছিল যে—হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুযায়ী-রাজা নার্মারের প্রথম কাজ ছিল পানি আটকে রাখার জন্য একটি বাঁধ তৈরি করা।
হেরোডোটাস আরও বলেন, ‘প্রায় ২৫০০ বছর পরেও নীল নদের এই বাঁকটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতো। তারা প্রতি বছর বাঁধটিকে আরও মজবুত করে তুলত, কারণ নদীর পানি কূল ছাপিয়ে গেলে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হবে আর সেই পানিতে মেমফিস শহর সম্পূর্ণরূপে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।’
নার্মারের একত্রীকরণ এবং মেমফিসকে একমাত্র মিশরীয় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠাকরণের মাধ্যমে প্রাক-রাজবংশভিত্তিক মিশরের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর তার পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করে এবং পরবর্তীতে পরপর ছয়জন রাজা রাজ-শাসনের দায়িত্ব পান—যাদেরকে মানেথো মিশরের তথাকথিত ‘প্রথম রাজবংশ’ হিসেবে অভিহিত করেন। এটিই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক রাজকীয় ধারাবাহিকতা।
এই আটজন রাজা প্রায় ছয়শ বছর ধরে কীভাবে মিশরকে শাসন করেছেন সেই ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে আমরা একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের বেড়ে ওঠা দেখতে পাই যেখানে রাজকীয় আদালত, খাজনা সংগ্রহ ব্যবস্থা এবং একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছু মিশরীয় নাগরিক, যারা কোনো ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদন করতেন না, তাদেরকেও সরকার লালনপালন করার বিলাসিতা দেখাতে পারত। এই দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল পূর্ণকালীন পূজারিগণ, যারা রাজার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন; এবং দক্ষ কামারগণ, যারা রাজসভার নারী ও পুরুষদের জন্য গয়নাগাটি তৈরি করতেন; এবং লেখকগণ, যারা ক্রমবর্ধনশীল আমলাতন্ত্রের হিসাব রক্ষা করতেন।
রাজবংশের তৃতীয় রাজা জের মিশরীয় সৈন্যদেরকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক অভিযানে পাঠান নার্মারের রাজত্বের সীমানার ওপারে। হিয়েরাকনপলিসের দক্ষিণে ২৫০ মাইল দূরে দ্বিতীয় ক্যাটারাক্টের কাছে অবস্থিত একটি পাথরে খোদাই করা দৃশ্যপটে দেখা যায় যে জের ও তার সৈন্যরা জয়লাভ করেছে এবং সম্ভবত নুবিয়ার নিম্নাঞ্চলের উপজাতীয় বাসিন্দাদের বন্দি করে রেখেছে। এই ঘটনার অল্প কিছুকাল পরেই উপজাতিরা সেই এলাকা থেকে সম্পূর্ণ তিরোহিত হন—প্ৰতিকূল আবহাওয়া এবং মিশরীয়দের মুহুর্মুহু আক্রমণের মুখে। মিশরীয় সৈন্যরা আরও উত্তর-পূর্বদিকে এগিয়ে যান ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে। তারা বর্তমানের দক্ষিণ প্যালেস্টাইনে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
আর দুজন রাজা পরলোকগমন করার পর রাজা ‘ডেন’ পুনরায় মিশরের সীমানার বাইরে পাড়ি জমিয়েছিলেন, বেশ সতর্কতার সাথে। তিনি তার সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়ে সিনায় উপদ্বীপের দিকে নিয়ে যান, যেটি ছিল রেড সি-র উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এক টুকরো ত্রিভুজাকৃতির ভূমি। ‘যখন প্রথমবারের মতো পূর্বে আঘাত হানা হয়েছিল’ নামে পরিচিত ডেন রাজার এই বিজয়টি একটি সমাধির ভেতর খোদাই করা আছে, যেখানে দেখানো হয়েছে যে তিনি স্থানীয় নেতাদের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে বশীভূত করছেন।
তাত্ত্বিকভাবে এই বিজয়গুলো ছিল সমগ্র মিশরের-উত্তর এবং দক্ষিণের। কিন্তু মৃত্যুর পর প্রথম রাজবংশের রাজারা তাদের উচ্চ মিশরীয় পরিচয়ে ফিরে যেতেন। তারা তাদের মাতৃভূমি এবিডোসে সমাধিস্থ হতেন যা মেমফিস থেকে অনেক দূরে–দক্ষিণে অবস্থিত ছিল।
এটি কোনো সরল কবরস্থান ছিল না। সাধারণ মিশরীয়রা তখনও মরুভূমির প্রান্তে বালুর মধ্যে সমাধিস্থ হতেন এবং তাদের মুখমণ্ডল পশ্চিমদিকে ঘোরানো থাকত। কিন্তু মিশরীয় অভিজাত বংশীয় ব্যক্তি যারা মর্যাদার দিক দিয়ে দ্বিতীয় সারিতে ছিলেন তারা মেমফিসের পশ্চিমদিকে অবস্থিত সাক্কারা নামক জায়গায় একটি বড়ো আকারের কবরস্থানে সমাধিস্থ হতেন। রাজাদেরকে কবর দেওয়া হতো এবিডোসে এবং কবরের চারপাশে ইট কিংবা পাথরের ঘর বানিয়ে নিমজ্জিত করা হতো। এই ঘরের চারপাশে বিব্রতকরভাবে বলিদানকৃত মানুষরা ছড়িয়ে থাকত। ডেনের চারপাশে প্রায় দুইশ মৃত পরিচারক ছিলেন এবং রাজা জেরের কবরের সঙ্গী ছিলেন প্রায় তিনশ সভাসদ ও চাকর।
এই রাজাগুলো হয়তো বা উত্তরের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিব্রত ছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পরে তারা বিস্ময়কর এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার অধিকারী হতেন। যে মানুষ তার নিজ মৃত্যুর পরেও আরও অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারেন—তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে, তিনি অবশ্যই সুমেরীয় রাজাদের সাময়িক ক্ষমতার প্রদর্শনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করতে পেরেছেন।
এটি আসলে সহজে ব্যাখ্যাযোগ্য কোনো ব্যাপার না—কীভাবে মানবজীবন উৎসর্গের মাধ্যমে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব! পঞ্চম ও ষষ্ঠ রাজবংশের ফারাওদের সমাধিস্থ করার সময় আস্তে আস্তে মিশরীয়রা কবর দেওয়ার পরে সমাধির দেওয়ালে বিস্তারিত নিয়মাবলি খোদাই করা শুরু করে দিয়েছে। সেখানে পিরামিডের পিচের মতো কালো প্রকোষ্ঠ থেকে আকাশে উত্তরণ, জীবন ও পরকালের মাঝে থাকা পানির স্রোত পেরিয়ে যাওয়া, অপেক্ষমাণ দেবতাদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়া ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে লেখা ছিল। কিন্তু এই ‘পিরামিড লেখনী’গুলোর বয়স এবিডোসে কবর দেওয়ার রীতি চালু হওয়ার অন্তত অর্ধ সহস্র বছর পর। এর মানে হচ্ছে, যখন প্রথম রাজবংশের রাজাদের কবর দেওয়া হচ্ছিল তখনও এসব রীতিনীতির কিছুই চালু হয়নি। সেই সময় রাজকীয় লাশগুলোকে ছেঁড়া কাপড়ে জড়িয়ে রেজিন দিয়ে ভেজানো হতো—কিন্তু তাতে লাশ সংরক্ষণে কোনো সুবিধা হতো না।
আমরা ধরে নিতে পারি যে রাজারা সূর্যের সাথে মিলিত হতো—আকাশপথে যাত্রার সময়। এবিডোসে রাজাদের পাশে কাষ্ঠনির্মিত নৌকার বহর থাকত, যেগুলোর কোনো কোনোটি একশ ফুট দৈর্ঘ্যের ছিল। এগুলো কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরি লম্বা লম্বা কূপের মধ্যে রাখা হতো। প্রথম রাজবংশের খোদাই করা বার্তায় দেখা যায় যে সূর্যদেবতা আকাশের মধ্য দিয়ে নৌকায় করে ভেসে যাচ্ছেন। অনুমান করা হয় যে ফারাও এবং তাদের সাথে কবরস্থ হওয়া বাকি আত্মারা এসব নৌকায় করে সূর্যদেবের সাথি হতেন (যদিও এবিডোসের একটি সমাধি কমপ্লেক্সে দেখা যায় যে নৌকা নয় বরং এক পাল উৎসর্গীকৃত গাধা রয়েছে রাজার জন্য; যা থেকে ধারণা করা যায় যে অন্তত এই একজন রাজা আকাশের পরিবর্তে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন মৃত্যুর পর)।
আমরা ধরে নিতে পারি যে রাজারা দিগন্তের অপরপাশে যাওয়ার মাধ্যমে পরকালে প্রবেশ করতেন; কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা কী করতেন?
সম্ভবত ফারাওরা সেখানে গিয়েও তাদের রাজকার্য চালিয়ে যেতেন। এই ধারণার পেছনে কোনো মিশরীয় প্রমাণ আমাদের হাতে নেই কিন্তু এটি নিশ্চিত যে গিলগামেশ মৃত্যুর পর যমপুরীর দেবতাদেরকে সহায়তা করেছিলেন সেখানে রাজত্ব চালানোর কাজে। উৎসর্গ করার ব্যাপারগুলো খানিকটা অর্থবহ হয় যদি আমরা ধরে নিই যে প্রাচীন ফারাওরা মৃত্যুর পরেও রাজকার্য চালিয়ে গিয়েছিল। যদি একজন রাজার ক্ষমতা তার মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় তা হলে তাকে শুধু তার জীবিতকালেই মান্য করার প্রশ্ন আসে-তাকে মৃত্যুর পরে অনুসরণ করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু তিনি যদি ‘ওপারে’ আপনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তা হলে তার ক্ষমতা হয়ে দাঁড়ায় অবিসংবাদিত। অজানা পথে পাড়ি দেওয়ার ব্যাপারটা শুধুই হয়ে দাঁড়ায় আনুগত্যের এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে উত্তরণের সোপান।
উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে থাকা টানাপোড়েনের কারণে প্রথম রাজবংশের রাজাদের এরকম কর্তৃত্বের প্রয়োজন ছিল—পুরো দেশকে এক সুতোয় গাঁথার জন্য। রাজার ক্ষমতার ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো বর্ণিত ছিল ‘মেমফাইট থিওলজি’- তে, যা খোদাই করা ছিল ‘শাবাকা পাথর’ (বর্তমানে এটি ব্রিটিশ জাদুঘরে রাখা আছে) নামক একটি সমাধিতে। পাথরটি আরও অনেক পরের কিন্তু এতে খোদাই করা ইতিহাস অনেক মিশর-বিশেষজ্ঞের মতে প্রাচীনতম মিশরীয় রাজবংশের কথা বলে।
পরে এই উপাখ্যানের আরও অনেক লম্বাচওড়া বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু এর মূলভাবটি খুবই সহজ।
দেবতা ওসাইরিসের কাছে সমগ্র পৃথিবীর উপর রাজত্ব করার ভার দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তার ভাই সেট তার ক্ষমতার উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। সে ওসাইরিসকে নীল নদে ডুবিয়ে মারে। ওসাইরিসের স্ত্রী (এবং বোন) দেবী আইসিস তার হারিয়ে যাওয়া স্বামী/ভ্রাতাকে খোঁজা শুরু করেন। যখন তিনি তার অর্ধনিমজ্জিত দেহটি খুঁজে পান তখন তিনি নিচু হয়ে তাকে অর্ধজীবিত করে তোলেন। ওসারাইস তাকে অন্তঃসত্ত্বা করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ সময় ধরে বেঁচে ছিলেন কিন্তু পৃথিবীর বুকে জীবন ধারণ করার মতো যথেষ্ট জীবন তার মাঝে ছিল না। তিনি মারা গিয়ে যমপুরীর অধিকর্তা হয়ে যান।
ওসাইরিস যমপুরীর ক্ষমতা গ্রহণের পর আইসিসের পুত্র হোরাস ভূমিষ্ঠ হয় এবং পার্থিব জগতের অধিকর্তায় পরিণত হয়।
জীবিতদের রাজা হিসেবে দেবতা হোরাসকে সূর্য, তারাসমূহ এবং চাঁদের সাথে তুলনা করা হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে (মিশর-বিশেষজ্ঞ রুডলফ আন্থেসের ভাষায়), ‘তার আছে স্বর্গীয় দেহ, যা দিন ও রাত উভয় সময়ে উজ্জ্বল; তিনি হচ্ছেন আকাশের স্থায়ী শাসক, যিনি সূর্যের মতো রাতের বেলায় অদৃশ্য হয়ে যান না।’ এ থেকে পরিষ্কার যে হোরাসের ক্ষমতার কখনও বেশকম হতো না।
মিশরের প্রথম যুগের ফারাওরা হোরাসের পার্থিব অবতার হিসেবে নিজেদেরকে দাবী করতেন এবং বলতেন যে তাদের ক্ষমতা রাতের আঁধার কিংবা মৃত্যুর পরও কমে যেত না। তবে যে যাই বলুক, সব রাজারই মৃত্যু হয়। তবে মিশরীয় ধর্মতত্ত্ব এই অবশ্যম্ভাবী সত্যের সাথে মানিয়ে নেয়। সুতরাং যখন একজন ফারাও মারা যেতেন তখন তাকে আর হোরাসের প্রতিরূপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো না।
তিনি ওসাইরিসের প্রতিমূর্তিতে রূপান্তরিত হলেন—এবং তিনি একইসাথে ছিলেন যমপুরীর রাজা এবং পার্থিব জগতের অধীশ্বর হোরাসের পিতা। মৃত ফারাও রাজার জীবিত পুত্র এখন পুনর্জীবনপ্রাপ্ত হোরাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন, যা এই ব্যবস্থাটির ব্যাবহারিক প্রয়োগ আমাদের কাছে পরিষ্কার করে দেয়; এর মাধ্যমে খুব সহজেই এবং ঝামেলামুক্তভাবে উত্তরাধিকারীদের মসনদে আরোহণের পথ সুগম হয়। নতুন রাজা শুধু পুরানো রাজার পুত্রই ছিলেন না, তিনি এক অর্থে তার পিতার পুনর্জন্ম নেওয়া রূপ। ফারাওদের মৃত্যু হতো কিন্তু তাদের প্রকৃত রাজক্ষমতার কোনো ক্ষয় হতো না কখনও। মিশরের রাজার কোনো ব্যক্তিসত্তা ছিল না—তিনি নার্মার, ডেন কিংবা জের নন, তিনি ছিলেন ক্ষমতার সমার্থক।
সমাজবিজ্ঞানীরা এই বন্দোবস্তকে ‘অবস্থানগত উত্তরাধিকার’ নাম দিয়েছেন। এখান থেকে মিশরীয়দের মাঝে তাদের পূর্বসূরিদের নাম বেছে নেওয়ার প্রবণতার পেছনে একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়—এই নামগুলো শুধুই নাম নয়, এগুলো আমৃত্যু রাজা হওয়ার অধিকার ধরে রাখার ইচ্ছার পরিচায়ক। এই ব্যবস্থাটি নিজের বোন কিংবা কন্যাকে বিবাহ করার প্রবণতার চেয়ে বেশি যৌক্তিক ছিল। যখন একজন ফারাও তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হন তখন তার মাতা এক অর্থে তার স্ত্রীতে রূপান্তরিত হন, কেননা তিনি তার পিতার নাম ও সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তবে আরও বেশ কয়েক শতক আগের ইডিপাসের মতো ঝামেলায় পড়তে হয়নি কাউকে এই প্রসঙ্গে।
মিশরীয়দের জন্য নিজ পরিবারই ছিল স্ত্রী খুঁজে পাওয়ার আদর্শ জায়গা। এডজিব, প্রথম রাজবংশের চতুর্থ রাজা, তার রাজকীয় খেতাবসমূহের সাথে একটি নতুন খেতাব যোগ করেন : দ্য নেসু-বিট। যদিও এই দুটি মিশরীয় শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘উচ্চ’ ও ‘নিম্ন’ কিন্তু এর দ্বারা এটা বোঝায় না যে ফারাও উচ্চ ও নিম্ন মিশরের অধিকর্তা ছিলেন। বরং এই দুটি শব্দের দ্বারা ইহজগৎ ও পরজগৎকে বোঝানো হতো। নেসু হচ্ছে সরকার চালানোর স্বর্গীয় ক্ষমতা- পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রচলিত রাজক্ষমতা, যা রাজা থেকে রাজায় হস্তান্তরিত হতো; আর বিট হচ্ছে নিচে বা ইহজগতে অবস্থানরত রাজা, যিনি ছিলেন মরণশীল এবং সেই স্বর্গীয় ক্ষমতার তৎকালীন অধিকারী।
এডজিব ছিলেন প্রথম রাজা যিনি এই খেতাবটি নিয়েছিলেন। তবে এই বিট অংশটুকু ধরে রাখতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল—তার রাজত্বকালেই সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম গণ-আন্দোলনটি হয়েছিল। তার কবরের চারপাশে চৌষট্টিজন বলিদানকৃত মিশরীয় ছিলেন–পরজগতের রক্ষাকর্তা হিসেবে তার অবস্থানকে মহিমান্বিত করার জন্য। কিন্তু অপরদিকে তার সমাধির অবস্থা খুবই করুণ, যা একটি পার্থিব স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে তার ইহজগতের রাজত্বের চিহ্নস্বরূপ। সম্ভবত এটিই এবিডোসের সবচেয়ে জীর্ণ সমাধি। তার নামখানাও বিভিন্ন সমাধি থেকে মুছে ফেলা হয় পরবর্তীতে, যা তার জীবদ্দশায় খোদাই করা হয়েছিল।
নাম মুছে ফেলার কাজটির নেপথ্যে ছিলেন পরবর্তী ফারাও রাজা সেমেরখেত। তিনি তার পূর্বসূরির নাম মুছে ফেলার মাধ্যমে ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে চেয়েছিলেন। ফারাওরা নিজেদেরকে বিবিধ নাম দেওয়ার মাধ্যমে স্বর্গীয় রাজক্ষমতার উপর নিজেদের অধিকার ফলাতেন আর জাদুবিদ্যায় ভরপুর হায়েরোগ্লিফিক্সে খোদাই করার মাধ্যমে তারা ইহজগতের উপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেন। কোনো একজন ফারাওর ব্যাপারে খোদাইকৃত বক্তব্যকে বিকৃত করার মানে ছিল সেই ফারাওকে পার্থিব স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা।
এডজিবের নাম মুছে ফেলার প্রয়াস থেকে আমরা সেমেরখেতের ব্যাপারে এটাই ধারণা করতে পারি যে তিনি হয় উৎখাতকারী ছিলেন নয়তো আততায়ী ছিলেন। পার্থিব ক্ষমতার দখল তিনি ভালোভাবেই নিয়েছিলেন; তিনি নিজের জন্য একটি সুদৃশ্য কবর নির্মাণ করেছিলেন যা এডজিবের তুলনায় অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। সেখানে এত বেশি ধূপ ঢালা হয়েছিল যে ভূগর্ভের তিন ফুট নিচে পর্যন্ত তৈলাক্ত হয়ে গিয়েছিল; এবং পরবর্তীতে ১৯০০ সালের দিকে যখন সমাধিটি খনন করা হয় তখন খননকাজে ব্যস্ত শ্রমিকদের নাকে তেলের সেই তীব্র গন্ধটি এসে আঘাত হানে।
কিন্তু তার নেসুর ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা সেভাবে সফল হয়নি। মানেথোর নথিতে লেখা আছে, ‘তার রাজত্বকালে অনেক অসাধারণ ঘটনা ঘটেছিল আর সাথে হয়েছিল ভয়াবহ বিপর্যয়ও।’
পরবর্তীতে অন্য কোনো নথিতে এই বিচিত্র বাণীটির কথা শোনা যায়নি। তবে নীল নদের আশেপাশের ভূমি পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে যে প্রথম রাজবংশের রাজত্বকালের শেষের দিকে নীল নদের বন্যার সংখ্যা ও প্রকোপ নাটকীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। দ্বিতীয় রাজবংশ ক্ষমতায় আসতে আসতে বন্যার সময়ের পানির উচ্চতা গড়ে তিন ফুট কমে গিয়েছিল, যা তার আগের একশ বছরের মাঝে সর্বনিম্ন ছিল।
কমে যাওয়া বন্যার সাথে সাথে যদি মিশরীয় কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণও কমে যায় তা হলে সেটিই হতে পারে আন্দোলনের উপযুক্ত কারণ। যখন জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী সেমেরখেত ব্যস্ত ছিলেন তার পূর্বসূরি এডজিবের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত মিনারসমূহ বিকৃত করার কাজে তখন সম্ভবত তার প্রজাদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল।
মিশরের জনজীবন অনেকাংশেই নীল নদের বন্যার উপর নির্ভরশীল ছিল। বছরের পর বছরের বন্যার সাথে বয়ে আসা পলিমাটির পরিমাণ ওঠানামা করলেও বছর শেষে ফলাফল একইরকম থাকত। সূর্যদেবতা হিসেবে হোরাস দায়িত্ব পালনকালে প্রতিটি সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় ভিন্ন হলেও প্রতিদিন সকালে সূর্য সেই পূর্বদিকেই উদিত হতো। নেসু-বিট খেতাবের অর্থ হচ্ছে যে রাজা অসীম এবং অপরিবর্তনশীল স্বর্গীয় ক্ষমতার অধিকারী হলেন এবং একইসাথে তাকে ক্ষয়িষ্ণু পার্থিব ক্ষমতা রক্ষার দ্বৈত ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হতে হলো। রাজা কবরস্থ হওয়ার পরও আবার তার নিজ পুত্রের মাধ্যমে ফিরে এলেন কিন্তু কিছুটা পরিবর্তিত অবস্থায়। তিনি ছিলেন সেই বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদের মতো যে বছর বছর নতুনভাবে জন্ম নেয়। প্রতিবার তার ফুলের রং ভিন্ন থাকে কিন্তু মূলটি একই থাকে।
সেমেরখেত যখন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো ফারাওর অতীত ইতিহাস মুছে ফেলতে শুরু করলেন তখন তা রাজতন্ত্রের তৎকালীন মতবাদের উপর একটি বড়ো ধরনের আঘাত ছিল। ব্যাপারটা এরকম ছিল যে একজন পোপ (খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরু) বছরের পর বছর ধরে অপরিবর্তনশীল নিয়মকানুন জারি করার পর জানা গেল যে তার নির্বাচনটিই বৈধ নয়; তিনি পোপ হতে পেরেছিলেন শুধু কার্ডিনালদের কলেজের ভুল গণনার কারণে। হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই যদি নীল নদের স্রোতধারা প্রশমিত হয়ে যায় তা হলে স্বাভাবিকভাবেই রাজার অবিসংবাদিত ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মিশরীয়রা ভাবতে লাগল, এরপর কী হবে? সকালে সূর্য ওঠা বন্ধ হয়ে যাবে?
সেমেরখেতের রাজত্ব একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়, যা এতটাই প্রকট ছিল যে মানেথো বাধ্য হয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় রাজবংশ’ শুরু করতে। ফারাওদের জন্য খারাপ সংবাদটি ছিল যে সেই সময় তাদের কবরের সাথে মানুষ বলিদানের প্রথাটি থেমে যায়।
ব্যাপারটা এমন ছিল না যে হঠাৎ করে মিশরীয় রাজাদের মানবজীবনের উপর নতুন করে শ্রদ্ধাভক্তি বেড়ে গিয়েছিল; যেমনটা কিছু ইতিহাসবিদের কলমে উঠে এসেছে—’প্রথম রাজবংশের তিরোধানের সাথে সাথে থেমে যায় মানবজীবন বলিদানের মতো অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক প্রথা।’ এর চেয়ে বেশি সম্ভাব্য কারণ ছিল হোরাসের অবিসংবাদিত ক্ষমতার প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যাওয়া। দ্বিতীয় রাজবংশের রাজা মানুষকে তার নিজের জীবন বলিদানে বাধ্য করতে পারছিলেন না আর, কারণ তিনি সেই আশ্বাস দিতে পারছিলেন না যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার হাতে রয়েছে নেসু-বিট-এর পদাধিকার। তিনি মানুষকে পূর্বের রাজাদের মতো করে আশ্বস্ত করতে পারেননি যে তার হাতে রয়েছে তাদের পরকালযাত্রাকে সুগম করার মতো ক্ষমতা।
দ্বিতীয় রাজবংশের রাজত্বকাল শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৯০ সালের দিকে; কিন্তু ঠিক কতজন রাজা রাজত্ব করেছিলেন সেই ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। খরার আগমনের সাথে সাথে জীবন-মৃত্যুর উপর রাজাদের প্রভাব না থাকার ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়ে যায় এবং মিশরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, যা বহু বছর ধরে চলেছিল। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় রাজবংশের সর্বশেষ রাজার ঠিক আগেরজন অর্থাৎ সেকেমিবের রাজত্বের সময়ে চরম উৎকর্ষে পৌঁছায়। একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে দক্ষিণের সৈন্যবাহিনী উত্তরের শত্রুদের সাথে নেখেব শহরে যুদ্ধ করে।
শকুনি দেবীর প্রাচীন শহর নেখেব ছিল হিয়েরোকনপোলিসের পূর্বপাশের অর্ধেক জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এটি এবিডসের একশ মাইল দক্ষিণে, একেবারে উত্তর মিশরের শেষ প্রান্তে ছিল। যখন দেখা যায় একটি নিম্ন মিশরীয় বিদ্রোহী দল এত দূরে এসে দক্ষিণের উচ্চ মিশরে আঘাত হানছে তখন আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে ততদিনে দ্বিতীয় রাজবংশের শৌর্যবীর্য প্রায় নিঃশেষিত।
যদিও সেকেমিব নিজে একজন দক্ষিণবাসী ছিলেন, তার নামসংবলিত শিলালিপি থেকে জানা যায় তিনি আদতে উত্তরবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এমনকি তার শরীরে উত্তরের রক্তও থাকতে পারে। তিনি তার খেতাবগুলো দেবতা হোরাসের চিহ্নগুলোর পাশে না লিখে দেবতা সেটের চিহ্নগুলোর পাশে লিখতেন।
ওসাইরিসের ভাই এবং তার হত্যাকারী (এবং তার পুত্র হোরাসের জাতশত্রু) সেট সর্বদাই উত্তরে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। পরবর্তীকালে সেটকে চিত্রায়িত করা হতো লাল চুল আর লাল আলখাল্লার সন্নিবেশে, যার মাধ্যমে লাল রাজত্ব আর নিম্ন মিশরকে বোঝানো হতো। তিনি ছিলেন বাতাস ও ঝড়বাদলের দেবতা এবং একইসাথে তিনি মেঘ ও বালুঝড়ের নিয়ন্ত্রকও ছিলেন। একমাত্র তার কাছেই ছিল সূর্যকে ঢেকে দেওয়ার মতো ক্ষমতা
ভাই ওসাইরিস এবং তার ছেলে হোরাসের প্রতি সেটের ঘৃণার ভাব শুধু ঈর্ষা থেকে আসেনি—তাদের মতো সেটও দেবতাদের রাজার রক্তসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন; তারও অভিলাষ ছিল মিশরের ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার। প্রাচীন উপাখ্যান থেকে জানা যায় যে ওসাইরিসকে হত্যা করার পরও সেট ও হোরাসের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে ঝগড়াবিবাদ চলেছে, এই ব্যাপারটি নির্ধারণ করার জন্য যে কার শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষমতা বেশি—পৃথিবী শাসন করার জন্য। এক পর্যায়ে তর্ক করতে করতে তারা একজন আরেকজনের সাথে কুস্তি করতে শুরু করেন। সেট হোরাসের বাঁ চোখ উপড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন কিন্তু শেষ হাসিটি হোরাসই হেসেছিলেন—তিনি তার চাচার অণ্ডকোষ ছিঁড়ে ফেলেন।
এর চেয়ে দ্বৈতভাবসংবলিত পরিস্থিতি আর হতে পারে না—দুই প্ৰতিপক্ষ, একইসাথে পরম শত্রু ও আত্মীয়, যুদ্ধ করছে ক্ষমতার উত্তরাধিকারের জন্য। হোরাস তার চাচার উত্তরাধিকারী তৈরি করার ক্ষমতাকে পাকাপাকিভাবে বিনষ্ট করে দিলেন এবং পরবর্তীতে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হলেন কিন্তু সেট ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তার আগেই পৃথিবীর আদিমতম অপরাধে দুষ্ট—নিজ ভাইকে হত্যা করেছেন তিনি।
সেট ও হোরাসের মাঝে তীব্র ঘৃণার সম্পর্কটি উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে থাকা বৈরিতার একটি প্রতিফলন ছিল। একই রক্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে ছিল যোজন যোজন পার্থক্য।
সেকেমিবের হোরাসের বদলে সেটের প্রতি আনুগত্য দেখানো থেকে পরিষ্কার ছিল যে কারা মিশরের দখল নেবে সেই বিতর্ক তখনও ভালোভাবেই বেঁচে ছিল। এবং যখন তিনি মারা যান তখন খাসেখেম নামের একজন হোরাস-পূজারি এসে সিংহাসনে বসেন এবং অস্ত্রের শাসন চালু করেন। তিনি দক্ষিণের সমগ্র বাহিনীকে এক পতাকার নিচে আনেন এবং একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে উত্তরের শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেন। নেখেন শহরে (হিয়েরোকনপলিসের বাকি অর্ধেক; পশ্চিমপাশে অবস্থিত) তার দুইটি মূর্তি পাওয়া যায়, যেখানে তিনি শুধু উচ্চ মিশরের সাদা মুকুট পরিধান করে আছেন এবং তার সিংহাসনের পায়ের কাছে পড়ে আছে উত্তরের পরাজিত যোদ্ধাদের বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশগুলো।
এভাবেই মিশর তার প্রথম গৃহযুদ্ধ কাটিয়ে ওঠে। খাসেখেমের যোগ্য নেতৃত্বে মিশরে তৃতীয় রাজবংশের আগমন ঘটে। খাসেখেম অবশ্যই আরও অনেক বেশি শ্রদ্ধা ও সুনামের দাবিদার, কেননা তার সময়েই দীর্ঘদিন ধরে শান্তি বজায় ছিল এবং এই সময়েই মিশরীয়রা উন্নতির শিখরে পৌঁছে পিরামিডের মাধ্যমে শিল্পচর্চা করার সুযোগ পেয়েছিল।
তৃতীয় রাজবংশের আয়-উন্নতির পেছনে খাসেখেমের মিশরীয় বাণিজ্যপথগুলোর পুনর্নির্মাণের বড়ো ভূমিকা রয়েছে। বদ্বীপ থেকে অস্ত্রসজ্জিত অভিযানগুলো আর করা হতো না কিন্তু খাসেখেমের রাজত্বকালীন লিখিত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে উপকূলীয় শহর বিবলোসে একটি বড়ো ধরনের বাণিজ্য হতো। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ঢাল থেকে সিডার গাছের গুঁড়ি কেটে এনে সেগুলো মিশরীয় বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে রপ্তানি করা হতো অন্যান্য জায়গায়। এই বাণিজ্যটির শুরু হয়েছিলে খাসেখেমের রাজনৈতিক বিবাহের হাত ধরে। তিনি স্ত্রী হিসেবে নিম্ন মিশরের একজন রাজকন্যাকে গ্রহণ করেছিলেন যার নাম ছিল নেমাথাপ। তার নাম ও পরিচয় ইতিহাসের পাতায় বেঁচে রয়েছে, কেননা পরবর্তীকালে তাকে স্বর্গীয় সম্মান দেওয়া হয় এবং তৃতীয় রাজবংশের গোড়াপত্তনকারী রাজমাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এবং এই সময়ে বিরাজমান শান্তিপূর্ণ পরিবেশ শুধু খাসেখেমের যুদ্ধকৌশলের কারণে নয় বরং সেটসংক্রান্ত সমস্যাটির বুদ্ধিদীপ্ত সমাধানের কল্যাণেও সম্ভব হয়েছিল।
যুদ্ধের পরে খাসেখেম তার নামটি পরিবর্তন করেন। কিন্তু তিনি সেটকে সম্মানিত করার জন্য উত্তরের কোনো নাম কিংবা হোরাসকে গর্বিত করার জন্য কোনো দক্ষিণী খেতাব না নিয়ে বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। তিনি খাসেখেমউই হিসেবে পরিচিত হন, যার মানে হচ্ছে ‘দুই শক্তিমান জন আবির্ভূত হন’। এই নামটিতে হোরাসের শকুন এবং সেটের প্রতিকৃতি আঁকা ছিল। এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে হলেও এই দুই শক্তি একীভূত হয়েছিল।
এই একীভূতকরণের ব্যাপারটি পৌরাণিক কাহিনিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। হোরাস ও সেটের মাঝে কুস্তিযুদ্ধের পরে হোরাস তার হারিয়ে ফেলা চোখটি সেটের কাছ থেকে উদ্ধার করেন এবং তার পিতার কাছে দিয়ে দেন উপঢৌকন হিসেবে, যিনি তখন ‘মৃত্যুর অধীশ্বর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এদিকে সেটও তার নিজের সম্পদ ফিরে পান তিনি তার অণ্ডকোষ উদ্ধার করতে সমর্থ হন।
দুটি বিপরীতধর্মী শক্তির মাঝে যে দ্বন্দ্ব তার ভারসাম্য রক্ষা পেলেও তা পুরোপুরি চলে যায়নি। হোরাস মিশরের উপর তার ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থ হন কিন্তু সেট, যে পুনরায় একজন উত্তরাধিকারী জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছিল (যদিও তাত্ত্বিকভাবে), তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাতে থাকেন গোপনে। কয়েক শতক পরে প্রাপ্ত কিছু গল্প সংকলন থেকে কিছু কৌতুককর কাহিনি জানা যায় যেখানে সেট ও হোরাস তাদের মাঝের সংগ্রাম চালিয়ে যান বিচিত্র পন্থায়, যার মাঝে একটির মূলভাব ছিল—’হোরাসের বীর্য এবং এক টুকরো লেটুসের।’ শুনতে বিচিত্র মনে হলেও জননেন্দ্রিয়সংক্রান্ত এই কৌতুককর ঘটনাগুলো সেট ও হোরাসের ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দুতেই ঘটেছিল।
সেটের ক্ষমতা কখনোই কমে যায়নি এবং তিনি চলেও যাননি। তিনি সব সময় আশেপাশে থেকেছেন সুযোগের অপেক্ষায় এবং তিনি সারাক্ষণ নেসু-বিট নামটি একজন রাজার কাছ থেকে আরেকজনের কাছে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিতে বাধা দিয়ে গিয়েছেন, নিজের দাবি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে লিপ্ত থেকে।
ওসাইরিসের পরবর্তীকালের গল্পগুলোতে জানা যায় যে সেট শুধু তার ভাইকে ডুবিয়ে মারেননি বরং তিনি তার শরীরের অঙ্গগুলোকে ছিন্ন করে নিয়ে সেগুলোকে মিশরের বিভিন্ন জায়গায় ছুড়ে ফেলেছিলেন—তার নামকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য। আরও এক হাজার বছর পরে, সেট পরিণত হয়েছেন মিশরীয় লুসিফার কিংবা শয়তানে। তিনি ছিলেন একজন লাল চোখের আধারের রাজপুত্র এবং নর্সদের লোকির মতো তিনি দেবতাদের মন্দিরকে আগুনের শিখায় ভস্মীভূত করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
খাসেখেমউই, যে রাজা উত্তর ও দক্ষিণকে পুনরায় এক করতে পেরেছিলেন, শায়িত আছেন এবিডোসে, একটি সুবিশাল সমাধির মাঝে; যাতে রয়েছে প্রচুর সোনা, তামা ও মার্বেল কিন্তু নেই কোনো বলিদানকৃত মানবসন্তান। তার পিছে পিছে কোনো প্রজা মৃত্যুমুখে পতিত হননি।
মসনদ নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছিল যে কোনো ফারাও প্রকৃতপক্ষে দেবতা ছিলেন না; যে-কেউ যে-কোনো সময় তাদের ক্ষমতাকে দখল করে নিতে পারে।