অধ্যায় ছাব্বিশ – হিট্টিটদের উত্থান
খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯০ থেকে ১৫৬০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে হিট্টিটরা এশিয়া মাইনরে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল আর কাসাইটরা ব্যাবিলন দখল করে নিয়েছিল।
১৭১২ সালে সামসুইলুনা মৃত্যুবরণ করেন। ততদিনে তার পিতা হাম্মুরাবির ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের শক্তি স্তিমিত হয়ে গেছে এবং দক্ষিণ ও পূর্বদিকের অংশের দখল তাদের হাত থেকে ছুটে গেছে। সাম্রাজ্যটি হাম্মুরাবির সময়ে ওল্ড ব্যাবিলনিয়া নামে পরিচিত ছিল। এলাম বিদ্রোহ করেছিল, সুমেরের শক্তিশালী স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং এলাকাটি মোটামুটি জনমানবশূন্য হয়ে গিয়েছিল। সেখানকার ভূমিও অনুর্বর হয়ে পড়েছিল এবং সেখানে মানুষ বসবাস করার মতো পরিবেশ ছিল না। তথাকথিত সিল্যান্ড রাজবংশ – যাদের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানা যায় না- সেখানে রাজত্ব করতে শুরু করলেন। ব্যাবিলনের তৎকালীন রাজা তখনও উত্তর ও পশ্চিমের অঞ্চলগুলোর উপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন কিন্তু তার প্রভাব শুধু মারি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মারি পার হওয়ার পর বাকি অঞ্চলটুকু আলেপ্পোর রাজার অধীনে ছিল।
সামসুইলুনার প্রয়াণের পর বেশ কয়েকজন অজানা, অচেনা ও গুরুত্বপূর্ণ নয় এরকম রাজা পর্যায়ক্রমে ব্যাবিলনের শাসনভার দখল করেন। তার মৃত্যুর পরের একশ বছরের ইতিহাসে ব্যাবিলনের রাজসভা নিয়ে একটিমাত্র নথি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যেখানে বুধ গ্রহ উদয় ও অস্তমিত হওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত ও সঠিক বর্ণনা রয়েছে।
সেই সময়টিতে পৃথিবীর এক প্রান্তের শাসকদের ক্ষমতা কমে যাচ্ছিল আর আরেক প্রান্তের শাসকদের দাপট বাড়ছিল।
যখন সেমাইটরা মেসোপটেমিয়াতে ঘোরাঘুরি করতে করতে কানানে চলে এসেছিল তখন আরও উত্তরে একটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলা জাতির বসবাস ছিল—মূলত কাস্পিয়ান ও ব্ল্যাক সি-র মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের অনেকেই পূর্বদিকে অভিযোজন করেছিলেন। এরাই আর্যদের পূর্বপুরুষ যারা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যরা পশ্চিমে এশিয়া মাইনরে চলে গিয়েছিলেন এবং তারা সমুদ্রের তীরবর্তী বেশ কিছু গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০০ সাল নাগাদ এই ইন্দো-ইউরোপীয় গোত্রটি হ্যালিস নদীর পশ্চিমপাশে উপদ্বীপের সম্পূর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছিল। তারা পশ্চিমের অন্যান্য দ্বীপ ও উত্তরের বিভিন্ন জনবসতি বিশেষ করে আসসুর শহরের সঙ্গে নিয়মিত বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করেছিল। এই কারণেই আসসুরের বণিকরা সেখানে তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
যখন হাম্মুরাবি মেসোপটেমিয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে সমগ্র অঞ্চলটিকে একতাবদ্ধ করছিলেন তখন এশিয়া মাইনরের ইন্দো-ইউরোপীয়রা একাধিক যুদ্ধ-নেতার নেতৃত্বে ছোটো ছোটো রাজত্বে বিভক্ত হচ্ছিল। তবে এই নেতাদের কারও পরিচয়ই আমরা জানি না, তাই তারা কীভাবে এই সাফল্য অর্জন করেছিলেন সেটিও আমরা জানি না। আমরা শুধু এটুকুই জানি যে মিশরীয়রা তাদের ব্যাপারে জানতেন এবং তারা তাদেরকে একটি অনন্য জাতি হিসেবে বিবেচনা করতেন। মিশরীয়রা তাদেরকে ‘এইচটি’ নাম দিয়েছিলেন, যেটি নেওয়া হয়েছিল তাদের নিজেদের ভূখণ্ডের নাম ‘হাট্টি’ থেকে। এই হাট্টি অঞ্চলের বাসিন্দাদেরকেই আমরা হিট্টিট নামে চিনি।
হিট্টিটরা তাদের প্রতিবেশী আসসুরের বণিকদের কাছ থেকে লিখতে শিখেছিলেন। তাদের সকল প্রাচীন লেখনীতে তৎকালীন এসিরীয়দের কুনেইফর্ম লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। ১৭৯০ সাল নাগাদ হিট্টিটদের শহর কুসসারার নেতা নিজস্ব নথি সংরক্ষণ করতে শুরু করেন এবং এর মাধ্যমেই ইতিহাসে পদার্পণ ঘটে হিট্টিটদের।
তাদের নেতা আনিট্রাস তার পিতার কাছ থেকে দুই শহরবিশিষ্ট ছোটো রাজত্বটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। তার পিতা নিকটবর্তী নেসা শহরে রাতের অন্ধকারে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সেখানকার রাজাকে অপহরণ করে নিয়ে আসেন এবং শহরটির দখল নিয়ে নেন। পিতার আমলে আনিট্টাস ‘লর্ড অব দ্য ওয়াচটাওয়ার’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন, যে দায়িত্বের অংশ হিসেবে তাকে রাজত্বটির সীমানার চারপাশে বসানো সকল প্রহরাকেন্দ্র বা ওয়াচটাওয়ার থেকে পাওয়া প্রতিবেদনগুলোকে পর্যালোচনা করতে হতো। পিতার মৃত্যুর পর ‘কুসসারার রাজপুত্র’ হিসেবে পরিচিত আনিটাস সাম্রাজ্য বিস্তারের নিজস্ব লড়াই শুরু করলেন। তিনি নিকটবর্তী শক্তিশালী শহর হাটুসাসের উপর মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাতে চালাতে এক সময় শহরটিকে লুটে নিতে সক্ষম হলেন। তিনি শহরটিকে অভিশাপ দিলেন, ঠিক যেভাবে আগাদে শহর দখল করে সেটিকে অভিশপ্ত করা হয়েছিল—‘আমি শহরে আগাছা রোপণ করলাম… আমার পরে যে রাজা হবে তাকে যেন ঝড়ের দেবতা বজ্র দিয়ে আঘাত করেন এবং হাটুসাকে নতুন করে সাজান।’
তারপর তিনি পুরুশখন্দ শহরের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই শহরটি হিট্টিটদের কাছে পবিত্রভূমির মতো ছিল, যেমনটি ছিল সুমেরীয়দের কাছে নিপ্পুর। এই শহরটিও নিপ্পুরের মতো সবার মনে অবিসংবাদিত রাজধানীর আসনে ছিল এবং এর শাসনকর্তা সমগ্র ভূখণ্ডের উপর আধিপত্যের দাবি করতে পারতেন। পুরুশখন্দের রাজা হাটুসাসের ধংসস্তূপের উপর থেকে দৃশ্যমান কালো ধোঁয়া দেখেই সম্ভবত কোনো লড়াই ছাড়াই আত্মসমর্পণ করলেন।
তার সমসাময়িক রাজা হাম্মুরাবি তখন টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের দুইপাশের ভূখণ্ডের দখল নেওয়ার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছেন। একইভাবে আনিট্টাসও একটি জাতি গঠন করলেন। তিনি সগৌরবে ঘোষণা দিলেন, ‘সূর্য উদয় হয় এরকম সকল ভূখণ্ড আমি দখল করে নিয়েছি।’
এই দাম্ভিক ঘোষণার পাশাপাশি তিনি নিজেকে রাজপুত্রের পরিবর্তে ‘মহান রাজা’ হিসেবে অভিহিত করতে লাগলেন। তিনি চল্লিশ বছর ধরে রাজত্ব করতে পেরেছিলেন; যা ছিল যে-কোনো প্রাচীন রাজার জন্য বেশ সম্মানজনক একটি সময়পর্ব। হাম্মুরাবির মৃত্যুর এক বছর পরে তার মৃত্যু হয়। তবে এই দুজনের মধ্যে বার্তা বিনিময়ের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আনিট্টাসের নিজের হাতে বানানো রাজত্বটি বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শহর কুসসারাকে ঘিরেই পরিচালিত হয়েছিল। অবশেষে একজন রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন অভিশাপকে অবজ্ঞা করার এবং তিনি হাটুসাস শহরকে পুনর্নির্মাণ করতে গেলেন। ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরটির কাছেই ছিল সাতটি ঝরনা; এর চারপাশ ঘিরে ছিল উর্বর ভূমি এবং সেখানে এমন একটি টিলা ছিল যার উপর খুব সহজেই প্রাসাদ নির্মাণ করে সেটিকে প্রতিরক্ষা দেওয়া যেতে পারে। এরকম চমৎকার একটি জায়গাকে ফেলে রাখাকে পুরোপুরি অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
কুসসারা থেকে হাটুসাসে রাজধানী স্থানান্তর করার সঙ্গে সঙ্গেই এই রাজাটি হাটুসিলিস প্রথম নামে পরিচিত হলেন, যার মানে হলো ‘যিনি হাটুসেস থেকে এসেছেন।’ তিনি এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন জায়গা থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরের উত্তর-পূর্ব তীরে অবস্থিত পশ্চিম সেমাইট রাজত্বের উপর সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করেছিলেন, যার ফলে বেশ কিছু ছোটো শহর তার দখলে আসে। আনিটাস হিট্টিট জাতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিন্তু হাটুসিলিস তাদেরকে একটি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করেছিলেন, যাদের অধীনে বিভিন্ন জাতি ছিল।
তিনি ছিলেন একজন চৌকশ যোদ্ধা। খুব সম্ভব সেই আমলে তার চেয়ে যোগ্য কোনো যোদ্ধার অস্তিত্ব ছিল না—হরপ্পার শহরগুলো পানিতে ডুবে যাচ্ছিল; হাম্মুরাবি ততদিনে গত হয়েছেন; মিশরে থেবেস আর আভারিসের রাজারা যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং মিনোসের রাজত্ব কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল।
তবে এত সাফল্যের পরও হাটুসিলিসের মৃত্যু হয় চরম দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে এবং সেটি হাটুসাস শহরে নয় বরং তার পুরানো বাসস্থান কুসসারায়। তিনি নিজেই মৃত্যুশয্যায় বসে অনুরোধ করেছিলেন তাকে তার আদি নিবাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। টেস্টামেন্ট নামের একটি হিট্টিট নথিতে তার নাতি মুরসিলিসের উদ্দেশ্যে দেওয়া বিদায়ী ভাষণের বৃত্তান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। সেই বক্তব্যে হাটুসিলিস তার ছেলে ও মেয়ের প্রতি বিষোদ্গার করেন; এবং বলেন যে তারা অভিজাত শ্রেণির বিপথগামী হিট্টিটদের কথায় কান দিয়েছিল এবং তাতে তার প্রতি তাদের মন বিষিয়ে ওঠে। হাউসিলিস অভিযোগ করেন, ‘তারা আমার ছেলেমেয়েকে বলেছিল-তোমরা পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো এবং তারা সেই কথায় প্ররোচিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে।’
ইতোমধ্যে তিনি তার দুই সন্তানকে ত্যাজ্য করে নিজের ভাগ্নেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করে রেখেছেন মনে মনে। কিন্তু তিনি তার জীবন সায়াহ্নে এসে ভাগ্নেকেও পরিত্যাগ করলেন। টেস্টামেন্টে রেখে যাওয়া বর্ণনা অনুযায়ী সেই ভাগ্নের মধ্যে সহমর্মিতার গুণাবলি ছিল না। সে ছিল নিরুত্তাপ ও নির্দয় এবং তার রাজা হওয়ার মতো যোগ্যতা ছিল না। তার চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য তার মাকেই অর্থাৎ নিজ বোনকে দায়ী করেন হাটুসিলিস। তিনি বোনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন : ‘তুমি ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাপ, যে গরুর মতো জোরে শব্দ করে।’ বলা বাহুল্য, সেই বোনটি বা তার ছেলে কেউই সিংহাসনের কাছেও ভিড়তে পারেননি। বৃদ্ধ রাজা অবশেষে নাতি মুরসিলিসকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং অসংখ্য সামরিক বিজয় ও পারিবারিক অতৃপ্তি নিয়ে তার জীবনাবসান ঘটে।
১৩ কিংবা ১৪ বছর বয়সি মুরসিলিস নিজেকে আবিষ্কার করলেন একগাদা রিজেন্ট বা রাজকীয় অভিভাবকের মাঝে, যাদের দায়িত্ব ছিল প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত তার খেয়াল রাখা। শুধু এই অভিভাবকরাই নয়, সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারবঞ্চিত রাজার আত্মীয়স্বজনও তাকে ঘিরে রাখছিল। তবে এত গোলযোগের মধ্যেও মুরসিলিস সিংহাসনে দখল করার বয়স পর্যন্ত মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটেই পৌঁছাতে পেরেছিলেন; যেটি সেই যুগের জন্য বেশ বড়ো একটি প্রাপ্তি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। তার অভিভাবক-ভাগ্য বেশ ভালো ছিল, কারণ তিনি পেয়েছিলেন আদর্শ মানুষ ও হিট্টিট রাজপুত্র পিমপিরাকে। তিনি মুরসিলিসকে শুধু একজন যোগ্য রাজা নয় বরং একজন সহমর্মী শাসক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। হিট্টিটদের নথিতে পিমপিরার উপদেশের বর্ণনা পাওয়া গেছে। তিনি মুরসিলিসকে বলেন, ‘ক্ষুধাতজনকে রুটি দাও। উলঙ্গ মানুষকে কাপড় দাও। শীতে কাতর মানুষদের উষ্ণতা দাও।’
তবে সিংহাসনে বসার পর মুরসিলিস সহমর্মিতা দেখানোর বদলে নতুন ভূখণ্ড দখলের দিকেই বেশি নজর দিলেন। তিনি আলেপ্পোর সঙ্গে আগের শাসকদের সাক্ষরিত শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে অঞ্চলটিকে দখল করে নেন। এই ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে টেস্টামেন্টে : ‘মহামান্য রাজা হাটুসিলিসের মৃত্যুর পর তার নাতি মহামান্য মুরসিলিস আলেপ্পোর রাজবংশ ও আলেপ্পো শহরকে ধ্বংস করেন।’
আলেপ্পোর সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে মুরসিলিস ব্যাবিলনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রাপথে তিনি বিভিন্ন কাসসাইট যুদ্ধনেতার মুখোমুখি হন। তিনি তাদেরকে পরাজিত করেন অথবা তাদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৯৫ সালের মধ্যে তিনি ব্যাবিলনের প্রাচীরের কাছাকাছি চলে আসেন। এরপর খুব সহজেই তিনি হাম্মুরাবির বংশধরকে (নাতির নাতি) পরাজিত করেন। মুরসিলিসের নিজের বর্ণনামতে, তিনি শহরের সব সম্পদ দখল করে নেন, বাসিন্দাদের বন্দি করেন এবং রাজাকে লোহার চেইন দিয়ে আটকে রাখেন। হাম্মুরাবির সর্বশেষ বংশধরটির ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল তা আর জানা যায়নি।
মুরসিলিস ব্যাবিলনকে নিজের রাজত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তার আধিপত্য প্রমাণ করেছেন। তিনি তার নানার মতো ছিলেন; তিনি নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিমান রাজা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেই খুশি ছিলেন। ব্যাবিলন তার সাম্রাজ্য থেকে অনেক দূরে ছিল। হাটুসাসে বসে সেই শহর শাসন করা খুব কঠিন হতো। তাই তিনি মুরসিলিস শহরকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে নিজের রাজধানীতে বিজয়ীর বেশে ফিরে যান। তিনি অনেক দূরে চলে যাওয়ার পর কাসসাইট যুদ্ধবাজ নেতারা ব্যাবিলনের ধ্বংসস্তূপের উপর আধিপত্য স্থাপন করতে এলেন। অবশেষে ব্যাবিলনে অ্যামোরাইটদের শাসনের অবসান হলো।
মুরসিলিস আটক করা বন্দিদের ও লুট করা ধনসম্পদ নিয়ে বিজয়ীর বেশে নিজের রাজধানী হাটুসাসে ফিরে আসেন। বিপুল জয়ধ্বনীর নেপথ্যে তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র ততক্ষণে দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
ষড়যন্ত্রের কারিগর ছিলেন তারই কাপবাহক হ্যানটিলি, যিনি ছিলেন একজন বিশ্বাসভাজন কর্মকর্তা এবং একইসঙ্গে মুরসিলিসের বোনজামাই। মুরসিলিসের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী শাসক হিসেবে রাজত্ব করতে করতে তিনি মসনদের প্রেমে পড়ে যান। হঠাৎ রাজার ফিরে আসার ব্যাপারটি তাকে খুশি করতে পারেনি। ব্যাবিলন থেকে ফিরে আসার অল্পদিন পরে হ্যানটিলি ও প্রাসাদের আরেকজন কর্মকর্তা মিলে মুরসিলিসকে হত্যা করেন এবং হ্যানটিলি ক্ষমতা দখল করে নেন। হিট্টিটদের ক্রনিকল আমাদের জানায়, ‘তারা খারাপ একটি কাজ করেছে; তারা মুরসিলিসকে হত্যা করে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।’
হ্যানটিলি প্রায় তিন দশক ধরে ক্ষমতা দখল করে রাখতে পেরেছিলেন। এই সময়ে হিট্টিটরা বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তবে তিনি একটি দুর্ভাগ্যজনক ধারার সূত্রপাত করেছিলেন। হ্যানটিলি মারা যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজসভার একজন কর্মকর্তা তার সন্তানকে এবং নাতিদের হত্যা করেন এবং জোর করে সিংহাসন দখল করে নেন। পরবর্তীতে তাকে তার নিজ সন্তান হত্যা করেন। সেই হত্যাকারী সন্তান মৃত্যুবরণ করেন একজন উৎখাতকারীর হাতে এবং উৎখাতকারীর মৃত্যু হয় আততায়ীর হাতে। এভাবেই রক্তে রঞ্জিত হতে থাকে হিট্টিটদের সিংহাসন। হিট্টিটদের উত্তরাধিকার নির্বাচনের বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে রাজাকে হত্যা না করে কেউ রাজত্ব দখল করতে পারছিলেন না।
গুপ্তহত্যার বছরগুলোতে হাটুসাস শহরের রাজপ্রাসাদের চারপাশে ২৫ ফুট ঘনত্বের একটি মোটা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। হিট্টিট শাসকদের জন্য তার নিজ রাজত্বের সীমানার ভেতরে বসে রাজকার্য পরিচালনা করা যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।