অধ্যায় আট – প্রথম যুদ্ধের ইতিহাস

অধ্যায় আট – প্রথম যুদ্ধের ইতিহাস 

খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ সালের আশেপাশে উরুকদের রাজা গিলগামেশ সুমেরে তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলো দখল করে নেন। 

যখন সুমেরীয়রা কুনেইফর্ম ব্যবহার করা শুরু করেন তখন তারা ‘একদা এককাল’ থেকে নিকট অতীতে উন্নীত হন। তারা বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের উপাখ্যান, বাণিজ্যিক চুক্তি এবং নির্মিত মন্দিরের বিস্তারিত বর্ণনা লিখে রাখতে শুরু করেন। রাজাদের তালিকাটিকে তখন আনুষ্ঠানিকভাবে ট্যাবলেটে খোদাই করে রাখা সম্ভব হলো। 

যুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাল্পনিক প্রাণী ও অতিপ্রাকৃত শক্তির কাহিনিগুলোর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু লেখনীর উদ্ভাবনের সাথে সাথে আমরা সত্য ঘটনাকে কল্পকাহিনি থেকে আলাদা করে ফেলার একটি উপায় খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই সময়ের লেখাগুলো থেকে একটি ব্যাপার জানা যায় যে রাজারা লেখকদেরকে অর্থ প্রদান করতেন তাদের কীর্তিগুলোর ব্যাপারে লেখার জন্য এবং স্বভাবতই যে রাজার কাছ থেকে টাকা পাওয়া যেত তার বীরত্বগাথায় জাঁকজমকও বেশি থাকত। সেই কারণেই হয়তো এসিরীয়দের বর্ণনায় দেখা যায় যে খুব অল্পসংখ্যক এসিরীয় রাজা যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু একই যুদ্ধে জয়ী হওয়া দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজার জয়গাথা পড়ে এবং সেই বিবরণ তুলনা করে আমরা সহজেই ধরতে পারি প্রকৃতপক্ষে সেই যুদ্ধে কোন রাজা জয়লাভ করেছিলেন। 

সুমের রাজ্যে সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছিল এবং সাথে সাথে চলছিল বিভিন্ন শহরের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ। এই ধরনের ছোটো যুদ্ধগুলো খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকেই হয়ে আসছিল। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা বার্তা, রাজাদের তালিকা ও গল্পসংগ্রহ থেকে আমরা সবচেয়ে প্রাচীন যুদ্ধগুলোর ব্যাপারে জানতে পারি। সেটাই প্রথম যুদ্ধের উপাখ্যান। 

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০ সালে সুমেরীয় রাজা মেস্কিয়াজ্ঞাশের উরুক শহরের শাসক ছিলেন। ইরাকের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত শহর ওয়ারকার আদি নাম ছিল উরুক, যেটি ছিল সুমেরের সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলোর মাঝে একটি। এটি কমপক্ষে ৩৫০০ সাল থেকে মনুষ্য অধ্যুষিত ছিল। মেস্কিয়াজ্ঞাশেরের যুগে এটি ছিল বৃহত্তম শহর। 

এই শহরের প্রাচীরগুলো ছিল ছয় মাইল লম্বা এবং এর ভেতরে ও বাইরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। 

তোরণের ভেতরে দুটি বিশাল আকৃতির মন্দির কমপ্লেক্স ছিল। একটির নাম কুল্লাবা, যেখানে সুমেরীয়রা জড়ো হতো স্বল্পভাষী ও দূরে থাকা আকাশদেবতা আন-এর পূজা করার জন্য। ইয়ান্না কমপ্লেক্সে তারা আরও অনেক বেশি সুতীব্র ভক্তি প্রদর্শন করতেন ইনান্নার প্রতি, যিনি ছিলেন প্রেম ও যুদ্ধের জনপ্রিয় দেবী। 

এই ব্যাপারটি মেস্কিয়াজ্ঞাশেরকে বেশ পীড়া দিত যে তার বৃহৎ এবং ঐতিহাসিক শহরটি সুমের নামক মুকুটের সবচেয়ে বড়ো রত্ন নয়। সে স্থানটি কি দখল করে রেখেছিল, যে শহরের রাজা নিজেকে সুমেরের অধিপতি দাবি করেছিল। ততদিনে কিশের প্রতিরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ পবিত্র শহর নিপ্পুরের উপরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই শহরে প্রধান দেবতা এনলিলের সমাধি দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে সুমেরীয় রাজাগণ দেবতার উদ্দেশ্যে ভেট দিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেন। কিশ সুমেরের সবচেয়ে শক্তিশালী শহর না হলেও নিঃসন্দেহে সবচেয়ে প্রভাবশালী শহর ছিল। খানিকটা হালের নিউ ইয়র্ক শহরের মতো; এটি প্রশাসনিক কিংবা সামরিক রাজধানী ছিল না কিন্তু তারপরও এই শহরটিই ছিল সুমেরীয় সভ্যতার প্রাণভোমরা- বিশেষ করে বাইরের লোকদের কাছে। 

মেস্কিয়াজ্ঞাশেরকে সেরকম মানুষ ভাবার কোনো কারণ ছিল না যে খুশিমনে লাইনের দ্বিতীয় স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি সম্ভবত উরুকের আইনসম্মত রাজার কাছ থেকেই মসনদ দখল করে নিয়েছিলেন। সুমেরীয় রাজাদের তালিকায় তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ‘সূর্যদেবতা উতুর সন্তান’ হিসেবে। এই ধরনের বর্ণনা সাধারণত অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের দাবিকে হালাল করার উদ্দেশ্যেই লেখা হয়ে থাকে। উরুক দখল করে নেওয়ার পর মেস্কিয়াজ্ঞাশের তার প্রভাব বিস্তার করেন একটি ব্যতিক্রমধর্মী পন্থায়। পার্শ্ববর্তী শহর লাগাশ কিংবা কিশের সাথে টক্কর না দিয়ে তিনি আশেপাশের সকল বাণিজ্যপথের দখল নিয়ে নেন, যেগুলো পাহাড় ও সমুদ্রের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আবশ্যকীয় ছিল। 

কোনো রকম যুদ্ধ না করেই তিনি বাণিজ্যপথগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। 

মেস্কিয়াজ্ঞাশেরের দরকার ছিল তরবারি, কুড়াল, শিরস্ত্রাণ ও ঢালের কিন্তু নদীর মাঝের সমতলভূমিতে ধাতব পদার্থের ঘাটতি ছিল। কিশের অস্ত্র-নির্মাতারা উত্তর থেকে কাঁচামালের সরবরাহ পেতেন কিন্তু উরুকের সেরকম কোনো উৎস ছিল না। দক্ষিণ থেকে কাঁচামাল আনার জন্য তারা মরিয়া হয়ে গিয়েছিল। 

অবশেষে দক্ষিণে একটি কাঁচামালের উৎস খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। দক্ষিণ- পূর্ব আরবে (এখনকার ওমান) অবস্থিত তাম্রপর্বত মাগান উপবিষ্ট ছিল সমতলভূমির উপর—সগৌরবে। লাগাশ এবং তার আশেপাশের শহরগুলো থেকে প্রাপ্ত কুনেইফর্মে লেখা ট্যাবলেটগুলো থেকে জানা যায় যে আল-হাজার পর্বতমালার তাম্রপর্বতগুলোতে ৬৫ ফুট গভীর খনি ছিল এবং ধাতব পদার্থ গলিয়ে ফেলার জন্য সেখানে ওভেনও ছিল। 

আরব মরুভূমি থেকে মাগানে যাওয়ার জন্য সহজ কোনো পথ ছিল না। মাগানের বন্দরে অবশ্য সুমেরীয় নলখাগড়ার নৌকা পাওয়া যেত, যেগুলোকে বিটুমেন সহযোগে পানিরোধক করা হতো। এই নৌকাগুলোতে সর্বোচ্চ ২০ টন পর্যন্ত ধাতব পদার্থ বহন করা যেত এবং এদের মাধ্যমে শস্য, উল ও তেলের বিনিময়ে তামা আনা যেত। মেস্কিয়াজ্ঞাশেরের প্রথম যৌক্তিক যুদ্ধ-প্রস্তুতিমূলক কাজ ছিল এইটা নিশ্চিত করা যে উরুকের বণিকদের জন্য একটি সরল পথ ছিল তৈরি করা ওমানের উপত্যকা থেকে মাগান পর্যন্ত। এই কাজটি করার জন্য তিনি আলাপ আলোচনা ও হামলা—দুই পন্থার জন্যই প্রস্তুত ছিলেন। 

কিন্তু সুমেরীয় কামারদের শুধু বিশুদ্ধ তামা হলেই চলছিল না। মেস্কিয়াজ্ঞাশেরের তিনশ বছর আগে থেকেই তারা তামার সাথে শতকরা দশ ভাগ আর্সেনিক যোগ করা শুরু করেছিল, যার মাধ্যমে ব্রোঞ্জ তৈরি করা যেত, যেটিকে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া সহজতর ছিল এবং এর মাধ্যমে তৈরি অস্ত্রগুলো অধিকতর ধারালো থাকত। 

সর্বসেরা ব্রোঞ্জ পাওয়ার জন্য মেস্কিয়াজ্ঞাশেরের দরকার ছিল টিনের। আর্সেনিক দিয়ে তৈরি ব্রোঞ্জ ছিল খানিকটা দুর্বল এবং এর মাধ্যমে অস্ত্র বানানো একটু ঝামেলাপ্রদ ছিল। এ ছাড়া আর্সেনিক দিয়ে কাজ করার কারণে দীর্ঘমেয়াদে দক্ষ কামারদের মৃত্যুর হারও অনেক বেশি ছিল, যা ভালো অস্ত্রাগার বানানোর পথে একটি বড়ো বাধা ছিল। এই কারণেই সম্ভবত টিনের খোঁজে মেস্কিয়াজ্ঞাশের তার সৈন্যদলকে নিয়ে পাহাড়ে অভিযান চালিয়েছিলেন। হয়তো জাগরোস পর্বতমালার পাথুরে ঢালে কিংবা আরও উত্তরের কাস্পিয়ান সাগরের নিম্নদেশে অবস্থিত বরফাচ্ছাদিত ও খাড়া পর্বত এলবুর্জে টিন লুক্কায়িত ছিল। মেস্কিয়াজ্ঞাশের তার সৈন্যদের এসব পার্বত্য পথের গভীরে নিয়ে যান এবং পাহাড়ি উপজাতিদের বাধ্য করেন তাকে সেসব ধাতু এনে দিতে যার মাধ্যমে তিনি তামাকে ব্রোঞ্জে রূপান্তরিত করতে পারতেন। 

অবশেষে উরুক অস্ত্রসজ্জিত হলো কিন্তু মেস্কিয়াজ্ঞাশের তার জীবদ্দশায় যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখে যেতে পারলেন না। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র এনমেরকার সিংহাসনে বসলেন। এনমেরকারের কাজটি একেবারেই ঈর্ষণীয় ছিল না; তার পিতার রেখে যাওয়া সুনামকে ছাড়িয়ে যাওয়ার গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তার উপর। এবং এক্ষেত্রে ব্যাপারটি মোটেও সহজ ছিল না, কেননা তার পিতা ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি সমুদ্র ও পর্বত জয় করেছিলেন সগৌরবে। আরও অনেক বছর পরে লিখিত এনমেকার অ্যান্ড দ্য লর্ড অব আরাত্তা নামক উপাখ্যানে সুনাম কুড়ানোর কারণে তার প্রয়াসের ব্যাপারে কিছুটা জানা যায়। 

আরাত্তা কোনো সুমেরীয় শহর ছিল না; এটি কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে পূর্বদিকের পর্বতগুলোর কাছে অবস্থিত ছিল। সেখানকার বাসিন্দারা এলামাইট নামে পরিচিত ছিলেন, যারা এমন একটি ভাষায় কথা বলতেন যার সাথে সুমেরীয় ভাষার কোনো যোগসূত্র ছিল না। এই ভাষাটির মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি এখনও। এলামাইট শহরগুলো টিন কিংবা তামার খনির উপর বসে ছিল না কিন্তু সেখানে পাওয়া যেত অন্যান্য মূল্যবান ধাতু এবং পাথরসমূহ; যেমন রুপা, সোনা, নীলা পাথর এবং তারা এসব দামি পাথরের বিনিময়ে সুমেরীয়দের কাছ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে আসছিল বেশ কয়েক বছর ধরে। 

তার পিতার ছায়া থেকে বের হয়ে আসার জন্য এনমেরকার ঠিক করলেন তিনি তার একজন বাণিজ্য-অংশীদারের সাথে ঝগড়া করবেন। তার তেমন কোনো রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না এক্ষেত্রে কিন্তু তারপরও আরাত্তা ছিল দখল করার জন্য উপযুক্ত একটি শহর। যে-কোনোভাবে তাদেরকে কুক্ষিগত করতে পারলে তিনি নিজেকে এমন একটি শহরের অধিকর্তা হিসেবে দাবি করতে পারতেন যে শহরের প্রাচুর্য, দক্ষ কামার এবং পাথর কাটিয়েদের উরুক শহরের বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে শ্রদ্ধা করে আসছিলেন। এই ঘটনাটি ঘটাতে পারলে নিশ্চিতভাবেই তিনি অনেক খ্যাতি পেতেন। 

তাই তিনি আরাত্তার রাজার কাছে একটি চিঠি পাঠান, এই মর্মে যে ইনান্না (যিনি ঘটনাচক্রে আরাত্তারও প্রধান উপাস্য দেবী ছিলেন) আরাত্তার চেয়ে উরুকের প্রতি বেশি সন্তুষ্ট এবং এই ব্যাপারটিকে অনুধাবন করার নিমিত্তে তাদের উচিত হবে এনমেরকারকে তাদের স্বর্ণ, রৌপ্য ও নীলা পাথর পাঠানো—বিনা খরচে। 

এটি প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা ছিল এবং আরাত্তার বাসিন্দারা সেভাবেই এর প্রত্যুত্তর দেন। 

দুঃখজনকভাবে, এনমেরকার সম্ভবত তার নিজ বাহিনীর শক্তিমত্তাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই উপাখ্যানে বর্ণিত আছে যে দুই রাজার মধ্যে কিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে দেবী ইনান্না ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করেন। তিনি এনমেরকারকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে তিনি অবশ্যই উরুককে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন কিন্তু আরাত্তার প্রতিও তিনি অনুরক্ত, যে কারণে তিনি আশা করছেন যে এনমেরকার সেই শহরটিকে ধ্বংস করবেন না। কাহিনির শেষে আমরা দেখতে পাই যে আরাত্তার এলামাইটরা তখনও এনমেরকারের কবজার বাইরেই থেকে গিয়েছে। 

আমরা এই গল্পটি সুমেরীয়দের কাছ থেকে পেয়েছি, এলামাইটদের কাছ থেকে নয়। সেক্ষেত্রে গল্পের অনিশ্চিত উপসংহার থেকে ধারণা করে নেওয়া যায় যে প্রকৃতপক্ষে সেই যুদ্ধে সুমেরীয়দের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। এনমেরকারের মৃত্যু হয় সন্তানহীন অবস্থায় এবং সেই সাথে তার পিতার রাজত্ব ও বংশেরও সমাপ্তি ঘটে। 

তার উত্তরসূরি ছিলেন তারই একজন সহযোদ্ধা, যার নাম ছিল লুগুলবান্দা, তিনি নিজেও ছিলেন একাধিক উপাখ্যানের নায়ক। লুগুলবান্দার পরে আরও একজন যোদ্ধা সিংহাসনে উপবিষ্ট হন যার সাথে আগের রাজাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ থেকে দুটি জিনিস পরিষ্কার হয় : ১) বংশপরস্পরায় ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল এবং ২) উরুক শহরের পক্ষ থকে পরবর্তীতে আর কোনো শহর দখল করে নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। 

সম্ভবত আরও একশ বছর পরে পুনরায় উরুক থেকে সুমেরের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখলের আরেকটি প্রচেষ্টা দেখা যায়। তরুণ গিলগামেশ ছিলেন উরুকের নতুন রাজা। তিনি আগের রাজাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। 

রাজাদের তালিকা অনুযায়ী গিলগামেশ কোনো রাজবংশ থেকে আসেননি। তিনি সম্ভবত কুলুবা মন্দির কমপ্লেক্সের একজন উচ্চশ্রেণির পূজারি ছিলেন যার মূল দায়িত্ব ছিল আন দেবতার উপাসনা করা। এ ছাড়া তার একটি বিশেষ সুনাম ছিল। রাজতালিকায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তাকে লিল্লু ডাকা হতো, যে শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পৈশাচিক ক্ষমতাসম্পন্ন’। যদিও সুমেরের সকল রাজা এক সময় পূজারির ভূমিকা নিতেন কিন্তু সেই সময়টি ততদিনে সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক বছর ধরেই পূজারিদের উপাসনার কাজ ও প্রশাসনিক অধিদপ্তরের কাজকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছিল। গিলগামেশের ধর্মীয় ক্ষমতা থাকতে পারে কিন্তু সেই সাথে তিনি রাজ্যাধিকারও দখল করে ফেলেন, যার উপর তার কোনো বৈধ দাবি ছিল না। 

গিলগামেশের রাজত্ব শেষ হওয়ার অল্প কিছুদিন পরে লিপিবদ্ধ একটি উপাখ্যানে আমরা দেখতে পাই যে তিনি এনমেরকারের সহযোদ্ধা লুগুলবান্দাকে নিজের পিতা হিসেবে দাবি করেছেন। 

ব্যাপারটিকে বেশ হাস্যকর মনে হয়, কেননা লুগুলবান্দা গিলগামেশের জন্মেরও প্রায় কয়েক দশক আগে সিংহাসনে ছিলেন। তবে একজন মানুষ যে কিনা নিজের ব্যক্তিগত ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখতে চাইছে তার জন্য লুগুলবান্দার জীবন ছিল একটি খুবই ভালো সুযোগ। তিনি একজন অসামান্য সাফল্যের অধিকারী যোদ্ধা-রাজ ছিলেন এবং তার মধ্যে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জয় করে সম্পূর্ণ তাজা অবস্থায় পরবর্তী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার বৈশিষ্ট্যটি প্রকট ছিল। 

গিলগামেশের সময়ে সম্ভবত লুগুলবান্দা ত্রিশ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে মৃত ছিলেন। কিন্তু তিনি ততদিনে একজন সুমেরীয় বীর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন। আরও একশ বছর পরে তাকে দেবতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। তিনি নিজের অজান্তে গিলগামেশকে ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষমতার ঝলক ধার দিয়েছিলেন। 

গিলগামেশের প্রথম অভিলাষ ছিল উরুকের ক্ষমতা দখল করে নেওয়া। সেটি সফল হওয়ার সাথে সাথেই তিনি তার পরবর্তী লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ দেন। কিশ শহরটি তখনও বেদখল ছিল এবং তার রাজার দায়িত্ব ছিল পবিত্র শহর নিপ্পুরকে সুরক্ষা প্রদান করা। এই দায়িত্বের মাধ্যমে কিশের রাজা অন্য সবার চেয়ে বেশি সম্মান এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। 

উরুকের তরুণ রাজা গিলগামেশের জীবন থেকে আমরা এসব পৌরাণিক উপাখ্যান সরিয়ে ফেললেও তাকে আমরা আবিষ্কার করি একজন চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব হিসেবে। গিলগামেশ সব চাইতেন : বিশ্বাসী সঙ্গী, মসনদ, একটি রাজকীয় তকমা, ‘কিশের রাজা’ উপাধি এবং সবশেষে অমরত্ব। 

অন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আগে গিলগামেশ প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে আগে তার নিজ শহরের প্রাচীরগুলোকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন। গিলগামেশের মহাকাব্যের শুরুতে লেখা আছে, ‘উরুকে (গিলগামেশ ) প্রাচীর বানালেন’ এবং সাথে ‘একটি বিশাল দুর্গ আজও সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়; বাইরের শক্ত প্রাচীর যা এখনও উজ্জ্বল রয়েছে তামার অসাধারণ ক্ষমতায়; এবং ভেতরের দেওয়ালেরও কোনো তুলনা হয় না।’ 

তবে তামার ব্যাপারটি পুরোপুরি অতিরঞ্জিত। উরুকের প্রাচীরের উপাদান পাথরও ছিল না, তামা হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। সেসব প্রাচীর তৈরি হয়েছিল উত্তর থেকে আনা কাঠ দিয়ে। 

গিলগামেশের কাঠ আনার অভিযানের বর্ণনা রয়েছে সেই মহাকাব্যে। সেখানে বলা আছে যে তিনি উত্তরের সিডার বনের দিকে যাত্রা করেন দেবতাদের উদ্দেশ্যে একটি মঠ নির্মাণের পরিকল্পনায় কিন্তু সেটি তৈরি করার আগে তার বনের রাক্ষসের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। সেই রাক্ষসের নাম ছিল ‘হুমবাবা’, যার অর্থ সুমেরীয় ভাষায় ‘বিশালত্ব’। সে ছিল একজন মহান যোদ্ধা এবং তার যুদ্ধের কৌশলকে দেওয়াল ভাঙার যান ‘ব্যাটারিং র‍্যাম’-এর সাথে তুলনা করা হতো। তবে এটি শুধুই গল্পের কাহিনি, প্রকৃত সত্য হচ্ছে গিলগামেশকে এলামাইট উপদলগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল যারা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটি বিনা বাধায় ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। 

প্রাচীরগুলোর শক্তি বাড়ানোর পর গিলগামেশ প্রস্তুত হলেন কিশের রাজার সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে। 

কিশের রাজার নাম ছিল এনমেবারাজ্ঞেসি এবং তিনি ভুঁইফোঁড় গিলগামেশের আগমন ঘটার অনেক বছর আগে থেকেই রাজত্ব করছিলেন। তিনি শুধু কিশের রাজাই ছিলেন না, একইসাথে তিনি ছিলেন পবিত্র শহর নিপ্পুরের রক্ষাকর্তাও। সেখানে পাওয়া একটি খোদাইকৃত লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে এনমেবারাজ্ঞেসি নিপ্পুরে ‘হাউস অব এনলিল’ নামের একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন—আকাশ, বায়ু ও ঝড়বাদলের অধিকর্তা সুমেরীয় দেবতা এনলিলের উদ্দেশ্যে। এনলিলের হাতে ছিল সকলের ভাগ্যের চাবিকাঠি এবং সেই সূত্রে তার ছিল অসীম ক্ষমতা। এনলিলের সাথে টক্কর দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না; বর্ণিত আছে যে একদিন সামান্য কারণে রেগে গিয়ে তিনি পৃথিবীতে মহাপ্লাবন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু যখন থেকে জানা যায় যে এনমেবারাজ্ঞেসির নির্মিত মন্দিরটি এনলিলের প্রিয় তখন থেকেই কিশের রাজা আশ্বস্ত ছিলেন যে তিনি দেবতার আশির্বাদপ্রাপ্ত। তিনি দক্ষিণ থেকে আগত তরুণ প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলেন বলে মনে হয় না। 

অপরদিকে, গিলগামেশ উরুকের বাহিনীগুলোকে সাজাচ্ছিলেন যুদ্ধের সাজে। পদাতিক বাহিনীকে চামড়ার ঢাল, বর্শা ও কুড়ালে সজ্জিত করা হয়েছিল; প্রাচীর ভাঙার কাজে ব্যবহৃত ‘সিজ ইঞ্জিন’ বানানো হয়েছিল উত্তর থেকে আনা কাঠ দিয়ে, যেগুলোকে টেনে নেওয়ার জন্য ষাঁড় ও ঘর্মাক্ত মানুষ নিয়োজিত করা হয়েছিল। একটি সুবিশাল সিডার গাছের গুঁড়িকে ভাসিয়ে আনা হয়েছিল ইউফ্রেটিস নদের স্রোতে। এটিকে ‘ব্যাটারিং র‍্যাম’ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য আনা হয়েছিল এবং ধারণা করা হয়েছিল যে এটি খুব সহজেই কিশের মূল তোরণটি ভেঙে ফেলতে পারবে। 

প্রাচীন যুগে যুদ্ধকৌশল ছিল সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা। সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকে আমরা খোদাই করা দৃশ্যে দেখতে পাই বর্শা-যোদ্ধা, আটক করা জীবিত ও মৃত বন্দি, ভেঙে যাওয়া তোরণ এবং ফাটল ধরানো প্রাচীরের বর্ণনা। 

এক সময় আক্রমণ শুরু হলো এবং তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। আমরা এটা নিশ্চিতভাবে জানি, কেননা রাজাদের তালিকায় দেখা যায় যে এনমেবারাজ্ঞেসির মৃত্যু হয়েছিল বার্ধক্যজনিত কারণে এবং তার মৃত্যুর পর শান্তি পূর্ণভাবে তার পুত্র আজ্ঞার কাছে কিশ রাজ্য শাসনের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। 

গিলগামেশ কেন পিছপা হয়েছিলেন? 

গিলগামেশকে ঘিরে যত ধরনের গল্প আছে তার মূলভাবটি একইরকম একজন তরুণ, যুদ্ধংদেহী ও উদ্দাম ব্যক্তি, যার ছিল প্রায় অতিমানবীয় স্বাস্থ্য; তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি রাতে মাত্র ঘণ্টা তিনেক ঘুমাতেন এবং তার পরেই লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে কাজে ফিরে যেতেন; কিংবা সেরকম একজন মানুষ যিনি পঁচিশ বছর বয়সের আগেই একটি উড়োজাহাজ কোম্পানির মালিক বনে যেতেন কিংবা আটাশের আগে চারটি প্রতিষ্ঠান কেনা ও বেচার অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন কিংবা ত্রিশের আগেই নিজের আত্মজীবনী লিখে ফেলতেন। 

আরেকটি ব্যাপার সবখানে শোনা যেত যে গিলগামেশের এই অসীম শক্তি ও সামর্থ্য তার চারপাশের মানুষের বিরক্তির উদ্রেক করত। মহাকাব্যে বর্ণিত আছে যে গিলগামেশের নিরন্তর খোঁচাখুঁচিতে তার সহযোদ্ধা ও সহকর্মীরা এতটাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল যে তারা দেবতাদের কাছে ফরিয়াদ জানাতেও ছাড়ত না। তবে বাস্তবে যা হয়েছিল তা হচ্ছে মানুষ হাল ছেড়ে দিয়েছিল এবং নাগরিকদের কাছ থেকে যথাযথ সহায়তা না পেয়ে গিলগামেশ বাধ্য হন পিছপা হতে। 

কোনো একটি সুমেরীয় শহরের রাজা প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম শাসক ছিলেন না। গিলগামেশ উত্তরে অভিযান চালানোর আগে তাকে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের একটি সভার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। সুমের এমন একটি জায়গা ছিল যেখানে প্রতিটি মানুষকে সর্বক্ষণ তার প্রতিবেশীদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হতো। সেই কারণেই তাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। সমগ্র মানবজাতির মধ্যে তারাই সবার আগে আইনকানুন লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তারা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করতে পেরেছিল এবং তারা সেই তথ্য খোদাই করে রেখেছিল যাতে এই ব্যাপারে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না থাকে। তারা কোনো রাজার অনধিকার চর্চায় প্রতিবাদ করতে পিছপা হতেন না কখনও; আর এই বিশেষ ঘটনাটির ক্ষেত্রে তারা এক পর্যায়ে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে বসে। 

গিলগামেশ তখনও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন কিশ দখল করার ব্যাপারে। অপরদিকে ‘কিশের আজ্ঞা’ শান্তিচুক্তি করার ব্যাপারে উৎসাহিত ছিলেন। একটি কাব্যিক গল্প ‘গিলগামেশ অ্যান্ড আজ্ঞা অব কিশ’-এ বর্ণিত আছে যে আজ্ঞা গিলগামেশের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার উদ্দেশ্যে। 

গিলগামেশ এটাকে দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে নিয়েছিলেন, শান্তির প্রতীক না ভেবে। সেই গল্প অনুযায়ী, তিনি প্রথম সেই জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সভায় আজ্ঞার বার্তার ব্যাপারটি উত্থাপন করেন। কিন্তু তিনি শান্তির কথা না বলে পুনরায় আক্রমণ করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক প্রাচীর ও ভূমি রয়েছে দখল করে নেওয়ার জন্য। আমরা কি কিশের রাজার কাছে হার মেনে নেব? আমাদের উচিত অস্ত্র দিয়ে তাদের উপর আঘাত হানা।’ 

প্রবীণদের সেই সভা কিশ শহরে অস্ত্রের আঘাত হানার প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয় আর গিলগামেশকে জানানো হয় অন্য শহরের দিকে নজর না দিয়ে নিজের শহরের উন্নতি সাধন করতে। কিন্তু গিলগামেশ হাল ছাড়েননি। তিনি এরপর যুবাদের সভায় একই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তিনি জোর গলায় বলেন, ‘এর আগে, কখনোই তোমরা কিশের কাছে পরাজিত হওনি।’ আরও কিছু বাগাড়ম্বর প্রয়োগের পরে তারা রাজি হয়ে যায় তার যুদ্ধযাত্রায় সহায়তা প্রদান করতে। 

“কার সেই ক্ষমতা আছে যে কিশের রাজার ছেলেকে ধরে নিয়ে আসতে পারবে? আপনিই দেবতাদের আশির্বাদপুষ্ট’, তারা গিলগামেশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল। “কিশ পরিবারের কাছে অবনত হয়ো না; আমরা, যুবাদের কি উচিত হবে না তাদের উপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া? মহান দেবতারা তৈরি করেছেন উরুক এবং তার সুউচ্চ প্রাচীরসমূহ আকাশকে স্পর্শ করে; কিশের সৈন্যবাহিনী ক্ষুদ্র; এবং সেই শহরের বাসিন্দারা আমাদের দিকে মাথা উঁচু করে তাকাতে পারে না।’ 

যুবাদের সমর্থন পেয়ে গিলগামেশ নবোদ্দ্যমে কিশকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। 

বয়োবৃদ্ধ (জ্ঞানী কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার বয়স নেই) ও যুবা (সবল কিন্তু মাথা গরম)-দের সমন্বয়ে গঠিত এই দ্বৈত সংসদীয় ব্যবস্থা প্রায় সকল সুমেরীয় নগরেই দেখা যেত। প্রাচীন পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে এই ব্যবস্থা শত শত বছর ধরে প্রচলিত ছিল। অনেক বছর পরে, মহান হিব্রু রাজা সলোমন সিংহাসনে আরোহণ করার পর তার দেশের শাসনব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করে নেন; যাতে প্রয়োজনবোধে বৃদ্ধদের শান্তিপূর্ণ উপদেশকে উপেক্ষা করে যুবাদের হঠকারী উপদেশকে গ্রহণ করে নেওয়া যায়। 

গিলগামেশ একই পন্থা অবলম্বন করেন কিন্তু তাতে তিনি ক্লেশের শিকার হন। পুনরায়, কিশের উপর আক্রমণ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না, অর্থাৎ তিনি জয়লাভ করতে অসমর্থ হন। পুনরায়, উরুকের লোকজন প্রতিবাদ করেন এবং গিলগামেশ বাধ্য হন সৈন্যবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিতে 

আমরা এই তথ্যগুলো জানতে পেরেছি, কেননা গিলগামেশ শেষ পর্যন্ত কিশকে পরাজিত করে কিশের রাজা এবং নিপ্পুরের রক্ষাকারী উপাধিগুলো জয় করতে পারেননি—এই কীর্তি সাধন করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন ব্যক্তি; তিনি হলেন উর-এর রাজা। 

উরুক থেকে বেশ খানিকটা দক্ষিণে এবং কিশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত উর শহরটি নীরবে শক্তি অর্জন করে যাচ্ছিল যুগ যুগ ধরে। এই শহরের রাজা মেসানেপাড্ডা ছিলেন অবিশ্বাস্য লম্বা জীবনের অধিকারী। গিলগামেশ দ্বিতীয়বারের মতো কিশ আক্রমণ করতে করতে মেসান্নেপাড্ডার ক্ষমতাসীন থাকার সময়পর্ব কয়েক যুগ পেরিয়ে গিয়েছে। তার বয়স গিলগামেশের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এমনকি তিনি হয়তো প্রয়াত এনমেগারাজ্ঞেসির চেয়েও বেশি বয়স্ক ছিলেন। তিনিও কিশের দখলদারিত্ব কামনা করতেন এবং তার সাথে উরুকের কোনো ধরনের মিত্রতাও ছিল না। 

কিন্তু তিনি আক্রমণ শুরু করার আগে উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। 

গিলগামেশ সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করলেন আর রেখে গেলেন একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল কিশ। ঠিক সেই সময় মেসান্নেপাড্ডা কিশ আক্রমণ করলেন এবং অনায়াসে শহরটি দখল করে নিলেন। তিনিই কিশের প্রথম রাজপরিবারের বিনাশ ঘটান এবং পবিত্র শহর নিপ্পুরের দখল নেন। অপরদিকে গিলগামেশের অতিমানবীয় শক্তিমত্তা দেওয়ালের পিছে গুমরে মরতে লাগল—তার নিজ নাগরিকদের যুদ্ধযাত্রায় অনীহার কারণে। 

আবারও উত্তরাধিকারের বিষয়টি রাজনীতির খেলাকে প্রভাবিত করল। কিশের পতন হলো, যখন এনমেবারাজ্ঞেসি মারা গেলেন এবং তার পুত্রের হাতে শহর রক্ষার ভার দিয়ে গেলেন। এখন গিলগামেশ অপেক্ষা করতে লাগলেন উপযুক্ত সময়ের জন্য। বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ মেসান্নেপাড্ডা মারা গেলেন এবং তার পুত্র মেসকিয়াগুন্নার হাতে তিনটি রাজত্ব—উর, কিশ ও নিপ্পুরের রক্ষাভার অর্পিত হলো। ততদিনে যুদ্ধযাত্রায় আপত্তি জানানো বয়োবৃদ্ধদের সভার সদস্যদের মধ্যেও অনেকে মারা গিয়েছে। এই অবস্থায় গিলগামেশ তৃতীয়বারের মতো আক্রমণ পরিচালনা করলেন। 

এবার তিনি জয়লাভ করলেন। একটি তিক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি মেস্কিয়াগুন্নাকে পরাজিত করে তার শহর এবং তিনি অন্য যেসব অঞ্চল যুদ্ধের মাধ্যমে দখল করেছিলেন তার সবটা দখল করে নিলেন। একটি ফলাফল নির্ধারণী যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে গিলগামেশ শেষ পর্যন্ত সুমেরের চারটি প্রধান শহর—কিশ, উর, উরুক এবং পবিত্র নিপ্পুরের অধিকর্তা হতে পারলেন। 

কয়েক যুগ ধরে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করার পর অবশেষে গিলগামেশের কিশ অভিযান সফলতার মুখ দেখেছিল এবং এর মাধ্যমে তিনি সুমেরের সিংহভাগ এলাকা দখলে এনেছিলেন, যা এর আগে অন্য কোনো রাজা করে দেখাতে পারেননি। তবে তার এই জয়রথ ছিল স্বল্পস্থায়ী। গিলগামেশের অতিমানবীয় শারীরিক সক্ষমতাও তাকে অমরত্ব প্রদান করতে পারেনি। তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরেই চার কোণে অবস্থিত চার রাজ্যের আধিপত্য এবং তাকে ঘিরে থাকা সকল সত্য-মিথ্যা গল্পগুলো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার আসে তার পুত্রের উপর। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *