অধ্যায় আটাশ – উৎখাত ও প্রতিশোধ

অধ্যায় আটাশ – উৎখাত ও প্রতিশোধ 

মিশরে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৪৬ থেকে ১৪৪৬ পর্যন্ত ১০০ বছরে টুথমোসিস তৃতীয় তার চাচি হাটশেপশুটের কাছে রাজত্ব হারান কিন্তু তিনি তা পুনরুদ্ধার করেন এবং পশ্চিমা সেমাইটদের ভূখণ্ড দখল করে নেন। 

আহমোসের মৃত্যুর পর তার ছেলে আমেনহোটেপ প্রথম ক্ষমতায় বসেন এবং নুবিয়ানদের উপর একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকেন এবং তাদের দখলে থাকা সকল ভূখণ্ডে মিশরীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তার পিতার বিজয়কে সমন্বিত করেন। কিন্তু এখানেই তার পরিবারের যবনিকাপাত ঘটে। আমেনহোটেপের কোনো সন্তান ছিল না এবং তিনি তার জীবনের বড়ো একটি অংশ অবিবাহিত অবস্থায় কাটিয়ে দেন। তার স্ত্রী (এবং আপন বোন) খুব কম বয়সে মারা যান এবং আমেনহোটেপ আর কাউকে বিয়ে করেননি। 

যে যুগে ফারাওরা অসংখ্য স্ত্রী এবং ডজন ডজন রক্ষিতা রেখে গর্ববোধ করতেন সেই যুগে আমেনহোটেপের এহেন আচরণ এটাই নির্দেশ করে যে নারীর প্রতি তার আসক্তিই ছিল না। 

তারপরও এটি খুবই অদ্ভুত ঘটনা। প্রাচীন যুগের শাসকরা সমলিঙ্গের সম্পর্কে জড়ালেও রাজবংশের স্থিতিশীলতা রক্ষার তাগিদে উত্তরাধিকারী জন্ম দেওয়ার দায়িত্বে কখনও অবহেলা করতেন না। ব্যতিক্রম হিসেবে আমেনহোটেপ একা থাকলেন এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতিকে পরবর্তী রাজা হওয়ার জন্য মনোনীত করলেন। 

সেনাপতি টুথমোসিস তার শ্যালক ছিলেন, যার কারণে তাকেও রাজবংশের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তারপরও তার রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রচলিত পিতা-পুত্রের রাজা হওয়ার স্বাভাবিক ধারায় একটি বড়ো আকারের বিঘ্ন ঘটে। আহমোস, টুথমোসিস প্রথম এবং তার দুই বংশধর টুথমোসিস দ্বিতীয় ও চতুর্থের মমিগুলো এতটাই ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে যে খুব সহজেই তাদের চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়। টুথমোসিস পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চেহারার মিল খালি চোখেই দেখা যায় এবং এটাও দেখা যায় যে তারা আহমোসের চেয়ে দেখতে অনেকটাই ভিন্ন। 

টুথমোসিস প্রথম শেষ বয়সে রাজা হন এবং মাত্র ৬ বছর রাজত্ব করেন। 

তার রাজত্বের শুরু থেকেই তিনি তার কবরের ব্যাপারে পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। ততদিনে পিরামিডগুলো মিশরীয়দের মনে আর আগের মতো বিস্ময় জাগানিয়া কোনো পবিত্র বস্তু হিসেবে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। চোর- ডাকাতরা মোটামুটি মিশরের সব পিরামিডে ঢুকে পড়তে পেরেছিল। স্বভাবতই ফারাওদের কবরস্থান হিসেবে পরিচিত পিরামিডগুলো সোনা ও সোনার তৈরি বিভিন্ন উপকরণে ঠাসা ছিল। টুথমোসিস তার কবরের উপকরণ না হারানোর জন্য একটি নতুন ও গোপন স্থান খুঁজে বের করেন। তিনি একটি গুহায় নিজের কবর তৈরি করেন। পিরামিডের অভ্যন্তরের মতো সেই গুহার দেওয়ালেও রং করা ছিল এবং এর একটি গোপন প্রবেশদ্বারও ছিল। যে উপত্যকায় এই গুহার অবস্থান সেটি পরে ‘ভ্যালি অব দ্য কিংস’ (রাজাদের উপত্যকা) হিসেবে পরিচিত হয়। 

চিত্র-১১ : প্রাচীন মিশরের রাজারা 
চিত্র-১১ : প্রাচীন মিশরের রাজারা 

তার পূর্বসূরির মতো টুথমোসিস প্রথম নারীবিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি কমপক্ষে দুবার বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন আমেনহোটেপের বোন এবং মহান আহমোসের কন্যা। দুটি পুত্র ও দুটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয় এই স্ত্রীর গর্ভে। তবে পরবর্তীতে তিনি তার রাজবংশের বাইরে থেকেও আরেকজন নারীকে বিয়ে করেন যার গর্ভে আসে একটি পুত্রসন্তান। 

টুথমোসিস ফারাও হওয়ার পর তার উত্তরসূরি হিসেবে তিনি প্রথমে বড়ো পুত্র এবং পরে দ্বিতীয় পুত্রকে মনোনয়ন দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুজনেই তার মৃত্যুর আগেই মৃত্যুবরণ করেন। নিজের বংশের বাইরে কোনো ‘বিশ্বস্ত বন্ধুর’ কাছে রাজশাসনের ভার ছেড়ে যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিল না। তাই নিরুপায় হয়ে তিনি তার নিম্ন গোত্রীয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রকে মনোনয়ন দেন। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি, পরিবারে নিম্ন গোত্র থেকে আসা পুত্রের অবস্থানকে সুসংহত করতে তিনি তাকে তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত এক কন্যাসন্তানের সঙ্গে বিয়ে দেন, যার নাম ছিল রাজকন্যা হাতশেপশুট। মাত্র ৬ বছর রাজত্ব করার পর টুথমোসিসের মৃত্যু হয় এবং তার সন্তান টুথমোসিস দ্বিতীয় নাম নিয়ে অভিষিক্ত হন এবং পাশে পান রানি হাতহেপশুটকে। 

টুথমোসিস দ্বিতীয় মোটামুটি সারা জীবনই দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে ঝামেলায় ছিলেন এবং তার এই দুর্বল স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে স্ত্রী হাতহেপশুটের যে-কোনো দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। টুথমোসিস দ্বিতীয়-এর রাজত্বের প্রথম থেকেই হাতহে পশুটকে সহ-শাসক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের কোনো পুত্রসন্তান জন্মায়নি; একমাত্র সন্তান ছিলেন কন্যা। 

হাতহেপশুটের গর্ভে টুথমোসিস দ্বিতীয়র আর কোনো সন্তান জন্মায়নি। কথিত আছে, রাজা আইসেট নামে এক নারীর সঙ্গ উপভোগ করতেন কিন্তু তাকে কখনোই বিয়ে করেননি। 

আইসেটের গর্ভে একটি পুত্র জন্ম নেওয়ার পর তিনি এই অবৈধ সন্তানকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত করেন, যেটি তার স্ত্রীর জন্য বেশ অপমানজনক একটি বিষয় ছিল। 

মাত্র ৩৫ বছর বয়সে টুথমোসিস দ্বিতীয় মারা যাওয়ার পর তার সন্তান টুথমোসিস তৃতীয় শাসনভার পান। কিন্তু তার বয়স তখন মাত্র ৬। হাতহে পশুট কৌশলে এই শিশুর সৎ-মা এবং চাচি হিসেবে রিজেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

রাজপ্রতিনিধি বা রিজেন্ট হিসেবে প্রথম তিন-চার বছরে তাকে দেখা যায় শিশু টুথমোসিস তৃতীয়-এর পাশে, সহযোগী হিসেবে। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের আশেপাশে হাতহেপশুট একটি বড়ো মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন। মন্দিরটি তিনি এমনভাবে তৈরি করেন যাতে সবাই মনে করে তিনি নিজে সূর্যদেবতা আমুনের সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে এসেছেন। 

অপরদিকে তিনি এটাও ঘোষণা দেন যে তার ‘পৃথিবীর’ পিতা টুথমোসিস প্রথম মারা যাওয়ার আগে তাকেই মিশরের শাসক হিসেবে নির্বাচিত করে রেখে গেছেন এবং তার অভিষেকও হয়েছে। নববর্ষের প্রথম দিনে পুরো রাজসভার সামনে এই অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেন। তিনি একটি হোরাস নাম এবং নিম্ন ও উচ্চ মিশরের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য নিজেকে শক্ত দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। 

এই গল্পটি পুরোপুরি বানোয়াট ছিল এবং রাজসভার কোনো না কোনো সদস্য অবশ্যই এটার প্রতিবাদ জানাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন সভাসদও এর প্রতিবাদ করেননি, যা থেকে বোঝা যায় হাতহেপশুট তাদেরকে আগেই হাত করে রেখেছিলেন এবং বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে শিশু রাজার চেয়ে তিনি দেশ চালানোর জন্য বেশি দক্ষ। নিশ্চিতভাবেই তিনি প্রভাবশালী আমুনের স্টুয়ার্ড সেনেনমাট-এর সহায়তা পেয়েছিলেন, যার বিনিময়ে তিনি তাকে কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কিছু বড়ো বড়ো উপাধি দিয়েছিলেন। প্রধান স্থপতি, রাজকীয় জাহাজের স্টুয়ার্ড, আমুনের গোলাঘরের রক্ষক, আমুনের জমিজমার তত্ত্বাবধায়কসহ আরও বেশ কিছু বিচিত্র দায়িত্ব তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি একইসঙ্গে গবাদি পশু, বাগান ও তাঁতিদেরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। 

 এসব দায়িত্ব পেয়ে তিনি ক্ষমতাবান হতে পারলেও জনপ্রিয় হতে পারেননি। অনেকে কানাঘুষা করতে লাগলেন যে সেনেনমাট শুধুই উপদেষ্টা নন, হাতহেপশুটের কাছে তার গুরুত্ব আরও বেশি। হাতহেপশুটের মন্দিরের কাছাকাছি একটি গুহার দেওয়ালে একটা খুবই রূঢ় দেওয়াললিপি খুঁজে পাওয়া গেছে। সেখানে সেনেনমাট ও হাতহেপশুটের মধ্যে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ইঙ্গিতসূচক একটি ছবি দেখা যায়। 

হাতহেপশুট প্রকৃতপক্ষে তরুণ টুথমোসিস তৃতীয়কে কখনও উৎখাত করেননি। তিনি নিজেকে শুধু দুই শাসকের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হিসেবে চিত্রিত করেন। হাতহেপশুটের যে মূর্তিগুলো খুঁজে পাওয়া গেছে সেখানে তাকে কখনও রাজকীয় মাথার ব্যান্ড পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে, আবার কখনও অভিষিক্ত ফারাওর মার্কামারা দাড়িসহও দেখা গেছে। তার নিজস্ব মরচুয়ারি টেম্পলে রাখা পাথরের মূর্তিকে হেব সেড উৎসবে অংশগ্রহণরত অবস্থায় দেখা যায়, যে উৎসবের মাধ্যমে ফারাও রাজারা তাদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতেন। 

এই মূর্তির সঙ্গে টুথমোসিস তৃতীয়কেও দেখা যায় রানির সঙ্গে উৎসবে মেতে উঠতে। 

তবে শুধু হাতহেপশুটকেই দেখা যায় হেব সেড উৎসবের দৌড়ে অংশগ্রহণ করতে, যে উৎসবের মাধ্যমে ফারাওদের নীল নদের পানি ফিরিয়ে আনার ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রমাণ দেওয়া হয়। 

টুথমোসিস তৃতীয়র নিজস্ব শিলালিপিতে বর্ণিত আছে হাতহে পশুটের রাজত্বের সময় তিনি কোথায় ছিলেন। বেশির ভাগ সময় তিনি মেমফিস থেকে বহুদূরে অবস্থিত বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করতে যেতেন। তার চাচি তাকে এসব যুদ্ধে পাঠিয়েছেন বিরামহীনভাবে, এই আশায় যে কোনো এক যুদ্ধে তার মৃত্যু হবে। তিনি মূলত মিশরের উত্তরদিকের নব্য প্রজাতন্ত্রগুলোতে যেতেন যেখানে পশ্চিমা সেমিটিক প্রজারা সারাক্ষণ বিদ্রোহের হুমকি দিচ্ছিল। 

তবে তিনি যুদ্ধে নিহত হওয়া তো দূরে থাক এমনকি গুরুতরভাবে আহতও হননি। তার বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যার কোনো প্রচেষ্টার কথাও শোনা যায়নি। এ থেকে ধারণা করা যায় যে তার দেশের মানুষ তাকে হাতহেপশুটের বা সেনেনমাটের চেয়ে কোনোদিক দিয়েই বেশি অপছন্দ করতেন না। 

হাতহেপশুট তার ক্ষমতার সিংহভাগ ব্যয় করেন বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ প্রকল্পের পেছনে বিশেষ করে নির্মাণকাজে। সেই যুগে যে রাজা যত বেশি দালান নির্মাণ করতে সক্ষম হতেন তাকে তত বেশি সফল হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং হাতহেপট নিজেকে মহান শাসক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু প্রায় ২০ বছর ধরে তার সেনাবাহিনীর কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল না। 

হাতহেপশুটের স্বামী মৃত্যুবরণ করার প্রায় ২১ বছর পরে তিনি নিজেও মৃত্যুমুখে পতিত হন। অল্পদিন পরে তার প্রতিনিধি ও দোসর সেনেনমাটও মারা যান। ততদিনে টুথমোসিস তৃতীয় টগবগে তরুণে পরিণত হয়েছেন এবং অনেক বছর নির্বাসনে থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়ে মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করেছেন। 

এর পরের ঘটনাগুলোর সঙ্গে টুথমোসিস তৃতীয়-এর সরাসরি সংযুক্তির পেছনে কোনো প্রমাণ নেই। তবে সৎ-মায়ের মৃত্যুর পরপরই তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসেন এবং মিশরের বুক থেকে তার সৎ-মায়ের সকল ধরনের চিহ্ন মুছে ফেলার এক বিধ্বংসী অভিযান শুরু করেন। প্রতিটি স্মৃতিসৌধ থেকে তার পদমর্যাদার বর্ণনা মুছে দেওয়া হয়। তাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে এরকম যত চিত্রকর্ম টুথমোসিস তৃতীয় খুঁজে পেয়েছিলেন তার সবগুলোই তিনি টুকরো টুকরো করে ফেলেন। তার সকল মূর্তি নিকটবর্তী পাথর ভাঙার খনিতে নিক্ষেপ করা হয়। হাতহেপশুট আমুনের সম্মানে সূর্যাভিমুখী কিছু গম্বুজ নির্মাণ করেছিলেন, যেগুলোকে টুথমোসিস তৃতীয় ‘ঐশ্বরিক রাগ’ নেমে আসার ভয়ে ধ্বংস করেননি। তবে তিনি প্রতিটি গম্বুজের চারপাশে দেওয়াল তুলে দেন যাতে মানুষ সেগুলো দেখতে না পায়। এ ছাড়া তিনি সেনেনমাটের কবরস্থান ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। তার বয়স তখন ৩০ পেরিয়েছে এবং তিনি তার আসল কাজ রাজ্য শাসনের জন্য আর অপেক্ষা করতে চাইছিলেন না। 

ততদিনে টুথমোসিস তৃতীয় কাগজেকলমে ২২ বছর ধরে মিশর শাসন করেছেন। তবে এই দীর্ঘ সময় প্রায় অকেজো অবস্থায় কাটানোর কারণে তার ভেতর বড়ো আকারের উদ্যম জমা হয়েছিল। তিনি সেই উদ্যমকে ছড়িয়ে দেন যুদ্ধযাত্রায়। তার পরবর্তী যুদ্ধযাত্রাগুলো নেপোলিয়নের মতো তীব্র ছিল। তিনি ঠিক সেই কাজগুলোই করেছিলেন যেগুলোকে হাতহে পশুট অবজ্ঞা করেছিলেন। 

টুথমোসিস তৃতীয় একজন ইতিহাস লেখকের নিয়োগ দেন যার দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে তার যুদ্ধযাত্রার বয়ান লেখা। তবে এই বর্ণনা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এর কিছু অংশ অন্যান্য কাগজপত্র ও দলিল থেকে আমরা খুঁজে পেয়েছি যেখানে এই ফারাও রাজার কীর্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। হাটহেপশুট যে বছর মারা যান সেই বছরই টুথমোসিস তৃতীয় কানান আক্রমণ করেন। ইতোমধ্যে কাদেশ-এর রাজা একদল মিত্র জুটিয়ে টুথমোসিস তৃতীয়কে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মেগিদ্দো শহরে এই মিত্রবাহিনীর সঙ্গে টুথমোসিসের দেখা হয়। এই শহরটি একটি পর্বতের মাঝে অবস্থিত ছিল। এই শহরের মাধ্যমে মিশরকে মেসোপটেমিয়া থেকে আলাদা করা যেত। 

খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই যুদ্ধ শেষ হয়। কাদেশের রাজার নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী এত দ্রুত শহরে ফিরে যেতে বাধ্য হয় যে সৈন্যরা তাদের গায়ের কাপড়কে দড়ি বানিয়ে দেওয়াল টপকাতে বাধ্য হয়। মিশরীয়রা প্রাচীরের বাইরে খাটানো তাঁবুগুলোর উপর লুটপাট চালাতে শুরু করে। এই সুযোগে মেগিদ্দোর গেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

তবে এসিরীয়দের মতো মিশরীয়দের কোনো নগরীর প্রাচীরে আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণ অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের কোনো সিজ টাওয়ার বা মই ছিল না। তাদের একমাত্র উপায় ছিল প্রাচীর ঘিরে রেখে শহরবাসীকে খাবারের অভাব বোধ করানো। সাতটি দুর্ভাগ্যজনক মাসের পর কাদেশের রাজা এবং তার মিত্ররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। মিশরীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধজয়ের আনন্দ এবং প্রচুর পরিমাণ ধনসম্পত্তি, বর্ম, ঘোড়ায় টানা গাড়ি, গবাদি পশু, দাসদাসী ও শস্য নিয়ে দেশে ফিরে আসে। 

এই যুদ্ধজয়ের ফলস্বরূপ দেশের সকল প্রান্তে টুথমোসিস তৃতীয়-এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। নিকটবর্তী শহরগুলোর সেমাইট সম্প্রদায়ের যুদ্ধবাজ নেতারা টুথমোসিস তৃতীয়কে বিভিন্ন উপহার পাঠাতে শুরু করেন। তারা দক্ষিণের এই রাগান্বিত যুবক রাজার সঙ্গে শান্তি রক্ষা করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান। 

রাজার বিরোধিতাকারী প্রতিটি শহর আক্রমণ ও লুণ্ঠনের শিকার হলো। এই যুদ্ধগুলো পরবর্তী কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে। সমুদ্রতীরে অবস্থিত শহর জোপ্পা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের বদলে একটি চুক্তি করার চেষ্টা করে। কথিত আছে, জোপ্পার রাজা মিশরের কমান্ডারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি নিয়ে আলাপ করতে চেয়েছিলেন। তিনি মিশরে আসার পর তার সম্মানে একটি ভোজের আয়োজন করা হয়। তবে ভোজের পর তাকে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলা হয় এবং পেছনের কামরায় আটকে রাখা হয়। মিশরীয় কমান্ডার বাইরে এসে তার ঘোড়ার গাড়ির চালককে বলেন, মিশরীয়রা জোপ্পার কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে এবং গাড়িচালক যেন দ্রুত জোপ্পার রানিকে খবর দেন যে তার স্বামী বন্দীসহ শহরে ফিরে আসছেন। খুব শিগগির জোপ্পার সীমানায় বেশ কিছু মিশরীয় বন্দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল এবং তাদের সঙ্গে ছিল মিশরীয় ক্যাম্প থেকে লুট করে আনা মালপত্রভর্তি বড়ো আকারের ঝুড়ি। তবে প্রতিটি ঝুড়ির ভেতর লুকিয়ে ছিলেন একজন অস্ত্রসজ্জিত মিশরীয় যোদ্ধা। যখন জোপ্পার রানি গেইট খুলে দিলেন তখন সেই যোদ্ধারা ঝুড়ি থেকে বের হয়ে এসে খুব অল্প সময়ের মধ্যে শহর দখল করে বাসিন্দাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করলেন। 

তবে আরডাটা শহরকে প্রথাগত উপায়েই দখল ও লুণ্ঠন করা হয়। দেওয়াল ও তোরণ ভেঙে খুব সহজেই মিশরীয় সেনাবাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে। তারা আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করে শহরের ভাঁড়ারে প্রচুর পরিমাণ মদ সংরক্ষিত ছিল। তারা প্রতিদিন মাতাল হতে লাগলেন। এক পর্যায়ে টুথমোসিস তৃতীয় সিদ্ধান্ত নিলেন যে যথেষ্ট পরিমাণ আমোদ হয়েছে, তাই সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন সকল মাঠ ও ফলের গাছ পুড়িয়ে ফেলতে। এরপর তিনি তার সেনাবাহিনীকে বগলদাবা করে পরবর্তী লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। 

টুথমোসিস তৃতীয় প্রায় দুই দশক ধরে উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি কাদেশে পৌঁছে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। তিনি আলেপ্পো দখলের পর কারচেমিশও দখল করে নেন। এই জয়ের মাধ্যমে তিনি এশিয়া মাইনরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান। তার জীবনের শেষ বছরগুলোর সাফল্য তার আগের নির্বাসনে থাকার সময়কে ম্লান করে দেয়। তার আমলে মিশর প্রায় ইউফ্রেটিস পর্যন্ত পৌঁছে যায়। উত্তরের এই সীমানা পর্যন্ত আর কখনোই কোনো মিশরীয় শাসক পৌঁছুতে পারেননি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *